ফাগুন ছোঁয়া পর্ব-০২

0
183

#ফাগুন_ছোঁয়া
#পর্ব_২
#লেখিকা_সারা_মেহেক

ভরা পূর্ণিমায় রাতের আকাশে চাঁদের সাথে লুকোচুরি খেলায় মত্ত হয়েছে নিকষ কালো মেঘ। চারপাশে মৃদুমন্দ শীতল হাওয়া বইছে। বোধহয় আশেপাশে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। এদিকেও মাঝে মাঝে গাঢ় মেঘ এসে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। হয়তো এ শহরে বৃষ্টি নামাতে পূর্বপ্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। কিন্তু এই অপূর্ব পূর্ণিমা রাতটি নিলীন করতে মেঘের আনাগোনা পছন্দ হলো না মিমের। সে আঁধারে পরিবেশে এক ঝুড়ি জ্যোৎস্না কুঁড়িয়ে নিতে ব্যস্ত ছিলো। তন্মধ্যে বৃষ্টির আগাম বার্তা তার পছন্দ হলো না। এমন নয় যে বৃষ্টি তার অপছন্দ। কিন্তু এই যে একটা পছন্দের বস্তু টপকে অপর একটা পছন্দের বস্তু যখন নিজের কর্তৃত্ব ফলায়, সেটা তার ভীষণ অপছন্দ।

হঠাৎ ফোনের রিংটোনে নিরিবিলি পরিবেশ ধ্বনিত হলো। ঈষৎ ধড়ফড়িয়ে উঠলো মিম। স্ক্রিনে চেয়ে দেখলো অপরিচিত একটি নাম্বার। সে সাধারণত এসব নাম্বার রিসিভ করে না। তাই সে কল রিসিভ নিয়ে মাথা ঘামালো না। ফোন রেখে দিলো মেঝেতে। এভাবে দুবার কল এলো। তৃতীয়বারে সে কিয়ৎ বিরক্ত হয়ে কল রিসিভ করলো। এপাশ হতে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ হতে পুরুষালি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
” এক্ষুণি নিচে নামো। আমি তোমার হোস্টেলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি৷ ”

অপরিচিত নাম্বার হতে হঠাৎ কল রিসিভ করার পর এমন ফরমাশ শোনায় থতমত খেয়ে গেলো মিম। কণ্ঠটাও ঠিক চিনতে পারলো না সে।তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞেস করে বসলো,
” কে আপনি? আপনাকে চিনি না আমি। আর এভাবে আদেশ দিচ্ছেন কেনো আমায়? রঙ নাম্বারে কল দিয়েছেন৷”
বলেই সে কল কাটতে গেলো। অমনিই ওপাশে আদ্রিশ এক গাল হেসে বললো,
” আরে! কল কেটো না। চিনতে পারোনি আমাকে? কি মেয়ে তুমি! হবু বরের কণ্ঠটাও ঠিক চিনতে পারো না! ”

মিম চমকালো। কিয়ৎক্ষণের জন্য সে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো। অতঃপর নিজেকে ধাতস্থ করে কয়েক সেকেন্ড পর বললো,
” আমার কোনো বর, হবু বর নেই। আপনার সাথে আজ কথা বলার পরও আপনি এমন করছেন কেনো?”

” আজকে কথা হয়নি ভালোভাবে। কি কারণে তুমি এমনটা করলে তা জানতে হবে আমাকে। আর তোমার সাথে আরো বিস্তারিত কথা বলার ছিলো। কিন্তু তুমিই চলে গেলে। তাই বাধ্য হয়ে তোমার হোস্টেলে আসতে হলো। ”

” আর কি বিস্তারিত কথা বলবেন? আমি বিয়েতে না বলে দিয়েছি। তাহলে এখানে দ্বিতীয় কোনো কথা বলার আর সুযোগ রইলো না৷ ”

ওপাশে আদ্রিশ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। খানিক অধৈর্য্য হয়ে পড়েছে সে। তবুও নিজেকে স্থির রেখে বললো,
” কিন্তু আমি ‘না’ করিনি। আমি এখনও আমার আব্বু আম্মুর সিদ্ধান্তে অটল আছি। এর মানে এই দাঁড়ায় যে, আমি তোমাকেই বিয়ে করছি। ”

আদ্রিশের শেষোক্ত কথাটি মিমের নিকট ভালো শোনালো না। ভীষণ ক্ষি’প্ত হলো সে। খানিক রুষ্ট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” জো’রজ’বর’দস্তি নাকি?”

মিমের রুষ্ট স্বরের প্রশ্নের আদ্রিশ মৃদু হাসলো। কয়েক পা পিঁছিয়ে এসে হোস্টেল গেটের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত হলুদ কলকে গাছের নিচে দাঁড়ালো। অতঃপর সিমেন্ট দিয়ে পাঁকা করা চার স্তরের ইটের গাঁথুনির উপর বসলো সে। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
” তুমি জো’র’জ’ব’র’দস্তি মনে করলে জো’রজ’ব’র’দ’স্তি’ই। যদিও আমাদের মাঝে এখনও এ ধরণের কথা হয়নি। আমি শুধু তোমার কাছে যুক্তিযুক্ত একটা কারণ শুনতে চাচ্ছি। ”

মিমের ক্ষুব্ধতা যেনো কিছুতেই কমছেই না। আদ্রিশ নামক ব্যক্তিটির উপর সে যারপরানই বিরক্ত ও অতিষ্ঠ। এমন বোধহয় অন্য কারোর বেলায় হয়নি যার উপর সে আকাশ পরিমাণ অসন্তুষ্ট নিয়ে কথা বলেছে।
ভাবলো, কি এক মানুষের পাল্লায় পড়লো সে! এ কেমন নাছোরবান্দা গোছের লোক! এই লোকের সাথে বিয়ে হলে যে সে সারাজীবন দুঃখে কষ্টে জীবন অতিবাহিত করবে তা ঢের বুঝতে পারছে সে।
এভাবে অনুরক্তিহীন আচরণ দেখিয়েও যখন সে দেখলো আদ্রিশ এরূপ তেতো কথা শোনার পাত্র নয় তখন সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখে মিষ্টি বুলি আনলো। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে পূর্বের তুলনায় বেশ নম্র কণ্ঠে বললো,
” দেখুন, আমি কিছুক্ষণ আগেই ওয়ার্ড থেকে ফিরেছি। এখন একটু রেস্ট নিবো। শরীরটা ক্লান্ত। আগামীকাল কথা বলি?”

আদ্রিশ জানে, মিম তাকে এড়িয়ে চলতেই এরূপ কথা বলছে। তার জানা আছে মিম কখন রুমে ফিরেছে। তাই সে বললো,
” মিথ্যা বলো না। তুমি ওয়ার্ড থেকে ফিরেছো আরো এক ঘণ্টা আগে। মেডিসিনে আছি তার মানে এই না যে সার্জারির কোনো খোঁজখবর রাখি না। যাই হোক, কথা না বাড়িয়ে দ্রুত নিচে আসো। তোমার ‘না’ বলার আসল কারণটা না জানা পর্যন্ত আমি এখান থেকে এক পা-ও নড়বো না। সো দ্রুত নিচে নামো।”

এবার মিমের রা’গে দুঃখে মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে মন চাইলো। হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁতে দাঁত পিষে নিজের অন্তঃক্রোধকে দমিত করার চেষ্টা করলো। আদ্রিশের এরূপ আচরণে সে যারপরনাই ক্ষিপ্ত। ফলে বিয়েতে ‘না’ করার সিদ্ধান্তটা সে পূর্বের তুলনায় আরো পাকাপোক্ত করে ফেললো। অতঃপর বললো,
” এই রাতে আমি নিচে নামতে পারবো না। কালকে কথা বলবো। ”

” আমি তোমার হোস্টেলের নিচেই দাঁড়িয়ে আছি। এমন নয় যে আমি হসপিটালে বসে তোমাকে ডাকছি। তাহলে আসতে কি প্রবলেম? আর আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা আমার জন্য সম্ভব না। কারণ আমার কাজে কিছুতেই মন বসছে না। আর একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট হয়ে তুমি নিশ্চয়ই চাও না যে আমার জন্য কোনো রোগীর ক্ষ’তি হোক?”

” অবশ্যই চাই না। কিন্তু কোনো রোগীর ক্ষ’তি হলে তার সম্পূর্ণ দায়ভার আপনার। আমাকে এর মধ্যে টানছেন কেনো?”

” কে বললো দায়ভার আমার? আমার এ সম্পূর্ণ অমনোযোগীতার কারণ তোমার ঐ একটা ‘না’। এবার এতো তালবাহান না বানিয়ে নিচে নেমে এসো। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না।”

” তো কে বলেছে আপনাকে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে?”

” আচ্ছা বাবা, কেউ বলেনি। আমিই নিজে এসেছি। এখন আমার আর ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিও না। তুমি জানো আমার ধৈর্য্য আছে। কিন্তু এ ধৈর্য্যেরও একটা লিমিট আছে। আর আমি চাই না সে লিমিট ক্রস হোক। সো বি কুইক।
আর হ্যাঁ, শোনো, তোমার ‘না’ বলার সঠিক ও যুক্তিসম্মত কারণ জানলে আমি তোমার সিদ্ধান্তে দ্বিমত জানাবো না৷ তখন তুমি যা বলবে তাই মেনে নিবো। ”
এই বলে আদ্রিশ কল কেটে দিলো। প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করে বললো,
” যাই বলো না কেনো, এতো সহজে তোমাকে ছাড়ছি না মিশমিশ। বিয়ে করলে একমাত্র তোমাকেই করবো,এটাই ফাইনাল ডিসিশন। তবে এর আগে তোমার এই ‘না’ কে ‘হ্যাঁ’ তে পরিণত করতে হবে। মনে হচ্ছে এ কারণে বেশ কাঠখড় পো’ড়া’তে হবে আমাকে। ”

ওদিকে আদ্রিশ কল কেটে দিতেই মিম ক্ষু’ব্ধ হয়ে ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেললো। এমন মহাঝামেলার পাল্লায় সে কোনোদিনও পড়েনি। এ এমন এক পরিস্থিতি যে সে তার পরিবারের সাথেও সরাসরি আলোচনা করতে পারছে না। কেননা সে এ ব্যাপারে অবগত যে তার পক্ষের যুক্তি শুনলে উল্টো তার পাশে না থেকে পরিবারের লোকজন তাকে বিয়ের দিকে আরোও ঠেলে দিবে। সে ভাবছে, কোন কু’ল’ক্ষ’ণে সময় আদ্রিশের পরিবার হতে বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো তার জন্য! এ হসপিটালে কি একমাত্র সে একাই ছিলো যে আদ্রিশকে তাকেই বিয়ে করতে হবে! এমন তো নয় যে আদ্রিশ তাকে পূর্বেই পছন্দ করতো। বরঞ্চ তাকে ঠিকভাবে চিনতোই না আদ্রিশ। অথচ এখন ভাবখানা এমন যে, এ বিয়ে না করলে আদ্রিশ বাঁচবেই না। তাহলে এতে কিসের জোরাজুরি?

নাহ, আজকে আদ্রিশের দফারফা করে তবেই দম ফেলবে মিম। মুখের উপর কিছু কথা শুনিয়ে আসবে। এই ভাবনা নিয়েই সে বোরকা পরে রুমে তালা ঝুলিয়ে নিচে নেমে আসলো। তাকে নিচে নামতে দেখে আদ্রিশ উঠে দাঁড়ালো। মুচকি হেসে তার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
” চলো কোথাও বসে কথা বলি। ”

মিম দৃষ্টি অন্যদিকে রেখে একরোখা গলায় বললো,
” আমি অন্য কোথাও যাবো না৷ কথা বললে এখানেই বলুন। ”

আদ্রিশ চোখ বুলিয়ে একবার চারপাশ দেখে নিলো। নাহ এখানে একান্তভাবে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। ডানে ফিরতেই তার নজর গিয়ে ঠেকলো হোস্টেলের দারোয়ানের রুমের উপর। সে এগিয়ে গিয়ে ভদ্রতাসূচক কণ্ঠে দারোয়ানকে অনুরোধ করলো,
” মামা? আমরা একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম। আশেপাশে কোনো জায়গা নেই, তাই বলছিলাম এ রুমটা কিছু সময়ের জন্য ছেড়ে দিলে ভালো হতো।”

হোস্টেলের দারোয়ান তখন আরামে বসে ফোনে নাটক দেখছিলো। হঠাৎ আদ্রিশের এমন অনুরোধ খানিক বিরক্ত হলেন তিনি।
দারোয়ান উঠে দাঁড়ালো। উঠতে উঠতে মিমের দিকে সন্দেহের চাহনিতে চেয়ে রইলো। উনার এ চাহনি সংক্ষেপ চট করে বুঝে ফেললো আদ্রিশ। তৎক্ষনাৎ এক গাল হেসে বললো,
” আরে মামা চিন্তা করবেন না। বাসা থেকে আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। কিছু কথা বলার জন্য এসেছিলাম এখানে। ”

দারোয়ানের সন্দেহ দূর হলো বোধহয়। সে বিস্তৃত হেসে বললো,
” আচ্ছা আচ্ছা কথা বলেন মামা। সমস্যা নেই। আপনি এই হাসপাতালের ডাক্তার না?”

আদ্রিশ সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো,
” জি মামা। ”

” ও আচ্ছা মামা। তাহলে কথা বলেন আপনারা। আমি একটু চা খেয়ে আসি। ”
এই বলে দারোয়ান বেরিয়ে গেলো। তিনি বেরিয়ে যেতেই আদ্রিশ ও মিম দুটো চেয়ারে মুখোমুখি বসে পড়লো।
এ মুহূর্তে মিমের প্রতি আদ্রিশের চাহনি যতোটা মুগ্ধতা ও প্রশান্তিতে ঘেরা, আদ্রিশের প্রতি মিমের চাহনি ঠিক ততোটাই বিরক্তি ও অশান্তিতে ঘেরা। এরূপ বিপরীত দুই অনুভূতি আশ্রিত মানুষের ভাগ্যরেখা ঠিক কোথায় গিয়ে ঠেকে সেটাই ভাবাচ্ছে দুজনকে।

®সারা মেহেক

#চলবে