বঁধুয়া কেমনে বাঁধিবো হিয়া পর্ব-০১

0
653

#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — এক

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

-‘এ্যাই মেয়ে, তুমি কি ভ্রমর না-কি? এইভাবে ফুলের মধু সংগ্রহ করছ যে! আমি তো এতদিন জানতাম ভ্রমরেরা ফুলে বসে মধু সংগ্রহ করে। এখন তো দেখছি, মানুষও ফুলের মধু সংগ্রহ করছে। আশ্চর্য! তুমি যদি ভ্রমর-ই হও, তোমার পিছনে পাখা নেই কেন? কীভাবে পাখা ছাড়া ওড়ে ওড়ে আমাদের বাড়ির ফুলগাছে চলে এলে?’

বাগানবিলাসী মানুষের অত্যন্ত পছন্দের কাজ হচ্ছে, বাড়ির সামনে-পিছনে প্রিয়সব ফুল গাছ রোপণ করা। সেই গাছের যত্ন নেয়া। ফুলের সাথে যাদের সখ্যতা তাদের মন ও চোখের শান্তি-ই হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন বাগান। এই বাড়ির কর্ত্রী বেগম সায়রা করীম অত্যাধিক হারে ফুল পছন্দ করেন। এজন্য বাড়ির বাগান ছাড়াও নিজের রুমের বেলকনিতে ছোটো ছোটো টবে ফুলের গাছ পালাক্রমে গ্রিলের মধ্যে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছেন তিনি। তিনি ছাড়া এই বাড়িতে আর কেউ ফুল এত পছন্দ করে না। তা-ই সময়ে, অসময়ে, অবসরে কিংবা মন খারাপে তিনি নিজেই ফুলগাছের যত্ন নেন।

তপ্ত দুপুরবেলায় বাড়িতে পা রেখে বাগানের দিকে চোখ গিয়েছিল ছোট্ট মাহদিয়ার। ফুলের ওপর ওড়াউড়ি করছিল সাত ডোরা প্রজাপতি। প্রজাপতি দেখলেই পিছনে দৌড়াতে ইচ্ছে হয় তার। চঞ্চল পাখাসমেত প্রজাপতিটা যখন তার চোখের সামনে ডানা ঝাপটে ঝাপটে ফুলে বসছিল আবার ধরতে গেলে পালাচ্ছিল, তখনই তাকে দু’হাতের মুঠোয় বন্দী করার জন্য ডানে-বামে না তাকিয়ে ফুলগাছ মাড়িয়ে প্রজাপতির পিছু ছুটছিল সে। একটা সময় প্রজাপতি গাঁদাফুলের ওপর বসলে সে চুপিচুপি হাতে ওটা ধরতে চেয়েছিল। তারমধ্যেই এই বাড়ির মোটকু ছেলেটা তাকে দেখেই চিৎকার, চেঁচামেচি করে উঠল। একটুর জন্য হাত ফসকে বেরিয়ে গেল প্রজাপতিটা। নিজের ব্যর্থতা কখনওই মেনে নিতে পারে না মাহদিয়া। রাগে তার গোলগাল মুখে অভিমান জমে। সে দু’ঠোঁট একত্রিত করে কোঁকড়া চুলের সামনের বিনুনি সরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে আহ্লাদী মায়ের বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক বাচ্চা বলাও যায় না একে, আবার ছোটোও বলা যায় না। তার দৃষ্টিতে এই ছেলেটা গোটা একটা বড়ো বাচ্চা। নয়তো, পনেরো বছরে কেউ এত মোটা হয়? একদম গুলুমুলু, নাদুসনুদুস। যেমন মোটা দেহ, তেমন চেহারাটাও। এক দেখাতেই ঘাবড়ে গেল বেচারী। চারপাশে তাকিয়ে মা’কে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করে।

ছেলেটা ধুপধাপ পা ফেলে এগিয়ে গেল তার দিকে। থেতলে যাওয়া ফুল, নষ্ট হওয়া গাছের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘মধু খাবে খাও না, গাছ নষ্ট করলে কেন? মা দেখলে পিঠের ছাল তুলে নিবে।’

বোকা বোকা চেহারায় তাকিয়ে রইল মাহদিয়া। হালকা বাদামী রঙের কোঁকড়ানো চুলের একপাশে সামান্য সিঁথিকাটা। ওইপাশ দিয়েই ছোটো ছোটো বিনুনি করা। তারওপর ছোটো ছোটো কাঁকড়া ক্লিপ বসানো। একেকটা বিনুনিতে পাঁচ থেকে ছ’টা ক্লিপ আটকানো। বিনুনিও দশ থেকে পনেরোটা। ধূসর মনির চোখ। উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারা। দেখতে একদম পুতুল পুতুল সাজ। চুল কালো না হওয়ার এক আফসোস ওর। তবুও রংবেরঙের এই বিনুনির কারণে তার চেহারা পুরোটাই পুতুলের মতো লাগছে দেখছে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেও কোনো জবাব না পেয়ে ছেলেটা আগ্রহচিত্তে বলল,

-‘তুমি কি বোবা না-কি? কথা বলতে পারো না?’

মেজাজ বড্ড খারাপ মাহদিয়ার। প্রজাপতি ধরতে পারেনি। ছুঁয়েও দিতে পারেনি। এরমধ্যে মোটকু ছেলেটা তাকে কতকিছু বলে যাচ্ছে। এই বলছে ভ্রমর, এই বলছে বোবা। সহ্য করা যায়? সে ওমন হতে যাবে কেন? আস্তো একটা মানুষকে কেউ ভ্রমর বলে, তা-ও কোনো যুক্তি ছাড়া? দশ বছরের ছোট্ট মাহদিয়া ক্ষ্যাপেট্যাপে দাঁড়িয়ে রইল, সুযোগ বুঝে শোধ তোলার জন্য। প্রথম দেখা, প্রথম আলাপ যে এমন ভয়ানক যু//দ্ধ দিয়ে শুরু হবে, ভাবেনি দু’জনার অবুঝ মন। কেউ কাউকে চিনে না, শুধু নামের খাতিরে চিনে। এই বাড়ির বড়ো কর্তা এমদাদ কায়ছার ও ছোটো কর্তা আরফান হায়দার সম্পর্কে তার বড়ো মামা ও ছোটো মামা। দূর দূর সব আত্মীয়স্বজন কিংবা রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই এই বাড়ির কারও সাথে তাদের। তবুও একটা আত্মিক বন্ধন জড়িয়ে আছে। মাহদিয়ার বাবা আজাদুর রহমান সাহেব ছিলেন কায়ছার সাহেবের সুসম্পর্কের মানুষ। বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা এজাতীয় সম্পর্ক না থাকার পরও নিজের গ্রামের পরিচিত ভাই হিসেবে তিনি সকল কাজে বেশ ভরসা করতেন আজাদ সাহেবকে। ব্যবসায়ীক সকল কাজে তাকে কাছেপাশে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। আজাদ সাহেবও সৎ, সাহসিকতার প্রমাণ দিয়ে নিজের সমস্ত দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে যেতেন। তবে তিনি এখন দেশে নেই। জীবনে উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে দেশ ছেড়ে পাড়ি দেন সুদূর ইতালিতে। সেখানে দীর্ঘবছর একাকী জীবনযাপন করে ছ’মাসের ছুটিতে দেশে এসে বিয়ে করে বউকে রেখে পূণরায় চলে যান প্রবাসে। দীর্ঘবছর ওইদেশে থাকার ফলে, তিনি ওখানকার সিটিজেনশিপ পেয়ে যান, এবং স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভিসার কাগজপত্র তৈরী করতে লেগে পড়েন। সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পরই বাড়ি ছেড়ে মায়ের সাথে কায়ছার সাহেবের বাড়িতে আসে মাহদিয়া। কারণ, আর মাত্র সাতদিন পরই তাদের ফ্লাইট। দেশ ছেড়ে চলে যাবে অচিনদেশে। এই বাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট অনেক কাছে। যাতায়াতের সুবিধা ও প্রয়োজনীয় সব কেনাকাটার জন্যই মূলত এখানে আসা। তবে এখানে আসার পিছনে কায়ছার সাহেবের জোরাজুরিটা ছিল বেশি। তিনি-ই প্রায় জোর করে মা-মেয়েকে এখানে আসতে বলেছিলেন।

মোটকুর আচরণে মাহদিয়ার মন ভীষণরকম খারাপ হয়েছিল সেদিন। একেই তো দেশে ছেড়ে চলে যাবে, তারমধ্যে ঘুরতে এসে এমনসব কথা তার ঠিক হজম হলো না। অবুঝ মনে ব্যথা লাগল বেশি। ছেলেটা বিরক্তিতে নুয়ে যাওয়া ফুলগাছটা সোজা করতে লাগল। অমনি পিছন থেকে তার মাথা একদম মাটির সাথে মিশিয়ে দিল মাহদিয়া। তাতেই কাজ সারা। গতকাল রাতে অল্পস্বল্প যা বৃষ্টি হয়েছিল, বাগানে তখন একটু-আধটু কাদামাটিও ছিল। সেই মাটিতে মাখামাখি হয়ে গেল তার মুখ। প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল বেচারা। পরক্ষণেই বুঝতে পেরে পিছু ঘুরে দেখল মাহদিয়া খিলখিল করে হাসছে। বিনুনি করা চুলগুলো মুখের ওপর এসে পড়ছে। বকতে গিয়েও থেমে গেল সে। ভূতের মতো দেখতে মুখখানা নিয়ে মাহদিয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। বলল,

-‘মজা লাগছে না?’

-‘খুব মজা লাগছে। তোমাকে দেখতে এখন পুরো কুমোরপাড়ার কুম্ভকার মনে হচ্ছে। মাটির কিছু খেলনাবাটি দিয়ে যাও না গো।’

কথাটা বলে যে মারাত্মক রকমের ভুল করল, সেটা দু সেকেন্ড পর টের পেল মাহদিয়া। এরমধ্যেই হাতভরতি কাদামাটি দিয়ে তার পুতুল পুতুল মুখখানি লেপটে দিয়েছে পাজি ছেলেটা। কিছু কাদামাটি ঠোঁটেও লেগেছে। গালে, নাকে, চুলেও। এতেই সে অতিমাত্রায় কান্না জুড়ে দিল। চিৎকার করে মাকে ডাকল, মামাকে ডাকল, মামিকেও ডাকল। মার খাওয়া হোক কিংবা বকা, সবাইকে ফেইস করার ভয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির পিছন দিকে গিয়ে, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে, গাছের ডালের ফাঁকে ঝুলে থাকা নিজের ছোট্ট কাঠের ঘরে চলে গেল ছেলেটা। পিছন থেকে কড়া শাসনের স্বরে ভেসে এলো এক মমতাময়ী নারীর গলা। তিনি একাধারে ছেলেকে বকছেন। চিৎকার করছেন,

-‘টোটোন, দিনদিন তোর বাঁদরামি বাড়ছে। অকারণ মেয়েটাকে কেন জ্বালাচ্ছিস? আজ আয় ঘরে, তোর পাতের ভাত আমি তোর শত্রুকে খাওয়াব।’

***

সেদিনের মতো আজও সেই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটবে ভেবে মনের ভেতর সেইসব দিনকে যত্ন করে আগলে রেখেছিল মাহদিয়া। কিন্তু যে দিন অতীত, যা চলে যায়, তা আর ফিরে আসে না। এই চরমসত্য মেনে নিয়ে সেসব দৃশ্য স্মৃতিপটে বাঁচিয়ে রেখেছিল দীর্ঘবছর। এতগুলো দিন, এতগুলো মাস পর জন্মভূমির মাটিতে পা রেখে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিল মাহদিয়া। পনেরো বছর কম সময় নয়। এই পনেরো বছরে পালটেছে অনেককিছু। সে-ও পালটেছে। একটু একটু করে পালটেছে। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য পেরিয়ে সে এখন পঁচিশ বছরের যুবতী। শারিরীক, মানসিক সবদিক দিয়েই পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু তার সেই চুলের স্টাইলটা আগের মতোই আছে। যেভাবে কোঁকড়ানো চুলের সামনের দিকে বিনুনি বেঁধে তাতে কাঁকড়া ক্লিপ বসিয়ে রাখত, এখনও রাখে। আধুনিক এই যুগে চুল স্ট্রেইট করার সুযোগ থাকলেও নিজের কোঁকড়া চুলকে সে-ই একইভাবে যত্ন করে আগলে রেখেছে। মাথাভরতি চুল যেন শালিকপাখির বাসা।

বাড়ির মূল রাস্তা ধরে যখন কমলা রঙের বিএমডব্লিউ গাড়িটা প্রবেশ করে একদম সদরদরজার কাছে এসে থামল, তখনই অস্থির চোখজোড়া নিয়ে ইতিউতি চোখ ঘুরাল সে। বুক ছিঁড়ে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসলো। বাড়িটা আর আগের মতো নেই। সাজানো-গোছানো ফুলের গাছগুলোও নেই। সব গাছ মরে-পঁচে শেষ হয়ে গেছে। পুরো বাগানের অংশটুকু আস্তো এক খেলার মাঠ এখন। ফাঁকা মাঠে যে কেউ এখানে এদিক-ওদিক দৌড়াতে পারবে। অথচ কয়েক বছর আগেই এই বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করলে, তাজা ফুলের সুভাস এসে নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে মন-মেজাজ সতেজ করে দিত। রঙিন সব ফুলেরা দৃষ্টি মাতিয়ে রাখত। মন ভুলিয়ে রাখত। আজ এসবের কিচ্ছু নেই। থাকবে কী করে? ফুল ভালোবাসে যে মানুষ তিনি-ই তো নেই। না এই বাড়িতে তিনি আছেন, না কারও মনে। তার চলে যাওয়ার কারণ আজও জানে না মাহদিয়া। শুধু জানে, তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। কোথায় গেছেন, সেই ঠিকানাটাও কারও কাছে নেই।

গুটিকয়েক পা ফেলে মাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল মাহদিয়া। যত এগোয়, চারপাশে থাকায়। চোখে মুগ্ধতার চেয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ পায় বেশি। ভীতি এসে ভর করে মনের কোণে। তা-ও আগ্রহী চোখে চেনা পরিচিত মানুষকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে। বারান্দা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে একসময় দাঁড়িয়ে পড়ে কায়ছার সাহেবকে দেখে। তিনি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন তাদের ঘরে নেয়ার জন্য। ভয় দূরে সরিয়ে ঠোঁটে হাসি টেনে নিচে বসে ভদ্রলোককে সালাম করল মাহদিয়া। এই সালামের অর্থ কেবল তিনি-ই বুঝতে পারলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন,

-‘তোমার বাবা এবারও আসলো না? ভিনদেশকেই আপন করে নিল? ইতালি যাওয়ার পর, ও যে একেবারে পর হয়ে যাবে, সেটা তো আগে বুঝিনি। যদি বুঝতাম, তবে ঘাড় ধরে ব্যবসায় বসিয়ে রাখতাম।’

আজাদ সাহেব ইতালি যাওয়ার পিছনের সমস্ত ক্রেডিট কায়ছার সাহেবের। সেটা মাহদিয়া বাবা-মায়ের মুখে অনেক শুনেছে। এসব ছাড়াও ভদ্রলোকের প্রতি তার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ছেলেবেলা থেকে একটু বেশি-ই। যেকোনো বিপদেআপদে তাঁকে যেভাবে পাশে পেয়েছে, সেভাবে আর কেউ এগিয়ে আসেনি কোনোদিন। তার বাবা, সে এবং তার মায়ের আজকের এই অবস্থান তো কেবল এই মানুষটার জন্যই। তাই কৃতজ্ঞতাবোধও অনেক বেশি।

আজাদ সাহেবকে ঘিরে তিনি বরাবরই একটু বেশি রসিকতা করতে পছন্দ করেন। এখনও করলেন। শোনে মাহদিয়া একগাল হাসল। বলল,
-‘তুমি তো জানোই, বাবা এখন দেশের চেয়ে ইতালিতেই স্বস্তিবোধ করেন বেশি, তাই আসতে চান না।’

-‘সে তো জানি। কিন্তু এতগুলো বছর পর ওর একবার আসা উচিত ছিল। জন্মভূমির প্রতি মানুষের আত্মিক টান থাকে। সেই টানকেও আজাদ অস্বীকার করা শুরু করল।’

শায়লা সুলতানা নিজেদের ট্রলিব্যাগ ভেতরে টেনে আনতে গিয়ে দেখলেন, দু’জনেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্পের আসর জমিয়ে ফেলেছে। তিনি এসে ভদ্রতাসূচক হাসলেন। বললেন,
-‘আবারও আপনাকে বিরক্ত করতে এলাম ভাইজান। দিয়া এখানে থাকলে অসুবিধা হবে? আমি আগামীকাল সকালেই গ্রামে চলে যেতাম। যে ক’টাদিনের জন্য এসেছি, গ্রামের বাড়িতে থাকলে শান্তি পাব। ওখানে ওর দাদা-দাদীর কবর আছে, সেসবও দেখা দরকার। বাড়িটা নিশ্চয়ই এতদিনে জঙ্গল হয়ে গিয়েছে।’

কায়ছার সাহেব সানন্দে মাহদিয়াকে থাকবার অনুমতি দেয়ার মনস্থির করলেন। তিনি অনুমতি না দিলেও মাহদিয়া যে এখানে হাঁটুগেড়ে বসবে সেটা তার চঞ্চল চোখজোড়া দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তিনি সহাস্যে বললেন,

-‘ওর তো এখানেই থাকা উচিত। যাও। আগে ফ্রেশ হও। তারপর ডাইনিং-এ আসো। জরুরী আলাপ আছে।’

ভদ্রলোকের জরুরী আলাপ কী, সেটা শায়লা সুলতানা টের পেলেও মাহদিয়া কিচ্ছু বুঝতে পারল না। সে তার কোঁকড়ানো চুল নিয়ে হেলতেদুলতে দু’তলায় তার পরিচিত ঘরে চলে আসলো। আজ থেকে সে এখানেই থাকবে।

***

-‘মামা, আমি শুনলাম মামি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। কেন চলে গেলেন তিনি? এই বাড়িতে কোনোকিছুর অভাব টের পেয়েছিলেন?’

ঘর-বাড়ি সব যেমন-তেমন আছে, কিন্তু বাড়ির কর্ত্রী বাড়িতে নেই। তাঁর সাজানো-গোছানো পরিবার এলোমেলো করে দিয়ে তিনি চলে গেছেন। কথাটা মানতে পারছে না মাহদিয়া। কেমন অস্বস্তি ও বুক জ্বালাপোড়া হচ্ছে। কাউকে বুঝাতেও পারছে না নিজের মনের অবস্থা। তা-ই সাহস নিয়ে জানতে গিয়েই এমন কথা তুলে বাড়ির সবচেয়ে চমৎকার মনের মানুষটার কথা জিজ্ঞেস করল সে। উত্তরে কায়ছার সাহেব বললেন,

-‘দুষ্টু গোরুর চেয়ে শূণ্য গোয়াল অনেক ভালো। আমার ভাগ্য ভালো যে, আপদ নিজে থেকে বিদায় হয়েছে। নয়তো মান-ইজ্জত কিছুই টিকে থাকত না আর। সব জলের তলায় গিয়ে হাবুডুবু খেয়ে সম্মান হারানোর যন্ত্রণায় অযথা হাউকাউ করত।’

নিজের স্ত্রী সম্পর্কে কেউ কতটা বাজে চিন্তাভাবনা মনে পুষে রাখলে এইভাবে ক্ষোভ ঝাড়তে পারে? তা-ও সেই স্ত্রী, যাকে তিনি ভালোবেসে বিয়ে করে এই বাড়ির সমস্ত দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন। কায়ছার সাহেবের এমন একটা কঠিন কথাই যেন তার ভেতরের সমস্ত জ্বালাযন্ত্রণাকে টেনে বের করে আনল। শায়লা সুলতানা আড়চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। মাহদিয়া মারাত্মকভাবে চমকেছে। চমকের দরুন সে খেতে পারছে না। এতক্ষণ খাবার গিলতে অসুবিধা না হলেও এখন মাহদিয়া টের পেল, এমনতর কথা শোনার আগে তার কানে তালা লেগে যাক। সায়রা করীম মানুষটাকে সে সাতদিনে যতখানি চিনেছে, তাতেই তার অবুঝ মন তাকে বুঝিয়েছে, এই নারী সর্বদা সংসার-সন্তানের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। অথচ এতগুলো বছর পর, আজ এসে এটা কী শুনছে? প্লেটের ওপর শুধু চামচটাই নড়াচড়া করল, মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারল না। ভদ্রমহিলা মেয়ের মনের অবস্থা যথেষ্ট বুঝতে পারলেন। এই মেয়েটার হঠাৎ পাগলামির জন্যই দেশে আসা। সে কোনোভাবেই মানতে পারছে না, সায়রা করীম ও তার ছেলে স্বর্গপুরী ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি নিজেও প্রথমে বিশ্বাস করেননি, কিন্তু পরবর্তীতে স্বামীর মুখ থেকে বিস্তারিত শোনে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছেন।

ঘর-সংসারকে আগলে রেখে যিনি কতগুলো বছর ধরে এই ঝিমে যাওয়া বাড়িতে প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়েছিলেন, আজ তিনি-ই বাড়িতে নেই। তার শূণ্যতায় বাড়িটা কতখানি অসহায় সেটা চারপাশের পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে। স্বর্গপুরী আজ নরকে পরিণত হয়েছে সেটাও পরিলক্ষিত। সে বাড়ির এলোমেলো বেশভূষার দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘আগে কিন্তু বাড়িটা এত শূণ্য ছিল না। সবসময় মনে হোতো, এখানে এক নারী আছেন, যিনি তাজা ফুলের মতো মানুষের মনের ভেতর নিজের গুণাগুণের সুভাস ছড়িয়ে দিতে পারেন। আর আজ, বাড়ির আঙিনাতে ঢুকেই টের পেলাম, এই বাড়ি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। মামা, অপরাধ নিও না। আমি যতদূর জানি, মামিকে তুমি ভালোবেসে বিয়ে করেছ। যে নারীকে তুমি সম্মানের সাথে ঘরে এনে তুললে, তাকে এইভাবে আপদ ভেবে যেতে দিলে? এটা কেমন বিচার? তার অন্যায়টা কী? তাছাড়া টোটোন। ও তো তোমারই সন্তান। তাকে তুমি কীভাবে যেতে দিলে? আটকালে না কেন?’

মানুষ বড়ো হলে বুঝতে শিখে, আবেগ সরে বিবেক জাগ্রত হয় মনে। বুদ্ধিশুদ্ধি বৃদ্ধি পায়। জ্ঞানের ভাণ্ডার প্রসারিত হয়। অবুঝ মাহদিয়া এখন বড়ো হওয়ার পাশাপাশি কাউকে প্রশ্নের বানে জর্জরিত করতে জানে এটাই একটা কঠিন দৃষ্টান্ত। এতসব প্রশ্ন শোনে তিনি শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। উদাস চোখে বললেন,

-‘তোমার বয়স এখনও অনেক কম। বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞানও কম। যে কঠিন সত্য মেনে নেয়া আমার জন্য অস্বস্তির, অপমানের সেটা আমি তোমাকে জানতে দিতে চাই না। কেন চাই না, এই প্রশ্ন তুমি কোনোদিন করবে না। উত্তর দেয়া অপ্রয়োজনীয় আমার কাছে। তাই এর কোনো জবাব আমি তোমাকে দিব না।’

মাহদিয়া আহত হলো। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে রইল নিজের জায়গায়। এই বাড়ির মানুষগুলো তার আপন। সবাই-ই আপন। এইজন্যই প্রশ্নটা করে ফেলেছে। ভাবেনি, কায়ছার সাহেব তাকে এইভাবে ধাক্কা দিবেন। তবে ধাক্কাটা খুব সহজেই সামলে নিল সে। ম্লানমুখে বলল,

-‘আমি কেন এসব জানতে চাইছি, সেটা তুমি বুঝতে পারছ।’

কায়ছার সাহেব শক্ত মেজাজে বসে রইলেন চেয়ারে। মাহদিয়াও নীরবে খাবারের বাকি অংশটুকু শেষ করতে শুরু করল। দীর্ঘপথ অতিক্রম করে এসেছে। আগে খাওয়া দরকার, পরে বাকি কাজ। মাহদিয়ার কথা শোনে তিনি কতক্ষণ বোন সমতুল্য নারী শায়লা সুলতানার দিকে তাকালেন। বললেন,

-‘ও’কে দেশে নিয়ে আসা উচিত হয়নি তোমার। বাবার কাছে রেখে আসতে।’

-‘আমি অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি ভাইজান। কিন্তু ও দেশে আসার জন্য মরিয়া। কোনোভাবেই মানছে না। পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর থেকে নিজেই দৌড়াদৌড়ি করে টিকিট কনফার্ম করে নিয়েছে। একা পাঠাব সাহস পাইনি দেখে আমি সাথে আসতে বাধ্য হয়েছি। ভাবলাম আমি মানাতে পারিনি, আপনি যদি পারেন।’

দু’জনার কথার মাঝখানে দড়াম করে টেবিলে আওয়াজ তুলল মাহদিয়া। সবাই তাকে আসল ঘটনা এড়িয়ে যাচ্ছে। কেউ কিচ্ছু বলছে না। কী এমন খারাপ ঘটেছে যে, কেউ ঘটনার কোনো ইঙ্গিত তাকে দিচ্ছে না। একেই তো সামান্য কিছুতে তার রাগ বেড়ে যায়। তারমধ্যে সবাই তার আসাটাকে খারাপ চোখে দেখছে। সে কেন ছুটে এসেছে, এটা তো সবার জানা। তবুও সবার এই নাটকীয় কথাবার্তা ভালো লাগছে না তার। চোখমুখ গরম করে দু’জনের দিকেই তাকাল। এরপর ঠাণ্ডা মাথায় বলল,

-‘আমি এখন যথেষ্ট ম্যাচিউরড। নিজের জীবন নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো উপযুক্ত। বিবেক, বুদ্ধি, জ্ঞান সবটাই পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে আমার মধ্যে। ঠিক-ভুলের মধ্যে থাকা পার্থক্য ধরতে জানি। তাই আমি চাইব, আমার এখানে আসা নিয়ে কেউ কোনো নেগেটিভ ভাবনা মনে পোষণ করে রাখবে না। আমাকে শুধু আন্টির বাসার ঠিকানা দিয়ে দাও। তাতেই চলবে। আমার কাজ শেষ হলে আমি ফিরে যাব।’

খাবার শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন কায়ছার সাহেব। নির্বিকার ভঙ্গিমায় বেসিনে গিয়ে হাত ধুলেন। মাহদিয়াও পিছন পিছন গেল। তিনি তাকে পাত্তা দিলেন না। সে পাঞ্জাবীর কোণা ধরে লটকে থেকে বলল,

-‘প্লিজ মামা। ঠিকানাটা দিয়ে দাও। আমি কাউকে বেশিদিন জ্বালাব না। কথা দিচ্ছি।’

টুথপিক নিয়ে দাঁতের ফাঁকফোকর পরিষ্কার করায় মনোযোগ দিলেন ভদ্রলোক। মাহদিয়া অধৈর্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ফের কাতর গলায় বলল,

-‘কেন এমন করছ?’

তিনি চোখমুখ শক্ত করে মাহদিয়ার দিকে তাকালেন। মেয়েটা ঘাবড়ে গেলেও দাঁড়িয়ে রইল। ঠিকানা নেয়ার জন্য গাইগুই শুরু করল। ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। চড়া গলায় বললেন,

-‘ঠিকানা আমার কাছে নেই দিয়া। ওরা কোথায় গেছে আমি জানি না। আমি শুধু জানি, ওই দু’জনার এই বাড়িতে ফেরার সব পথ বন্ধ। টোটোন আমার সন্তান। তার প্রতি আমার ভালোবাসার কমতি ছিল না কোনোদিন। কিন্তু শেষবেলা ছেলেটা তার মাকে বেছে নিয়ে আমাকে অপমান করেছে। সেই দৃশ্য কখনওই ভুলতে পারব না আমি। জীবনের শেষপ্রান্তে গিয়েও ধোঁকাবাজ মানুষের ধোঁকাবাজি আমার মনে গেঁথে থাকবে।’

***

চলবে..