প্রেম পায়রা পর্ব-১৯

0
1277

#গল্পের_নাম:|| প্রেম পায়রা ||
#লেখনীতে: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব______১৯ (বোনাস পার্ট)

৩২.

টেবিলের ঘড়ির দিকে তীক্ষ্ণ নজরে চেয়ে আছে সম্পদ।ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই করতে সে উঠতে নিল।উঠতে পারলো না।তিথি তার বুকের উপর শুয়ে আছে।গভীর ঘুমে সে।নেতিয়ে পড়া বনলতার মতো সে সম্পদের সাথে মিশে আছে।সম্পদ তিথির চুলগুলো গুছিয়ে অতি সন্তর্পনে তাকে বুক থেকে সরাল।মাথাটা বালিশের উপর রেখে গায়ে কম্বল টেনে দিল।

উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সে।বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে ঘন্টা দুই-তিন হলো।এখন পরিষ্কার মেঘমুক্ত আকাশ।কুচকুচে কালো আকাশে কিছুদূর পর পর নক্ষত্রও দেখা যাচ্ছে।বাহিরে শীতল পরিবেশ বিরাজমান।জানালার কাচ সরিয়ে সে পর্দা টেনে দিল।

সরে এসে ফোনটা হাতে নিল।সবুজের নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে।মেসেজটা অপেন করে পড়লো।পাওয়ার বাটন অফ করে সে ফোনটা পুনরায় পকেটে রাখলো।তিথির দিকে এক পলক চেয়ে শব্দহীন নিরবতা বজায় রেখে ছিটকিনি খুলল।ড্রয়িং রুম পেরিয়ে সদর দরজা খুলে সে বাইরে বের হলো।

বন্ধ গেটের এ পাশে দাঁড়িয়ে সম্পদ গলা পরিষ্কার করে বলল,

—‘সবুজ!’

সবুজের উদ্বিগ্ন গলা শোনা গেল।

—‘জ্বি স্যার!আসসালামু আলাইকুম স্যার।এনেছি।’

—‘গেটের নিচ দিয়ে বক্স ঢুকিয়ে দাও।দেখো তো আসে কি না!’

সবুজ চেষ্টা করে ঢুকাতে পারল না।গেটের নিচে তিন-চার আঙুলের মতো দূরত্ব।সে কিছুক্ষণ ভেবে বলল,

—‘স্যার, দেয়ালের উপর দিয়ে দিই।নইলে থেঁতলে যাবে।আমি উঁচু করে ধরছি স্যার।আপনি ওপাশ থেকে হাতে নিবেন স্যার।’

সম্পদ গেটের ডানপাশে গিয়ে দাঁড়ালো।পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দেয়ালের ওপাশ থেকে বক্স আর ফুলের বুকেটা হাতে নিল।ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

—‘থাঙ্কস সবুজ!অনেক বড় উপকার করলে।’

—‘মাই প্লেজার!আমি এখন আসি স্যার।শুভরাত্রি।’

—‘শুভরাত্রি।’

দেয়ালের ওপাশে পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতে সম্পদ হাতের জিনিস গুলোর দিকে তাকাল।বুকের কোণে একটু একটু করে ভালো লাগার অনুভূতিরা এসে জমা হলো।সে দ্রুত পা চালিয়ে সদর দরজা দিয়ে রুমে ঢুকলো।

হাতের জিনিস গুলো টেবিলে রেখে সে দরজার ছিটকিনি লাগাল।টেবিল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল,বারোটা আট বাজে।সে ওয়াশরুমে ঢুকলো।

চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ঘুমকে বিদায় জানাল সম্পদ।টাওয়াল দিয়ে সিক্ত হাতমুখ মুছে বিছানার দিকে গেল।তিথি এই জগতে নেই।তার প্রগাঢ় ঘুম।ঘুমিয়ে গেলে পৃথিবীর কোনো খোঁজ থাকে না।সম্পদ মুচকি হেসে তিথির দু পাশে হাত রাখল।মাথাটা নিচু করে কপালের উপরের ভেজা চুলগুলো তিথির মুখের উপর ঝাড়া দিল।কয়েক ফোঁটা পানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে মুখে পড়তে তিথির কপাল কুঁচকে গেল।হালকা নড়েচড়ে আবার স্থির হয়ে গেল।

সম্পদ কন্ঠে বিষণ্ণতা ঢেলে বলল,

—‘তিথি,রাত,রাত্রি,রজনী!উঠে পড়ো।’

তিথির কোনো হেলদোল নেই।বটবৃক্ষের মতো স্থির হয়ে আছে।সম্পদ ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে সরে পড়লো।রুমের কর্নার ঘেঁষে থাকা টেবিলটা সে উঁচু করে মাঝামাঝি আনলো।টেবিল খালি করে বক্সটা খুলে টেবিলের উপর রাখলো।বক্সের ভেতর লাভ শেইপের কেক!সম্পদ মোমবাতি গুলো জ্বালিয়ে টেবিলের চারপাশে রাখলো।ফুলের বুকে থেকে কয়েকটা গোলাপ বের করে তার পাপড়ি ছিঁড়ে ফেলল।মুঠোয় পুড়ে সেগুলো টেবিলের সর্বত্র ছড়িয়ে দিল।শেষ মেষ ট্রাউজারের পকেট হাতড়ে ছোট্ট রিংয়ের বক্সটা খুলে কেকের পাশে রাখলো।

কাজ কমপ্লিট!টেবিলের দিকে চেয়ে সে মৃদু আনন্দের শব্দ করলো।

মাথার চুলে একবার আঙুল চালিয়ে তিথির দিকে এগিয়ে গেল।তোড়জোড় করে তিথিকে কোলে তুলে নিতে তিথি ভয়ানক চমকে বলল,

—‘ক-কি হয়েছে সম্পদ?আপনি ঘুমাননি?’

সম্পদ মিষ্টি করে হাসলো।তিথির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

—‘শুভ শুভ্র জন্মদিন তিলবতী!’

তিথি চমকালো।তার চোখ দুটো আপনা-আপনি বড় হয়ে গেল।আজ তার জন্মদিন সম্পদ জানলো কি করে?

তার এক্সাক্ট জন্মতারিখ কেউ জানে না।বড় বাবা যেদিনটিতে তাকে কুড়িয়ে পেয়েছিল সেই দিনটিই তার জন্মদিন হয়ে যায়।প্রতি বছর বড় বাবা ঘরোয়া ভাবে তার জন্মদিনটি পালন করে।এ বছর নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে, নতুন মানুষ পেয়ে তিথি তো ভুলেই গেছিল দিনটির কথা।সে চোখ ছোট ছোট করে বলল,

—‘এর জন্য এত রাত অবধি জেগে থাকতে হবে আপনার?নিচে নামান।’

সম্পদ ঘুরে কয়েক পা গিয়ে টেবিলের সামনে তিথিকে নামিয়ে দিল।টেবিলটা মাত্র নজরে এলো তিথির।টেবিলের ডেকোরেশন দেখে তার মুখ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল।ঘুরে দাঁড়িয়ে সম্পদকে কিছু বলতে নিতে সম্পদ পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল।তিথির কাঁধে মাথা রেখে বলল,

—‘একমাত্র তোমার জন্মদিনে উইশ করার জন্য আমি ইমার্জেন্সি টিকেট কেটে দেশে চলে এসেছি।বিষয়টা আড়ালে রেখে সবাইকে বিজনেসের কথা বলেছি।বিশাল বড় সারপ্রাইজ দেয়ার ইচ্ছে ছিল তোমাকে।কিন্তু বড় বাবার অসুস্থতার জন্য এরেন্জ করতে পারিনি।এতটুকু করেছি শুধু।’

তিথির চোখ ভিজে উঠলো।দাঁত কামড়ে নিজেকে সামলাল।ঘুরে দাঁড়িয়ে সম্পদের বুকে অনবরত কিল,ঘুষি দিয়ে রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

—‘আপনি একটা পাগল!’

সম্পদ দুহাতে তিথির হাত ধরে ফেলল।চোখের ইশারায় হাত দেখিয়ে এবার মারতে বললো।তিথি মুচকি হেসে সম্পদের বুকে মাথা রাখলো।

—‘নাও কেক কাটো!’

ঘড়িতে যখন বারোটা চৌত্রিশ বাজে তখন সম্পদের কথায় তিথি ফু দিয়ে বাতি নিভিয়ে কেক কাটে।এক টুকরো কেক হাতে উঠিয়ে সম্পদের দিকে বাড়িয়ে দেয়।সম্পদ সেখান থেকে একটা অংশ ভেঙে তিথির মুখে পুড়ে দেয়।তারপর তিথির হাতসুদ্ধ কেকটুকু নিজের মুখে পুড়ে!

কিছুক্ষণ পর গোলাপের বুকেটা তিথির দিকে বাড়িয়ে দেয় সম্পদ।তিথি সানন্দে বুকেটা হাতে নেয়।চোখ বন্ধ করে তার গন্ধ শুঁকে।তিথি নরম সুরে বলে,

—‘আপনি আমার মাথায় হাত রেখে দুয়া করুন।’

—‘আমার সব প্রার্থনায় তুমি সবসময় থাকো তিথি।আলাদা ভাবে দোয়া করার প্রয়োজন নেই।’

—‘অতশত বুঝি না আমি।আপনি এক্ষুণি আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করবেন।যাই বলেন না কেন সাথে এটা বলবেন যে আমার ব্যক্তিগত সম্পদ যেন সারাজীবন আমার একান্ত ব্যক্তিগত হয়ে থাকে।আমায় সারাজীবন যেন ভালোবাসায় আগলে রাখে।’

সম্পদ তার কাছাকাছি এগোয়।তিথির ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,

—‘তিথি চোখ বন্ধ করো।’

তিথি চোখ বন্ধ করে।সম্পদ ডান হাতটা তিথির মাথায় রেখে বিড়বিড় করে কিছু একটা বললো।একটুপর হাত সরিয়ে বলল,

—‘এবার খুশি তো?’

তিথি বন্ধ চোখে বলে উঠলো,

—‘হুঁ!অনেক খুশি।নিঃসন্দেহে আজকের রাতটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাতের মধ্যে একটি!’

তিথির বন্ধ চোখের দিকে সম্পদ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে।টেবিল থেকে রিংয়ের বক্সটা হাতে নিয়ে তিথির বাম হাতের অনামিকা আঙুলে পড়িয়ে দিল।মুখটা নিচু করে রিংয়ের উপর নিজের ঠোঁট ছোঁয়াতে তিথি চোখ খুলল।লজ্জা মিশ্রিত চোখে সম্পদের দিকে এক নজর চেয়ে মুখটা নিচু করলো।

সম্পদ রিং পড়ানো হাতটা টেনে নিয়ে তার বুকের উপর রাখলো।একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল,

—‘তিথি কালকের দিন আর রাতটা শুধু আমি দেশে আছি।পরশুদিন রাতে আমার ফ্লাইট।’

তিথির বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো।সমস্ত কথা যেন গলার কাছে এসে আটকে গেল।সম্পদের কথাটি বুকে তীরের মতো বিঁধলো।সে কাঁপা কাঁপা গলায় কোনো রকমে বলল,

—‘এত তাড়াতাড়ি?’

—‘হুঁ!প্রচুর টাকা খরচ করে তিনদিনের ছুটিতে এসেছিলাম।আমার এত ধকল নিয়ে দেশে ছুটে আসাটা সার্থক হয়েছে।আমি আমার জীবনের সেরা এবং সবচেয়ে মূল্যবান রত্নটিকে উপহার পেলাম।নিজের করে পেলাম।’

তিথির হাত থেকে ফুলের বুকেটা খসে পড়লো।তার কান্না পাচ্ছে।ভীষণ কান্না পাচ্ছে।কেন সবসময় তাকেই কাঁদতে হবে?মুখে হাত চেপে নিজের কান্না লুকানোর চেষ্টা করলো সে।সফল হলো না।ফলে সম্পদের থেকে বাম হাতটি ছাড়িয়ে সরে যেতে নিল।বেশিদূর এগোতে পারলো না।শাড়ির আঁচলে টান পড়েছে।সে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে তার লম্বা আঁচলের এক অংশ সম্পদের পায়ের নিচে।

সম্পদ ফ্লোরে ঝুলে থাকা আঁচলের দিকে তাকিয়ে সেটা হাতে তুলে নিল।নাকে চেপে তার গন্ধ শুঁকে তিথির দিকে এগিয়ে গেল।পেছন থেকে আঁচলটা পেঁচিয়ে তিথির মাথায় দিতে সে ঘুরে দাঁড়াল।তিথির অশ্রুতে টলমল চোখ দুটো থেকে টসটসে জল গড়িয়ে গালে পড়লো।সম্পদের বিষণ্ণ চোখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো।পরক্ষণে পায়ের উপর ভর দিয়ে মুখটা উঁচু করলো।সম্পদের ঠোঁটে চুমু খেয়ে ভেজা গলায় বলল,

—‘ভালোবাসি!’

৩৩.

নিশান অফিস থেকে ফিরতে রেশমা বেগম তার দিকে মিষ্টি বাড়িয়ে দিলেন।ছোট্ট একটা পিরিচে তিনটে মিষ্টি।সাথে একটা কাঁটা চামচ।সে সন্দেহের দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চেয়ে বলল,

—‘মা!রাত দশটার উপরে বাজে।এত রাতে খাবার না খেয়ে আমি এখন মিষ্টি খাব?’

রেশমা হাসিমুখে বললেন,

—‘একটা খা না বাপ!’

—‘তুমি টেবিলে ভাত দাও তো মা!চিংড়ি দিয়ে ভাত খাব।চিংড়ি রান্না হয়েছে তো মা?দুপুরে তুলিকে বলেছিলাম।’

—‘হুঁ।হয়েছে।তুই আগে মিষ্টি খা।’

নিশানের অপেক্ষা না করে রেশমা বেগম এক টুকরো মিষ্টি নিশানের মুখে পুড়ে দিল।নিশান জোরপূর্বক সেটা গিলে ফেলে মায়ের দিকে তাকালো।মায়ের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।সে ঠোঁটের কোণের রসটুকু হাত দিয়ে মুছে বলল,

—‘এবার খুশি তো মা?ভাত দাও এখন।আমি হাত ধুয়ে আসছি।’

রান্নাঘর থেকে নিশান হাত ধুয়ে টেবিলে বসলো।আড়চোখে নিজের রুমের দিকে তাকালো।সে বেশ জোরেশোরে কথা বলেছে এতক্ষণ।তুলির কানে যাওয়ার কথা।তাহলে বের হয়ে আসছে না কেন?কিছুক্ষণ উসখুস করে সে বলল,

—‘তোমরা খেয়েছ?বাবা খেয়েছে?’

রেশমা নিশানের প্লেটে শুঁটকি ভর্তা তুলে দিয়ে বলল,

—‘সবাই খেয়েছি আমরা।আজ তুই অনেক দেরি করে ফেলেছিস।’

এক লোকমা ভাত মুখে পুড়ে নিশান আবার নিজের রুমের দরজার দিকে তাকালো।তুলিকে দেখতে না পেয়ে বলল,

—‘মা,তুলিকে দেখছি না।ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?’

—‘হুঁ!সারাদিন ঘুমায় না।টুকটুক করে হাঁটাহাঁটি করে।এখন সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়েছে।’

—‘বাবার মেডিসিন ঠিক মতো খাইয়েছ?’

—‘হুঁ!ভালো কথা।তিথি আজ ফোন দিয়েছিল।অনেকক্ষণ কথা বললো।সম্পদ এক সপ্তাহ হলো বিদেশ চলে গেছে আবার।মেয়েটা একা একা আছে।বললাম আমাদের এখানে এসে থাক।আসবে না!তাছাড়া ওর হুইল চেয়ার শ্বশুর মশাই আসতে দেয় না।বলে,আমার মেয়ে আমার কাছেই থাকবে বেয়াইনসাব।এক নম্বরের বজ্জাত লোকটা!’

শেষের দিকের কথাগুলো রেশমা রাগী গলায় বললো।নিশান মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল।

শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে নিশান নিজের রুমে ঢুকলো।রুম অন্ধকার।তুলি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। দরজা বন্ধ করে অন্ধকারের মধ্যে দক্ষিণ দিকের দেয়ালের দিকে এগোল।সুইচে চাপ দিতে স্নিগ্ধ আলোয় ভরে গেল রুমটা!বিছানার দিকে তাকানোর আগে তার চোখ আটকে গেল ড্রেসিং টেবিলের পাশে বসে থাকা মেয়েটির উপর!

(চলবে)