ফেরার কোন পথ নেই পর্ব-০৯

0
178

#ফেরার_কোন_পথ_নেই ( ৯)
কলমে #রেহানা_পুতুল
এটা আমার জন্য সত্যিই অনেক বড় সুসংবাদ। সে আমার না থাকুক। কিন্তু আমার তিন সন্তানের পিতার ভাগে অন্য একজনের অধিকার ফলে যাক। এটা আমি একজন মা হয়ে কিছুতেই চাইনা। ভেবেই আমার ঠোঁটের কোনে এক চিলতে প্রশান্তির আভা ছড়িয়ে পড়ল।

দুহাত উল্টিয়ে এলোমেলো হয়ে থাকা আমার দীর্ঘকায় আঁধার কালো কেশগুলোকে হাত খোঁপা করে নিলাম। বিয়ের রাতে এই কেশ নিয়েই সে কত সময় পার করেছে। আমার সারা পিঠজুড়ে চাদরের মত বিছিয়ে থাকা কৃষ্ণকেশের নিচে সে নাক মুখ ডুবিয়েছিলে। সুবাস নিয়েছিল পুষ্পরেণুতে বসা ভ্রমরের মতই।

নিবেদিত কন্ঠে বলেছিল,
জানো শিলা মেয়েদের লম্বাচুলে আমার দারুণ দুর্বলতা রয়েছে। লম্বাচুল থাকলে অনেক ধরনের রোমান্টিকতা করা যায়। সেই মজা বউ।

আমি শিহরিত হয়ে উঠলাম। আমার উদাম পিঠে তার ঠোঁটের নিবিড় উষ্ণ ছোঁয়ারা বিক্ষিপ্তভাবে ছোটাছুটি করতে লাগল। গোপনে ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। লাজুক বদনে উপুড় থেকেই নিচু স্বরে বললাম,
তাহলেতো আপনি আমার চেয়ে আরো লম্বাচুলের কাউকে পেলে ভালোবেসে ফেলবেন।

সে চুপ! বলে আমার মুখ চেপে ধরল। কামুক চাহনিতে বলল,
প্রাণ থাকতে এহসানের জীবনে দ্বিতীয় কোন নারী আসবেনা। শত জনম দুবেলা খেয়েও পার করা যাবে এমন একজন শিলা কারো জীবনে থাকলে।

মাগো! কি মিথ্যুক! কি প্রতারক! আর পারছিনা ভাবতে। স্মৃতির ঝাঁপি থেকে ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসা মধুময় স্মৃতিগুলোকে আর রোমন্থন করতে চাইনা। ভারী করতে চাইনা দুঃখের গ্লানি। জোর করে দমিয়ে রাখলাম অতীতকে। হাহ!

ওরে মীর জাফর। ওরে বেঈমান। এত এত আনন্দঘন মুহুর্তগুলো ভুলে গেলি? মনে রাখবিই বা কেন? তুইতো দ্যা গ্রেট স্বার্থপর। তাই সব ভুলে গেলি।

” বেঈমান কখনো কাঁদেনা। স্বার্থপররা কখনো কোন স্মৃতি মনে রাখে না।”

ভাবছি মিতার মিসক্যারেজ কি সত্যিই হয়েছে। যদি তাই হয় তাহলেতো ডিভোর্স দিতে আর কোন বাঁধাই রইলনা। আচ্ছা অপেক্ষা করে দেখি। এভাবে কেটে গেল সপ্তাহ খানেক।

এক সকালে ও আমাকে বিরক্তময় কন্ঠে বলল,
বড় ভাই থেকে দুই দোকানের চাবি এনে দাও। এটা কোন কথা। উনি ফাজলামো শুরু করছে। লাইফ আমার। মাতব্বরি করছে উনি।

আমি বললাম,
বড় ভাই হিসেবে উনার যা উচিত মনে হয়েছে। তাই করছে। দুটো দোকানতো উনিই নিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু দোকানের ভিতর যে লক্ষ লক্ষ টাকার মালামাল রয়েছে। সেগুলোতো আমার পরিশ্রমের টাকা। সংসার চালাতে হবেনা আমার? মাস শেষ যে মোটা অংকের খরচ দাঁড়ায়, বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে। এসব কি উনি দিবে? হাজী মুহাম্মদ মহসিন এসে গেল।

আমাকে বলে কি হবে এসব। উনাকে বললেই হয়।

যত নষ্টের গোড়া যে তুমি। তাই তোমাকে বলছি। জগতে আর কোন পুরুষ দ্বিতীয় বিয়ে করেনা? আমি একা এ দলে? এই বলে এহসান চেনাজনদের মধ্যে কে কে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ বিয়েও করেছে তাদের উদাহরণ টানতে লাগল।

আমি তক্ষুনি ফোন করলাম আমার ভাসুরকে। লাউড় স্পিকার দিলাম যেন সে শুনতে পায় উনার কথাগুলো।

আমার ভাসুর ফোন রিসিভ করতেই,
আমি সালাম দিয়ে চাবি ফিরিয়ে দিতে বললাম এহসানকে।

উনি গম্ভীর স্বরে জানালেন,
আগে আমি ডিভোর্স এর প্রমাণ পাই। তারপরে দিব।

আমি এহসানকে শুনিয়ে ছল করে বললাম,
ভাইজান আমার দিক থেকে কোন সমস্যা নেইতো। চাবি দিয়ে দেন। নয়তো আমরা কিভাবে চলব? মাস শেষান্তে এতগুলো টাকা কোথায় পাব?

উনি গজগজ করে উঠলেন ফোনের বিপরীত প্রান্ত হতে।
আমি এককথার মানুষ। যা বলছি। তাই হবে। শোন শিলা। তোমার সমস্যা না থাকতে পারে। কিন্তু আমার আছে। আমাদের আছে। আমাদের খানদানে আজ অবধি কোন পুরুষ এমন অনুচিত, ভুল কাজ করেনি। যা সামাজিকভাবে দেখতে দৃষ্টিকটু ও নিন্দনীয়। কোন ভুল আমার কাছে আশ্রয় প্রশ্রয় পাবেনা। তোমার কথার সুর কোন মন্ত্রবলে চেঞ্জ হয়ে গেল? তোমরা নারীরা সহজভাবে স্বামীর অন্যায় আবদারগুলো সহজভাবে মেনে নাও বলেই অন্য পুরুষেরাও দ্বিতীয় বিয়ে, পরকিয়া করার সাহস পায়। এত বাজে একটা কান্ড ওই বদমায়েশ করে ফেলছে যা আমাদের কল্পনার অতীত ছিল। এবার আসি তোমাসের খরচ। মাস শেষে সব খরচ নিয়ে যেও আমার থেকে। বলেই উনি ফোন লাইন কেটে দিলেন।

আমি বাঁকাচোখে এহসানের দিকে চাইলাম। বোঝালাম,শুনলেতো তোমার ভাইয়ের কথা।

সত্যি বলতে ভাইজানের কথাগুলো শুনে আমি গোপনে উল্লসিত হয়ে উঠলাম। আমার ভিতরে অসীম ভালোলাগা দোল খেল ভোরের নির্মল হাওয়ার মতই। আমাদের ভাড়া বাসা হলেও উনার উত্তরায় নিজের বাড়ি রয়েছে। তাই উনি খরচ দিবে এটা বিশ্বাস করলাম। শশুর বাড়ির সবাই পর। এরা কখনো আপন হয়না। এ কথাটা আজ ভুল ঠেকল আমার কাছে। পৃথিবীতে কিছু সুন্দর মনের মানুষ এখনো আছে। চাই সে শশুর বাড়ির হোক আর নিজের গ্রামেরই হোক।

বাদল ভাই আমার বড় ভাসুর একরাম ভাই আমার ভগ্নদশা জীবনের ঢালস্বরূপ। যাদের হৃদয়টা ঔদার্যতা ও মহানুভবতার ঐশ্বর্য দিয়ে আবৃত। এই জগত সংসার আজো তার সমস্ত মাধুর্যতা ও পবিত্রতা নিয়ে টিকে আছে হয়তো এমন কিছু মানুষদের জন্যই।

এহসান আমার সামনে থেকে সরে গেল। ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই ছিল তার যত ব্যস্ততা। এখন যেহেতু সেটা বন্ধ। তাই তার উঠাবসা,ঘুমানো, মোবাইল টেপা,টিভি দেখা ছাড়া আর কোন কাজই নেই। বাচ্চারা ও এখন স্কুলে যাওয়া আসা করে আমার সাথেই। আগে মাঝে মাঝে সেও নিয়ে যেত।

বিশেষ করে আয়রাতো বাবা বলতে অজ্ঞান। কিন্তু এখন আয়রা কেমন হয়ে গিয়েছে। চোখভর্তি অপার ভয় আমার ছোট্ট মেয়েটার। কোলে নিলেই রসগোল্লার মত তুলতুলে শরীরটাকে ছেড়ে দেয় মায়ের উপরে। হয়তো এতেই নির্ভরতা খুঁজে পায়৷ এহসান আয়রাকে আগের মতই আদর করতে চায়। কিন্তু আয়রা অচেনা দৃষ্টিতে তার পিতাকে দেখে একটু দূরে দাঁড়িয়ে। কাছে ঘেঁষেনা। ছুট দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার বুকে।

আমি ভাবছি তার কথার তেজ এখনো মিয়ম্রাণ হলনা কেন? পতনের সংকেত ধ্বনি পেয়েও কি করে একজন মানুষ এত দম্ভ নিয়ে খোঁড়া যুক্তি খন্ডন করে?

এশার বন্ধুর বাবার ফার্মেসী থেকে আগের মত আরো বিশটা ঘুমের ট্যাবলেট কিনে নিলাম হাইডোজের। আগের দশটা শেষ। তনুমনে তার কাছ হতে আমার আর কিছুই পাওয়ার প্রত্যাশা নেই। সে আমার কাছে সেদিনই মৃত হয়ে গিয়েছে। যেদিন জানলাম তার জীবনে, তার ভুবনে অন্য নারীর মুখরিত পদচারণা মুক্ত পাখির ন্যায়। আমিতো এখন এক আস্তাকুঁড়ে তার জীবনে।

তার ম’ দ গেলা বেড়ে গিয়েছে। আগে খেত মাঝে মাঝে। এখন নিত্যনিশিতে। কারণ রয়েছে অবশ্য। একদিকে প্রেমিকা বনাম স্ত্রীকে কাছে পাচ্ছেনা। দিয়ে দিতে হবে চিরতরে বিদায়। তার জন্য কেনা মোবাইলটা দোকানের ভিতরে। এই ফোন দিয়ে যখন তখন ঢালাওভাবে কথা বলতে পারছেনা। পাছে আমি ভাইজানকে বলে দিই যদি। অপরদিকে কাজ নেই। বেকার হয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। হাত খালি পুরোদমে। মিতাকেও খরচ দিতে পারছেনা। আমার কাছেও চাইবার জো নেই। তাদের গ্রামের রুমের ভাড়াও বা দিবে কিভাবে। রেহানা_পুতুল পেইজে লাইক ও ফলো দিয়ে যুক্ত হবেন গল্প সবার আগে পেতে। কথায় আছে অর্থ না থাকলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়। মিতা বুঝি তার জীবন থেকে পালাল। সব মিলিয়ে হতাশ সে। কুলে এসে যেন তরী ডুবল। মিতাকে একবারে বাসায় তুলেও কোন ফায়দা করতে পারলনা।

সে মিতাকে ডিভোর্স দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাকে আর মানানোর মিছে চেষ্টা করলনা। কেননা আমার চেয়েও তার বড় ভাই তেতে আছে তার উপরে। পারেতো মারে। আমি নিয়ম করে রোজ রাতে ওকে ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে দিচ্ছি। কখনো কফির মগে কখনো মদের গ্লাসে।

এশাকে আমি মানা করে দেওয়াতে সে এখন আর পিতার কুকর্ম নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনা। তবে বাবাকে সে প্রচন্ড ঘৃণা করে। একমাস পর মা জমির বায়না নিয়ে দুই লক্ষ পাঠালো আমার জন্য। চুপিচুপি ব্যংক থেকে টাকাগুলো তুললাম। মাস শেষে আমার,এশার ও মাহিনের একাউন্টে নির্ধারিত টাকা জমা দিলাম। কন্টিনিউ না করলে পরে ঘাপলা লেগে যাবে।

এহসানের কাছে কোন অতিরিক্ত টাকা নেই আমি জানি। যা ছিল মানিব্যাগে। তা এই কয়দিনে শেষ হয়ে গিয়েছে বাইরে চা,সিগারেট,নাস্তা খেয়েই। আর থাকলেই বা কি। আমার চাইনা তার টাকাকড়ি।

আমি নারী। কিন্তু সর্বোপরি আমি একজন মানুষ। আমার প্রগাঢ় ব্যক্তিত্ব রয়েছে। মজবুত আত্মসম্মান রয়েছে।
আমার অবশ হাত পা চলেনা। তাই সকাল সন্ধ্যা ভালো নাস্তা তৈরি করা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। অল্পস্বল্প করেই বাচ্চাদের জন্য করতাম।

বাদল ভাইকে ফোন দিয়ে দেখা করতে চাইলাম। পরেরদিন ওদের স্কুলের পাশে বাদল ভাই আসল। একটা নিরিবিলি স্থানে পাশাপাশি বসলাম দুজন। আমি টাকার বিষয়টা জানালাম। এবং বললাম বাদল ভাই,

এতটা বছর সংসারের বাইরের দিক অর্থের যোগান সবটুকুই ও করেছে। আমি চারদেয়ালের ভিতর বন্দী থেকে গৃহকার্যগুলো দেখভাল করেছি। এবং ওদের পড়াশোনার বিষয়টাও। এর বাইরে সবকিছুই আমার চেনাজানার বাইরে।

আচমকা বৈশাখী ঝড়ের মত জীবনটা যে কোন দূর্বিপাকে উড়ে গিয়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। তা কে জানত।
আচ্ছা যদি বাসার এক রুমকে পার্লার করি। তাহলেও একা চালানো মুশকিল। বিউটিশিয়ান রাখা লাগবেই। আবার যদি একটা সেলাইর মেশিন কিনি তাও তিন সন্তান, সংসার সামলে যেটুকু সময় পাব তাতে কয়টা ড্রেস আর সেলাই করা যাবে? একজন দক্ষ নারী কর্মী প্রয়োজন।
উমমম.. বলে মাথা চুলকাচ্ছি দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভঙ্গিতে।

বাদল ভাই গাম্ভীর্যপূর্ণ চোখে আমার দিকে চাইলো কিয়ৎক্ষণ। কপালের উপরে উড়ে আসা এলোমেলো চুলগুলোকে কানের পিছনে গুঁজে দিল। ফুঁ দিয়ে আমার ঘাড়ে পিঠে একটু শীতলতা দেওয়ার চেষ্টা করল।

একটু নড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
কি ভাবছেন বাদল ভাই?

” কারো পৌষমাস কারো সর্বনাশ। ”

ঠিক বলছেন। আমার সর্বনাশ। তাদের পৌষমাস। তবে এখন তাদের দুজনের পথ ও সর্বনাশের দিকে।

আচ্ছা তোদের সবার সর্বনাশগুলো আমার পৌষমাস হতে পারেনা শিলা?

ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে অবুঝ দৃষ্টিতে চাইলাম বাদল ভাইয়ের দিকে।

তিনি আমার দিকে তার বলিষ্ঠ হাতখানিকে প্রসারিত করে ধরলেন। উজল নয়নে বলে উঠলেন,
তুই কি একবার আমার কথা ভাবতে পারবি শিলা? আমিতো একেলা। নিঃসঙ্গ!

নিমিষেই আমার দুচোখের পাথর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে গেল বাদলের সজল দুটি আঁখিপানে।

ক্রমশ ঃ ৯