বঁধুয়া কেমনে বাঁধিবো হিয়া পর্ব-০২

0
416

#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — দুই

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

আরফান হায়দার যখন বাড়ি ফিরলেন তখন কেবল বিকেল গড়িয়েছে। শুনশান এই বাড়িটা আজ যেন অন্যরকম মনে হলো তাঁর কাছে। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার আগেই তিনি অভ্যাসবশত চোখ ফেললেন, টোটোনের প্রিয় সেই কাঠের ঘরের দিকে। দরজা, জানালা খোলা দেখে চমকে গেলেন। এই ঘরে পা রাখবে এমন মানুষ এই বাড়িতে নেই। দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে ঘরটা তালাবদ্ধ আছে। মাঝেমধ্যে নিলুফার মা ঘরটা পরিষ্কার করতে গেলে কায়ছার সাহেব তাকে ধমক দিয়ে ওই ঘরে যেতে নিষেধ করতেন। রাগের বশে একদিন তিনি কাঠের ওই ঘর ভেঙে ফেলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু হায়দার সাহেবের জন্য পারেননি। সায়রা করীম ও টোটোন বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার দিন তিনি জোর করে, ধরেবেঁধেও টোটোনকে আটকে রাখতে পারেননি। সেদিন ছেলেটা জেদ ধরে, অভিমানে মায়ের সাথে চলে গিয়েছিল। এরপর কায়ছার সাহেব তাদের না খোঁজলেও হায়দার সাহেব শহরের আনাচে-কানাচে টানা একমাস ছোটাছুটি করেছেন, অথচ কোথাও কাউকে খুঁজে পাননি। ভালোবেসে স্বামীর ঘরে আসার অপরাধে সায়রা করীমের জন্য তার নিজের বাবার ঘরের দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। একদিন সে বাড়িতে গিয়েও খোঁজ নিয়েছেন, কিন্তু সেখানেও তাদের পাননি। যখনই সময়-সুযোগ পান, গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ভাবী-ভাতিজাকে খুঁজতে। জলজ্যান্ত দুটো মানুষ রাতারাতি কোথায় গিয়ে লুকাল? এত দৌড়ঝাঁপ, এত চেষ্টা সবটাই তাঁর বৃথা। পনেরো বছর ধরে খুঁজেও তিনি ব্যর্থ।

ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন বারান্দায় পা রাখলেন অমনি ওপর থেকে চিৎকার এলো,
-‘ছোটো মামা…।’

হায়দার সাহেব চমকে গেলেন। ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকালেন। এই বাড়িতে এখন মাত্র তিনজন মানুষের বসবাস। তাঁরা দুই ভাই ও নিলুফার মা। কাজের লোক কেউ নেই। যেদিন সায়রা করীম বাড়ি ছাড়েন সেদিন তার বিশ্বস্ত সব কাজের লোক এই বাড়ি ছেড়ে চলে যায় কেবল বাড়ির বেগমকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়ার কারণে। পুরনো কাজের লোক ও সায়রা করীমের কাছে ওয়াদাবদ্ধ থাকায় নিলুফার মা বাড়ি ছেড়ে যেতে পারেননি। শুধু ওয়াদা রক্ষার খাতিরেই এখানে পড়ে আছেন। নিলুফার মার ওই ঘরে যাওয়া নিষেধ যদি হয়, তবে কে ডাকল তাকে? নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি বাড়িতে না ঢুকে সোজা পিছনের দিকে চলে গেলেন। কাঠের ঘরের জানালা দিয়ে একটা মিষ্টিমুখের স্বচ্ছ হাসি দেখতে পেয়ে চেহারায় বিস্ময়ের পাশাপাশি ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে উঠল তাঁর। তিনি বিস্মিত স্বরেই বললেন,

-‘ওমা! দিয়া। কখন এলি?’

ঝলমলে হাসি নিয়েই কাঁধ নাচাল মাহদিয়া। বলল,
-‘দুপুরে। তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ?’

-‘আর কোথায়? মাদরাসায়। আজ ফিরতে একটু দেরী হয়ে গেল।’

হায়দার সাহেব এই শহরের নামীদামী মাদরাসার সহকারী অধ্যাপক। বিয়েশাদী, ঘর-সংসারের ইচ্ছে থাকলেও সায়রা করীমের চলে যাওয়ার পর সেসবেও আর আগ্রহ পাননি। ভাইয়ের বউকে তিনি সম্মান করতেন। ভালোও বাসতেন। সেই ভালোবাসায় ছিল শ্রদ্ধা, আবদার, খুঁনসুটি, অভিযোগ। বাবা-মা, ভাই-বোন ছেড়ে এই বাড়ি-ই হয়ে উঠেছিল, ভদ্রমহিলার সবচেয়ে আপন জায়গা। এখানকার প্রত্যেকটা মানুষ ছিল তার নির্ভার হাসির কারণ। সবাইকে তিনি মায়া-মমতার চাদরে পরম যত্নে আগলে রেখেছিলেন। ঘরকে, ঘরের মানুষকে আগলে রাখা মানুষটা যখন ঘর ছেড়ে চলে যায়, তখন শুধু ঘর কেন প্রতিটা মানুষ সবটুকু মায়া-মমতার শূণ্যতায় ডুকরে কাঁদে। নিজের জীবনসঙ্গী বাছাই করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন সায়রা করীমের কাঁধে। তিনিও চেনা-পরিচিত মানুষদের সাহায্যে ভালো মেয়ে খোঁজার চেষ্টা চালান। কিন্তু সময়! সময় সবসময় মানুষকে পর্যাপ্ত সাহায্য-সহযোগিতা করে না। অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা জীবনে কখন যে ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রবেশ করে, ধুমধাম তাণ্ডব চালিয়ে সুখের ঘর ভেঙে চুরমার করে দেয়, সেটা মানুষজন টের পায় না। সময়ের সবচেয়ে বড়ো নিষ্ঠুরতা বোধহয় একেই বলে। একঝলকেই হাসিখুশী ঘরের সমস্ত সুখকে খড়ের গাদার স্তুপ সাজিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় দূরে। ঠিক একইভাবে এই ঘরের সুখও একদিন হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে চেনা-পরিচিত মানুষগুলো। সেদিন তিনিও সিদ্ধান্ত নেন, জীবনে কোনোদিন বিয়ের নাম মুখে নিবেন না। ভালোবাসার মানুষকে, ঘরের প্রাণকে যদি সসম্মানে ঘরে রাখতে না পারেন, তবে লোকদেখানো বিয়ের কী প্রয়োজন? একজন মেয়ে স্বস্তিতে, শান্তিতে বাঁচার জন্য তো বিশ্বস্ত হাত খুঁজে। যে হাত ভরসার হওয়ার কথা, বিশ্বাসের হওয়ার কথা, সে হাত গলা ধাক্কা দেয়ার কারণ হয়, তবে তো সংসার এমন প্রাণহীন মরুভূমি হবেই। সুখ সেখানে মরিচীকার মতোই। দিনরাত শুধু হাহাকার করবে।

মাহদিয়ার চঞ্চল চোখের মিষ্টি হাসি দেখে অনেকদিন পর তিনিও দেহে প্রাণ ফিরে পেলেন। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে যখন ছোট্ট ঘরে প্রবেশ করলেন, তখন আরও বেশি চমকালেন। নোংরা, ধুলোমাখা, ঘুণেধরা এলোমেলো হয়ে থাকা, ঘরটা এত পরিপাটি। চারদিক চকচক করছে ঘরের। দেয়ালে ঝুলে থাকা প্রত্যেকটা রঙিন পোর্ট্রেট যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। দক্ষ হাতে এই ঘরটা পরিষ্কার করে নিয়েছে। অনেকদিন পর তাঁর চোখেমুখে মুগ্ধতা নেমে এলো। তিনি মনে মনে কতকিছু ভেবে ফেললেন। তাঁর মনে হলো, ঘরের যোগ্য কর্ত্রী বোধহয় ফিরে এলো আবারও। অথচ যার মাধ্যমে ঘরে প্রাণের বিস্তার হওয়ার সুযোগ হবে, সে-ই তো বাড়িতে নেই। যদি টোটোনকে ফিরে পেতেন, তবে মাহদিয়াকে চিরদিন এখানেই আটকে রাখতেন তিনি। ঘরকে বাঁচাতে, ঘরের মানুষের মুখে হাসি ফিরিয়ে আনতে এমন একজন কর্ত্রী তো অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু কোথায় পাবেন টোটোনকে? বেঁচে আছে তো ছেলেটা? কীভাবে আছে? কেমন আছে? ফিরে পাবেন তো কোনোদিন? সেইযে দুটো মানুষ ঘর ছাড়ল, আর তো কোনো যোগাযোগ হোলো না। নিজের এই আচানক ভাবনায় স্তম্ভিত, ব্যথিত দেহ নিয়েই মাহদিয়ার পাশে এসে দাঁড়ালেন। বললেন,

-‘তুই এসব করছিস কেন? নিলুফার মাকে ডাকলেই হতো।’

-‘খালা না-কি এখানে আসেন না। আগে টোটোন আসতে দিত না, এখন মামা আসতে দেন না। কী যে সমস্যা এই বাড়ির লোকজনদের। কিচ্ছু বুঝি না আমি।’

-‘ওসব বুঝতে গিয়ে তোর ছোটো মাথায় এত চাপ নিতে হবে না। তুই শুধু নিজের কথা ভাব।’

নিচে ফেলে রাখা সবটুকু ময়লা ঝুড়িতে তুলে রাখছিল মাহদিয়া। পুরো ঘরটা এখন যথেষ্ট সুন্দর দেখাচ্ছে। আরও কিছু ঝাড়পোঁছ করলে একদম আগের মতো ঝকঝকে, তকতকে হয়ে যাবে। সে ছোটো মানুষ, মাথায় চাপ নেয়া বারণ, কিন্তু এখন যে তার নিজের জন্য হলেও সায়রা করীম ও টোটোনকে তার দরকার। সেটা কীভাবে বুঝাবে? ঝাড়ু হাতে নিয়ে নিচের অংশটুকু পরিষ্কার করা শুরু করল মাহদিয়া। মাথানিচু রেখেই বলল,

-‘নিজের কথা ভাবতে গেলেও ওই দুটো মানুষকে আমার দরকার ছোটো মামা। এনে দিবে?’

অবুঝ মনের আবদার শোনে মনে ব্যথা পেলেন হায়দার সাহেব। অসহায় চোখমুখ নিয়ে বললেন,
-‘আমি নিজেও তো জানি না রে মা, ওরা দু’জন এখন কোথায়। অনেক খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি।’

মাহদিয়ার ঝলমলে মুখটা অমাবস্যার মতোই আঁধার হয়ে গেল। তার ধারণা ছিল, কেউ কিচ্ছু না বললেও তার ছোটো মামা তাকে সবকথা শেয়ার করবেন। অথচ এখন তিনিও জানেন না বলছেন। সে হতাশার স্বরে বলল,

-‘এমন কেউ কি নেই, যে তাদের খোঁজ জানে?’

-‘জানি না দিয়া। আমার নিজের কাছেও কোনো অপশন নেই। তবে তুই চাইলে খোঁজ নিতে শহরের অলিগলি দেখতে পারিস।’

-‘এভাবে মানুষ খোঁজা যায়? এতগুলো বছরে অনেককিছু পালটে গেছে মামা। টোটোনও নিশ্চয়ই পালটেছে। ওর বর্তমান চেহারার কোনো ছবি নেই আমার কাছে। যোগাযোগ করার মতো কোনো অপশনও নেই। এভাবে যদি খুঁজতে রাস্তায় নামি, তবে নির্ঘাত হোঁচট খাব। মানুষও হাসিঠাট্টা করবে। সেসব কথা বাদ দিলাম, ছবি ছাড়া শুধু নামের ভিত্তিতে কাউকে খুঁজে বের করা এত সোজা নয়।’

দু’জনেই চেহারাতেই হতাশা নেমে এলো। মাহদিয়া পূণরায় বলল,
-‘এক কাজ করি। আমরা থানায় যোগাযোগ করি। যদি হারিয়ে যাওয়া মানুষকে ওরা খুঁজে এনে দেয়?’

-‘তোর কী মনে হয়? ওরা হারিয়েছে? ওরা স্বেচ্ছায় লুকিয়েছে। যেন শুধু ভাইজান কেন, আত্মীয়-স্বজনের কেউ ওদের কোনো খোঁজ না পায়। ওরা চলে যাওয়ার পরই থানায় আমি যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। কেউ হারিয়ে গেলে তাকে খুঁজে বের করা সহজ দিয়া, কিন্তু কেউ স্বেচ্ছায় লুকোলে পুলিশের বাপেরও সাধ্যি নেই তাকে খুঁজে বের করবে।’

***

কেউ স্বেচ্ছায় কেন লুকাবে? ঘর-সংসার ফেলে চলে গেছেন ভালো কথা, যোগাযোগ কেন রাখলেন না? বাড়ির মানুষের সাথে সম্পর্ক নাই-বা রাখলেন, শায়লা সুলতানার সাথে তো যোগাযোগ রাখতেই পারতেন। শত হলেও দু’জন অনেক কাছের মানুষ। দু’জনেই একে-অন্যের ভরসার। পিছনের ঘটনা খুব সামান্য কোনো ঘটনা নয়, নিশ্চিত বড়ো কোনো দুর্ঘটনা। যা সবাই লুকাচ্ছে, এড়িয়ে যাচ্ছে, বলতে চাইছে না। সত্যি জানতে না পারলে সে-ও তো বুঝতে পারবে না, দোষটা কার? জানার জন্য মরিয়া হয়ে গেল মাহদিয়া। অধৈর্য্য হয়ে বলল,

-‘কেউ স্বেচ্ছায় কেন লুকাবে মামা? কার প্রতি বিতৃষ্ণা?’

-‘একটা নারী যখন মা হওয়ার আনন্দে ভাবাবেগে ভেসে যায়, তখন যদি সেই নারীকে কেউ বলে, গর্ভের সন্তানটা সম্মান নষ্টের কারণ! তখন ওই মায়ের মনে কেমন প্রভাব ফেলবে বল তো দিয়া? ঠিক এমন কিছুই ঘটেছে ভাবীর সাথে। চারমাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ভাইজান বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, শুধু নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য। প্রৌঢ়ত্বের দ্বারে পৌঁছে দ্বিতীয় বার মা হওয়া কি খুব বেশি দোষের ছিল?’

মাহদিয়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নিজের জায়গায়। চোখের কোণ ভরে উঠল তার। হায়দার সাহেব চোখের চশমা খুলে বুড়ো আঙুলের সাহায্যে চোখ পরিষ্কার করে অতীতের বিদ্রুপ দৃশ্যটা ছোটো পরিসরে বললেন,

-‘তোরা ইতালি যাওয়ার এক বছর পরের ঘটনা এটা। নতুন মেহমানের আগমনে ভাবী যতখানি খুশি, ভাইজান ততখানি অখুশি, বিরক্ত। দু’জনেই বিষয়টা নিয়ে তর্কাতর্কি শুরু করতেন। একজন বেবি রাখতে চায়, একজন মে//রে ফেলতে চায়। ভাইজানের মতে, তিনি আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারবেন না। তাই এই বাচ্চার তার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ভাবীও নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। তর্কাতর্কি, কথা কাটাকাটি, চড়-থাপ্পড় কিচ্ছু বাকি থাকেনি। রোজ রোজ অশান্তি। বেবিকে মে//রে ফেলার জন্য ঔষধ খাওয়াতে চাইলে ভাবী সেই বাচ্চা বাঁচাতে মরিয়া। তবুও ভাইজান সেদিন চাপাচাপি করে ভাবীর মুখে ঔষধ ঠেলে দিয়েছিলেন। সহ্য করতে না পেরে ভাবী আহাজারি শুরু করেন। ভাইজানকে খু//নী দাবী করার এক পর্যায়ে ভাবীকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেন তিনি। স্পোকেন থেকে ফিরে অসুস্থ মা’কে উঠোনের একপাশে পড়ে থাকতে দেখে টোটোনও সেদিন জেদী হয়ে গেল। কোনোদিকেই তাকাল না ছেলেটা। ট্যাক্সিক্যাব এনে ভাবীকে নিয়ে চলে গেল। এসব দৃশ্যের সাক্ষী নিলুফার মা ও বাড়ির পুরনো সব কাজের লোক। আমি সেদিন বাড়িতে ছিলাম না রে দিয়া। থাকলে এতোবড়ো অন্যায় হতে দিতাম না।’

টোটোনের এসএসসি পরীক্ষা শেষ তখন। ইংলিশ কোর্স কমপ্লিট করার জন্য স্পোকেনে অ্যাডমিশন নিয়েছিল। বয়স, বুদ্ধি, বিবেচনা যথেষ্ট ছিল তারমধ্যে। মায়ের শারিরীক অসুস্থতার কথা সে বুঝতে পারত। এই নিয়ে বাবা-মায়ের মাঝে ঝগড়ার দৃশ্য তাকে রোজ বিরক্ত করত। কিন্তু কাউকে কিচ্ছু বলতে পারত না। সেদিন যখন মা’কে ওইভাবে পড়ে থাকতে দেখল, অবুঝ মনের কোণায় মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা দ্বিগুণ বেড়ে গেল তার। পাশাপাশি বাবা নামক মানুষটার প্রতি ঘৃণা জন্মাল। ট্যাক্সি নিয়ে যখন সে মায়ের সাথে চলে যাওয়ার জন্য রওনা দেয়, কায়ছার সাহেব ছেলেকে আটকাতে চান। তাকে টেনেটুনে নিয়ে আসেন। পড়ালেখা করানোর স্বপ্ন দেখান। খেলনাপাতি কিনে দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কম্পিউটার, মোবাইল এসব কিনে দেয়ার লোভ দেখান, তবু ভদ্রলোকের কোনো কথাকে কানে জায়গা দেয়নি টোটোন। সে হাত-পা ছুঁড়ে গাড়িতে উঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলে তিনিও রাগ দেখিয়ে বলেছিলেন,

-‘এরপর আর এই বাড়িতে আসতে পারবে না কেউ। তোমাদের দু’জনের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দেব আমি। এই ঘরের দরজাও তোমাদের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। তুমি আমার সন্তান বলেই, তোমাকে সুযোগ দেব। যদি বাবাকে বেছে নিতে চাও, তাহলে মা’কে ছেড়ে চলে আসো।’

জানালা দিয়ে মাথা বের করেছিল টোটোন। বাবাকে শুনিয়ে বলেছিল,
-‘আমার বয়স কম হতে পারে, কিন্তু এতটাও অবুঝ নই। মায়ের দায়িত্ব নেয়ার মতো যথেষ্ট শক্তি আছে আমার শরীরে। তোমার মতো বাবার আর দরকার নেই আমার। আজ আমি যা দেখেছি, তাতে অন্তত এইটুকু বুঝতে পারছি, তোমার ভেতরে কোনো মনুষ্যত্ব নেই। এই মুহূর্ত থেকে আমি তোমাকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করি। সারাজীবন সন্তানের মনে তুমি ঘৃণার পাত্র হয়েই বেঁচে থাকবে।’

মাহদিয়ার মনে হলো সে কোনো বড়োসড়ো বটগাছের সাথে ধাক্কা খেল। এমন বিচ্ছিরি মনের মানুষকে সে এত শ্রদ্ধা করে সেটা ভেবেই গা গুলিয়ে আসলো তার। মানুষ এত পাষাণ হয় কী করে? নিজের স্ত্রী-সন্তানের সাথে কেউ এত রূঢ় আচরণ করে কীভাবে? সম্মানের ভয়ে কেউ কীভাবে নিজের সন্তানকে অস্বীকার করতে পারে! তাকে মে//রে ফেলতে পারে! অসহ্য যন্ত্রণা টের পেল মাহদিয়া। সবাইকে ভালোবেসে আগলে রাখা মানুষটা, ভালোবাসার বিনিময়ে নিজের সবচেয়ে আপন মানুষের কাছ থেকে এইভাবে অপমানিত হয়ে ফিরে গেছেন! ভুল মানুষকে ভালোবেসে নিশ্চয়ই আফসোস করছেন তিনি! চোখে নোনাজল নিয়ে হাতজোড় করে হায়দার সাহেবকে বলল,

-‘তুমি আমাকে সাহায্য করো মামা। টোটোনকে আমার দরকার। খুব দরকার। ওর থেকে ছোট্ট একটা উত্তর নিয়ে আমি চলে যাব এখান থেকে। শুধু একবার আমাকে সাহায্য করো। আর কিচ্ছু চাই না আমি।’

হায়দার সাহেবের চোখেমুখে অসহায়ত্বের চাপ। এমন একটা আবদার সামনে তুলে ধরল মাহদিয়া, যা পূরণ করার সাধ্য তার নেই। স্বেচ্ছায় চলে যাওয়া দুটো মানুষকে কোথায় গিয়ে খুঁজে পাবেন আজও জানেন না তিনি। ব্যর্থ কণ্ঠে বললেন,

-‘টোটোন কোথায় আমি তো সেটা জানি না মা। তবে তোর কাজে সাহায্য করতে পারব।’

ঘরের দরজা আটকে ময়লার ঝুড়ি নিয়ে দু’জনেই নিচে নেমে আসলেন। হাঁটতে হাঁটতে মাহদিয়া বলল,
-‘আন্টির কোনো আত্মীয়স্বজন আছেন?’

-‘ভাবী তো নিজের বাপের বাড়ি যাননি কখনও। তবে ওনার বোন একজন সুনামগঞ্জের ওইদিকে থাকেন শুনেছি। কোনোদিন দেখিনি তাঁকে। ওনাদের মূল এলাকাটাও চিনি না। ওনার সাথে ভাবীর বন্ডিং ভালো ছিল, এটাই জানি। এখন ওখানে কি-না, সেটা বুঝতে পারছি না।’

-‘ওনার নাম জানো?’

-‘বেগম সাওদা করীম।’

-‘আমরা কি ওনার বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিতে পারি?’

মাহদিয়ার বোকা বোকা কথায় হেসে ফেললেন ভদ্রলোক। বললেন,
-‘বললাম তো, আমি ওই এলাকা চিনি না। ওখানে গ্রাম, শহর কি একটা? অনেকগুলো তো। কোথায় খুঁজব?’

-‘তারমানে কোনো অপশন নেই!’

মাহদিয়ার ব্যকুল মনের অপ্রকাশ্য আর্তনাদ যেন ছুঁয়ে গেল তাঁকে। এতকাল তিনি শুধু নিজের মায়ের পেটের ভাই দেখে কোনোপ্রকার ঝগড়াঝাটিতে যাননি। শুধু চেয়েছেন, কোনোদিন তাদের খুঁজে পেলে পূণরায় বাড়িতে এনে ঠাঁই দিবেন। বাড়ির কর্ত্রী ছাড়া বাড়ি যে কতটা অসহায়, কতটা একা সেটা এই কয়েক বছরে সবাই-ই টের পেয়েছেন। বিশেষ করে, কায়ছার সাহেব। তবে তিনি যে ভুল করেছেন, অন্যায় করেছেন এটা মানতে নারাজ। কিছু মানুষ দাম্ভিকতা, অযৌক্তিক কথার দ্বারা নিজের অন্যায়ের দিক ঢেকে রাখতে চায়। এমদাদ কায়ছারও তেমনি একজন মানুষ। অতীত যাই হোক, বর্তমানটা হায়দার সাহেবকে বেশি বিব্রত করছে। এইযে, সুদূর ইতালি থেকে ছুটে এসেছে দুটো মানুষের কাছ থেকে একটা প্রশ্নের উত্তর নিতে। সেই উত্তরের পিছনে ছোটা মানেই তো জেনেশুনে মরিচীকার পিছনে দৌড়া। কিন্তু তিনি তাকে বারণ করতে পারছেন না। কারণ, যে উত্তরের জন্য সে ছুটে এসেছে সেই উত্তর একজন পুরুষের জন্য সহজ, স্বাভাবিক, সঠিক সিদ্ধান্ত হলেও একজন মেয়ের জন্য অস্বাভাবিক, কঠিন ও ভুল সিদ্ধান্তের একটা। বিশেষ করে সম্পর্ক নিয়ে! সেই সম্পর্কের ওপর যদি তাকে অল্প বয়সের নিচক কোনো আবেগ। আবেগের বশে লেখা ছোট্ট একটা সিগনেচার। তখন সেই সম্পর্ক থেকে বেরোনোর উপায় কী? যদি মানুষটাকেই খুঁজে না পাওয়া যায়, আদৌ এই বিচ্ছেদ টানা সম্ভব হবে? এমন অনিশ্চিত সিদ্ধান্তের চাপে পড়ে মাহদিয়ার মনের ভেতর এখন বেগতিক তুফান বইছে। সেই তুফান তাকে ভেতর থেকে লণ্ডভণ্ড করে দিলেও মুখের ভাবভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন আসছে না।

***

ঝটপট হাতে রান্নাঘরের সমস্ত কাজ সামলে নিলেন নূরুন্ নাহার। নিজের রুমে এসে বোরখা গায়ে জড়িয়ে ওড়না দিয়ে ভালোমতো মাথা প্যাঁচিয়ে নিলেন। ছোট্ট একটা ভ্যানিটি ব্যাগে যাতায়াত খরচ হিসাব করে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লেন। এখনও সন্ধ্যা হয়নি। নির্দিষ্ট স্থানে যেতে আসতে তার সময় লাগবে আনুমানিক চার ঘণ্টা। বাকি দু’ঘণ্টা সে জরুরী আলাপ সারবে। রাত বারোটার মধ্যে ফিরে আসবে। পঞ্চম শ্রেণী অবধি পড়াশোনা থাকায় সময় ও স্বল্প পরিসরের টাকার হিসাবটা ঠিকঠাকই সামলে নেন এই নিলুফার মা। প্রথম যখন এই বাড়িতে কাজের সন্ধানে আসেন, নিলুফা তখন অনেক ছোটো। আঞ্চলিক ভাষায় কথাবার্তা বলতেন দেখে বেগম সায়রা করীম তাকে বলেছিলেন,

-‘কথাবার্তায় একটু স্মার্ট হও নিলুফার মা। তোমার সব কথা বুঝতে আমার অসুবিধা হয়। অনেক কথা বুঝি না।’

উত্তরে সলজ্জ হাসতেন নিলুফার মা। নিজের অপারগতা স্বীকার করতে খানিকটা লজ্জা পেতেন। সায়রা করীম সেটা বুঝেও যেতেন। তিনি নিজেই খাতা-কলমের সাহায্যে নিলুফার মা’কে পড়াশোনা শেখান। ভাষার ব্যবহার শেখান। দিন, মাস পেরোনোর সাথে সাথে নিলুফার মা-ও বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহারটা আয়ত্তে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। যার কারণে পথিমধ্যে তাকে হোঁচট খেতে হয় না। অচেনা জায়গা ও অপরিচিত লোকের সাথে কথোপকথন সামলে নিতে পারেন।

তিনি উঠোনে পা রেখে দেখলেন মাহদিয়া ও হায়দার সাহেব গল্প করতে করতে পিছনের আঙিনা পেরিয়ে সামনের দিকে আসছেন। দু’জনকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। হায়দার সাহেবকে বললেন,

-‘ভাইজান, আমি রাত বেশি হওয়ার আগেই ফিরে আসব। আমাদের মেহমানদের কয়েক ঘণ্টা মানিয়ে নিতে বলবেন। খাবার-দাবার সব রান্না করা আছে। শুধু সময়মতো খেয়ে নিবেন সবাই।’

হায়দার সাহেব তার তাড়াহুড়ো লক্ষ্য করে বললেন,
-‘এই অসময়ে কোথায় যাচ্ছ?’

-‘একটু গ্রামে যাব ভাইজান।’

গ্রামে নিলুফা ও তার স্বামী আছে। তাদের দুটো সন্তানও আছে। নুরুন্ নাহার মাঝেমধ্যেই মেয়ের কাছে ছুটে যান। নাতি-নাতনীদের সাথে সময় কাটিয়ে আসেন। সময় হোক কি অসময় এই ভদ্রমহিলা এখন রাস্তাঘাটে খুব সুন্দর চলতে পারেন। তাঁর একা যাওয়ার কথা শোনে মাহদিয়া অবাক হলো। বলল,

-‘তুমি কি একা যাবে খালা? ভয় পাবে না? রাস্তাঘাটে যদি কোনো বিপদ হয়!’

নুরুন্ নাহারের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। তবুও তিনি মুখে হাসি ধরে রেখে বললেন,
-‘বেগম সাহেবা একা চলতে শিখিয়ে ছিলেন তো। তারপর থেকে মানিয়ে নিয়েছি। এখন একাই পথ চলতে পারি।’

একটা মানুষ কতটা অমায়িক হলে কাজের মানুষদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করে তাদেরকে শিখতে পড়তে শেখান সেটা জানা নেই মাহদিয়ার। সে শুধু জানে এই বাড়ির কর্ত্রী মানুষ হিসেবে অনন্য। তার তুলনা হয় না। তিনি শুধু সন্তানের জন্য মমতাময়ী ছিলেন না, বরং এই পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের ভরসার জায়গা ছিলেন। সহজ-সরল সুন্দর মনের মানুষটার সাথে এমন অবিচার কীভাবে করলেন তার মামা? বুক ফুলিয়ে আবার বললেন, ধোঁকাবাজি। কে, কাকে ধোঁকা দিল? কার ক্ষতি হলো? একটা মানুষ গোটা জীবন ভালোবেসে, আগলে রেখে, শেষে চড়-থাপ্পড় খেয়ে বিদায় নিল। ইশ! নির্মম সেই দৃশ্যটা চোখে দেখার ক্ষমতা হোতো না মাহদিয়ার। এখুনি তার বুক কাঁপছে। সে চোখ বন্ধ রেখেও সেদিনের দৃশ্য কল্পনা করে কেঁপে উঠল। নূরুন্ নাহারকে বিদায় দিয়ে চলে এলো রুমে। যেখানে আগে টোটোন থাকত।

দরজায় তালা দেয়া দেখে দৌড়ে কায়ছার সাহেবের কাছে গেল মাহদিয়া। তিনি ইজি চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছেন। চোখ দুটো বন্ধ। বুকের ওপর বই, তারওপর হাত। দু’হাতে বই ধরে পড়তে পড়তেই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন। সে নীরবে পুরো রুমে চোখ বুলাল। কোনোকিছুই যে আগের মতো নেই, সেটা দেখে মন খারাপ হলো। খানিকক্ষণ চোখ ঘুরিয়ে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা হাতের কাছে না পেয়ে বলল,

-‘বড়ো মামা, জেগে আছো?’

-‘হুম্ কিছু বলবে?’

মনে সাহস ধরে রাখার চেষ্টা করল মাহদিয়া। চেয়ারের হাতলে হাত রেখে ফ্লোরে হাঁটুভেঙে বসল। আমতা-আমতা করে বলল,
-‘টোটোনের রুমের চাবিটা কার কাছে?’

বকা খাওয়ার ভয়ে চোখ বন্ধ করে রইল মাহদিয়া। কায়ছার সাহেব এবার সোজা হয়ে বসলেন। হাতের বই টেবিলে রেখে চোখে চশমা পরে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। চোখ খুলে এই ভয়ানক চাহনি দেখে ভরকে গেল মাহদিয়া। বলল,

-‘ওই রুমে কিছু জরুরী কাজ ছিল।’

-‘ওখানে প্রবেশ করা নিষেধ!’

গমগমে গলায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তিনি পূণরায় চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিলেন। মাহদিয়া হাতদুটো মুঠোবন্দী করে মেজাজ ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করল। এইভাবে মানুষটার সাথে এক্ষুণি তর্কে নামবে না। তার এত বড়ো স্পর্ধাও হয়ে যায়নি। তবে একবার যদি টোটোনকে পেয়ে যায়, তাহলে সব ঝুটঝামেলার মোকাবেলা করবে! আগে তো জানতে হবে, টোটোন এখন দেখতে কেমন হয়েছে? আগের মতোই তুলোর বস্তা না-কি পাটখড়ি? নিষেধ শোনেও বেয়াদবের মতো বলল,

-‘ওই রুমে যাওয়ার অধিকার আমার আছে। তুমি আমাকে নিষেধ করতে পারো না।’

এইটুকু মেয়ের মুখে অধিকারের হিসাব দেখে অবাক হলেন তিনি। থমথমে মুখে তাকিয়ে রইলেন। যেন মাহদিয়ার মুখ থেকে এই কথা আশা করেননি তিনি। এড়িয়ে যাবেন সে-ই উপায়ও নেই। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে চাবি হাতে নিলেন। এগিয়ে এসে সেটা মাহদিয়ার হাতে তুলে দিয়ে বললেন,

-‘ও একটা বেয়াদব ছেলে। এমন বেয়াদব ছেলেকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না। ও মরুক কী বাঁচুক, এসব নিয়ে তোমার এত মাথা ঘামানোর দরকার নেই।’

হাতের মুঠোয় চাবি নিয়ে নির্ভার হাসি ফুটাল মাহদিয়া। পূণরায় বেয়াদবি দেখিয়েই টানটান গলায় বলল,
-‘দেশের বাইরে ছিলাম, তারমানে এই না যে, আমি আমার ধর্মীয় রীতিনীতি ভুলে গেছি। ওই সময়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ছিল না, তা-ই গুরুজনদের আদেশ-হুকুম মেনে নিয়ে দু’জনেই একটা কাগজে সাইন করেছিলাম। ধর্মীয় নিয়ম ও রাষ্ট্রীয় নিয়ম, দুটো মেনে নিয়েই বাল্যবিবাহকে গ্রহণ করেছিলাম। তখন বিয়েটা ভুল না হলেও এখন মনে হচ্ছে, সেদিন যা হয়েছে তা ভুল। অবুঝ হওয়ায়, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। এই কারণে, টানা এক বছর আমরা ফোনে শুধু ঝগড়াঝাঁটি করেছি। এমনকি বিদায়ের দিনও। সেই একটা সিগনেচারের জন্য আমি আমার জীবন সাজাতে পারছি না। যে ভুল তোমরা করেছ, সেই ভুল শোধরে আমি ইতালি ব্যাক করব। আর এরজন্য টোটোনকে আমার দরকার।’

***

চলবে…