প্রেম থেকে অপ্রেম পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

0
857

#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব৪০ (অন্তিম পর্ব)
#রাউফুন

জীবনে কিছু কিছু ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি বহন করার সক্ষমতা সবার থাকে না! রাগ,অভিমান, আবেগ- অনুভূতি, ঝগড়া-খুনসুটি এই সব কিছুই ভালোবাসার অংশ অতিলোভ এবং অতিক্ষোভে যখন একটি সম্পর্কের অবসান হয় সেই অবসান হওয়ার কষ্ট যেন এক বিশাল আকৃতির পাহাড় বুকে চাপিয়ে দেওয়ার মত, কেউ চুপ থাকে নিজের আত্মসম্মান রক্ষার্থে আবার কেউ প্রকাশ করে নিজের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে।

তবে পৃথিবী চলবে তার নিজস্ব নিয়মে। কোন কিছুই থেমে থাকবে না, তারপরেও বলি কিছু সময়ের জন্য আবেগ ধাঁমাচাপা দিয়ে নিজের পথ চলতে হবে।বেঁচে থাকতে হবে নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য। প্রিহান ওঁ বেঁচে আছে। তার পরিবারের জন্য, তার ফুলের জন্য! মালার হঠাৎ তাকে ছেড়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনি, দগ্ধ হয় প্রতিটি মুহুর্তে। কিন্তু সে তো কাঁদবে না। সে যে কথা দিয়েছে মালাকে, তার ড্রাগনফ্লাই’সকে। এখনো ঔশী জানে না মালা তার মাম্মাম ছিলো। প্রিহান কথা রেখেছে। সে জানাইনি ঔশীকে যে মালা তার মাম্মাম।

‘ফুল উঠো। অনেক বেলা হলো৷ স্কুলে যাবে কখন?’

‘উফফ পাপাই যাচ্ছি না আজকে আমি স্কুলে।’

‘কেন কি হয়েছে আমার ফুলের? দেখি দেখি শরীর খারাপ নাকি?’

‘নাহ পাপাই, পেটে খুব ব্যথা।’

প্রিহান ভালো করে দেখলো ঔশীর মুখ। কেমন পাংশুটে হয়ে গেছে মেয়েটার মুখ। সে বিচলিত হয়ে গেলো মেয়ের এমন চেহেরা দেখে। স্পষ্ট ব্যথিত ফেস। তার যে সহ্য হয় না এই মেয়েটার ব্যথিত মুখ। সে অনুচিন্তন গলায় শুধাই, ‘হঠাৎ পেট ব্যথা কেন মা? কি হয়েছে বলো আমায়। আমি ঔষধ আনবো এক্ষুনি। না হলে তুমি চলো ডক্টর এর কাছে নিয়ে যাচ্ছি আমি।’

‘পাপাই আ’ম ইন ফরটিন! ভুলে গেছো তারিখটা?’ ঔশী কোম্বল দিয়ে মাথা ঢেকে ফেলে। ব্যথায় অচেতন, অবশ হয়ে আসছে শরীর। এটা নিয়ে দ্বিতীয় বার ঋতুচক্র তার। ব্যথা কিভাবে সহ্য করবে? ততক্ষণে প্রিহানের টনক নড়লো। সে জলদি গিয়ে হট ওয়াটার ব্যাগ নিয়ে এলো। মেয়েকে জোর করে উঠিয়ে ব্যথার ওষুধ খাইয়ে দিলে সে আবার সটান শুয়ে পরলো। চোখ টলটলে হলেও জল গড়িয়ে পরতে দিলো না প্রিহান। ঔশী অল্প বিস্তর চোখ বের করলে সেটা লক্ষ্য করে বলে,

‘পাপাই এটা ন্যাচারাল। কাঁদার কিছু নেই। আমি তো মরে যাচ্ছি না।’

বুক কেঁপে উঠে প্রিহানের। মেয়েকে দু’হাতে বুকে চেপে ধরে বললো, ‘হুশ এসব বলবে না কখনোই। আমি আর আমার প্রিয় কোনো জিনিস স্বচক্ষে শেষ হয়ে যেতে দেখতে পারবো না। সেই ক্ষমতা আমার নেই। আমি আসলে তোমার বেস্ট পাপা হতে পারলাম না। কেমন পাপাই আমি তোমার যে তোমার ভালো মন্দ খেয়াল রাখি না। আমি পাপা হিসেবে অসফল!’

‘ উঁহু তুমি ওয়ার্ল্ডের বেস্ট পাপা।সব সময় তুমি আমাকে ইমোশনালফুল করে দাও! খালা মনি কবে ফিরবে লান্ডন থেকে? এবারে কিন্তু ওঁর বিয়েটা দিতেই হবে।’

না চাইতেও হেসে ফেলে প্রিহান। মেয়ের কপালে চুম্বন একে বলে, ‘ কাল পরশু চলে আসবে। তবে একটা কথা কিন্তু তুমি ঠিক বলেছো। তোমার খালামনির এবারে বিয়ে দেওয়া উচিত। না হলে তো পাত্র টা বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। রাগ দেখিয়ে না আবার পাত্রীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেই।’

তার কথায় ঔশী হিহিহিহি করে হেসে উঠলো। আর প্রিহান দু-চোখ ভরে নিজের মেয়ের হাসি মাখা মুখ দেখলো। মালার ফেস ফিচারটি যেনো কে’টে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে মেয়েটির মুখে। নাকি সে নিজে নিজেই ঔশীর মুখে মালাকে খুঁজে পাই? চাইলেই কি তাকে প্রেম থেকে অপ্রেম করা যায়? সেই সুন্দর মুহুর্ত, প্রথম দেখা হওয়া, প্রথম স্পর্শ, প্রথম আদুরে ডাক, প্রথম আদুরে আলাপের কথা কি ভুলা যায়? সে যে তার প্রেম! তার আজীবনের প্রেম হয়েই থাকবে তার ড্রাগনফ্লাই’স! শুধুই প্রেম! অপ্রেম করা হবে না যে আর তাকে ইহ জীবনে।

মালা যে ফুল বলতে সেদিন ঔশীকে বুঝিয়েছিলো, ঔশীই যে তার মেয়ে এটাই সে বুঝাতে চেয়েছিলো। সেদিন সে মালার বাক্য বুঝার মতো অবস্থায় ছিলো না। কথাটা ভেবে হতাশাজনক নিঃশ্বাস ফেললো সে। শূন্য অনুভব হলো অন্তঃকরণে। শেবার দলবলসহ সবাই সেদিন এরেস্ট হয়েছিলো। রুমিকে মালার হ’ত্যা’র অভিযোগে সে নিজেই কোর্টে ফা’সির আ’বেদন করেছিলো। বাকিদের যাবৎ জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। আট বছর অতিবাহিত হলেও প্রিহানের মন-মস্তিষ্ক তো সেই দুর্বিষহ দিন ভুলতে পারেনি।

প্রিহান বাইরে বেরিয়ে এলো। মাঝহারুল হাওলাদার আর ফারুক হাওলাদার দুই ভাই মিলে গল্প করছেন। খোদেজা চা, কফি করে দিয়েছেন তাদের। প্রিহান নিচে নেমে এসে তাদের পাশে বসে। দুজনেই আড় চোখে প্রিহানকে অবলোকন করলেন। প্রিহানের দাদি গত হয় মালার মৃত্যুর এক বছর পরেই। দাদির মৃত্যুর এক বছর পর আবার দাদার মৃত্যু হলো। এখন বাবা, মা, মালার মা বাবা, ভাই গহীন, সবার দায়িত্ব এখন প্রিহানের উপর!

লিলির মৃত্যুর পর খুবই নিঃস্ব হয়ে পরেন মাঝহারুল। প্রিহানের অবস্থা কিছু টা হলেও উপলব্ধি করতে পারেন স্ত্রী লিলির মৃত্যুর পর। তিনিই নিজে দায়িত্ব নিয়ে পুতুলকে উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডনে পাঠিয়ে দেন। এই তো পড়াশোনা শেষ করেই ফিরে আসছে। মাঝহারুল হাওলাদার এর সবকিছুই এখন সবার জানা।

‘পুতুল আজ ব্যাক করছে। কোনো স্পেশাল টিকিট পেয়েছে সে। তুমি তাকে আনতে এয়ারপোর্টে যাবে?’

‘না চাচা আমি যাচ্ছি না। আপনি, আব্বু-আম্মু যান না।’

‘মালার মৃত্যুর পর তো কোথাও যাচ্ছো না। এরপর উকালতিও ছেড়ে দিয়েছো। কতগুলো বছর হয়ে গেলো এবার একটু নিজেকে নিয়ে ভাবা উচিত তোমার।’

‘নাহ বাবা এসব আর আমার জন্য না। আমি আপনার ব্যবসায় সামলাবো।’

‘শুনলাম শাহনাজের জেল থেকে জামিন হয়েছে। ওঁ নাকি ঔশীর সঙ্গে দেখা করতে চাইছে!’

‘খবরদার আব্বু ওই লোকটার কথা আমাকে বলবেন না। আমার মেয়ের কাছে ঘেঁষতেই দেবো না আমি ওঁকে। যদি সত্যিই ঔশীকে নিজের মেয়ে ভাবতো তবে বার বার কিডন্যাপ করতে চাইতো না। ওঁ ওঁর সাজা পেয়ে গেছে। কিন্তু আমার মেয়ের উপর ওঁর কালো ছায়া পরতে দেবো না কখনোই।’

বলেই গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেলো প্রিহান। ছেলেকে এতো বছরেও বুঝাতে পারেন নি। কেমন বেপরোয়া হয়ে গেছে। মেপে মেপে কথা বলে ছেলেটা। আরও বেশি গম্ভীর থাকে। কিন্তু মেয়ের কাছে? মেয়ের কাছে সব সময় আলাদা। খোদেজা ছেলেকে আড়াল থেকে দেখে চোখের পানি ফেলেন। কিছুতেই অন্যত্র বিয়ের জন্য রাজি করাতে সক্ষম হয়নি তিনি। একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো হয়ে গেছেন তার ছেলেটা।

হলুদ রঙের একটা লং থ্রি-পিস পরেছে
পুতুল। লম্বা চুল গুলো পনিটেইল করে বাঁধা। চোখে কালো চশমা। রঞ্জকবিহীন শুষ্ক ঠোঁট, এক হাতে লাগেজ, অন্য হাতে একটা স্বর্নের ব্রেসলেট। যেটা তাকে দেওয়া প্রশান্তর প্রথম উপহার ছিলো । এটা সে কখনোই হাত থেকে খুলেনি, এক মুহুর্তের জন্যও না। এয়ার্পোট নেমেই কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিকে খুঁজলো সে। কিন্তু পেলো না। মাঝহারুল আংকেল, আর ভাই গহীনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো পুতুল। তারা কাছে এগিয়ে আসলেন পুতুলের দিকে । দুইজনের সঙ্গেই সুন্দর ভাবে কথা বলে গাড়িতে বসে পরলো পুতুল। মাঝহারুল জিজ্ঞেস করলেন,

‘কি ব্যাপার মুখটা শুকনো কেন মামনি?’

‘কিছু না আংকেল। আর কেউ-ই আসলো না এটাই ভাবছি। আপনিই আসলেন শুধু। আমি এতো বছর পর ফিরলাম অথচ কারোর খোঁজ নেই।’

‘পুতুল আমাকে কি চোখে দেখো না তুমি?’

‘আপু বলো গহীন। আমি তোমার বড় ভুলে যেও না।’

‘উম মানি না। এখন আমিও অনেক বড়। অনার্স পড়ছি।’

‘আহা দুজনে ঝগড়াঝাটি করো না তো। তোমার বাবার শরীর খুবই খারাপ তাই তোমার মা আসতে পারেন নি। আর প্রিহানকে তো জানোই সেও আসবে না। আমি আর গহীন ছাড়া কেউ-ই ফ্রী নেই মা।’

‘প্রিহান ভাইয়া কেমন আছেন আংকেল?’

‘আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছে। তবে আগের মতো কথা বলে না। শুধুই মেয়েকে নিয়েই তার সকল ভাবনা।’

পুতুল মুচকি হাসলো ঔশীর কথা ভেবেই। লন্ডন থেকে সে রোজই ঔশীর সঙ্গে কথা বলতো। আজ তাকে হঠাৎ দেখেই চমকে যাবে মেয়েটা। মেয়েটার রিয়াকশন কেমন হবে তাকে সামনে দেখার পর সেটাই ভাবছে। তাই সে প্রথমে প্রিহানের বাড়ির সবার সাথে দেখা করলো। ঔশী সত্যিই খুবই এক্সাইটেড তাকে পেয়ে। সে কিছুতেই পুতুলকে যেতে দেবে না। তাই সে ব্যাগ রেখে গেলো মা বাবার সঙ্গে দেখা করে আবার ফিরলো। আবার কোথাও বেরোতে নিলে তখনই ফারুক সাহেব বলেন,

‘এখনি এসেই এতো ছুটছো? এই তো জার্নি করে ফিরলে। এখন রেস্ট করো পরে যেও।’

পুতুল আর কথা বারাইনি। কিন্তু মন টা আঁকুপাঁকু করছিলো একটা বার মানুষটার দেখা পাওয়ার জন্য। সে পরদিন ওখান থেকেই চলে গেলো সেই মানুষটার বাড়িতে। মাহিয়ার সঙ্গে ভালো মন্দ কথা বার্তা চালাতে চালাতে আড় চোখে পুরো বাড়ি স্ক্যান করলো কিন্তু সেই মানুষটা নেই। সে তো জানে তবুও একটাবার যায়নি তাকে দেখতে? এমন পাষণ্ড কবে হলো মানুষটা?

‘তো ভাবি, তুই তো সেই সুন্দরী হয়েছিস। একদম বিদেশিনী টাইপ।’

‘তুই ও সুন্দর হয়েছিস। তোর বর কি কই রে আসেনি?’

‘নাহ রে সে ব্যস্ত। আসবে কিভাবে। তুই যাকে খুঁজছিস সেও ব্যস্ত। এখন অফিসে আছে।’ ঠোঁট চেপে হেসে বলে মাহিয়া।

‘ওহ আচ্ছা!’ পুতুল মন খারাপ করে বলে। সে ইনিয়েবিনিয়ে সন্ধ্যা অব্দি রয়ে গেলো এই বাসায়। ঔশী আর মাহিয়ার ছোট বোন মিহি দুজনে ভীষণ সুন্দর মিশে গেছে। ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে বলা যায়।
সন্ধ্যায় ফিরলো প্রশান্ত। পুতুলকে দেখেও দেখলো না সে। ভাব এমন সে তাকে চেনেই না। এতে অভিমানে গাল ফুলিয়ে রইলো পুতুল। সে ঠিক করলো লোকটার সঙ্গে কথায় বলবে না। এতো ইগো কিসের হ্যাঁ? এমন-তো আগে ছিলো না সে?

সালেহা জোর করেই পুতুলের হাতে চা পাঠিয়ে দিলেন। না চাইতেও পুতুলকে যেতে হলো প্রশান্তর রুমে। সে নক করলো কিন্তু আওয়াজ এলো না৷ তাই সে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। দেখলো প্রশান্ত নেই। চা রেখে বেরোতে নিলেই হুট করে অর্ধ নগ্ন অবস্থায় প্রশান্ত বেরিয়ে এলো। প্রশান্ত চোয়াল শক্ত করে বলে,

‘বিদেশে থেকে কি মিনিমাম ভদ্রতা, সহবত সব ভুলে গেছেন? কারোর রুমে আসতে গেলে যে নক করতে হয় জানেন না?’

অপমানে থমথমে হয়ে গেলো পুতুলের মুখ। সে তো নক করেছিলো নাকি। এতো বছর পর দেখা হলো আর লোকটা তার সাথে এইরকম ব্যবহার করলো?
প্রশান্ত আগের চেয়ে অনেক বেশি সুদর্শন হয়ে গেছে। সে বেহায়ার মতো তাকিয়ে রইলো প্রশান্তর দিকে। যে যেনো চোখ সরাতে ভুলে গেছে। হুট করেই প্রশান্ত পুতুলের গালে চ’ড় বসিয়ে দিলো। কথা নাই বার্তা নেই এমন আকস্মিক ঘটনায় আহত চোখে তাকিয়ে রইলো প্রশান্তর দিকে।

‘যান বেরিয়ে যান এখান থেকে! কেন এসেছেন এখানে? জীবনে পুরুষ মানুষ দেখেন নি? বেহায়া হয়েছে বিদেশ থেকে থেকে।’

পুতুল নড়লো না এক পাও। একটা থাপ্পড় খাওয়ার পরও পুতুল চুপ করে রইলো। থাপ্পড় টা মোটেও আস্তে ছিলো না। জোর ছিলো সেটাই। মালা ছলছল করে তাকালো আর বললো,

‘আরেকটা গালেও মারেন থা’প্প’ড়!’

সামনের ব্যক্তি টি ভ্রু দারুন ভাবে কুচকে বলে, ‘মানে আরেকটা থা’প্প’ড়? কেন?’

‘আরেকটা গালে থা’প্প’ড় না দিলে আমার বিয়ে হবে না জীবনেও।’ বলেই ভেঁভেঁ করে কাঁদতে লাগলো পুতুল।

প্রশান্ত তাজ্জব বনে গেলো। মেয়েটা তবে তার শক্ত হাতে থাপ্পড় খেয়ে কাঁদেনি। আরেক গালে থাপ্পড় না দিলে বিয়ে হবে না এটা ভেবেই কাঁদছে। হায় আল্লাহ্! সে টেনে বের করে দিলো পুতুলকে। পুতুল মন খারাপ করে ছাদে চলে গেলো দৌঁড়ে।

পরিশিষ্ঠঃ

প্রশান্ত নিজের মনে যতই রাগ পুষে রাখুক না কেন সত্য এটাই পুতুল তার অভ্যাসে, বদ অভ্যাসে নয় বরং প্রিয় এক অসুখে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে। যা কখনো নিরাময় হওয়ার নয়। এতো বছর পর দেখা হলো অথচ সে কি না মেয়েটাকে আঘাত করলো। আট, আটটা বছর তো আর কম নয়। যাওয়ার আগে যে মেয়েটা তার সাথে দেখা করে যায়নি সেই রাগ এতো বছরেও সে ভুলতে পারেনি? নিজের উপর নিজেরই ভীষণ রাগ লাগছে। তার জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আবেগ-অনুভূতি এতটা প্রখর যে মেয়েটাকে ভুলে থাকা অসম্ভব। এই মেয়েটা বিহীন যেন তার জীবন নির্জীব, নিষ্প্রাণ ছিলো এতোদিন। অথচ সে কি করলো? মধুর এক ধ্বনি গুঞ্জিত হলো চারদিক। এশারের আজান পরেছে। গোধুলির আকাশ আঁধার আকাশের গহীনে ঢাকা পড়ল। সে গুটিগুটি পায়ে ছাদে উঠলো। সোজা গিয়ে অভিমানী রমনীর কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ম্লান কন্ঠে বলে,

‘এই যে বিদেশিনী এখানে কি করছেন? ভয়-ডর নেই? এই সময় জ্বীন-ভুত থাকে ছাদে! অবশ্য আপনাকে দেখে ভু’ত ও তো ভয় পাবে। ভয় ডর না থাকার ই কথা।’

কথার যথার্থ অর্থ ধরতে পেরে রোষানল দৃষ্টিতে তাকালো পুতুল!

‘কি? অভাবে তাকানোর কিছু নেই হ্যাঁ? বিদেশে গিয়ে তো গায়ের চামড়া আরও সাদা হইছে। আমিই ভয় পেয়ে গেছিলাম আপনাকে প্রথম দেখে।’

‘”আপনি!” সম্বন্ধে অভিমান আরও বাড়লো তার। চোখের কোণে জমে থাকা জল গড়িয়ে পরলো অজান্তেই। সে তো শেষ অব্দি প্রশান্তর জন্য অপেক্ষা করেছিলো। মানুষটাই তো এলো না। কত আশা করেছিলো যেনো মানুষটাকে দেখে যেতে পারে। পারিপার্শ্বিক ভাবে এখানে তার দোষ কোথায়? এতো বছরেও লোকটা তাকে একটাও কল করেনি। কেন? সে যাওয়ার আগে দেখা করতে বলেছিলো সে যায়নি বলেই? পরিস্থিতি এমন ছিলো যে তার তো সময় হয়নি দেখা করে যাওয়ার। হুট প্রশান্ত তার দুই গালে হাত গলিয়ে নিজের দিকে মুখ ঘুরালো। মন্থর কন্ঠে বলে, ‘দেখি দেখি, আহারে গাল টা লাল হয়ে গেছে। বেশি লেগেছিলো তখন? আ’ম স্যরি। তখন ওভাবে তোমার গায়ে হাত তোলা উচিত হয়নি। আমি জানি না হুট করেই কি হয়ে গেলো। প্লিজ আগের সব কথা ভুলে যাও। আমরা নতুন করে সব শুরু করবো হ্যাঁ?’

পুতুল চট করে হাত ছাড়িয়ে দিয়ে প্রস্থান করতে উদ্যত হলে,

‘কথা বলবে না ডল?’

এমন আবেগ মাখা ডাক শোনার পর কার সাধ্য আছে মানুষটার সাথে রুষ্ট হয়ে থাকার? তার তো নেই। একবারেই নেই। প্রশান্ত তার হাত টেনে ধরে তার কাছে আনলো। সন্তপর্ণে নিজের অধর স্থাপন করলো পুতুলের অধরযুগলে। সুহৃত্তম ব্যক্তিটির সান্নিধ্য পাওয়ামাত্র বরফের ন্যায় গলে পড়ল সকল অভিমান। সর্বগ্রাসা হলো অনড় নারীর মন। কিয়ৎক্ষণ পর প্রশান্ত তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘বিয়ে না করেই এই অন্যায় টা মেনে নিলে?’

তখনই খুক খুক করে কেশে উঠে প্রিহান তার উপস্থিতি জানান দিলো। দুজনেই সটকে দূরে সরে চকিতে তাকালো প্রিহানের দিকে। প্রচন্ড রকমের অসন্তোষ জড়ানো দুইজোড়া চোখ অবলোকন করলো প্রিহান। সে পুতুলকে ডাকতে এসেছিলো। মেয়েকে বাড়িতে না পেয়ে ছুটে চলে এসেছে এখানে। মেয়েকে নিয়ে বড্ড বেশিই ভয়। অতঃপর এক সাথে ফিরবে বলে এখানে ডাকতে এসেছিলো পুতুলকে। কিন্তু ছাদে যে প্রশান্ত আছে তার জানা ছিলো না। কিছু কিছু সুন্দর মুহুর্ত দেখতেও ভালো লাগে। সে এক গাল হেসে করুনার স্বরে বললো, ‘আহারে প্রেম! শালিকা পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই। নিউটনের এই তৃতীয় সুত্র ভুলে গেছো বুঝি? বেচারা সাইন্টিস্ট! আর অভিমান করো না। সব মিটিয়ে নিচে আসো আমরা বেরোবো। চাইলে থেকেও যেতে পারো।’

‘না ভাইয়া আ-আপনি যান আমি আসছি।’

প্রিহান এদিক ওদিক তাকিয়ে সন্তপর্ণে ছাদ প্রস্থান করলো। নিঃশ্বাসের সাথে অহেতুক অস্বস্তি উড়িয়ে দিয়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলো ওঁ।

বার কয়েক পলক ফেলে পুতুল তাকালো প্রশান্তর দিকে।

‘তাহলে আসি?’ বলেই পুতুল প্রশান্তর দিকে তাকালো। শরৎ প্রচ্ছন্ন আকাশে গোলাকৃত চন্দ্রপ্রভায় ফর্সা মুখটি একটু বেশি স্পষ্ট দেখালো।

প্রশান্তও তাকালো। তখনকার করা আচানক কাজে অস্বস্তি হচ্ছে তার। না জানি কতটা খারাপ ভাবছে পুতুল তাকে? সে নিবিড় ভাবে দেখলো পুতুলকে। গায়ে চন্দ্রমা লেপ্টে আছে খুব আদুরে ভাবে। হিমেল বাতাসের দোলে অর্ধ-সিক্ত কেশ উড়ছে আলগোছে। সে একটু কাছে আসলো পুতুলের। মুখের কাছে পড়ে থাকা অবাধ্য চুলগুলো খুব সন্তর্পণে কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলে, ‘অনেক ক্ষেত্রে দূরত্ব অনুভূতি ফিকে না বরং প্রগাঢ় করে। আর আমার অনুভূতি এক বিন্দুও আলাদা বা ফিকে হয়নি। সেই আগের মতোই আছে। সেই ছোট্ট ডল এখন বড় হয়েছে সাথে আমার অনুভূতিও প্রগাঢ় হয়েছে।’

অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকায় পুতুল। অধর ধারে মিহি রেখা বর্ধিত। মানুষটা তার মন পড়ে ফেললো নাকি? সে যে আসলেই এই ভাবনায় মত্ত ছিল। এতদিন দূরে থেকেছে তারা। এতোদিনেও কি সেই একই অনুভূতি রয়েছে? তাকে ভুলে যায়নি তো প্রশান্ত? এই সবই তো সে ভাবছিলো। আর কি সুন্দর মানুষটা তার মুখাবয়ব দেখেই চমকে দেওয়ার মতো কথাটা বলে ফেললো।

‘দ্রুত আপনার ঘরে আনার ব্যবস্থা করুন। অনেক তো হলো দূরে দূরে থাকা।’

লজ্জা পেয়ে ছুটে চলে গেলো পুতুল। প্রশান্ত তৃপ্ত চোখে পুতুলের চলে যাওয়া দেখে আওড়ালো,

‘ওই তারা ভরা সাঁঝের আকাশে,
যখন আসবে তুমি চাঁদ উঠবে হেঁসে!
নিয়ে ফুলের সুভাষ বয়ে যাবে বাতাস
মনে আসবে খুশি, পদতলে থাকবে নরম ঘাস!
তুমিই প্রথম , তুমিই আমার শেষ প্রেম!
প্রথম প্রেম হয় না যে কভু অপ্রেম!’

সমাপ্ত