বঁধুয়া কেমনে বাঁধিবো হিয়া পর্ব-০৮

0
339

#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — আট

কার্টেসিসহ কপি করা নিষেধ!

শমসের আলমের সাথে কায়ছার সাহেবের পরিচয় নিজেদের বিয়ের দিনই। ভালোবেসে সায়রা করীমকে নিয়ে পালিয়ে আসার পর, নিজ শহরে এসে বন্ধুবান্ধবদের সাক্ষী রেখে এই শমসের কাজীর মাধ্যমেই বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হোন দু’জনে। তখন সালটা ছিল উনিশশো নব্বই। বিয়েটা হয় অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে। অর্থাৎ পনেরো তারিখে। সায়রা করীম তখন আঠারো বছরের তরুণী ও কায়ছার সাহেব পঁচিশ বছরের যুবক। প্রেমের শুরু একটা কোচিং সেন্টারে। কায়ছার সাহেব তখন সুনামগঞ্জের ছাতক শহরে পড়াশোনা করতেন। মেধাবী ছাত্র হওয়ার সুবাদে বেশ কয়েকটা টিউশনি করাতেন ওখানকার ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের। সেই টিউশনির ছাত্রী ছিলেন বেগম সায়রা করীম। বয়সটা নেহাৎ কম ছিল না, কিন্তু প্রেম-ভালোবাসা জীবনে আসলে বয়স কম হোক কি বেশি, ভুল মানুষ করেই। চিঠি আদান-প্রদান ও টুকরো টুকরো আলাপের মাধ্যমে দু’জনের মনেই ভালোবাসার বীজ বপন হতে শুরু করে। সেই থেকে তাদের জীবনেও ভুলের সূচনা ঘটে। তারাও ভুল করেছিলেন। তাদের এই ভুল কায়ছার সাহেবের পরিবারের লোকজন মেনে নিলেও সায়রা করীমের পরিবার সহজে মেয়ের এই ভুল গ্রহণ করতে পারেননি। শ্বশুরবাড়িতে জম্পেশ আয়োজন করে বধূবরণ করা হয়। সায়রা করীমের বাবার বাড়ির আত্মীয় স্বজনকেও দাওয়াত দেয়া হয়। কিন্তু তারা কেউ সেই দাওয়াত গ্রহণ করেননি। উলটে সায়রা করীমের বাবা ফজলে করীম চিঠি পাঠিয়ে কায়ছার সাহেবের বাবা-মাকে বলেছিলেন,

-‘আপনারা যেহেতু তাকে গ্রহণ করেছেন, তখন আজ থেকে সে আপনাদের মেয়ে হয়েই থাকুক। আমার বাড়িতে ও’কে আর পাঠাবেন না। এই বাড়ির দরজা ওর জন্য বন্ধ ঘোষণা করলাম।’

শমসের কাজী তখন পেটের দায়ে শহরের একটা কোণে কাজী অফিস খোলে বসেন। খুব একটা পরিচিতি না থাকলেও ধীরে ধীরে এই প্রফেশনে তিনি মানিয়ে নেন। তার এখানে বেশিরভাগই পালিয়ে আসা প্রেমিক-প্রেমিকার বিয়েশাদী হয়। লোকমুখে প্রচলিত নাম এই শমসের কাজীর বয়স এখন ষাটের অধীক। কিন্তু তবুও এই প্রফেশন তিনি ছাড়তে পারেননি। বিয়ের পর স্বামীর সংসারে পর্যাপ্ত সাপোর্ট পান সায়রা করীম। সংসারে মনোযোগ দেয়ার পাশাপাশি পড়াশোনার দিকটাও যথেষ্ট যত্ন নিয়ে সামলে ওঠেন তিনি। গ্রাজুয়েশন শেষ করে পুরোদস্তুর সংসারী হয়ে যান। স্বামী, সংসার, সন্তান, সবই হয়ে উঠে তার আপন। দুটো মানুষ শক্ত হাতে যে সম্পর্ককে পর্যাপ্ত যত্ন, ভালোবাসা, ভরসা, বিশ্বাস দিয়ে আগলে রেখেছিলেন, সেই সম্পর্কে কেন এমন দুর্দিন নেমে এলো আজও তা ভেবে পান না হায়দার সাহেব।

শমসের কাজীর সামনে বসে ভাই-ভাবীর সম্পর্কের শুরু থেকে শেষ অবধি ভেবে যাচ্ছিলেন তিনি। মাহদিয়াও পাশের চেয়ারে বসে কাজী সাহেবের সাথে প্রাথমিক আলাপ শেষ করেছে। তিনি মাহদিয়াকে প্রথমে না চিনলেও হায়দার সাহেবের কথা শোনে, স্মৃতির পাতা ঘেটে খুঁজে বের করেছেন ছোট্ট মাহদিয়া ও শাদাবের বিয়ের সময়টুকু। ম্যারেজ সার্টিফিকেটটা খুঁজতে খুঁজতে না পেয়ে একসময় খাতাপত্র চেক করে দেখলেন, বহু বছর আগে সায়রা করীম কোনো এক সময়ে এসে ম্যারেজ সার্টিফিকেট তুলে নিয়েছিলেন। এত বছর পর, এসবের খোঁজ করতে এসে হায়দার সাহেব যারপরনাই অবাক হলেন। হতাশও হলেন। সায়রা করীম এখানে এসে ম্যারেজ সার্টিফিকেট তুলে নিয়েছেন, অথচ বাড়িতে যাননি! কতটা মনঃকষ্ট নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন কে জানে! বিশ্বস্ত মানুষগুলো বিশ্বাস ভেঙে দিলে, মানুষ মৃতপ্রায় হয়ে যায়। তার অবস্থাও হয়তো সেরকমই। দুটো মানুষকে অসহায় মুখে বসে থাকতে দেখে শমসের কাজী হায়দার সাহেবকে বললেন,

-‘আমি সেদিন ভেবেছি, তিনি আপনাদের হয়েই সার্টিফিকেট নিতে এসেছেন। তাই আর এত কথা জিজ্ঞেস করিনি। বাড়ির কারও কথা জানতেও চাইনি।’

অনেকক্ষণ নীরব থেকে মুখ খুলল মাহদিয়া। বলল,
-‘আন্টি কি সেদিন একা এসেছিলেন? সঙ্গে কেউ আসেনি?’

-‘একাই ছিলেন উনি।’

-‘ফোন নম্বর, ঠিকানা কোনোকিছু রেখে যাননি?’

-‘ওসব কি আমার রাখার কথা মা? আমি তো কায়ছারের নম্বর জানি। আর কারও নম্বর রাখার প্রয়োজন মনে করিনি।’

ব্যাপারটা স্বাভাবিক। যার সাথে পরিচয়, আলাপ, মানুষ তারই নম্বর রাখবে। তিনি তো আর জানতেন না, সায়রা করীম সংসারে ভাঙনের পর ম্যারেজ সার্টিফিকেট নিতে কাজী অফিসে উপস্থিত হবেন। এখন আর এসব ঘেটে লাভ নেই। মাহদিয়ার সিদ্ধান্ত শোনতে বলতেন,

-‘এখন তুমি কী চাইছ? সার্টিফিকেট দিয়ে কী করবে?’

সেই সময়ের বিয়ে নিয়ে তখন কোনো প্রভাব মনে না পড়লেও জীবন এগোনোর সাথে সাথে মাহদিয়া সেই ছোট্ট সিগনেচার ও একটা শব্দকে ঘিরে ওঠা সম্পর্কের মূল্য বুঝতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কত চেনা-পরিচিত ইমাম, শিক্ষিত মানুষ ও কত উচ্চ ডিগ্রীধারী ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে এই সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছে। বিয়েটা বৈধ, শরীয়তসম্মত হলো কি-না সেই নিয়েই মনের ভেতর দ্বিধাদ্বন্দের দেয়াল তৈরী হয়েছিল। সেই দেয়ালটা এখনও ভেঙে ফেলতে পারেনি। উলটে অতীত স্মৃতি মনে পড়লেই মন বলে উঠে, ভুল। সব ভুল। তবে একটা দিক সে কখনওই অস্বীকার করার চেষ্টা করেনি। যতবার সে অন্য পুরুষ অথবা মানুষের সামনে নিজেকে ‘এ্যানগেজড’ বলে দাবী করেছে, ততবারই মন হালকা হয়ে গেছে। সম্পর্কটাকে বোঝা কিংবা ভুল মনে না হলেও, এটা সে বুঝতে পারে, নিজেকে ‘এ্যানগেজড’ দাবী করতে পারলে কোথা থেকে যেন সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা জেগে উঠে। তখন মনে হয়, ভুল হলেও ওই সম্পর্কে একটা টান আছে। এই টানটাই সে শত চাইলেও অস্বীকার করতে পারে না।

সম্পর্ক নিয়ে সিদ্ধান্ত সে তখনই নিবে, যখন শাদাবকে সে খুঁজে পাবে। এই মুহূর্তে এসব দিকে টার্ন করার আগ্রহ তার নেই। তাই কিছুটা উশখুশ মেজাজে কাজী সাহেবকে বলল,

-‘বিয়েটা তো আপনি পড়িয়েছিলেন। ওই বিয়েটা কি বৈধ হয়েছিল? আমরা দু’জনই কিন্তু অবুঝ ছিলাম তখন। যদি এর থেকে মুক্তি নিতে চাই, সেটা কি সম্ভব হবে?’

শমসের কাজী হাসলেন। সেদিন তিনি এই বিষয় নিয়ে কায়ছার সাহেবের সাথেও আলোচনা করেছেন। কায়ছার সাহেব তাকে নিশ্চিত করেছিলেন, দু’জনের কাউকেই সংসার বিষয়ক বাড়তি চাপ, শারিরীক, মানসিক কোনো অতিরিক্ত দায়দাবী ঢেলে দেয়া হবে না। কেবল, দুটো মানুষকে যেন পূণরায় এক করতে পারেন, সেই কারণেই অল্প বয়সকে তুচ্ছ করে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া। এর ভিত্তিতেই অবুঝ দুটো মানুষকে একই সুতোয় বেঁধে দেয়ার দায়িত্ব কাঁধে নেন তিনি। মাহদিয়া যে এখনও ওই সম্পর্ক নিয়ে মনে সংশয় জমিয়ে রেখেছে সেটাই তাকে বিস্মিত করল। তিনি তাকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে বললেন,

-‘বিয়ের দিন কেউ তোমাকে জোর করেছিল?’

স্মৃতির পাতায় সেইসব দিনকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করল মাহদিয়া। প্রথমে বিয়েতে সে রাজি ছিল না। পরবর্তীতে শায়লা সুলতানা ও কায়ছার সাহেব তাকে বুঝান। শুধু ওই বাড়ির একজন মানুষ হিসেবে তাকে গ্রহণ করে নিতেই বিয়ের আয়োজন করেছেন। সে প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো ওই বিয়ের মাধ্যমে তাকে বাংলাদেশে আটকে রাখবেন সবাই। তার মা চলে যাবেন ইতালি। অবুঝ মনে ভয়, আতঙ্ক ঝেঁকে বসেছিল। সেই কারণে সে বিয়েতেও রাজী হতে চায়নি। কিন্তু তিনজন মানুষের অনুরোধ ও বুঝানোর ফলে সে আর কোনো আপত্তি দেখাতে পারেনি। ওইটুকু মন, বিয়ে, সংসার, এসব কি বুঝেনি! মাথাও ঘামায়নি। সম্পর্ক জোড়া না লাগলে যে বিচ্ছেদ টানতে হয়, এ-ও বুঝত না। সে পড়তে পারবে, বিদেশ ঘুরতে পারবে, নিজের ব্যাপারে যা খুশি সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, এইসব সুযোগ-সুবিধার কথা উঠায় রাজী হওয়া ছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না তার। নির্ভয়ে ‘কবুল’ বলেছিল। তখন পুরো বিষয়টা তার কাছে পুতুল পুতুল খেলাই মনে হয়েছিল। মনে হয়নি, জীবনের একটা বিশেষ সিদ্ধান্ত ছিল ওটা। এখন যখন বুঝতে পারে, বড্ড আফসোস হয়। নিজের ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে দুঃশ্চিন্তা শুরু হয়। কী উপায় হবে, সেই নিয়ে মন সারাক্ষণ দোটানায় ভোগে। অথচ কোনো সমাধান মিলে না। কেউ তাকে জোর করেনি, কিন্তু তাকে যা যা বলা হয়েছে সবটা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতেই মাহদিয়া বলল,

-‘এমন না যে, আমাকে ধরেবেঁধে রাজী করানো হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, এটা শুধু কাগজ হয়েই থাকবে। বড়ো হয়ে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, যদি কোনোদিন দেশে ফিরি তবেই এই সম্পর্কটাকে পূণরায় পাকাপোক্ত করা হবে।’

-‘দ্যাখো, তুমি তখন নাবালিকা ছিলে ঠিকই কিন্তু শাদাব সাবালক ছিল। বয়সটা আইনী ঝামেলা হলেও শরীয়তমতে বিয়েটা বৈধ হয়েছে। যেহেতু কোনো জোরাজুরি ছিল না, শাদাবও যথেষ্ট উপযুক্ত ছিল, বিয়ের বয়স না হলেও সে অবুঝ ছিল না, তোমার গার্ডিয়ানও উপস্থিত ছিলেন, তোমার ওপর কোনোপ্রকার শারিরীক নির্যাতনও হয়নি, সেক্ষেত্রে এটা এখন অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে তুমি চাইলে, বিচ্ছেদ টানতেই পারো। একজন উপযুক্ত মেয়ে, বড়ো হওয়ার পর তার জীবনের সিদ্ধান্ত সে নিজেই নিতে পারে। দেশীয় আইনে তা স্বীকৃত। আবার ইসলামেও জোরাজুরি করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাই তুমি চাইলে অল্প বয়সের এই বিয়ে নামক নামমাত্র সম্পর্ক থেকে মুক্তি নিতেই পারো। তারজন্য তোমাদের দু’জনকে মিলে সিদ্ধান্ত নিতে নিবে। তোমার একার সিদ্ধান্ত কিংবা সিগনেচারে বিচ্ছেদটা সম্ভব নয় মা।’

সবকিছু বুঝে, ভেবে মাহদিয়া বলল,
-‘এখুনি তাড়াহুড়োর দরকার নেই। আমি শাদাবের সাথে আগে যোগাযোগ করি, তারপর সিদ্ধান্ত নিব।’

***

বাড়ি ফিরে অবাক হলো মাহদিয়া। দু’দিন যেতে না যেতেই শায়লা সুলতানা গ্রাম থেকে চলে এসেছেন। আবার একজন লইয়্যারকে সাথে নিয়ে কায়ছার সাহেবের সাথে কীসব আলোচনা করছেন। কাজী অফিস থেকে ফিরে দু’জনেই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। ড্রয়িংরুমের এই ঝামেলাটাকে ফেইস করার ইচ্ছে হলো না কারও। কিন্তু এড়িয়ে যেতেও পারলেন না। দু’পা এগোতেই শায়লা সুলতানা দু’জনকে ডাক দিয়ে পাশে গিয়ে বসতে বললেন। মেয়ের মাথায় ব্যান্ড-এইড দেখে আহ্লাদী কণ্ঠে বললেন,

-‘অসুস্থ শরীর নিয়ে বাইরে না গেলেই হচ্ছিল না?’

মাহদিয়া হাসিমুখে বলল,
-‘আমার কাছে নিজের অসুস্থতা এতটাও গুরুত্বপূর্ণ নয় মা, যতটা গুরুত্বপূর্ণ ওই দুটো মানুষ।’

শায়লা সুলতানার মুখে আঁধার নেমে এলো। সামান্য একটা সাইন, ছোট্ট একটা কাগজ, নামহীন, ভিত্তিহীন এক সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের মানুষ! মাহদিয়া এখন এসব নিয়েই ব্যস্ত। অথচ মেয়েটা চাইলেই পারত, ইতালির একজন প্রতিষ্ঠিত ছেলেকে বিয়ে করে সংসার করতে। মানুষ তো এইভাবেই সংসার করছে। প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে কত অন্যায় করছে। নিজের মেয়েটার এই বোকা বোকা কাজ তার ভালো লাগছে না। জোর করে টেনে নিয়ে যেতে পারবেন না। মেয়েটা এখন উপযুক্ত। আগে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বিয়ে দিতে পারলেও এখন আর ভুলিয়ে-ভালিয়ে সেসব কিছুই করতে পারবেন না। এই মেয়ে বাপের চেয়ে একখাঁটি উপরে। বিচার, বিবেচনা ও সততার দিক দিয়ে সবসময় নিজের সিদ্ধান্ত ও মনের ডাককেই প্রাধান্য দেয় বেশি। তখন সেখানে মায়ের ছোটোখাটো একটা সিদ্ধান্তও ধাক্কা খেয়ে দূরে সিটকে পড়ে। এই কারণে মেয়ের মুখের ওপর চোটপাট করতে ভয় পান তিনি। এই বয়সে এসে আইনী ঝামেলায় ফাঁসতে কার মন চাইবে? এজন্য, যত পারেন এড়িয়ে চলেন। শোনেও না শোনার ভান ধরে বসে থাকেন। বোঝেও অবুঝ সাজেন। যেন এসব বিষয় নিয়ে মাথায় কোনো ব্যথাই নেই তার। অথচ একদিন তিনি-ই চাইছিলেন, শাদাবের সাথে মাহদিয়ার বিয়ে দিয়ে মেয়েকে এই ঘরে পার্মানেন্ট করতে। এখন চান উলটো। কোনোমতে সম্পর্কে ভাঙন আসলেই শান্তি পাবেন তিনি।

মাহদিয়ার কথা ও সিদ্ধান্ত সবসময়ই স্পষ্ট। তাতে বাঁধ সাধলেও সে শুনবে না, মানবে না। যা মনে হবে, সেটাই করবে। তার কাছে এখন সায়রা করীম ও শাদাব গুরুত্বপূর্ণ। তাদেরকে না পেয়ে থামবে না এই মেয়ে। জোর করে থামানোও যাবে না। অযথা বকাবকি না করে, যা করণীয় এখন সেটাই করতে চাইলেন। তাদের পরিচিত উকিলকে দেখিয়ে বললেন,

-‘ইনি তোর বাবা-চাচাদের পরিচিত। গ্রামের বাড়ির সব সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়ে গেছে। তোর চাচারা তোর ভাগের অংশটুকু আলাদা রেখে দিয়েছিলেন। তুই সাইন করে নিজের সম্পত্তি বুঝে নিতে পারিস এখন।’

মাহদিয়া উপস্থিত থাকা সেই লইয়্যারকে সালাম দিল। ইতালি থাকতে খেয়াল করেছিল, এই লোকটা তার বাবার সাথে কথা বলেন। বাবার পরিচিত এই বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। স্থিরচোখে কাগজপত্র দেখে সই করে ঝটপট উঠে দাঁড়াল। বলল,

-‘এসব ঝামেলার কী দরকার ছিল?’

-‘ঝামেলা বলছিস কেন? তুই তোর বাবার একমাত্র মেয়ে। তার ভাগটুকু তো তোরই। নিজের সম্পদ নিজে গ্রহণ করবি। এতে আবার ঝামেলা কী?’

মুখ দিয়ে শুধু ‘অযথা’ শব্দটাই বের করল মাহদিয়া। চলে যেতে চাইল, কিন্তু কায়ছার সাহেব তাকে থামালেন। লইয়্যারের সাথে কথা বলে বাড়তি আরও কিছু কাগজ বের করে মাহদিয়ার হাতে তুলে দিলেন। বললেন,

-‘এটা টোটোনের অংশ। এর মালিকানা এখন তোমার হাতে। যেহেতু টোটোন নেই, এই সম্পত্তির ভাগিদার তুমি।’

কায়ছার সাহেবের কথাটা হজম হলো না মাহদিয়ার। কানে বাজল, ‘টোটোন নেই।’ নেই মানে কী? ঘরে নেই, শহরে নেই, নাকি পৃথিবীতে নেই? বাবা হয়ে নিজের ছেলেকে এতদ্রুত নেই বলে চালিয়ে দিতে পারলেন? বুকে বিঁধল না? মুখে আটকাল না? এ কেমন বাবা? নিজের সন্তানের জন্য টান নেই, মায়া নেই, ভালোবাসা নেই। অথচ অন্যকে নিয়ে দুঃশ্চিতার শেষ নেই। আজব! এমন মানুষেরা ঠিক কীসের তৈরী ভেবে পায় না মাহদিয়া। সে আলগোছে কাগজটা এনে চোখ বুলায়। পড়তে পড়তে খেয়াল করে, কায়ছার সাহেব শাদাবকে মৃত বলেই ধরে নিয়ে এই দলিল তৈরী করেছেন! আশ্চর্য হওয়ার বদলে রেগে গেল সে। দু’হাতের টানে কাগজটা ছিঁড়ে কয়েক টুকরো করে কায়ছার সাহেবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলল,

-‘ও বেঁচে আছে। আমার মন বলছে, একদিন আমি শাদাবকে খুঁজে পাবই। যেদিন ও’কে পাব, তোমার এই ভালোমানুষীর মুখোশটা আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলব। আই সোয়্যার মামা, যে অন্যায় তুমি ওর সাথে করেছ, সেই অন্যায় ও সম্মানের সস্তা অহমিকাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেব। শুধু অপেক্ষা কোরো। একটু অপেক্ষা।’

কথা শেষ হওয়া মাত্রই তার গালের ওপর ঠাস করে আওয়াজ হলো। মাহদিয়া চোখ বন্ধ করে আবার খুলে নিজের মায়ের দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল। বলল,

-‘মারলে কেন? ভুল কিছু বলেছি? তুমি জানো, এই লোকটা একটা স্বার্থপর? শুধু নিজের সম্মানের কথা ভেবে, স্ত্রী-সন্তানদের ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে! এখন আবার সন্তানকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে, তাকে মৃত বানিয়ে ফেলেছে। এমন মানুষের জন্য তুমি আমার গায়ে হাত তুললে মা?’

মেয়ের কথা আমলেই নিলেন না শায়লা সুলতানা। কণ্ঠে রাগ ও দাম্ভিকতা বজায় রেখে বললেন,
-‘তোকে মানুষ বানিয়েছি। অমানুষ নোস তুই। বড়োদেরকে একটু সম্মান দিয়ে কথা বল। এই সম্পত্তি তুই চাস না। আমিও চাই না। আমি ভাইজানকে বাড়ন করেছি। কিন্তু উনি তোর কথা ভেবে, তোকে এই ঘরের একজন মেনে, দলিল তৈরী করেছেন। পুরো ব্যাপারটা বুঝে মাথা গরম করতি।’

-‘আমার মাথা গরম হয়নি। যথেষ্ট ঠাণ্ডা আছে। আমি যা সিদ্ধান্ত নিই, ভেবে নিই। উনি যদি মনে করেন, শাদাব মৃত। তাহলে এটাও ধরে নিতে বোলো, আজ থেকে ওনার কাছে আমিও মৃত। সম্পত্তি দিয়ে উনি অধিকারের সীমা-পরিসীমা দ্যাখাতে চান? যদি তা-ই হয়, তবে আগে নিজের স্ত্রী-সন্তানদের খুঁজে আনতে বোলো মা। তারপর পুত্রবধূকে অধিকার দেয়ার মতো দুঃসাহস দ্যাখাতে বোলো। তার আগে নয়, ওকে? এই দিয়ার কোনো সম্পত্তি চাই না, শুধু মানুষ দুটোকে চাই। পারলে এনে দাও, না পারলে আমার চেষ্টা দ্যাখে যাও, মাঝপথে আমাকে আটকানোর মতো বাড়াবাড়ি রকমের সাহস দ্যাখাতে এসো না কেউ।’

ধুপধাপ পা ফেলে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেল মাহদিয়া। তাকে থামলে চলবে না। দৌড়াতে হবে। খুঁজে পেতেই হবে দুটো মানুষকে। কোথায় আছে তারা কে জানে! মেয়ের এই রাগ, এই রূপ, আজই প্রথম দেখলেন শায়লা সুলতানা। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। মেয়ে তাকে অপমান করল! দুটো মানুষের জন্য নিজের মাকে কথা শুনাল! এই শিক্ষা দিয়েছেন তিনি মেয়েকে? ছিঃ ছিঃ। লজ্জায় যে মুখ লুকাতে ইচ্ছে করছে তার। তিনি কায়ছার সাহেবের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে বললেন,

-‘ওসব বাদ দিন ভাইজান। আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম, এসবের দরকার নেই। আপনি শুনলেন না। অযথা একটা সিনক্রিয়েট হলো। মেয়েটাকে দেশে নিয়ে আসাটাই ভুল হয়েছে আমার।’

হায়দার সাহেব শুধু হাসলেন। সেদিন দুটো মানুষের সাথে অন্যায় করে পার পেয়ে গেছিলেন তার ভাই। আজ আর পারলেন না। ছলেবলে কৌশলেও মাহদিয়াকে বুঝাতে পারলেন না, শাদাবকে তিনি এতদিনে মন থেকে মুছে ফেলেছেন। তাই তার ভাগের অংশটুকু, দ্বিতীয়জনকে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেসব তো আর হবে না। মাহদিয়া যে এসবের দিকে ফিরেও তাকাবে না, তিনি এবার নিশ্চিত। সবাইকে চিন্তিত রেখে তিনিও নিজের রুমের দিকে এগোলেন। ভাইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে শুধু বলে গেলেন,

-‘কোনো সম্পর্ক এতটাও মূল্যহীন নয় ভাইজান, যতটা মূল্যহীন তুমি ভাব। পৃথিবীতে সব সম্পর্কই মূল্যবান। শুধু তার মূল্য বুঝে, কদর বুঝে, গুরুত্ব বুঝে তাকে মূল্যায়ন করতে হয়। এসব কিন্তু, সবাইকে দিয়ে হয় না। সবাই সব সম্পর্ককে মূল্য দিতে জানে না। কেউ কেউ আছে তোমার মতো, যাদের কাছে সম্পর্কের চেয়ে সম্মানটা বড়ো হয়ে যায়। বাঁচাও, তুমি তোমার সম্মানকেই বাঁচাও। এই করে করে, জীবন তো শেষ কিনারায় গিয়ে থামবেই একদিন।’

***

শিহাবের বাঁদরামির সাথে পেরে উঠছে না নায়রা। এসেছিল, নিজের খালামনিকে দেখতে। এই ছেলে সুযোগ পেয়ে তাকে এখন দাবার গুটি বানিয়ে ছেড়েছে। খেতে বসলে জ্বালাচ্ছে, ঘুমোতে গেলে জ্বালাচ্ছে, টিভি দেখতে গেলেও জ্বালাচ্ছে। তার একটাই গান, ‘ভাইয়া ব্যস্ত, তুমি আর আমি মিলে ঘুরতে যাই চলো।’ কিন্তু নায়রা এই কথা মানতে নারাজ। তার পরীক্ষা এখনও শেষ হয়নি। আরও কয়েকটা বাকি আছে। আগামী দু’দিন গ্যাপ থাকায়, পড়াশোনাতে ফাঁকি দেয়ার মতো একটা অজুহাত পেয়ে যাওয়াতে ছুটে চলে এসেছে এই বাসায়। ইভানাকেও আসতে বলেছিল। কিন্তু নাবহান, ভার্সিটি থেকে ফিরে বউকে বাসায় না পেলেই ক্ষ্যাপে যাবে। তার মতে, ‘ঘুরতে যাওয়ার হলে যাও, কিন্তু আমি বাসায় আসার পর।’ এমন আদুরে হুকুম ও আদেশের কাছে ইভানা বরাবরই নেতিয়ে যাওয়া মেয়ে। সে স্বামীকে হাসিখুশি দেখলেই সারাদিন নির্ভার থাকতে পারে। এজন্য তাকে মূল্য দিতে গিয়ে, মাঝেমধ্যে নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছেকে খুব গোপনে ত্যাগ করে সে। যে আগলে রাখছে, যত্নে রাখছে, তাকে মূল্য না দিলে বড্ড পাপ হবে। ইভানা সেইসব পাপে পা ডুবাতে চায় না। একটা স্বচ্ছ, সুন্দর, পরিচ্ছন্ন সংসার চায়। তার সেই সংসারে খুঁনসুটি, রাগ, অভিমানেরা মিশে থাকুক। কভু মূল্যহীনতার গন্ধ তাদের স্পর্শ না করুক।

এতসব কথা ও যুক্তির জন্য, ইভানাকে কোথাও টেনে আনতে পারে না নায়রা। যার কারণে, ঘুরতে গেলেও মাঝেমধ্যে তাকে একাই ঘুরতে হয়। কখনও কখনও বন্ধুবান্ধবরা সঙ্গী হয়, আবার কখনও কখনও শিহাবও তাকে সঙ্গ দেয়। সুযোগ পেয়ে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে শিহাব তাকেই ঠ্যালাঠুলি শুরু করল আজকে। সে-ও পাত্তা না দেয়ার মতো এড়িয়ে গেল সবদিক। শুধু খাওয়ার বেলা গাল ফুলানো ভাইকে আদর দিয়ে বুঝিয়ে বলল,

-‘তুই চিন্তা করিস না। তোর ট্যুর হবে। আমাকে একটু সময় নিয়ে ভাবতে দে। আমি ভাইয়াকে ম্যানেজ করে নেব।’

শিহাব জানে, শাদাবকে ম্যানেজ করা কঠিন এখন। তার চারিদিকে ছোটাছুটি। ব্যস্ততা। কোনোমতেই রাজি হবে না। এদিকে তারও সামনে বোর্ড এ্যাক্সাম আসছে। পরীক্ষার আগে যদি ঠিকমতো ট্যুর না হয়, মন-মেজাজ একদম তুঙ্গে উঠে যাবে। তখন বই-খাতা মেলে ধরে রাখলেও পড়া হবে না। বুঝতে পেরেই নায়রাকে নাজেহাল করতে বলল,

-‘যা পারবে না, তা করবার মতো গ্যারান্টি দিও না। ওসব তোমাকে দিয়ে হবে না। এই মুহূর্তে ভাইয়া আমাকে নিয়ে কোথাও ট্যুর দেবে। তার সময় নেই। কেন বুঝো না? তারচেয়ে চলো না, তুমি-আমি যাই।’

নায়রার অবস্থা তখন, ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ ধরনের। কী বলে যে সান্ত্বনা দিবে, ট্যুরে যাওয়ার ভূত মাথা থেকে তাড়াবে ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে গেল সে। তক্ষুনি তার সমস্ত চিন্তার অবসান ঘটিয়ে শাদাবের আগমন ঘটল। ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে ডাইনিংটেবিলের দিকে তাকিয়ে ভাই-বোনকে চিন্তিত অবস্থায় বসে থাকতে দেখে বলল,

-‘কী হয়েছে? দুটোর মাথায় কী চলে?’

শাদাবকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নায়রা। প্লেট থেকে খাবার তুলে শিহাবের মুখে দিয়ে বলল,
-‘ও ট্যুরে যেতে চায়। নিয়ে যাও না প্লিজ। জানোই তো আমার এ্যাক্সাম চলে। আমি এখন গ্যাপ দিতে পারবই না। তোমাকেই ম্যানেজ করতে হবে।’

শিহাব ভাইকে দেখেও দেখল না, এমন মুখ করে খেতে লাগল। ভাইয়ের এই গাল ফুলানো স্বভাবটা বড্ড ভালো লাগে শাদাবের। ফুলানো গালদুটো টেনে দিতে মন চায়। একসময় সে-ও এমন গুলুমুলু ছিল। আর এখন! কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছে। মনে পড়লেই, নিঃশ্বাসটাও তার যন্ত্রণার হয়ে দাঁড়ায়। সে ভাইয়ের অভিমান ভাঙাতে কাছে এলো। শার্টের হাতা গুটিয়ে, টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে মুখ বাড়িয়ে রাখল ভাইয়ের দিকে। বলল,

-‘কেউ কি আমায় খাইয়ে দিবে? প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে।’

শিহাব চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলল,
-‘তোমার হাতে-মুখে ময়লা। যাও। আগে ফ্রেশ হও। তারপর মায়ের হাতে খাও। আর কারও সময় নেই, তোমার মুখে খাবার তুলে দেয়ার।’

-‘তাই?’

-‘হ্যাঁ। তুমি যদি ব্যস্ততার অজুহাত দ্যাখাও, আমরাও দ্যাখাব। আমাদের সময়গুলো কি আর ওত সস্তা না-কি?’

শাদাব মাথা নাড়ল। মাথায় বুদ্ধি আঁটল। অভিমানী কণ্ঠে বলল,
-‘ঠিক আছে দিও না। আমি ভাবছিলাম, কেউ একজনকে সময় দেব। তার পছন্দের জায়গায় গিয়ে ঘুরব, ফিরব, হৈচৈ করব। আগামী শুক্রবার থেকে তিনদিন তার জন্য সমস্ত কাজকর্মের ইস্তফা দেব। কিন্তু কেউ আমাকে পাত্তাই দিবে না। থাক্। তার আর ট্যুরে যেয়ে কাজ নেই। সে ব্যস্ত মানুষ। ব্যস্তই থাক্। আমি বরং নায়রা আর ভাবীকে নিয়েই ঘুরতে যাব।’

শাদাব উঠে দাঁড়াল। শিহাব জিহ্বায় কামড় দিয়ে নায়রার দিকে তাকাল। পরক্ষণেই কথার সারমর্ম ধরতে পেরে ‘এইরে, চান্স মিস হয়ে যাচ্ছে’ বলে ভাইকে ধরেবেঁধে চেয়ারে বসাল। তাড়াহুড়ো করে বলল,

-‘সময় আছে। সময় আছে। আমার অনেক সময় আছে। হাত-মুখ পরিষ্কার করার দরকার নেই। তুমি এমনিতেই বসো। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’

শাদাব গালমুখ ফুলানোর ভাব ধরে রেখে বলল,
-‘না। ক্ষিধে নেই আর। তুমি-ই খাও।’

শিহাব ঝটপট কানে হাত দিয়ে বলল,
-‘স্যরি তো ভাইয়া!’

-‘কেন? তুমি আবার স্যরি বলছ কেন?’

-‘রাগ করছ কেন? বসো এখানে। একসাথে খাই।’

-‘তুমি নিজের হাতে খাওয়াও। তাহলেই বসব।’

শিহাব তখন ভাইয়ের আদরের হয়ে গেল। হাত ধুয়ে নিজেই প্লেট থেকে ভাত মেখে একটু একটু করে ভাইয়ের মুখে তুলে দিল। শাদাব মুখে ভাত নিয়ে, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল। নায়রার তখন মাথায় হাত। এতক্ষণ খাবে না, খাবে না বলে হাত-পা গুটিয়ে বসেছিল শিহাব। নিজের হাতটাও ব্যবহার করতে নারাজ ছিল। অথচ এক্ষুণি ভাইকে দেখে, ট্যুরে যাওয়ার গন্ধ শোনে কেমন পালটি খেল। সে দুই ভাইয়ের এই মান-অভিমানের কাহিনী দেখে গালে হাত দিয়ে বিড়বিড় করল,

-‘সেই তো প্লেটে হাত ডুবালি ভাই। এতক্ষণ অকারণ আমাকে জ্বালিয়ে মেরেছিস। অসভ্য কোথাকার!’

সে হাত ধুয়ে নিজের খালামনির কাছে চলে গেল। শিহাব খেতে খেতে জানতে চাইল,
-‘ট্যুরে কোথায় যাব?’

-‘তিনদিন সময় দিতে পারব। দেশের বাইরে কোথাও যেতে পারব না। সিলেটের মধ্যে কোথায় যেতে চাও ঠিক করো।’

-‘এক্ষুণি করব? একটু সময় দিবে না?’

-‘তোমাকে সময় দেয়া মানে, দুনিয়া চক্কর দেয়ার লিস্ট তৈরী করা। ফাইনাল এ্যাক্সাম শেষ হোক, কাশ্মীর যাব। এখন পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। দ্রুত সিদ্ধান্ত জানাও। রিসোর্ট বুকড করতে হবে। টুরিস্ট গাইড লাগবে। হাইওয়েতে যাবে না-কি হেলিকপ্টার দ্যাখব, সবটা ভেবে এক্ষুণি বলবে।’

চিন্তায় পড়ে গেল শিহাব। কোথায় যাবে, কোন জায়গা ঘুরাঘুরি বাকি ঝটপট একটা হিসাব দেখল মাথায়। সিলেটের সব জায়গায় তার ট্যুর দেয়া শেষ। দেশের বাইরে এখন আর নিবে না। তাই এই বিভাগের অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে। সুযোগটা কাজে না লাগালে, বসে বসে আঙুল কামড়ানো লাগবে। তড়িঘড়ি জায়গা সিলেক্ট করে বলল,

-‘শ্রীমঙ্গলে যাই। ওফিং হিল, বধ্যভূমি ৭১, লাওয়াছড়া, মাধবপুর লেক, কতকিছু দ্যাখা বাকি। এগুলো ছাড়াও ওখানে বেশ কয়েকটা পর্যটন এরিয়া আছে। আমরা চাইলে সেগুলোও দ্যাখতে পারি। আর হেলিকপ্টারের দরকার নেই, আমরা এবার হাইওয়েতে যাব। হবে না?’

শাদাব সিদ্ধান্ত জানাতে গিয়েও থমকে গেল! হুট করে শ্রীমঙ্গলে যেতে চাইছে কেন ছেলেটা! কতবার ইনিয়েবিনিয়ে ওই জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করেছে। ঘুরতে যাওয়ার আর জায়গা পেল না। শেষমেশ নিজের পূর্বপুরুষের ঠিকানায়! এখন কী করবে? ক্যান্সেল করবে না-কি যা থাকে কপালে, এইভেবে ব্যাগ গোছানো শুরু করবে?

***

চলবে…