ফিরে আসা ২ পর্ব-১৪+১৫+১৬

0
116

#ফিরে_আসা২
১৪
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

পর্দা সরিয়ে দিতেই ঝকঝকে আকাশটার দেখা মিলল। এক খন্ড রোদ এসে পড়লো অরার চোখেমুখে। অসহনীয় তীব্র কোনো রোদ নয়, মিষ্টি একটা রোদ। মনের অজান্তেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটে।
দুদিন হলো হসপিটাল থেকে বাড়িতে আনা হয়েছে তাকে। এখন অরা পুরোপুরি সুস্থ। শরীরের দিক থেকেও, মনের দিক থেকেও।

আজকের দিনটার জন্যে তার উৎসাহ-উদ্দীপনার কোনো শেষ নেই। আজ কোনো উপলক্ষ নেই, অন্য দশটা সাধারণ দিনের মতোই আজকের দিনটা। তবুও অরার কাছে বিশেষ। দীর্ঘদিন পর আজ আরশাদের কোনো শুটিং বা মিটিং নেই। পুরোটা দিন আজ বাড়িতে থাকবে সে। চব্বিশ ঘন্টা ভালোবাসার মানুষটা চোখের সামনে! এর থেকে আনন্দের উপলক্ষ অরার কাছে কীই বা হতে পারে? এই উপলক্ষে অরা আজ অফিসে যাবে না। জরুরি কারণ ছাড়া অরা অফিস ফাঁকি দেয় না। আর আজকের কারণটা একটু বেশিই জরুরি।

ছোট ছোট পা ফেলে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল অরা। গভীর ঘুমে ডুবে আছে আরশাদ। কতগুলো চুল তার চোখের সামনে এসে পড়েছে। সারাটা দিন অনায়েসেই এই নিষ্পাপ মুখটার দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায়। আরশাদকে ডাকতে ইচ্ছা হলো না অরার। তবুও ডাকতে হবে।

প্রতিদিন কথাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অফিসে যায় অরা। আজ যেহেতু অফিসে যাবে না, তাই আরশাদ গত রাতে বলে রেখেছিল সেই কথাকে স্কুলে দিয়ে আসবে। পুরো একটা দিন যাতে অরা বাড়ি থেকে না বেরিয়ে রেস্ট নিয়ে কাটাতে পারে। বেচারা এতগুলো দিন পর কাজ থেকে ছুটি পেয়েছে। অরা প্রথমে চায়নি সকাল সকাল আরশাদকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বিরক্ত করতে। মনের এই কথাটা আরশাদকে জানাতেই কড়া ধমক খায় সে।

আরশাদের ভালোবাসার মাঝে নিদারুণ শৈল্পিকতা এখানেই। দীর্ঘদিন পর ব্যস্ততাবিহীন একটা দিন পেয়েছে। চাইলেই তো পারতো বেলা একটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটাতে। ভালোবাসার মানুষটাকে একটু বিশ্রাম দিতে কত আয়োজন তার!

অরা আলতো স্পর্শে আরশাদের পিঠে হাত রেখে বলল, “আরশাদ?”

স্বাভাবিকভাবেই অপরপ্রান্ত থেকে কোনো জবাব নেই। এই ছেলের প্রগাঢ় ঘুম ভাঙানো সহজসাধ্য কাজ নয়।

অরা আবারও ডাকলো, “আরশাদ ওঠো!”

আরশাদ অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ।”

মুখে “হুঁ” বললেও, ওঠার কোনো প্রয়াস নেই আরশাদের মাঝে। ঠিক আগের ভঙ্গিতেই ঘুমে তলিয়ে আছে সে।

অরা তার কাঁধে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলল, “ওঠো না আরশাদ!”

এবার আরশাদের ঘুম ভাঙলো। চোখ পিটপিট করে একবার অরার দিকে তাকিয়ে আবারও আলস্যের ভঙ্গিতে চোখদুটো বুজে ফেলল সে।

ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, “রাতে ঘুমাতে দিবে না, দিনেও ঘুমাতে দিবে না। সমস্যা কী তোমার?”

তৎক্ষণাৎ লজ্জায় লাল হয়ে অরা বলল, “এই অসভ্য! রাতে কখন ঘুমাতে দিলাম না তোমাকে?”

আরশাদ এবার চোখদুটো মেলে তাকালো অরার দিকে। স্বাভাবিক কোনো দৃষ্টি নয়। তার তাকানোর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন নেশাগ্রস্ত তার কাঙ্ক্ষিত নেশাদ্রব্যের দিকে তাকিয়ে আছে। আরশাদের এই দৃশ্য নিমিষেই এলোমেলো করে দিলো অরার ভেতরটা।

আরশাদ নেশাভরা কণ্ঠে বলল, “সারারাত জেগে তোমাকে দেখি, ঘুমানোর সময় কোথায়?”

অবিশ্বাস করার মতো কোনো কথা নয়। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মাঝেমধ্যেই অরা দেখে, এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে আরশাদ। নাটক-সিনেমায় তো এমন দৃশ্য বহুবার দেখেছে সে। প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে, নিতান্তই অবাস্তব এক দৃশ্য। দীর্ঘ সময় একটা ঘুমন্ত মানুষের দিকে কেউ তাকিয়ে থাকতে পারে না-কি? কে জানত, একদিন তার বাস্তবেই দেখা মিলবে সেই অবাস্তব দৃশ্যের!

লজ্জায় বহুকষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে অরা বলল, “আমি বলেছি সারারাত না ঘুমিয়ে আমাকে দেখতে?”

আরশাদ উঠে বসতে বসতে বলল, “আর আমি বলেছি এত সুন্দর হতে?”

খিলখিল করে হেসে উঠে অরা বলল, “নিজের বউয়ের সাথে এভাবে কে ফ্লার্ট করে?”

আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “আমি করি। তোমাকে কে মানা করেছে? তুমিও চাইলে আমার সাথে ফ্লার্ট করতে পারো!”

অরা বহুকষ্টে নিজের লজ্জায় রাঙা মুখটা সামলে বলল, “এই তুমি ওঠো তো! কথার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

আরশাদ অরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “আজ শরীর খারাপ লাগছে না তো?”

“উহুঁ।”

পাসেঞ্জার সিটে বসে রীতিমত ঝিমুচ্ছে কথা। আরশাদ ড্রাইভ করতে করতে আড়চোখে তাকালো মেয়ের দিকে। বেচারি মধ্যে এখনো সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। রাতে তো জলদিই ঘুমিয়ে পড়ে। তবুও স্কুলে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত তার চোখে স্থায়ীভাবে ঘুম লেগে থাকে। এতটুকু বাচ্চাদের স্কুল একটু দেরিতে শুরু হলে কী ক্ষতি হতো?

আরশাদ হাসিমুখে বলল, “জেগে ওঠ বাবা!”

কথা ভ্রু কুঁচকে বলল, “জেগেই তো আছি।”

“আরেকটু ভালো করে জাগ।”

কথা বাবার কথামতো চোখ ডলতে ডলতে সোজা হয়ে বসলো।

কথা আক্ষেপের সুরে বলল, “এটা কিন্তু ঠিক না বাবা।”

আরশাদ অবাক গলায় বলল, “কোনটা?”

“আমি একাই শুধু স্কুলে যাই কেন? তুমি আর অরা কেন যাও না?”

মেয়ের এমন প্রশ্নে আরশাদ হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারলো না।

খানিকক্ষণ চিন্তা করে আরশাদ কোমল স্বরে বলল, “আমি আর অরা তো স্কুলে গেছি। যখন তোর মতো বাচ্চা ছিলাম তখন। এখন তো আমরা বড় হয়ে গেছি। বড়রা কি স্কুলে যায়?”

কথা গাল ফুলিয়ে বলল, “গেলে প্রবলেম কী?”

“প্রবলেম তো কিছুই নেই। শুধু তোর মিস আমাদেরকে ক্লাসে অ্যালাউ করবে না।”

গাড়ি স্কুলের সামনে এসে থামলো। আরশাদ আজ তার বিখ্যাত গাঢ় সবুজ গাড়িটা আনেনি। সুপারস্টার আরশাদ হকের মেয়ে যে এই স্কুলে পড়ে এই তথ্য সকলেরই জানা। তার ওপরে আবার ওই বিখ্যাত গাড়ি স্কুলের সামনে এসে দাঁড়ালে ভয়ানক ভীড় জমে যাবে।

কথা পেছনের সিট থেকে তার স্কুলব্যাগটা আনতে আনতে বলল, “আজ কি তুমি আমাকে পিক করতে আসবে বাবা?”

“হুঁ।”

“ছুটি কিন্তু দেরিতে হবে।”

“কখন?”

“বারোটায়।”

এমনিতে কথার স্কুল ছুটি হয় পৌঁনে এগারোটায়। আজ এত দেরিতে ছুটি হবে কেন এ নিয়ে তেমন একটা প্রশ্ন করলো না আরশাদ।

মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলল, “আচ্ছা। লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকবি কিন্তু।”

কথা হাসি হাসি গলায় বলল, “আমি লক্ষ্মী মেয়ে হয়েই থাকি বাবা।”

কথা গাড়ি থেকে নেমে গেট দিয়ে স্কুলের ভেতর প্রবেশ করলো। গাড়ির কলো কাঁচে ঘেরা জানালা ভেদ করে একদৃষ্টিতে সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রইলো আরশাদ। অন্যান্য বাবা-মায়েরা সন্তানদের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছে। সন্তান স্কুলের মূল দরজায় প্রবেশের আগ পর্যন্ত বাইরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরশাদ। সেই ইচ্ছা থাকলেও, পূরণ করতে পারবে না সে। খ্যাতি জিনিসটা তার ওপর বর্ষিত হয়েছিল আশীর্বাদের মতো। তবে সেই আশীর্বাদস্বরূপ খ্যাতির সঙ্গে যে এত এত বিড়ম্বনা আসবে, কে জানত?

বসার ঘরে সোফায় বসে আরশাদের অপেক্ষা করছে অরা। এই সকাল সকাল টিভিতে ভালো কোনো প্রোগ্রাম থাকে না। রিমোট হাতে নিতে আয়েশি ভঙ্গিতে একটু পর পর চ্যানেল বদলাচ্ছে অরা। একটা রান্নার অনুষ্ঠানে তার চোখ আটকালো। নতুন নতুন রেসিপি পরখ করে দেখতে তার ভালোই লাগে। এখন আর সে উপায়ও নেই, আরশাদের কারণে।

আরশাদ কড়াভাবে নিষেধ করে দিয়েছে, বাবু পৃথিবীতে আসার আগে না-কি আর রান্নাঘরে গিয়ে কাজ নেই অরার। যদিও রান্নাবান্নায় ডাক্তারের বারণ নেই। রান্না তো একটা শিল্প। খানিকক্ষণ রান্না করলে মনেও মেলে শান্তি। তবে সে কথা আরশাদকে বোঝাবে কে? সে মনে করে পৃথিবীতে অরাই প্রথম অন্তঃসত্বা হয়েছে।

দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো অরা। আরশাদ এখন কলিংবেল বাজায়নি। বাইরে থেকে পাসওয়ার্ড চেপে নিজেই দরজা খুলে নিয়েছে।

সময়গুলোকে ফ্রেমে বন্দী করার উপায় থাকলে অরা ঠিক এই মুহূর্তটাকে ফ্রেমবন্দী করে ফেলল। বাড়িতে প্রবেশ করে আরশাদ তার মোহনীয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো অরার দিকে। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে মাত্র, তবে সেই কয়েক সেকেন্ডই যথেষ্ট তাকে পাগল করে দেওয়ার জন্যে।

দরজাটা ফের বন্ধ করে আরশাদ সোফার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, “কথার না-কি আজ বারোটার ছুটি হবে?”

অরা স্বাভাবিকভাবেই বলল, “হুঁ। গতকালই বলে দিয়েছিল। ক্লাসের পর সাইন্স প্রজেক্টে কাজ করতে হবে।”

আরশাদ হতাশ কণ্ঠে বলল, “এতটুকু বাচ্চাদের দিয়ে জোর করে এসব করানোর কোনো মানে আছে?”

অরা মুগ্ধ গলায় বলল, “জোর কোথায়? কথা তো বেশ ভালোই এনজয় করছে। ও আর ওর বন্ধুরা মিলে কী যে চমৎকার একটা সৌরজগতের মডেল বানিয়েছে!”

আরশাদ অরার পাশে বসতে বসতে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “পড়াশোনাটাকে কথা ভালোই এনজয় করে তাই না? আমার একেবারে বিপরীত। বইপত্র চোখের সামনে পড়লেই আমার গায়ে আগুন ধরে যেত।”

“কিন্তু তুমি তো ভালো স্টুডেন্ট ছিল আরশাদ।”

“ভালো স্টুডেন্ট হলেই যে পড়াশোনা এনজয় করতে হবে এমন তো নয়। বাধ্য হয়েই বেশি বেশি পড়তাম। তখন সময় কাটানোর জন্যে তেমন কিছু ছিল না। টিভি ছিল, তবে একটাই মাত্র চ্যানেল দেখা যেত। পড়তে বসা ছাড়া সময় কাটানোর উপায়ও ছিল না। কী যে বিরক্তিকর স্কুল আর কলেজলাইফ! মনে পড়লেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।”

অরা হেসে ফেলে বলল, “তোমার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে যেন এই মুহুর্তে কেউ তোমার কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে পড়তে বসতে বলছে। চলো, ছাদে যাই।”

“ছাদে কেন?”

অরা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “আজ আমরা ছাদে বসে ব্রেকফাস্ট করবো।”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুমি এতগুলো সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠবে?”

“তো?”

আরশাদ উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেমানুষী প্রশয় দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “বুঝেছি, সব তোমার অজুহাত।”

অরা অবাক ভঙ্গিতে বলল, “কীসের অজুহাত?”

“ছোটাছুটি করে বেড়ানোর অজুহাত।”

আরশাদ কথা বলে আর এক মুহুর্তও অপচয় করলো না। তৎক্ষণাৎ অরাকে কোলে তুলে নিলো। আরশাদের আকস্মিক এমন কান্ডে রীতিমত হকচকিয়ে গেল অরা। তবে বিস্ময়ের সঙ্গে সঙ্গে কী যেন মনে করে আবার খিলখিল করে হেসে উঠলো।

আরশাদ তাকে কোলে নিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়ে বলল, “হাসছো কেন?”

হাসি না থামিয়েই অরা বলল, “ভাগ্যিস বলোনি, তোমার কোলে ওঠার অজুহাত।”

আরশাদ ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “সেই অজুহাত তো আছেই, তুমি স্বীকার করো বা নাই করো।”

অরা মজার ছলে বলল, “আহারে! এই দৃশ্য যদি তোমার ওপরে ক্রাশ খাওয়া মেয়েগুলো দেখতো, নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক করতো।”

যতই দিন যায়, মেয়েটা ততই অবাক করে তোলে আরশাদকে। আরশাদকে নিয়ে মনে মনে স্বপ্ন সাজায় দেশের হাজারো মেয়ে। অরার জায়গায় অন্য কেউ হলে তো এটা নিয়ে হিংসায় জ্বলে যেত। অথচ অরা কিনা হাসছে তাদের নিয়ে।

অরার নির্দেশ অনুযায়ী ব্রেকফাস্টের চমৎকার আয়োজন করেছে স্টাফরা। মেঝেতে একটা চাদর বিছানো, মাথার ওপরে বিশাল ছাতা। একটা ফ্লাক্সে কফি, আর কাঁচের স্বচ্ছ জগে জুস। একটা বাস্কেটে তাদের ব্রেকফাস্ট। মনে হচ্ছে যেন আর্ষস আরশাদ আর অরা বাড়ির মধ্যে থেকেই দূরে কোথাও পিকনিকে এসেছে।

আরশাদ মজার ছলে বলল, “এই সকাল সকাল যে ডেটে নিয়ে আসবে, আগে বললেই পারতে।”

অরা কিছুই বলল না। এই ছেলে যে অরাকে বারবার লজ্জায় ফেলে দিয়ে কী মজা পায়, সেই জানে!

দুজনে বসলো পাশাপাশি। পাশাপাশি বললে ভুল হবে। আরশাদ বসেছে অরার গা ঘেঁষে। অদ্ভুত মোহনীয় এক পরিবেশের সৃষ্টি হলো। মাথার ওপরে আলোছায়া খেলা করছে আর পাশে প্রিয় মানুষটা।

ব্রেকফাস্ট করতে করতে হঠাৎ কী যেন মনে করে অরা আগ্রহ নিয়ে বলল, “আচ্ছা আরশাদ? যদি আমাদের বিয়েটা না হতো? তাহলে কী হতো?”

আরশাদ অবাক ভঙ্গিতে বলল, “বিয়ে হতো না কেন?”

“না মানে, যদি ওইদিন আমি হলওয়েতে জ্ঞান হারিয়ে না ফেলতাম, আর যদি ওই সিসিটিভি ফুটেজটা ভাইরাল না হতো? তাহলে তো আমাদের বিয়েটাও হতো না।”

আরশাদ দৃঢ়ভাবে বলল, “তাহলেও হতো।”

“কীভাবে?”

আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “ভাগ্যে লেখা ছিল না? বিয়ে না হয়ে উপায় কী? হয় আমি তোমার প্রেমে পড়ে যেতাম, না হলে তুমি আমার।”

মুগ্ধ-বিস্মিত দৃষ্টিতে অরা তাকিয়ে রইল আরশাদের দিকে। এই মানুষটা ভাগ্যে বিশ্বাস করে না বললেই চলে। অথচ, ভালোবাসার বেলায় তার সকল যুক্তি যেন বিপরীতে চলে। ভাগ্য বলে সত্যিই যদি কিছু থাকে, তবে সে তো কোনোকালেই সহায় হয়নি অরার প্রতি। সে ভাগ্যই অরার জন্যে রেখে দিয়েছিল এই মানুষটাকে? আজও অবিশ্বাস্য বলে মনে হয় তার।

আরশাদ হালকা গলায় বলল, “তুমি কখনো আমার প্রেমে পড়নি?”

“পড়েছি তো।”

“বিয়ের আগে?”

“না, বিয়ের আগে না। বিয়ের পরে প্রেমে পড়েছি।”

আরশাদ কৃত্রিম হুমকির স্বরে বলল, “সত্যি করে বলবে কিন্তু!”

অরা মিষ্টি হেসে বলল, “সত্যিই বলছি। এদেশে প্রতিদিন হাজারো মেয়ে তোমার প্রেমে পড়ে। তোমার লুকস, অভিনয়, কথার বলার ধরনের প্রেমে হাবুডুবু খায়। কিন্তু আমি কোনো সুপারস্টারের প্রেমে পড়িনি। যে মানুষটা আমার আশেপাশে থাকে, নিঃসঙ্কোচে তার সিক্রেরগুলো আমাকে বলে দিতে পারে, আমি তার প্রেমে পড়েছি।”

আরশাদ অন্যরকম গলায় বলল, “উফ অরা! তুমি এত রোমান্টিক হলে কবে থেকে?”

আবারও চুপ করে রইলো অরা। এই ছেলেটার সঙ্গে আর পারা যায় না!

কিছুটা সময় চুপ করে থেকে আরশাদ বলল, “মাঝে মাঝে আমার কী মনে হয় জানো অরা?”

“কী?”

মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরশাদ বলল, “তুমি আমার জীবনে আরও আগে এলে খুব ভালো হতো।”

“আগেই তো এসেছিলাম, তুমিই খুঁজে পেতে দেরি করলে।”

আরশাদ বিস্মিত ভঙ্গিতে বলল, “আমার সেই কাজপাগল সুটেজ-বুটেজ ম্যানেজার, যাকে দিনে হাজারবার ধমক দেওয়া যায়, সে না-কি এখন আমার বউ! ভাবতেও অবাক লাগে। মাঝেমধ্যে তো ঘুম থেকে উঠে পাশে তোমাকে দেখে চমকে উঠি আমি।”

খানিক হেসে আরশাদের দিকে তাকিয়ে রইলো অরা। বাকিটা সময় তাদের নীরবতার মাঝেই কাটলো। প্রশান্তিময় নীরবতা। নীরবতা না-কি কোনো আনন্দের বিষয় না, অথচ আরশাদের সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তই অরার কাছে আনন্দময়। হোক সেটা নীরবে কিংবা সরবে।

ছাদ থেকে নিচে নেমে এসে আরশাদ লক্ষ করলো তার ফোনে কতগুলো মিসড কল। তার ম্যানেজার, সিনেমার ডিরেক্টর, কে ফিল্মসের পিআর টিমের হেড। সবই কাজের কল। আজ নিজেকে কোনপ্রকার কাজে জড়াতে চায় না আরশাদ। এই কলগুলো ব্যাক করলে কথাবার্তা সারতে সারতে অন্তত এক ঘন্টা লাগবে। কাজবিহীন দিনের এক ঘন্টা কাজকে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। পুরোটা দিনই আজ আরশাদ দিতে চায় অরাকে। ফোনটা তাই সুইচ অফ করে রেখে দিলো আরশাদ।

ব্রেকফাস্টের পরবর্তী সময়টা দুজনের কাটলো টিভির সামনে। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার টেস্ট ম্যাচ চলছে। অরা ক্রিকেট দারুণ উপভোগ করলেও টেস্ট ম্যাচ ঠিক বুঝতে পারেনি। আরশাদ তাকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে।

এক পর্যায়ে অরা আচমকা বলে উঠলো, “আচ্ছা আরশাদ? তোমার স্বপ্ন কী?”

আরশাদ কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়েই বলল, “হঠাৎ এই প্রশ্ন? তোমাকে তো বলেছিলাম, ছোটবেলায় আমার স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার হবো।”

“একটা স্বপ্ন পূরণ না হলে কি মানুষের মনে আরেকটা স্বপ্ন জাগতে পারে না? এই যেমন আমার স্বপ্ন ছিল একদিন অনেক অনেক সাকসেসফুল হবো। সাকসেসফুল হয়েও গেলাম। তবে স্বপ্ন পূরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।”

আরশাদ আগ্রহ নিয়ে বলল, “তাই না-কি? তা নতুন স্বপ্নটা কী?”

অরা দুষ্টুমির ছলে, “আগে আমি প্রশ্ন করেছি!”

আরশাদ পরাজয় স্বীকার করে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “আমার স্বপ্ন হলো ভিন্ন ভিন্ন সিনেমা করা। একটা সিনেমার গল্পের সাথে আরেকটার মিল থাকবে না। এদেশের মানুষের একটা অংশের তো এখনো দেশী সিনেমার ওপর ভরসা গড়ে উঠতে পারেনি। আমি সেই ভরসাটা গড়তে চাই। মানুষ যাতে গল্পের টানে হলে যায়, আমার জন্যে না।”

অরা মুগ্ধ গলায় বলল, “বাহ্! চমৎকার।”

“আর তোমার স্বপ্ন?”

অরা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়ে বলল, “বেশি কিছু না। আমার স্বপ্ন রিটায়ারমেন্টের পর সমুদ্রের পাড়ে থাকবো। ছোট্ট একটা কাঠের ঘর থাকবে আমাদের সমুদ্রের পাড়ে। এমন একটা জানালা থাকবে, যেটা দিয়ে ঘর থেকেই সরাসরি সমুদ্র দেখা যায়। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই তোমার হাত ধরে সমুদ্রের পাড়ে হাঁটবো।”

আরশাদ ভ্রু ওপরে তুলে বলল, “বাব্বাহ! তুমি এত রোমান্টিক স্বপ্নও দেখতে পারো?”

অরা লজ্জিত গলায় বলল, “তুমি আবার শুরু করলে?”

“রিটায়ারমেন্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে কেন? ডেলিভারির আগ দিয়েই চলো তোমার স্বপ্নটা পূরণ করে আসি। মাসখানেক সমুদ্রের পাড়ে থাকবো।”

“ডেলিভারির আগে আমি না হয় মেটার্নিটি লিভে থাকবো। কিন্তু তুমি যাবে কী করে? তোমাকে তো কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হবে।”

আরশাদ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “আমি যে লিভ নিবো না সেটা কে বলল তোমাকে?”

অরা হতবাক গলায় বলল, “মানে?”

আরশাদ সহজ গলায় বলল, “পেটার্নিটি লিভ। তোমার প্রেগন্যান্সির আট মাস থেকে বাবুর তিন-চার মাস বয়স পর্যন্ত সব কাজ থেকে আমার ছুটি। এই সময়টা তোমাদের সঙ্গে থাকবো।”

অরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “আরশাদ! তুমি কি একেবারেই পাগল হয়ে গেলে? কাজের কতটা ক্ষতি হয়ে যাবে বুঝতে পারছো?”

“তুমিও তো লিভে থাকবে। তোমার কাজের ক্ষতি হবে না?”

“আমাকে তো লিভে থাকতেই হবে আরশাদ।”

“আমাকেও লিভে থাকতেই হবে। প্রেগন্যান্সির শেষ সময়টাতে তুমি কষ্ট করবে, বাবু আসার পর একা একা ওকে সামলাবে। আর আমি স্বার্থপরের মতো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকবো?”

আমাদের সমাজের ওই এক ভ্রান্ত ধারণা। সন্তান জন্ম দেবে মেয়েরা, তাই শুধুমাত্র তাদের কাজ থেকে বিরতি নিলেই চলবে। অথচ সন্তান জন্মদানের সময় একটা মেয়ের তার ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে যে কী পরিমাণের মানসিক সহায়তার প্রয়োজন হয়, এটা তারা বোঝে না। আরশাদ বোঝে, সেজন্যেই অরার পাশে থাকতে চাইছে। প্রকৃতি যে এই ছেলেটাকে কীভাবে তৈরি করেছে কে জানে!

দিনটা এভাবেই প্রশান্তির মাঝে কেটে গেল। কথা স্কুল থেকে ফেরার পর আরশাদ আর অরা দুজনেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো তার স্কুলের গল্প শুনতে।

দুপুরের দিকে ফোনটা সুইচ অন করতেই আরশাদ দেখতে পেলো, আশফিয়ার মিসড কল। এই মানুষটার কল এড়িয়ে গিয়ে কাজ নেই। শেষমেশ কঠিন ধমধমকির মুখোমুখি হতে হবে তাকে।

আরশাদ কলব্যাক করতেই অপরপ্রান্ত থেকে আশফিয়া হড়বড় করে বলল, “আরশাদ শোন! আগামী সপ্তাহে তুই আর অরা ফ্রি আছিস।”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “না নেই।”

আশফিয়া ধমকের সুরে বলল, “আমি কোনো প্রশ্ন করিনি গাধা। আমি বলেছি ফ্রি আছিস, তার মানে ফ্রি আছিস।”

“তুমি বললেই ফ্রি থাকা যায় না-কি? আমার শুটিং শুরু হবে, দম ফেলারও সময় থাকবে না আগামী সপ্তাহে।”

আশফিয়া বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “শুটিং পিছিয়ে দে না বাপ! এমন তো না যে প্রোডিউসারের সিনেমায় অভিনয় করছিস। তুই নিজেই প্রোডিউসার, এত চিন্তা কীসের?”
“আগামী সপ্তাহে কী সেটা তো বলবে?”

“মায়ের জন্মদিন।”

আরশাদ বিস্ময়মাখা কণ্ঠে বলল, “মায়ের আবার জন্মদিনও আছে?”

আশফিয়া গর্ব করে বলল, “এত দিন ছিল না। কিন্তু আমি শার্লক হোমসের মহিলা ভার্সনের মতো খুঁজে বের করেছি।”

“কীভাবে খুঁজলে?”

“আমি যখন সিলেটের বাড়িতে ছিলাম না? তখন পুরনো কিছু চিঠিপত্র ঘাটাঘাটি করে নানীর লেখা একটা চিঠি খুঁজে পাই। নানাকে লিখেছে। নানার তখন চিটাগংয়ে পোস্টিং। নানী লিখেছে তাদের ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে। জন্মের দিন, তারিখ, সময় স্পষ্টভাবে লেখা। মেয়ের নাম কী রাখবে তাই জানতে চেয়েছে নানী।”

“জন্মদিনটা কবে?”

“ষোলো তারিখ। আরশাদ শোন, আমি কিন্তু কোনো অজুহাত শুনছি না। আগামী শুক্রবার আমরা সবাই দলবেঁধে সিলেটে গিয়ে মেয়ে জন্মদিন সেলিব্রেট করবো। এটাই আমার ফাইনাল কথা।”

(চলবে)

#ফিরে_আসা২
১৫
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

শীত কি এ বছর আগে আগেই চলে এলো না-কি? না বোধ হয়। ঢাকায় তো এ সময় অসহনীয় গরম। মাথার ওপরে কড়া রোদটার উত্তাপে চোখ মেলে তাকানোই দুঃসাধ্য। অথচ এখানে শীতের রীতিমতো থরথর করে কাঁপছে অরা। সকাল আটটা, অথচ রোদের দেখা নেই। শীত সহ্য করতে না পেরে শাড়ির ওপরে আরশাদের একটা শার্ট গায়ে জড়িয়ে রেখেছে। তবুও যেন মানছে না শীত।

গ্রামে না-কি আগেভাগেই শীতে এসে যায়। অরার শ্বশুরবাড়িটাকে ঠিক গ্রামের কাতারে ফেলা যায় কিনা কে জানে? বাড়ির চারিদিকে পাহাড়ঘেরা চা বাগান। রান্নাঘরের জানালা থেকে চমৎকার একটা দৃশ্য দেখতে পেল অরা। কুয়াশাঘেরা আকাশের মাঝে ডুবে আছে বিশাল এক পাহাড়। পাহাড়ের নিচে সারি সারি চা গাছ। মনে অজান্তে মিষ্টি এক হাসির ফুটে উঠল অরার ঠোঁটে। আচমকা এই ছুটিটা আসায় ভালোই হলো। মন খানিকক্ষণের জন্যে হলেও স্বস্তি পেয়েছে।

শুধু তার মন কেন? তার মাঝে লুকিয়ে থাকা ওই ছোট্ট সুপারস্টারও স্বস্তি পেয়েছে খানিকটা। অরা কনসিভ করার পর থেকে কেবল ঢাকার যান্ত্রিকতার মাঝে ডুবে রয়েছে। বাবুকে প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সময়টাই হয়ে ওঠেনি।

আরশাদের ব্যস্ত শিডিউলের মাঝ থেকে সময় বের করে সিলেটে বেড়াতে এসেছে তারা। উপলক্ষ, মায়ের জন্মদিন। প্রথমবারের মতো ঘটা করে সেলিনা হকের জন্মদিন পালন করা হবে। তিনি অবশ্য এসবের কিছুই জানেন না। তাকে বলা হয়েছে, এমনি ছুটি কাটাতে পরিবারের সকলে বেড়াতে এসেছে এখানে। জন্মদিনে আচমকা সারপ্রাইজ দিয়ে তাকে চমকে দেওয়াই সকলের উদ্দেশ্য।

পানিতে বলক ফুটে উঠেছে। জানালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চায়ে মনোযোগ দিল অরা। ওদিকে বাংলাঘরে গুরুতর মিটিং চলছে। আরশাদ তার কাজিনদের নিয়ে সারপ্রাইজ প্ল্যানিং করছে। সেই মিটিংয়ে অরার প্রবেশাধিকার নেই। যদিও এ নিয়ে ভোরবেলা এক দফা তর্কাতর্কি হয়েছে আরশাদ এবং তার মাঝে। সেই তর্ক সসম্মানে জিতেও নিয়েছে আরশাদ।

দুটো কাপে চা ঢেলে তা নিয়ে উঠানোর দিকে পা বাড়ালো অরা। উঠানে কাঠের মোড়ায় বসে আছেন সেলিনা হক।

অরাকে ট্রেন হাতে প্রবেশ করতে দেখি তিনি উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, “তুমি শুধু শুধু এত কষ্ট করতে গেলে কেন বৌমা?”

অরা মুচকি হাসি হেসে বলল, “চা বানানো বুঝি খুব কষ্টের কাজ?”

অরা সামনের টেবিলে ট্রে নামিয়ে রেখে সেলিনা হকের পাশের মোড়ায় বসলো। সেলিনা হক যত্নের সঙ্গে ধরে বসালেন তাকে।
ওরা চায়ের কাপ তুলে তার দিকে বাড়িয়ে দিলো।

তিনি কাপ হাতে নিয়ে বললেন, “তোমার কষ্ট হলো না?”

সেলিনা হকের কথার ভঙ্গি শুনে মনে হচ্ছে যেন তিনি বিরাট অপরাধ করে ফেলেছেন। আর এখন সে অপরাধের জন্য অনুশোচনা করছেন।

ছেলে মানুষের ছেলে মানুষই প্রশ্রয় দেওয়ার ভঙ্গিতে হেসে অরা বলল, “আচ্ছা মা, একটা কথা সত্যি করে বলুন তো। আপনিও তো দুই সন্তানের মা হয়েছেন। তারা যখন গর্ভে ছিল তখন কি আপনিও কাঠের পুতুল হয়ে ঘরে বসে থাকতেন?”

সেলিনা হক বুঝ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “একেবারেই কাজ করতে নিষেধ করছি না। তবে প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে একটু সাবধান থাকতে হয়।”

অরা আশ্বাস দিয়ে বলল, “আমি সাবধানেই আছি মা। চায়ে চিনি হয়েছে?”

সেলিনা হক প্রশংসার সুরে বললেন, “একদম! তোমার হাতের চা অবিকল আমার শাশুড়ির বানানো চায়ের মতো।”

অরা অবাক গলায় বলল, “তাই না-কি?”

“হ্যাঁ! সকালের নাস্তা বাড়ির বৌয়েরা তখন তৈরি করতাম। শুধু চা তিনি কাউকে বানাতে দিতেন না।”

খানিকটা সময় নীরবতার মাঝে সকালটা উপভোগ করলো দুজনে। এর মাঝে বাড়ির পেপারওয়ালা পেপার বিলি করতে এসে দেরি করার অপরাধে কয়েক দফা সেলিনা হকের ধমক খেয়ে নিল।

চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে সেলিনা হক বললেন, “কথা উঠেছে?”

অরা হাসিমুখে বলল, “না! উনার ঘুম ভাঙতে ভাঙতে বেলা একটা।”

মুগ্ধ দৃষ্টিতে অরার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন সেলিনা হক। কথার প্রসঙ্গ এলে জ্বলজ্বল করে ওঠে মেয়েটার চোখদুটো। কথার প্রতি এই মেয়েটার এত টান না থাকলে কী যে হতো, কল্পনা করেই শিউরে ওঠেন তিনি।

সেলিনা হক ইতস্তত করে বললেন, “তোমাকে একটা মনের কথা বলবো বৌমা?”

অরা আগ্রহ নিয়ে বলল, “বলুন না মা!”

সেলিনা হক কৃতজ্ঞার সুরে বললেন, “আমি তোমার প্রতি সত্যিই অনেক কৃতজ্ঞ। তুমি যেভাবে কথার দেখাশোনা করছো, প্রশংসা না করে পারি না।”

অরা প্রচ্ছন্ন হাসি হেসে বলল, “আপনার সন্তানরা যখন ছোট ছিল তখন আপনি তাদের দেখাশোনা করেননি?”

“করেছি তো।”

“কেউ আপনার প্রশংসা করেছে?”

“না মানে…”

অরা সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “আমি কথার দেখাশোনা করবো না তো কে করবে মা? এজন্যে আবার কৃতজ্ঞতা দেখাতে হয় না-কি?”

সেলিনা হক আবারও মুগ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রইলেন অরার দিকে। এই মেয়েটা বলেই সম্ভব! তার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে, এ জীবনে কোনদিন কথাকে তার মতো আপন করে নিতে পারতো না।

বাংলাঘর থেকে হইচইয়ের শব্দ ভেসে আসছে। এরই মাঝে আবার আরশাদের কড়া ধমকের আওয়াজও পাওয়া গেল।

সেলিনা হক কৌতূহলভরা কণ্ঠে বললেন, “ওরা এই সকাল সকাল কী করছে বলো তো?”

অরা রহস্যমিশ্রিত গলায় বলল, “সেটা তো মা আপনাকে বলা যাবে না।”

বাংলাঘরে কী হচ্ছে এ নিয়ে সেলিনা হকের প্রবল কৌতূহল থাকেলও আপাতত তার বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন না। আবারও ভেসে এলো আরশাদের ধমকের আওয়াজ। তার বিচ্ছু কাজিনগুলোকে এরূপ ধমকাধমকি ছাড়া সামলে রাখা মুশকিল।

সেলিনা হক নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন, “রাগ কোরো না বৌমা। তোমার ওপর আরও একটা কারণে আমি কৃতজ্ঞ।”

অরা মজার ছলে বলল, “আপনি দেখি কৃতজ্ঞতার দোকান খুলে বসেছেন মা! এত ফর্মালিটি করলে আমি কিন্তু উঠে চলে যাবো।”

“আহা শোনো না।”

অরা মনোযোগী শ্রোতার ন্যায় তাকিয়ে রইলো শাশুড়ির দিকে।

সেলিনা হক আর্দ্র গলায় বললেন, “আমার ছেলেটা আজ হাসছে, সকলের সঙ্গে মিশছে। কয়েক বছর আগে যেন নিজের ছেলেকেই চিনতে পারতাম না। ক্যামেরার সামনে হাসতো ঠিকই, তবে সেই হাসি যে আসল নয় সেটা আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতে পারতাম। নিজেকে কেমন গুটিয়ে নিয়েছিল আরশাদ। আর সেই ছেলেটা কাজ আবারও আগের মতো হয়ে গেছে। শুধুমাত্র তোমার কারণে।”

কথাগুলো বলতে বলতে চোখের পলকেই টপটপ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো সেলিনা হকের চোখ বেয়ে।

অরা ব্যস্ত হয়ে কোমল স্বরে বলল, “কাঁদবেন না তো মা! কত বছর পর কাউকে মা ডাকছি জানেন? আমার মা তো সেই ছোটবেলাতেই আমাকে রেখে চলে গেল। এরপর তার জায়গায় আরেকজন এলেও তাকে মা ডাকতে পারিনি কখনো। মা ডাকা কি এতই সোজা? তবে আপনাকে দেখে মনের অজান্তেই মা ডাকটা বেরিয়ে আসে। আপনার চোখে জল সহ্য করি কী করে মা?”

বাংলাঘরের বিছানা আর মেঝেতে এলোমেলো হয়ে বসে আছে আরশাদের সকল কাজিনরা। সেলিনা হকের জন্মদিন উদযাপন করতে ঢাকা থেকে ছুটে এসেছে দিশা, রনি, মেহের, আকাশরা। আধ ঘন্টা যাবত পাকাপোক্ত একটা প্ল্যান দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে আরশাদ। এদের হইচইয়ের কারণে কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। রাগে-বিরক্তিতে সহ্যের সকল সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আরশাদের।

দাঁতে দাঁত চেপে আরশাদ বলল, “এই তোরা থামবি?”

থামবার ভাবলক্ষণ কারও মাঝেই প্রকাশ পেলো না। সকলে নিজেদের মধ্যে কথা বলেই যাচ্ছে।

আরশাদ এবার প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে বলল,
“চুপ কর ছাগলের দল!”

আচমকা নীরবতার হাওয়া বয়ে গেল বাংলাঘরে। ছোট ভাই-বোনেরা সকলেই তাদের আরশাদ ভাইয়াকে ভয় পায়।

তবুও কী যেন মনে করে দিশা সাহস করে বলল, “ভাইয়া তুমি কিন্তু এভাবে মানুষকে ছাগল ডাকতে পারো না। এটা একই সঙ্গে মানুষ এবং ছাগল দুই জাতিকেই অপমান করা।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আরশাদ বিরক্ত গলায় বলল, “বের হ।”

“মানে?”

আরশাদ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “বেরিয়ে যা এখান থেকে। গাড়িতে উঠে সোজা ঢাকায় গিয়ে নামবি। এমন সচেতন মানুষের দরকার নেই এখানে।”

দিশা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে বলল, “আরে বাবা তুমি রেগে যাচ্ছো কেন?”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “বের হবি?”

দিশা গাল ফুলিয়ে বলল, “আচ্ছা সরি, সরি।”

আরশাদ শুকনো গলায় বলল, “আমরা এখানে কেন এসেছি?”

সঙ্গে সঙ্গে আকাশ লাফিয়ে উঠে বলল, “বেড়াতে!”

ঘরে থাকা সকলেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করলো তার দিকে। এই ছেলেটার ভুল সময়ে ভুল কথা বলার অভ্যাস আর গেল না!

আরশাদ আবারও ধমক দিতে যাবে তার আগেই রনি হড়বড় করে বলল, “ফুপুর বার্থডে সেলিব্রেট করতে।”

আরশাদ বিরক্ত স্বরে বলল, “একটা বার্থডে পার্টির আয়োজন করতে হবে। কোনো সায়েন্টিফিক গবেষণা তো করতে হবে না। তোরা এত ঘাবড়ে যাচ্ছিস কেন?”

দিশা বলল, “কারণ এটাই খালার প্রথম বার্থডে।”

“তাতে কী হয়েছে? শোন, তোদের সব ছাগলগুলোকে দুটো গ্রুপে ভাগ করা হবে। প্রত্যেক গ্রুপের দায়িত্ব একটা করে কেক বানানো।”

রনি হতবাক গলায় বলল, “কেক?”

“মনে হচ্ছে যেন আকাশ থেকে পড়লি? কেকের নাম শুনিসনি কখনো? ওই যে গোল দেখতে, ক্রিম দিয়ে মোড়া থাকে। ওপরে ক্যান্ডেল জ্বালানো হয়।”

রনির ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। বছরে দুয়েকবার কোনো উপলক্ষ্য উদযাপন করার জন্যে এক হয় তাদের পুরো পরিবার। তবুও কোনোবারই মন মতো আনন্দ করতে পারে না রনি। প্রত্যেকবারই এমন উদ্ভট একটা দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে দেয় আরশাদ।

রনি আহত গলায় বলল, “মজা নিচ্ছো ভাইয়া? কেক চিনবো না কেন? কিন্তু আমরা তো কেক বানাতে পারি না।”

দিশা ভেংচি কেটে বলল, “আমরা না, বলো আমি। ভাইয়া আমরা কেক বানাতে পারবো।”

আরশাদ বলল, “ভেরি গুড। আর শোন, কেকের ডিজাইন কিন্তু ইউনিক হতে হবে। ওসব ফুল-লতা-পাতার ডিজাইন করে আনবি না।”

“তুমি কোনো চিন্তা কোরো না ভাইয়া।”

রনি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, “কিন্তু আমার কী হবে? আমি তো কেক বানাতেই পারি না।”

আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “এই যুগে পারি না বলতে কোনো কথা নেই। ইউটিউব দেখে শিখে নিবি! আমার একটাই কথা, দুটো গ্রুপ থেকে দুটো কেক লাগবেই। আর খবরদার, বাইরে থেকে কিনে আনার চেষ্টা করবি না।”

দিশা আর মেহের ইতোমধ্যেই কাগজ-কলম নিয়ে কেকের ডিজাইন করতে শুরু করলো। ওদিকে রনি আর আকাশ কী লিখে ইউটিউবে সার্চ করলে কেকের রেসিপি পাওয়া যাবে তা ভাবতে ব্যস্ত।

এরই মাঝে বাংলাঘরে প্রবেশ ঘটলো আশফিয়ার। আরশাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তার দিকে। আজকের এই মিটিংয়ের শুরু আশফিয়ারও থাকার কথা ছিল। তার কারণেই তো সকলের জন্মদিন উদযাপন করতে সিলেটে আসা। অথচ সেই কিনা, মিটিং বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে ছিল!

ভাইয়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উপেক্ষা করে আশফিয়া বিছানার ওপরে বসতে বসতে বলল, “কী রে? এই সকাল সকাল তোরা মিটিংয়ে বসে গেছিস?”

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “হাতে মাত্র আজ আর কালকের দিনটা। সময় নষ্ট করার সময় কোথায়?”

“তুই শুধু শুধু এত ব্যস্ত হচ্ছিস আরশাদ। মায়ের যে একটা জন্মদিন আছে, এটা তো সে নিজেই জানে না। ছোট্ট একটা কেকের ওপর ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে তাকে উইশ করলেই দেখবি কত খুশি হয়ে যাবে।”

আকাশ আবারও লাফিয়ে উঠে বলল, “সেটাই তো!”

আরশাদ তার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই দমে গেল সে।

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “ঢাকা থেকে এত দূরে এসেছি ছোট্ট একটা কেক দিয়ে বার্থডে সেলিব্রেট করার জন্যে? তোরা আপার কথা শুনে খুশিতে লাফাবি না। আমি যেভাবে বলেছি, সেভাবেই বার্থডে সেলিব্রেট হবে।”

মেহের হঠাৎ কৌতূহলী গলায় বলল, “আচ্ছা ভাইয়া, আমরা যে এত আয়োজন করবো খালা তো দেখে ফেলবে। সারপ্রাইজ দিবো কী করে?”

আরশাদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই আশফিয়া বলল, “আমি ওই দিন সকাল সকাল মাকে নিয়ে চেকআপে চলে যাবো। যতটা সময় পারা যায় বাইরে ঘোরাঘুরি করবো। এই ফাঁকে তোরা সব কাজ সেরে ফেলিস।”

নিজেদের মধ্যে মিটিং সেরে আরশাদ আর আশফিয়া গেল তাদের খালা আর মামীদের সঙ্গে মিটিং করতে। জন্মদিন রান্নাবান্নার দায়িত্ব তাদের ওপরেই পড়েছে।

বেলা একটার আগেই জেগে উঠলো কথা। লাল টুকটুকে একটা ফ্রক পড়ে বেণী দুলিয়ে দুলিয়ে সারা বাড়িজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর সকলের সঙ্গে মিশছে সে। অরা এই সুযোগে বিছানা গুছিয়ে নিচ্ছে। আরশাদ তো কোনো কাজই করতে দেয় না তাকে। একেবারে কোনো কাজ না করলে যে শরীরটা অকেজো হয়ে পড়বে, এ কথা তাকে বোঝায় কে?

হঠাৎই বেজে উঠলো অরার ফোন। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে মাহমুদের নাম। অরা একবার ভাবলো ফোনটা রিসিভ করবে না। বেড়াতে এসে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কোনো মানে হয় না। তবে পরমুহূর্তেই জরুরি কল ভেবে রিসিভ করলো সে।

ফোন রিসিভ করতেই শোনা গেল মাহমুদের চিন্তিত কণ্ঠস্বর, “হ্যালো? ম্যাম আপনি কোথায়? আজ অফিসে আসবেন না?”

মনে মনে কিঞ্চিৎ বিরক্ত না হয়ে পারলো না অরা। সে অফিসে যাবে কি যাবে না, তার কৈফিয়ত এই ছেলেটাকে দিতে হবে কেন?

তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে অরা ভদ্রভাবে বলল, “আমি তো ছুটিতে মাহমুদ।”

মাহমুদ সঙ্গে সঙ্গে অনুতপ্ত ভঙ্গিতে বলল, “ও সরি, সরি। আমি আপনার কেবিনে এসেছিলাম একটা ফাইল দেখাতে। অথচ কেউ আমাকে বললই না আপনি ছুটিতে।”

“সমস্যা নেই, তুমি ফাইলটা আমাকে মেইল করে দাও।”

“জি আচ্ছা ম্যাম।”

ল্যাপটপ ওপেন করে মাহমুদের পাঠানো ফাইলটা চেক করলো অরা। তেমন কোনো ভুল চোখে পড়ছে না। ফিরতি মেইলে, ফাইলটাকে অ্যাপ্রুভ করলো অরা।

মিনিট পাঁচেক না পেরোতেই আবারও মাহমুদের কল। অরা ভ্রু কুঁচকে রিসিভ করলো, তবে মুখে কিছুই বলল না।

মাহমুদ বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল, “ম্যাম? সরি আবারও বিরক্ত করলাম।”

অরা এক হাতে ফোনটা চেপে ধরে আরেক হাত দিয়ে বেডসাইড টেবিলে রাখা বইগুলো গোছাতে গোছাতে বলল, “না, না বলো।”

“আপনি কি অফিসের সব দায়িত্ব সাদিক ভাইকে দিয়ে গেছেন।”

সাদিক সাহেব কে ফিল্মসের চিফ কর্পোরেশনস অফিসার। অরার একদম নিচেই তার পোস্ট। অরার অবর্তমানে তিনিই কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারেন।

“হ্যাঁ, কেন?”

মাহমুদ ইতস্তত করে বলল, “বেয়াদবি মনে না করলে একটা কথা বলি ম্যাম?”

“বলো।”

মাহমুদ নিচু গলায় বলল, “সাদিক ভাই তো নিজেই ফাঁকিবাজি করছে। বারোটা বেজে গেল, এখনো অফিসে আসেনি। অফিসেও কোনো শৃঙ্খলা নেই ম্যাম। যার যখন ইচ্ছা আসছে, যখন ইচ্ছা চলে যাচ্ছে। কাজ তো একেবারেই হচ্ছে না। আমি তো দেখে এলাম এডিটিং টিম কাজকর্ম বাদ দিয়ে ছাদে আড্ডা দিচ্ছে।”

বিচিত্র এক স্রোত বয়ে গেল অরার গা বেয়ে। এই পৃথিবীতে তার সবথেকে অপছন্দের জিনিস এই ফাঁকিবাজি। কারও যদি কাজ করতে ভালো না লাগে, তাহলে সে কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে থাকুক। কাজের প্রতি অবহেলা করার তো কোনো মানে হয় না।

অরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “আমি তোমাকে একটু পরে ফোন করছি মাহমুদ।”

ল্যাপটপে অফিসের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করলো অরা। মাহমুদের বলা প্রতিটা কথাই সত্যি। ছাদে এডিটিং টিম এলোমেলভাবে বসে আড্ডা দিচ্ছে। সাদিক সাহেবের কেবিনটাও ফাঁকা পড়ে আছে।

অরা আর এক মুহুর্তও অপচয় না করে কতগুলো ফোন কল সারলো। সবগুলো কলই কিঞ্চিৎ হুমকিস্বরূপ। তার একটা কলেই আধ ঘণ্টার মাঝে স্বাভাবিক চিত্র ফিরলো অফিসে।

বলতেই হয়, মাহমুদ ছেলেটা কাজের। অফিসের সকলে আড়ালে তাকে ডাকে ‘বসের চামচ’। অরার প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠার চেষ্টায় তার কোনপ্রকার কমতি নেই। চামচামি জিনিসটা একেবারেই অপছন্দ অরার। তবে কেউ যদি চামচামি করতে গিয়ে উপকার করে, তবে ক্ষতি কোথায়?

অরা এবার নিজেই মাহমুদকে ফোন করে বলল, “থ্যাংক ইউ মাহমুদ। তুমি না বললে তো বুঝতেই পারতাম না ওখানে কি হচ্ছে।”

মাহমুদ কৃতজ্ঞতায় মোমবাতির মতো গলে গিয়ে বলল, “কী যে বলেন ম্যাম, এটা তো আমার দায়িত্ব।”

মায়ের জন্মদিনের প্ল্যানিং করতে সুপারস্টার সাহেব সারাটা সকাল এতই ব্যস্ত ছিলেন যে বউয়ের খোঁজ নিতে রীতিমত ভুলেই গেছেন। অরার অবশ্য এ নিয়ে কোনো রাগ নেই। সারাটা বছর তো অরাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে আরশাদ। এই কয়েকটা দিন জন্মদিন নিয়ে ব্যস্ত থাকাই তো স্বাভাবিক।

ঘরে এসে আরশাদ কেবল তার ল্যাপটপ খুলে বসেছে।

ওদিকে অরা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে অভিমানী স্বরে বলল, “তুমি না-কি সবাইকে কেক বানানোর দায়িত্ব দিয়ে এসেছো?”

আরশাদ ল্যাপটপের দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বলল, “হুঁ।”

অরা গাল ফুলিয়ে বলল, “বাড়ির সবাই কেক বানাবে, অথচ জাতীয় কেক বিশেষজ্ঞ বানাবে না?”

আরশাদ অরার দিকে তাকিয়ে বিভ্রান্ত স্বরে বলল, “কে বিশেষজ্ঞ? তুমি?”

“নয়তো কে?”

আরশাদ আবারও ল্যাপটপে মন দিয়ে বলল, “অরা! সেই ইচ্ছা বাদ দাও। কেক-টেক তুমি বানাতে পারবে না।”

“কিন্তু কেন?”

আরশাদ কড়া ভঙ্গিতে বলল, “প্রথম তিন মাস শেষ হয়েছে এখনো? ডক্টর কী বলেছে মনে নেই? প্রথম তিন মাসের আগে কোনো ধকলের কাজ করা যাবে না।”

অরাও পাল্টা রাগ দেখিয়ে বলল, “কেক বানানো মোটেও ধকলের কাজ না।”

“সেটা আমি জানতে চাইনি।”

“আরশাদ আমি প্রেগন্যান্ট, অসুস্থ নই। তোমাকে এই কথা হাজারবার বলেছি।”

আরশাদ অরার যুক্তির পেছনে যুক্তি দেখিয়ে বলল, “আমিও হাজারবার বলেছি যে এসব কথা আমাকে বলে লাভ নেই।”

অভিমানে মুষড়ে পড়ে অরা বলল, “বাড়ির সবাই বার্থডের আয়োজন করবে আর আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকবো? আমার কোনোই কাজ নেই? তাহলে এনেছো কেন আমাকে এখানে?”

হঠাৎ সুপ্ত এক দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল আরশাদের মস্তিষ্কে। ল্যাপটপটাকে সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট পা ফেলে অরার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। মুহুর্তও সমস্ত অভিমান গলে জল হয়ে গেল অরার। আরশাদের চোখের দিকে একবার চোখ পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সে। ওই চাহনি খুব ভালো করে চেনা আছে তার। তার ভেতরটাকে উন্মাদনায় ভাসিয়ে দেওয়ার মতো চাহনি।

আরশাদ মোহগ্রস্ত কণ্ঠে বলল, “কে বলেছে তোমার কোনো কাজ নেই? কাজ আছে তো।”

অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “কী কাজ?”

“আমার সাথে রোম্যান্স করা।”

আর এক মুহুর্তও অপচয় না করে আরশাদ অরার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে তাকে এনে ফেলল নিজের বুকে।

অরা আঁতকে উঠে বলল, “এই কী করছো! দরজার লক খোলা।”

আরশাদ তার কথায় একেবারেই কর্ণপাত না করে বলল, “থাকুক।”

মোহগ্রস্তের ন্যায় অরার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো আরশাদ। যেন এই মুহুর্তটাই পৃথিবীতে তার শেষ মুহূর্ত। যত পারছে তাই, প্রাণ ভরে ভালোবাসার সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছে প্রিয় মানুষটাকে। অরাও ভেসে যাচ্ছে নির্দ্বিধায়। আরশাদের ভালোবাসাময় একেকটা স্পর্শ যেন একটু একটু করে পাগল করে তুলছে তাকে। উত্তেজনায় নিজেকে সামলাতে খামচে ধরলো আরশাদের শার্ট।

হঠাৎ দরজায় টোকা পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে আরশাদের থেকে ছিটকে দূরে সরে গেল অরা। হৃদস্পন্দন যেন এক লাফে বেড়ে গেল একশ পঞ্চাশে।

দিশা বাইরে থেকে উচ্চস্বরে বলল, “ভাইয়া?”

মোহনীয় মুহূর্ত বাধাগ্রস্ত হওয়ায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে আরশাদ বলল, “কী?”

“খালা ডাকছে।”

“আসছি।”

দিশা চলে গেছে, ঘরের ভেতর থেকে স্পষ্ট পাওয়া গেল তার পায়ের শব্দ। আরশাদ দেরি না করে আবারও কাছে টেনে নিলো অরাকে।

অরা ভীত গলায় বলল, “কী করছো? আবারও যদি কেউ চলে আসে?”

অরার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না আরশাদ। তার ঠোঁটজোড়া যে অরার শরীরজুড়ে অবাধ বিচরণ করবে বলে ছটফট করছে।

(চলবে)