ফেরার কোন পথ নেই পর্ব-০৪

0
175

#ফেরার_কোন_পথ_নেই ( ৪)
কলমে #রেহানা_পুতুল
আচম্বিতে হা’রা’মিটা শক্ত করে আমার দুহাত চেপে ধরল। করুণ কন্ঠে বলল,
শিলা ওকে নিয়ে আসব আমাদের কাছে। তুমি মেনে নিলে সারাদুনিয়াও ওর কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। সব তোমার কাছে। আমি তোমাদের দুজনকে আজীবন ভালোবাসায় আর যত্নে রাখব। আমার দায়িত্বের এতটুকু হেরফের হবেনা। এই তোমার মাথা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি।

মন চেয়েছে তাকে চা’কু দিয়ে কুচি কুচি করে ফেলি।এবং তার শরীরের কিমাগুলো সারা ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে ছড়িয়ে দিই। যেন কাক, কুকুরে খায়।

এটা কি আদৌ সম্ভব? মেনে নেয়ার যে প্রকারভেদ রয়েছে এটা জানো তুমি?
দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললাম তাকে।

খুউব জানি। তবুও বলছি না মানার মতই মেনে নাও অন্তত। দেখ আমাদের নবীও চার বিয়ে করেছে। এটা জায়েজ আছে। আমিতো কোন পাপ করিনি। সব স্ত্রীর হক সমভাবে আদায় করলেই আর কোন সমস্যা নেই। এটাতো তুমিও জান। আমি কারো স্ত্রীকে বিয়ে করিনি। আমি বিয়ে করেছি একজন কূলহারা অসহায় নারীকে। এই বলে সে আমার কাছে দুহাত জোড় করে আকুলিবিকুলি শুরু করল ভেজা চোখে।

তার নিরীহ আকৃতির চেহারাকে আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিদঘুটে চেহারা মনে হলো। এর চেয়ে নদর্মার কীটের চেহারাও ভালো।

মন সুন্দর না হলে সুন্দর চেহারাটাও দেখতে কুৎসিত। আর মন সুন্দর হলে কুৎসিত চেহারাটাও দেখতে সুন্দর।

বলে উঠলাম বাহ বাহ! তোমার লজিক দেখলে নিজেরই গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে করছে। খবরদার বলছি আর কথায় কথায় নবী, হাদিসের রেফারেন্স টানবেনা। বাটপারির ও একটা লিমিট আছে। সমাজে পাপ না করা সব কাজই কি ঠিক বা উচিত? এতই যদি মহান সাজতে চাও,তাহলে আরো দুজন বিধবাকেও বিয়ে করে নাও। অন্যের সন্তানদের দরদ দেখাচ্ছ নিজের সন্তানদের অধিকার কেড়ে নিয়ে? তুমি করো তাকে নিয়ে সংসার। তোমার দীর্ঘ বছরের বিরহিত অনুভূতি পূর্ণতা পাক এবার। জুতা মারি তোমার সংসারে।

একটু বুঝতে চেষ্টা কর শিলা। তোমার সংসার তোমারই থাকবে।

সংসারের মানে বোঝ তুমি? সংসার মানেই কি তিনবেলা পেটপুরে খাওয়া আর পরনে ছেঁড়া শাড়ি না থাকা? ভালোবাসাহীন, মর্যাদাহীন কোন সংসার হয়না। এ কেবল লোক দেখানো আর মন ভুলানো ছলাকলাই মাত্র। তোমার মস্তিষ্ক জুড়ে অন্য নারীর অবাধ বিচরণ। তোমার প্রাণ উজাড় করা আলিঙ্গনে অন্য কেউ। আবার বলছ আমার সংসার।

আমার রোষপূর্ণ কথার তোড়ে সে চুপ হয়ে আছে। তখন তার একটা ব্যবসায়ীক কাজের জরুরী ফোন এলে সে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যায়।

সেদিন হতে আমি তার সাথে শুধু ততটুকুই কথা বলি। ঠিক যতটুকু আমার সন্তানদের জন্য প্রয়োজন হয়। আমরা দুজন কাছে থেকেও যোজন যোজন দূরে। বাসার অবস্থা থমথমে। যেন একসাথে কয়েকটা লা’শ পড়েছে। রাতেও এশার সাথে ঘুমাই তার রুমে। কি হবে ওর হৃদয়হীন শরীরটার পাশে শুয়ে। কেবলি বিষাদের পাল্লা ভারী করা। মন ছাড়া যে দেহ কত ভারী তা যে জন হারায়। সে মাত্রই টের পায়।

সময়ের নিয়মে সময় যায়। বেলা গড়ায়। আমি তিন সন্তানের জন্যই সব সামলাই টলতে টলতে। প্রতিটিমুহুর্তে আমার আঁখিকোণটা টলমল হয়ে থাকে বরষার ভরা বিলের মতো। চারদিকে থই থই পানি। অশ্রুপূর্ণ জলকণাগুলো হুটহাট যখন তখন গড়িয়ে পড়ে বেসামালভাবে৷ আমার বালিকা মেয়ে এশার মনের অবস্থাও শোচনীয়। তার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ভণ্ড পিতা প্রেম করে বিয়ে করেছে। সে এটা বুঝতে না পারলেও তার বাবা অন্য নারীতে আসক্ত এটা বেশ উপলব্ধি হয়ে গিয়েছে তার।

যার দরুণ আজকাল এশার মনটাও বিষাক্ত হয়ে থাকে। বেদনায় নীল হয়ে থাকে তার কোমল গালদুটো। তার স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় অনিয়ম ঢুকে পড়েছে। দিনে দিনে আমাদের চারজনের প্রতি তার বাবার অমনোযোগ উদ্ভাসিত হতে লাগল। আমি নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম চূড়ান্তভাবে।

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর মনোযোগ কমে গেলে তার প্রভাব সন্তানদের উপরেও পড়ে। তাদের উপরেও মনোযোগ হারায় পাষণ্ড বাবারূপী প্রতারকটা।

আরেহ সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমার এতবছরের সম্পর্ক, মায়া,ত্যাগ,সন্তান,মর্যাদা, গুরুত্ব,সমাজ,পরিবার, এগুলো কিভাবে ধূলিসাৎ করে দিলি। কোথায় গেল নাক উঁচু করে তোর মূল্যবোধের কথাগুলো। এই মূল্যবোধ আর বিবেকবুদ্ধির নমুনা? তুই কি উনিশ বিশ বছরের যুবক নাকি? আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিসনা! মানুষ পরিবারের কথা ভেবে,সমাজ,সম্মানের কথা ভেবে কত কিছু স্যাক্রিফাইস করে। আর তুই খাটাইস এটা পারলিনা? সুযোগ এলো আর অমনি তা লুফে নিলি হুড়মুড় করে। গজগজ করে বললাম আমি।

এদিকে আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয় পর্যন্ত ভাবতে থাকি। কার স্বামী মারা গেল। কই মনে পড়ছেনা কারো কথাই। এক খালাত বোনের স্বামী মারা গেল। কিন্তু সেতো আমার ছোট। ও বলল আমার সিনিয়র। এফোঁড়ওফোঁড় করেও চিহ্নিত করার মত কাউকেই পেলাম না।

গ্রাম থেকে মা ফোন দিল।
কিরে শিলা আজ কয়দিন ফোন দেসনা কেন?শরীর খারাপ নাকি?

ফোনের এপ্রান্তে আমি থম মেরে আছি। ধরা পড়ার অতি আশংকায় মা বোনের সাথে এই কয়দিন যোগাযোগ করিনি। এটা সত্যি।

মায়ের নরম কন্ঠ শ্রবণ হতেই আমার অন্তরের থরে থরে সজ্জিত দুঃখরা হামলে পড়ল নয়নযুগলে। অশান্ত শ্রাবণঢলের ন্যায় হুহু করা চাপা রোদন মায়ের অন্তঃস্থল ভেদ করল। মা আৎকে উঠল। উৎকন্ঠাজনিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
কি হলোরে মা? এভাবে কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে বল?

আমার মুখ দিয়ে গলগলিয়ে সব বের হয়ে গেল। মা সহ্য করতে পারলনা। কান্নার বদলে ক্ষেপে গেল। ফোন রেখে দিল তড়িতেই।

কিছুসময় পর মা আবার ফোন দিয়ে আমাকে পরামর্শ দিল। বলল, তুই সবসময় বলিস এহসান তার বড় ভাইকে খুব ভয় পায়। তার বাসায় গিয়ে সব খুলে বল এবং সেই স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে বল।

আমি বললাম, মা এটা করবনা। এতে লাভ হবেনা। সংঘাত বেড়ে যাবে। ঠান্ডা মাথায় যা করার করব।

কি করবি?

থানায় মামলা দিব। প্রথম স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করার মামলা। দ্বিতীয়ত আমিই তাকে ডিভোর্স দিব।

মা হায় হায় করে বললেন,
তোর বুদ্ধিসুদ্ধি সব লোপ পেয়ে গিয়েছে। এতে তার আরো সুবিধা হবে। তাকে এনে বাসায় উঠাবে।

জাহান্নাম করুক সে। যার হৃদয়ে আমার স্থান ভাঙাকুলো আর অচল পয়সার মতো । তার ছায়া মাড়াতেও আমি রাজী নই মা। আমার আত্মসম্মানবোধ আছে। ব্যক্তিত্ব আছে।

মা হতাশ কন্ঠে আমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফোন রেখে দিল।

আমি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি একাকী জীবনের। এই ভিতরে তার ফোন রেকর্ড চেক করার ও সময় হলনা। এক সকালে সে মোবাইল বালিশের তলায় রেখে শাওয়ার নিতে ঢুকল। আমি তার মোবাইল নিয়ে কমন ওয়াশরুমে ঢুকে রেকর্ডগুলো শুনতে পেলাম। কন্ঠটা অল্পস্বল্প চেনা মনে হলো। ধোঁয়াশায় পড়ে গেলাম।

ও ওয়াশরুম থেকে বের হলে, তার হাতে মোবাইল দিলাম। ফিচলে হাসি হেসে বললাম, অভিনন্দন মিস্টার এহসান। বাবা হতে যাচ্ছেন শুনলাম।

সে তার মোবাইল চেক করে বুঝল, কিভাবে জানলাম। রেকর্ড অপশন অফ করে দিল। পলক না পড়তেই আমার মুঠোফোনটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে সজোরে আছড়ে ফেলল। কয়েকটুকরো হয়ে গেল আমার পছন্দের নিউ মোবাইলটা। আমি হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলাম কেবল।

সে ব্যাঘ্রকন্ঠে বলে উঠল,
তুই খুব বাড় বেড়েছিস। আজ থেকে তোর মোবাইল ইউজ করা অফ। তোর এত বড় সাহস? আমার খেয়ে আমার পরে আবার আমার উপরেই নজরদারি করছিস? তোর চেয়ে সুমনা ঢের ভালো। দূরে থেকেও আমার টেইক কেয়ার করে।

আমি বিষিয়ে আসা ভগ্নচিত্ত নিয়ে তার নয়ন সম্মুখ হতে সরে গেলাম। এখন আর লুকিয়েও কথা বলেনা সে। দুদিন পরে দোকানে এক স্টাফ থেকে জানলাম,
সে আরেকটা নিউ মোবাইল কিনেছে। রোজ রাতে বাসায় ফেরার আগে সেই মোবাইল বন্ধ করে ক্যাশ রাখার ড্রয়ারে লক করে রেখে দেয়। সকালে গিয়ে অন করে। শুরু হয় তাদের প্রণয়লীলা। তিন চার ঘন্টা নাকি তারা কথা বলে অড়িও ভিড়িওতে।

নদীর যেমন এ পাড় ভাঙে ওপাড় গড়ে। আমার জীবনের অবস্থাও তদরূপ। আমি হলাম নদীর ভাঙ্গা পাড়। আমি সিদ্বান্ত নিতে থাকি আমার ও তিন সন্তানকে নিয়ে।

একদিন দুপুরে চুপিচুপি গিয়ে উত্তরা থানায় মামলা করে আসলাম তার নামে। নির্জীবের মত বেঁচে আছি কেবল। বাসায় সবার জন্য একটা পুরনো মোবাইল ছিল। সেটাতে সিমকার্ড ভরে নিজের মা বোনের সাথে কথা বলছি। সে কিন্তু আমার মোবাইল ঠিক ও করে দেয়নি। নতুন ও কিনে দেয়নি। অথচ নিজের স্বার্থে আরেকটা দামী সেট ঠিকই নিল। হায়রে স্বার্থের দুনিয়া। এই বুঝি তোর ছিনিমিনি খেলা।

সেদিন ছিল বৃহস্পতিবারের রাত। ঘড়ির কাঁটা রাত এগারোটা ছুইঁ ছুইঁ। এহসান বাসায় ফিরলনা। আমি খানিক ভাবলাম শুধু এইজন্যই। সে আমার তিন সন্তানের বাবা। নয়তো কবেই তার কপালে ঝাড়ু মারতাম।

বাসার ডোরবেল বেজে উঠল। বাচ্চারা যার যার মত করে ঘুমিয়ে আছে। আমি গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। দেখলাম এহসানের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে কালো বোরকা পরিহিত একজন নারী। মুখ নেকাব দিয়ে ঢাকা। দুই হাত ও দুই পাও তার মোজা দিয়ে ঢাকা।

আমি একটু সরে দাঁড়ালাম,
জিজ্ঞাসু চোখে এহসানের মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম।

শিলা ও সুমনা। আমি গ্রামে গিয়ে নিয়ে আসলাম। তুমি না চাইলে ওকে আলাদা বাসায় রাখব। দুই চারদিন একটু থাকুক তোমার সাথে।

আমি সুমনার মুখের দিকে নজর ফেললাম। ঢাকা তাই দেখতে পেলাম না। সুমনা মুখের নেকাব সরিয়ে মার্জিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
শিলা কেমন আছিস?

নিমিষেই আমার সারাশরীরের লোমগুলো কাঁটাদিয়ে উঠল। একটা ভয়ংকর শীতল স্রোত সর্পিল গতিতে আমার হৃদপিণ্ডের মাঝবরাবর দিয়ে বয়ে গেল। আমার রাঙা অধরযুগল ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করল মরা মাছর ন্যায়।

তোতলানো স্বরে বললাম,
মি..মি..তা আন্টি আপনি! বলেই আমি মাথা ঘুরে পড়ে ঠাস করে মেঝেতে পড়ে গেলাম।

ক্রমশ ঃ ৪