বকুলের বাস্তবতা পর্ব-০১

0
551

#বকুলের_বাস্তবতা
#সূচনা_পর্ব
#লেখক_দিগন্ত

আমার প্লেট থেকে মুরগীর লেগপিছটা তুলে নিয়ে নিজের ছেলের প্লেটে দিতে দিতে আমার ফুফু বলতে লাগল,
-“আমার ভাইয়াকে তো খেয়েছিস।এখন আবার মুরগীর লেগপিছটাও খেতে হবে।”

আমি মাথা নিচু করে রইলাম।এক সপ্তাহ আগেই আমার আব্বু হার্ড এট্যাক করে মারা গেছে।আমার আব্বু-আম্মুর ডিভোর্স অনেক আগেই হয়ে গেছে।তারপর থেকে আমি আব্বুর সাথেই ছিলাম।আব্বুর রাজকন্যা ছিলাম আমি।শুনেছি আমার আম্মু নাকি আবার বিয়ে করে নিয়েছে।তাই বাধ্য হয়ে ফুফুর বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছে।আমার যে আর আপন বলতে কেউ নেই।

আমার ফুফা রেগে ফুফুকে বলতে লাগল,
-“এটা কি করলে মেহের? তোমার থেকে এরকম ব্যবহার আশা করিনি।মেয়েটা অনাথ।ওর সাথে এরকম ব্যবহার করলে আল্লাহ তায়ালা কোনদিনও তোমায় ক্ষমা করবে না।”

আমার ফুফা একজন ধার্মিক ব্যক্তি।আমাকেও তিনি অনেক স্নেহ করেন।তিনিই আমায় এই বাড়িতে নিয়ে এসেছেন।

আমার ফুফাতো ভাই রবীন মুরগীর লেগপিছটা আবার আমার প্লেটে তুলে দিয়ে বলল,
-“আমি কারো এঁটো খাবার খাইনা।যার খাবার সেই খাক।আম্মু তুমি আমায় আরেকটা লেগপিছ দাও।”

ফুফু আর কথা বাড়ালো না।আমার দিকে একবার রাগী চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে করতে রবীন ভাইয়ার প্লেটে আরেকটা মুরগীর লেগপিছ তুলে দিল।
____________
খাওয়া শেষ করে ঘরে এসে বসে আছি।আমার আশ্রয় হয়েছে ফুফুদের বাড়ির একটি চিলেকোঠার ঘরে।ফুফা প্রথমে এই ব্যাপারে খুবই আপত্তি করেন।কিন্তু ফুফু নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন।ঝামেলা এড়াতে আমিও এই ঘরে থাকতে রাজি হয়ে যাই।তাই ফুফাও আর কিছু বলতে পারেন না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি ভাবতে থাকি আমি এরপর কি করব।এইবছর মেডিকেলে পরীক্ষা দিয়েছি।আব্বুর ইচ্ছে ছিল আমায় ডাক্তার বানাবে।দুদিন আগেই পরীক্ষার ফলাফল দিল।একটুর জন্য মেডিকেলে চান্স পেলাম না।আব্বুর ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারলাম না ভেবে খারাপ লাগছে।

কিন্তু এভাবে থেমে থাকলে হবে না।আমায় কিছু একটা তো করতে হবে।ভেবে দেখলাম কোন পাব্লিক ভার্সিটিতে কি চান্স পাওয়া যেতে পারে? প্রাইভেটে পড়ার সামর্থ্য আমার নেই।এখন সবটাই ভাগ্যের উপর।

আমার এসব ভাবনার মধ্যেই ফুফু আমার ঘরে চলে আসলো।তাকে দেখে আমি থতমত খেয়ে যাই।ফুফু আমার কাছে এসে বসল।

আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
-“তখনকার ব্যবহারের জন্য আমার উপর রাগ করে আছিস বকুল? আমি কি করব বল? ভাইয়ার এরকম অকালমৃত্যুতে মনটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল।তাইতো…তুই আমার উপর মন খারাপ করে থাকিস না।”

-“না ফুফু।আমি মন খারাপ করিনি।আমি তো সব বুঝি।”

-“তাহলে এটাও তো বুঝিস আমাদের আর্থিক অবস্থা অতোটা ভালো না।তোর বাবা তো একটি ব্যাংকে চাকরি করতো।এখন নিশ্চয়ই তার মৃত্যুর পর ব্যাংক থেকে তোকে টাকা দেওয়া হবে।”

ফুফুর কথায় আমার মনে পড়ল।তাইতো এই টাকা দিয়েই তো আমি পড়ালেখা করতে পারি, নিজের সব চাহিদা পূরণ করতে পারি।তাই ফুফুকে বললাম,
-“হুম ফুফু বুঝেছি।তুমি কোন চিন্তা করোনা আমি তোমাদের উপর আর বোঝা হয়ে থাকব না।আব্বুর ব্যাংক থেকে টাকা পেলেই আমি এই বাড়ি থেকে চলে যাবো।”

ফুফু বেশ রেগে গিয়ে বললেন
-“বকুল তুই কি পাগল হলি নাকি? এই শহরে তোর আর কোথায় যাওয়ার যায়গা আছে।তাছাড়া একটা মেয়ের এভাবে একা থাকা মোটেও ঠিক নয়।আমি তোর ফুফু আছি না।আমি কি তোকে ফেলে দেব নাকি? তুই একটা কাজ কর কাল ব্যাংকে গিয়ে টাকাগুলো তুলে নিয়ে আয়।তারপর টাকাগুলো আমার হাতে তুলে দিস।আমি তোকে দেখে রাখব।”

ফুফুর এমন মিষ্টি কথায় আমি গলে যাই।আর সিদ্ধান্ত নেই ফুফু যা বলছে তাই করবো।
ফুফুকে কথাটা বলতেই তিনি একগাল হেসে বলেন,
-“আজ রাতে তোর পছন্দের কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করব।তুই খেতে চলে আসিস।”

আমি মুচকি হেসে মাথা নাড়ালাম।আসলে ফুফুদের অবস্থা ওতোটাও খারাপ না।ফুফা ব্যবসা করে বেশ ভালোই রোজকার করে।কিন্তু ফুফু খুব উচ্চাকাঙ্খী।তিনি আরো ভালোভাবে জীবনযাপন করতে চান।
.
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে নেই।তারপর জানালার পাশে বসে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি।আব্বুর কথা খুব মনে পড়ছে।আজ আব্বু বেঁচে থাকলে হয়তো আমার জীবনটা এরকম হতোটা।আল্লাহর কাছে আমার আব্বুর জন্য দোয়া করতে থাকি।আমার আব্বু যেন জান্নাতবাসী হয়।

ভাবনার মধ্যেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি খেয়াল করিনি।ফুফুর ডাকে আমার ঘুম ভেঙে যায়।নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ১০ টা বেজে গেছে।ফুফু আমায় বলতে লাগল,
-“আমি সকালের নাশতা তৈরি করেছি খেয়ে তাড়াতাড়ি ব্যাংকে চলে যা।যাওয়ার সময় তোর বাবার কিছু কাগজপত্র নিয়ে যাস।তাহলেই ওরা তোর হাতে চেক তুলে দেবে।”

ফুফুর কথায় বাধ্য মেয়ের মতো আমি সব কাজ করতে থাকি।সকালের নাস্তা শেষ করে ব্যাংকে চলে যাই।ব্যাংকে আমার আব্বুর কিছু কলিগ ছিল যারা আমায় চিনত।তারা আমার খোঁজখবর নেয়।তাদের সাহায্যে খুব সহজেই আমি ব্যাংকের ম্যানেজারের কাছ থেকে ২০ লক্ষ টাকার একটা চেক পাই।

চেকটা নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসি।আমাকে আসতে দেখে ফুফু ছুটে আসে।তারপর হাফাতে হাফাতে জিজ্ঞাসা করে,
-“কিরে চেক পেলি?”

-“হুম।”

-“দে চেকটা আমায় দে।”

আমিও ফুফুকে ভরসা করে তার হাতে চেক তুলে দিলাম।চেকটা হাতে নিতেই ফুফুর চেহারা বদলে যায়।তার চোখ লোভে চকচক করছিল।তিনি আমাকে আর কিছু না বলে চেকটা নিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যান।আমি বোকার মতো সেখানে দাঁড়িয়ে থাকি।
______________
দুপুর ২ টো বেজে গেছে।আমি সেই কখন থেকে ঘরে বসে আছি অথচ ফুফু একবারও আমায় খাওয়ার জন্য ডাকল না।এদিকে ক্ষিধেয় আমার পেট ব্যাথা করছে।

কিছুক্ষণ বাদেই ফুফু আমার ঘরে আসল।এবার আর আগের মতো মিষ্টি ব্যবহার করলেন না।আমায় কটু কথা শোনাতে শোনাতে বললেন,
-“তোকে কি এখানে বসে বসে খাওয়ানোর জন্য এনেছি? এই নে খেয়ে নে।খেয়ে আমায় উদ্ধার কর।”

আমি খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তেমন কিছুই নেই।শুধু ভাত,ডাল আর একটু লালশাক।

আমি কোন প্রতিবাদ করলাম না।চুপচাপ খেতে শুরু করলাম।ফুফু যাওয়ার আগে বারবার করে বললেন,
-“খেয়ে সব ধুয়ে রাখবি।আর এভাবে বসে বসে খেতে পারবি না।আজ থেকে সব কাজে আমায় সাহায্য করবি।”

আমিও ফুফুর কথায় মাথা নাড়ালাম।বড়দের মুখের উপর কথা বলার শিক্ষা যে আব্বু আমায় দেয়নি।আমার আব্বু সবসময় বলতেন,
-“শোন বকুল, গুরুজনদের সাথে সবসময় ভালো ব্যবহার করবি।তারা যা বলবে তাই করবি।”

কিন্তু ফুফুর এরকম ব্যবহার যে আর আমার ভালো লাগছিল না।ইচ্ছে করছিল এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে।ভাবলাম ফুফুর কাছ থেকে চেকটা নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।কিন্তু পরে ভাবলাম ফুফু হয়তো এতে মন খারাপ করবে।তাই আর কথা বাড়ালাম না।
~~~~~~~
রাতে ফুফুকে রান্নার কাজে সাহায্য করছিলাম।জীবনে কোনদিনও রান্না করে খাইনি।আব্বু সবসময় অফিস থেকে এসে নিজে আমায় রান্না করে খাওয়াতেন।আমায় কখনো রান্নাঘরে ঢুকতে দেননি।আজ ভাগ্যের পরিহাসে আমায় কিনা রান্না করতে হচ্ছে।

হঠাৎ হাতে জ্ব*লে যাওয়ার মতো অনুভব করলাম।বেগুন ভাজতে গিয়ে তেল ছিটকে পড়েছে।ব্যাথায় ডুকরে উঠলাম আমি।ফুফু পাশ থেকে আমায় ধমক দিয়ে বলল,
-“একটা কাজও ঠিকমতো করতে পারিস না।বিয়ের পর কিভাবে শ্বশুরবাড়িতে থাকবি?”

ফুফুর কথায় আমি অবাক হয়ে যাই।বিয়ের কথা আসছে কোথা থেকে? কি চলছে ফুফুর মনে? আমি তো বিয়ে করতে চাইনা আমায় পড়াশোনা করতে হবে।

ফুফু বিড়বিড় করতে করতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল।দেখলাম বাইরে গিয়ে ফুফু কারো সাথে কথা বলছে।কথা বলার মাঝে বারবার “বকুল” বলছে।আমার ব্যাপারে কি বলছে জানার খুব আগ্রহ হলো।তাই আমিও ফুফুর কাছাকাছি চলে গেলাম।গিয়ে এমন কিছু শুনলাম যা শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।
(চলবে)