ফিরে আসা ২ পর্ব-১০+১১+১২+১৩

0
123

#ফিরে_আসা২
১০+১১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

কাঁচে ঘেরা স্মোকিং জোন। শহরের বড় বড় রেস্টুরেন্টগুলোতে এমনই কাঁচে ঘেরা বিশাল স্মোকিং জোন থাকে। নামে স্মোকিং জোন হলেও বিন্দুমাত্র সিগারেটের গন্ধ আসছে না জায়গাটা থেকে। এই তিনতলা রেস্টুরেন্টের দোতলাটা আজ সারাদিনের জন্যে রিজার্ভ করে রেখেছে অরা। এই মুহূর্তে সেই স্মোকিং জোনেই বসে আছে সে।

দ্বিধা-দ্বন্দ আর দোনমনো নিয়ে দুটো দিন কাটিয়ে দেওয়ার পর আজ অরার মনে হলো, একটা সিদ্ধান্তে এবার আসতেই হবে। এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকা যাবে না। নওশীনের সঙ্গে কথা দেখা করবে কিনা এই নিয়ে সিদ্ধান্ত।

সীমা ঠিকই বলেছিল, নওশীন মানুষটা ভয়ঙ্কর। ওই মানুষকে এক মুহূর্তের জন্যেও ভরসা করা যায় না। হয়তো এখনো তার মাথায় কোনো কুবুদ্ধি ঘোরাফেরা করছে। নওশীনের এখনো চাইছে কোনো না কোনো উপায়ে আরশাদের জীবনে ফিরে আসতে। আবারও নতুন করে অরার ক্ষতি করতে। তার সেই নতুন প্ল্যানের অংশ হিসেবে কথার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে।

নওশীনের কীর্তি-কলাপ মোটেও ভুলে যায়নি অরা। ভোলার কথাও নয়। যে মানুষটা তাকে কিডন্যাপ করার মতো জঘন্য কাজ করতে পারে, তাকে আর যাই হোক বিশ্বাস করা যায় না। এমন মানুষের কাছ থেকে একশ হাত দূরে থাকাই উত্তম। নওশীনের জামিনের পর তো এই অজানা ভয়টাই আঁকড়ে ধরেছিল অরাকে। সেই অরা নিশ্চয়ই চাইবে না ভালোমানুষির খাতিরে কথাকে নওশীনের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে যেতে।

নওশীনের গ্রেফতারের পর থেকে আরশাদ আর অরা চিন্তায় ছিল কী করে সামাল দেবে কথাকে। যদি মেয়েটা তাদের কাছে আর থাকতে না চায়? যদি মায়ের জন্যে তার মন ছটফট করতে শুরু করে?

নওশীনের গ্রেফতারের পর পর আরশাদ চেয়েছিল শান্ত ভঙ্গিতে মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে। “মা আর কখনোই ফিরে আসবে না” – এই জাতীয় কথা বলতে। কথা যদি মনে মনে মায়ের অপেক্ষায় দিন গোনে, তবে সেই অপেক্ষাটা যেন বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে আবার ভাবলো, কী দরকার মেয়েটার অতটুকু মনে এত ভারী চাপ প্রয়োগ করার? তার থেকে বরং কথাকে মা বিহীন জীবনে অভ্যস্ত করে তোলা হোক।

মা বিহীন জীবনে মেয়েটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে ঠিকই তবে মনের মাঝে মাকে নিয়ে তার উদ্বেগ বিন্দুমাত্র দূর হয়নি। মনে মনে সে ঠিকই মাকে খুঁজে বেড়ায়, তবে মুখে তা প্রকাশ করতে পারে। একটা বাচ্চা যখন ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণায় ভোগে, তখন তার থেকে ভয়ঙ্কর আর কিছুই হতে পারে না।

ছোটবেলায় অরার মনেও হাজারটা ইচ্ছা খেলে বেড়াতো। তবে যে ভয়ঙ্কর এবং যন্ত্রণাদায়ক পরিবেশে তার বেড়ে ওঠা, তাতে ইচ্ছা পূরণের অবকাশ আর ছিল না। অরার ছোটবেলার ভয়, আতঙ্ক আর কষ্টগুলো একান্তই তার নিজের। ছোটবেলায় না-কি মানুষের মন থাকে নরম কাদামাটির মতো। তাতে যে আকার দেওয়া হবে, ভবিষ্যতে সে সেভাবেই গড়ে উঠবে। ভয়ে-আতঙ্কে বেড়ে উঠতে উঠতে অরা মনে ক্ষত-চিহ্নের মতো ওই অনুভূতিগুলোর দাগ এখনো লেগে রয়েছে।

কথার বেড়ে ওঠার পরিবেশটা তো আর ভয়ঙ্কর-যন্ত্রণাদায়ক নয়। তাহলে সে কেন মনে মনে যন্ত্রণায় ভুগবে? কেন বাধ্য হবে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে?

মনের মাঝে জেগে ওঠা দ্বিধা-দ্বন্দ চাপা দিয়ে সকাল সকাল অরা গেল কথার সঙ্গে আলাপ করতে।

আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কথা? এখনো তোর মায়ের জন্যে মন খারাপ হয়?”

মাকে নিয়ে প্রশ্ন করতেই হাস্যোজ্জ্বল কথার মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। শুকনো গলায় সে বলল, “হুঁ।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অরা শুকনো ঢোক গিলে বলল, “মায়ের সাথে দেখা করবি?”

কথা এমনভাবে অরার দিকে তাকিয়ে রইলো যেন যে ভিনগ্রহী। অচেনা কোনো ভাষায় কথা বলছে তার সঙ্গে।

কথা একরাশ বিভ্রান্তি নিয়ে বলল, “কীভাবে? মা তো বেড়াতে গেছে!”

“গিয়েছিল, কিছুদিনের জন্য আবার ফিরে এসেছে।”

এবার তার মুখটা উচ্ছ্বাসে মাখামাখি হয়ে গেল। ঠোঁটে প্রসন্ন এক হাসি টেনে বলল, “সত্যি?”

“হুঁ, সত্যি। করবি দেখা?”

কথা উৎফুল্ল গলায় বলল, “হ্যাঁ করবো! কবে করবো?”

“হয়তো আজই।”

“আজ? সত্যি?”

আনন্দে ঝলমল করছে কথার মুখটা। এতটা আনন্দে বহুদিন দেখা যায়নি তাকে। যে কথাটা অরা বলতে চাইছে তাতে হয়তো তার আনন্দে সামান্য ভাটা পড়বে। তবুও কথাটা অরাকে বলতে হবে।

অরা ক্ষীণ গলায় বলল, “কথা শোন! মা কিন্তু আবারও বেড়াতে চলে যাবে। তুই মায়ের কাছে থাকতে পারবি না। আজ শুধু দেখা করে আমরা আবার বাসায় চলে আসবো।”

কথার আনন্দে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়লো না। আগের মতো উচ্ছ্বাস নিয়েই সে বলল,
“আচ্ছা। আমরা কখন যাবো অরা?”

কথার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরা। মেয়েটার এই হাসির জন্যেই তো পৃথিবীর সকল কঠিন পথ পাড়ি দেওয়া যায়। এই কথোপকথনের পর পর সিদ্ধান্তে স্থায়ী হয়ে গেল অরা। কথা দেখা করবে নওশীনের সঙ্গে। এটা নওশীনের প্রতি কোনো দয়া নয়, ভালোমানুষির উদাহরণ নয়। অরা যা করছে, করছে শুধুমাত্র কথার জন্যে। মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা শুনতেই আনন্দের ঝলকানি এসে জায়গা করে নিয়েছে মেয়েটার চোখেমুখে। সত্যি সত্যি দেখা হলে না জানি কত স্তরের প্রশান্তিতে ডুবে যাবে তার মন।

আরশাদকে না জানিয়ে, তার অনুমতি ছাড়াই এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? অরা বুঝতে পারছে না। তবে এতটুকু সে নিশ্চিতভাবে বলতে পারে, আরশাদ তার এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করবে না। ভেতরে ভেতরে নওশীনের প্রতি সে সাত সমুদ্র সমান রাগ পুষে রেখেছে। নওশীনের নামটা তার কর্ণকুহরে পৌঁছালেই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে সেই রাগ। এক্ষেত্রে নিজের রাগকেই সবথেকে বেশি প্রাধান্য দেবে সে। কথার অনুভূতিগুলো বুঝতে চেষ্টা করবে না।

ইয়াসমিন বেগমকে ফোন করতেই তার মাঝেও দেখা গেল কথার মতোই উচ্ছ্বাস। একটু পর পর তিনি বললেন, “তুমি সত্যি বলছো তো মা?”

অরা বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দিলো দেখা করার জন্যে। প্রথমত, এক ঘণ্টার বেশি তারা থাকতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, অরার পছন্দ করে দেওয়া জায়গাতেই তারা দেখা করবে। আর তৃতীয়ত, দুজন বডিগার্ড সর্বক্ষণ কথার সঙ্গে থাকবে। কথাকে যদি সন্দেহজনক কিছু বলা হয়, বডিগার্ড যাতে তা শুনতে পায় এজন্যেই এই ব্যবস্থা। ইয়াসমিন বেগম বিনা বাক্য ব্যয়ে সকল শর্তে রাজি হয়ে গেলেন। তার মেয়ে নিজের মেয়ের সঙ্গে দেখা করবে, এই আনন্দে সংবাদে তিনি এমনিতেই আত্নহারা। শর্তে মনোযোগ দেওয়ার অবকাশ কোথায়?

আরশাদকে না জানিয়ে এর আগেও নওশীনের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে বিপদে পড়েছিল অরা। এটাও যদি তার কোনো ফাঁদ হয়? অরা বেশ বুঝতে নওশীনের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ায় বিপদের আশঙ্কা নেহায়েত কম নয়। তবুও সে যাচ্ছে কেবল কথার কথা ভেবে।

এই রেষ্টুরেন্টের দোতলাটা আজ সারাদিন ব্যাপীই বুক করে রেখেছে অরা। এই রেষ্টুরেন্টের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই জোরালো। কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলেই তাকে কয়েক দফায় চেকিংয়ের মুখোমুখি হতে হবে। নওশীন চাইলেও এখানে তাদের কোনো ক্ষতি যাতে না করতে পারে।

অরার বডিগার্ড জহুরুলকে এসেছে একটা সিকিউরিটি সংস্থার মাধ্যমে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আরও একজন বডিগার্ডকে খবর দিয়ে আনলো অরা। এই বডিগার্ডের নাম শামীম। শামীম বিকেলের পর থেকে ওই রেস্টুরেন্টেই বসে ছিল। নওশীন যাতে আগে আগে এসে তার কুবুদ্ধির জাল বিছাতে না পারে।

সন্ধ্যার খানিক আগ দিয়ে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলেন ইয়াসমিন বেগম তার মেয়েকে নিয়ে। চেকিং করে দুজনের কাছে সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া যায়নি। তাদের বসিয়ে রেখে শামীম ফোন করলো অরাকে। পরিস্থিতি কন্ট্রোলে আছে কিনা নিশ্চিত হয়ে তবেই অরা কথাকে নিয়ে বাড়ি থেকে রওনা দিলো। জহুরুল যাচ্ছে তাদের সঙ্গে। দুজন বডিগার্ড, রেষ্টুরেন্টের কড়া নিরাপত্তা – কোনো ক্ষতি করতে চাইলেও সে সুযোগ পাবে কোথায় নওশীন?

কাঁচে ঘেরা এই স্মোকিং জোন মূল রেষ্টুরেন্টের মধ্যে থাকলেও যেন আলাদা একটা অংশ। এখান থেকে পুরো জায়গাটার কোথায় কী হচ্ছে পরিষ্কার দেখা যায়। এখানে বসেই অরা দেখতে পাচ্ছে নওশীনকে। তার সামনে পড়ার কোনো ইচ্ছা অরার নেই। ওই মানুষটাকে এক সময়ে অসম্ভব সম্মান করতো অরা। তবে এখন সেই সম্মানের লেশমাত্র অবশিষ্ট নেই।

নওশীন যেন আর আগের সেই নওশীন নেই। চোখেমুখে তার সর্বক্ষণ এক বিচিত্র লাবণ্য চকচক করতো। প্রত্যেকটা পদক্ষেপে আর চাল-চলনে এক রাজকীয় জৌলুস ছিল তার মাঝে। এখন সেসবের কিছুই নেই। চোখের নিচে তার কালো দাগ স্থায়ী জায়গা দখল করে নিয়েছে। বসেও আছে কেমন কাচুমাচু ভঙ্গিতে। ইয়াসমিন বেগম তাকে নিচু স্বরে কী কী যেন বলছেন। প্রত্যেকটা কথাতেই যেন কেমন চমকে উঠছে সে।

অরা অবাক হয়ে দেখছে নওশীনকে। চোখের নিচে কালি, চোখেমুখে ক্লান্তি – তবুও সৌন্দর্যের কোনো কমতি নেই। প্রকৃতির অপরূপ এক সৃষ্টি সে। এই মানুষটার মন তার চেহারার মতো অপরূপ হলে কী এমন ক্ষতি হতো?

কথা এতটা সময় অরার পাশেই বসে ছিল। অরা আঙুল উচিয়ে বলল, “ওইদিকে যা!”

কথা অবাক গলায় বলল, “ওখানেই মা আছে?”

“আছে তো!”

কথা অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ছোট ছোট পা ফেলে বেরিয়ে গেল এই স্মোকিং জোন থেকে। অরার কথাটা যেন বিশ্বাস হয়নি তার। মা যে এত কাছাকাছি আছে, এটা হয়তো ছিল তার ধারণারও বাইরে।

দৃষ্টি সীমানার মধ্যে নওশীনকে দেখতে পেয়েই ছুটে গেল কথা। নওশীনও অবিশ্বাসে উঠে দাঁড়ালো। চোখ সরিয়ে নিলো অরা। এই আবেগঘন দৃশ্য দেখলে তার কোমল হৃদয়ের কোমলতা সকল সীমানা ছাড়িয়ে যাবে। ইচ্ছা হবে, রোজ একবার করে নওশীনের সঙ্গে কথাকে দেখা করাতে।

অনেকটা সময় এভাবেই পেরিয়ে গেল। ওদিকে কী হচ্ছে অরা দেখছে না। তবে কথার পাশে সর্বক্ষণ আছে জহুরুল। আর এই স্মোকিং জোনের বাইরে দৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে শামীম।

আচমকা সাইরেনের শব্দে আঁকতে উঠলো অরা। পুলিশের জিপের সাইরেন। বডিগার্ড দুজনও সতর্ক হয়ে গেল। পুলিশ হঠাৎ এই রেস্টুরেন্টের বাইরে কী করছে? এটা আবার নওশীনের নতুন কোনো চাল নয়তো?

অরার হৃদস্পন্দন ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। তার মন বলছে, নির্ঘাত পুলিশের বেশে জিপ ভর্তি বদ লোক এসেছে রেস্টুরেন্টে। এতগুলো মানুষের সঙ্গে কি দুজন বডিগার্ড পারে উঠবে? আবারও কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে অরাকে। এবার আগের থেকেও বড় ধরনের ক্ষতি করবে তার।

ভয়ে রীতিমত পাথরের ন্যায় জমে গেছে অরা। কী করবে, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। পুলিশের ইউনিফর্ম পরিহিত এক অফিসার প্রবেশ করলো এই দোতলায়। তার পেছনে আরও কয়েকজন অফিসার এবং এই রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার।

বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো অরার। নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তার মন বলছে এরা কেউই আসল পুলিশ নয়। নওশীন এতটাই নিকৃষ্ট যে মেয়েকে দেখার নাম করে আবারও অরার ক্ষতি করতে উদ্যত হয়েছে। নিজের চুল নিজেই ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে অরার। কী করে পারলো সে এত বড় ভুল করতে?

অরার প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে। প্রেগন্যান্সির সময়ে প্যানিক অ্যাটাক মোটেও ভালো কোনো ঘটনা হয়। অরা প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে সামলাতে, নিজেকে ধরে রাখতে। লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে নিতে অরা স্মোকিং জোনের কাঁচ ভেদ করে দেখলো ইতোমধ্যেই কথাকে নওশীনের কাছ থেকে আলাদা করে কোলে তুলে নিয়েছে জহুরুল।

সকলের সামনে থাকা পুলিশ অফিসার লম্বা লম্বা পা ফেলে স্মোকিং জোনে প্রবেশ করে বিনয়ী ভঙ্গিতে অরাকে বললেন, “ম্যাম, আপনাকে একটু আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।”

অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “কেন?”

অরা বেশ বুঝতে পারছে কেন। এই পুলিশ অফিসার বেশী লোকটার সঙ্গে সে নিচ অব্দি যাবে। এরপর তাকে একটা মাইক্রোবাসে তোলা হবে। ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করা হবে। ঠিক যেমনটা আগেরবার করা হয়েছে। আগের থেকে এবার যেন ভয়টা একটু বেশিই আঁকড়ে ধরেছে অরাকে। আগেরবার তো সে একা ছিল। আজ তার সঙ্গে আরও একজন রয়েছে। তার যদি কোনো ক্ষতি হয়?

লোকটা আবারও ভদ্রভাবে বলল, “Mam, please cooperate.”

অরা কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই লক্ষ্য করলো দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছেন ধানমন্ডি থানার ওসি হানিফ সাহেব। ওসি সাহেবকে অরা খুব ভালো করেই চেনে। নওশীনের গ্রেফতারের পর কয়েকবার জিজ্ঞাসার সঙ্গে তিনি বাড়িতে গিয়েছিলেন।

অরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এরা তার মানে সত্যিকারের পুলিশ। পুলিশ বেশী সন্ত্রাসী নয়। শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করে রক্তচাপ বাড়িয়ে ফেলছিল সে। তবে এক দুশ্চিন্তার কালো মেঘ কাটতেই আরেক দুশ্চিন্তা! আসল পুলিশ হঠাৎ এখানে কেন?

হানিফ সাহেব অরার দিকে এগিয়ে এসে ব্যস্ত গলায় বললেন, “ভাবি! আপনাদেরকে এক্ষনি যেতে হবে!”

হানিফ সাহেবের ব্যস্ততার কারণে মায়ের কাছ থেকে ঠিকমত বিদায় নিতে পারলো না কথা। অরার হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে সে। একটা ব্যাপারই কিছুতে মাথায় ঢুকছে না অরার। পুলিশের এই আকস্মিক আগমনের কারণ কী? এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় যেতে বলল তাদের? উত্তরটা অবশ্য অরা পেয়ে গেল রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে মূল রাস্তায় এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে।

ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো অরা। হৃদপন্দন নির্ঘাত এক লাফে বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক’শ পঞ্চাশে। গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরশাদ। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট আর চোখে আগুনের ঝলকালি। তার চোখেমুখে এক ভয়ানক রাগ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে অরা।

আরশাদ কী করে জানলো অরা কথাকে নিয়ে এসেছে নওশীনের সঙ্গে দেখা করাতে? কী করে জানলো, তার থেকেও বড় কথা সে জেনে গেছে। রেগে গেলে আরশাদ হয়ে ওঠে সবথেকে ভয়ঙ্কর। তার এই রূপটাকেই সবথেকে বেশি ভয় করে অরা।

আরশাদের চোখ তাদের দুজনের দিকে পড়তেই ছুঁড়ে হাত থেকে সিগারেটটা ফেলে দিলো সে। উদ্বিগ্ন পায়ে হেঁটে এলো এদিকে। তার এগিয়ে আসায় অরা থেমে গেল। আরশাদ এসে হাঁটু মুড়ে বসে জড়িয়ে ধরলো কথাকে। এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছে যেন, বহু মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলেছিল। বহুদিন পর আজ খুঁজে পেয়েছে।

অরা কথাকে আগেভাগে শিখিয়ে এনেছিল, মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার ব্যাপারটা বাবাকে না জানাতে। সে বাধ্য মেয়ের মতো সেই কথাটা
গোপন করে গেল আরশাদের থেকে।

আরশাদ উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “তুই ঠিক আছিস বাবা?”

কথা অবাক হয়ে বলল, “ঠিক থাকবো না কেন?”

আরশাদ কিছুই বলল না। পর পর কতগুলো দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামলে নিলো নিজেকে। ভেবেছিল আজ বুঝি বড়সর একটা ক্ষতি হয়ে যাবে। আর কখনো কাছে পাবে না নিজের মেয়েকে। যদিও সবটাই ঠিক আছে, তবুও বিশ্বাস হচ্ছে না সত্যিটা।

আরশাদ নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। গাড়ির পেছনের দরজা খুলে দিয়ে বলল, “তুই বস বাবা। আমরা বাসায় যাবো।”

কথা লক্ষ্মী মেয়ের মতো গাড়িতে গিয়ে বসে পড়লো। আরশাদ বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুকটা ধ্বক করে গেল অরার। আরশাদের সঙ্গে নীরবতায় কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত তার মোহনীয় প্রশান্তিময়। তবে আজকের এই নীরবতা যেন একেবারেই ভিন্ন। আরশাদের গাম্ভীর্য মনের মাঝে জোরালো এক তুফানের সৃষ্টি করেছে।

সাহস করে অরা কম্পিত স্বরে বলল, “আরশাদ…”

অরাকে কোনপ্রকার কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “Shut up! Just shut up! উঠে বসো।”

আরশাদের এই ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর এলোমেলো করে দিলো অরার ভেতরটা। এই জীবনে বহুবার তার ওপরে রাগ করেছে আরশাদ। এই রাগের প্রকাশস্বরুপ ধমকও দিয়েছে প্রচুর। তবে কোনোবারই তার রাগকে এতটা ভয় অরা করেনি, যতটা আজ এই মুহূর্তে করছে।

পুরোটা পথ কোন কথা বলল না আরশাদ। একদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করে গেল কেবল। এদিকে মনে মনে কথা গোছাতে ব্যস্ত অরা। আরশাদ নির্ঘাত তার ওপরে ব্যাপক রেগে আছে। আগ্নেয়গিরির লাভা ভেতরে ভেতরে উত্তপ্ত হচ্ছে। সময় হলেই ফেটে পড়বে। তার রাগের আগুনকে শান্ত করার জন্যে কোন কথাগুলো উপযুক্ত হবে, তাই ভেবে হিমশিম খাচ্ছে অরা।

বাড়ি পৌঁছেও অগ্নিমূর্তিটা ধরে রাখলো আরশাদ।

বসার ঘরের সোফায় বসে জুতার বেল্ট খুলতে খুলতে কথা উৎফুল্ল গলায় বলল, “বাবা? আজ আমরা ভিডিও গেম খেলবো না?”

আরশাদ বহুকষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, “খেলবো তো সোনা। তুই ওপরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। তারপরই আমরা ভিডিও গেম খেলতে বসবো।”

কথা ছোট ছোট পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল। জড়সড় ভঙ্গিতে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো অরা। আরশাদের সঙ্গে এই মুহূর্তে কোনো কথায় না জড়ানোই শ্রেয়। আরশাদ শান্ত হলে না হয় তাকে বুঝিয়ে বলা যাবে। অরা সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো।

সঙ্গে সঙ্গে আরশাদ উত্তপ্ত গলায় বলল, “দাঁড়াও!”

আরশাদের এই কণ্ঠস্বর হিমবাহের ন্যায় জমিয়ে দিলো অরাকে। এই কণ্ঠে তো সে কখনো কথা বলে না অরার সঙ্গে! মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল অরা। চোখ তুলে আরশাদের দিকে তাকানোর সাহস তার হচ্ছে না।

দাঁতে দাঁত চেপে আরশাদ বলল, “কোন সাহসে আমার মেয়েকে ওরকম ভয়ঙ্কর একটা মানুষের সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে গেছ তুমি?”

অরা এবার আরশাদের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আরশাদ আমার কথাটা শোনো!”

অরার মুখ খোলায় আরশাদের রাগ যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল।

রাগে ফেটে পড়ে সে বলল, “কী শুনবো আমি? কী বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করছো আমাকে?”

অরা থেমে থেমে বলল, “আমি কোনো কিছু বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করছি না আরশাদ। অনেক ভেবেচিন্তে এই ডিসিশনটা নিয়েছি আমি।”

“কে বলেছে তোমাকে ভেবেচিন্তে ডিসিশন নিতে। আমি বলেছি? আমার মেয়ের ব্যাপারে ফাইনাল ডিসিশন আমি দিয়ে দিয়েছিলাম না?”

অরা আহত গলায় বলল, “ও আচ্ছা? কথা তোমার মেয়ে। আর আমার কেউ না?”

আরশাদ বিরক্ত গলায় বলল, “কথায় কথায় ইমোশনাল হওয়াটা বন্ধ করো অরা। You have no idea what you’ve done.”

চুপ করে রইলো অরা। ইতিমধ্যেই তার চোখে জল এসে জমেছে। যেকোনো সময় গড়িয়ে পড়বে তারা। তার ভালোবাসার মানুষটা এভাবে কথা বলছে কেন তার সঙ্গে? এতটাই বড় ভুল করে ফেলেছে সে?

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “তোমার কোনো লজ্জা নেই তাই না? নওশীন তোমাকে কিডন্যাপ করেছিল অরা! তোমাকে সারাজীবনের জন্যে আমার কাছ থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ইনফ্যাক্ট এই দেশ থেকেই সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। একবার চিন্তা করে দেখো, ওইদিন যদি আমি ঠিক সময়ে না পৌঁছাতাম, তাহলে কী হতো? আজ কোথায় থাকতে তুমি?”

“একটা বারের জন্যে দেখা করাতে নিয়ে গিয়েছিলাম শুধু আরশাদ। দুইজন বডিগার্ড সাথে ছিল। এত সিকিউরড একটা রেস্টুরেন্ট, কীভাবে ক্ষতি করতো?”

তর্জনী দিয়ে কপাল ঘষে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে আরশাদ। অরার প্রত্যেকটা উত্তর তার রাগের আগুনে ঘিয়ের মতো কাজ করছে।

আরশাদ অগ্নিকণ্ঠে বলল, “এসব করে কী প্রমাণ করতে চাইছো তুমি?”

“মানে?”

“এত ভালোমানুষি করে প্রমাণ করতে চাইছো যে তুমি সেইন্ট? মানুষ যতই অপরাধ করুক না কেন, তোমার কাছে ক্ষমা পাবেই?”

“আরশাদ আমি কোনো ভালোমানুষি দেখাইনি।”

আরশাদ উঁচু স্বরে বলল, “তাছাড়া আবার কী? নওশীন অ্যারেস্ট হওয়ার পরও তো চোখের জল ফেলেছিল। একজন মা দিনের পর দিন তার সন্তানকে না দেখে কাটাচ্ছে, এই কষ্টে নিশ্চয়ই তোমার ঘুমই হতো না রাতে। আচ্ছা অরা, সত্যি করে বলো তো এসব ভালোমানুষি কি মন থেকেই করো? না-কি শুধু শো-অফের জন্যে?”

নিজেকে আর সামলাতে পারছে না অরা। সহ্য করতে পারছে না আরশাদের কথাগুলো। সারা পৃথিবী তাকে কটাক্ষ করুক, তার দিকে আঙুল তুলুক। তাই বলে তার ভালোবাসার মানুষটা না জেনে তাকে নিয়ে এমন কথা কী করে বলতে পারছে। নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না তার।

আর সহ্য করতে না পেরে অরা বলল, “Enough Arshad! আমি কোনো ভালোমানুষি দেখাইনি। উনার মা আমার কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে তো কথাকে নিয়ে ছুটে যাইনি দেখা করাতে। এড়িয়ে গেছিলাম। কিন্তু কয়েকদিন আগে আমি এমন কিছু খুঁজে পাই যা আমাকে এই ডিসিশনটা নিতে বাধ্য করেছে।”

আরশাদ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “Don’t make excuses.”

অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “I’m not making excuses Arshad! তোমার মেয়েটা ট্রমাটাইজ হয়ে গিয়েছিল। মনে মনে মায়ের জন্যে অপেক্ষা করতো। মায়ের ছবি আঁকতো। কাউকে বুঝতেও দেয়নি যে ও মাকে মিস করছে। অতটুকু একটা বাচ্চার জন্যে কতটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার, তুমি বুঝতে পারছো?”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আরশাদ বলল, “তাই বলে নিজে যা ভালো বুঝবে তাই করবে? আমাকে জানানোর প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করবে না?”

অরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমাকে জানালে বুঝতে তুমি? রাগ ছাড়া আর কোনো ফিলিংস কাজ করে তোমার মধ্যে?”

অরার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না আরশাদ। পৃথিবীটা আবেগ দিয়ে চলে না। সকলেই যদি অরার মতো আবেগের স্রোতে গা ভাসাতো, তবে আর টিকে থাকতে হতো না মানব সভ্যতাকে।

আরশাদ কড়া গলায় বলল, “অরা আমি তোমাকে ওয়ার্ন করে দিচ্ছি! আমাকে জিজ্ঞেস না করে আমার মেয়ের ব্যাপারে কোনো ডিসিশন তুমি নিবে না।”

অরা আহত ভঙ্গিতে বলল, “তুমি এমনভাবে আমার মেয়ে, আমার মেয়ে করছো যেন আমি একজন আউটসাইডার। এই যে মেয়েটা আজকে এত বড় হয়েছে, নিজে নিজে পড়তে পারে, নিজের কাজ নিজে করতে পারে, এত সুন্দর ডিবেট করতে পারে – এসবের মধ্যে আমার কোনোই অবদান নেই?”

“তুমি আবারও ইমোশনাল কার্ড প্লে করছো? তোমার সাথে কথা বলাই তো মুশকিল হয়ে পড়ছে।”

অরা হতবাক গলায় বলল, “আমি ইমোশনাল কার্ড প্লে করছি?”

“হ্যাঁ করো। ইনফ্যাক্ট এখনো করছো। তোমার সমস্যাটাই হলো কথায় কথায় ইমোশনাল হয়ে পড়া।”

“আর তোমার সমস্যা কী আরশাদ? তুমি এত সিনক্রিয়েট করছো কেন? কথা তো নিরাপদে বাড়ি ফিরে এসেছে।”

“ক্ষতি কি শুধু কিডন্যাপ করেই করা যায়? হয়তো এখনো কোনো ক্ষতি করে ফেলেছে? কথাকে এমন কিছু বলে ফেলেছে, যার কারণে মেয়েটা এখন তোমাকে আর আমাকে সহ্যই করতে পারবে না।”

“তোমাকে তো বললাম, মেয়েটা ট্রমাটাইজ হয়ে পড়েছিল।”

“ট্রমা থেকে না হয় অন্য কোনোভাবে বের করে আনতাম। আমি যখন বলেছি, ওই মানুষটার ছায়াও কথার উপর পড়ুক আমি চাই না, meant it!”

কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না অরা। ভেতর থেকে কিছু একটা এসে আটকে দিলো তাকে।

আরশাদ আবারও তার তপ্ত স্বরে বলল, “আমার আসল রূপটা ভুলে যেও না অরা। কথার গায়ে একটা আঁচড়ে এলেও আমার থেকে খারাপ এই পৃথিবীতে কেউ হবে না।”

শেষ কথাগুলো সম্ভবত পৌঁছাতে ব্যর্থ হলো অরার কর্ণকুহরে। নিমিষেই চারপাশটা ঝাপসা হয়ে এলো। মাথার ভেতরটা প্রচন্ড এক ঘূর্ণির ন্যায় ঘুরপাক খেয়ে উঠলো। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও যেন কষ্ট হচ্ছে তার।

মুহূর্তের মাঝেই সকল রাগ, সকল ক্রোধ অদৃশ্য হয়ে আরশাদের মধ্যে থেকে। অরা পড়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ছুটে এসে ধরে ফেলল তাকে। একরাশ উদ্বেগ তরঙ্গের ন্যায় খেলে বেড়াচ্ছে আরশাদের মাঝে।

উদ্বিগ্ন গলাতেই আরশাদ ডাকলো, “অরা! অরা!”

অরা কোনপ্রকার সাড়া দিলো না।

(চলবে)

#ফিরে_আসা২
১২+১৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

অন্ধকারমাখা ভোর, সূর্যটা উঠেছে সেই কখন অথচ আলো ছড়ানোর নামগন্ধ নেই। হসপিটালের করিডোরে কথাকে কোলে নিয়ে পায়চারি করছে আরশাদ। হসপিটালের এই অংশটা ভিআইপি এরিয়া। সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার নেই এখানে। তবুও কীভাবে যেন কাল রাতে অন্যান্য রোগীদের মাঝে রটে গেল, আরশাদ হক আছে এই হসপিটালে।

ব্যস! কীসের চিকিৎসা নেওয়া আর কীসের সুস্থ হওয়া! বিপুল মানুষের ভীড় জমে গেল ভিআইপি এরিয়ার সামনে। পছন্দের সুপারস্টারকে এক নজর দেখার আকাঙ্ক্ষা সকলের। সেই ভীড় সামলাতে রীতিমত হিমশিম খেতে হয় আরশাদের বডিগার্ড এবং হসপিটালের সিকিউরিটি গার্ডদের। পরিস্থিতি এখন অনেকটাই ঠান্ডা।

অন্যান্য সময় হলে আরশাদ একবার হলেও দেখা দিতো তার ভক্তদের। তবে কাল সেই পরিস্থিতি ছিল না। মানসিক জোর নেই। মানসিক জোর না থাকলে মানুষ কোনো কাজেই আগ্রহ পেয়ে ওঠে না। হোক সেটা কয়েক মুহূর্তের জন্যে ভক্তদের দেখা দেওয়া।

গতকাল পর পর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ধকল সামলাতে ব্যস্ত আরশাদের অশান্ত মন আর উত্তপ্ত মস্তিষ্ক। এমনিতেই গতকাল সে ব্যস্ততায় দিন কাটাচ্ছিল বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ের কারণে। যেকোনো বিজ্ঞাপনের শুটিং হয় তিন থেকে পাঁচ দিন ধরে। গতকাল ছিল শুটিংয়ের শেষ দিন। স্বাভাবিকভাবেই চাপটাও তাই বেশি।

কাজের হাজার ব্যস্ততার মাঝেও আরশাদের চোখ এড়িয়ে যায়নি অরার অস্বাভাবিকতা। অন্যান্য দিন আরশাদ শুটিং থাকলে বেশ কয়েকবার ফোন করে খোঁজখবর নেয় অরা। কাল একবারও ফোন আসেনি। আরশাদ নিজে ফোন করলেও লক্ষ করে অরার গলা কাঁপছে। এতদিন অরাকে বেশ ভালো করেই পড়তে শিখে গেছে আরশাদ। তাই বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না কিছু একটা লুকানো হচ্ছে তার কাছ থেকে।

সময় অপচয় না করে আরশাদ সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলো অরার ড্রাইভার রমিজকে। রমিজ আবার আরশাদের ভীষণ অনুগত। ওদিক থেকে এক এক করে তথ্য সেই পাচার করছিল। প্রথমত সে খবর দেয়, অরা না-কি আরেকজন বডিগার্ডকে খবর দিয়ে এনেছে। অরার সঙ্গে সব সময় একজন বডিগার্ড থাকে। আরেকজনের প্রয়োজন কী? আরশাদের সন্দেহ তীব্র হতে থাকে।

তখনই শুটিং প্যাক আপ করে রওনা দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। এরপর খবর এলো অরা না-কি কথাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। বিলাসবহুল ওই রেস্টুরেন্ট তাদের গন্তব্য। অরা কথাকে নিয়ে ভেতরে চলে যাওয়ার পর আরশাদ রমিজকে নির্দেশ দিয়ে বলল, ওপরে উঠে দেখতে ঘটনা কী!

রমিজের কাছ থেকে ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই রক্ত উঠে গেল আরশাদের মাথায়। রাগের প্রবল স্রোত এলোমেলো করে দিলো তার ভেতরটা। অরার ওপরে এতটাই রাগ হচ্ছিল, যে ওই মুহূর্তে পৃথিবীটা পুড়িয়ে ফেলতে ইচ্ছা হলো। সেই সঙ্গে আবার কাজ করছিল ব্যাপক উদ্বেগ। নওশীন যদি আবারও অরার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করে? যদি কথাকে তার থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে?

উদ্বেগে দিশেহারা হয়ে আরশাদ ফোন করে ওসি সাহেবকে। ওসি সাহেবও তৎক্ষণাৎ ফোর্স নিয়ে পৌঁছে যান ওই রেস্টুরেন্টে। কোনো অফিসিয়াল অভিযোগ ছাড়া পুলিশ এভাবে হাজির হতে পারে কিনা কে জানে। সবটাই সম্ভব হয়েছে ডিআইজি সাহেবের সঙ্গে আরশাদের ভালো সুসম্পর্কের জন্যে।

কালকের দিনটা কেটে গেছে, নতুন সূর্য এসেছে পৃথিবীর বুকে। তবুও কমেনি আরশাদের রাগ। অরার প্রতি রাগ নয়, নিজের প্রতি। কেন যে মেয়েটাকে ওভাবে বকতে গেল সে! আরশাদ জানে অরা অসম্ভব সাহসী একটা মেয়ে। তবুও প্রত্যেকটা সাহসী মানুষের একটা করে উইকনেস থাকে। অরার উইকনেস আরশাদ। পুরো পৃথিবীর সঙ্গে একা হাতে লড়াই করার ক্ষমতা রাখলেও, আরশাদের দেওয়া সামান্য আঘাত ক্ষতি-বিক্ষত করে ফেলে তার ভেতরটা। এই সত্যি জেনেও কেন যে আরশাদ নিজেকে সামলাতে পারলো না! অপরাধবোধ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে।

অরাকে কাল রাতে সঙ্গে সঙ্গে হসপিটালে নিয়ে আসে আরশাদ। ডাক্তার বললেন, অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। এছাড়াও তার ব্লাড প্রেশার কম বলে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ডাক্তার এর আগেও বলেছিলেন, অরা মানসিক চাপ নেয়। এই মানসিক চাপের কারণেই বাবুর কোনো ক্ষতি না হয়ে যায়!

কথাকে কোলে নিয়েই করিডোরের বিশাল জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো আরশাদ। হসপিটালের সামনের ফাঁকা রাস্তার চিত্র পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। গত রাত থেকে এক ফোঁটা ঘুমও নেমে আসেনি আরশাদের দুচোখে। কথার ক্ষেত্রেও তাই। এতটুকু একটা মেয়ে কী করে সারারাত না ঘুমিয়ে পারলো কে জানে!

আরশাদ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলল, “তোর ঘুম পাচ্ছে না বাবা?”

অরা আরশাদের কাঁধে মাথা রেখে দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “না তো!”

“তাহলে আমাকে একটা কথা বল।”

কথা কাঁধ থেকে মাথা তুলে আরশাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী কথা?”

আরশাদ সহজ ভঙ্গিতে বলল, “কাল মায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলি?”

কথা চমকে উঠে বলল, “তুমি জানলে কীভাবে বাবা?”

আরশাদ কথার চমক দেখে ক্ষীণ হেসে বলল, “বাবা সব আগেভাগে জেনে যাই। তুই মনে মনে একটা নম্বর ভেবে দেখ, গেস করতে পারি কিনা।”

কথা খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “ভেবেছি।”

“Eight?”

“হ্যাঁ! তুমি কীভাবে জানলে?”

কথার পছন্দের সংখ্যা আট। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাকে কোনো সংখ্যা ভাবতে বলা হলে, আটই ভাববে।

আরশাদ হালকা গলায় বলল, “বললাম না, আমি সব জেনে যাই।”

কথা উৎফুল্ল গলায় বলল, “You’re a genius Baba!”

আরশাদ কৌতূহল নিয়ে বলল, “মায়ের সাথে যে দেখা করেছিস, এই কথাটা আগে বললি না কেন?”

কথা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শুকনো গলায় বলল, “অরা বারণ করেছিল, তাই।”

মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরশাদ। মেয়েটা তার অরার বড় ভক্ত। অরা কিছু বলেছে আর কথা সেটা অমান্য করেছে, এমন দৃষ্টান্ত নেই।

কথা আগ্রহ নিয়ে বলল, “আচ্ছা বাবা, অরা কী জানে না তুমি সব জেনে যাও।”

“জানে তো।”

“তাও আমাকে বারণ করলো কেন?”

“সেটাই তো! আচ্ছা বাদ দে, এখন আমাকে সত্যি করে একটা কথা বলবি?”

“কী?”

“কাল মা তোকে কী কী বলেছিল?”

কথা মায়ের বলা কথাগুলো মনে করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নওশীন কথাকে কী বলেছে জানাটা জরুরি। নওশীনকে একবিন্দু ভরসা নেই আরশাদের। সে চাইলেই এমন কিছু বলতে পারে কথাকে যা তার কোমল হৃদয়ে গাঢ় আঁচড় ফেলতে পারে। অথবা এমন কিছু, যা তার মনে আরশাদ বা অরার প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণার জন্ম দেবে।

আরশাদ কথাকে সাবধান করে দিয়ে বলল, “কোনো কিছু লুকিয়ে রেখে লাভ হবে না কিন্তু। আমি সব জেনে যাবো।”

“মা তো প্রথমে কতক্ষণ আমাকে কোলে নিয়ে অনেক আদর করলো, আর অনেক কাঁদলো। আচ্ছা বাবা, মা ওভাবে কাঁদলো কেন?”

আরশাদ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “সেটা তো বলতে পারছি না সোনা। মা কিছু বলেনি?”

কথা চিন্তা করে বলল, “বলেছে তো। আমার স্কুলের কথা জিজ্ঞেস করেছে। আমার নতুন স্কুলের মিসরা কেমন, ফ্রেন্ডসরা কেমন। এক্সামে আমি কত পাই, আমাকে কে পড়িয়ে দেয় – এইসব।”

“আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি?”

“আর বলেছে তোমার আর অরার কথা শুনতে। লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকতে, কোনো দুষ্টুমি না করতে।”

আরশাদ কিঞ্চিৎ সন্দেহ নিয়ে বলল, “আর কিছুই বলেনি?”

“না তো। আমিই গল্প করেছি, মা শুনেছে।”

“ভালো করে মনে করে দেখ। এমন কিছু বলেনি তো যেটা আবার আমাকে বলতে বারণ করেছে, তাই তুই বলছিস না?”

“না বাবা। এমন কিছুই তো বলেনি।”

প্রায় এক বছর হলো স্থায়ীভাবে দেশে ফিরেছে আশফিয়া। তার মতে, “কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ একা একা বিদেশে পড়ে থাকে না। আমি আগে সুস্থ ছিলাম, এখন পাগল হয়ে গেছি।”
অসুস্থ মন-মস্তিষ্ককে সুস্থ করতেই মূলত দেশে ফিরেছে। কোথায় থাকবে এ নিয়ে বেশ কিছুদিন দ্বিধায় ভুগেছে। দেশে ফিরে প্রথম কয়েক মাস মায়ের কাছে সিলেটে ছিল। একটা সময়ে তার মনে হলো, সিলেটে থেকে কী হবে?

সে ঢাকায় চলে এলো। নিজের ডিজাইনার হাউজ শুরু করলো। আশফিয়া নিজে ডিজাইনিংয়ের কিছু পারে না। কয়েকজন ডিজাইনার নিয়োগ করে একেবারে লাক্সারি জামাকাপড় বানাতে শুরু করেছে। তার বেশিভাগ ক্রেতাই মূলত সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির। আরশাদ তার ফেসবুক পেইজে আশফিয়ার ডিজাইনার হাউজ নিয়ে একটা পোস্ট করতেই রাতারাতি জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় সে।

আরশাদের জন্যে অবশ্য ভালোই হয়েছে। এই বিশাল শহরে আগে ছিল সে অভিভাবকশূণ্য। এখন তার অভিভাবক হয়েছে। যাকে বিপদের সময়ে আবার আনন্দের সময়ে হাতের কাছে পাওয়া যায়। কাল রাতে অরাকে হসপিটালে ভর্তি করার পরও আশফিয়াকে কিছু জানায়নি আরশাদ। জানালেই সব কাজ ছেড়েছুঁড়ে ছুটে আসবে। জানিয়েছে একটু আগে। আশফিয়া তার স্বভাবমত আরশাদের ফোন রেখেই রওনা দিয়েছে হসপিটালের উদ্দেশ্যে।

সিঁড়ির কাছে আশফিয়াকে দেখেই এগিয়ে গেল আরশাদ। আশফিয়ার চোখেমুখে এমন দুশ্চিন্তা দেখা যাচ্ছে, যেন পৃথিবী এই মুহূর্তে ধ্বংসের মুখে।

আরশাদ ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আপা! এই সকাল সকাল কষ্ট করে আসতে গেলে কেন?”

আশফিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, “কেন বিরক্ত হয়েছিস?”

“বিরক্ত তো তোমাকে করলাম।”

আশফিয়া ধমকের সুরে বলল, “গাধার মতো কথা বলবি না তো আরশাদ। অরা হসপিটালে অ্যাডমিট, আর আমি ঘরে বসে নাক ডেকে ঘুমাবো?”

আশফিয়াকে দেখে কথা আগ্রহ নিয়ে বলল, “ফুপি জানো! অরা সিক হয়ে গেছে, ডক্টর ওকে এত্ত বড় একটা ইনজেকশন দিয়েছে।”

আশফিয়া কথার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “সিক হয় কীভাবে? তুই খেয়াল রাখতে পারলি না তোর অরার?”

কথা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “আমি কীভাবে খেয়াল রাখবো? আমি তো এখনো ছোট।”

কথার ছেলেমানুষী কথায় আশফিয়া মিষ্টি হেসে আরশাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী অবস্থা এখন?”

আরশাদ উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে বলল, “তেমন সিরিয়াস কিছু না। স্ট্রেস যাচ্ছিল অনেক, তাই সেন্সলেস হয়ে পড়েছিল। আজকের দিনটা এখানেই থাকতে হবে।”

আরশাদ তার আপাকে নিয়ে বসলো হসপিটালের ভিআইপি লাউঞ্জে। সোফায় আরশাদের কোলের মাথা রেখে শুয়ে মোবাইলে গেম খেলছে কথা।

আশফিয়া চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “কীসের এত স্ট্রেস? কাজের খুব চাপ?”

আরশাদ অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, “না।”

পরমুহূর্তেই সংবিৎ ফিরে পেলো আরশাদ। কাজের চাপের কারণে তো অসুস্থ হয়ে পড়েনি অরা, পড়েছে অন্য কারণে।

আরশাদ সঙ্গে সঙ্গে বলল, “হ্যাঁ!”

“আরশাদ?”

“হুঁ?”

আশফিয়া সন্দেহযুক্ত গলায় বলল, “ঝগড়া করেছিস?”

আরশাদ সত্যিটা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে বলল, “না আপা, তেমন কিছু না।”

আরশাদকে তার আপা চেনে হাড়ে হাড়ে শিরায় শিরায়। আরশাদ আর যাই পারুক, মিথ্যা বলতে একেবারেই পারদর্শী নয়।

আশফিয়া হতবাক ভঙ্গিতে বলল, “মেয়েটা প্রেগন্যান্ট আরশাদ। এই অবস্থায় কী করে ঝগড়াঝাঁটি করতে পারলি!”

আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনুতপ্ত স্বরে বলল, “কথাকে নওশীনের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে গিয়েছিল। আমি বারণ করেছিলাম, আমার কোনো কথাই শোনেনি। আমার মাথা কাজ করছিল না। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। ওভাররিয়্যাক্ট করেছি।”

অরার এমন কান্ডে অবাক না হয়ে পারলো না আশফিয়া। অরাকে তো বুদ্ধিমতী মেয়ে বলেই জানে সে। সেই বুদ্ধিমতী মেয়েটা এত বড় বোকামি করলো কী করে?

বিস্ময় সামলে আশফিয়া বলল, “ভুল করেছে, অনেক বড় একটা ভুল করেছে। মানলাম। তোর রাগকে তো আমার চেনা আছে। নিশ্চয়ই অনেক রুড বিহেভ করেছিস মেয়েটার সঙ্গে।”

আরশাদ দুর্বল স্বরে বলল, “আপা তোমাকে বললাম তো আমার মাথা কাজ করছিল না। ওই রেস্টুরেন্টে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত আমার মনে হচ্ছিল নওশীন ওদের কোনো ক্ষতি করে ফেলবে।”

“ক্ষতি করতে তো আর পারেনি। ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরেছে তো অরা আর কথা।”

“যদি করতো? আমি একবার অরাকে হারাতে হারাতে ফিরে পেয়েছি, আরেকবার হারানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

“বুঝলাম, রাগটা তোর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এখন যে নিজেকে একটু সামলাতে শিখতে হবে ভাই। যখন তখন বকাঝকা করা যাবে না। মেয়েটা এমনিতেই সফটহার্টটেড। তার ওপর আবার এই অবস্থায় স্ট্রেস নেওয়া মোটেও ঠিক নয়। বাবুর ওপর খারাপ প্রভাব পড়বে।”

চুপ করে রইলো আরশাদ। ভুল কোনো কথা তো বলেনি তার আপা। কালকের ঘটনার খারাপ প্রভাব কেবল অরার ওপরে পড়েনি, তার ভেতর লুকিয়ে থাকা ওই ছোট্ট প্রাণটার ওপরেও সমানভাবে পড়েছে। অপরাধবোধ দ্বিগুণ হারে বেড়ে গেল তার মধ্যে।

“আরশাদ?”

“বলো।”

“ম্যাচবক্স ছাড়া দিয়াশলাই কাঠিতে আগুন ধরাতে পারবি?”

আরশাদ না-সূচক মাথা নাড়লো।

“অরা হলো সেই ম্যাচবক্স যা তোকে জ্বলে উঠতে সাহায্য করে। সকলের সামনে উজ্জ্বল করে মেলে ধরে। দুই-তিন বছর আগের পরিস্থতি কল্পনা কর। মানুষ ছিলি তুই? কোনো অনুভূতি কাজ করতো তোর মাঝে? সেই তোকে সুস্থ করে তুলেছে মেয়েটা। নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে।”

আবারও চুপ করে রইলো আরশাদ।

আশফিয়া ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল, “অরাকে কখনো কষ্ট দিস না। তুই নিজেই তাতে কষ্ট পাবি, এই যেমন এখন পাচ্ছিস।”

অরার জ্ঞান ফিরলো সকাল সাতটার দিকে। তবে ক্লান্তির লেশমাত্র যায়নি তার মধ্য থেকে। আবারও ইচ্ছা করছে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে। মাথার ভেতরে ভারী একটা চাপ অনুভব করছে সে।

ডাক্তার কতক্ষণ চেকআপ করলেন তাকে। খুব বুঝেশুনে ওষুধ দিতে হবে তাকে। অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করতে প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়াই যায়। তবে এই সত্যি অন্তঃসত্বা নারীদের জন্যে প্রযোজ্য নয়। তারা অসুস্থ হলেও সুস্থতার জন্যে প্রয়োজনীয় ওষুধ খেতে পারে না। সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।

চেকআপ শেষে অরাকে দেখতে এলো আশফিয়া। বেডের পাশে থাকা সোফায় বসে আছে সে। বেশ দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরশাদ। অরার সামনে পড়তেও ভেতরে ভেতরে বিচিত্র এক জড়তা কাজ করছে তার।

আশফিয়া কোমল স্বরে বলল, “এখন কেমন লাগছে অরা?”

অরা অস্পষ্ট স্বরে বলল, “ভালো আপা।”

এতটুকু কথা বলতেও যেন বহু কষ্ট হলো তার। শরীরে বিন্দুমাত্র বল নেই।

“থাক। আর মিথ্যা বলতে হবে না। দেখেই তো বুঝতে পারছি কতটা ভালো আছো। রেস্ট নাও অরা। ঠিকমত নিজের যত্ন নিবে।”

অরা কী উত্তর দিবে বুঝতে পারলো না। উত্তর সাজানোর ক্ষমতা এই মুহুর্তে তার মস্তিষ্ক হারিয়ে ফেলেছে।

আশফিয়া উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “আরশাদ শোন! তোকে তো আজ সারাদিন এখানে থাকতে হবে। আমি বরং কথাকে আমার সাথে নিয়ে যাই। বেচারির প্রচুর ঘুম পেয়েছে।”

আরশাদ বলল, “থাকুক না আপা। তোমাকে শুধু শুধু বিরক্ত করবে।”

“কথা বলে আমাকে বিরক্ত করবে! মাঝে মাঝে বিরক্ত হতেই ভালো লাগে। যাই আমরা।”

ফুপির সঙ্গে চলে গেল কথা। হসপিটালে রইলো কেবল আরশাদ এবং অরা। আশফিয়া ভুল কিছু বলেনি। অরাকে কষ্ট দিয়ে তার থেকে হাজারগুণ বেশি কষ্ট আরশাদ পাচ্ছে। মেয়েটাকে অমন নিস্তেজভাবে পড়ে থাকতে দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ তার বুকের মাঝে অনবরত হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করেছে। ইচ্ছা করেছে এই মুহূর্তে অরাকে বুকে টেনে নিয়ে হাজারবার ক্ষমা চাইতে। কিন্তু ক্ষমা করার মতো শক্তিও মেয়েটার মধ্যে অবশিষ্ট নেই।

কাল রাত থেকে কিছুই খায়নি অরা। যদিও সেলাইন চলেছে সারারাত। তবুও ডাক্তার নির্দেশ দিয়েছেন, হালকা কিছু খাইয়ে সকলের ওষুধগুলো খাওয়াতে। হসপিটালের কিচেন থেকে এক বাটি কর্ন স্যুপ পাঠানো হলো।

আরশাদ বাটি নিয়ে অরার পাশে বসলো। মেয়েটা চোখ বুজে শুয়ে রয়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

আরশাদ নরম স্বরে বলল, “একটু উঠে বসবে অরা?”

সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে তাকালো অরা। ঘুমায়নি তার মানে মেয়েটা। অরা দুর্বলভাবে উঠে বসার চেষ্টা করতেই আরশাদ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল। বালিশে হেলান দিয়ে বসলো অরাকে। আধ-ঘুম আধ-জাগরণের পর্যায়ে আছে সে। জেগে আছে, তবুও যেন এই পৃথিবীতে নেই। চারপাশে কী ঘটছে কিছুই অনুভব করতে পারছে না।

আরশাদ চামচে স্যুপ তুলে অরার মুখের কাছে ধরতেই সে যন্ত্রের মতো স্যুপ খেয়ে নিলো। স্যুপ অতিরিক্ত গরম থাকায় কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো সে।

আরশাদ উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে বলল, “বেশি গরম?”

অরা দুর্বলভাবে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

এরপর থেকে প্রত্যেকবার আরশাদ যত্ন নিয়ে স্যুপে ফুঁ দিয়ে তুলে দিলো অরার মুখে। কে বলবে এই একই মানুষ গত রাতে অমন ভয়ানক রাগ দেখিয়েছে অরার ওপরে?

একটা সময়ে অরা ক্ষীণ গলায় বলল, “আর খাবো না।”

“আর একটু?”

“উহুঁ!”

আরশাদ আর জোরাজুরি করলো না। ওষুধগুলো খাইয়ে শুইয়ে দিলো অরাকে। ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যেতে খুব একটা সময় নিলো না অরা।

নিঃশব্দে অনেকটা সময় অরার দিকে তাকিয়ে রইল আরশাদ। এই ঘুমন্ত মানুষটা না-কি তার, একান্তই তার। ভাবতেও অবাক লাগে। কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি আবারও নতুন করে কাউকে ভালোবাসতে পারবে তার মনটা। ভালোবাসা জিনিসটার ওপর থেকে তো বিশ্বাসই উঠে গিয়েছিল তার। এই মেয়েটা তাকে ভালোবাসার এক নতুন রূপের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। অরা না থাকলে আরশাদ যে কবে তলিয়ে যেত অতল গহ্বরে!
অরার দিকে তাকিয়ে থেকে তার হাতটা ধরে আরশাদও যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সে নিজেও জানে না।

অরার ঘুম ভাঙলো দুপুরের দিকে। অনেকটাই হালকা লাগছে এখন। মাথার ভেতরে ওই ভারী অনুভূতিটা আর হচ্ছে না। কড়া রোদ জানালা ভেদ করে এসে পড়েছে মুখের ওপরে। অরা ধীরেসুস্থে চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পেলো তার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে আরশাদ। অরা সামান্য নড়ে উঠতেই ঘুম ভেঙে গেল আরশাদের।

আরশাদ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “অরা! কখন উঠলে তুমি?”

অরা হাই তুলে বলল, “এই তো, এইমাত্র।”

“এখন কেমন লাগছে?”

“ভালো।”

আসলেই ভালো লাগছে অরার। শরীরে ঐ ক্লান্তি ভাবটা আর নেই। ডাক্তার আবারও এলেন অরার চেকআপ করতে। সব ঠিকঠাক থাকলেও অবজারভেশনের জন্যে আজকের দিনটা অরাকে হসপিটালেই কাটাতে হবে।

ডাক্তারের চেকআপ শেষে ফ্রেশ হয়ে এলো অরা। নিজে নিজেই উঠে দাঁড়াতে পারলো। নিজেই চুলও বেঁধে ফেলল। বসে বসে কেবল অরার কর্মকান্ড দেখছে আরশাদ। কিছু বলার সাহস করে উঠতে পারছে না। যে গভীর অপরাধবোধে ডুবে গিয়েছিল সে, তা থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি।

একটা পর্যায়ে অবশ্য সাহস করে নীরবতা ভঙ্গ করেই বলল, “অরা?”

“হুঁ?”

আরশাদ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “I’m sorry.”

অরা কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আরশাদের দিকে। সে কী এমন করেছে যার জন্যে সরি বলতে হবে? আরশাদ তো আর শুধু শুধু ধমকাধমকি করেনি অরাকে। অরা বোকার মতো একটা কাজ করে ফেলেছে বলেই করেছে।

অরা শান্ত ভঙ্গিতে আরশাদকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে বলল, “I’m sorry!”

এবার যেন আরশাদের নিঃশ্বাসে প্রাণ এলো। এতটা সময়ে বারবার মনে হচ্ছিল যেন, নিঃশ্বাস নিলেও ফুসফুসের বড় একটা অংশ ফাঁকা রয়ে যাচ্ছে। এখন আর তা মনে হচ্ছে না।

আরশাদ অরার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে অনুতপ্ত স্বরে বলল, “তুমি তো জানোই আমি কত বড় পাগল। কাল যখন জানতে পারলাম তুমি কথাকে নওশীনের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে গেছ, তখন মাথাটা আরও খারাপ হয়ে যায়। রাগটা কন্ট্রোল করতে পারিনি, তোমার সাথেও মিসবিহেভ করে ফেলেছি। I’m so sorry Aura.”

অরা আরশাদের বুক থেকে মাথা তুলে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। আরশাদের রাগটা তো স্বাভাবিক। বরং অরা যে বড় ধরনের ভুল করেছে তার তুলনায় খুব বেশি একটা রাগ দেখায়নি সে অরার ওপর। তবুও এত অনুতপ্ত হওয়ার কী আছে কে জানে?

“বিশ্বাস করো, আমি চাইনি তোমাকে কষ্ট দিতে। কিন্তু ওই মুহূর্তে আমার কেবল মনে হচ্ছিল যদি তোমার আর কথার কোনো ক্ষতি হয়ে যেত? কী নিয়ে বাঁচতাম আমি?”

অরা রহস্যের হাসি হেসে বলল, “এত কৈফিয়ত দিচ্ছো? আমি যা করেছি, তাতে তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে তো আরও বেশি রাগ দেখাতো।”

“আমার জায়গায় অন্য কেউ নেই তো। শুধু আমি আছি, আমিই থাকবো।”

অরা কোমল স্বরে বলল, “আসলে তো আমি সরি। অনেক অনেক সরি। তোমাকে না জানিয়ে তোমার মেয়েকে ওখানে নিয়ে যাওয়া আমার উচিত হয়নি।”

“আমার মেয়ে আবার কী? রাগের মাথায় উল্টোপাল্টা কথা আমি বলেই ফেলি, তাই বলে সেই কথাগুলো নিয়ে আমাকে খোঁচা দিতে পারবে না।”

অরা হেসে ফেলে বলল, “কাল আমার খুব ভয় করছিল জানো।”

“কেন?”

“যখন পুলিশ রেস্টুরেন্টের ভেতর এলো। আমি তো ভেবেছিলাম এটা আসল পুলিশ নয়। গুন্ডাপান্ডারা পুলিশ সেজে এসেছে আমাকে কিডন্যাপ করতে। তখনই আমার মনে হয়েছিল, বিরাট ভুল হয়ে গেছে। তোমাকে একবার জানানো উচিত ছিল। একবার তোমাকে না জানিয়ে, কী বড় বিপদের মুখে পড়েছিলাম। উনার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য থাকলে হয়তো কাল আরও বড় বিপদ হতো।”

“তোমাকে নিয়ে আমি এত ভয়ে থাকি কেন জানো?”

“কেন?”

“কারণ এখন তুমি একা নও। সবসময় তোমার সাথে উনি থাকেন।”

আরশাদ পরম যত্নে হাত রাখলো অরার পেটের ওপরে। কার কথা সে বলছে বুঝতে অসুবিধা হলো না অরার।

আরশাদ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “তোমার আমার ভালোবাসার প্রথম ফসল উনি। উনার কোনো ক্ষতি হলে সহ্য করবো কীভাবে?”

অরা দৃঢ়ভাবে বলল, “আমি উনার কোনো ক্ষতি হতে দিবো না। প্রমিজ করলাম।”

আরশাদ যত্ন নিয়ে একটা চুমু খেল অরার কপালে। আরশাদের এই মোহনীয় স্পর্শগুলোর কারণেই হয়তো জীবনটাকে এত সুন্দর বলে মনে হয় অরার।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আরশাদ কৌতূহলী ভঙ্গিতে বলল, “আচ্ছা অরা। কাল তুমি কী যেন বলছিলে, কথা মায়ের কথা ভেবে ভেবে ট্রমাটাইজড হয়ে পড়েছে?”

“আমি তো প্রথম দিকে চাইনি কথা ওর মায়ের সঙ্গে দেখা করুক। কিন্তু কিছুদিন আগে ওর বুকশেলফে মায়ের ছবি এঁকেছে। আমি ছবিগুলোর ব্যাপারে যখন জিজ্ঞেস করলাম, বলল ওর না-কি মায়ের কথা মনে পড়ে। মাকে মিস করে।”

“এটা তো কথা আমাকে কখনো বলেনি।”

“একপ্রকার ক্লান্ত হয়েই বলেনি। বললেই তুমি ওই এক কথা বলবে, মা বেড়াতে গেছে।
একটা বাচ্চা ভেতরে ভেতরে কতটা ট্রমায় পড়লে এমনটা ভাবতে পারে, একবার চিন্তা করো আরশাদ। আমার মনে হয়েছিল মায়ের সঙ্গে দেখা হলে ওর মনটা অন্তত শান্ত হবে। দেখা করার আগে তোমাকেও জানাইনি, কারণ তুমি শুধু শুধু রাগ করতে। কথাকে যেতে দিতে না।”

আরশাদ কী যেন চিন্তা করে বলল, “অন্যভাবেও তো ট্রমা দূর করা যেত অরা। মেয়েটা একরকম জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। যে জীবন মা নেই, মা বেড়াতে গেছে। কাল হঠাৎ করে মায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে ওর সাজানো জীবনটা যদি এলোমেলো হয়ে যায়? এখন যদি রোজ রোজ কথার মাকে দেখতে ইচ্ছা করে? দুদিন পর তো নওশীন আবারও জেলে ফিরে যাবে। তখন কীভাবে দেখা করাবে কথার সঙ্গে?”

অরা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “এটা তো ভেবে দেখিনি।”

আরশাদ অরাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, “থাক! আর ভাবতেও হবে না। যা হবার হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে যা হবে, সেটা না হয় আমরা একসঙ্গে সামলে নেবো। পারবো না?”

অরা মুচকি হেসে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।

(চলবে)