ফিরে আসা ২ পর্ব-৭+৮

0
125

#ফিরে_আসা২

লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

অরা প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার। তবে তার সামনে বসে থাকা মানুষটার কারণেই সেই চেষ্টা বিফলে যাচ্ছে বারবার। সকাল সকাল অফিসে এসে কেবল কম্পিউটার অন করে কাজ নিয়ে বসেছে অরা। তখনই রিসিপশন থেকে ফোন এলো, কেউ না-কি দেখা করতে চাইছে তার সঙ্গে।

যে কেউ চাইলেই এমন হুটহাট করে কে ফিল্মসের সিইওর সঙ্গে দেখা করতে পারে না। অরার টিমের কাছ থেকে আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়। কী কারণে দেখা করবে তার একটা ব্যাখ্যা দিতে হয়। বাছাই পর্ব শেষে তার টিম যদি মনে করে, এই মানুষটার সঙ্গে অরার দেখা হওয়ার প্রয়োজন আছে তবেই তাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হয়।

তবে আজ আমস্মিকভাবে আগত এই আগন্তুকের কাছে কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই। তবে রিসিপশনে তার জানানো তথ্য অনুযায়ী, অরার সঙ্গে তার আজই দেখা হওয়াটা অনিবার্য। অরার সঙ্গে দেখা না হলে, বড়সর বিপদে পড়ে যাবেন তিনি।

রিসিপশন থেকে যখন মানুষটার নাম বলা হলো, তখনও ঠিক চিনে উঠতে পারেনি তাকে অরা। চিনেছে পরিচয় দেওয়ার পরে। অরার সামনে বসে থাকা মানুষটির নাম ইয়াসমিন বেগম। নওশীনের মা।

অরা চাইলেই পারতো এই মানুষটাকে দেখা না দিয়ে ফিরিয়ে দিতে। তবে তার মনে কোমলতার মাত্রা যেন একটু বেশিই। একটা বয়স্ক মানুষ তার সঙ্গে দেখা করতে এসে ফিরে যাচ্ছে, তা কী করে হয়? এতটা রূঢ় হওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে।

ইয়াসমিনের বেগমের বয়স ষাটের একটু বেশি। চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে। বয়সের ছাপ ছাড়াও চোখেমুখে দৃশ্যমান হয়ে ফুটে উঠেছে একরাশ দুশ্চিন্তার ছাপ। তার চোখের নিচের কালি স্পষ্ট জানান দিচ্ছে, দীর্ঘ রাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন ভদ্রমহিলা। নওশীনের সাজা কমানোর আশায় দীর্ঘদিন দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে তাকে। ঘুমের আর অবকাশ কোথায়?

ইয়াসমিন বেগম মুখে হাসি হাসি ভাব ধরে রাখার চেষ্টা করে বললেন, “তোমার কথা অনেক শুনেছি মা। এই প্রথম সামনাসামনি দেখার সুযোগ হলো।”

হাসি ব্যাপারটা বড়ই খুব অদ্ভুত। যে কেউ চাইলেই জোর করে ঠোঁটে ফুটিয়ে তুলতে পারি এই জিনিসটি। তবে মানুষ খুব সহজেই জোরপূর্বক হাসি আর প্রকৃত হাসির পার্থক্য করতে পারে। ইয়াসমিন বেগমের এই হাসিটি জোরপূর্বক এতে কোনপ্রকার সন্দেহ নেই। হাসির পেছনে নিশ্চয়ই সূক্ষ্ম এক দুশ্চিন্তা কাজ করছে তার মাঝে।

দুশ্চিন্তা যে অরার মধ্যে কাজ করছে না এমনটা নয়। মনে মনে সে কেবলই ইয়াসমিন বেগমের আগমনের উদ্দেশ্য অনুসন্ধানে ব্যস্ত।

অরা গলার স্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, “আন্টি আপনি কফি খাবেন তো?”

“আমাকে নিয়ে একদমই ব্যস্ত হতে হবে না মা।”

“না, না! ব্যস্ততা কীসের?”

কল করে একজন স্টাফকে কফি দিয়ে যেতে বলল অরা। তবে তার মধ্যকার অস্থিরতা এখনো কাটেনি। ইয়াসমিন বেগম নিশ্চয়ই শুধু শুধু দেখা করতে আসেনি। তার আগমনের পেছনে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। তবে সেই উদ্দেশ্য যে একেবারেই সুখকর হতে যাচ্ছে না, এ বিষয়ে অরা শতভাগ নিশ্চিত।

ইয়াসমিন বেগম ইতস্তত করে বললেন, “আরশাদ কেমন আছে?”

অরা সহজভাবে বলল, “ভালো আছে।”

“তোমার আর আরশাদের ছবি দেখি অনলাইনে। মাঝে মাঝে আবারও যখন দুজনে একসঙ্গে অ্যাওয়ার্ড শোতে যাও, তখনও দেখি। কী যে সুন্দর লাগে দুজনকে পাশাপশি!”

অরা চুপ করে রইলো। কী বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক করতেই ডোরবেল বেজে উঠলো। ওই স্টাফ এসেছে দু কাপ কফি নিয়ে। কফি অরার ডেস্কে নামিয়ে রেখে সে চলে গেল।

ইয়াসমিন বেগম কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “প্রথম যখন শুনেছিলাম, আরশাদ আবার বিয়ে করেছে, খুব খুশি হয়েছি। প্রত্যেকটা মানুষেরই তো ভালো থাকার অধিকার আছে। আরশাদের মতো ছেলে হয় না! এত বড় সুপারস্টার, অথচ তার আচরণ কী অমায়িক। নিজের মধ্যে কোনো অহংকার তো নেই আছে শুধুই ভদ্রতা। ও ভালো না থাকলে কে ভালো থাকবে?”

ইয়াসমিন বেগম প্রাণপণ চেষ্টা করছেন পরিস্থিতি সহজ রাখার। তবে এ পরিস্থিতি মোটেও সহজ নয়। ভদ্রমহিলা একটা সময়ে ছিলেন আরশাদের শাশুড়ি। তার মেয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল আরশাদের জীবন। কোনো মা নিশ্চয়ই চায় না, তার মেয়ে সংসারটা ভেঙে যাক। ইয়াসমিন বেগমের মেয়ের সংসার ভেঙেছে। তার নিজের কারণেই ভেঙেছে।

অরা আরশাদের জীবনের প্রথম ভালোবাসা নয়। এ সত্য সে মেনে নিয়েছে। প্রথম ভালোবাসা হওয়াটা কোনো কৃতিত্বের ব্যাপার নয়। বরং নিখাদ ভালোবাসা হওয়াটাই গর্বের। অরা সবসময় ভুলে থাকতে চায়, আরশাদের জীবনে নওশীন নামে কেউ ছিল। তাকে যখন এটা কেউ মনে করিয়ে দেয়, তার অস্বস্তি তখন বহুগুণ বেড়ে যায়।

ইয়াসমিন বেগম স্মৃতিচারণ করে বললেন, “আমাকে খুবই সম্মান করতো আরশাদ। দেখা হলেই পা ছুঁয়ে সালাম করতো। এই ছেলেটা যে একসময়ে আমার পরিবারের অংশ ছিল ভাবতেই গর্ব হয়। আমার মেয়েকে নিয়ে আফসোসের শেষ নেই আমার। আরশাদের মতো সোনার টুকরা ছেলেকে পেয়েও তার সঙ্গে থাকতে পারলো না। নিজের দোষেই পারেনি অবশ্য। নওশীন আরশাদের সঙ্গে যা করেছে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমি নিজেও আজ পর্যন্ত তাকে ওই ঘটনার জন্যে ক্ষমা করতে পারিনি।”

অরা চুপ করে রইলো। এমন পরিস্থিতিতে চুপ করে থাকাটাই শ্রেয়। আরশাদের সঙ্গে যা করেছে নওশীন তা সত্যিই ক্ষমার অযোগ্য। তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছিল আরশাদের ভেতরটাকে। মনের অসুখ সাংঘাতিক। এর থেকে মুক্তির উপায় সহজসাধ্য নয়। তবুও আরশাদ সেরে উঠেছে, নতুন করে বাঁচতে শিখেছে। তবে এমনটা না হলেও তো পারতো।
এতটা কষ্ট কি সত্যিই আরশাদের প্রাপ্য ছিল?

আরশাদের প্রতি নওশীনের করা অন্যায়ের জন্যে অরা মনে মনে তার প্রতি ক্ষীণ ঘৃণা জমিয়ে রেখেছে। তবে একজন মায়ের সামনে নিশ্চয়ই তার সন্তানদের প্রতি রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করা যায় না। অরা যথাসম্ভব ভদ্রভাবে বসে রইলো।

ইয়াসমিন বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “নওশীন সবসময় বলে, ওই সময়ে আমি ভুল করেছি। মানুষ হয়ে জন্মে কেউ ভুল না করে পারে? মানলাম, সেবার না হয় ভুল ছিল। কিন্তু তোমার সাথে নওশীন যা করলো!”

অরা ক্ষীণ গলায় বলল, “থাক না আন্টি, এসব কথা এখন বলে আর কী লাভ?”

ইয়াসমিন বেগম আক্ষেপজড়িত কণ্ঠে বললেন, “কেন বলবো না? আরশাদ সব ভুলে যখন নতুন করে জীবনটাকে গোছাতে শুরু করলো, তখনই তোমার বিশাল ক্ষতি করার চেষ্টা করলো আমার মেয়ে। কোথায় রাখি এই লজ্জা? লজ্জায় তোমার সামনে এসে দাঁড়ানোর সাহসও পাচ্ছিলাম না।”

“এভাবে বলবেন না আন্টি। ওই ঘটনা তো আমি প্রায় ভুলেই গেছি।”

ইয়াসমিন বেগম হতাশ গলায় বললেন, “আমার মেয়ের এই হাজারো অন্যায়ের জন্যে তার প্রতি এক ধরনের ঘৃণা জন্মে গেছে। তার দিকে তাকিয়ে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধে। কিন্তু কী আর করার? মা তো, মেয়ের বিপদে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। কানাডা থেকে তাই ছুটে এলাম। প্রায় এক বছর কেবল উকিলের বাড়ি আর কোর্টে ঘোরাঘুরি করেই কেটে গেল। মেয়েটার সাজা কমে এলো, জামিনও পেলো। তুমি হয়তো আমাকে সেজন্যে খারাপ ভাবতে পারো…”

ইয়াসমিন বেগমকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অরা বলল, “না আন্টি! আপনার মেয়ের জন্যে আপনি তো লড়াই করবেনই। খারাপ ভাবার কী আছে?”

“মায়েরা তো এমনই। পৃথিবী উল্টে গেলেও সন্তানের প্রতি তাদের টানের কোনো কমতি নেই।”

চুপ করে রইলো অরা।

“শুনছি তুমিও মা হতে যাচ্ছো। নিজের সন্তানকে অনুভব করতে পারো?”

অরা ইতস্তত করে বলল, “হ্যাঁ, পারি তো।”

“তোমার কাছ থেকে যদি তোমার সন্তানকে কেউ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, সহ্য করতে পারবে?”

অরা আবারও চুপ করে রইলো। যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে সে। বেশ বুঝতে পারছে কোনদিকে ইঙ্গিত করে কথাটা বললেন ইয়াসমিন বেগম। মনে মনে নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো অরা। ইয়াসমিন বেগম নির্ঘাত এমন কোনো কথা বলতে যাচ্ছেন, যা মোটেও সুখকর হবে না তার জন্যে।

ইয়াসমিন বেগম কোমল স্বরে বললেন, “আমি তোমার কাছে এসেছি মা একটা অনুরোধ নিয়ে। নওশীন তার মেয়েকে একনজর দেখবে বলে পাগল হয়ে আছে। প্রায় দুবছর হয়ে গেল মেয়েটাকে দেখে না ও। কথা হয়তো নিজের মাকে ভুলেই গেছে। কিন্তু মা তো আর নিজের সন্তানকে ভুলতে পারে না।”

শুকনো ঢোক গিললো অরা। মনে মনে যে ভয়টা সে পাচ্ছিল, সেটাই সত্য হয়ে সামনে এলো তবে। এবার কী হবে?

“দেখো মা, আমি জানি কথাকে তুমি নিজের সন্তানের মতোই মানুষ করছো। তোমার কাছে নিশ্চয়ই ওর কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। এমন না যে, নওশীন মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে রাখতে চাইছে। ওকে তো আবার সেই জেলেই ফিরে যেতে হবে। শুধু মেয়েকে একবারের জন্যে দেখতে চাইছে। তুমি প্লিজ কথাকে নওশীনের সঙ্গে দেখা করতে দাও!”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে লম্বা লম্বা শ্বাস নিলো অরা। তার চোখেমুখে যেন অন্ধকার নেমে এসেছে। মনে মনে সে কথা গোছাচ্ছে কেবল।

কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে অরা বলল, “আন্টি, কথা আমার মেয়ের মতোই। আমার নিজের সন্তান পৃথিবীতে এলে তাকে যতটা ভালোবাসবো, তার থেকে ওকে কোনো অংশে কম ভালোবাসি না। তবুও কাগজে-কলমে তো আর আমি ওর কেউ নই। তাই চাইলেই ওকে নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। আপনি এই বিষয়টা নিয়ে যদি ওর বাবার সঙ্গে কথা বলতেন…”

ইয়াসমিন বেগম গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, “আরশাদ রাজি হবে না। কোনোদিনই চাইবে না নওশীনের ছায়াও যেন কথার ওপরে পড়ুক। তাই তো তোমার কাছে এসেছি। আমি জানি মা, তুমিই পারবে।”

ইয়াসমিন বেগম চলে যাওয়ার পরও কাজে মন বসলো না অরার। মাথায় ভর করছে কেবল ওই একটা চিন্তাই। ভদ্রমহিলার দৃঢ় বিশ্বাস কেউ যদি নওশীনের সঙ্গে কথাকে দেখা করাতে পারে, তবে সেটা অরাই পারবে। তবে অরা ভাবছে ভিন্ন কিছু। সে কি আদৌ পারতে চায়? সে কি চায়, কথার সঙ্গে তার মায়ের দেখা হোক?

নিজেকে নিজেরই বুঝতে কষ্ট হচ্ছে অরার। যথেষ্ট বাস্তববাদী মেয়ে সে। ঠিকই জানতো, নওশীন আজীবন জেলে বন্দি থাকবে না। একটা না একটা সময়ে ফিরে আসবে সে। মায়ের কাছ থেকে মেয়েকে দীর্ঘ সময় আলাদাও রাখতে পারবে না আরশাদ। ঠিকই কোনো না কোনোদিন কথার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে নওশীনের। এই সত্যগুলো বহু আগেই মেনে নিয়েছিল অরা। তবে আজ কেন আচমকা বিচিত্র এই ভয় ঝেঁকে ধরেছে তাকে?

আচ্ছা, এটাও কি নওশীনের কোনো ‘প্ল্যানের’ অংশ? না-কি সত্যিই মায়ের অশান্ত হৃদয় মেয়েকে দেখার জন্যে ছটফট করছে? কিছুই বুঝতে পারছে না অরা। চিন্তাভাবনা করার পর্যায়ে আর নেই তার মস্তিষ্ক।

দুপুরের পরপরই অফিস থেকে বেরিয়ে গেল অরা। এমন গভীর দুশ্চিন্তা নিয়ে কাজে মন দেওয়া সম্ভব নয়। ব্যাপারটা নিয়ে আরশাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। দিন কয়েক যাবত বেশ বিরক্ত বেচারা। অনলাইন নিউজ পোর্টাগুলোতে নিউজের মেলা বসেছে।

“আরশাদ হকের প্রাক্তন স্ত্রীর জামিনে মুক্তি!” শিরোনামে একেকটা নিউজ বের হচ্ছে। নওশীনকে ঘিরে যতগুলো আর্টিকেল লেখা হচ্ছে, সবগুলোতেই তার এই একটাই পরিচয়। ‘আরশাদ হকের প্রাক্তন স্ত্রী’। আরশাদ তো মনে করে তার নামের সঙ্গে একই নিঃশ্বাসে কারো নওশীনের নাম উচ্চারণ করাটাও অন্যায়। সেখানে এতগুলো নিউজ চোখের সামনে পড়ায় আরশাদ পৌঁছে গেছে বিরক্তির চরম শিখরে। তবুও চেষ্টা করছে যতটা সম্ভব ব্যাপারটাকে এড়িয়ে চলার, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার। কখনো পারছে, কখনো পারছে না।

অসময়ে অরাকে বাড়িতে পেয়ে কথার মাঝে উচ্ছ্বাসের সীমা রইল না। দুজনে একসঙ্গে লাঞ্চ করলো। অরা মন দিয়ে কথার স্কুলের গল্প শুনলো। লাঞ্চ শেষে একটু বিশ্রাম নিতে এলেই কথা বায়না ধরে বসলো, “অরা গল্প শুনবো!”

অরাও বিনা বাক্য ব্যয়ে গল্প বলতে শুরু করলো। প্রত্যেকবারই তাকে ডিজনি প্রিন্সেসের গল্প বলতে হবে। যদিও এই গল্পগুলো সবই কথার মুখস্ত। তবুও অরার মুখ থেকে নতুন করে শোনার মাঝে যেন বিচিত্র এক আনন্দ।

গল্প শুনতে শুনতে কথা অরার গলা জড়িয়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল। আবারও গভীর চিন্তায় ডুব দিলো অরা। বাবা-মাকে একসঙ্গে দেখার কোনো স্মৃতি নেই কথার মস্তিষ্কে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মেয়েটা মায়ের কাছে থেকেই অভ্যস্ত। মায়ের সঙ্গে থাকবে, মাঝে মাঝে বাবার কাছে বেড়াতে আসবে। এটাই ছিল কথার কাছে স্বাভাবিক জীবন।

তার স্বাভাবিক জীবনটা একটু হলেও এলোমেলো হয়ে যায় নওশীনের গ্রেফতারের পর। মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসে আরশাদ। মায়ের অভাব এক মুহূর্তের জন্যেও তাকে টের পেতে দেয়নি আরশাদ এবং অরা। তবুও আগে কথা মায়ের খোঁজ করতো। তাকে নিশ্চয়ই বলা যায় না, নওশীন প্রকৃতপক্ষে কোথায় রয়েছে। আরশাদ প্রতিবারই উত্তরে বলতো, “মা বেড়াতে গেছে।”

এখন আর মেয়েটা মায়ের খোঁজ করে না। তার বেড়ানো শেষ হয়েছে কিনা, তাও জিজ্ঞেস করে না। আচ্ছা, কথার মস্তিষ্কে আদৌ মায়ের কোনো স্মৃতি অবশিষ্ট রয়েছে তো?

রাত দশটার দিকে বাড়ি ফিরলো আরশাদ। আজও তার পুরোটা দিন কেটেছে ‘দূরে হারিয়ে’র প্রমোশনে। যতগুলো টিভি চ্যানেল বা পত্রপত্রিকায় সে ইন্টারভিউ দিতে গেছে, সবগুলো জায়গাতেই আরশাদের ম্যানেজার কড়াভাবে জানিয়ে দিয়েছে নওশীন সংক্রান্ত কোনপ্রকার প্রশ্ন তাকে করা যাবে না।

সেই কথা সকলে মেনেছেও বটে। নওশীনকে নিয়ে কোনপ্রকার সরাসরি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি তাকে। তবুও একজন সঞ্চালক সাহস করে করে ফেলে ইঙ্গিতপূর্ণ একটি প্রশ্ন। প্রশ্নটা এমন, “আজকাল সেলিব্রিটিদের মাঝে অপরাধ প্রবণতা অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে আপনার কী বলার আছে?”

ভাবটা এমন যেন সেলিব্রিটি ছাড়া দেশে কেউ অপরাধ করছে না। মূলত তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইনিয়ে বিনিয়ে আরশাদের মুখ থেকে নওশীনের ব্যাপারে মতামত আদায় করা। যদিও সেই প্রশ্নের জবাব আরশাদ দেয়নি।

গভীর মনোযোগে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছে আরশাদ। তার ম্যানেজার অয়ন খানিকক্ষণ আগে এ সপ্তাহের শিডিউল মেইল করে পাঠিয়েছে। এ সপ্তাহে ইন্টারভিউয়ের জন্য আরশাদ কোথায় কোথায় যাবে, কোন কোন ডিরেক্টরের সঙ্গে মিটিং রয়েছে, কোনদিন শুটিং আছে – সবই গুছিয়ে লেখা রয়েছে এই শিডিউলে।

হঠাৎ তার সামনে এসে বসলো অরা। আরশাদ একবার তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে আবারও মনোযোগ ফেরালো ল্যাপটপ স্ক্রিনে।

অরা হালকা গলায় বলল, “আজ আমার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছিল।”

আরশাদ ল্যাপটপের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই ক্ষীণ স্বরে বলল, “ও আচ্ছা।”

অরা থমথমে গলায় বলল, “আমি কিন্তু একটা জরুরি কথা বলছি আরশাদ।”

আরশাদ এবার অরার দিকে তাকিয়ে বলল, “কে দেখা করতে এসেছিল?”

অরা ইতস্তত করে বলল, “ইয়াসমিন বেগম।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো আরশাদ। তার চোখে মুখে রাগ ও হতাশা দৃশ্যমান হয়ে ফুটে উঠেছে।

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “তোমার সঙ্গে কি যে কেউ চাইলেই দেখা করতে পারে? আমি তো জানতাম অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার পর তোমার দেখা পাওয়া যায়। অফিসে কাজ বাদ দিয়ে এভাবেই সবাইকে দেখা দাও?”

“তো কী করতাম আমি? দেখা না করে ফিরিয়ে দিতাম?”

“হ্যাঁ দিতে। অপ্রয়োজনীয় মানুষের সঙ্গে দেখা করে সময় নষ্ট করার তো কোনো মানে হয় না।”

“আরশাদ তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি এমন কাজ করতে পারি না। তাছাড়া এই ভদ্রমহিলার তো কোনো দোষ নেই।”

ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আরশাদ বলল, “কী বলেছে? কথাকে নিজেদের কাছে নিয়ে রাখবে, তাই তো?”

অরা জানতো আরশাদকে বিস্তারিতভাবে কিছু ব্যাখ্যা করতে হবে না। ইয়াসমিন বেগমের নামটা শুনেই সে বুঝতে পারবে তার আগমনের উদ্দেশ্য কী। হলোও ঠিক তাই।

অরা বলল, “না। একবার দেখা করবে শুধু।”

আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “অরা, একটা কথা মনে রেখো। আমি চাই না ওই নোংরা মানুষটার ছায়াও আমার মেয়ের ওপরে পড়ুক।”

“কথাকে একবার জিজ্ঞেস করলে হতো না?”

“কথা এসবের কী বোঝে? অনেক কষ্টে ওই মানুষটাকে ভুলেছে ও। নতুন করে মনে করিয়ে ওর ট্রমা বাড়ানোর কোনো দরকার নেই। ওকে নিয়ে আমার ডিসিশনই ফাইনাল ডিসিশন।”

আরশাদের উদ্বেগটা স্বাভাবিক। এমন তো হতেই পারে, দেখা করার ছল করে মেয়েকে নিয়ে চিরতরে পালিয়ে যেতে চাইছে নওশীন। নিজের স্বার্থ উদ্ধারে কতটা ভয়ানক নওশীন তা খুব ভালো করেই জানে আরশাদ। যাই হয়ে যাক না কেন, এবার আর কোনো ভুল করবে না সে। এতে যদি কেউ তাকে অমানবিক পাষাণ মনে করে, করুক!

(চলবে)

#ফিরে_আসা২

লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

পরপর কতগুলো বিজ্ঞাপনের শুটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকায় নওশীনের ব্যাপারটা একেবারে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল আরশাদ। কাজের ব্যস্ততা তাকে অযাচিত সব চিন্তাভাবনা থেকে দূরে রাখে। তবে গভীর চিন্তা থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি অরা। ভেতরে ভেতরে এক ক্ষীণ অপরাধবোধ তাকে শেষ করে দিচ্ছে।
একজন জন্মদাত্রী মা শুধুমাত্র তার কারণে নিজের মেয়েকে দেখতে পারছে না।

যদিও অরা নিজেকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করছে। এতে তার অপরাধবোধে ভোগার কিছু নেই। কাগজে-কলমে কথার একমাত্র অভিভাবক তার বাবা। আরশাদের একমাত্র সিদ্ধান্ত, কথা দেখা করবে না নওশীনের সঙ্গে।

নিজের দাঁড়ানো যুক্তি মেনে নিতে নিজেরই কষ্ট হচ্ছে অরার। কাগজে-কলমে কথার একমাত্র অভিভাবক আরশাদ হলে কী হবে? মেয়েটার জীবনের বেশির ভাগ সিদ্ধান্তই নেয় অরা। কথা স্কুলের অ্যানুয়াল প্রোগ্রামে গান করবে না-কি বিতর্ক, ছবি আঁকার অনুষ্ঠানে কোন টপিকের ওপরে ছবি আঁকবে, বাইরে ঘুরতে গেলে কোন জামাটা পরবে – কথার জীবনের ছোট ছোট এই সমস্ত বিষয়গুলো ঠিক করে দেয় অরা। আর সেখানে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় হাত গুটিয়ে বসে থাকবে সে?

আজ অফিসে যায়নি অরা। তেমন কোনো কাজ নেই, তাছাড়া শরীরটাও ভালো নেই। ক্লান্তিতে জড়িয়ে আছে পুরো শরীর। এই অজুহাতে কথাও ঘোষণা দিয়েছে, আজ সে স্কুলে যাবে না। দুজনে মিলে পুরোটা সকাল বাগানেই কাটিয়ে দিলো।

ঘরে ফিরতেই বেজে উঠলো অরার ফোনের রিংটোন। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা পড়তেই অরার চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে উঠলো। ইয়াসমিন বেগম। ভদ্রমহিলা গতকাল অরার ফোন নম্বর নিয়ে গিয়েছিলেন।

অরা ফোনটা রিসিভ করতেই ইয়াসমিন বেগম অপরপ্রান্ত থেকে আন্তরিক কণ্ঠে বললেন, “মা ভালো আছো?”

অরা যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলল, “জি আন্টি। আপনি ভালো আছেন?”

ইয়াসমিন বেগম হতাশার সুরে বললেন, “ভালো আর থাকি কী করে মা? তুমি তো সবটাই জানো। এতদিন পর জেল থেকে বেরিয়েই শান্তিতে নেই নওশীন। ঠিক মতো খাচ্ছে না, ঘুমাচ্ছে না। সারাদিন তার মুখে শুধু একটাই প্রশ্ন, কথা কোথায়?”

অরা কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। একবার ভাবলো মুখের ওপর বলে দেয়, আরশাদ তার মেয়েকে নওশীনের সঙ্গে দেখা করতে দেবে না। তবুও শেষ মুহূর্তে ভেতর থেকে কী যেন একটা এসে আটকে দিলো তাকে।

ইয়াসমিন বেগম আবারও বললেন, “তুমি একটু দেখো না মা। আমরা বেশিক্ষণ সময় নেবো না। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার।”

অনেকটা সময় চুপ করে থেকে অরা শুকনো গলায় বলল, “আমি দেখছি আন্টি।”

মুখে দেখছি বললেও, আসলে দেখার কিছুই নেই। আরশাদের কথার অবাধ্য হয়ে কথাকে নওশীনের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। মনটাকে শক্ত করতে হবে। মানুষের কষ্টে মনটাকে মোমবাতির মতো গলিয়ে ফেলার কোনো অর্থ নেই। আর যেই মানুষটা তাকে এবং আরশাদকে কষ্ট দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি, তার কষ্টে ব্যস্ত হয়ে পড়ার অর্থ নিতান্তই বোকামি।

আরশাদ ঠিকই তো বলে। নওশীন অসম্ভব ভয়ঙ্কর। কথাকে নিয়ে মনে মনে কোনো কুবুদ্ধি আটা তার পক্ষে অসম্ভব নয়। অরা ঠিক করলো ব্যাপারটাকে পুরোপুরি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলবে। ইয়াসমিন বেগমের ফোন আর রিসিভ করা যাবে না। তিনি দেখা করতে এলেও নানান অজুহাতে এড়িয়ে যেতে হবে।

কয়েকটা দিন এভাবেই কেটে গেল। ইয়াসমিন বেগম প্রথম কয়েকদিন অনেকবার করে ফোন দিলেও অরা সেই ফোনগুলো এড়িয়ে গেছে বারবার। এখন অবশ্য ফোন-টোন আর করেন না তিনি। ভালোই হয়েছে। উটকো এক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাওয়া গেল।

সকাল সকাল কথার স্কুলের রুটিন মিলিয়ে বই গোছাচ্ছে অরা। কথার ঘরে তার ছোটখাটো একটা বুকশেলফ আছে। তার স্কুলের বইখাতাগুলো এখানেই সাজিয়ে রাখা। এছাড়াও একটা তাক জুড়ে রয়েছে তার ড্রয়িং খাতাগুলো।

বাচ্চারা তাদের মনের কথাগুলো ছবির মাধ্যমে প্রকাশ করে। কথাও তার ব্যতিক্রম নয়। দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছে হলো তার ছবিতে ফুটে ওঠে সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কথা, বাবা আর অরার ছবি। তার মনে জমে থাকা স্বপ্নগুলোও প্রকাশ পায় ছবির মাধ্যমে। এই যেমন তার সারাজীবনের স্বপ্ন আকাশে উড়ে বেড়ানোর। আকাশে উড়ে বেড়াবে ঠিকই, তবে তার কোনো ডানা থাকবে না। প্রায়ই তাই তার পেন্সিলে দেখা মেলে আকাশে উড়ন্ত ডানাহীন কথার।

কথা তার অঙ্কিত প্রত্যেকটা ছবি দেখায় আরশাদ এবং অরাকে। তাদের মতামত জানতে চায়। যে ছবিগুলো আরশাদ এবং অরার সবথেকে ভালো লাগে, সেই ছবিগুলো তার ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে দিতে বলে। সে কারণেই হয়তো কথার সবগুলো ড্রয়িং খাতার সঙ্গে পরিচিতি আছে অরার। শেলফে সবগুলো খাতার ওপরে অপরিচিত মলাটের একটা খাতা দেখে তাই অবাক না হয়ে পারলো না অরা। খাতাটা হাতে নিয়ে দেখলো, শুধু মলাটই নয়। ভেতরের ছবিগুলোও তার অপরিচিত।

অরা অবাক গলায় বলল, “এই ছবিগুলো আগে দেখাসনি তো!”

কথা চট করে খাতাটা অরার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলল, “এগুলো পচা ছবি। তাই দেখাইনি।”

এমনিতেই স্কুলের জন্যে দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাই আর খাতার ব্যাপারটা নিয়ে আপাতত মাথা ঘামালো না অরা। কথাকে তৈরি করে দিয়ে, নিজেও চলে গেল তৈরি হতে।

অফিসে আজ কাজের চাপ অসম্ভব। সকাল সকাল অরাকে মিটিংয়ে বসতে হয় পরিচালক এহসান আহমেদ এবং তার সিনেমার প্রোডাকশন ম্যানেজারের সঙ্গে। গাজীপুরে এহসানের সিনেমার শুটিং চলছিল। কে ফিল্মসের প্রযোজনায় এটি তার দ্বিতীয় সিনেমা। যদিও সিনেমার নাম এখনো ঠিক হয়নি।

শুটিংয়ের জন্যে গাজীপুরে গোটা একটা গ্রামের সেট তৈরি করা হয়। সে কারণে খরচও হয়েছে প্রচুর। তবে সমস্যা বাঁধে দুইদিন আগে। প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে নষ্ট হয়ে যায় সেটটি। যেকোনো ব্যবসাতেই ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। সিনেমার ব্যবসাও তার ব্যতিক্রম নয়। এই ক্ষতিটার কারণে এখন সিনেমার সেটের পেছনে নতুন করে খরচ করতে হবে। সিনেমার বাজেট বেড়ে যাবে। লাভের আকাঙ্ক্ষাও বেড়ে যাবে।

মিটিং সেরে অরা এসে বসলো নিজের কেবিনে। সঙ্গে সঙ্গে দরজায় টোকা পড়লো। অদ্ভুত ব্যাপার! এই অফিসে কেউ তার দরজায় টোকা দেয় না। সবাই ডোরবেল বাজিয়ে প্রবেশের অনুমতি চায়।

অরা দরজার বাইরে সিসিটিভির দিকে তাকিয়ে দেখলো, অপরপ্রান্তে মাহমুদ দাঁড়িয়ে। এই ছেলেটা অফিসের সঙ্গে এখনো মানিয়ে নিতে পারেনি নিজেকে।

অরা উঁচু গলায় বলল, “Come in!”

মাহমুদ ছেলেটা হাসি হাসি মুখে প্রবেশ করলো। তার হাতে নীল রঙের একটা ফাইল।
হাসি হাসি মুখেই ডেক্সের কাছে এসে অরার বিপরীতে থাকা চেয়ারদুটোর একটায় বসে পড়লো।

অফিসে প্রচলিত আদব-কায়দাগুলোও এখনো আয়ত্ব করতে পারেনি ছেলেটা। কারও কেবিনে চেয়ারে বসার আগে তার অনুমতি চাইতে হয়। আর সেটা যদি হয় অফিসের সিইও তাহলে তো কথাই নেই। নিজের আদব-কায়দার ঘাটতির জন্যে মাহমুদ ইতোমধ্যে নিজের ঊর্ধ্বতন যুথীর কাছে ধমক খেয়েছে। অরা নেহায়েত কড়া প্রকৃতির মানুষ হলে তার কাছেও ধমক খেত নির্ঘাত।

মাহমুদ ফাইলটা অরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ছাই সিনেমার স্ক্রিনপ্লের ওপর একটা রিপোর্ট চেয়েছিলেন না ম্যাম? এটাই সেটা।”

অরা ফাইলটা হাতে নিয়ে ভদ্রভাবে বলল, “Thank you. আমি পরে চেক করে নেবো।”

মাহমুদ অবাক গলায় বলল, “আপনি এখনো আমাকে আপনি ডাকছেন ম্যাম? প্রথম দিন তো বলেছিলেন হুট করে কাউকে তুমি ডাকতে পারেন না। কিন্তু এখন তো দশ দিন হয়ে গেল আমি এখানে কাজ করছি। তাছাড়া আমি কিন্তু আপনার চেয়ে ছয়মাসের ছোট। আপনার জন্ম সাতানব্বইয়ের মার্চে আর আমার সেপ্টেম্বরে।”

অরা কৌতূহল নিয়ে বলল, “আমার জন্মসাল, জন্মমাস জানলেন কী করে?”

“গুগল থেকে! কত বড় মাপের মানুষ আপনি! আপনাকে নিয়ে প্রত্যেকটা ইনফরমেশন গুগলে পাওয়া যায়।”

অরা সামান্য হেসে বলল, “বাহ্! বেশ ভালো। তবে আমাকে নিয়ে রিসার্চ করাটা কিন্তু আপনার কাজের অংশ নয়।”

মাহমুদ আহত গলায় বলল, “এখনো আপনি ডাকছেন ম্যাম।”

অরা ছেলেটার ছেলেমানুষীর সঙ্গে পেরে না উঠে বলল, “আচ্ছা, এর পরের দিন থেকে তুমিই ডাকবো।”

মাহমুদ লজ্জিত ভঙ্গিতে হেসে বলল, “Thank you mam. আচ্ছা ম্যাম, আপনাকে একটা রিকুয়েস্ট করবো?”

“রিকুয়েস্ট?”

“জি ম্যাম। আগামী সপ্তাহে এই নতুন সিনেমার লোকেশন দেখতে যাওয়া হবে। ডিরেক্টর, ডিরেক্টরের টিমের সাথে ক্রিয়েটিভ টিমের অনেকেই যাচ্ছে। আমি যুথী ম্যাডামকে বলেছিলাম আমাকেও সঙ্গে নিতে। তিনি এক ধমক দিয়ে বললেন, আমার না-কি ওখানে গিয়ে কোনো কাজ নেই।”

একটা সিনেমার স্ক্রিপ্ট, অভিনেতা-অভিনেত্রী চূড়ান্ত হয়ে গেলে পরবর্তী কাজ লোকেশন দেখা। পরিচালক দলবল নিয়ে শুটিংয়ের আগে যে জায়গাগুলোতে শুটিং হবে, সেখানে ঘুরে আসেন। এতে শুটিংয়ের ছক কষতে সুবিধা হয়। স্ক্রিপ্টে লেখা দৃশ্যগুলো কল্পনায় আনতেও কোনো অসুবিধা হয় না।

অরা অবাক হয়ে দেখছে মাহমুদের কান্ড। এই অফিসে হাজারটা বিশাল বিশাল ঝামেলা সামাল দিতে হয় তাকে। আর সেখানে এই ছেলেটা প্রতিদিনই এমন ছোটখাটো সমস্যা নিয়ে আসছে তার কাছে। অরা না পারছে ধমক দিতে, না পারছে ফিরিয়ে দিতে।

মাহমুদ ইতস্তত করে বলল, “আমার অনেক দিনের শখ ম্যাম। বাইরে লোকেশন দেখতে যাবো। প্লিজ ম্যাম, মানা করবেন না।”

অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “ঠিক আছে। আমি যুথীকে বলে রাখবো।”

মাহমুদ চলে যেতেই অরা আবারও ডুব দিলো কাজের মাঝে। দুপুরের পর তার আরও একটা মিটিং ছিল অন্য এক সিনেমার পরিচালকের সঙ্গে। এই লোকের নাম সাদমান সাইদ। তিনি যে সিনেমাটি নির্মাণ করতে যাচ্ছেন, তার নাম ‘ছাই’। গ্রামের মানুষের জীবনধারা নিয়ে সিনেমা। এই সিনেমার লোকেশন দেখতে যাওয়ার জন্যেই ছটফট করছে মাহমুদ।

সাইদের সঙ্গে মিটিং শেষে অরা মিটিংয়ে বসলো কে ফিল্মসের পিআর টিমের সঙ্গে। পিআর টিমের দায়িত্ব একটা সিনেমা প্রচারণায় অভিনব সব কৌশল খুঁজে বের করা। সিনেমাকে মুক্তির আগেই দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

মুক্তির অপেক্ষায় থাকা আরশাদের সিনেমা ‘দূরে হারিয়ে’র প্রচারণায় কোনপ্রকার কমতি নেই। সিনেমা মুক্তি পেতে যাচ্ছে এ মাসের একুশ তারিখে। শেষ মুহূর্তের প্রচারণার একটা ছক সাজাতেই তাদের সঙ্গে আজ মিটিংয়ে বসা।

অরা নিজের কেবিনে অবশেষে ফিরতে পারলো সন্ধ্যা মিলিয়ে যাওয়ার পর। ফোনটা হাতে নিতেই তার চোখে পড়লো আরশাদের মিসড কল। সর্বনাশ! কাজের ব্যস্ততায় এতটাই ডুবে গিয়েছিল সে আরশাদের কলটা খেয়াল পর্যন্ত করেনি অরা। অনুতাপের দমকা হাওয়া বয়ে গেল অরার গা বেয়ে।

সঙ্গে সঙ্গে অরা কল ব্যাক করলো আরশাদের নম্বরে। অপরপ্রান্ত থেকে কোনো জবাব এলো না। নির্ঘাত সেও ব্যস্ত এখন। আজ আরশাদের বিজ্ঞাপনের শুটিং রয়েছে। এমন কিছু মুহূর্ত থাকে, যখন অরার ইচ্ছে হয় সব কাজ বাদ দিয়ে কেবল আরশাদের আশেপাশে পড়ে থাকতে। এই যেমন, এই মুহূর্তটা।

এই ব্যস্ততা কি ক্রমেই দূরত্ব সৃষ্টি করছে দুজনের মাঝে? দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরা। এত ব্যস্ততা কেন তাদের জীবনে? ব্যস্ততাগুলো নিমিষেই কেটে গিয়ে যদি প্রশান্তিময় একটা সময়ের সৃষ্টি হতো! যদি কোনো চিন্তা না করে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে পারতো দুজনে! বেশ হতো।

অরার ভাবনায় ছেদ পড়লো দরজার শব্দে। চোখ তুলে তাকাতেই বুজে ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেল অরা। ধাক্কা খাবে নাই বা কেন? এতক্ষণ তার এলোমেলো ভাবনায় যে ঘোরাফেরা করছিল, তাকে চোখের সামনে দেখে তো ধাক্কা খাওয়ারই কথা।

অরা উচ্ছ্বাসে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আরশাদ তুমি!”

ঠোঁটে রহস্যের এক হাসি বজায় রেখে দরজাটা আবারও বন্ধ করে দিতে দিতে বলল, “কেন বিরক্ত করলাম?”

প্রশ্নটার জবাব আর দিতে পারবো না অরা। ছুটে গেলো তার প্রিয় মানুষটার কাছে। আরশাদও এক মুহুর্ত অপচয় না করে বুকে টেনে নিলো অরাকে। আরশাদের বুকে মাথা রাখতেই বিচিত্র এক প্রশান্তি খেলে গেল অরার সমস্ত শরীরে। দিনের সমস্ত ক্লান্তি যেন নিমিষেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

আরশাদ কোমল স্পর্শে অরার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে কৃত্রিম অভিমান নিয়ে বলল, “এত ব্যস্ত আপনি? সারাটা দিনে একবারও মনে পড়লো না আমার কথা?”

অরা আরশাদের দিকে তাকিয়ে অনুতাপমাখা কণ্ঠে বলল, “I’m so sorry Arshad! আজ একটু বেশিই ব্যস্ত ছিলাম।”

আরশাদ অন্যরকম গলায় বলল, “এত ব্যস্ত থাকলে তো চলবে না ম্যাডাম।”

আরশাদ তার ডান হাতের দুটো আঙুল অরার মাথার একপাশে রেখে বলল, “আপনার এখানে…”

আঙুলদুটো নামিয়ে আরশাদ ঠিক অরার হৃদয়ের ওপরে রেখে বলল, “আর এখানে। শুধুমাত্র আমারই বিচরণ। আর কাউকে তো আমি আমার জায়গাটা দেবো না।”

অরা কিছুই বলতে পারলো না। আরশাদের আকস্মিক এমন স্পর্শে যেন পাথরের ন্যায় জমে গেল সে। চোখদুটো প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। আরশাদ অরার চিবুক ছুঁয়ে মুখটা তুলে ধরলো তার চোখের দিকে।

আরশাদের চোখে অরা স্পষ্ট নিজের জন্যে একরাশ ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে। সে ভালোবাসা পৃথিবীর সকল ভয়কে দূর করে দেয়। কোনপ্রকার ব্যস্ততার সাধ্য নেই এই ভালোবাসার মাঝে দুরত্বের মতো ঠুনকো জিনিস সৃষ্টি করার।

আরশাদ যেন আর নিজের মাঝে নেই। ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে তার বাহুডোরে আটকা পড়ে যাওয়া মানুষটার মাঝে। তার চোখদুটো এখন আবদ্ধ হয়ে আছে অরার ঠোঁটের দিকে। একটু একটু করে সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছে আরশাদ।

অরা আঁতকে উঠে বলল, “আরশাদ দরজা…”

অরার ঠোঁটের ওপর একটা আঙুল রেখে তাকে চুপ করিয়ে দিলো আরশাদ। তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে নিচু গলায় বলল, “আমার বউয়ের ঘরে কখনো দরজা লক না করে ঢুকি না। বুঝলেন ম্যাডাম?”

আরশাদের এমন কথায় লজ্জায় লাল হয়ে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো অরা। মেয়েটার এই লজ্জারাঙা মুখটা দেখার লোভ আরশাদ কোনোকালেই সামলাতে পারেনি। কোনো কারণে অরা লজ্জা পেলেই সে ব্যস্ত হয়ে যায় তাকে আরেকটু লজ্জা পাওয়াতে।

সেই উদ্দেশ্যেই আরশাদ অরার কানের সাথে ঠোঁট মিশিয়ে বলল, “তাহলে আমার কাজটা শুরু করি?”

আরশাদের মনের আশা পূর্ণ হলো। আরও দ্বিগুণ লজ্জায় অরার গালদুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। লজ্জায় তার মুখ থেকে টু শব্দ পর্যন্ত বের হলো না।

আরশাদ আবারও তার মোহনীয় স্বর বলে উঠলো, “করবো না?”

লজ্জাসরমের মাথা খেয়ে অরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো। আর কোনোকিছুই থামাতে পারলো না আরশাদকে। ব্যস্ত ভঙ্গিমায় তার শীতল ঠোঁটদুটোর স্পর্শ পেলো অরার ঠোঁট। প্রশান্তিময়, কোমল কোনো স্পর্শ নয়। ব্যাকুলতায় ভরা তৃষ্ণার্ত এক স্পর্শ। এই স্পর্শ পাওয়ার জন্যে যেন হাজার বছর ধরে অপেক্ষায় ছিল আরশাদ।

আরশাদ ঠিক এভাবে থেকেই অরাকে নিয়ে এগিয়ে গেল এই কেবিনে থাকা প্রকান্ড সাদা সোফাটার দিকে। অরার ঠোঁটদুটোকে নিতান্ত কয়েক মুহূর্তের জন্যে ছেড়ে দিয়ে আগে নিজে বসলো সোফায়। তারপর অরার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাকে বসালো নিজের কোলে। আবারও আরশাদ হারিয়ে অরার ঠোঁটের ভাঁজে। নিজের অজান্তেই তার হাতদুটো চলে গেল অরার চুলে। একটানে বাঁধনমুক্ত করতেই চুলগুলো তার পিঠের ওপরে ছেয়ে গেল।

সময়ের হিসাব কারও কাছেই নেই। কতক্ষণ পেরিয়ে গেছে কে জানে? বেশ অনেক সময় পর অরার ঠোঁটদুটো ছেড়ে দিলো আরশাদ। রীতিমত হাপাচ্ছে অরা। তবে বিন্দুমাত্র ক্লান্তি নেই আরশাদের মাঝে। মোহাগ্রস্ত ভঙ্গিতে সে মুখ ডুবিয়ে দিলো অরার ঘাড়ে। শিহরণে দিশেহারা হয়ে অরা খামচে ধরলো আরশাদের টি-শার্ট।

অরা লজ্জায় জড়সড় হয়ে বলল, “এত অসভ্য কেন তুমি? কথা নেই বার্তা নেই, সারাদিন শুধু অসভ্যতা!”

অরার ঘাড় থেকে মুখ না সরিয়েই আরশাদ বলল, “আমি অসভ্য না হলে দুদিন পর মা ডাক শুনতে কীভাবে?”

অরা মিইয়ে গিয়ে বলল, “ছিহ!”

আরশাদ এবার অরার ঘাড় থেকে মুখ তুলে ঠিক তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “শুধু আমিই অসভ্য না? তুমিও তো আমার সাথে কত অসভ্যতা করে এসেছো। মনে নেই? দাঁড়াও মনে করিয়ে দিচ্ছি!”

আরশাদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই অরা নিজেকে আর সামলাতে না পেরে মুখ লুকালো তার বুকে।

আরশাদ অরার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে মুচকি হাসি হেসে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। বাসায় গিয়ে মনে করিয়ে দিবো।”

বাসায় ফিরে দুজনেই কথাকে অনেকটা সময় দিলো। দুদিন পর মেয়েটার হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা। এতটুকু একটা বাচ্চা, অথচ পরীক্ষার গুরুত্ব বেশ বুঝতে পারে। তাই নিজেই গেম-টেম একটু কমিয়ে দিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। কথার গভর্নেন্স পায়েল বলল, আজ না-কি স্কুল থেকে ফেরার পর সে কোনপ্রকার বিশ্রাম নেয়নি। শুধু পড়ে গেছে।

আরশাদ আর অরা বাড়ি ফেরার পর অবশেষে উঠলো পড়ার টেবিল থেকে। ব্যস্ত হয়ে তার অংকগুলো দেখালো আরশাদকে। আরশাদও প্রায় পঞ্চাশটার মতো অংক ধৈর্য ধরে দেখলো। ভুলগুলো ধরিয়ে দিলো, সুধরেও দিলো।

কথাকে ব্রাশ করিয়ে দিয়ে আরশাদ তাকে ঘুম পাড়াতে নিয়ে গেল। তবে কথা না-কি এখন ঘুমাবে না। আধ ঘন্টা টিভি দেখে তারপরে ঘুমাবে। আরশাদও তাই ফিরে এলো নিজেদের ঘরে।

অরা বিছানার ওপরে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। আরশাদ ঘরে ঢুকেই ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেলো তার ব্যাগটার দিকে। এই বাদামি রঙের লেদারের ব্যগটাতে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থাকে। এটা নিয়েই সাধারণত সে শুটিংয়ে যায়। ব্যাগের চেন খুলে কী যেন খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আরশাদ।

খুঁজতে খুঁজতেই বলল, “অরা? বলো তো, পৃথিবীর সবথেকে রোমান্টিক গয়না কী?”

অরা হাসিমুখে বলল, “গয়না আবার রোমান্টিক হয় না-কি?”

“হয় তো! ভেবে বলো রোমান্টিক গয়নাটা কী?”

অরা খানিকক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে বলল, “আংটি?”

“না।”

ধাঁধায় পড়ে গেল অরা। আংটি দিয়েই তো ছেলেরা মেয়েদের প্রোপজ করে। দ্বিতীয়বার সকলের সামনে বিয়ে করার জন্যে প্রোপজ করে আরশাদও তাকে একটা হীরার আংটি পরিয়ে দিয়েছিল। যে আংটি আজও তার আঙুল থেকে অবিচ্ছেদ্য। আংটি যদি সবথেকে রোমান্টিক গয়না না হয়, তাহলে কী?

অরা আরেকটু চিন্তা করে বলল, “চুড়ি?”

ব্যাগ থেকে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা খুঁজে পেয়ে আরশাদ অরার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, “উহুঁ।”

“তাহলে?”

“নূপুর।”

চোখের সামনে আরশাদ মেলে ধরলো অসম্ভব সুন্দর এক রূপার নূপুর। ওপরের সারিতে চকচক করতে থাকা কতগুলো পাথর, আর নিচের দিকে ঝুলন্ত ছোট ছোট রূপার পাতা।
অরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল জিনিসটার দিকে।

“নূপুর রোমান্টিক কীভাবে?”

আরশাদ তার মোহনীয় গলায় বলল, “এই নূপুর পরে যতবার তুমি পা ফেলবে, ততবারই ঝনঝন শব্দ হবে। যে শব্দটা বারবার তোমাকে আমার কথা মনে করিয়ে দিবে। রোমান্টিক না?”

অরা প্রচ্ছন্ন এক হাসি হেসে তাকিয়ে রইল আরশাদের দিকে। এই মানুষটার পাগলামি কি কখনোই শেষ হবার নয়?

আরশাদ অরার পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে তার পায়ে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে অরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “কী আশ্চর্য! পায়ে হাত দিতে হবে কেন?”

অরার ব্যস্ততার কোনপ্রকার তোয়াক্কা না করে আরশাদ বলল, “পায়ে হাত না দিলে পরাবো কীভাবে?”

“আমি নিজে পরে নিতে পারতাম না?”

“না। আমার বউকে শুধু আমিই পরিয়ে দিবো!”

যত্ন নিয়ে আরশাদ নূপুরটা পরিয়ে দিলো অরার পায়ে। তাদের এই সুন্দর মুহূর্তে বাঁধ সাধলো দরজায় টোকার শব্দ। আরশাদ এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখলো কথা দাঁড়িয়ে আছে। তার ছোট্ট হাতে আবদ্ধ হয়ে আছে একটা টেডি বিয়ার।

আরশাদ চট করে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, “কী হয়েছে বাবা?”

কথা আরশাদের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি আজ এখানে ঘুমাই?”

“অবশ্যই।”

আরশাদ কথাকে বিছানায় নামিয়ে রাখতেই অরা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “ভয় পেয়েছিস সোনা?”

কথা শুকনো গলায় বলল, “না। এমনিই এখানে ঘুমাতে ইচ্ছা করছিল।”

আরশাদ ব্যস্ত হয়ে পড়লো মেয়েকে ঘুম পাড়াতে। কথাও বাধ্য মেয়ের মতো গুটিশুটি মেরে বাবার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে রাজ্যে তলিয়ে গেল। চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো একটা দৃশ্য। মানুষের সুখী হতে খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন হয় না। ছোট্ট একটা সখময় পরিবারই যথেষ্ট।

(চলবে)