ফেরার কোন পথ নেই পর্ব-০৫

0
160

#ফেরার_কোন_পথ_নেই ( ৫)
কলমে #রেহানা_পুতুল
নিমিষেই আমার সারাশরীরের লোমগুলো কাঁটাদিয়ে উঠল। একটা ভয়ংকর শীতল স্রোত সর্পিল গতিতে আমার হৃদপিণ্ডের মাঝবরাবর বয়ে গেল। আমার রাঙা অধরযুগল ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করল মৃত মৎসের ন্যায়। তোতলানো স্বরে বললাম,
মি..মি..ই..তা আন্টি আপনি! বলেই আমি মাথা ঘুরে পড়ে ঠাস করে মেঝেতে পড়ে গেলাম।

জ্ঞানশূন্য আমার আর কিছুই মনে নেই। পরেরদিন ঊষালগ্নে নিদ্রা ভঙ্গ হতেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম এশার বিছানায়। এক পাশে আয়রাও রয়েছে। বিছানা থেকে নামলাম। বিড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে আমার একমাত্র ছেলে মাহিনের রুমে গেলাম। নিদ্রায় তলিয়ে আছে মাহিন। বুঝলাম সেই পিশাচরা আমার বেডরুম দখল করে আছে।

আজ শুক্রবার। সবকিছু বন্ধ। তাই কারোই বের হওয়ার তাড়া নেই। তবে আমার আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে তাড়া এখন আমার মাঝে। আমাকে ভেঙ্গেচুরে গেলে চলবেনা। আমার তিনসন্তানের জন্য আমাকে মজবুত হতে হবে লোহার মত। যেন কেউ আমাকে আঘাত করতে এলে উল্টো নিজেই আঘাত খেয়ে পড়ে যায়। এ পৃথিবী দুর্বলের জন্য নয়। এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারে কেবল শক্তিশালীরাই। নিজের সন্তানদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করবনা।

আমি পূনরায় এশার রুমে চলে গেলাম। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি দুই বোন জেগে গিয়েছে। বিছানার মাঝ বরাবর বসে আছে করুণ মুখে। রাজ্যের মায়া আমার দুই কন্যার সারামুখজুড়ে। আমিও খাটের উপরে উঠে বসলাম।

এশা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল,
আম্মু তোমাদের রুমে আব্বুর পাশে একটা মহিলা ঘুমানো। আব্বু কি একেই বিয়ে করেছে?

আমি এশা ও আয়রাকে বুকে লেপ্টে নিলাম। অঝোরে কেঁদে ফেললাম। এশাও হুহু করে কেঁদে ফেলল। আমাদের অশ্রুবাণে ভেসে গেল ছোট্ট ফুলের মত আয়রাও। ফ্যালফ্যালিয়ে সেও কেঁদে ফেলল। মাথার উপরে চার হাতার সিলিং ফ্যান ঘুরছে। তার শোঁ শোঁ শব্দের দরুণ আমাদের তিনজনের চাপা আর্তনাদ রুম থেকে বের হলোনা। কেবল একটা অশরীরী আত্মার মত চারদেয়াল ঘুরে ফের আমাদের কানে বিষাদের ঝংকার তুলল।

আম্মু এ ডাইনী কে?

ম্যাড়মেড়ে স্বরে বললাম, মুখ দেখিসনি?

নাতো। দেখিনি।

আমার সেজো খালা আছেনা। তার আপন চাচাত দেবরের বউ। অর্থাৎ খালার চাচাতো জা। আমার তো খালাই। আমি খালার বাড়িতে গেলেই এদের ঘরে দিনে কয়েকবার যেতাম। খালার আর তাদের ঘর পাশাপাশি। খালার সাথে তার ঘনিষ্ঠতা প্রবল। আন্টি ডাকতাম তাকে। আমাকেও অনেক খাতির করতো সে। তাদের ঘরে টিভি দেখতাম। তাদের পেঁপে গাছ পেয়ারা গাছ আছে। এগুলো আমাকে সাথে নিয়ে পেড়ে নিতো। এরপর আঁচার দিয়ে ভর্তা বানাতো। এই মহিলা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। তাবলীগে যেত। হাত মোজা পা মোজা পরত। ঘুরে ফিরে তার মুখে পর্দার কথা শুনতাম। হাদীসের কথা শুনতাম। নীতির কথা শুনতাম। কিন্তু আমি স্বপ্নেও ভাবিনি এইই চেনামুখটাই আমাদের জীবনে অভিশাপ হয়ে আসবে। তার স্বামী মারা গিয়েছে। তার আটমাস পরেই নাকি তোর আব্বু তাকে বিয়ে করে। তাদের পরিচয় নাকি আমাকে বিয়ে করার আগে থেকেই। এটা তোর আব্বুই স্বীকার করছে। চিন্তা কর তুই। স্বামীর স্মৃতি ভুলে গেল মাত্র কয়েকমাসেই। তার মানে সে তার স্বামীকে ওভাবে ভালোবাসেনি বয়সের ব্যবধানের জন্য। ধোঁকা দিয়েছে স্বামীকে। তার স্বামী কিন্তু খুব ভালো মানুষ ছিল। তাকে নাকি অনেক ভালোবাসতো। সংসারের চাবিকাঠি তার হাতেই ছিল। এসব খালার মুখেই শুনেছি কত। তার এত বছরের সাজানো সংসার, তিন ছেলেমেয়ে ফেলে এটা কিভাবে পারল। কেবলমাত্র নিজের সুখের কথা ভেবেছ বলেই পেরেছে। আমি প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম কথাগুলো বলেই।

এশা ক্লাশের মনোযোগী বাধ্য ছাত্রের মত আমার কথাগুলো শুনল। শুনল না যেন মুখস্থ করল। সে যতটা না মর্মাহত হলো। তার চেয়ে হাজার গুণ বেশী ক্ষুব্ধ হলো তাদের দুজনের উপর। ফণা তোলা সর্পের মত ফোঁসফোঁস করতে লাগল।

দরজায় টোকা পড়লে এশা গিয়ে দরজা খুলে দিল। মাহিন চোখ ঢলতে ঢলতে বিছানায় উঠে আমাদের পাশে বসল। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
আম্মু তোমাদের রুমে আব্বুর পাশে কে ঘুমানো? তুমি কোথায় ঘুমিয়েছ?

আমি যে এই কয়দিন আলাদা ঘুমাই। তা মাহিন জানেনা। সে ঘুমিয়ে গেলেই এশার রুমে যেতাম। আসলে আমি চাইনি মাহিন সব জেনে যাক। নয়তো এশার মত তার মনেও বিরূপ প্রভাব পড়বে। এখনতো দেখি হাটেই হাঁড়ি ভেঙ্গে দিল সেই পাষণ্ডটা।

এশা বড়। তাই নিজ থেকেই সব জেনে গিয়েছে। বুঝে নিয়েছে। আমি মেঘমুখে মাথা নামিয়ে রাখছি। কি বলব। লজ্জায়,ঘৃণায়,অপমানে আমি নিজেই ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছি ক্ষয়ে আসা চাঁদের মতো। এশা মাহিনকে উত্তেজিত কন্ঠে সব বলল। মাহিন আম্মু বলে আমাকে পেঁচিয়ে ধরল লতার মতো। বাঁধভাঙা জলে তার দুচোখ ভরে গেল।

হুট করেই মাহিন ভয়ার্ত সুরে বলে ফেলল,
আম্মু চলো আমরা তিনজন একসঙ্গে মরে যাই। ক্লাসের বন্ধুদেরকে এ মুখ দেখাতে পারবনা। আব্বুতো এই কালনাগিনীকে বাসায় নিয়েই এলো। আর আব্বুই যদি তোমাকে এখন বের করে দেয়। আমাদের কি হবে আম্মু?

আত্মবিশ্বাসী স্বরে বললাম,
দেশে আইন আছে। কানুন আছে। বিবাহিত স্ত্রী ও তিন সন্তানের মাকে উপযুক্ত কারণ ছাড়া বের করে দেওয়া মুখের কথা নয়।

মরে গেলেই সব সমস্যা শেষ আম্মু। আসো মরে যাই। বাঁচতে ইচ্ছে করছেনা আর। খুউব খারাপ লাগছে আম্মু।

আমার গা ঘেঁষে বসা ছোট্ট আয়রা কেঁদে ফেলল। ঘাবড়ে গেল ভীষণ। মাহিনকে কিল-ঘুষি দিতে দিতে আদূরে গলায় বলল,

না ভাইয়া না। আমি মরবনা। আম্মু মরবেনা। তুমি মরবেনা। আপুনি মরবেনা। আমরা চারজন মিলে ওই মহিলাকে মেরে ফেলব।

আমি আমার আয়রার পেলব অঙ্গখানা আলতো করে তুলে আমার কোলের মাঝে বসিয়ে দিলাম।

এশা দৃঢ় স্বরে চোখ পাকিয়ে বলল, নো। আমরা এটা করবনা। মানুষ হত্যা মহাপাপ। আমরা পাপ না করেই শায়েস্তা করব তাদের। আমরা বজ্র হয়ে উঠব। কঠিনভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করব।

আমি আশ্চর্য হয়ে এশার চোখের দিকে চেয়ে আছি। এতটুকুন মেয়ে। কত কঠিন করে কথা বলল।

পরিবেশ, সময়,পরিস্থিতি প্রতিটি মানুষকে এমন করেই বদলে দেয়। পরিবর্তন হতে সাহায্য করে।

আমি কোনমতে ওদের শান্ত করে উঠে গেলাম। নাস্তা রেডি করে রুমের ভিতরে এনে তিন ভাইবোনকে খাইয়ে দিলাম। বেশ বেলা হয়ে গেল। লক্ষ্য করে দেখলাম সেই হারামি দুটো সুখ নিদ্রায় নিমগ্ন হয়ে আছে।

আমি এশাকে বললাম,
ওদের দিকে খেয়াল রাখ। আম্মু একটু একটু বাইরে থেকে আসছি। কিছুক্ষণ বাদেই চলে আসব।

যেই বিছানায় আমার ও এহসানের বহু মধুর আলিঙ্গনের সুখ স্মৃতি মিশে আছে। সে বিছানায় অন্য নারী। অন্য শরীর৷ উফফ! মাগো! বাসায় আমি আর দম ফেলতে পারছিনা। আর কিছুক্ষণ থাকলে আমি মরেই যাব। তাই একটু নিঃস্বাস ফেলার জন্য একটু বেরিয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য কোন এক নির্জন স্থানে গিয়ে বৃক্ষতলায় বসে তনু ও মনকে খানিক জুড়িয়ে নিব।

ক্লান্ত পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ব্যস্ততম রাস্তার পাড় ধরে। এই কয়দিন নাওয়া খাওয়া বলতে গেলে নাই। ক্ষুধাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। শরীরটাও নিস্তেজ হয়ে আসছে। দুলে দুলে হেঁটে পাশের একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিচের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছি উদাস হয়ে পথ হারা পথিকের মতন।

শিলা তুই এখানে!

কোন পুরুষালী গলার আওয়াজ শুনে মাথা তুলে ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকাই। আমার ভিতরটা ভূমিকম্পের ন্যায় নড়ে উঠল চেনামুখটা দেখেই। যে একসময় আমায় খুউব চাইতো। দিনের পর দিন আমার এড়িয়ে চলা তাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। আমার গ্রামের পাশের বাড়ির সেই বাদল ভাই এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে।

মাই গড়! তোকে এমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে
আয় হোটেলের ভিতরে লাঞ্চ কর। পরে কথা বলছি। আমি যেতে না চাইলে উনি আমার হাত ধরে জোর করে হোটেলের ভিতরে নিয়ে গেল। আমি সৌজন্যতা দেখিয়ে উনার কথা ও তার মৃত স্ত্রীর কথা জিজ্ঞেস করলাম।

উনি আগেরি মতো তৃষ্ণার্ত চোখে আমার জিজ্ঞাসার উত্তর দিলেন। উনার কন্ঠে এখনো আমাকে না পাওয়ার বিরহ। উনার চোখে এখনো রাশি রাশি হাহাকার। লাঞ্চ শেষে আমি চলে আসলাম নানান ছুতোয়। উনি উনার ভিজিটিং কার্ড আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

প্লিজ শিলা অবসরে মিসকল দিস। আমি কলব্যাক করব। কত খুঁজেছি তোকে এই শহরে। এই বলে আমার মোবাইল নাম্বার ও নিল। লজ্জায় বলতেও পারছিনা আমার দূর্দশাগ্রস্ত বেহাল জীবনের গল্প। শুনাতে পারছিনা বেদনার আয়াতগুলো। উনার সামনে থেকে সরে গেলাম। আমাকে এতটা বছর পর দেখে বাদল ভাইয়ের পুরনো অনুভূতি নতুন করে সঞ্চারিত হলো। কিন্তু আমার মাঝে সমস্ত অনুভূতি, অনুভব, স্নেহ,ভালোবাসা সব আমার তিন সন্তানকে ঘিরেই।

তাই সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম। তাকে ডিভোর্স দিবনা। কিন্তু কড়া শাস্তি দিব কৌশলে ও কায়দা করে।

ক্রমশ ঃ৫