ফাগুন ছোঁয়া পর্ব-০৩

0
159

#ফাগুন_ছোঁয়া
#পর্ব_৩
#লেখিকা_সারা_মেহেক

অদূরে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। রাতের আকাশে নিকষ কালো মেঘের আনাগোনা। পূর্ণিমার চাঁদ ঢাকা পড়েছে সেই মেঘের আড়ালে। আজ চাঁদ নিজেকে লুকিয়ে নিয়েছে পৃথিবীর সকল প্রেমিক যুগলের নিকট হতে। চারপাশে শীতল মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। সেই হাওয়ার তালে থেকে থেকে দুলে উঠছে কলকে গাছের ডালপালা।

গার্ড রুমে এ মুহূর্তে বিস্তর নীরবতা বিরাজ করছে। বাইরের ঝড়ো ঝড়ো প্রাকৃত নিস্বন ব্যতিত কারোর কর্ণকুহরে আর কিছুই প্রবেশ করছে না। আদ্রিশের ভীষণ বিরক্ত লাগছে এই নীরবতা। কিন্তু এই নীরবতা ভেঙে ফেলার মতো কথাও সে খুঁজে পাচ্ছে না।

এদিকে আদ্রিশের পাশে বসে মিম হৃদয়ের উথালপাতাল ঢেউকে শান্ত করতে চেষ্টা করছে। মনে মনে আওড়ানো প্রতিটি কথা যেনো সে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে দিয়েছে, যা এ মুহূর্তে একত্র করা অসম্ভব বোধ হচ্ছে।

প্রবাহমান হাওয়ার গতি বাড়লো। মিমের দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো বাইরে। আদ্রিশ এই সুযোগে তাদের দুজনের মাঝের নীরবতা ভাঙলো। বললো,
“ বাইরে অনেক সুন্দর বাতাস। যাবে বাইরে?”

মিম নত দৃষ্টিতে বসে ছিলো৷ সে অবস্থায় বললো,
“ উঁহু। এখন বোধহয় বৃষ্টি হবে।”

“ কেনো বৃষ্টি বুঝি ভালো লাগে না?”

“ লাগে। তবে এই রাতে বৃষ্টিতে ভিজতে চাচ্ছি না। যদি ঠাণ্ডা জ্বর লেগে যায়?”

“ সামান্য জ্বর ঠাণ্ডার প্রতি এতো ভয়!”

মিম দৃষ্টি তুলে আদ্রিশের পানে চাইলো। এক পলক আদ্রিশের মুখশ্রীর উপর দৃষ্টি বুলিয়ে পুনরায় দৃষ্টি নত করলো। মোলায়েম স্বরে বললো,
“ ভয় আছে তবে এই জ্বর ঠাণ্ডার প্রতি না। অসুস্থ হওয়ার প্রতি। হোস্টেলে অসুস্থ হলে বাসার মতো সেই সেবা যত্ন পাবো না। এ কারণে অসুস্থ হতে চাই না। আবার রোজ রোজ ক্লাস, ওয়ার্ড এসব তো আছেই।”

আদ্রিশ মিমের স্বরের পরিবর্তন দেখে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো। কেননা কিছুক্ষণ পূর্বেই সে ফোনে বেশ কঠোর গলায় কথা বলেছে। কিন্তু এখানে এসে তার কথার ঢং এ পরিবর্তন এসেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার!
আদ্রিশ কথা আগালো। বললো,
“ তাহলে তোমাকে হোস্টেলে থাকতে দেওয়া যাবে না৷ বিয়ের পর আমরা একটা বাসা নিবো। এখন তো মেসে থাকি। তখন…..”

মিম চট করে তাকালো। ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত করে বললো,
“ আমি কি এখন একবারও বলেছি আমি আপনাকে বিয়ে করবো?”

” বলোনি ঠিক। কিন্তু বলবে।”

মিম কিঞ্চিৎ বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,
“ এতো কনফিডেন্স!”

আদ্রিশ দৃঢ় প্রত্যয়ের সহিত বললো,
“ হ্যাঁ। এনি ডাউট?”

“ আপনি ডাউট রাখার সুযোগ দিলেন কোথায়?”
মিমের প্রশ্নে আদ্রিশ বিস্তৃত হাসলো।

কিছুক্ষণের মাঝেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। প্রকৃতি শীতলতায় ছেয়ে গেলো। মিমের দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো বাইরে। জানালার গ্রিল দিয়ে এক দৃষ্টিতে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পর্যবেক্ষণ করছে সে। অসময়ের এ বৃষ্টি দেখে হঠাৎ তার মনটা খারাপ হয়ে এলো। ঠিক কি কারণে তার মনটা খারাপ হলো সে উপলব্ধি করতে পারলো না। কেননা বৃষ্টি দেখে তার মন কখনো খারাপ হয়নি। বরঞ্চ এই বৃষ্টিই তার মন ভালো করে দিতো। অথচ আজ!

আদ্রিশ জিজ্ঞেস করলো,
“ শেষ বৃষ্টিতে কবে ভিজেছিলে?”

“ সম্ভবত গত বছর?”

“ আমাকে জিজ্ঞেস করছো?”

“ উঁহু, নিজেকে। ”

“আচ্ছা? কোনো কারণে কি তোমার মন খারাপ?”

মিম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো,
“ জানি না। ”

আদ্রিশ ফিরতি প্রশ্ন করলো না। খানিক সময় নিয়ে বললো,
“ বিয়েতে ‘না’ বলার কারণটা জানতে পারি?”

মিম এবার খানিক নড়েচড়ে বসলো। আদ্রিশের দিকে তাকাতেই আদ্রিশ যথাসম্ভব নম্র গলায় বললো,
” তোমার যা সমস্যা আছে আমার সাথে শেয়ার করতে পারো। আমি আমার পক্ষ থেকে পুরোপুরি চেষ্টা করবো যেনো তোমার সমস্যার সমাধান করতে পারি। যদি আমার পক্ষে সেটা সম্ভব না হয় তাহলে কথা দিচ্ছি, আমি নিজ দায়িত্বে বিয়ে থেকে পিছিয়ে আসবো। আমার মনে হয় এবার তুমি আমাকে নিজের সমস্যাটা বলবে?”
এই বলে সে তার প্রশ্নের জবাব জানার জন্য জিজ্ঞাসু চাহনিতে মিমের দিকে চেয়ে রইলো।
এদিকে আদ্রিশের পক্ষ হতে অকস্মাৎ এমন আশ্বাসিত প্রতিশ্রুতি পেয়ে মিম ঈষৎ বিস্মিত হলো। তাকে এই ভাবনা ভাবালো যে এই লোকটা এমন অদ্ভুত চরিত্রের কেনো! আজ সন্ধ্যায় এমনকি কিছুক্ষণ পূর্বেও মনে হলো তার পাশে বসা এই মানুষটা তাকে বিয়ে করেই ছাড়বে। কিন্তু এখন এমন আশ্বাস দিচ্ছে কেনো সে! অদ্ভুত!

আদ্রিশ এখনও মিমের দিকে জিজ্ঞাসু চাহনিতে চেয়ে আছে। মিমের পক্ষ হতে এখন অব্দিও কোনো জবাব না পেয়ে সে ভ্রু উঁচিয়ে চোখের ইশারায় জবাব জানতে চাইলো। মিম এতে খানিক অপ্রস্তুত হলেও বললো,
” জি সমস্যা নেই। তবে আশা করবো আমার সমস্যা শুনে আপনি আপসেট হবেন না। ”

আদ্রিশ মুহূর্তেই ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো,
” এমন কি আপসেট করার মতো কথা বলবে তুমি?”

” আছে কিছু কথা।”

” আচ্ছা। বলো, শুনছি তোমার কথা। ”

মিম এবার খানিক নড়েচড়ে বসলো। নিমিষের জন্য আদ্রিশের দিকে চেয়ে সাথে সাথেই দৃষ্টি নত করলো। একটা ঢোক গিলে আঙুলগুলো দিয়ে বোরকা খুঁটতে খুঁটতে বললো,
” বিয়েতে ‘না’ করার প্রধান কারণ ট্রাস্ট ইশ্যু। আমি মানুষকে সহজে বিশ্বাস করতে পারি না। বিশেষ করে ছেলেদের। তাই বলে নিজের মানুষদের নয়। বাইরের মানুষকে, অপরিচিত মানুষকে ট্রাস্ট করতে ভয় পাই। সাথে ভয়, ইনসিকিউরিট ফিলিংটা যেনো দিন দিন তীব্র হচ্ছে। ”
আদ্রিশ মিমের জবান হতে এমন কিছু শুনবে তা সে ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি। তাই তো তার মুখশ্রীতে ঈষৎ আশ্চর্যান্বিত একটা ভাব ফুটে উঠেছে। সে অদ্ভুত কিছু শুনেছে এমন ভাব ধরে জিজ্ঞেস করলো,
” এসব কারণে বিয়ে করতে চাইছো না তুমি!”

মিম দৃষ্টি তুলে নিষ্প্রাণ গলায় বললো,
” আপনার কাছে এগুলো ছোট কারণ মনে হলেও একটা মেয়ের কাছে এসব কারণ অনেক বড় একটা ফ্যাক্ট। আজকালকার যে পরিস্থিতি তাতে যেকোনো মেয়ের এমন ট্রাস্ট ইশ্যু হওয়া স্বাভাবিক। আমার এক বান্ধবীর অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছিলো। প্রথম প্রথম ওর স্বামী খুব ভালো হয়ে চললেও পরে ঠিকই তার আসল রূপ দেখায়। রোজ গায়ে হাত তোলা, অক’থ্য ভাষায় গা’লা’গা’লি করা যেনো ওর স্বামীর নিত্যদিনের কাজ। কিন্তু এতো কিছুর পরও আমার বান্ধবী কিছু করতে পারে না। কারণ সে এখন এক বাচ্চার মা। ও জানে ও প্রতিবাদ করলে ওর সে মুহূর্তেই ঘরছাড়া হতে হবে। হয়তো ডি’ভো’র্সও হতে পারে। আর এই ডি’ভো’র্স ওর বাচ্চার ভবিষ্যতে কতোটা প্রভাব ফেলবে তা ও ভালোভাবেই জানে। ঘটনা শুধু একটা না।
আমার এক পরিচিত খালা আছে, তার প্রেমের বিয়ে। কিন্তু তারপরও সে সুখী না। বিয়ের পর থেকেই সংসারে অশান্তি। মাঝে তো সেই খালু পর’কী’য়া করতে গিয়ে ধরাও পড়ে। এখন তাদের ডি’ভো’র্সের কথা চলছে। এখন আপনিই বলুন, কাছের মানুষগুলোর এতো অশান্তিময় সংসার জীবনের কথা শুনে কার ইচ্ছা করবে বিয়ে করতে? আর কার-ই বা ট্রাস্ট ইশ্যু হবে না?”

মিমের স্বপক্ষের যুক্তি শুনে আদ্রিশ অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার যুক্তির পক্ষে দাঁড়ালো। সত্যিই তো, একটা মেয়ে তার আশেপাশে এতো নেতিবাচক ঘটনার সম্মুখীন হলে তার উপর মানসিকভাবে এর খারাপ প্রভাব পড়াটা অযৌক্তিক কিছু নয়।

মিম কয়েক সেকেন্ডের জন্য বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় বললো,
” শুধু যে অন্যের জীবনের কাহিনি শুনে আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা কিন্তু নয়। আমার নিজের সাথেও এমন কিছু ঘটেছে।”

আদ্রিশ চমকিত হলো, বিস্মিত হলো। সে উদ্বিগ্ন চাহনিতে চেয়ে বিস্ময়ের সহিত জিজ্ঞেস করলো,
” কি হয়েছে তোমার সাথে? কে কি করেছে?”

মিম প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
” আমি কখনো রিলেশনশিপে বিশ্বাসী ছিলাম না। মানে বিয়ের আগে কখনো রিলেশনশিপে জড়াতে চাইনি। সবসময় এসব এড়িয়ে চলেছি। সেবারও যতোটা সম্ভব এড়িয়ে চলেছিলাম। এজন্যই বোধহয় বেঁচে গিয়েছিলাম।
এ কলেজেরই এক স্টুডেন্ট। আমাদের সিনিয়র। আপনি সম্ভবত ভালো করে চিনবেন। নাম বলতে চাই না তার। তবে সে এবার ইন্টার্নি করে বেড়িয়েছে।
এই তো ছয় মাস আগের কথা। ঐ ভাইয়ার সাথে আমি ফেসবুকে এড ছিলো। একদিন আমার এক স্টোরিতে রিপ্লাইয়ের মাধ্যমে আমাদের টুকটাক কথা শুরু হয়। তবে প্রয়োজনীয় যেমন পড়ালেখা, ডিউটি এসব বাদে কোনো কথা হতো না। আমিও ভালো বুঝে মাঝে মাঝে পড়া বুঝে নেওয়ার জন্য নক দিতাম। হঠাৎ একদিন উনি ইনবক্সেই আমাকে প্রপোজ করে বসেন। আমি তখনই নানাভাবে রিজেক্ট করে দেই। কিন্তু এরপরও কয়েকটা দিন আমার পিছনে পড়ে থাকেন উনি। ওয়ার্ডে এসেও সরাসরি কথা বলেন উনি। তবুও আমি রাজি হইনা। কেননা এসব আমার পছন্দ নয়। মাঝে মাঝে উনার কথা শুনলে মনে হতো উনি বোধহয় সত্যিই আমাকে পছন্দ করেন। কিছুক্ষণের জন্য এমনটা মেনেও নিয়েছিলাম আমি। কিন্তু পরে আমার ফ্রেন্ডদের সাথে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার পর জানলাম উনার আগে থেকেই গার্লফ্রেন্ড আছে। সে অন্য মেডিকেলে পড়ে। আর আপনি শুনলে অবাক হবেন, ঐ ভাইয়া আমাকে প্রপোজ করার দু সপ্তাহের মাঝে উনার গার্লফ্রেন্ডকে বিয়ে করে ফেলেন। পরে জানতে পারি, উনার গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা কাটাকাটি হওয়ায় ব্রেকআপ করেছিলেন উনি। আর এজন্যই আমার সাথে টাইম পাস করার জন্য আমাকে প্রপোজ করে। উনার এ কাজে আমি যে শুধু অবাক হই তা নয়। ভাবি, একটা মানুষ এতোটা নিকৃষ্ট কি করে হতে পারে! নিজের প্রয়োজনে, নিজের অলস সময় কাটানোর জন্য একটা মেয়েকে এভাবে ব্যবহার করবে সে! আমি যদি সেদিন রাজি হতাম তাহলে আজ হয়তো আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারতাম না। ভেঙে পড়তাম সম্ভবত। এটা ঠিক যে আমি উনাকে পছন্দ করতাম না। কিন্তু উনি তো আমায় প্রপোজ করেছিলেন। তবে কে জানতো, শুধু টাইম পাসের জন্য এমন করেছিলেন উনি। ঐ ঘটনার পর থেকে আমার বিশ্বাস আরো ঠুনকো হয়ে যায়। এবার আপনিই বলুন, কি করবো আমি? এমন অবস্থায় বিয়ের প্রতি, কারোর উপর কমিটমেন্টের প্রতি কি করে বিশ্বাস রাখা যায়?”

মিমের বাকি কথা শুনে আদ্রিশের আর বলার মতো কিছু রইলো না। সে নির্বাক চাহনিতে মিমের দিকে চেয়ে রইলো। চুপচাপ স্বভাবের মেয়েটির ভেতরে যে এরূপ ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা বাইরে থেকে কে বুঝতে পারবে!
আদ্রিশের মন খারাপ হলো। মিমের প্রতি ভীষণ মায়া হলো তার। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সে মিমের উদাসীন মুখশ্রী পানে চেয়ে রইলো। অতঃপর খানিক নড়েচড়ে মিমের দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে বসলো সে৷ হাসিমুখে বললো,
” দেখো, একজন দুজন এমন করেছে এর মানে এই না যে সবাই এমন হবে। তাই না?”

মিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দিলো,
” হাতের পাঁচটা আঙুল সমান হয় না, এটা আমিও জানি। কিন্তু ঐ একজন দুজনই আমার বিশ্বাস ভেঙে দিতে যথেষ্ট ছিলো।”

” শোনো, তোমাকে কারোর না কারোর উপর ভরসা করতেই হবে। তা না হলে কাকে তুমি জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিবে? এমন সন্দেহের জের ধরে বসে থাকলে তোমাকে সারাজীবন এভাবেই থাকতে হবে। আর নিশ্চয়ই তোমার ফ্যামিলি এমনটা চায় না।”

“ আমার ফ্যামিলি এমনটা চায় না। কিন্তু আমি চাই। সত্যি বলতে বিয়ে করে কাউকে যাচাই-বাছাই করার সাহস আমার নেই। বিয়ে মানে অনেক বড় একটা দায়িত্ব, সারাজীবনের কমিটমেন্ট। এখন সারাজীবন যার সাথে থাকতে হবে সে যদি ভালো না হয় তখন আমি কি করবো? বিয়ে করে আবার ডিভোর্স দিয়ে আসবো? আমি ডিভোর্সের তকমা নিতে চাই না। জানি এ সমাজ কেমন। তাদের আচরণ কেমন।”

” তুমি কি ইনডিরেক্টলি আমাকে খারাপ বলছো?”

” আপনাকে কখন খারাপ বললাম?”

“ তাহলে ভালো বলছো আমাকে?”

“ না। ভালোও বলিনি, খারাপও বলিনি। কেননা আপনার সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। আপনার ক্লাস করা অব্দিই আপনার প্রতি আমার ধারণা ছিলো। আর সেটা পড়াশোনা নিয়েই। চরিত্র নিয়ে নয়। ”

” কোনো অনুমান আছে আমার চরিত্র নিয়ে?”

“ চরিত্র নিয়ে অনুমান করে লাভ কি। ভালো চরিত্রের মুখোশ তো যে কেউ পরে থাকতে পারে। কি গ্যারেন্টি আছে যে আপনি সে মুখোশ পরে নেই?”

মিমের কথায় আদ্রিশ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই মেয়েটার বিশ্বাস অর্জন করতে যে তাকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে তাতে সন্দেহ নেই। সে এ ব্যাপারে আর ঘাঁটলো না।
চেয়ারটা সামান্য এগিয়ে নিয়ে বসলো মিমের দিকে বসলো আদ্রিশ। সামান্য গলা পরিষ্কার করে বললো,
” তোমার পক্ষের যুক্তি তো শুনলাম। এবার আমার বিয়ে করার পিছনে কারণটা কি সেটাও শুনো। আমার বিয়ে করার পিছনে কারণটা আমার আম্মু। আমার আম্মু হার্টের পেশেন্ট। আর আম্মুর স্বভাব খানিকটা খুঁতখুঁতে প্রকৃতির। মানে সহজে কিছু পছন্দ হয় না তার। কিন্তু সে আম্মুরই তোমাকে পছন্দ হলো। সেটাও একবার না দু বার। মানে ছবিতে দেখে তো পছন্দ করেছেই আবার সরাসরি দেখেও পছন্দ করেছে। সেদিন বিয়ের কথা পাকাপাকি করে এসে আম্মু খুশি মনে কাছের সব আত্মীয়, প্রতিবেশী সবাইকে বলে দিয়েছে যে সে ছেলের বউ ঠিক করে এসেছে। এমন অবস্থায় আমি কি করে না বলি তুমিই বলো। আর আমি এ কথাটা অস্বীকার করবো না যে তোমাকে আমার পছন্দ হয়নি। অবশ্যই তোমাকে সরাসরি দেখে পছন্দ করেছি বলেই আম্মুকে আর বাঁধা দেইনি। ”
এই বলে আদ্রিশ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।

মিম নত মস্তকে বসে আছে। তার মন মস্তিষ্কে হাজারো দুশ্চিন্তা, উৎকণ্ঠা, আড়ষ্টভাব বিরাজ করছে। সে জানে সে মস্ত বড় ইন্ট্রোভার্ট প্রকৃতির একজন মানুষ। কিন্তু আজ সে কি করে বসলো! আদ্রিশকে মনের মধ্যে চলা সকল চিন্তা, বি’ভ্রা’ন্তি, মনোভাব সকল বলে বসলো! কি আশ্চর্য! সে কখনো ভাবেনি এভাবে নিঃসংকোচে আদ্রিশকে সব বলে বসবে সে! নিজের এ কাজে সে নিজেই ভীষণ বিস্মিত হলো।
বেশ খানিকক্ষণ দুজনের মাঝে কোনোপ্রকার কথাবার্তা চললো না। হঠাৎ আদ্রিশই নিজ হতে বললো,
” শুনো, তুমি এখন রুমে যাও। একটু রেস্ট নাও, খাওয়াদাওয়া করো। নিজেকে একটু সময় দাও। এ নিয়ে ভাবো। প্রয়োজন হলে কোনো ফ্রেন্ডের সাথে এ বিষয়ে কথা বলো। সবদিক বিবেচনায় যদি তোমার মনে হয়, আমাকে বিয়ে করা উচিত না, আমি তোমার জন্য ভালো স্বামী বলে বিবেচিত হবো না তাহলে আমাকে জানিয়ে দিও। আমি আম্মুকে বলে এ বিয়ে থেকে পিছিয়ে আসবো। আর তুমিও তোমার ফ্যামিলিকে বলে দিও যে তুমি আমায় বিয়ে করতে পারবে না। তবে আমি পরামর্শ দিবো যে, এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ঠাণ্ডা মাথায় সব দিক বিবেচনা করে নিজের এবং সবার পরিস্থিতি দেখে তবেই হ্যাঁ বা না করবে। ঠিক আছে? ”

মিম বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ায়। আদ্রিশ পুনরায় বললো,
” আর হ্যাঁ, আজ থেকে বিয়ের জন্য তোমার উপর আমার পক্ষ থেকে আর কোনো জো’র’জ’ব’র’দ’স্তি হবে না। কেননা এখন আমি তোমার পক্ষের কারণটা জানি। তোমার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানি। এ অবস্থায় তোমার উপর বিয়ে নিয়ে চাপ সৃষ্টি করা একদমই মানায় না।”

এই বলে সে উঠে দাঁড়ালো। হাতের এপ্রোনটা গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে বললো,
” তুমি চাইলে আরো খোঁজখবর নিতে পারো আমার ব্যাপারে। তবে আমায় নিয়ে খারাপ কোনো খবর পাবে না আশা করি। আর হ্যাঁ, তোমাকে ছোট্ট করে একটা শিউরিটি দিয়ে যাই। আমার বিশ্বাস, তুমি আমাকে বিয়ে করলে কখনো ঠকবে না। আমি নিজের উপর এতটুকু বিশ্বাস রাখি যে আমি ওমন ছেলেদের মতো হবো না। আর ওমন হতে হলেও আমাকে হাজারবার ভাবতে হবে। কারণ আমার নিজেরও একটা ছোট বোন আছে। এ কারণে একটা মেয়ের কষ্ট বা ফিলিংস সম্পর্কে সামান্য হলেও ধারণা আছে আমার৷ যাই হোক, অনেক লম্বা লম্বা কথা বললাম। এবার আমি আসি। অনেকক্ষণ এসেছি ডিউটি রেখে। আল্লাহ হাফেজ।”
এই বলে আদ্রিশ বেরিয়ে গেলো। তবে পিছে মিমকে চরম দ্বি’ধা’দ্ব’ন্দে ফেলে গেলো।
®সারা মেহেক

#চলবে