প্রেম প্রেম পায় পর্ব-০৬

0
308

#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব ছয়

৬.
পার হয়ে গেল বেশ কিছু দিন। এ কয়েকটি দিন অসহ্য গরমে কেটেছে।আজ একটু আকাশের রূপ বদল দেখা দিচ্ছে।বিকেল থেকেই গুমোট রূপ ধরে আছে।বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব থাকলেও বৃষ্টিটা এখনো নেমে আসে নি। ঘড়িতে আটটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট। মা বেশ কয়েকবার ফোন করেছে। ফোন ধরে নি ফায়াদ। আজ অনেকদিন পর গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে কিছুটা সময় নিজের মতো কাটানোর জন্য।ডাক্তার হওয়ার সুবাদে নিজের জন্য সময় খুব কমই থাকে।সে ইচ্ছে করেই নিজেকে ব্যস্ত রাখে বলা যায়।শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে আছে সে বর্তমানে। আপাতত একটা টং এর দোকানে বসে আছে।দোকানে তেমন মানুষ নেই। প্যান্ট এর পকেট থেকে ফোন বের করলো ফায়াদ।বেশ কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে কল করলো বিদেশি নাম্বারটিতে৷
রিং হচ্ছে।একসময় রিসিভ হলো। কিছু বলছে না সে।

‘কেমন আছিস ফারাজ?’

অপর পাশে চুপ রইলো। ফায়াদ অপেক্ষা করলো উত্তরের।বেশ খানিকটা সময় পর উত্তর এলো,
‘হুম আছি ভালো’

‘দেশে আসবি না?’

‘কার জন্য?’

‘কেউ নেই দেশে?মা, বাবা,আমি?’

‘মা-বাবা তোকে দেখলেই আমাকে দেখা হয়ে যাবে ভাই।আমি আর তুই একি তো।’

ফায়াদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘তোর আমাদের কথা মনে পড়ে না?’

‘পড়ে তো ভীষণ মনে পড়ে।সাথে তাকেও। দেশে গেলে তাকে অনুভব করতে পারবো কিন্তু ছুতে পারবো না৷ যেখানে তাকাবো শুধু তার স্মৃতি কিন্তু সে নাই। আমার সে নাই। দূরে থেকে যদি ভালো থাকা যায় খারাপ কি?’

ফায়াদ বেশ শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
‘ভালো আছিস তবে?’

ফারাজ বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। আশ্চর্য সামান্য একটা প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারছে না। কষ্টরা বুকে দানা বাধছে। ফায়াদ ফোনটা কেটে দিল। সে জানে ফারাজ এইটার উত্তর দিতে পারবে না। প্রশ্নটা মোটেও সামান্য ছিল না।
ফায়াদ মা কে ফোন দিল।ফোন দিয়ে জানালো টেনশন না করতে। সে আসছে বাসায়।
গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে৷ বেশ খানিকটা ভিজে গিয়েছে সে। গাড়ি স্টার্ট দিল সে। বাহিরে ঝুম বৃষ্টির শব্দ।মাতাল করা ঠান্ডা হাওয়া বইছে।গাড়ি চালানোর সময় অপরাজিতার কল এলো।
ফোন লাউডস্পিকারে দিয়ে গাড়ি চালানোতে মনোযোগ দিল সে। ফোন ধরতেই অভিযোগ করে উঠলো অপরাজিতা,

‘ আপনার ফোন ব্যস্ত কেন ছিল?’

ফারাজের সাথে কথা বলার সময় কল দিয়েছিল অপরাজিতা। ব্যস্ত পাওয়ায় তার এই অভিযোগ।

‘জরুরি কল ছিল।’

অপরাজিতা বিশ্বাস করলো। সে ফায়াদকে খুব বিশ্বাস করে।কেন করে তার জানা নেই।
‘আপনি বাহিরে? বৃষ্টির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি৷ কোথায় যাচ্ছেন?’

গাড়ি চালাতে চালাতেই তার সেই গম্ভীর আওয়াজে বলল,
‘হুম বাহিরে।গাড়ি চালাচ্ছি।বাসায় যাচ্ছি।’

অপরাজিতা মন খারাপ করে বলল,
‘কতদিন সামনে থেকে দেখি না আপনাকে। আপনাকে আমার ভীষণ মনে পড়ে।আপনার আমাকে মনে পড়ে না আমি জানি।’

মেয়েটার কথায় অভিমান ছিল।নিঃশব্দে হাসলো ফায়াদ। অপরাজিতার এক্সিডেন্টের পর থেকে তাকে বাসা থেকে বের হতে দেওয়া হয় না বিনা প্রয়োজনে। আর প্রয়োজন থাকলেও সাথে কেউ না কেউ থাকে।যার কারনে ফায়াদকে তার দেখা হয়ে উঠে না। কিছুদিন পর এইচএসসি হওয়ার কারনে বাসায় বসেই পড়ছে।আর টিউটর তো আছেই।

‘আমাকে দেখে কি করবা? পড়ো গিয়ে কাজে লাগবে।’

অপরাজিতা বিরবির করলো,
‘আর পড়া!মাথার মধ্যে আপনি ঢুকে বসে আছেন। রুই মাছের বৈজ্ঞানিক নাম পড়তে গিয়ে labeo rohita এর জায়গায় labeo fayad পড়ে ফেলি।’

ফায়াদ অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
‘কি সাংঘাতিক ব্যাপার!’

ফায়াদের কথা শুনে অপরাজিতা নিজের মুখে নিজে চড় মারলো। বিরবির করতে গিয়ে জোড়ে বলে ফেলেছে।এখন এই লোক যদি তাকে এটা নিয়ে খোটা দেয়?
‘দেখুন আপনি কিছু শুনেন নি।’

ফায়াদ ঠেশ মেরে বলল,
‘কিন্তু আমি তো শুনেছি।’

পরক্ষনেই অপরাজিতা আবার বলে উঠলো,
‘আচ্ছা শুনছেন ভালো করছেন। তবুও তো ভালোবাসেন না।’

আবারো এক নিরব অভিমান দেখালো মেয়েটা।ফায়াদ শুনলো সে অভিমান। মনের খুব গোপনে হয়তো লিখেও রাখছে অভিমানের কারন গুলো।কোনো একদিন হয়তো খুব যত্ন করে অভিমানিনীর অভিমান ভাঙাবে।

অপরাজিতা বিভিন্ন কথা বলছে। কথার এক ফাঁকে ফায়াদ বাধা দিল অপরাজিতাকে।

‘অপরাজিতা?’

‘হুম’

‘বারান্দায় আসো।’

‘বাহিরে বৃষ্টি তো!’

ফায়াদ আবারও বলল,
‘আসো।’

অপরাজিতা আসলো বারান্দায়। ফায়াদ খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল,
‘তাকাও।গাড়ির দিকে।’

অপরাজিতা নিচে তাকাতেই ফায়াদ গাড়ির গ্লাস টা নামিয়ে দিল। এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল অপরাজিতা। দেখতে পেল তার প্রনয় পুরুষকে, তার ডাক্তার সাহেবকে।ফায়াদকে এই মুহুর্তে সে আশা করে নি। ফায়াদ এখানে আসবে এটা তার ধারনার বাহিরে ছিল। বৃষ্টির ঝুম ছন্দে তার মনের মধ্যেও ছন্দ বেজে উঠছে।মানুষটা তার জন্য এসেছে? তার আবদার পূরণ করতে এখানে আসা?তবে কি মানুষটা তাকে ভালোবাসে? তার জন্যই এসেছে তো? সে যেন কথা বলতে ভুলে গেলো।তার মনের ইচ্ছা যে এভাবে পূরণ হবে সে ভাবে নি। বৃষ্টির ছাট এবং ঠান্ডা হাওয়া এবং সাথে মনের এই পাগল করা অনুভূতি সব মিলিয়ে অপরাজিতা যেন জমে গেল। সে থেমে থেমে বলল,
‘আ আপনি এএখানে?’

অপরাজিতা যখন বলেছিল যে তার ফায়াদকে ভীষন মনে পড়ে, তখনি ফায়াদ গাড়ি ঘুড়িয়ে নিয়েছিল অপরাজিতার বাসার রাস্তায়। কেন করেছে এতো কিছু ভাবে নি সে। মন বলেছে ‘যাও’, তাই সেও এগিয়ে গিয়েছে সেই পথে।এতোক্ষন সে অপরাজিতাদের বাড়ির পথেই চলছিল। অপরাজিতার মন খারাপ যেন তার সহ্য হচ্ছিল না। মন যেন বলছিল মেয়েটার ছোট্ট মনটা কষ্ট না পাক। দিলাম না হয় একটু দেখা!এইটাই কি শুধু কারন? নাকি তার অবচেতন মনও চাচ্ছিল মেয়েটার একটু দেখা পেতে।

‘কেউ একজন নাকি রুই মাছের বৈজ্ঞানিক নাম পড়তে পারছে না।তাই সে যাতে নামটা তাড়াতাড়ি শিখতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে এলাম।’

অপরাজিতা লজ্জা পেল। লজ্জায় মাথা নিচু করে আড়চোখে দেখছে ফায়াদকে। ফায়াদ আড়ালে হাসলো।দুজনেই চুপচাপ আছে ফোন কানে দিয়ে৷ একে অপরকে দেখছে।
হঠাৎ অপরাজিতা দাঁড়িয়ে গেল।ফায়াদকে বলল,
‘একটু অপেক্ষা করুন।’

বলে সে রুমে গেল। রুমের দরজা আটকে সাউন্ড বক্স ছাড়লো।তার রুমের দরজা আটকালে বাহিরে আওয়াজ যায় না। আবার ফিরে আসলো বারান্দায়।
মিউজিকের শব্দ শুনে ফায়াদ বলল,
‘এখন গান–‘

শেষ করার আগেই অপরাজিতা ফোনটা ঠোঁটের কাছে এনে ফিসফিস করে বলল,
‘হুশশ! Feel it!’

অপরাজিতার বলার ধরনে সে আর প্রতিবাদ করতে পারলো না। অন্যকিছু ছিল সে কথায়।অপরাজিতার কথাই মেনে নিল।মাঝে মধ্যে কিছু কথা মেনে নিতে ক্ষতি নেই। দারুন এক অনুভূতি খেলা করছে মনে।যেন সে নিজেকে ডুবোতে চাচ্ছে কারো মায়ায়।
বেজে উঠে ইংরেজিতে কিছু মন ভোলানো শব্দের মেলা,

‘I found a love for me..
Darling just dive right in
And follow my lead’

গানটা শুরু হতেই চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল অপরাজিতা। বৃষ্টির ছাট সাথে সেই রিমিঝিম মধুর শব্দ, পছন্দের গান আর আছে ফোনের অপর পাশে ভালোবাসার মানুষ। প্রকৃতি যেন ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
ফায়াদ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অপরাজিতার পানে। এতোটা মুগ্ধতা কি মেয়েটার মধ্যে আগেই ছিল? নাকি আজ প্রথম মেয়েটাকে এতোটা মুগ্ধতা নিয়ে দেখছে বলে এতো মুগ্ধ হচ্ছে সে! বৃষ্টির ছাট ছুয়ে যাচ্ছে মেয়েটাকে৷ মুখমণ্ডলে ছোট ছোট বৃষ্টির কণা।তা যেন সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে সেই মায়াবী ফুলের মতো চেহারার। ফায়াদ অনুভব করলো তার এতো বছরের জীবনে এতোটা মুগ্ধতা নিয়ে সে কাউকে দেখে নি।
কানে বাজছে,
‘Cause we were just kids when we fell in love
Not knowing what it was
I will not give you up this time
But darling, just kiss me slow
Your heart is all I own
And in your eyes, you’re holding mine’

হ্যা মেয়েটা তো বাচ্চা ই ছিল। তার তুলনায় এখনো খুব ছোট। তবে তার ভালোবাসায় পরিমাপটা বিশাল। যা একটু একটু করে কাবু করছে ফায়াদকে। হয়তোবা গোপনে গোপনে কাবু করেও ফেলেছে।

‘Baby, I’m dancing in the dark
With you between my arms
Barefoot on the grass
Listening to our favourite song
When you said you looked a mess
I whispered underneath my breath
But you heard it….’

অপরাজিতা বন্ধ চোখের পাতা খুললো।দৃষ্টিতে আটকালো ফায়াদের দৃষ্টি।চোখ সরালো না। দৃষ্টিতে দৃষ্টি আটকে থাকুক অনন্তকাল। সময়টা এখানেই থমকে থাকলে মন্দ হয় না। অপরাজিতা গানের সাথেই ফিসফিস করে বলল,
‘Darling, you look perfect tonight’

ফায়াদের কি হলো তার জানা নেই। তবে প্রথমবারের মতো কিছুটা অনুভূতি সেও ব্যক্ত করেই ফেলল।অপরাজিতার মতো সেও তার সম্মোহনী গম্ভীর কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
‘You too’

(চলবে)