ফেরার কোন পথ নেই পর্ব-১০

0
188

,,, #ফেরার_কোন_পথ_নেই ( ১০)
কলমে #রেহানা_পুতুল
আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। দোনোমোনো করে মুখ লুকানোর চেষ্টায় তৎপর হয়ে উঠলাম। বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলাম। গলার স্বরকে ভারী করে মলিন মুখে বললাম,

আমার কাউকে নিয়ে ভাববার অবকাশটুকুও নেই। এবং কারো একলা জীবনেও #ফেরার_কোন_পথ_নেই।
বাদল ভাই আমার হাত ধরে টান মারলেন চিলের ছোঁ মেরে মাছ ধরার মতন। তার পাশে বসিয়ে নিলেন আবার।

নত মস্তকে ঠায় বসে আছি। উনি আমার হাতের পিঠে মৃদু চাপ দিলেন। আমার দিকে তাকা বলছি শিলা।
শোন,
আমি তোর সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। রেস্পেক্ট করি। এটা জোরের বিষয় নয়। হয়তো পথটা আমার জন্য সুগম বলেই প্রস্তাব রাখলাম। ব্যাস হলে হবে
। না হলে নাই। খাল্লি বাল্লি বলে উনি হোহোহো করে হেসে উঠলেন।

বাদল ভাইয়ের সেই হাসি ছিল একটা সূক্ষ্ম বেদনাবোধের ধূসর প্রলেপে মিশ্রিত। আমরা মানুষ। আমাদের আবেগ আছে,অনুভূতি আছে। তাই ভিতরে ভিতরে আমার সামান্য খারাপ লাগলেও উপর দিয়ে টলে গেলামনা।

উনি ফের বলে উঠলেন,
সাপোজ তোর জামাই তোকে ছেড়ে দিল। তখন আসবি আমার কাছে?

নেভার এভার বাদল ভাই। আমার ভুবনে আমি অন্য কাউকে জড়াতে চাইনা। আমার তিন সন্তান নিয়েই আমার ভালো থাকার সাম্রাজ্য গড়ে তুলব আমি। আজ যদি আমি আপনার কাছে যাই। আমার তিন সন্তানের কাছ থেকে জনমভর ঘৃণা, অবজ্ঞাই উপহার পেতে থাকব। তাহলে ওরা তার বাবা ও মায়ের কোন পার্থক্যই খুঁজে পাবেনা।

আমি আপনার সান্নিধ্য না পেয়ে বাঁচতে পারব। কারণ এটা পাওয়ার আকাঙ্খা আমার কখনোই ছিলনা। কিন্তু আমার তিন সন্তানের কাছে আমি অঢেল ভালোবাসা চাই। যত্ন চাই। সম্মান চাই। দৃষ্টি অন্যদিকে তাক করে আরো বললাম আমার প্রিয় একটি উদ্ধৃতি।

“মানুষ পৃথিবীতে শুধু ভালোবাসার জন্যই বেঁচে থাকেনা। সম্মানের জন্যও বেঁচে থাকে।”

সেই সম্মান হারাতে চাইনা আমি। আমি একজন আদর্শ অনুসরণীয় মা হতে চাই। শ্রেষ্ঠ জননী হতে চাই। নারীর প্রকৃত পরিচয় কিন্তু মার্তৃত্বেই। এই শিক্ষাটা আমি আমার মাকে দেখে শিখেছি। পিতৃহীন আমাদেরকে মা শক্ত হাতে যুদ্ধ করে বড় করেছে তার আদর্শে। মায়েরতো পথ পুরোটাই ফাঁকা ছিল। তবুওতো মা আমাদের ফেলে বা ছেড়ে যায়নি নিজের সুখের কথা ভেবে। মা হতে হয় এমন।। যেন সবাই শ্রদ্ধার নজরে দেখে সেই মাকে।

দয়া করে আর কখনোই আপনি এমন অযাচিত কথা বলে আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবেন না বাদল ভাই।
আপনি আমার পাশের বাড়ির বাদল ভাই। সারাজীবন আপনি আমার প্রিয় বাদল ভাই হয়েই থাকুন না। আমার জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃসময়ে আপনাকে পেয়েছি আলোকশিখার মতো। স্বার্থের পৃথিবীতে যেখানে প্রিয় মানুষেরাই অপ্রিয়র মত কাজ করে। সেখানে আপনার ও আমার ভাসুর থেকে যতটুকু যা পেয়েছি। তা চিরটাকাল আমি মাথায় তুলে রাখল। আপনাকে আমি পছন্দ করি। আজকাল খুউব ভালোওলাগে। কিন্তু তা একটা সীমা পর্যন্তই। সেই সীমা যেন অসীমে না পৌঁছায়। সেই প্রার্থনাই বরং করুন আমার জন্য।

আমি আর কিছু বলতে পারলামনা। বুকটা ভার হয়ে গলা ধরে এলো। বাদল ভাই নয়ন ভরা মুগ্ধতা নিয়ে আমার কথাগুলো শুনলেন অনুরাগী হয়ে।

বললেন,
তুই শান্ত হ শিলা। আমি তোকে ছিনিয়ে নিচ্ছিনা তোর তিন সন্তানের বুক খালি করে। আমি এটা কোনদিন করবনা। যেদিন তোকে প্রথম দেখলাম পথের মাঝে। সেদিন হতেই তোর মাঝে আমি কেবল একটি সত্তাই অবলোকন করেছি। তা হলো মাতৃসত্তা। না দেখেছি স্ত্রী সত্তা না প্রেমিকা সত্তা। এবং তোর মাঝে দেখেছি কেবল সন্তানদের জন্য এক ত্যাগী মায়ের সংগ্রামী মনোভাব। যে কিনা জীবনযুদ্ধে হার না মানার দৃঢ় প্রত্যয়ে প্রতিমুহূর্তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় নিজের কাছে। যে আমাদের মরচে পড়া ক্ষয়ে আসা সমাজকে বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দিতে চায়,নারীও মানুষ। একবিংশ শতাব্দীতে এসে নারীরা আর ধসে পড়বেনা পলেস্তরার মতন। সত্যিই তুই আমাদের রসুলপুর গ্রামের গর্ব। তুই নারী জাতির প্রতিকৃতি।

বাদল ভাই হাস্যোজ্জ্বলভাবে পরিতৃপ্তির দম ছাড়লেন।

বাদল ভাই অপার খুশি হলাম আপনার কথাগুলো শুনে। হৃদয়টা জুড়িয়ে গেল। এই না হলো আমার সেই বাদল ভাই।
আমি আলতো হাসলাম। আমার হাসির সারথী হলেন বাদল ভাই নিজেও। কিছুসময় ধরে বিরাজমান থাকা গুমোট পরিবেশ এবার হালকা হয়ে এলো তুলোর মতন। উনার মন রক্ষার্থে সামান্য কিছু খেতে হলো। উনাকে বিদায় দিয়ে বাচ্চাদের স্কুল থেকে নিয়ে বাসায় ফিরলাম।

কলিংবেল না চাপতেই ভেতর হতে এহসানের গলার আওয়াজ কর্ণগোচর হলো। সিঁড়িতে আমার পিছনে দাঁড়িয়েই মাহিন ও আয়রা আমার সস্তা মোবাইল সেটে সাপলুডু খেলায় ব্যস্ত৷ আমি দরজায় কান পেতে রইলাম শোনার জন্য আগ্রহান্বিত হয়ে।

” মিতা শোন। কান্না করনা। প্রেমকে সার্থক করার জন্য কম চেষ্টা করনি। তুমি বলছ প্রেগন্যান্ট। আমিও বিলিভ করছি। ভাবছি এটা শুনলে শিলা রাজী হবে তোমাকে মেনে নিতে। আবার বলছ মিসক্যারেজ হয়েছে। আজ বলছ ওসব মিথ্যে ছিল।

ওখানে তোমার ছেলেদের চোখেও বিষকাঁটা হয়েছ। যেহেতু তোমার ওই সংসারে থাকাটা অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছে৷ তাহলে তোমার সাইড গুছিয়ে নাও আস্তে আস্তে। আমি পরিচিত উকিলের সাথে কথা বলে ভুয়া কাগজপত্র রেডি করতেছি। শিলা ও ভাইকে বলব ছেড়ে দিয়েছি তোমাকে। আর ভাইয়ের দোকান আমিও করবনা। আমার ভাগের জমি বিক্রি করে ফেলব। সেই টাকা দিয়ে আলাদা ব্যবসা করব। ব্যবসাতো আমি জানিই। সমস্যা কি। এখান থেকে সব মালামাল নিয়ে যাব। তোমাকে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকব। তবে বাচ্চাদের সব খরচ দিব।

শিলার খরচ দিবনা। পাজী মেয়েলোক সে। নিজের স্বভাবেই সব হারাবে। নয়তো কি সুন্দর তোমার সাথে মিলেমিশে থাকতে পারত।

মনে মনে বলছি,
” যার আস্ত মানুষটাই হারিয়ে গিয়েছে জীবন থেকে। তার আবার কিসের হারানোর ভয়।”

মাহিনের চড়া কাশির শব্দে ভিতরে তার বাবার কথাবলা বন্ধ হয়ে গেল। দরজা খুলে দিল। চলে গেল বারান্দার দিকে।

আমি পুঞ্জীভূত ঘৃণা নিয়ে তার পিছনে পলক মেরে চাইলাম। অর্ন্তদহনে অন্তরটা ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে। রুমে গিয়ে অন্তসারশূন্য হয়ে বসে পড়লাম।

মনে মনে তার উদ্দেশ্যে বলছি,
তাহলে এই কাহিনী নাহ? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা। নতুন সংসার পাতবি। নাহ? জা’লি’ম, নর পি’ শা’ চ কোথাকার। আমি ক্ষিপ্তহস্তে স্টিলের আলমারির ড্রয়ার খুলে ফেললাম। দেখলাম আমার গয়নাগুলো অক্ষত রয়েছে। তালা দিয়ে সচেতনভাবে চাবি মেরে দিলাম। বাংলায় রেহানা পুতুল সার্চ করে যুক্ত হয়ে নিন গল্প সবার আগে পেতে। এর মতো নিমক হারামিদের বিশ্বাস নেই। ও যেখানে একজন মানুষের সমস্ত বিশ্বাসের দেয়াল ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে পারে। সেখানে সামান্য গহনা চুরি করতেই পারে নিজেদের স্বার্থে।

আমি বাচ্চাদের খাইয়ে দিলাম। রুমের দরজা বন্ধ করে আমার ভাসুর একরাম ভাইকে সব জানালাম। উনি ছ্যাত করে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন,
কাল ওদের স্কুলে দিয়ে দোকানের সামনে এসো। প্রয়োজন আছে।

পরেরদিন উনার কথামতো দোকানের সামনে গেলাম। উনি দোকান খুললে আমি ড্র‍য়ার থেকে নিউ সেই মোবাইল সেটটি নিয়ে নিলাম। একরাম ভাই মোবাইলের বিষয় জানতে চাইলে তাও বললাম। আদেশপূর্ণ কন্ঠে বলল, তোমার মোবাইল ও ভেঙ্গে ফেলেছে। এটা তুমি নিয়ে নাও। আমি গাইঁগুই শুরু করলে উনি কড়া চোখে আমার দিকে চাইলেন।

বললেন,
তুমি এই সেট ইউজ করবে এখন থেকে। এটা তোমার প্রাপ্য। কিছু প্রাপ্য নিজ থেকে আদায় করে নিতে হয়। কেউ সেধে দিয়ে যাবেনা তোমাকে। আর সে তার ভাগের সম্পত্তি বেচে দিলে দিবে। তবে ওর সাথে আমাদের সবার সারাজীবনের জন্য সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটবে। ধর্মীয়মতে যেহেতু বিধান রয়েছে দ্বিতীয় বিয়ে করার। তাই সেখানে কিছুই করতে পারবনা আমরা কেউই। এর বাইরে যতভাবে যা করণীয় ওকে শাস্তি দেওয়ার। অবশ্যই দিচ্ছি এবং দিব।

” নিজের বিবেক হলো মানুষের সবচেয়ে বড় আদালত। সেই আদালতে একদিন না একদিন মানুষ হেরে যাবেই।”

তখন তার একমাত্র সম্বল হবে পাহাড়সম অনুশোচনা ও অনুতাপ। তখন চাইলেও আগের সেই শান্তিময় জীবনে ফেরার কোন পথ থাকেনা তার।

আমি নিরব থেকে একরাম ভাইয়ের কথায় সহমত প্রকাশ করলাম।
উনি আরও বললেন, এখন গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো,
তোমাকে যে জন্য ঢেকেছি। এই দোকান আর তাকে দিবনা। তার মাল সে নিয়ে যাক। এই দোকান আমি ভাড়া দিয়ে দিব।।তুমি চাইলেও এটা করতে পারবেনা। কারণ এখানে অন্য বিজনেস চলবেনা। একই বিজনেস কন্টিনিউ করতে হবে। আর আরেকটা যে দোকান আছে গলির মোড়ে। তুমি চাইলে সেই দোকানে তোমার পছন্দমতো বিজনেস শুরু করতে পার। তোমার বাসা থেকে ততটা দূরেও নয় সেটা।

আমার দুচোখ ভিজে গেল মুহুর্তেই। ছলছল আঁখিতে চেয়ায়ে বসে আছি টেবিলে মাথা এলিয়ে দিয়ে। বুঝলামনা নিয়তি আমার সাথে এত তামাসা করছে কেন। এই সে বেয়াড়া হয়ে কি করল। এই আবার সুপ্রসন্ন হলো।

কি বল? পারবে শিলা?

হুম বলে মাথা তুলে চাইলাম। নিস্তেজ কন্ঠে বললাম,
ইনশাল্লাহ ভাইজান। আপনারা সাথে আছেন যে। এখন সব পারব। পারতেই যে হবে আমাকে।

এইতো নারী সাহসীনি। তাহলে সেই দোকান তাদের ছেড়ে দিতে বলব সামনের মাসেই। তারাও অন্য দোকান খুঁজে নিক এক মাসের ভিতরে। তুমিও মেন্টালি পিপারেশন নিতে থাক পুরোদমে।

দোকানে তালা দিয়ে একরাম ভাই চলে গেলেন। আমিও স্কুলে ওদের আনতে চলে যাই।

কয়েকদিনের মধ্যেই এই নিয়ে মা বোনের সাথে দীর্ঘ আলাপ আলোচনা হলো। তারা সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরামর্শ দিলেন সেলাইর দোকান দেওয়ার জন্য।

বাদল ভাইকে বিষয়টি জানাই। উনি দৌড়ঝাঁপ করে প্রাথমিক অবস্থায় দুজন নারী সেলাইকর্মী ঠিক করল আমার জন্য। সেলাইমেশিন ও কিনে নিল দুটো। উনার সাথে যতটুকু দেখা হয় তাও আমার জরুরী প্রয়োজনেই।

উনি নিজেকে আমার থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন শামুকের অস্তিত্বের ন্যায়। আগের মত আর গা ঘেঁষে কথা বলার চেষ্টা করেন না। হাত, চুল স্পর্শ করার মিথ্যে বাহানা খুঁজেন না। এতে আমিও বেশ স্বস্তি পেলাম।

একমাস প্রায় শেষ। এহসান আলাদা দোকান দিয়ে ফেলেছে উত্তরাতেই। আলাদা বাসাও নিয়েছে খবর পেলাম। বর্তমান যুগে কোন কিছুর খোঁজ খবর নেওয়া জটিল কিছুই নয়।

এক রাতে আমি তার মুখোমুখি হলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
তুমি না বললে মিতাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে? এখন দেখি আলাদা বাসাই নিয়ে নিলে। তুমি এতটা নীচ কি করে হলে? আগেতো এমন ছিলেনা?

জবাবে সে স্পষ্ট করেই জানাল,
শুধু আলাদা বাসা কেন, তাকে কোলে করে বসে থাকব। তাতে তোর কিরে। দ্বিতীয় বিয়ে করা কিসের নিচুতা? তাহলে বলব তুই নিচু কাজ কি,তা চিনিসইনা। আর আমি আগেও এমন ছিলাম। ও আমার দীর্ঘবছরের ভালোবাসা। শোন ও তোর সিনিয়র। আপনি করে আগেও বলতি। এখনো বলবি। আগের মতই মিতাকে সম্মান করে কথা বলবি।

তার মানে তুমি তাকে ডিভোর্স দিবেনা?

বললামতো না। মিতাকে নয়। ডিভোর্স আমি তোকেই দিব। পীপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে।

আমার মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। আমি স্তম্ভিত! নির্বাক হয়ে কেবল শেষবারের জন্য জ্বলজ্বলে চাহনিতে বহু বছরের প্রিয় মানুষটাকে একবার দেখে নিলাম।

চলবে ঃ১০