প্রেম প্রেম পায় পর্ব-০৫

0
313

#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব পাঁচ

৫.
ভোরের আলো তখন ফুটতে শুরু করেছে।আজান এর পর অতিবাহিত হয়ে গেছে বেশ খানিকটা সময়। শুরু হয়ে গিয়েছে পাখিদের কিচিরমিচির। তার সাথে শুরু হয়েছে ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ততা।সেই ব্যস্ততা এবং আকাশের রং বদলানো দাড়িয়ে দাড়িয়ে অনুভব করছে একজন।

‘পাখি রে, তুই খাঁচা ভেঙে আমার কাছে আয়
চোখের মণি চোখের কাছে না থাকলে
মনটা আমার আকুল হয়ে মরে যেতে চায়
পাখি রে, তুই দূরে থাকলে
কিছুই আমার ভালো লাগে না
পাখি রে, তুই দূরে থাকলে
কিছুই আমার ভালো লাগে না
পাখি রে, তুই…’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেও নিত্যদিনের মতো ব্যস্ত হয়ে গেল সে।
——————–

নড়ে চড়ে ঘুমটা ভেঙে গেল অপরাজিতার।আরেকটু নড়ে উঠতেই হাতে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করলো। নিজেকে সামলে উঠে বসলো সে। তার রুমের ঘড়িতে দেখলো সকাল সাতটা বেজে সাত মিনিট। বেশি বেলা হয়নি বলে মা কে ডাকলো না।পিছে বালিশ দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসলো। ফায়াদের কথা মনে পড়লো তার। লোকটা কাল বেশ বিচলিত ছিল তার জন্য। তখন খেয়াল না করলেও এখন তার মনে পড়ছে।সে যেন ফায়াদের চোখে তার জন্য অস্থিরতা দেখেছিল।আসলেই কি ছিল কোনো কিছু?তার দেখার ভুল নয়তো!
পাশে হাতরে ফোনটা খুজলো।ফোনের লক খুলতেই চমকে গেল সে।ফায়াদের মিস কল।ফায়াদ কখনো নিজ থেকে তাকে কল করে নি। সেই করতো প্রতিদিন৷ কাল কল করেছিল তাও কিনা ৩৬ বার! অপরাজিতা তাড়াতাড়ি করে কল ব্যাক করলো ফায়াদকে।

ফায়াদের চোখটা নামাজের পর লেগেছিল।বেশিক্ষন হয় নি ঘুমিয়েছে। ঘুম ঘুম চোখে ফোনটা রিসিভ করেছে।অপরাজিতা ফোন কানে দিয়ে কিছু বলছে না। অপেক্ষা করছে অপরজনের কিছু বলার।ফোন কানে ধরে অপরাজিতা কিছু বলছে না দেখে ফায়াদ ফোন চোখের সামনে এনে কে কল দিয়েছে দেখলো। নাম্বার টা দেখে নিশ্চিত হয়ে আবারো কানে লাগালো।

‘কথা বলো না কেন?’

ঘুমঘুম গম্ভীর কন্ঠ শুনে মনের মধ্যে ঢোল পিটিয়ে উঠলো অপরাজিতার। তার এখন ফায়াদের ঘুম ঘুম মুখটাও দেখতে ইচ্ছে করছে৷ না জানি কত মায়া সেই চেহারায়!নাহ!! তার এখন ডাক্তার সাহেবকে দেখতেই হবে।নাহলে তার এই দেখতে চাওয়ার রোগ আজ সারাদিনেও সাড়বে না।ফলে সে কোনো কাজে মন বসাতে পারবে।ব্রেইন অকাজের হয়ে যাবে৷ এতে পড়ায়ও মন করবে। ফেল করলে ডাক্তার তাকে পাত্তা দিবে না।দুনিয়ার সব ভাবনা যেন তার মাথায় ভীড় জমাচ্ছে এখন।
অপরাজিতা কে কিছু বলতে না শুনে ফায়াদ আবার বলল,
‘আছো?’

অপরাজিতা হুট করেই বলে উঠলো,
‘ভিডিও কল দেই?’

ফায়াদ উঠে বসেছে। অপরাজিতার কথা শুনে খানিকটা অপ্রস্তুত হলো সে। তবে কিছু একটা ভেবে সম্মতি দিল। তারপর অপরাজিতা ফোন কেটে ওয়াটসাপ এ কল করলো।ততক্ষনে ফায়াদও বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসেছে।কল রিসিভ করতেই অপরাজিতা থমকে গেল। বুকের ভিতর তার যেন কিছু বেজে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে । এলোমেলো চুল, ফুলোফুলো চোখ, চোখে মুখে ঘুমের রেশ কিছুতা এখনো রয়ে গেছে।দেখতে খুবই মায়াবী লাগছে।মেয়েদের নাহয় মায়াবতী বলে কিন্তু ছেলেদের কি বলে?
ফায়াদ দেখলো অপরাজিতার দৃষ্টি। সে গলা খাকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘হাতের কি অবস্থা?’

ধ্যান ভাংলো অপরাজিতার৷নিজেকে সামলে বলল,
‘এই আর কি! আগের মতোই।’

‘ঠিক মতো ঔষধ গুলো নিয়ো।’

‘হুম’
সে তো ফায়াদকে দেখতে ব্যস্ত।ফায়াদ ও প্রহর গুনলো সে ব্যস্ততার। অপরাজিতা কিছু মনে পড়ায় বলে উঠলো,
‘কাল এতোবার ফোন দিয়েছিলেন যে!আপনি তো আমাকে কখনো ফোন দেন না!

‘আব ওই আর কি খোজ নেওয়ার জন্য।’

‘একটা কথা বলি?’

‘বলো।’

অপরাজিতা ভীষণ অনুভূতি নিয়ে বলল,
‘আপনাকে না ভীষণ ভীষণ আদুরে লাগছে এই মুহুর্তে!চোখ,মুখ,ঠো—‘

বাকিটা বলার আগেই ফোন কেটে দিল ফায়াদ৷ ফোন রেখে বিরবির করে বলল,’ফাজিল মেয়ে কোথাকার।’
ফায়াদ ফোন কেটে দেওয়ায় অপরাজিতা ফিক করে হেসে দিল। সে জানতো এমন কিছুই হবে।

ফায়াদ ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে বসলো।সেখানে তার বাবা আগে থেকেই বসা ছিল। তিনি ম্যাগাজিন পড়ছেন।ছেলেকে একনজর দেখে আবারো ম্যাগাজিনে মনোযোগ দিলেন।ফায়াদ তার মাকে গলা বাড়িয়ে বলল,
‘মা এক কাপ চা দিয়ো।’

ফারদিন আহমেদ ম্যাগাজিন এর পাতা উল্টাতে উল্টাতে ঠেশ মেরে বললেন,
‘কতদিন আর অন্যের বউয়ের হাতে চা খাবে?’

ফায়াদ হামি দিতে দিতে বলল,
‘ওটা আমার বাবার বউ।’

ফারদিন আহমেদ জোড় দিয়ে বললেন,
‘আর তোমার বাবা আমি।’

ফায়াদ অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
‘সত্যি?’

বলেই সে রান্নাঘরে মায়ের কাছে চলে গেল।এদিকে রেখে গেল অবাক ফারদিন আহমেদকে। নিজের বাবাকেও ছাড় দিবে না এই ছেলে।নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলেন,
‘এটা আমারই ছেলে তো?’
পরক্ষনেই আবার নিজেকেই যেন শাসালেন,’আরে ধুর আমারই তো!আশ্চর্য এই ছেলে আমার মাথা টা ঘেটে দিচ্ছে!’

ফায়াদ তার মায়ের কাছে গিয়ে বলল,
‘মা তোমার জামাই আমাকে জালাচ্ছে।’

আখি বেগম চোখ রাঙানি দিয়ে বললেন,
‘ফায়াদদদ!!’

ফায়াদ এক হাতে কানে ধরে বলল,
‘স্যরি স্যরি! বাবা জালাচ্ছে!’

হেসে দিলেন আখি বেগম।হাসতে গিয়ে চোখের কোণ ভিজে উঠলো। তার ঘরটা আরো হাসিতে মেতে থাকতো আগে। ফায়াদ তাদের সাথে এতো সুন্দর করে মিশে যে একাকিত্বের কোনো ফাঁকফোকর থাকে না৷কিন্তু মায়ের মন তো! মনটা ভীষণ আনচান করে আজকাল।অজান্তেই কেদে উঠে ভিতরটা।তার তো আরো একজন আছে। সে কী মায়ের বুকে ফিরে আসবে না?
ফায়াদকে চা দিলেন।

অপরাজিতা ফ্রেশ হয়ে তার খাটেই আবার শুয়ে পড়েছে।ভীষণ আলসেমি লাগছে তার উঠতে। অনেকক্ষন শুয়ে ছিল সে। রামিসা বেগম আসলেন মেয়েকে চেক করতে।এসে তাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে তাড়া দিয়ে বললেন,
‘উঠেছিস?তাড়াতাড়ি চল খাবার খাবি।আমার আজ অনেক কাজ।’

‘উফ আম্মু আমি অসুস্থ আর তুমি আমাকে পাত্তাই দিচ্ছো না।’

রামিসা এবার চোখ রাঙানি দিয়ে বললেন,
‘তোকে যে এখনো মারি নি এইটা তোর ভালো ভাগ্য।তাড়াতাড়ি খেতে যা৷ ডান হাতে তো কিছু হয় নি। আর নাহয় তোর বাবা আছে গিয়ে বল খাইয়ে দিতে। তারপর পড়তে বসবি। কয়েকদিন পর পরীক্ষা আর উনি হাত ভেঙে বসে আছে।তাও ভাগ্য ভালো ডান হাত ভাঙে নি।’

অপরাজিতা মুখ ফুলিয়ে খেতে গেল। আর রামিসা বেগম অপরাজিতার রুম গোছানোতে ব্যস্ত হলেন।অপরাজিতার রুম সচরাচর অপরাজিতাই গোছায়। এখন তো এক হাত দিয়ে গুছাতে পারবে না৷ আবার যদি ব্যথা পায়!

—————

‘ব্ল্যাক কফি চেয়েছিলাম। ব্ল্যাক কফিতে চিনি কে খায়?’

‘স্যরি স্যার! আসলে আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট !’

মাথায় হাত দিয়ে বলল,
‘বুঝতে পেরেছি। তুমি যাও।’

কফিটা সে বেসিনে ফেলে দিল।তার অ্যাসিস্ট্যান্ট এর মতে তেতো কফি খেলে সে তেতো হয়ে যাবে।অথচ সে জানে না তার জীবনটাই তেতো হয়ে আছে।এই জীবনে মিষ্টতা কি আসবে কখনো? তার অফিসের কেবিনে ৪ টা গিটার রাখা আছে। গান তার প্যাশন।আপনজনের থেকে এতোটা দূরে থেকে এইটাই যেন তার সঙ্গী হয়ে উঠেছে।
এই অবেলায় গিটার হাতে নিল সে এখন। অস্থির লাগছে তার। বুকের ভেতর এক অসহনীয় ব্যথা।চেয়ারে বসে টেবিলে পায়ের উপর পা তুলে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে ছাদের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে সুর তুললো গিটারে। সেই সুর শুনলো সব কর্মচারীরা। এই সুরে রয়েছে ব্যথা,ভালোবাসার অভিযোগ ,ব্যর্থতা,অভিমান।

‘দেহ পাশে কেউ কেঁদো না
গল্পগুলো রেখো অজানা
গানখানা থেকে খুঁজে নিও মোর সে গল্প
যাতে লিখা হাজার কষ্ট
নিজেকে ভেবে নিতাম এক শ্রেষ্ঠ
যার প্রতিপদে জীবন বিচ্ছেদের স্বপ্ন
সেই দিনে এক গানে এক গল্পকারের গল্প খুঁজে পাবে
খুঁজে পাবে না সেই গল্পকার
দিনগুলো খুঁজে পাবে গানের প্রতিটা ছন্দে
শুনতে পাবে মৃত মানুষের চিৎকার’

কেবিনের বাহিরে প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয় ভার হয়ে গেছে। হয়তো কেবিনের ভিতরের মানুষটির চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে মূল্যবান অশ্রুকণা।
কেবিনের বাহিরে দাঁড়িয়ে কান্না করছে নীতি।এসেছিল স্যারকে কিছু ফাইল দিতে। কিন্তু গিটারের সুরে বুঝেছে স্যার এর মন খারাপ। এখন সে আর ভিতরে যাবে না। তার অনেক কান্না আসছে। কোথাও গিয়ে কান্না করা দরকার।এই লোকটা নিজের অজান্তেই তাকে কাঁদায়।

(চলবে)