বকুলতলা পর্ব-০৮

0
325

বকুলতলা

৮.
মাহাদের সাথে রিকশা চালকের একপ্রকার ঝগড়াই লেগে যাচ্ছিল। সেটা বেশি দাম চাওয়ায় নাকি অন্য কিছু, তরী বুঝতে পারছে না। সামলাতেও পারছে না মাহাদকে। লোকটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেছে। বারবার তেড়ে যাচ্ছে রিকশা চালকের দিকে। চোখ-মুখ কাঠিন্যে ভরপুর। দম ফেলছে না প্রায়। নিশ্বাস আটকে মুখশ্রী লাল করে ফেলেছে।
দিক বেদিক শূণ্য হয়ে তরী মাহাদের বাহু খামছে ধরলো, “মাহাদ! চলুন এখান থেকে! রাস্তার সবাই দেখছে। কি শুরু করেছেন?”

মাহাদ জবাব দিলো না। পরোয়া করলো না একদমই। বাধ্য হয়ে তরীকেই জোড় করে টেনে আনতে হয়েছে। রিকশা চালকটার ভাষা বড্ড বিশ্রী! আজেবাজে কথা বলছিল শুধু। ওগুলো শোনাও পাপ। মাহাদ যেতে যেতে পেছন ফিরে আরেকবার দেখে নিলো রিকশা চালকটাকে। ভীষণ রাগী গলায় বললো, “ওই ব্যাটার চোখদু’টোয় পেন্সিল ঢুকিয়ে দিবো আমি! শুধুমাত্র তোমার জন্য লোকটাকে কিছু করতে পারিনি। আরও কয়েকটা গালি দেওয়ার দরকার ছিল।”
তরী হতাশ নয়নে তাকালো। মাহাদ মুখ গম্ভীর করে রেখেছে। নিশ্বাসের আনাগোনায় ক্ষিপ্ততার স্বতঃস্ফূর্ত আভাস। সরল কণ্ঠে জানতে চাইলো, “মাথা গরম কেন? কি করেছে লোকটা?”
মাহাদের সব রাগ, তেঁতো মেজাজ যেন তরীর ওপর পরলো এবার। উচ্চস্বরে ধমকে উঠলো, “তুমি না মেয়ে? বেয়াদবটা যে প্রথম থেকে তোমার দিকে বাজে নজরে তাকাচ্ছিল, খেয়াল করোনি? এভাবে চলাফেরা করো রাস্তায়? বাহ্!”
—“এটুকুই কারণ?”

কুঁচকে থাকা কপালের ভাঁজগুলো একটু একটু করে বেড়ে গেল। চোখ তুলে পাশের মেয়েটাকে দেখলো সে। বেগুনি রঙের জামা পরনে। পাতলা ওড়নাটাও কি সুন্দর করে শরীর ঢেকে রেখেছে। মাহাদ প্রথমে তরীর স্থির মুখটির পানে বেশক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ভেতরে ভেতরে তেক্ত হয়ে উঠলো, এই শান্ত, স্নিগ্ধ মেয়েটার ওপর কিভাবে এতটা বাজে নজর দিতে পেরেছে আধবুড়ো লোকটা? যেন চোখ দিয়েই গিলে খাচ্ছিল বুকের কাপড়ের আবৃত অংশ।
মাহাদের মেজাজ আবারও বিগড়ালো। তীব্র হলো অসহ্য অনুভূতি। অশান্ত হলো সবকিছু।

—“তোমার কাছে এটুকু কারণ মনে হয় এটা?”
—“আগে মনে হতো না। এখন হয়। আপনি তো মাত্র আজকেই দেখলেন। আমরা তো প্রতিদিন সহ্য করি। আর বললেন না? আমি মেয়ে হয়ে কিভাবে খেয়াল করিনা এসব? আমি খেয়াল করি মাহাদ। সব বুঝতে পারি। বাম দিকে তাকান, কালো প্যান্ট-শার্ট পরা একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। সে কিন্তু আমার দিকে ওই নজরেই তাকাচ্ছে।”

মাহাদ তৎক্ষণাৎ বাম দিকে তাকালো। দুই লাইনের সাধারণ রাস্তা। মাঝখানে অল্পসল্প গাছগাছালি লাগানো। সেই গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে লোকটাকে স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ তার নজর তরীর দিকেই ছিলো। মাহাদকে তাকাতে দেখে এমন ভাব করলো, যেন সে নিস্পাপ, ভাঁজা মাছটাও উলটে খেতে পারে না।
মাহাদ এমনিতেই মাথা গরম মানুষ। তরী কথাগুলো বলতে চায়নি। পাছে যদি লোকটাকে কিছু করে ফেলে সে? শুধুমাত্র বাস্তবতা বুঝাতে চেয়েছিল। এখন ভয় লাগছে। মাহাদের দৃষ্টি স্বাভাবিক না। লোকটাকে মনে মনে কতবার যে মেরে ফেলেছে, তার ইয়ত্তা নেই! কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মাহাদ কিছুই করলো না। বরং নির্বিকার ভঙ্গিতে তরীর আঙুলগুলো হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলো সে। কোমল ভাবে আগলে ধরলো। ভাবখানা এমন, তরীকে সব খারাপ দৃষ্টি থেকে আড়াল করে ফেলছে সে। কি ভীষণ নম্র-ভদ্র! তরী অল্প হাসলো। আলতো স্বরে বললো, “এখন তো কেউ দেখছে না। হাত ছাড়ুন।”
মাহাদের একরোখা উত্তর, “না দেখুক।”
তারপর আবার বললো, “তুমি একা একা আর কোথাও বের হবে না। আমাকে কল করবে। আমি আসবো। রিকশা ঠিক করে দিবো।”
তরী বিস্ময় নিয়ে বললো,
—“শুধু রিকশা ঠিক করে দিতে আসবেন? সেটা তো আমিও পারি।”
—“এখন থেকে কিভাবে রিকশা ঠিক করতে হয় ভুলে যাও। এ বিষয়ে তুমি মূর্খ।”
—“আমি মূর্খ?”
—“আগে ছিলে না। এখন থেকে মূর্খ।”
অধরের ক্ষীণ হাসিটা মিইয়ে গেল। উদাস নেত্রে মাহাদকে পরখ করলো সে। দেখলো। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আমার জন্য এতটা করার প্রয়োজন নেই মাহাদ। অভ্যাস হারালে কষ্ট পাবেন।”
মাহাদ এবার একটুখানি চুপ থাকলো। তারপর মুচকি হেসে বললো, “আমি আমার অভ্যাস হারাতে দিবোই না। তাছাড়া তোমার দিকে কেউ খারাপ চোখে তাকালে আমার ভেতরটা জ্বলে যায়।”

তরী চুপচাপ হাঁটতে লাগলো মাহাদের সঙ্গে। আর কিছু বললো না। সে জানে, মাহাদের তাকে রিকশা ঠিক করে দেওয়াটাই মূখ্য উদ্দেশ্য না। বাইকে করে তরীর পিছু পিছি এসে দেখা, রিকশা চালকটা আসলেই তরীকে নিরাপদ ভাবে পৌঁছে দিয়েছে কিনা! তরীর উদাসীনতা বেড়ে যায়। লোকটা কেন আরও আগে এলো না তার জীবনে? তাহলে হয়তো তাকে ভালোবাসার বিশাল বাঁধাটাও থাকতো না।

ফোনের স্ক্রীনে একটা গ্রামীণ নম্বর তুলে রাখা। তরীর বাবার নম্বর। প্রায় দু’সপ্তাহ আগে রাশেদ আকবরের সঙ্গে কথা হয়েছিল তার। এরপর না ওপাশ থেকে কল এসেছে, না এপাশ থেকে কল দেওয়া হয়েছে। তরী একটু দুরুদুরু মনেই কল লাগালো নম্বরটায়। রিং হলো। কল রিসিভ হলো। নিরবতা চললো কিছুক্ষণ। রাশেদ আকবরের কাঁপা কণ্ঠ শোনা গেল,
—“মা? কেমন আছিস?”

উপচে আসা কান্নাটা গিলে ফেললো তরী। মলিন গলায় জবাব দিলো, “আলহামদুলিল্লাহ বাবা। তুমি কেমন আছো?”
—“আমি আছি কোনোরকম। ঢাকায় কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? তোর মামী কি তোকে এখনো অপমান করে?”
—“ঢাকা শহর অনেক সুন্দর বাবা। সবাই অনেক ভালো। মামীও আর বকেন না।”
তরী কি মিথ্যেটা ভালোভাবে বলতে পারলো? পারলো না বোধহয়। রাশেদ আকবরের কণ্ঠেই বোঝা গেল সেটা। তিনি ঠুকরে উঠলেন, “ওখানে কি বেশি অসুবিধা হচ্ছে মা? টাকা হাতে এখনো পাই নাই। তুই অন্য বাসা খুঁজ। যা লাগে আমি পরে দিয়ে দিবো।”
—“বার্তি টাকা দিতে হবে না বাবা। আমি অনেককে বলে রেখেছি। কয়েকদিনের মাঝে কোনো একটা চাকরি পেয়ে যাবো। তখন বান্ধবীদের নিয়ে একটা নতুন বাসা খুঁজবোনে। তুমি চিন্তা কইরো না।”

রাশেদ আকবর শান্ত হলেন না। বাবার অসহায় কণ্ঠ, ঠুকরে ওঠা তরীকে যেন আরও দূর্বল করে দিলো। কোনোমতে কথা কাটিয়ে কল কেটে দিলো সে। প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলতে ফেলতেই আবার দরজায় কারাঘাত। সালেহার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। অস্পষ্ট কিসব বকছে মেয়েটা!
তরী গায়ের ওড়না ঠিক করলো। দরজা খুলে দিতেই সালেহা বকবক করে উঠলো, “প্রণয় ভাইজান আইছে আপা। আজকে মনে অয় মেজাজ ভালা নাই ভাইজানের। চোখ-মুখ কেমন করি রাখছে! এত যে কিল্লাই রাগে!”

তরী শুনলো। তবে কোনোরুপ আগ্রহ দেখা দিলো না। ক্লান্ত স্বরে বললো, “আজকে আমার ভালো লাগছে না সালেহা। তুমি প্রণয় ভাইয়াকে খাবার-দাবার একটু বেড়ে দিও?”

সালেহা যেন আঁতকে উঠলো, “কি কও আপা? বেশি খারাপ লাগতাছে?”
—“আমি ঠিক আছি সালেহা। শুধু একটু ক্লান্ত লাগছে। ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে।”

সালেহা তিন, চারবার পলক ঝাপটে বললো, “আইচ্ছা তাইলে তুমি ঘুমাও। আমি ভাইজানরে খাওন দিয়ে দিমুনে।”

____________

চলবে~