ফাগুন ছোঁয়া পর্ব-৫+৬

0
123

#ফাগুন_ছোঁয়া
#পর্ব_৫
#লেখিকা_সারা মেহেক

অনাড়ম্বর সাজসজ্জায় সজ্জিত হয়েছে মিমের রুম। সেই রুমের খাটের উপর চুপচাপ বসেছিলো সে। দুশ্চিন্তায় ছিলো ভীষণ। হঠাৎ রুমে আদ্রিশের উপস্থিতিতে চমকে উঠলো সে। ভয়ে বুক দুরুদুরু কাঁপতে লাগলো। ভেতরে ভীষণ অস্থিরতা কাজ করলো। চিন্তাভাবনা সব এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে গেলো।
আদ্রিশ এসেই মিমকে সালাম দিলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মিম সালামের কি জবাব দিতে হয় সেটিই ভুলে বসলো। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে সালামের জবাব দিলো সে। আদ্রিশ এসে তার সম্মুখে বসলো। সরাসরি তার দিকে দৃষ্টি স্থাপন করলো। সে খানিক ভড়কে উঠলো। আদ্রিশের এহেন চাহনিতে সে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলো। সে দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। আদ্রিশ তবুও চেয়ে রইলো তার দিকে।

আদ্রিশের দৃষ্টি মিমের এ নতুন রূপের উপর। সে নিজের মাঝেই নিজেই ভীষণ অবাক হলো। এই কি সেই মেয়ে যাকে একদম সাধারণ রূপে কিছুদিন পূর্বে দেখে এসেছে সে! কি মায়াবী লাগছে তার মিশমিশকে! এখনও তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সামনে চুপচাপ বসে থাকা এই মেয়েটিই তার অর্ধাঙ্গিনী। বাকি জীবনটা এই মেয়েটার সাথেই তাকে কাটিয়ে দিতে হবে। সে কোনো ভ্রমে আছে কি না নিশ্চিত হতে মিমকে বললো,
” এই শোনো, আমার হাতে একটু চিমটি কা’টো তো।”

বাসর ঘরে সালামের পর চিমটি কাটার আবদার শুনে তব্দা খেলো মিম। বিস্মিত চাহনিতে ঘাড় ফিরিয়ে আদ্রিশের পানে চাইলো। তার দু চোখে বিস্ময় উপচে পড়ছে যেনো। আদ্রিশ তা খেয়াল করলো। তবে তার এ বিস্ময়ভাবকে পাশ কাটিয়ে বললো,
” আরে চিমটি কা’টো না!”

মিম ভারী বিস্মিত কণ্ঠে শুধালো,
” আশ্চর্য! আপনাকে চিমটি কা’টবো কেনো!”

” কা’টতে বলেছি, কা’টো আগে। ”

মিম দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলো না। আদ্রিশের হাতে চিমটি কাটলো। মিমের চিমটিতে আদ্রিশ তীব্র গোঙানি দিয়ে ব্যাথায় হাত সরিয়ে নিলো। হাতে ডলা দিতে দিতে অভিযোগের সুরে বললো,
” এতো জোরে দিতে বলিনি পাগলী। প্রথম দিনই দেখি অ্যা’টা’ক করে বসলে!”

মিম ভ্রুজোড়া কুঁচকালো। প্রতিবাদ করে খানিক উচ্চস্বরে বললো,
” অ্যা’টা’ক আমি করিনি। আপনি স্বেচ্ছায় আমার কাছ থেকে অ্যা’টা’ক করিয়ে নিয়েছেন। আবার আমাকে দোষ দিচ্ছেন! ”

আদ্রিশ মুহূর্তেই মিমের ওষ্টজোড়া হাত দিয়ে চেপে ধরলো। সাবধানী কণ্ঠে বললো,
” আস্তে আস্তে! এতো জোরে বলার কিছু নেই এখানে। আর সরি, তোমাকে দোষ দেওয়ার জন্য। আমি চিমটি দিতে বলেছি। তবে এতোটা জোরেও দিতে বলিনি। ”

মিম আদ্রিশের হাত সরিয়ে রাখলো। মুখ ঘুরিয়ে ফের অন্যদিকে নিলো। তবে তেরছাভাবে তাকিয়ে বললো,
” শুনুন, এভাবে নিজের দোষ কখনো অন্যের ঘাড়ে চাপাবেন না৷ বিশেষ করে আমার ঘাড়ে তো মোটেও না৷ আমার এগুলো পছন্দ না। চট করে রাগ হয়ে যায় এসব দেখলে।”

আদ্রিশ মিমের এ কথা বলার ধরণে ঠোঁট টিপে হাসলো। বিস্মিত হবার ভান করে বললো,
” তুমি রাগও করো! ”

মিম আদ্রিশের এহেন কথায় চট করে তার দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,
” কেনো? আমি রাগ করতে পারি না?”

” পারো, তবে তোমাকে দেখলে মনে হয় না এমনটা। ”

” ভালো। যাদের দেখলে রাগী মনে হয় না, শান্তশিষ্ট লাগে তারা রেগে গেলে কিন্তু ভয়ানক কিছু হয়ে যেতে পারে।”

আদ্রিশ মিমের দিকে সামান্য এগিয়ে এলো। ঠোঁট উল্টে বললো,
” তাই নাকি! তুমি ভয়ংকর কিছুও করে ফেলতে পারো! জানা ছিলো না তো।”

” অবশ্যই করতে পারি। এই যে এখন থেকে জেনে নিন এসব। ”

” আরো কিছু কি জানার বাকি আছে?”

” হুম। এখনও আমাকে পুরোপুরি চিনেননি আপনি৷ আর না আমি আপনাকে চিনেছি। দুজন দুজনকে চিনবো, জানবো। তারপর না কথা আগে বাড়বে।”

” আর কি কথা আগে বাড়বে। বিয়ে তো হয়েই গিয়েছে। ”

মিম এবার গোমড়ামুখে বললো,
” তা অবশ্য ঠিক বলেছেন। বিয়ে একবার হয়েই গিয়েছে। এখন চাইলেই আর পালানো সম্ভব না।”

আদ্রিশ সন্দেহের সুরে শুধালো,
” কেনো? তুমি কি পালাতে চেয়েছিলে?”

মিম তীব্র আত্মবিশ্বাসের সহিত বললো,
” আপনার মাঝে খারাপ কিছু পেলে আমি সত্যি পালিয়ে যেতাম। আর ভবিষ্যতে আপনার মাঝে খারাপ কিছু পেলে আমি একদম পালিয়ে যাবো। এই যে বলে দিলাম। ”

আদ্রিশ মিমের এহেন কথায় কয়েক মুহূর্তের জন্য নিশ্চুপ রইলো। নিষ্পলক মিমের দিকে চেয়ে রইলো। অতঃপর আচমকা মিমের ডান হাত নিজের বুকের রেখে উপর প্রগাঢ় কণ্ঠে বললো,
” সাহস আছে কারো পালিয়ে যাওয়ার! তাকে আমি এই বুকের খাঁচায় বন্দি করে রাখবো সারাজীবন। আমার জীবদ্দশায় সে কখনো এখান থেকে পালাতে পারবে না৷ ”

ভারী বিস্ময়ে মিম ড্যাবড্যাব করে আদ্রিশের পানে চেয়ে রইলো। আচমকা এমন কিছু আশা করেনি সে। খানিক সময়ের জন্য তব্দা খেয়ে বসে রইলো সে। আদ্রিশের দৃষ্টি বরাবর সে চেয়ে থাকতে পারলো না৷ তার দৃষ্টিতে যেনো এ মুহূর্তে তীব্র অধিকারবোধের দেখা মিলছে। মিম দৃষ্টি হটিয়ে নিলো।

আদ্রিশ কয়েক সেকেন্ড বাদে মিমের হাত ছেড়ে দিলো। অতঃপর অকস্মাৎ মিমকে চমকে দিয়ে আরেকটি কাজ করে বসলো। খানিক পিছিয়ে গিয়ে খাটের উপর পা উঠিয়ে মিমের কোলে মাথা রাখলো। ঘটনাটি বুঝতে মিমের কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। তার বুকের মাঝে ঢিপঢিপ শব্দ হলো। বোধহয় এই শব্দ বাইরেও শোনা যাচ্ছে। কে জানে, আদ্রিশও শুনতে পাচ্ছে কি না! আদ্রিশ শুনতে পারলে মানসম্মান নিয়ে টানাটানির একটা ব্যাপার হয়ে যাবে। কি লজ্জাজনক!

আদ্রিশ মিমের বিস্মিত মুখখানা দেখে মুচকি হাসলো। বিনাবাক্যে মিমের বা হাত খানা নিয়ে বুকের উপর রেখে দু হাত চেপে ধরলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অভিভূত কণ্ঠে বললো,
” বউয়ের কোলে মাথা রাখার মাঝে যে এতো সুখ আছে আগে জানা ছিলো না। প্রথম অনুভূতি এটা।”

মিম অন্যদিকে তাকিয়ে আছে৷ এলেমেলো চাহনিতে ঘরের এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘুরাচ্ছে। কেননা এভাবে আদ্রিশের দিকে চেয়ে থাকা অসম্ভব তার জন্য। ওদিকে বুকের ঢিপঢিপ শব্দ বেড়েই চলছে যেনো। বোধ হচ্ছে এখনই বুকের খাঁচা ছেড়ে পালিয়ে যাবে তার ছোট্ট হৃদয়খানা।
আশ্চর্যের বিষয় তার এ ধুকধুক শব্দ আদ্রিশের কান অব্দি পৌঁছালো। আদ্রিশ স্বাভাবিক কণ্ঠেই শুধালো,
” কি ব্যাপার মিশমিশ? তোমার হার্টবিটের শব্দ এখান থেকে শুনতে পারছি আমি। ভয় পাচ্ছো নাকি?”

মিম চট করে আদ্রিশের দিকে তাকালো। যেটার ভয় ছিলো শেষমেশ সেটাই হলো! এখন সে কি বলবে? এ শব্দ শুনতে পাবার কারণ কি বলবে সে? বুঝে পেলো না৷ নিশ্চুপ রইলো। আদ্রিশ বললো,
” বুঝতে পেরেছি, প্রথম এভাবে কাছে এসেছি সেজন্য ওমন ভয় করছে তোমার তাই না?”

মিম পুনরায় অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। মনে মনে বললো,
” জানেন যখন জিজ্ঞেস করলেন কেনো তাহলে?”

আদ্রিশ তখন অন্য কথায় চলে গেলো। পুনরায় কয়েক মুহূর্ত মিমের পানে চেয়ে থেকে বিমুগ্ধ কণ্ঠে বললো,
” কতক্ষণ পর মন ভরে তোমাকে দেখছি। ভাবছি, আদৌ কি তুমি আমার সামনে আছো নাকি আমার কল্পনায়। এজন্যই তখন চিমটি কা’ট’তে বলেছিলাম। জানো, যখন আমি কবুল বললাম, তখনও মনে হচ্ছিলো, সবটাই বুঝি কল্পনা। কখনো ভাবিনি এভাবে সময়টা চলে যাবে। এই তো মাত্র দু সপ্তাহ আগে তোমার সাথে আমার দেখা। তারপর আজ বিয়ে। এতোদিন যাকে জুনিয়র বা স্টুডেন্ট হিসেবে ট্রিট করেছি, আজ থেকে তাকে ওয়াইফ হিসেবে ট্রিট করতে হবে। কি ভাগ্য আমার! ”

মিম প্রত্যুত্তর জানালো না। আদ্রিশ এবার খানিক অভিমানী স্বরে বললো,
” কতক্ষণ যাবত তুমি কথা বলছো না। ব্যাপার কি?”

মিম এবারও জবাব দিলো না। আদ্রিশ এবার এক হাত ছেড়ে মিমের থুতনি ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো। বললো,
” কিছু তো বলো।”

মিম কোনোমতে জবাব দিলো,
” কি বলবো?”

” কিছুই কি বলার নেই?”

” উঁহু, নেই।”

আদ্রিশ এবার কি মনে করে জিজ্ঞেস করলো,
” আচ্ছা, তুমি কি লজ্জা পাও না? ”

মিম প্রশ্নাত্মক চাহনিতে আদ্রিশের পানে চেয়ে বললো,
” মানে?”

” মানে আবার কি? কখন থেকে দেখছি হয় তুমি ভ্রজোড়া কুঁচকিয়ে রাখো, না হয় ভয় পাও। কই একটু মিষ্টি মিষ্টি হেসে লজ্জা পাবে তা না। তোমার গালটা লজ্জায় লাল হয়ে যাবে, সেটাও দেখছি না। মেয়েদের তো এমন সিচুয়েশনে লজ্জায় লাল লাল টমেটো হয়ে যাওয়ার কথা। ”

মিম কি প্রত্যুত্তর জানাবে ভেবে পেলো না৷ এই যে আদ্রিশ তার কোলে এভাবে অধিকার খাটিয়ে মাথা রেখেছে তার তো লজ্জা লাগছে, ভয় লাগছে। কিন্তু সে ঠিক প্রকাশ করতে পারছে না। এখন বুঝি আদ্রিশকে জানান দেওয়ার জন্য সে লজ্জায় টমেটোর রূপ ধারণ করবে!
মিম খানিক সময় নিয়ে বললো,
” লজ্জায় লাল নীল হওয়া ফর্সা মেয়েদের দেখা যায়। শ্যামলা বর্ণে অতশত চোখে পড়ে না৷ ”

আদ্রিশ মিমের এ কথা মানতে নারাজ হলো। বলল,
” এ লজিক মানি না। আমার মনে হয় তুমিও লজ্জায় লাল হচ্ছো। তবে সব তোমার মেকআপের আড়ালে লুকিয়ে আছে। ”

মিম ডান হাত দিয়ে নিজের গালের ব্লাশঅনের উপর হাত রেখে বললো,
” মেকআপের আড়ালে লুকিয়ে নেই। এই যে দেখুন, গোলাপি গোলাপি ব্লাশঅন। আপনার যখন আমার লাজুক চেহারা দেখার এতোই ইচ্ছা হচ্ছে, এই যে দেখুন এর দিকে। আমি লজ্জা পাচ্ছি। ”

মিমের এহেন কান্ডে না পেরে আদ্রিশ হো হো করে হেসে উঠলো। তবে কিছু বলার পূর্বেই তার ফোনটা বেজে উঠলো। শেরওয়ানির পকেট হতে ফোন বের করে দেখলো আফসার স্যারের ফোন। সে দ্রুত উঠে বসে কল রিসিভ করলো। কল রিসিভ করতেই ওপাশ হতে আফসার স্যার বললো,
” আদ্রিশ, কোথায় তুমি?”

“স্যার, আমি একটু শহরের বাইরে আছি। ছুটিতে।”

” কতক্ষণের দূরত্বে আছো?”

” এই তো স্যার সর্বসাকুল্য পঁয়তাল্লিশ মিনিট। ”

” আচ্ছা। তাহলে এক্ষুণি হসপিটালে চলে আসো। ”

” কেনো স্যার! আমি তো ছুটিতে আছি। ”

” এখন ওসব ছুটির চিন্তা বাদ দাও। আমাকে ওটিতে এসিস্ট করতে হবে। আর কোনো জুনিয়র ডাক্তার নেই।”

” কি বলেন স্যার! রায়হান, হারুন ভাই ওরা নেই?”

” এভেইলেভল থাকলে তোমাকে ফোন করতাম না। আর জানোই তো, সবাইকে বিশ্বাস করা যায় না।”

” স্যার, ওটিটা কালকে সকালে করা যায় না?”

” না। বাইপাস সার্জারির পেশেন্ট। এক্ষুনি চলে আসো। আর কথা শুনতে চাই না।”
বলেই আফসার স্যার ফোন কেটে দিলো।

আদ্রিশ কিছুক্ষণের জন্য চুপচাপ বসে ছিলো। মিম আদ্রিশের এ নীরবতা দেখে শুধালো,
” কি হয়েছে?”

” হসপিটালে যেতে হবে। ”

মিম বিস্মিত হলো,
” এই রাতে!”

” হ্যাঁ। ওটি এসিস্ট করার মতো কেউ নেই। তাই স্যার ডাকছে আমাকে। ”

” কি পেশেন্ট? ”

” বাইপাস সার্জারির।”

“ওহ। যান তাহলে।”
মিম আর কথা বাড়ালো না। দেয়াল ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলো, দশটা ত্রিশ বাজে। খানিক মন খারাপ হলো তার।
আদ্রিশ গোমড়ামুখে বিছানা হতে নেমে শেরওয়ানি বদল করতে ওয়াশরুমে গেলো।
ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
” পছন্দের জিনিসগুলো মাঝে মাঝে এতো প্যারা কেনো যে দেয়!”

মিম তার এ কথা শুনতে পেলো। বললো,
” নিজেকে মানিয়ে নিন। ভবিষ্যতে আপনি যখন নিজেই ওটি করবেন তখন রাত বিরাতে যেতে হতে পারে।”

” হুম। এই হলো কার্ডিওলজি ইউনিটে যাওয়ার কুফল।”

” কুফল বলছেন কেনো। আপনার স্বপ্ন এই লাইনে আসার।”

আদ্রিশ দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

——

নিজেকে স্টেরিলাইজড করে ওটিতে প্রবেশে করলো আদ্রিশ। নার্স এসে তাকে ওটি ড্রেস পরিয়ে দিলো। আদ্রিশ গিয়ে দাঁড়ালো আফসার স্যারের মুখোমুখি। স্যার মাস্কের উপর হতে আদ্রিশকে একনজর দেখে জিজ্ঞেস করলো,
” বিরক্ত তুমি?”

জোরপূর্বক মেকি হাসি দিয়ে আদ্রিশ বললো,
” কি বলেন স্যার। বিরক্ত হবো কেনো। আপনার ওটি এসিস্ট করার সুযোগ সবাই পায় নাকি স্যার। আমি পেয়েছি৷ সুযোগটা কাজেও লাগিয়েছি।”

আফসার স্যার খুশি হলেন। বললেন,
” তাহলে শুরু করা যাক!”

আফসার স্যার প্রথমত পেশেন্টের পায়ে ইনসিশন দিয়ে স্যাফিনাস ভেইন হারভেস্ট করলেন৷ অতঃপর পায়ের কাজ শেষে তিনি পেশেন্টের বুকের মাঝ বরাবর স্কালপেল দিয়ে স্কিন ইনসিশন করলেন। স্টার্নোটমি করে বোন ওয়্যাক্স এপ্লিকেশন করলেন। অতঃপর ইনসিশনের দু পাশে রিট্র্যাক্টর দিয়ে ফাঁকা করে নিলেন। এরপর একে একে প্লুরা, মেডিয়াস্টিনাম ডিসেকশন করে পেরিকার্ডিয়াম ওপেন করলেন। এভাবে পুরো সার্জারি করতে উনার সময় লাগলো প্রায় চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা।
ওটি এসিস্ট করা শেষে ক্লান্ত আদ্রিশ এসে মেডিকেল অফিসারদের রুমে বসলো। ফ্রেশ হয়ে সেখানে রাখা খাটে গা এলিয়ে দিলো। কয়েক মিনিটের মাঝে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।
#চলবে

®সারা মেহেক

#ফাগুন_ছোঁয়া
#পর্ব_৬
#লেখিকা_সারা মেহেক

” কোথায় তুমি?”
আদ্রিশের অবসন্ন কণ্ঠের প্রশ্ন ফোনের ওপাশে মিমের কানে পৌঁছালো। মিম জবাব দিলো,
” ওয়ার্ডে আমি। ”

আদ্রিশ চমকে উঠলো। এক লাফে শোয়া হতে উঠে বসলো। জিজ্ঞেস করলো,
” আজকেই ওয়ার্ডে! ছুটিতে না তুমি?”

মিম এপাশে ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো,
” কিসের ছুটি? আমি কি আপনার মতো চাকরি করি নাকি যে বিয়ে উপলক্ষে চারদিনের ছুটি কাটাবো?”

” চারদিনের না হলেও আজকের দিনটা এটলিস্ট ছুটিতে থাকতে।”

” ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু আজকে দুটো আইটেম একসাথে হবে দেখে চলে আসলাম। রেগুলারে বসলে রিক্তা ম্যাম আইটেম নিয়ে বেশি ঝামেলা করে না। এজন্য আসলাম।”

আদ্রিশ এ ব্যাপার নিয়ে আর ঘাটালো না৷ জিজ্ঞেস করলো,
” কে দিয়ে গেলো সকালে?”

” আব্বু দিয়ে গিয়েছে।”

” ওহ। আচ্ছা শোনো।”

” জি বলুন।”
ততক্ষণে ওয়ার্ডে প্রফেসর স্যার চলে এলেন। মিম দ্রুত আদ্রিশকে বললো,
” স্যার চলে আসছে। আমি পরে কথা বলবো।”
বলেই আদ্রিশকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলো সে।
আদ্রিশের সামান্য মন খারাপ হলো। সে মিমকে লাঞ্চ অফার করতে চেয়েছিলো। কিন্তু সে সুযোগ পেলো কোথায়! পরে অবশ্য সে মিমকে ম্যাসেজ করলো,
” আজকে দুপুরে একসাথে লাঞ্চ করবো। কলেজ শেষ করে রেডি থেকো।”
এই ম্যাসেজ দিয়ে আদ্রিশ ওয়াশরুমে গেলো। ওদিকে মিম ওয়ার্ডে ক্লাস শেষ করে আদ্রিশের ম্যাসেজ দেখলো। কি কারণে কে জানে, কিন্তু আদ্রিশের ছোট্ট ম্যাসেজটি দেখে তার অধর কোনে স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠলো। সে উত্তর জানালো,
” আচ্ছা।”

———–

ক্লাস শেষে হোস্টেলে এসে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লো মিম। আদ্রিশ হসপিটালের বাইরে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। মিমকে দূর হতে দেখে মুচকি হেসে হাত নাড়ালো। যদিও মিম এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কিছু করেনি।

মিম এসে আদ্রিশের পিছনে বসলো, কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে। আদ্রিশ তখনও বাইক স্টার্ট করলো না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। মিম জিজ্ঞেস করলো,
” কেউ কি আসবে দেখা করতে?”

আদ্রিশ হেলমেটের ভেতর দিয়ে জবাব দিলো,
” না।”

” তাহলে স্টার্ট দিচ্ছেন না যে?”

” ভাবছি, বাইক স্টার্ট দিবো কি না। কারণ আমার পিছনে একটা মেয়ে বসে আছে যার কাছে আমি এখনও অপরিচিত, অবিশ্বাসযোগ্য। এমন অবস্থায় কিছু হয়ে গেলে সব দোষ আমার ঘাড়ে পড়বে।”

মিম আদ্রিশের কথার সুর ধরতে পারলো। ফলে খানিক এগিয়ে এসে বসলো সে। বললো,
” এবার চলুন তাহলে।”

” উঁহু, এখনও না।”

মিম এবার আদ্রিশের কাঁধে হাত রাখলো। বললো,
” এবার হয়েছে?”

” নাহ। এবারও হয়নি। তুমি কি কখনো রোমান্টিক মুভি দেখোনি নাকি?”
বলতে বলতেই আদ্রিশ ডান হাত দিয়ে মিমের হাত তার কাঁধ হতে সরিয়ে নিলো। তার উদরের হাত বসিয়ে দিয়ে বললো,
” এই যে এভাবে ধরতে হয় সামনের মানুষকে। একটু শক্ত করে ধরো যেনো পিছন থেকে কোনো অঘটন না ঘটে।”

মিমের খানিক অস্বস্তি অনুভব হলো। তবুও সে আদ্রিশের কথামতো শক্ত করে ধরলো তাকে। এরপর আদ্রিশ বাইক স্টার্ট দিলো।

রেস্টুরেন্টের পার্কিং লটে বাইক পার্ক করে মিমকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলো আদ্রিশ। দেখে দেখে কোনার দিকের একটা টেবিলে বসলো তারা। আদ্রিশ খাবার ওর্ডার দিলো। অতঃপর মিমকে জিজ্ঞেস করলো,
” তুমি কি জোর করে এসেছো আমার সাথে?”

মিম চারপাশ দৃষ্টি বুলিয়ে দেখছিলো। হঠাৎ আদ্রিশের এহেন প্রশ্নে সে থতমত খেয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলো,
” এমন কেনো মনে হলো আপনার?”

আদ্রিশ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললো। বললো,
” কেনো যেনো এমনটা মনে হলো। আচ্ছা, তুমি কি এখনও আমাকে একসেপ্ট করতে পারোনি?”

মিম স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলো,
” একসেপ্ট করবো না কেনো? কবুল বলে শরিয়ত অনুযায়ী বিয়ে হয়েছে। একসেপ্ট তো করতেই হবে।”

” অনেকটা জোরপূর্বক একসেপ্ট করছো তাই তো?”

” ব্যাপারটা সেরকম নয়। আপনার হয়তো এ কারণে মনে হয়েছে যে আমি আপনার সাথে কমফোর্টেবল না তাই। দেখুন, প্রথমত আপনি একজন ছেলে, আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। সে হিসেবে নিজেকে এ পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে একটু সময়ের প্রয়োজন। আপনি পূর্বপরিচিত বলে একদিনেই আপনার সাথে সেরকম মিশুক হওয়া সম্ভব না। এমনও না যে আমাদের রিলেশন ছিলো বলে বিয়ের পর আমরা খুবই ক্লোজ হয়ে যাবো। যেকোনো মেয়ের অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ পরবর্তী সময় কিছুটা এমনই যায়। এ বিষয়টা আপনাকে একসেপ্ট করতে হবে।”

মিমের ব্যবহারের কারণে ক্ষণিকের জন্য আদ্রিশের কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিলো। তবে মিমের কথাগুলো শুনে সে বুঝলো, আসলেই এমন পরিস্থিতিতে মেয়েদের মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগে। সে-ই বরং সবকিছু খুব দ্রুত আশা করছিলো। নিজের এ ভাবনার জন্য নিজেকে কিছুটা ভালোমন্দ শুনিয়ে দিলো সে।
গাম্ভীর্যপুর্ণ কিছু কথাবার্তা চলার পর দুজনের মাঝে উদ্ভট এক নীরবতা বিরাজ করলো। মিম এমন ধরণের মেয়ে যে এমন পরিস্থিতিতে কথা খুঁজে পায় না। আর আদ্রিশ এমন ছেলে যে এমন পরিস্থিতিতে পরিবেশটাই অন্যদিকে নিয়ে যায়। যদিও সর্বদা সে এরূপ কাজ করতে ব্যর্থ হয়। যেমনটা এ মুহূর্তে ঘটছে। বেশ ঘেঁটেঘুঁটেও কথা বের করতে পারছে না সে। অতঃপর বেশ কিছু সময় বাদে সে জিজ্ঞেস করলো,
” তোমাদের ক্লাসের সবাই আমাদের ব্যাপারে জানে? ”

মিম যেনো কিছুটা স্বস্তি পেলো। আড়ালে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
” সবাই জানে না। আসলে বিষয়টা ওভাবে সবাইকে বলাও সম্ভব না। কেউ কারোর মাধ্যমে জানলে সেটা এক ব্যাপার।”

” হুম। ঠিক বলেছো।”

” আপনার কলিগরা সবাই জানে?”

” হ্যাঁ, সবাই জানে।”

মিম কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” সবাই জানে! কার সাথে বিয়ে হয়েছে সেটাও জানে!”

আদ্রিশ হাসলো। বললো,
” হ্যাঁ সবাই জানে। তোমার সাথে যে বিয়ে হয়েছে সেটাও জানে।”

এবার মিম উদ্বেগপূর্ণ স্বরে বললো,
” একটা বিপদ ঘটিয়ে ফেললেন দেখি। এখন উনাদের সামনে যাবো কিভাবে!”

” কিভাবে যাবে মানে? হেঁটে হেঁটে যাবে।”

মিম তেরছাভাবে চেয়ে বললো,
” মজা না। সিরিয়াসলি বলছি।”

” তো আমিও মজা করিনি সিরিয়াসলি বলছি। ওদের সামনে যেতে কি সমস্যা?”

” ইশ, আপনি কি বুঝেন না? যখন জানবে এ কলেজের একটা স্টুডেন্টই আপনার ওয়াইফ তখন তারা কেমন নজরে তাকাবে না!”

” আশ্চর্য! কেমন নজরে তাকাবে কেনো। স্বাভাবিক একটা জিনিস। এমন কত সিনিয়র জুনিয়র, ডাক্তার স্টুডেন্ট বিয়ে হয়েছে এখানে। নরমাল এসব।”

” হতে পারে নরমাল। কিন্তু আমার…..”

” আহহা, অকারণে এতো চিন্তা কেনো? বাদ দাও এসব চিন্তা। লাঞ্চ এঞ্জয় করো।”

ততক্ষণে খাবার চলে এসেছে। ওয়েটার এসে খাবার দেওয়ার পর মিম নিকাব খুললো। আদ্রিশ তৎক্ষনাৎ গালে হাত দিয়ে মুগ্ধ হয়ে বললো,
” আহ, কতদিন পর দেখলাম তোমাকে! ”

আদ্রিশের এহেন কথায় মিম খানিক লজ্জা পেলো বোধহয়। মুখ ঘুরিয়ে ঠোঁট চেপে মুচকি হাসতে লাগলো। বললো,
” নাটক করবেন না। কালকে রাতেই দেখেছেন। একদিনও হয়নি এখনো।”

আদ্রিশ মিমের লাজুক হাসি দেখলো। টিপ্পনী কেটে বিস্মিত হবার ভান করে বললো,
” তুমি এমন লজ্জাও পেতে পারো!”

মিমের মুখখানা হতে চট করে হাসি উবে গেলো যেনো। ছোট ছোট চোখ করে বললো,
” আপনি মানুষটা আসলে খুবই খারাপ। এমন লজ্জা পেলেও দোষ। না পেলেও দোষ। খারাপ লোক একটা। হুহ।”

আদ্রিশ মিমের হেন কান্ডে ভীষণ হাসলো৷ বললো,
” আচ্ছা সরি সরি। এবার খাওয়া শুরু করো। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে খাবার।”

তারা খাবার খাওয়া শুরু করলো। খাবার মাঝে হঠাৎ কি মনে করে মিম জিজ্ঞেস করলো,
” আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি?”

আদ্রিশ মুখে খাবার পুরে নিতে নিতে বললো,
” হ্যাঁ করো।”

” আমি যে হিজাব পরি, নিকাব আপনার সমস্যা হয় না এতে?”

” না। সমস্যা হবে কেনো? এটা সমস্যা হওয়ার মতো কিছু?”

” না মানে অনেক ছেলেরাই এগুলো পছন্দ করে না। তারা চায় তাদের পার্টনারকে সবাই দেখুক। কেমন দেখতে সেটা সবাই জানুক।”

আদ্রিশ এবার খাওয়া বন্ধ করলো। স্বাভাবিক স্বরে বললো,
” আমি সেই ‘অনেক ছেলের’ মতো না৷ আমি চাই না আমার ওয়াইফকে কেউ দেখুক। তুমি কোনো প্রডাক্ট নাকি যে সবাই দেখবে আর কমেন্ট করবে তুমি দেখতে কেমন! আমি চাই, তোমার সৌন্দর্য, রূপ-গুণ সব আমিই দেখবো। বাইরের মানুষকে দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই। আমার এগুলো পছন্দ না। আর তোমার হিজাব পরা নিয়ে যদি আমার কোনো সমস্যা হতো তবে সেটা শুরুতেই ক্লিয়ার করে নিতাম। সো, বুঝতেই পারছো এসবে আমার কোনো সমস্যা নেই।”

মিম মনের মাঝে ভীষণ প্রশান্তি অনুভব করলো। আদ্রিশের এ মনোভাব তাকে মনের অজান্তে মুগ্ধ করলো। সে মনে মনে সবসময় এমনটাই চাইতো। ভাবতো, কখনো যদি বিয়ে হয় তবে তার এ বেশভূষায় যেনো তার স্বামীর কোনো ধরণের সমস্যা না হয়। সবসময় যেনো তার স্বামী তাকে সমর্থন করে। দিনশেষে আদ্রিশকে পেয়ে তার এ ছোট্ট মনোবাসনা পূরণ হলো।

খাওয়া শেষে আদ্রিশ বিল দিয়ে মিমকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। বাইকে করে মিমকে নিয়ে খালি একটা প্লটে ঘুরতে এলো।
চারপাশে শুধু ঘাস আর ঘাস। কিছুদূরে কয়েকটি আম গাছ ও বিশাল এক কাঠগোলাপ গাছ। সবুজে সবুজারোণ্য বিশাল জায়গাটির শেষপ্রান্ত দেখে বোধ হচ্ছে গাঢ় নীলচে আকাশ মিলিত হয়েছে সেখানে। দূরের ঐ জায়গাটির মিলিত স্থান সবুজ ও নীলচে রঙে রঙিন হয়েছে। শরীর শীতল করা হাওয়া বইছে চারপাশে। আকাশের সাদাসাদা মেঘকুঞ্জ ধীরেধীরে ভেসে যাচ্ছে।
প্রকৃতির রঙ মিশেল এ শীতল পরিবেশটি দারুণ পছন্দ হলো মিমের। সে বাইক হতে নেমে কয়েক সেকেন্ড আঁখিজুগল বুজে পরিবেশটি উপভোগ করলো।

আদ্রিশ বাইকের চাবি খুলে পকেটে রাখলো। মিমকে এক নজর দেখলো। জিজ্ঞেস করলো,
” আদ্রিশের মিসেস, আপনার হাতটি ধরার অনুমতি আছে কি? ”

মিম চট করে চোখ মেলে তাকালো। ক্ষণিকের জন্য সময় নিলো আদ্রিশের কথা বুঝতে। আদ্রিশ পুনরায় শুধালো,
” আপনি যদি অস্বস্তি বোধ না করেন তাহলে আপনার হাতটি কি ধরতে পারি? ”

মিম মৃদু হাসলো। তার হাসিতে হেসে উঠলো তার আঁখিজুগলও। সে নিরূত্তর রইলো। অকস্মাৎ আদ্রিশকে বিস্মিত করে আদ্রিশের হাতের আঙুলে আঙুল রাখলো। চেপে ধরলো আদ্রিশের হাত। মৃদুস্বরে বললো,
” প্রথম সম্মতির ছোঁয়া।”
®সারা মেহেক

#চলবে