প্রেম থেকে অপ্রেম পর্ব-২৫+২৬

0
290

#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব২৫
#রাউফুন

রাতে মালার ফিরতে দেরি হলো। প্রিহানকে কল করে আসতে বললে সে তাকে বাড়ি নিয়ে আসে। রাতের খাবার খেতে বসেছে তারা দুজনেই।মালা ফোন ঘাটছে আর প্রিহান ওঁকে খাইয়ে দিচ্ছে৷ এটা যেনো নিত্যদিনের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে মালার।

‘মালা খাওয়ার সময় ফোন রেখে দাও। ছোট বাচ্চাদের মতো মুখে খাবার ধরে রেখেছো!’ কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বলে প্রিহান।

‘আপনি এভাবে কেন বলছেন। আমি ফোনে একটা কাজ করছিলাম তো।’

‘হ্যাঁ সেই। কত কাজ আমার মহারাণীর। একদিন তো বরকে খাইয়ে দিতে পারো নাকি? শুধু আদর, যত্ন নিবা! দেওয়ার বেলায় বুড়ো আঙুল দেখাও!’

ফিক করে হেসে ফেললো মালা। এক পর্যায়ে শব্দ করেই হাসলো প্রিহানের গাল ফুলানো দেখে। তাছাড়া প্রিহানের মুখে খাবার লেগে আছে যা দেখে মালা না হেসে পারলো না।

‘এই হেসো না তো এতো রাতে। চারপাশে হাসির প্রতিশব্দ হচ্ছে। আর সেজন্য মনে হচ্ছে কোনো পে’ত্নী হিহিহিহি করে হাসছে।’

‘আপনি কি ইন-ডিরেক্টলি আমাকে পে’ত্নি বললেন?’ মেকি অভিমানে নাকের ডগা ফুলে উঠলো মালার।

‘ইনডিরেক্টলি না ডিরেক্টলি বললাম!’ মালাকে রাগাতে বলে প্রিহান ঠোঁট চেপে হাসছে।

‘যান খাবোই না। আমি তো পে’ত্নী তাই না। পে’ত্নির তো খাওয়ার প্রয়োজন পরবে না।’

‘ওঁ তো ঠিকই বলেছে। রাত বিরেতে এমন হাহা-হোহো করে হাসছো কোন সেন্সে? মিনিমাম সেন্স নেই যে এতো রাতে তোমার হাসাহাসি তে মানুষের ঘুমের অসুবিধা হতে পারে।’

‘আরে জাকিয়া আপু। আমি যদি জানতাম আপনার আমার হাসায় ঘুম ভেঙে যায় তবে আমি এভাবে হাসতাম না! আরও জোরে জোরে হাসতাম। আমি তো চাই না আপনার ঘুম হোক।’

‘ইউ ব্লাডি–!’

‘আহ, জাকিয়া কি হচ্ছে টা কি। তোর জন্য কি মানুষ হাসা ছেড়ে দেবে? আমার বউ যখন খুশি হাসবে, যত খুশি হাসবে তাতে তোর কি রে?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ লাই দাও বউকে। এটাই তো কর‍তে পারো!’

‘বউকে লাই দেবো না তো কি তোকে লাই দিয়ে মাথায় তুলবো।’

‘যায় হোক মালা, প্লিজ এক গ্লাস গরম পানি দিও তো। গলা খুশখুশ করছে তাই খাবো!’

‘আমার বউ কেন তোর জন্য গরম পানি করতে যাবে? তুই নিজে করে নে না। কিছুই তো করিস না। শুধু বসে বসে খাস!’

‘প্রিহান তুমি এভাবে আমাকে বলতে পারলে?’

‘প্রিহান না ভাইয়া বল!’

‘ঠিক আছে। আর বলতে হবে না। এসেছি তো কটা দিনের জন্য এতেই তোমাদের কাছে বোঝা হয়ে গেছি।’

গজগজ করতে করতে পানি গরম দিলো জাকিয়া। পানি গরম হওয়া শেষ হতে জাকিয়া স্টিলের গ্লাসে ভরে আনছিলো। ক্ষুব্ধ হয়ে ইচ্ছে করেই গ্লাসের গরম পানি ছুড়ে মালার দিকে। যাতে গরম পানি সব মালার গায়ে আসে। কিন্তু প্রিহানের সে সময় মালাকে খাওয়ানো শেষ হয়েছে। তাই সে বেসিনে যাচ্ছিলো প্লেট টা রাখতে। তখনই সমস্ত গরম পানি মালার গায়ে না গিয়ে প্রিহানের চোখ, মুখ, গলায় লাগে। সে ‘আহ!’ বলে চিৎকার করে উঠতেই মালা দৌঁড়ে যায় প্রিহানের কাছে।

‘কি হলো প্রিয়? এভাবে পানি পরলো কিভাবে?’

‘আ’ম স্যরি প্রিহান। আমি বুঝতে পারিনি যে আমার হাত থেকে গ্লাস টা পরে যাবে। আসলে গ্লাস টা গরম ছিলো তো তাই হাত ফসকে পরে গেছে। আমাকে ক্ষমা করে দাও।’

মালা কটমট করে তাকালো জাকিয়ার দিকে।বুঝতে পারছে না যে জাকিয়া কাজ টা ইচ্ছে করেছে নাকি না। সে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রিহানকে ধরে রুমে নিয়ে গেলো। যেখানে যেখানে গরম পানি লেগেছে সে স্থানেই লাল হয়ে গেছে। মালার ভীষণ কাঁন্না পাচ্ছে। ড্রয়ার থেকে অয়েন্টমেন্ট এনে লাগিয়ে দিচ্ছে। মালার টপটপ করে চোখের পানি পরছে। আর প্রিহান মালাকে কাঁদতে দেখে হাসছে।

‘আরে কাঁদছো কেন? গরম পানি টা আমার গায়ে না লাগলে এটা এতক্ষণে তোমার লাগতো। ভাগ্যিস আমি দেখেছিলাম পানিটা ছুড়তে। তাই তো সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরি।’

‘মানে?’ কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করলো মালা।

‘মানেটা হলো জাকিয়া ক্রোধের বসে তোমার দিকে ইচ্ছে করেই পানিটা ছুড়েঁছিলো। আমি দেখেছি।’

‘আমি ওই ডাইনিকে ছাড়বো না। কতটা কষ্ট হচ্ছে আপনার। যদি ফোসকা উঠে তখন। অনেক জ্বলছে তাই না প্রিয়!’ প্রিহানের লাল হয়ে যাওয়া স্থানে মলম লাগাতে লাগাতে হুহু করে কেঁদে উঠে মালা। প্রিহান তখনও হাসছে মালার কাঁন্না দেখে। মালা এবারে সেটা লক্ষ্য করে বলে,

‘আপনি হাসছেন? কত গুলো জায়গায় লাল হয়েছে দেখেছেন? আপনার কষ্টের মধ্যেও কি করে হাসি পাচ্ছে বুঝতে পারছি না আমি।’

‘গরম পানি আমার গায়ে না পরলে বুঝতেই পারতাম না আমার বউ আমাকে এতোটা ভালোবাসে। আজকে আমার খুব খুশির দিন মাই ড্রাগনফ্লাই’স। তুমি আমার এই সামান্য ক্ষ’ত দেখে এমন উতলা হচ্ছো বলেই হাসছি খুশিতে!’

বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে মালার চোখের পানি মুছে দিলো প্রিহান। ডাগর ডাগর আঁখি যুগল ছলছল করছে মালার। সে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো প্রিহানের দিকে। মলম লাগানো শেষ হতেই নাক টেনে উঠে দাঁড়ালো মালা। সে ড্রয়ারে মলম রাখতে রাখতে বললো,

‘আপনি শুয়ে পরুন প্রিয় আমি আসছি একটু।’

‘ঠিক আছে জলদি আসো। বউ ছাড়া এখন আর ভালো লাগে না আমার। উফফ কি যে জাদু করলে আমাকে।’

‘এই সময়েও আপনি হেয়ালিপনা ছাড়বেন না তাই না?’

বলেই বেরিয়ে গেলো। প্রিহান আরেকদফা হাসলো মালার যাওয়ার পানে তাকিয়ে।

মালা হাতে মোটা গ্লাভস পরলো৷ সে ফুটন্ত গরম পানি গ্লাসে ঢেলে জাকিয়ার রুমের দিকে পা বাড়ালো। দরজার কাছে যেতেই নক করলো মালা।

‘কে?’

‘আমি জাকিয়া আপু। আপনি না বললেন গরম পানি লাগবে আপনার। তাই নিয়ে এলাম।’

জাকিয়া গিয়ে দরজা খুলে দিলো। ভেতরে এসে মালা গরম পানিটা রাখলো। জাকিয়া গ্লাস ধরতেই ‘আউচ!’ বলে গ্লাস টা ফেলে দিলো। ছিচকে উঠে গরম পানি।

‘আহ ছ্যাঁ’কা’ লাগলো আপু?’

‘গরম পানি চেয়েছিলাম এতোটা ফুটন্ত গরম পানি চাইনি!’ হাতে ফু দিতে দিতে বলে জাকিয়া।

‘আপনি জানেন ও না কাকে কষ্ট দিয়েছেন আপনি। আমি কাটা দিয়ে, কাটা তুলতে জানি। আপনি যদি আগুন হোন তবে আমি আগ্নেয়গিরির লাভা! আপনি আমার চেয়ে বড় হলেও বুদ্ধিতে কিন্তু আমার সমকক্ষ নোন। আমার সাথে লাগতে আসলেই ঝলসে যাবেন বলে দিলাম!’

মালা ভ্রু-কুচকে হাত দুটো বুকের কাছে ভাজ করে , শান্ত ভাবে বললো। তার এক্সপ্রেশন এতোটাই কোল্ড যে ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাকে একদিকে স্ট্রিক্ট মনে হচ্ছিলো আরেক দিকে মনে হচ্ছিলো কোনো রহস্যের বেড়া জাল তার চারপাশে ঘিরে রয়েছে।
জাকিয়া মালার দিকে তীব্র ভাবে তাকাচ্ছে। যেনো সে বিষয় টাকে শেষ হতে দেবে না। সে মুচকি হেসে মালাকে ডেকে উঠে,

‘তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। তোমার প্রিহানের প্রতি ভালোবাসা, কেয়ার সবটাই নজরকাড়া।আমিও তো প্রিহানকে ভালোবাসি তাই আমি বুঝতে পারছি তোমার কষ্ট। আচ্ছা এসব ছাড়ো তো। দেখো তো আমার হীরের ক্লিপগুলো চুলে এভাবে গেঁথে গেছে খুলতেই পারছি না। একটু খুলে দাও না।’

এই কথায় মালা ফিরে যেতে গিয়েও থামলো। হঠাৎ জাকিয়ার এমন ভালো ব্যবহারের মানে ধরতে পারলো না সে। ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে চুল থেকে ক্লিপ গুলো খুলে দিলো মালা। জাকিয়ার হাতে দিতে চাইলে সে বললো সামনের ড্রেসিন টেবিলের উপরে রাখতে। মালা তাই করলো এবং রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। জাকিয়া ঠোঁট এলিয়ে হেসে রুমাল দিয়ে হীরের ক্লিপ গুলো তুলে নিলো। পরক্ষণেই হেসে উঠলো উচ্চ শব্দে। কি বিভৎশ সে হাসি।

সকাল বেলা মালার ঘুম ভেঙে গেলো ফোনের রিংটোনে। সে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো তার মায়ের ফোন থেকে কল এসেছে। সে ঘুম ঘুম চোখে ফোন টা রিসিভ করে কানে ধরলো। সে জানে তার মা তাকে ফোন করবে না। এটা পুতুল কল করেছে।

‘হ্যালো আপু?’

‘হ্যাঁ বলো পুতুল। কিছু কি হয়েছে এতো সকালে ফোন করেছো যে? বাড়িতে সব ঠিক আছে তো?

‘হ্যাঁ আপু ঠিক আছে সব কিছু। শুধু একটা কথা বলতে চাইছিলাম।’

‘কি কথা? মনে হচ্ছে সিরিয়াস কোনো কথা বলতে চাইছো। কি হয়েছে বলো তো।’

‘আসলে আমি আর চাইছি না প্রশান্ত স্যার আমাকে পড়াক। তুমি প্লিজ উনাকে পড়াতে আসতে বারণ করে দিও।’

‘হঠাৎ কি হয়েছে পুতুল যে তুমি তার কাছে আর পড়তে চাইছো না? সে কি ভালো পড়াচ্ছে না? কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়!’

‘নাহ আপু সেরকম কিছু নয়। আমার স্কুল থেকে অন্য একজন টিচার ঠিক করা হয়েছে। আমি তার কাছেই পড়বো। তুমি প্রশান্ত স্যার কে মানা করে দিও আসতে।’

‘আহা প্রশান্তও পড়াক না। তাতে ক্ষতি কি!’

‘আমি বলছি না উনার কাছে পড়বো না? ব্যাস পড়বো না। তুমি বারণ করে দিও না হলে আমিই বারণ করবো৷’

চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পরলো মালা। হঠাৎ মেয়েটার কি হয়েছে এমন ব্যবহার তো করে না। কিছু কি হলো নাকি মেয়েটার? এরুপ আচরণের মানে কি? সে শান্ত ভাবে বললো,

‘ঠিক আছে পুতুল আমি ওঁকে বারণ করে দেবো যেতে।’

‘আ’ম স্যরি আপু। আমি ওভাবে বলতে চাইনি!’

‘ইটস ফাইন পাখি। রাখছি এখন আমি। আমার একটু কাজ আছে পুতুল।’

‘আচ্ছা আপু।’

ফোন রাখতেই পুতুল মুখ চেপে কেঁদে উঠে।সে কি করবে? প্রশান্তকে যত দেখবে ততই সে দুর্বল হয়ে পরবে। সে কোনো পুরুষের সংস্পর্শে নিজেকে নিয়ে যাবে না। সে না হয় প্রশান্তকে দূর থেকেই ভালোবাসবে।

সকালে জাকিয়া ঘুম থেকে উঠেই চেচামেচি শুরু করলো, এটা বলে যে তার হীরের ক্লিপ জোড়া হারিয়ে গেছে। কোথাও পাচ্ছে না।

#চলবে

#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব২৬
#রাউফুন

‘মালা তুমিই তো শেষ বার আমার রুম থেকে বেরিয়েছিলে? তার মানে কি আমি ধরে নেবো হীরের ক্লিপ গুলো তুমিই সরিয়েছো?’

‘শাট-আপ জাকিয়া! তুই জানিস কার সম্বন্ধে কি বলছিস? মুখে লাগাম টান। না হলে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবি। আর তোর যে হীরের ক্লিপ আছে এটা তো বোধহয় মালা জানেও না।’

‘প্রিহান তুমি কি জানো? কাল মালা আমার রুমে গরম পানি নিয়ে এসেছিলো? তখনই আমি ওঁকে ক্লিপ জোড়া খুলে দিতে বলি। আর ও খুলেও দেই। তখনই হইতো ও লোভ সামলাতে পারেনি হীরের ক্লিপ গুলো দেখে। হতে পারে তখনই হাত সাফাই করেছে। ও যে ধরনের চিপ ফ্যামিলি থেকে উঠে আসা মেয়ে ওর দ্বারাই এটা হবে!’

মালার অপমানে সারা শরীর রিরি করে উঠলো। চুরির মতো একটা নিম্ন মানের কাজ সে করবে? আল্লাহ এটা তাকে কি রকম বিপদের সম্মুখীন হতে হলো? মাথা ঝিমিয়ে আসছে তার। দু চোখ ঘোলা হলো। রাগে রগরগ করছে মাথাটা। এইভাবে ওঁকে ফাসাচ্ছে জাকিয়া। কাল রাতের ওই ব্যবহার টা তবে নিছকই নাটক। আজকে সকালের এই সীন ক্রিয়েট করবে বলেই এটা করছে? সবার বিস্ফোরক প্রতিক্রিয়া। জাকিয়ার দিকে সকলের তীর্যক দৃষ্টি! হতচেতন, অবচেতন মনে সন্দেহের বীজ বপন হচ্ছে কি মালার জন্য? মালা সবার দিকে করুন চোখে তাকালো। কুলসুম আর খোদেজা মালার পাশে গিয়ে দাড়ালেন৷ তারা আশ্বাস দিলেন যে তারা কেউই তাকে অবিশ্বাস করছেন না। প্রিহানের কোর্টে হেয়ারিং টাইমিং এর আর বেশি সময় নেই। পয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছাতে হবে তাকে। আর এদিকে এখানে মালাকে একিউজ করছে এই জাকিয়া।

‘বিশ্বাস করুন প্রিহান আমি জাকিয়া আপুর ক্লিপ জোড়া নিই নি। আমি কেন নিতে যাবো ক্লিপ? আমার তো আর জাকিয়া আপুর মতো ছোট ছোট চুল না যে আমার ক্লিপ লাগবে? আমি ওসব ক্লিপ ইউস করি না আপনি তো জানেন।’

‘আহাহ! ইউস করো না জন্য যে নিতে পারো না সেটা কে বললো? তুমি হইতো ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছিলে ওগুলো হীরের ক্লিপ। ভেরি এক্সপেন্সিভ ক্লিপ। আর সেগুলো বিক্রি করলে তুমি মোটা অংকের টাকা পাবে!’

‘মুখ সামলে কথা বলো জাকিয়া। এটা আবার কোন ড্রামা শুরু করলে? তুমি ভালো ভাবে খুঁজে দেখো ঘরেই আছে।’ বললেন শোহিনী।

‘উফফ মম, আমি খুঁজেছি তন্নতন্ন করে। কোথাও পাইনি! ইউ নো না মম ওটা আমার জন্মদিনে পাপার দেওয়া স্পেশাল গিফট!’

‘তোমার ওটা সামলে রাখা উচিত ছিলো। এখন হারিয়ে গেছে বলে তুমি শুধু মালার উপর এভাবে আঙুল তুলতে পারো না।’

‘জাকিয়া থু থু উপরের দিকে ছুড়লে কিন্তু সেটা নিজের শরীরেই পরে। এই ধরনের লেইম শিক্ষা তোমাকে দিয়েছে তোমার বাবা মা? তোমার এই ধরনের ব্যবহার থেকে ঔশী কি শিক্ষা পাবে? ভাগ্যিস বাচ্চাটি ঘুম থেকে উঠেনি।’ বললেন রহমান সাহেব।

‘শোহিনী তোমার কেমন শিক্ষা দেওয়া হয়েছে তোমার মেয়েকে সেটা তো আমরা স্বচক্ষে দেখতেই পারছি। আমাদের বাড়ির বউকে একিউজ করছে। মিথ্যা এলিগেশন দিচ্ছে আমার পুত্র বধুর উপর।’

নিজের বাবা আর বড় ভাই ফারুক এর কথা শুনে শোহিনী মাথা নত করলেন। তিনি জানেন তার মেয়ে একটা নাটক করছে যাতে প্রিহান আজ কোর্টে পৌঁছতে না পারে সঠিক সময়ে।

‘দেখুন মামা, আমি ময়নার, ঔশীর, সবার রুম সার্চ করেছি কিন্তু কোথাও পাইনি ক্লিপ।এবার শুধু মালার রুম টা সার্চ করবো।’

‘ঠিক আছে জাকিয়া আপু তাতে যদি আপনার শান্তি হয় তবে গিয়ে সার্চ করুন।’ ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো মালা।

এটাই যেনো চাইছিলো জাকিয়া। কাল রাতেই সে একটা পরিকল্পনা করেছিলো। আর সেটা বাস্তবায়ন করতে সে তো নিজেই গিয়ে রেখে এসেছে ক্লিপ জোড়া। যখন মালা রান্না ঘরে কাজ করছিলো তখন। আর সে-সময় প্রিহান ওয়াশরুমে ছিলো। ঘরে কেউ না থাকার সুযোগ টা সে লুফে নিয়েছে এবং ড্রামা শুরু করেছে সকাল সকাল। সে মালার সাইড ব্যাগ টা বাইরে এনে সেখান থেকে হীরের ক্লিপ জোড়া বের করলো। এটা দেখে সবার চক্ষু চড়কগাছ। সবার যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না কিছুতেই যে ক্লিপ জোড়া মালার ব্যাগে পাওয়া গেছে।

‘এই দেখো আমি কি এমনি বলেছি? তাহলে আমার ক্লিপ জোড়া মালার ব্যাগে কেন? প্রিহান এবার কি বলবে তুমি?’

‘মালা তোমার ব্যাগে ক্লিপ জোড়া গেলো কি করে? তার মানে কি তুমি সত্যিই–!’ প্রিহান অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো মালার দিকে।

‘আমাকে বিশ্বাস করুন আমি জানি না ওগুলো আমার ব্যাগে কি করে গেলো? কেউ হইতো ইচ্ছে করে করেছে এসব।’

‘তাই নাকি? আমি এক্ষুনি প্রমাণ করছি দাঁড়াও। কই আপনারা ভেতরে আসুন!’

দুজন লোক কিছু সরঞ্জাম নিয়ে ভেতরে এলো।

‘উনারা এখানে? তুই এমন ভাবে সব কিছু রেডি কিরে রেখেছিস যেনো তুই জানতিস তোর হীরের ক্লিপ হারাবে।’ সন্দেহের দানা প্রিহানের মনে। এমন ভাবে সব কিছু রেডি করে রেখেছে জাকিয়া যেনো সে আগে থেকেই জানতো এমন কিছু হবে।

‘ন-না আমি জানবো কিভাবে? আমার ক্লিপ জোড়া হারানোর পরই আমি উনাদেরকে কল করে ডাকি। যাতে তোমরা বিশ্বাস না করলে সবার হাতের ছাপ মিলিয়ে দেখতে পারি যে কে নিয়েছে। সবার হাতের ছাপ দেওয়া হোক তবে? যদি তোমার হাতের ছাপ না পাওয়া যায় তবে তুমি নির্দোষ মালা। এই যে উনারাই করবেন পরীক্ষা।’

মালার হঠাৎ করেই মনে হলো কালকে রাতে ক্লিপ খোলার সময় তার হাতে গ্লাভস ছিলো। এছাড়া তো মালা ক্লিপ জোড়া ছুঁয়েই দেখেনি। তাই প্রশ্নই আসে না তার আঙুলের ছাপ আসা। মালাই সবার প্রথমে আঙুলের ছাপ দিলো। তার আঙুলের ছাপ ম্যাচ করলো না। একে একে ময়না, সহ খোদেজা, কুলসুম, শোহিনী, ফারুক, প্রিহান, এমন কি দাদু ও বাদ গেলেন না আঙুলের ছাপ দেওয়া। কারোর আঙুলের ছাপ ম্যাচ হয়নি। অপমানে থমথমে অবস্থা শোহিনীর। বাপের বাড়িতে তার এখন মুখ তুলে তাকানোর সাহস নেই। সেই মুখটা আর থাকলো না। এছাড়া একমাত্র জাকিয়ার আঙুলের ছাপ ই রয়েছে ক্লিপ জোড়ায়। ফরেন্সিক লোকেরা চলে গেলেন তাদের কাজ শেষ হতে।

শোহিনী রাগে থরথর করে কাঁপছেন। ঠা’টিয়ে চ ড় বসিয়ে দিলেন মেয়েকে। এই মেয়ের জন্য বাবা মা – ভাই-ভাবির কাছে তার মুখ থাকলো না। এখানে শুধু শুধু নাটক করছিলো মেয়েটা। রক্ত কথা বলে এই মেয়ের বাবার রক্তই তো খারাপ। অপবিত্র রক্ত। তার জীবন টা যে অজান্তেই সে নিজেই অপাত্রে প্রতিস্থাপন করেছে এটা সে কি করে কাউকে বুঝাবে? জাকিয়ার বাবাকে তো শোহিনী নিজেই পছন্দ করেছিলো অধিক ধনসম্পদ দেখে। এই কারণে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে বাবা মাকে বলতে পারতো না। কারণ বাবা মা ভাই সবাই তাকে বারণ করেছিলো জাকিয়ার বাবা হাকিম কে বিয়ে করতে। সে শুনেনি। পরবর্তীতে সে কিভাবে, কোন মুখ নিয়ে এ বাড়িতে নিত্য নতুন ঝামেলা তুলে ধরতো? ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলেন শোহিনী! বাবার স্বভাবের এক ছিটেফোঁটাও এই মেয়ে ছাড়েনি। পুরো দমে বাবার মতো হয়েছে।

‘তোর যদি এই ড্রামাটা শেষ হয়ে থাকে আমি চলে যাচ্ছি। দাদু, দাদি আমি আসছি। এই ড্রামা সহ্য হচ্ছে না। আমার তাড়া না থাকলে তোমাদের নাতনীকে কি যে করতাম তা ওর ধারণা ও নেই। আর কেউ যেনো আমার বউকে একটাও বাজে কথা না বলে। আর হ্যাঁ আমার বউকে যে বাজে কথা, মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে তাকে যেনো এই বাড়িতে না দেখি কোর্ট থেকে এসে। তল্পিতল্পা নিয়ে যেনো এই বাড়ি থেকে আজীবনের মতো বেরিয়ে যায়। এসে যদি দেখি, এই আমি প্রিহান নিজের সবচেয়ে বাজে দিকটা তাকে দেখাবো।আর মালা প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিও প্লিজ! আমার তোমাকে সন্দেহ হয়েছিলো একটুর জন্য।আসলে তোমার ব্যাগ থেকে ক্লিপ বের হয়েছে তাই। এগেইন স্যরি মালা।’

বলেই প্রিহান বেরিয়ে গেলো। গজগজ করতে করতে জাকিয়া ভেতরে গেলো। ড্রামা টা করেও এক চুল পরিমাণ সফল হতে না পেরে হাত মুঠো করে নিলো। সে তো মালার আঙুলের ছাপ যাতে পাওয়া যায় সেজন্যই কাল রাতে নাটক করে ক্লিপ জোড়া ওঁকে দিয়েই খুলে নিলো তবে? এই মেয়েটা অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। নিশ্চিত ওই কিছু একটা করেছে।

প্রিহান কোর্ট থেকে ফিরলো দুপুরের পর। আজকের হেয়ারিং এরপর সে আশাহত। মনে হচ্ছে হার নিশ্চিত। পরের শোনানি তে রায় দেওয়া হবে এই মামলার। কি জানি কি হবে। সেই কালো লোকটাকে আটক করা হলেও তার মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে পারেনি পুলিশ। এদিকে মালা আজকে প্রিহান আসার পর তার সামনে আসেনি। সে রুমে আসার আগে দেখেছে ময়না, আর তার মায়ের সঙ্গে কাজ করছে রান্না ঘরে। সে ভেবেছিলো তাকে দেখে অন্তত আসবে মালা। কিন্তু সে-গুড়ে বালি। মালা এলো না। খাওয়ার সময় ও তার দেখা মিললো না৷ এমন কি রাত বারোটা বেজে যাচ্ছে মালা রুমে যায়নি। প্রিহান কয়েকবার এসে তাকে ডেকে গেছে। তাতে কোনো হেলদোল নেই মালার। প্রিহান রাগে গজরে গজরে বাইরে আসে দপদপিয়ে।

এদিকে মালা জোর করে ময়নাকে ঘুমাতে দেইনি। তার সঙ্গে জোর করে বসিয়ে গল্প করছে টিভি ছেড়ে।ময়না ঘুমে ঢুলছে। কিন্তু মালা তাকে ধাক্কা ধাক্কি করেই জাগিয়ে রেখেছে। সে কিছুতেই আজ রুমে যাবে না। অন্যের কথায় তাকে কি করে ভুল বুঝলো প্রিহান?এর একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে সে।

প্রিহান সইতে না পেরে ময়নার সামনেই জোর করে মালাকে কোলে নিয়ে ঘরে এলো।মালা ছটফট করলো কোল থেকে নামার জন্য।কিন্তু জোরে করে ধরে থাকার দরুন এক চুল ও টলাতে পারেনি প্রিহান কে।

#চলবে