ফিরে আসা ২ পর্ব-০৪

0
134

#ফিরে_আসা২

লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

দুশ্চিন্তা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে অরার মাঝে। সামনে বিশাল স্ক্রীনে সিনেমা চলছে, অথচ তার চোখদুটো বারবার গিয়ে পড়ছে আরশাদের ওপরে। অন্ধকারের জন্যে কিনা কে জানে, আরশাদের মুখভঙ্গি ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সিনেমাটা তার পছন্দ হচ্ছে তো? চাপা এক সংশয় কাজ করছে অরার মাঝে। যদিও আরশাদের চোখদুটো স্থির হয়ে আছে স্ক্রিনের দিকে।

আজ কে ফিল্মসের ব্যানারে নির্মিত নতুন সিনেমা ‘নক্ষত্রের’ প্রিভিউ করছে আরশাদ। প্রিভিউতে সাধারণত খুব বেশি মানুষ থাকে না। আরশাদ, অরা এবং কে ফিল্মসের ক্রিয়েটিভ টিমের সদস্যরা। এমনকি সিনেমার পরিচালকেও ডাকা হয় না। কেয়া, হাবিব এবং যুথী ক্রিয়েটিভ টিমের প্রথম সারির সদস্য। এরা সকলেই যেন অরার ছোট ভাই- বোনের মতো। এছাড়াও আরও অনেক মানুষ কাজ করছে এই টিমে। এদের মূল লক্ষ্য একটা সিনেমার গল্প, চিত্রনাট্যের মান যেন সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন হয় সেদিকে খেয়াল রাখা।

সিনেমার গল্প নির্ধারণে এই ক্রিয়েটিভ টিমের মতামতকে গুরুত্ব নিয়ে বিবেচনা করে অরা। তবে ‘নক্ষত্রের’ বেলায় ঘটেছে ব্যতিক্রম। এই সিনেমার গল্পটা সম্পূর্ণই অরার নিজের পছন্দ করা। কারোর বিন্দুমাত্র সাহায্য সে নেয়নি। এছাড়াও সিনেমার বড় বড় কয়েকটা সিদ্ধান্ত সে একাই নিয়েছে। এজন্যেই তার ভয়টা আজ একটু বেশিই। অবশ্য ভয়ের কোনো কারণ নেই। অর্ধেক সিনেমা শেষ হয়েছে, এখন পর্যন্ত কোনো খুঁত তার চোখে পড়েনি। এতটা আত্মবিশ্বাসী হওয়াও ঠিক নয়। আমাদের সবথেকে কাছের জিনিসের খুঁতগুলো আমাদেরই চোখ এড়িয়ে যায়।

সিনেমা শেষ হলো, স্ক্রিনে ভেসে উঠলো এন্ড টাইটেল।

অরা আরশাদের দিকে তাকিয়ে উদগ্রীব গলায় বলল, “কেমন হয়েছে? তোমার পছন্দ হয়েছে না?”

বেশ অনেকটা সময় চুপ করে রইলো আরশাদ। তার দেখাদেখি যেন এই ঘরের সকলে মৌনব্রত পালনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আরশাদকে দেখে মনে হচ্ছে যেন গভীর কোনো চিন্তায় ব্যস্ত তার মস্তিষ্ক।

অরা আবারও বলল, “আরশাদ?”

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “I’m disappointed.”

মনে মনে যেন প্রবল এক ধাক্কা খেল অরা। সে আশা করেছিল সিনেমা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আরশাদ হয়তো প্রশংসায় ভাসিয়ে ফেলবে সিনেমাটিকে। আরশাদ যে একেবারেই বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেবে, এটা ছিল তার ধারণারও বাইরে।

অরা হতবাক গলায় বলল, “Disappointed? কেন?”

আরশাদ গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, “গল্প কে পছন্দ করেছে এই সিনেমার? তুমি?”

অরা থতমত খেয়ে বলল, “হ্যাঁ।”

“তোমার মনে হয়, এটা কে ফিল্মসের স্ট্যান্ডার্ডের গল্প?”

অরা ভেবে পাচ্ছে না গল্পে সমস্যা কোথায়। কে ফিল্মস বরাবরই থ্রিলার গল্প পছন্দ করে। সেই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী তো গল্পটা ভালোই। দুই বোনের গল্প। সেবা এবং মেধা। হাজার প্রতিকূলতার মাঝে দুই বোনের বেড়ে ওঠা। বাবা একেবারে ছোটবেলায় মারা যাওয়ায় মা আবারও বিয়ে করেন। সৎ বাবার সংসারে কোনো মতে বেড়ে ওঠে তারা। একটা পর্যায়ে কীভাবে যেন সেবার প্রেম হয়ে গেল ধনবান ব্যবসায়ী রেহানের সঙ্গে। রেহানকে সে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসেনি। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল রেহানের সম্পত্তিতে নিজের নামটা স্থায়ী করা।

রেহান বোধ হয় সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিল তাকে। তাই হুট করে একদিন কাউকে না জানিয়ে তারা বিয়ে করে ফেলে। ওদিকে তাদের সৎ বাবা স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য কানাডায় চলে যাচ্ছেন। তাই মেধাকে নিজের সংসারে জায়গা দিতে বাধ্য হলো সেবা। এই দুই বোনের মধ্যে সম্পর্ক যে খুব ভালো, এমনটা নয়। দিনে খুব কম কথাই হয় তাদের মাঝে।

সব কিছু ভালোই যাচ্ছিল। আচমকা একদিন বাড়িতে নতুন অতিথির আবির্ভাব ঘটে। রেহানের মামা ইউসুফ সাহেব। তিনি না-কি কয়েক মাস এখানেই থাকবেন। নতুন অতিথির আগমের সেবার বিরক্তি আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল। তবে রেহানের মন জুগিয়ে চলার জন্যে ওপরে ওপরে সে মামার যত্নে কোনো ত্রুটি রাখলো না।

এক মাস পেরিয়ে গেল। হঠাৎ একদিন রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে, অথচ রেহান এখনো বাড়ি ফিরছে না। দুশ্চিন্তায় অস্থির সেবার ঘুম হারাম হয়ে গেল। রেহানকে বারবার ফোন করেও পাওয়া যাচ্ছে না। শেষ রাতের দিকে খবর এলো রেহানের গাড়ি না-কি অ্যাকসিডেন্ট করেছে। তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেবা মেধা আর মামাকে নিয়ে ছুটে গেল সেখানে। তবে তারা হয়তো একটু বেশিই দেরি করে ফেলেছিল। ততক্ষণে রেহানকে মৃত ঘোষণা করেছে ডাক্তার। কান্নায় ভেঙে পড়লো সেবা। ততদিনে হয়তো সে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিল রেহানকে।

পুলিশ পরদিন রেহানের গাড়ি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানতে পারে, গাড়িটা আগে থেকেই ব্রেক ফেইল করে রাখা হয়েছিল। তার মানে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে রেহানকে খুন করে অ্যাকসিডেন্ট নামে চালিয়ে দিতে চাইছে। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের সন্দেহের তীর গিয়ে পড়লো সেবার ওপরে। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, সম্পত্তির লোভে রেহানকে খুন করলেও করতে পারে।

পুলিশের তদন্ত চলছে, এরই মাঝে সকলকে অবাক করে আরেকটি তথ্য সামনে আসে। সেবাদের ছাদের চিলেকোঠায় না-কি পাওয়া গেছে ইউসুফ সাহেবের মৃতদেহ। মাথায় ভারী আঘাতের চিহ্ন। পুলিশের সন্দেহ দুই বোনের ওপরেই এখন সমান।

এর মাঝে অনেক ঝামেলা হয়। সেবাকে রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ তাকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। মেধা তার এক বন্ধুর সঙ্গে ঢাকার বাইরে পালিয়ে যায়। যদিও পুলিশ ঠিকই খুঁজে বের করে তাকে।

শেষে এসে পুলিশ আসল সত্যিটা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। রেহানের সম্পত্তির ওপর বরাবরই সেবার লোভ থাকলেও খুনটা সে করেনি। করেছে মেধা। রেহান অনেক দিন যাবত তাকে কুপ্রস্তাব দিচ্ছিল। মেধা প্রত্যেকবারই ফিরিয়ে দিয়েছে সেই প্রস্তাব। এক পর্যায়ে না-কি হুমকি-ধামকি শুরু করে রেহান। মেধা রাজি না হলে তাকে জোর করবে – এই জাতীয় হুমকি। একবার তো রেহান সব সীমা অতিক্রম করে মধ্যরাতে মেধার ঘরে ঢুকে পড়ে। বহুকষ্টে তার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে মেধা।

মেধা চাইলেই পারতো এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। খুন করার কোনো প্রয়োজন ছিল না তার। তবে বাড়ি ছেড়ে সে যাবে কোথায়? এই এত বড় শহরে তার জন্যে কোনো জায়গায়ই তো নেই।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, ইউসুফ সাহেবের খুনটাও তাহলে মেধা করেছে? না, তিনি খুব হয়েছেন সেবার হাতে। নিতান্তই রাগের বশে। প্রতিশোধ নেবার আকাঙ্ক্ষায়। সেবার মনে দৃঢ় ধারণা জন্মে গিয়েছিল সে মামাই খুন করেছে রেহানকে।

গল্পটা খারাপ কী? এই স্ট্যান্ডার্ডের থ্রিলার সিনেমাই তো এতদিন যাবত নির্মাণ করে আসছে কে ফিল্মস।

আরশাদ হতাশ গলায় বলল, “গল্পটার মধ্যে তবুও ডেপথ ছিল। কিন্তু গল্পটাই তো স্ক্রিনে ফুটে উঠলোই না। সাসপেন্স ক্রিয়েট করতে গিয়ে হাজারটা প্যাঁচ লেগে গেছে। এমন বাজে স্ক্রিনপ্লে তুমি কীভাবে অ্যাপ্রুভ করলে?”

স্ক্রিনপ্লে হলো সিনেমার চিত্রনাট্য। কোন দৃশ্যের পর কোন দৃশ্য আসবে, তার একটা তালিকা।

অরা নিচু গলায় বলল, “আমি ভেবেছি এই স্ক্রিনপ্লেটা পর্দায় ভালো লাগবে।”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুমি ভাবলে তো হবে না অরা। নয় মাস ধরে কাজ চলছে এই সিনেমার ওপর। এত হাই বাজেট দেওয়া হলো। গল্পই যদি ঠিক না থাকে, তাহলে ইনভেস্ট করে লাভ কী হলো?”

অরা চুপ করে রইলো। গল্প কি এতটাই খারাপ? তার পছন্দে কি তাহলে ভুল ছিল?

“আমি শিওর, এই সিনেমা এক সপ্তাহও হলে চলবে না। আর আমার প্রোডাকশন হাউসের সিনেমা মাত্র এক সপ্তাহ হলে চলছে, এটা তো আমি মেনে নিবো না। তার থেকে ভালো, সিনেমাটাকে রিলিজ দেওয়ারই দরকার নেই।”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে প্রিভিউ রুম থেকে বেরিয়ে গেল আরশাদ। গভীর চিন্তার মাঝে ডুব দিলো অরা। তার পছন্দ করা গল্পে এর আগেও খুঁত খুঁজে পেয়েছিল আরশাদ। তবে সে সময় তার দোষের ভাগীদার ছিল। আজ কেউ নেই। এই গল্প, এই চিত্রনাট্য সবটাই অরার একার পছন্দ করা।

অরা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “সমস্যাটা কোথায়? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”

যুথীও অরার চিন্তায় তাল মিলিয়ে বলল, “স্যার তো স্পেসিফিকালি কিছু বলেও গেলেন না। শুধু বললেন স্ক্রিনপ্লে বাজে।”

“একটা সিনেমার স্ক্রিনপ্লে পুরোপুরি বদলে দেওয়া সম্ভব না-কি?”

হাবিব ভয়ে ভয়ে বলল, “ম্যাম? আমার মনে হয় স্যারের ক্লাইম্যাক্সটা পছন্দ হয়নি।”

অরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ক্লাইম্যাক্স পছন্দ না হয়ে পারে কীভাবে? ক্লাইম্যাক্সটাই তো গল্পের প্রাণ।”

প্রিভিউ সেরে আরশাদ অ্যাকাউন্টেন্টের সঙ্গে মিটিংয়ে বসলো। সেই মিটিংয়ে অরাকে থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। নিজের কাজেও মন বসছে না। অরা ছোট ছোট পা ফেলে ছাদে চলে গেল। অফিসের মধ্যে থেকে থেকে তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। একটু খোলা হাওয়ার প্রয়োজন।

রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অনেকটা সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল অরা। সিনেমাটার মধ্যে ভুল কী আছে? এখনো ভুলগুলো চিহ্নিত করতে পারছে না সে। অথচ এটা তো কোনো ভালো সিইওর লক্ষণ নয়। একজন ভালো সিইও অচিরেই নিজের ভুলগুলোকে চিহ্নিত করতে পারে, এবং ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।

অরার এলোমেলো চিন্তায় ছেদ পড়লো কারও স্পর্শে। আচমকা ছাদে এসে পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরেছে আরশাদ। একমুহূর্তও অপচয় না করে মুখ ডুবিয়ে দিয়েছে অরার চুলের মাঝে। নিমিষেই একরাশ মুগ্ধতা আর প্রশান্তি খেলে গেল অরার সমস্ত শরীরে।

আরশাদ মোহনীয় গলায় বলল, “বাসায় যাবে না?”

অরা অভিমানী স্বরে বলল, “এতগুলো মানুষের সামনে আমাকে ঝাড়ি মেরে এখন এবার আহ্লাদ দেখাচ্ছে!”

আরশাদ অরাকে তার দিকে ঘুরিয়ে সুন্দর একটা হাসি হেসে বলল, “খুব বেশি রাগ করছো?”

অরা চুপ করে রইলো।

আরশাদ হাসি হাসি গলাতেই বলল, “রাগ করার কী আছে তাই তো বুঝলাম না! আমি তো আমার বউকে ঝাড়ি মারিনি। মেরেছি আমার কোম্পানির সিইওকে। তুমিও তোমার হাসবেন্ডের কাছে ঝাড়ি খাওনি। ঝাড়ি খেয়েছো তোমার বসের কাছে।”

অরা বিরস গলায় বলল, “জীবনটাকে সিনেমা পেয়েছো, যে একেকজন আলাদা আলাদা চরিত্র থাকবে?”

“জীবনটা সিনেমা না হলেও সবার কিন্তু আলাদা আলাদা রোল আছে অরা। তোমাকে সেই রোলগুলো মিলিয়ে ফেললে চলবে না।”

ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে অরা বলল, “আচ্ছা আরশাদ? তোমার কি সিনেমাটা একেবারেই পছন্দ হয়নি?”

“একেবারেই যে পছন্দ হয়নি তা না। তবে অনেক খুঁত আছে।”

অরা ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “ধরিয়ে দাও খুঁতগুলো! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“এখানে দাঁড়িয়ে? ভেতরে চলো।”

“এখানেই থাকি না প্লিজ! সারাদিন বসে থাকতে থাকতে আমি বিরক্তি হয়ে গেছি।”

সাধারণত অরার এমন অন্যায় আবদারে সায় দেয় না আরশাদ। তবে আজ এক বিচিত্র মায়া খেলে বেড়াচ্ছে মেয়েটার চোখেমুখে। সে মায়ার কাছে পরাজয় স্বীকার করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

আরশাদ গুছিয়ে বলতে লাগলো, “আগেই বলেছি, গল্পটা একেবারে খারাপ না। খারাপ হলো তোমার স্ক্রিনপ্লে। স্ক্রিনপ্লেতে কোনো প্লট টুইস্ট নেই, কোনো মিস্ট্রি নেই। দেখে মনেই হয় না কোনো থ্রিলার সিনেমা দেখছি। আর তাছাড়া ক্লাইম্যাক্সটাও যা তা! দুটো খুন দুজনে করলো।”

“আমার তো এই ব্যাপারটাই ভালো লেগেছে। দর্শক ভাববে কোনো একজন খুনগুলো করেছে। কিন্তু যখন দেখবে দুজনেই খুনি, তখন নিশ্চয়ই অবাক হবে।”

“হবে না অরা। বরং আরও বিরক্ত হবে। দেখো, দর্শক যখন থ্রিলার সিনেমা দেখে তখন মনের অজান্তেই তারা সিনেমার শুরু থেকে একজনকে সাপোর্ট করে আর একজনকে ঘৃণা করে। তারা যাকে সাপোর্ট করে, সেই যদি শেষমেশ খুনি হয় তাহলে তাদের কাছে মজা লাগবে। কিন্তু এখানে দুজনেই খুনি। সিনেমা শেষে তাদের মনে ভালো অনুভূতিও থাকবে না, খারাপ অনুভূতিও থাকবে না।”

অরা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “কিছুই বুঝতে পারছি না।”

আরশাদ অরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “এখন কিছুই বুঝতে হবে না। বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও। আর কাল স্ক্রিপ্ট রাইটার আর ডিরেক্টরকে আসতে বলো। আমি নিজে ওদের সাথে বসবো।”

অরা শুকনো মুখে বলল, “রিশুট করতে হবে?”

“রিশুট তো করতেই হবে।”

রিশুট একটা সিনেমার জন্যে সুখবর নয়। কে ফিল্মসের ইতিহাসে খুব কম সিনেমাই আছে সেগুলোর নতুন করে দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে। ‘নক্ষত্র’ সেই তালিকায় নতুন নাম।

অরার খারাপ একটু বেশিই লাগছে, কারণ এই সিনেমার থেকে তার আশাটাও ছিল বেশি। তার ধারণা ছিল, প্রথম দর্শনেই পছন্দ করবে আরশাদ। সেন্সর বোর্ডও প্রশংসিত হবে। অথচ বাস্তবটা একেবারেই ব্যতিক্রম। দীর্ঘদিন ব্যর্থতার সম্মুখীন না হতে হতে অরা যেন ভুলেই গেছে এর স্বাদ। আজ পাচ্ছে। এবং সেই তিক্ত স্বাদ ভালোই ভোগাচ্ছে তাকে।

বাড়ি ফিরে আরশাদ বেশ অনেকটা সময় দিলো কথাকে। মেয়েটা আজকাল কেবলই মোবাইল ফোনের মাঝে ডুবে থাকে। বাচ্চাদের মোবাইল আসক্তি কমাবার উপায় কী কে জানে? কথার কাছ থেকে মোবাইল নিতে গেলে সে একেক করে বর্ষণ করতে থাকে হাজারটা অজুহাতের।

বাবু এসে গেলে হয়তো কথার এই আসক্তি কমবে। স্কুল থেকে ফেরার পর থেকে বেচারি একা, তার কোনো খেলার সঙ্গী নেই। বাবু এলে তো তাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হবে কথাকে।

আজ বাবাকে পেয়ে যদিও মোবাইলটা নিজে থেকেই দূরে সরিয়ে রেখেছে। বসার ঘরের সোফায় কথা আরশাদের কোলে বসে এলোমেলোভাবে গল্প করেই যাচ্ছে। তার স্কুলের গল্প, কার্টুনের গল্প – গল্পের কোনো কমতিই নেই তার কাছে।

পাশের সোফায় বসে চিন্তিত ভঙ্গিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে অরা। তার চোখেমুখে যেন একখণ্ড কালো মেঘ দৃশ্যমান হয়ে ফুটে উঠেছে। কোনো কিছুতেই মন বসছে না। মাথায় কেবল একটাই চিন্তা – এত বড় একটা ভুল সে কী করে করলো?

আরশাদের চোখদুটো মনের অজান্তেই গিয়ে পড়লো পাশে বসে থাকা চিন্তিত মুখটার দিকে।
উদ্বেগের প্রবল ঢেউ খেলে গেল তার মাঝে। এই মেয়েটার চোখেমুখে দুশ্চিন্তা মানায় না।

আরশাদ উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “কী ব্যাপার অরা? বাসায় আসার পর থেকে মুখ গোমড়া করে বসে আছো!”

অরা কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই কথা আগ্রহ নিয়ে বলল, “বাবা জানো, আমাদের ক্লাসে মিস বকলে আমার ফ্রেন্ডরাও অরার মতো মুখ গোমড়া করে থাকে।”

কথার এই কথাটায় আরশাদ এবং অরা দুজনেই হেসে ফেলল।

আরশাদ মজার ছলে বলল, “শুধু তোর ফ্রেন্ডদেরই বকে? তোকে বকে না?”

“আমাকে বকবে কেন? আমি তো গুড গার্ল। আচ্ছা অরা? তোমাকেও কি কেউ বকেছে।”

অরার হয়ে আরশাদ উত্তরটা দিয়ে বলল, “বকেছে হয়তো।”

“কে?”

“হবে কোনো বদ! তুই কার্টুন দেখ তো।”

কথার মন চলে গেল টিভির স্ক্রিনে ভেসে ওঠা কার্টুনের দৃশ্য। আরশাদ কথাকে সোফায় রেখে পাশের সোফায় গিয়ে বসলো।

একহাতে অরাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“এখনো ওই ব্যাপারটা নিয়ে রাগ করে আছো?”

অরা হালকা গলায় বলল, “আরে ধুর! ওটা আবার রাগ করার মতো কোনো বিষয় হলো না-কি?”

“তাহলে?”

“তাহলে কী?”

“তাহলে মুখ গোমড়া করে আছো কেন?”

“ভাবছি।”

“কী ভাবছো?”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অরা শুকনো গলায় বলল, “আরশাদ তোমার কি মনে হয় আমি এত বড় একটা পজিশনের যোগ্য?”

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আরশাদ বিরক্ত গলায় বলল, “আবার শুরু করলে?”

অরা নিজের যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করে বলল, “না, তুমি নিজেই একবার ভেবে দেখো। আমার একার কোনো ক্যাপাবিলিটি নেই। এই প্রথম আমি একটা গল্প পছন্দ করলাম, নিজে ইনভলভ থেকে একটা সিনেমাকে দাঁড় করালাম। কিন্তু…”

“এই প্রথম মানে? এর আগেও তো কে ফিল্মসের প্রত্যেকটা সিনেমার গল্প তুমি পছন্দ করেছো।”

“প্রত্যেকবার আমার সাথে ক্রিয়েটিভ টিম থাকে। একটা গল্প পছন্দ করার আগে আমি ওদের সবার মতামত নেই। তোমার হেল্প নিই। কিন্তু এবার আমি কারোর হেল্প নিইনি। শুধুমাত্র নিজে পছন্দ করেছি। স্ক্রিনপ্লেটাও আমি একাই অ্যাপ্রুভ করেছি। সেটাও ভুল।”

আরশাদ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “তোমাকে একা সব কাজ করতে হবে কেন অরা? প্রত্যেকটা সেক্টরে দক্ষ টিম আছে তোমার।”

অরা ব্যর্থ ভঙ্গিতে বলল, “নিজেকে টেস্ট করতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমার একার ডিসিশনই হয়তো যথেষ্ট।”

“একটা কোম্পানি কখনো একজন সিইওর ওপর নির্ভর করে দাঁড়াতে পারে না অরা। কোম্পানি মানেই তো টিমওয়ার্ক। আর তাছাড়া ভুল তো তুমি আগেও করেছো। একটা মানুষ প্রত্যেকবার সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে, এটা সম্ভব না-কি?”

অরা পরাজিত ভঙ্গিতে বলল, “আরশাদ আমার মনে হয় আমি এতবড় একটা কোম্পানির সিইও হওয়ার যোগ্য নই।”

আরশাদ তার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “অরা! আড়াই বছর ধরে একা হাতে পুরো কোম্পানিটা সামলাচ্ছো তুমি। কত ব্যবসাসফল সিনেমা এসেছে তোমার হাত ধরে! এত সাফল্যের মাঝে ছোট্ট একটা ব্যর্থতা এলো। ব্যর্থতা তো আসবেই, না এলে তুমি শিখবে কী করে? সাফল্যের আসল মজাটা বুঝবে কীভাবে? তাই বলে এতটা ভেঙে পড়তে হবে?”

অরা চুপ করে রইলো। আরশাদের বলা প্রতিটা শব্দ সত্য। ব্যর্থতা আছে বলেই তো সফলতা এতটা সুন্দর। জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে সকলেই ব্যর্থ হয়। তবুও যেন এই ব্যর্থতাটা মেনে নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে অরার।

আরশাদ অতীতে ফিরে গিয়ে বলল, “আড়াই বছর আগে যখন ঘোষণা দিলাম প্রোডাকশন হাউজ খুলতে যাচ্ছি, আমার কোম্পানির ম্যানেজার তুমি। তখন অনেকেই প্রশ্ন করেছিল, তোমাকেই কেন সিইও বানালাম। আমার তো উচিত ছিল আরও এক্সপেরিয়েন্সড কাউকে সিইও করা।”

অরা আঁতকে উঠে বলল, “সেটাই তো! আমারও মনে হয়…”

অরাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আরশাদ বলল, “কথা শেষ করতে দাও অরা।”

আবারও চুপ মেরে গেল অরা।

আরশাদ তার মোহনীয় কণ্ঠে সুন্দর করে গুছিয়ে বলল কথাগুলো, “যখন আমার ম্যানেজার ছিলে তখন থেকেই তোমার ডেডিকেশন আমাকে মুগ্ধ করে। আমার টিমে মোটামুটি সবাই ফাঁকিবাজ টাইপের। একমাত্র তুমিই ছোটবড় প্রত্যেকটা কাজ গুরুত্বের সাথে করতে। তখন থেকেই তোমার ওপর একটা ভরসা জন্মে গিয়েছিল। একটা ব্যাপারই কেবল অবাক করতো আমাকে, ঢাকার বাইরে হাজার প্রতিকূলতার মাঝে বেড়ে ওঠা একটা মেয়ে কীভাবে নিজেকে কাজের পরিবেশে এত সহজে খাপ খাইয়ে নিলো। আমি জানতাম, এই নতুন দায়িত্বটাকে বিন্দুমাত্র অবহেলা করবে না তুমি। আমি মনে করি, বড় কোম্পানির সিইও হতে হলে এক্সপেরিন্সের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন ডেডিকেশনের।”

আরশাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরা। তার চোখজুড়ে ছলছল করছে অবাধ্য অশ্রুগুলো। এই মানুষটা কখনোই, কোনো পরিস্থিতিতেই ভেঙে পড়তে দেয় না তাকে। পরম যত্নে আগলে রেখে সাহস যোগায়।

আরশাদের বুকে মাথা রেখে অরা অন্যরকম গলায় বলল, “ভাগ্যিস তুমি ছিলে! না হলে কী যে হতো আমার!”

মসৃণ হাসি হেসে আরশাদ বলল, “না থেকে আর উপায় কী?”

(চলবে)