বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে পর্ব-৩+৪+৫

0
666

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_৩
#Esrat_Ety

“এই নেংটি ইঁদুর দুটিকে কোথা থেকে ধরে আনলি রে জামিল। এদের কি করবি?”

_হুস!
ঠোঁটে আঙুল চেপে আরাফকে চুপ করিয়ে দিয়ে জামিল ফিসফিসিয়ে বলে,”কথা বলিস না। ভাইয়ের মাথা খুবই গরম আছে। কানের নিচে খাবি।”

আরাফ গলার আওয়াজ জামিলের থেকেও নিচু করে বলে,”কিন্তু এরা কারা? এই ছেলে দুটোকে আঁটকে রেখেছিস কেনো?”

_সময় আসুক। বুঝতে পারবি।

“জামিল”

ফুয়াদের ডাক শুনে দৌড়ে সেখানে চলে যায় সে। ফুয়াদ সামিন ইয়াসারের পাশে বসে আছে। ইয়াসারের মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। চুপচাপ বসে আছে সে। জামিল গিয়ে ফুয়াদকে বলে,”জ্বি ভাই বলেন।”
_হাসপাতালে ফুল নিয়ে গিয়েছিলি?
_জ্বি।
_কি হয়েছে সেখানে।
_মেয়েটা ফুলের তোড়া পায়ের নিচে ফেলে কুচলে দিয়েছে আর বলেছে সামিন ইয়াসারকে যেন বলে দেই এসব নাটক জনগণের সাথে করতে।

ফুয়াদ কথাটি শুনে সাথে সাথে সামিন ইয়াসারের দিকে তাকায়। সামিন বলে,”দেখলি! বলে ছিলাম না? আগা গোড়া তেজে ভরা। ওর তেজ আজকে ভাঙবো। আসুক একবার।”

রাহাত নামের একটি ছেলে পাশ থেকে বলে ওঠে,”হ ভাই। মেয়েটা ভীষণ জাঁদরেল। একটা কাহিনী বলি শোনেন। ওর কলেজের পাশে মঞ্জুর চায়ের দোকান আছে না? একদিন সেখানে আনোয়ারের গ্যাং কলেজ ছুটির সময় বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। তো আলো ওর বান্ধবীদের সাথে দোকানের পাশ দিয়ে যাবার সময় আনোয়ারের দলের একটা ছেলে ব্যাড কমেন্ট করে । আলো এসে সরাসরি সেই ছেলের মুখোমুখি দাঁড়ায়। চোখে চোখ রেখে বলে,”নাম কি?”

ছেলেটা হাসতে হাসতে বলে,”নাম দিয়ে তোমার কাম কি? প্রেম করতে চাও কি?”

আলো ঠান্ডা গলায় বলে,”আমি এখন একটা ইট এনে তোর বিচি থেঁতলে দেবো। হসপিটালে এডমিট করার সময় তোর নাম জিজ্ঞেস করলে তখন কি নাম বলবো?”

রাহাত কথাটি বলে শেষ করতে পারে না ফুয়াদ,জামিল এবং অন্যরা উচ্চশব্দে হেসে ফেলে। সামিন ইয়াসার কটমট দৃষ্টি দিয়ে ফুয়াদের দিকে তাকাতেই ফুয়াদ অনেক কষ্টে হাসি বন্ধ করে। বাকিরাও নিশ্চুপ হয়ে যায়। সামিন ইয়াসার বিড়বিড় করে বলে,”আসুক আজ।”

জামিল বলে,”ভাই পোলা দুইটা অনেক কাঁদছে।”

_ধমকাধমকি করিস না। যা করার ওর বোনের সাথে করবো।

গম্ভীর কন্ঠে বলে সামিন ইয়াসার। তারপর বলে,”এখানে নিয়ে আয় দুটোকে।”

দু-তিন জন গিয়ে আজান আর আয়াতকে নিয়ে আসে। দু’জনেই ভয়ে কাঁপছে। তাদের এনে সামিন ইয়াসারের সামনে রাখা হয়। আয়াত কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”ভাইয়া ওনাদের বলুননা আমার চশমাটা দিয়ে দিতে। চশমা ছাড়া আমার ভীষণ অসুবিধা হয়।”

সামিন ইয়াসার গম্ভীর কন্ঠে বলে,”তোমাদের আপু আসুক। সব দিয়ে দেওয়া হবে তোমাদের।”
কয়েক মুহূর্ত কাটে,আয়াতের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা মায়া হয় সামিনের,জামিলকে বলে,”ওর চশমা দে।”
জামিল চশমা এনে দেয়।

রিকশা থেকে নেমে আলো চারপাশে তাকিয়ে আন্ডার কন্সট্রাকশন বিল্ডিংটা খুঁজে বের করে। বিল্ডিং টা আজান আয়াতের কোচিংয়ের ঠিক পাশেই। দ্রুত পায়ে হেঁটে সে গেইটের ভেতরে প্রবেশ করে। নিজের দিকে তাকিয়ে গায়ের ওড়নাটা ঠিক ঠাক আছে কিনা দেখে নেয়। ফোনে সব বন্ধুদের মেসেজ দিয়ে রেখেছে সে, বিপদের আভাস পেলেই একটা ফোন করবে। অসম্পূর্ণ হয়ে পরে থাকা গ্রাউন্ড ফ্লোরে উঠে সে দাঁড়িয়ে পরে, মৃদু স্বরে বলে,”আয়াত, আজান।”

আয়াত আজান আলোর কন্ঠ শুনতে পেয়ে যেন দেহে প্রান ফিরে পায়। মাথা ঘুরিয়ে আলোর কাছে একপ্রকার দৌড়ে যায়। আলো দুহাতে দুই ভাইকে আগলে নেয়। উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”কি হয়েছে? কি হয়েছে তোদের?”

_আপু ওই লোকগুলো আমাদের এখানে আটকে রেখেছে।

সামিন ইয়াসারের দিকে আঙুল তুলে বলে আজান। আলো চোখ কপালে তুলে ফেলে,আজান আয়াতকে সরিয়ে দিয়ে বলে,”আটকে রেখেছে মানে!”

দ্রুত পায়ে হেঁটে আলো সামিন ইয়াসারের মুখোমুখি দাঁড়ায়। চোখে চোখ রেখে বাজখাঁই গলায় বলে,”এসব কোন ধরনের অসভ্যতামি? আমার ভাই দুটোকে আটকে রেখেছেন কেনো?”

সামিন ইয়াসার আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোনো এক অজানা কারনে সে চোখ ফেরাতে পারছে না, না পারছে আলো নামের এই বিচ্ছু মেয়েটিকে কিছু বলতে। পাশ থেকে জামিল বলে ওঠে,”ভাইয়ের সাথে চোখ নামিয়ে কথা বলুন। বেয়াদবি ভাইয়ের পছন্দ না।”
আলো একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,”যার গালে দুদিন আগে চড় মেরেছি,এখন তার সাথে চোখ নামিয়ে কথা বলতে হবে?”

সামিন ইয়াসার রাগে অন্ধ হয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে। ইচ্ছে করছে এই পাচ ফুটের মেয়েটার চোয়াল চেপে ধরতে। অনেক কষ্টে সে ইচ্ছে টাকে দমন করেছে। আলো জামিলের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার ছোটো ভাই দুটোকে হেনস্থা করা হচ্ছে তাই না? আমি এক্ষুনি পুলিশ ডাকছি।”

“পুলিশ তো আমরাই ডাকতে পারি ম্যাডাম অদ্রিতা আলো। কিন্তু সেটা চাই না বলেই তোমাকে এখানে ডেকেছি।”

ফুয়াদ বলে কথাটা। আলো ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে,”মানে?”

_মানে তোমার এই গুণধর দুই ভাইয়ের ব্যাগে ইয়াবা পাওয়া গিয়েছে।

আলোর মনে হলো তার সামনের পৃথিবীটা নড়ে উঠেছে। কাঁপছে সবকিছু। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”মানে।”

পাশ থেকে আজান বলে ওঠে,”আপু মিথ্যা কথা। একেবারেই মিথ্যা কথা । ওগুলো দু’টো লোক জোর করে ব্যাগে ভরে দিয়েছে আমার। বিশ্বাস করো তুমি।”

আলো একটা দম নিয়ে নেয়। বুদ্ধিমতি আলোর বুঝতে একটুও বাকি নেই ব্যাপারটা আসলে কি। সে সামিন ইয়াসারের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,”বুঝলাম। তো আপনার লোকেরা কিভাবে জানলো আমার ভাইদের ব্যাগে ইয়াবা আছে?”

জামিল বলে,”নিজেদের চোখে দেখেছি কারো সাথে আদান প্রদান করছিলো। দেখে তো মনে হচ্ছিলো না কেউ জোর করছিলো। তারপর গিয়ে ধরলাম।”
আলো সামিনের দিকেই তাকিয়ে আছে। সামিন এখনো চুপচাপ। আলো আটকে আটকে বলে,”আমার উপরে প্রতিশোধ নিতে আমার নিষ্পাপ ভাই দুটোকে ব্যবহার করলেন? আপনি কতটা জঘন্য একটা লোক।”

সামিন হঠাৎ করে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,”আমার ভাই দুটোকে ছেড়ে দিন। অনুরোধ করছি আপনার কাছে।”
_এতো সহজে না,হাতে নাতে ধরেছি। পুলিশে দেবো। আপনি থানায় গিয়ে ছাড়িয়ে আনুন।

জামিলের কথায় আলো কিছুটা ঘাবড়ে যায়। আজান আয়াতের দিকে তাকিয়ে দেখে ছেলে দুটোর চোখ ছলছল করছে। আলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”তোরা একটু ওদিকে গিয়ে দাঁড়া আজান আয়াত। আমি কথা বলছি।”

দুজনে বাধ্য ছেলের মতো দূরে গিয়ে বসে থাকে। আলো সরাসরি সামিন ইয়াসারের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,”ক্ষমা চাইছি। আমার ভুল হয়েছে। আমার ভাই দু’টোকে ছেড়ে দিন।”

জামিল বলে,”এতো শুকনো কথায় তো চিড়ে ভিজবে না আপা। আপনার কারনে ভাইয়ের কতখানি সম্মান নষ্ট হয়েছে জানেন?”

_তো আমাকে আর কি করতে হবে? মাফ তো চাইলাম।

_হুস। আস্তে কথা বলেন আপা। গলায় তো আস্ত একটা মাইক নিয়ে ঘোরেন।
একজন ছেলে বলে ওঠে ইয়াসারের পেছন থেকে।

জামিল বলে,”তেমন কিছু না। শুধু ভাইয়ের পা ধরে ক্ষমা চাইতে হবে আপনাকে।”

আলো কথাটি শুনে হতভম্ব হয়ে সামিন ইয়াসারের দিকে তাকায়। ইয়াসার তার দিকে উপহাস এবং ক্ষোভের মিশ্র দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। আলো তেজী কন্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে,”অসম্ভব!”

_সম্ভব আপা।
আলো জামিলের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে বলে,”আমি এখান থেকে এই মুহূর্তে আমার ভাইদের নিয়ে যাচ্ছি দেখি আমাকে কে আটকায়।
কথাটি বলে ঘুরে দাঁড়ায় আলো। জামিল বলে,”তার আগে এটা দেখে নিন।”

আলোর দিকে একটা ফোন এগিয়ে দিয়ে বলে জামিল। আলো কপাল কুঁচকে ফোনটা হাতে নেয়। ছবিতে আজান আর আয়াত ইয়াবা হাতে কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওদের দিয়ে জোর করে এসব ছবি তোলা হয়েছে। আলো দ্রুত ছবি গুলো ডিলিট করে ফেলে। জামিল হেসে বলে,”ছবিগুলো ভাইয়ের ফোনে আছে। ডিলিট করে লাভ নেই।”

আলো রেগে গিয়ে বলে,”জানোয়ারের দল। তোরা দেশের সেবা করিস? অমানুষ। ছিঃ। আজ ক্ষমতা আছে তাই করছিস,কাল তো থাকবে না! তখন?”

_আপনি ভাইয়ের পা ধরে ক্ষমা চাইবেন না তাইনা? ঠিকাছে,ভাইদের নিয়ে যান। আমরা ওদের ব্যাগ আর এই ছবিগুলো নিয়ে থানায় যাচ্ছি। ডিবি পুলিশ গিয়ে বাড়ি থেকে তুলে আনবে,পরে গিয়ে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনবেন,ভাইদের নামের পাশে আজীবনের জন্য ইয়াবাখোর ট্যাগ লেগে থাকবে।”

আলো কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন ইয়াসার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আলোকে দেখছে। চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি‌। এই পরিস্থিতিতে একটা মেয়ে কাঁদবে না কেনো! সামিন ইয়াসার তো আলোকে কাঁদতে দেখতে চায়, কাঁদতে কাঁদতে আলো সামিন ইয়াসারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করবে এটাই তো চায় সামিন ইয়াসার। কয়েক মুহূর্ত কেটে যায়,আলো কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”ঠিকাছে। আমি মাফ চাইবো। তবে দয়া করে আমার ভাইদের এখানে আনবেন না। ওরা দেখলে কষ্ট পাবে।”

জামিল বলে,”ঠিকাছে। মেয়ে মানুষ তাই অনুরোধ টা রাখলাম , এখন মাফ চান।”

আলো সামিন ইয়াসারের চোখের দিকে একবার তাকিয়ে তার পায়ের কাছে মাথা নিচু করে বসে পরে, কাঁপা কাঁপা হাত দুটো বাড়িয়ে সামিন ইয়াসারের পা ছোঁয়। ইয়াসার এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে আলোর দিকে। আলো নামের দেমাগী মেয়েটা তার পা ছুঁয়েছে অথচ তাতেও তার স্বস্তি হচ্ছে না, এই মেয়েটা ভেতরে ভেতরে যে ভাঙেনি তা ইয়াসার বুঝতে পারছে।”

“কি হলো,চুপ করে আছেন কেনো? মাফ চান!”

জামিলের কথায় আলো মাথা উঠিয়ে সামিন ইয়াসারের দিকে তাকায়,চোখে মুখে কাঠিন্যতা মেয়েটার অথচ তার ঘাবড়ে যাওয়ার কথা ছিলো। আলো ধীরে ধীরে বলে সে,”কি বলতে হবে?”

_বলুন যে, যা করেছি তার জন্য আমাকে মাফ করে দিন। আমি আমার কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত, অনুতপ্ত, ব্যথিত।

আলো রোবটের মতো বলে,”যা করেছি তার জন্য আমাকে মাফ করে দিন। আমি আমার কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত, অনুতপ্ত, ব্যথিত।”

জামিল বলতে থাকে,”আপনি অন্তত ভালো মানুষ, আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”

আলো বলে,”আপনি অন্তত ভালো মানুষ,আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”

_সামিন ইয়াসার জিন্দাবাদ

আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”সামিন ইয়াসার জিন্দাবাদ।”

_হু,এখন উঠুন।

আলো উঠে দাঁড়ায়। ফুয়াদ আলোর দিকে তাকিয়ে আছে,মেয়েটিকে দেখে তার এখন খানিকটা মায়া হচ্ছে।‌
জামিল বলে,”এই মাফ চাওয়ার দৃশ্যটা চাইলে ভিডিও করে নেট দুনিয়ায় ছেড়ে দিতে পারতাম। আমার ভাইয়ের ইমেজ টা ঠিকঠাক হয়ে যেতো কিন্তু তা করলাম না,মেয়ে মানুষ বলে। আপনার বাবার আপনাকে বিয়ে দিতে ঝামেলা হবে । আমাদের জননেতা সামিন ভাই আবার এই এলাকার অসহায় মেয়েদের বিয়ের দায়িত্ব নেয়, সেখানে তার জন্য একটা মেয়ের ভবিষ্যতে বিয়ে দিতে ঝামেলা হোক,তা সে চায় না।”

আলো ইয়াসারের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন ইয়াসার এতক্ষনে নীরবতা ভেঙে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাহাতকে বলে,”ওর ভাইদের ব্যাগ দুটো দিয়ে দে।”

রাহাত দৌড়ে গিয়ে দুটো ব্যাগ এবং আজান আয়াতকে নিয়ে আসে। সামিন ইয়াসার বলে,”ছবিগুলো ওকে দিয়ে ডিলিট করা।”

জামিল সামিন ইয়াসারের ফোন আলোর হাতে দিয়ে বলে,”নিন ডিলিট করুন।”
আলো ছবিগুলো ডিলিট করে ফোন দিয়ে দেয়। তারপর আজান আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে,”চল।”

ওরা তিনজন ঘুরে দাঁড়িয়ে দুই কদম ফেলতেই সামিন ইয়াসার বলে ওঠে,”মেয়ে মানুষের স্বভাবে সবকিছুই থাকতে হয়,তেজ ছাড়া। ওটা বাড়তি। বিপদজনক খুব।”

আলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য দাড়িয়ে পরে। কিন্তু সে ঘুরে তাকায় না। আয়াত আর আজানের হাত ধরে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে।

ফুয়াদ সামিন ইয়াসারের দিকে চায়,”হয়েছে? খুশি এবার? কিসব জেদ যে তোর মাথায় চাপে বুঝি না। তোর মতো মাথা ভাঙার সাথে বন্ধুত্ব করে আমার হয়েছে যত জ্বালা। কিরে,বল এখন। শান্তি পেয়েছিস?”
_না।
একশব্দে সামিন ইয়াসার উত্তর দেয়।

_না মানে? মেয়েটা তোর পা ধরলো তবুও শান্তি পাসনি?

সামিন ইয়াসার ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে,”ওর চোখ দেখেছিস তুই? বিন্দুমাত্র আতঙ্কিত হয়নি ওই চোখ দুটো। ও সামিন ইয়াসারকে ভয় পায়নি ফুয়াদ। পা ধরতে হবে বলে ধরেছে, ভয় পায়নি এই ইয়াসারকে। আমি তো ওর চোখে ভয় দেখতে চেয়েছি।”

ফুয়াদের মুখ হা হয়ে যায়। হতভম্ব ভাব নিয়ে বলে,”তুই কি শুরু করলি একটু বলতো।”

_কিছুইনা।
তারপর জামিলের দিকে তাকিয়ে বলে,”ওকে নজরে নজরে রাখবি। ওকে আমার চাই । ও ক্ষমতার কথা বললো না তখন? ওকে একটু একটু করে আমার ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা দেবো আমি।”

জামিল মাথা নাড়ায়। তাকে কিছুটা বিচলিত লাগছে ,রাজনীতি ছেড়ে ভাই এখন এসব করতে শুরু করলে মারা পরতে আর টাইম লাগবে না!

রাহাত ইয়াবার প্যাকেটটা নাড়িয়ে দেখছিলো। হঠাৎ করে বলে ওঠে,”ভাই এটা তো ইয়াবা না। এগুলো তো নকল।”

সামিন ইয়াসার শুকনো হাসি হাসে। পাশ থেকে সবুজ বলে ওঠে,”ওই শালা! নকলই তো থাকবে। সামিন ইয়াসার কি ইয়াবার ডিলার নাকি যে যখন তখন আসল ইয়াবা এনে দিবে?”

হাসির মৃদু গুঞ্জন শোনা যায় ওদের মাঝে। আজ ওই মেয়েটাকে বোকা বানিয়ে কার্যসিদ্ধি করেছে সবাই। খুবই মজা পেয়েছে ছোটোখাটো এই এডভেঞ্চারটি করতে পেরে তারা।

***
রিকশায় তিনজন চাপাচাপি করে বসে আছে তারা। আলো পার্স ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সময় দেখে। সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে। ফোনটা ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে আয়াত আর আজানের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,”বাড়িতে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে,কিছু খেয়ে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় পড়তে বসবি দুজন। ভুলে যাবি গত তিন ঘন্টায় কি কি হয়েছে। আমি তোদের বাড়িতে দিয়ে এসে আব্বুর কাছে যাবো। হাসপাতালে গিয়ে আম্মুকে পাঠিয়ে দেবো। আম্মু যেন কিছু টের না পায়। ঠিকাছে?”
আজান আর আয়াত মাথা নাড়ায়। আলো বলে,”অনেক বড় হয়ে গিয়েছিস দুজনে। এখন একটু সাহসী হ, সব সময় আমি আর আব্বু থাকবো না।”

আয়াত আজান কিছু বলে না। রিকশা তাদের বাসার সামনে এসে থামে। আলো নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে হনহন করে দরজার সামনে গিয়ে কলিং বেল চাপে। কাজের মেয়েটা এসে দরজা খুলে দিতেই আলো দ্রুত ভেতরে ঢুকে নিজের ঘরের দিকে যায়। আতাউর আলমের পঁচাত্তর বছর বয়সী বৃদ্ধা মা আলেয়া বেগম নিজের ঘর থেকে আলোর অস্তিত্ব টের পেয়ে রিনরিনে গলায় ডাকে,”ওও আলো,তুই আইছিস? তোর বাপ কখন আইবো? আরে ও আলো,কথা কস না ক্যান।”

আলো কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে ধপ করে দরজা লাগিয়ে দেয়। এক ঝটকায় হাতের পার্স টা বিছানার উপরে ছুঁড়ে মেরে ওয়াশ রুমে ঢুকে যায় সে। কল ছেড়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে সে তার দু হাতের দিকে তাকায়। আজ এই হাত একটা জঘন্য লোকের পা ছুঁয়েছে, ঘেন্নায় আলোর গা গুলিয়ে আসে। সে সাবান লাগিয়ে হাত দুটো ডলতে থাকে। দীর্ঘ সময় কেটে যায়, ডলতে ডলতে আলো হাত দুটো লাল বানিয়ে ফেলেছে। বিছানার উপরে পার্স ব্যাগের ভেতরে আলোর ফোন বেজে যাচ্ছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার,সে হাত ধুতে ভীষণ ব্যস্ত। তার এখন ইচ্ছে করছে এক স্তর চামড়া ছিলে ফেলতে হাতের। আরো কিছু সময় পরে আলো হাত ধুয়ে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়। ফোনটা তখনও বাজছে। তোয়ালে দিয়ে হাতে মুছে পার্স খুলে ফোনটা হাতে নেয় সে। ফোনের স্ক্রিনে তার ইশমামের নাম্বার দেখে অস্বস্তিতে পরে যায় আলো। এই মুহূর্তে ফোনটা ধরতে ইচ্ছে করে না আলোর। কিন্তু ইশমাম শত ব্যস্ততার মাঝেও একটু সময় বের করে দিনের ভেতর আলোর সাথে কথা বলার জন্য। আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে ব্যাকুল কন্ঠে ইশমাম বলে ওঠে,”কোথায় ছিলে!”

আলো নিচু স্বরে বলে,”ওয়াশ রুমে।”

_আমি গত এক ঘন্টা ধরে ফোন দিয়ে যাচ্ছি। এক ঘন্টা ওয়াশ রুমে ছিলে?

আলো চুপ করে আছে। ইশমাম বলে,”ভেবেছি আংকেল হয়তোবা অসুস্থ হয়ে পরেছে।”

_নাহ। আব্বু ঠিক আছে।

ইশমাম আদর মাখা কন্ঠে বলে ওঠে,”খুব স্ট্রেস যাচ্ছে তাই না?”

আলো বলে,”এই আর কি!”

_আচ্ছা ঐ ঝামেলাটার কি হলো? মির্জারা তোমাকে কিছু বলেছিলো তারপর?

আলোর হঠাৎ চোখ দুটো ভিজে ওঠে। গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে আসছে। তার ইচ্ছে করছে ইশমামের সাথে যন্ত্রনাটা শেয়ার করতে, কিন্তু এটা করা যাবে না। ইশমাম শুধু শুধু চিন্তা করবে।

ইশমাম বলে,”তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে আলো। ভিডিও কল দেই?”

_না। আমার খুব মাথা ব্যথা করছে। পরে।

ইশমাম চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ দুপাশের দু’জনেই চুপ করে থাকে। তারপর নীরবতা ভেঙে আলো বলে ওঠে,”দেশে ফিরছো কবে তুমি? কবে দেখা হবে আমাদের? তোমার পরিবারকে সব জানাবে কবে? আমাকে কেনো তোমার পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দাও না? আচ্ছা ইশমাম একটা কথা বলো তো, তুমি আমার সাথে টাইম পাস করছো না তো?”

ইশমাম ধমকের সুরে বলে,”অদ্রিতা।”

_তাহলে তোমার পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে বললে তুমি চুপ করে থাকো কেনো? যেনো কোনো আগ্রহ নেই তোমার।

চেঁচিয়ে বলতে থাকে আলো।

ইশমাম কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”মাথা ঠান্ডা করো। দেবো। সময় হলেই দেবো।”

চলমান……..

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_৪
#Esrat_Ety

“কতবার করে বলেছি ছেলেটাকে ধমকাবে না,কথা কি কানে যায়না? গণ্ডারের চামড়া নাকি তোমার গায়ে?”

ভাতের লোকমাটা ইহানের মুখের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে প্লেটে রেখে রিতু নিচু স্বরে বলে,”জোর না করলে খেতেই চায়না একেবারে।”

ইলহাম চোখ রাঙানি দিয়ে বলে,”জোর করতে হবে না। মির্জা বাড়ির ছেলেদের ওপরে জোর চলে না। তারা তাদের ইচ্ছা মর্জির মালিক। আমার ছেলের যখন মন চাইবে তখন খাবে।”

তারপর ইহানের দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি যাও বাবা। দাদার ঘরে গিয়ে খেলো।”

বাবার আস্কারা পেয়ে ইহানের ঠোঁটজোড়া প্রশস্ত হয়ে যায় হাসিতে। একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রিতু খাবারের প্লেট নিয়ে বসে আছে। ইলহাম কিছুক্ষণ রিতুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,”হাত ধুয়ে দরজা টা বন্ধ করে আসো।”

রিতু চমকে উঠে ইলহামের দিকে তাকায়। ইলহাম নিচু স্বরে বলে,”শাড়িটা পাল্টে এসো। এই রঙটা আমার পছন্দ নয়।”

হঠাৎ করে রিতুর বুকে সুক্ষ্ম যন্ত্রনা হতে শুরু করে। একেই বোধহয় বলে পুরুষ মানুষ। নিজের প্রয়োজনের সময় এরা ঠিকই নমনীয় হয়ে কথা বলে। রিতুর মনে হচ্ছে তার জন্মই হয়েছে কারো বৌ নামের যৌন দাসী হয়ে থাকার জন্য। কারো অর্ধাঙ্গিনী হয়ে সম্মানিত হওয়ার জন্য রিতুর মতো হার হাভাতে মেয়েদের জন্ম হয়নি।

“কি হলো,বসে আছো কেনো। আমাকে ভাইয়ার সাথে পার্টি অফিসে যেতে হবে সন্ধ্যায়। তাড়াতাড়ি।”

রিতু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। হাত ধুয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে আলমারি থেকে একটা নীল রঙের পাতলা জরজেটের শাড়ি বের করে ওয়াশ রুমে ঢুকে পরে নেয়। ধীর পায়ে স্বামীর পাশে এসে বসতেই হ্যাচকা টান মেরে তাকে নিজের কাছে নিয়ে নেয় ইলহাম। ঘোর লাগা কন্ঠে বলে ওঠে,”আজকাল খুব বার বেরেছো না তুমি? মা মারা যাওয়ার পরে পুরো সংসারের চাবি পেয়ে গিয়ে নিজেকে অনেক কিছু ভাবতে শুরু করেছো? স্বামী কাছে ডাকলে গায়ে লাগে না!”

রিতু শ্বাস নিতে পারছে না। তার বুকের যন্ত্রনাটা বেড়েই যাচ্ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কিন্তু এই মুহূর্তে চোখে পানি দেখলে ইলহাম আরো রেগে যাবে। রিতু গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”ভুল ভাবছেন।”

ইলহাম কোনো কথা বলে না। নিজের স্বামী হওয়ার হক আদায় করতে ব্যস্ত হয়ে পরে। রিতু দুচোখ বন্ধ করে অনুভূতি শূন্য হয়ে পরে থাকে।
দীর্ঘসময় পরে ইলহাম সেই চিরাচরিত ধমকের সুরে বলে,”তোমার বাবা ফোন করেছিলো। কাল বাড়িতে আসবে। ফোন করে বলে দিও যেন ভালো জামাকাপড় পরে আসে। আচ্ছা ওনার কি ভালো জামাকাপড় নেই? মাসে মাসে তো টাকা পয়সা ভালোই পাঠাও ও বাড়িতে। কিনে নিতে পারে না? ফকিন্নির মতো ঘুরে বেড়ায়।”

রিতু নিস্তেজ কন্ঠে বলে,”ফকিন্নির মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন কেনো তবে?”

ইলহাম কপাল কুঁচকে বলে,”মুখে মুখে কথা তো ভালোই চালাতে শিখে গিয়েছো। এতো সাহস পাচ্ছো কোথায়?”

রিতু চুপ হয়ে যায়। দীর্ঘসময় কেউ কোনো কথা বলে না, তারপর রিতু মৃদু স্বরে বলে ওঠে,”মাঝে মাঝে মনে হয় আমি আপনার বৌ না হয়ে আপনার ঐ সব রক্ষিতাদের মতো কেউ হলেই ভালো হতো। আপনার থেকে অন্তত একটু মিষ্টি কথা তো শুনতে পারতাম!”

***
“আতাউর আলম তো সুস্থ হয়ে উঠছে। মনে হয়না সে তার সিদ্ধান্ত থেকে সে সরে দাঁড়াবে। তোমার একজন প্রতিদ্বন্দ্বী কিন্তু বেড়ে গিয়েছে এবং জনগণের কাছে তার অবস্থান কিন্তু বেশ শক্ত পোক্ত!”

সামিন বাবার কথায় হালকা হেসে বলে,”ভালোই তো! তা না হলে নির্বাচনের মজা টা কোথায়?”
_মানুষ তোমাকে ছাত্রনেতা হিসেবে গ্রহণ করেছে, কিন্তু এই শহরের মেয়র হিসেবে আতাউর আলমের মতো একজন বয়স্ক,জ্ঞানী এবং সাদাসিধে ব্যক্তিকে রেখে তোমার হাতে শহরের দায়িত্ব তুলে দেবে বলে আমার মনে হচ্ছে না! আমি সন্দিহান।

সামিন ইয়াসারের কলম থেমে যায় বাবার কথায়। সে কিছু পেপার্সে সাইন করছিলো।

ইমতিয়াজ মির্জা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”বলছি রাজনীতি টা একটু মন দিয়ে কর। তারপর একটু সময় গেলে,সরাসরি এমপি পদের জন্য লড়বি।”

_তুমি কি ভয় পাচ্ছো?

ছেলের সরাসরি প্রশ্নে আমতা আমতা করে ইমতিয়াজ মির্জা বলে,”সাতবছর আগে তোর মেজো ভাইয়ের অপকর্মের দাম আমি এমপি পদ খুইয়ে দিয়েছি। মানুষ জনের কাছে বর্তমানে আমার গ্রহণযোগ্যতা কতখানি তা তো নিশ্চিত না। তার উপরে সেদিনের সেই ভাইরাল ভিডিও। টাকা দিয়ে নিউজ চ্যানেল গুলোকে সামলে নিয়েছি। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে এখনো কথা হচ্ছে। তোকে সবাই ভয় পায় তাই হয়তো সামনে কিছু বলছে না।”

_সেটাই। এই ভয়টাই আমার দরকার।
তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে,”আতাউর আলম সাদাসিধে মানুষ। রাজনীতি সাদাসিধে মানুষ দিয়ে হয়না বাবা। এদের জন্য উপযুক্ত পেশা শিক্ষকতা। দীর্ঘজীবন সাংবাদিকতা করেছে,এই শহরে টিকতে পেরেছে এটাই অনেক।

ইমতিয়াজ মির্জা ছেলের সাহস এবং আত্মবিশ্বাস দেখে অবাক হয়। সেও প্রচন্ড সাহসী ছিলো কিন্তু তার বড় ছেলে তাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। যদি এই সাহসটা ভালো কাজে লাগাতে পারে তাহলে অনেক দূর যেতে পারবে।

সামিন ইয়াসার বলে,”নির্বাচনে হারার কথা ভেবে চিন্তা করো না,কারন জিতবো আমিই। সেটা যেভাবে হোক। ”

_ঐ মেয়েটার ব্যাপারে কি করলি? বলেছি মামলা দিয়ে দে, ওর বাবাকেও একটু দমিয়ে রাখা যাবে।
_ওটা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার। তুমি ওটা নিয়েও ভেবো না।

_ভীষণ সাহস মেয়েটির। বাবার জন্য সন্দেহের বশে,কোনো রকম যাচাই-বাছাই না করেই সামিন ইয়াসারের গাঁয়ে হাত তোলে। আতাউর অনেক লাকি, এমন একটা মেয়ে পেয়েছে।

_তুমি মেয়েটার প্রশংসা করছো নাকি আমাকে অপমান করতে চাইছো বাবা?
_কোনোটিই না।

হঠাৎ করে সামিন ইয়াসারের ফোন বেজে ওঠে। ফোনের দিকে তাকিয়ে সে খুশি হয়। ইমতিয়াজ মির্জার দিকে তাকিয়ে বলে,”ছোটো ফোন করেছে।”
_কথা বলো। জিজ্ঞেস করো কবে ফিরবে দেশে। বাড়ির ব্যাবসা ইলহাম একা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। এতটুকু দায়িত্ব তো নিতে বলো।

সামিন ইয়াসার ফোন কানে তুলে নিয়ে বলে,”বল ভাই।”

ওপাশ থেকে কেউ বলে ওঠে,”ভাইয়া।”
_হ্যা বল ভাই। ঠিক আছিস তুই?
_ঠিক আছি। ভাইয়া একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
_কি কথা? বল।
_ওই ঝামেলাটার কি হলো? তুমি মেয়েটিকে কিছু বলেছো পরে?

সামিন কিছুটা অবাক হয়ে বলে,”সব কথা রেখে ওই কথা জিজ্ঞেস করছিস কেনো?”
_না মানে,আমি চাইনা তুমি কোনো ঝামেলায় জড়াও। তাই আর কি।

সামিন শুকনো হাসি হেসে ভাইকে আশ্বস্ত করে বলে,”আরে ধূর। ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করবো নাকি আমি। আমি এখন আমার ইলেকশন নিয়ে ভাবছি। মনোনয়ন পেয়ে গেছি দল থেকে ‌!”
_অভিনন্দন ভাইয়া।
ম্লান হেসে বলে ওপাশের ব্যক্তি। সামিন বলে,”তুই ফিরে আয় ছোটো। বাবা আসতে বলছে তোকে। বাড়ির ব্যবসা সামলাবি। এখানে এলে তোকে বিয়ে করিয়ে দেবো আগে। বিদেশী বৌ নিয়ে আসিস না সাথে করে খবরদার।”
ওপাশের ব্যক্তি হেসে বলে,” আর তুমি কবে করছো?”

সামিন,”তুই বিয়ে করে রিভিউ দিবি। তারপর।”

দুইভাই ফোনে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে। তারপর ফোন রেখে পুনরায় নিজের কাজে মন দেয় সামিন ইয়াসার।

***
আতাউর আলমকে গতকাল বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। তার আগমন উপলক্ষে বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের ঢল নেমেছে। দূর দূরান্ত থেকে সবাই উড়ে উড়ে আসছে। রেহেনা রান্নাঘরে চায়ের পানি বসিয়ে কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে, কিন্তু রাগটা প্রকাশ করতে পারছে না সে। এই নেমক হারাম গুলোর জন্য দফায় দফায় চা বানিয়ে সে ক্লান্ত। অসুস্থ মানুষকে দেখতে এসেছে নাকি দাওয়াত খেতে এসে তা এরাই ভালো জানে। আতাউর আলমের ঘর থেকে নাটকের সংলাপ শোনা যাচ্ছে। অভিনয় করছে আতাউর আলমের চাচাতো ভাই। ভাইয়ের প্রতি দরদ যেনো উথলে উঠেছে এখন। অথচ দূর্ঘটনার দিন আলো গিয়ে এতো করে বললো তার সাথে থানায় যেতে, থানায় সাধারণ ডায়েরী করবে সে,তখন গর্তে লুকিয়ে ছিলো সরীসৃপ টা।

রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায় আলোদের গৃহপরিচারিকা সীমা। রেহেনা চুলা থেকে চায়ের পাতিল নামিয়ে বলে,”উঠেছে আলো? গিয়ে বল চা খেতে ডেকেছি।”
_আপা তো বাড়িতে নেই খালা। কোথাও গিয়েছে।

রেহেনা অবাক হয়ে তাকায়। এই সাত সকালে কোথায় গিয়েছে মেয়েটা না খেয়ে !

গলির মোড়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। পরনে তার সাদা এবং নীল রঙ মিশ্রিত প্রিন্টের সালোয়ার কামিজ। হাত উঠিয়ে বারবার হাত ঘড়িতে সময় দেখছে সে। এ কদিনের ধকলে চোখের নিচে কালি জমে গিয়েছে। কিন্তু গাঁয়ের ওই উজ্জ্বল শ্যামলা ধরনের রঙের সাথে চোখের নিচের কালি বেশ মানিয়েছে। খুব একটা অদ্ভুত লাগছে না। আলো এবার বেশ বিরক্ত হয়। আধাঘণ্টা ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছে অথচ কোনো খালি রিকশা খুঁজে পাচ্ছে না সে। দীর্ঘ সময় পরে একটা রিকশা পেয়ে গেলে সে উঠে পরে রিকশায়। আজ আলোর বাবা আতাউর আলমের জন্মদিন। বাবাকে সারপ্রাইজ দিতে তার জন্য অল্প কিছু আয়োজন করবে আলো, সকাল সকাল সেজন্যই বের হয়েছে সে।

কিছুদূর যেতেই রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়ে দেয়। কাছে কোথাও থেকে মাইকের আওয়াজ আসছে। আলো বিরক্ত হয়ে বলে,”কি হয়েছে ভাই?”
_আপা সামনের রাস্তায় জ্যাম। আইজ এইখানে সমাবেশ। পার্কের সামনের রাস্তা পুরাডা আটকা। বিরক্তিতে আলোর মুখ তেতো হয়ে যায়। ডানপাশে একটা এ্যাম্বুলেন্স তাদের মতো আটকা পরেছে। এ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার বাইরে নেমে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে।

আলোর বেশ খারাপ লাগছে। নিশ্চয়ই রোগীটি পরে পরে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। সামনে নির্বাচন আর এখন সব রাজনৈতিক দল রাস্তাগুলোকে নিজেদের বাপের সম্পত্তি মনে করে আটকে রেখে ঘেউ ঘেউ করতে থাকবে। আলোর বাবা এই শহরের মেয়র হলে সে শহরের ভোল পালটে ফেলবে,আলো নিশ্চিত।

কয়েক মুহূর্ত পরে একটি গাড়ি এসে তাদের সামনে থামে। রিকশাওয়ালা অতি উৎসাহী হয়ে বলে,”ইয়াসার ভাই আসছে আপা। আইজ এইখানে ভাষণ দিবো।”

আলোর মেজাজ বিগড়ে যায়। রাস্তা আটকে মাফিয়াগিরি করা একমাত্র ইয়াসার মির্জার পক্ষেই সম্ভব। কোনো কিছু না ভেবেই আলো রিকশা থেকে নেমে পরে। ইয়াসার মির্জার দলের একটা ছেলে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিতেই সে বাইরে নেমে দাঁড়ায়‌। আলো বাতাসের গতিতে ইয়াসার মির্জার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে। সকাল সকাল অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আলো নামের মেয়েটিকে নিজের মুখোমুখি আবিষ্কার করে ইয়াসারের চোয়াল লম্বা হয়ে যায়। সে কিছুটা অবাক হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরী একজন শ্যামবতীর দিকে তাকিয়ে আছে।
“কি হচ্ছে এখানে? রাস্তাটাকে নিজেদের সম্পত্তি মনে করছেন নাকি?”

আলোর ধমকে ইয়াসারের ঘোর কাটে। পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পেরে সে প্রচন্ড বিরক্ত হয়। সেই ফাজিল মেয়েটা সব সময় এভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসছে তার কাজে বাধা দিতে। সেদিন পা ধরেও একটু ভয় ঢোকেনি মনে, আবার চেঁচিয়ে কথা বলছে ইয়াসারের সাথে!
ইয়াসার আলোকে কিছু না বলে জামিলের দিকে তাকায়, জামিল বলে,”এই যে আপা! আপনার সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে একটু বলবেন?”
_সমস্যা কোথায় হচ্ছে মানে? রাস্তা ব্লক করে জনগণের ভোগান্তির ব্যবস্থা করে বলছেন সমস্যা কোথায় হচ্ছে?

ইয়াসারের পেছনে দাঁড়িয়ে রাহাত ফুয়াদকে বলে,”দেখছেন ভাই? এই মেয়ে ভাঙে তবু মচকায় না। সেদিনের পা ধরার কথা বেমালুম ভুলে গেছে।”

ইয়াসার আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,”ভোগান্তি কোথায় হচ্ছে? বড় গাড়ি গুলো তো চলে যাচ্ছে একটার পর একটা। রিকশা গুলোকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না,আর হবেও না। হাই-ওয়েতে রিকশা ওঠার নিষেধাজ্ঞা আছে,তা কি জানেন না আপনি? বিশিষ্ট জ্ঞানী, সুনাগরিক ভোটার!”

ইয়াসারের কটাক্ষ শুনে আশেপাশে তার ছেলেগুলো হো হো করে হাসতে থাকে। আরাফ নামের ছেলেটা ইয়াসারকে বলে,”বেডি মানুষ ভাই! ব্রেইনের ওজন কয়েক গ্রাম কম আছে।”

আলো ক্ষেপে গিয়ে বলে,”তাহলে এই এ্যাম্বুলেন্সটা এখানে আটকা পরে আছে কেনো? জবাব দিন।”

এ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার আলোর চেঁচামেচি শুনে কান থেকে ফোন নামিয়ে সেদিকে যায়। এ্যাম্বুলেন্স থেকে রোগীর পরিবারের একজন লোক নেমে আসে। আলোকে উদ্দেশ্য করে বলে ,”ম্যাডাম আমাদের আটকে রাখেনি। এ্যাম্বুলেন্স টা হঠাৎ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অন্য একটা এ্যাম্বুলেন্স আসছে,একটু সময় লাগবে।”

আলো সামিন ইয়াসারের দিকে তাকায়। সামিন ইয়াসার কটমট দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আলোর দিকে তার রাগী দৃষ্টি রেখেই রোগীর পরিবারের লোককে গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,”কতক্ষন লাগবে?”

লোকটি কন্ঠে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”আধাঘণ্টা তো লাগবেই। আমার বৌটা খুব কষ্ট পাচ্ছে। প্রেগন্যান্ট সে।”

সামিন ইয়াসার রাহাতকে বলে,”রাহাত। গাড়ি ঘোরা। ওনার ওয়াইফকে হাসপাতালে নিয়ে যা।”

রাহাত এক মুহুর্ত চিন্তা না করে মাথা নাড়িয়ে গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দেয়। গর্ভবতী মহিলার স্বামী এবং অন্যান্যরা ধরাধরি করে রোগীকে সামিন ইয়াসারের গাড়িতে বসায়। যন্ত্রনায় ভীষণ কাতরাচ্ছে মহিলাটি।
আলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন ইয়াসারের দিকে কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে গর্ভবতী মহিলার স্বামী গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি চলতে শুরু করে।

সামিন ইয়াসার কয়েক মুহূর্ত আলোকে দেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”তুমি একটা ফটকা চালাক মেয়ে।”

আলো চুপ করে থাকে। হঠাৎ করে বলে,”পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার চমৎকার ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছেন,খুব ভালো নাটক দেখালেন আজ। আপনার মতো একটা গিরগিটির নতুন একটা দয়ালু রূপ আবিষ্কার করে আমি একটুও অবাক হইনি। এই রূপ ক্ষণে ক্ষণে বদলায়,বদলাবে। আবার কোনো গরীবকে ধরে লাথি মারবেন, অথবা কোনো মেয়ের ওড়না ধরে টান দেবেন‌। আপনাদের ফ্যামিলি হিস্ট্রি তো তাই বলে।”

আলো রিকশাওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রাস্তার ডান পাশে চাপা গলির রাস্তায় ঢুকে পরে।
সামিন ইয়াসার কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। ফুয়াদ পেছন থেকে বলে,”তুই বুনো ওল হলে ও তো দেখছি বাঘা তেঁতুল।”

_না, ও একটা মেয়ে। শুধু আর শুধু মাত্র একটা মেয়ে। দুর্বল প্রজাতির প্রাণী। এবং এটা ওকে বুঝতে হবে। আমি বোঝাবো।

সামিন ইয়াসার দাঁত কিড়মিড় করে বলে ওঠে।

***
“ফজিলাতুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ!”

_জ্বি ভাই।

সামিন ইয়াসার নড়েচড়ে বসে,নিমন্ত্রণ পত্রটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে।

_আপনাকে অতিথি হিসেবে যেতে হবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

_নিষেধ করে দে। আমি পারবো না,কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি খুব। বারবার মিছিল, মিটিং করতে হচ্ছে এখন এসব অনুষ্ঠানে গিয়ে মেয়েদের নৃত্য দেখার সময় নেই।
কথাটি বলে সামিন নিমন্ত্রণ পত্রটির একটা লেখার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।

জামিল মাথা নাড়িয়ে বলে,”ঠিকাছে ভাই। আমি ফোনে জানিয়ে দিচ্ছি।”

“ওয়েট।”

জামিল দাঁড়িয়ে পরে সামিনের কথা শুনে। সামিন নিমন্ত্রণ পত্র থেকে চোখ তুলে জামিলের দিকে তাকিয়ে বলে,”এই কলেজে তো ওই মেয়েটাও পড়ে তাই না?”
_কোন মেয়েটা?

জামিল কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলে,”ওও ওই ফটকা মেয়ে আলো? হ্যা,ও এই কলেজেই পড়ে।”

_ওর নাম অদ্রিতা আলো না? ফোর্থ ইয়ার। ডিপার্টমেন্ট অব ইংলিশ?
_হু, কেনো ভাই?

সামিন নিমন্ত্রণ পত্র উঠিয়ে জামিলের দিকে তুলে বলে, স্বেচ্ছাসেবকদের লিস্টে ওর নাম। অনুষ্ঠান হোস্ট করবে সে এবার।

_তো?
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জামিল ইয়াসারের দিকে তাকায়।

_প্রিন্সিপালকে বল আমি যাবো।
সামিন ইয়াসার নিমন্ত্রণ পত্রটির দিকে তাকিয়ে বলে।

জামিল খানিকটা অবাক হয়ে তাকায়। ইয়াসার তার দিকে তাকিয়ে বলে,”ওর আমার ক্ষমতা দেখার খুব শখ। ওকে একটু দেখিয়ে আসবো। কি বলিস?”

চলমান…….

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_৫
#Esrat_Ety

চায়ের কাপে দ্বিতীয় বারের মতো চুমুক দিয়ে কপাল কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে থাকে শমশের ভুঁইয়া। কোন ফাঁকে একটা ক্ষুদ্রাকার মাছি এসে বসে আছে চায়ে। ঠিক বসে নয়, মরে পরে আছে। শমসের ভুঁইয়া তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে মাছিটাকে ঠেলে কাপ থেকে উঠিয়ে একটা টিস্যু পেপারের উপর রাখে। পুনরায় চায়ের কাপ উঠিয়ে মুখের কাছে নেয় চুমুক দেবে বলে। পাশে বসে শমশের ভুঁইয়ার কাণ্ড দেখছিলো তার একনিষ্ঠ কর্মী জায়েদ আলী, বাঁধা দিয়ে বলে,”করছেন কি? আরেক কাপ চা আনিয়ে দিচ্ছি। ওটা রাখুন।”

শমসের ভুঁইয়া জায়েদ আলীর কথা না শুনে চায়ের কাপে তৃতীয় চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রাখে। তার দৃষ্টি টিস্যু পেপারের উপরে রাখা মাছিটার দিকে। এক দৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু স্বরে জায়েদ আলীকে বলে,”রাজনীতি হলো এই চায়ের কাপের অমৃত চা, তাতে দুয়েকটা মাছি এসে পরবে, স্বাভাবিক। তাই বলে চা টা খাবো না? আলবত খাবো। মাছি গুলোকে পরিষ্কার করে খাবো। যারা যারা রাজনীতি নামের অমৃত সুধা পান করতে চাইবে,তাদের মাছি পরিষ্কার করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।”

কথাটি বলেই শমশের ভুঁইয়া মুখ হাসি হাসি করে ফেলে। নিজের বলা কথাটি তার নিজেরই বেশ পছন্দ হয়। জায়েদ আলী বলে,”মাছি পরিষ্কার করার জন্য তো আপনাকে নোবেল দেওয়া উচিত। যেভাবে আতাউর আলম মাছিটাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করেছিলেন!”

_কি? আতাউর আলম মাছি? হা হা হা। বেশ ! বেশ বলেছো জায়েদ। ও তো একটা মাছিই।

জায়েদ আলী বলে,”পরিকল্পনা টা তো ভালোই করেছিলেন, ঠ্যাং ভেঙে ঘরে পরতে থাকতো। মেয়র হবার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যেত। কিন্তু বেঁচে গেলো কপালের জোরে।”

_হ্যা জায়েদ। ওর কপাল ওকে বারবার সাথ দেয়। কতবার যে বেঁচে গিয়েছে আমার হাত থেকে।

_তবে ভাই উপকারের মধ্যে একটা উপকার হয়েছে, আপনার নাম সামনে আসেনি। মাঝখান থেকে ফেঁসে গিয়েছে সামিন ইয়াসার। আতাউরের মেয়েটা চড় মেরে হুলুস্থুল কাণ্ড করে ফেলেছে দেখেননি। ভাবা যায়? কত সাহস এই মেয়ের। একেবারে বাবার কপি। একটা মামলা ঠুকে দিলেও বেশ হতো ! সময় মতো ওর কানে সামিন ইয়াসারের নামে বিষ ঢেলে কাজের কাজ হয়েছে।

_আতাউরকে যে গাড়িটা ধাক্কা দিয়েছে তার নাম্বার প্লেট দেখেনি তো কেউ?
_নাহ। সুযোগ ই ছিলো না দেখার। ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিলো, লোকজন তেমন ছিলো না।

_ওর মেয়েকে কিভাবে ম্যানেজ করেছিলি?

_আতাউর আলমের চাচাতো ভাই খোরশেদ কাজটা করেছে। তবে কিছু পয়সা খরচ করতে হয়েছে। শালা আস্ত দালাল,টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না।

তারপর জায়েদ আলী নিজের মুখটা শমশের ভুঁইয়ার কানের কাছে এগিয়ে এনে বলে,”বলতে বলেছি কিছুদিন আগে আতাউর আলম কিশোর গ্যাং-এর নামে যে আর্টিকেল লিখেছেন,সেটার জের ধরে সামিন ইয়াসার এসব করেছে।”

শমশের ভুঁইয়া পৈশাচিক হাসি হাসে। জায়েদ আলী বলতে থাকে,”মেয়েটা তেজী আর সাহসী হলেও মাথায় বুদ্ধি কম। অন্ধের মতো বিশ্বাস করে ইয়াসারকে চড় মেরে দিয়েছে। হিতে যে বিপরীত হতে পারে বুঝতে পারেনি।”
_ভিডিও করেছিলো কে?
_আমাদের দলের একটা ছেলে।

_আচ্ছা ইয়াসার এতো চুপচাপ আছে কেনো বলোতো? একটা মেয়ের হাতে চড় খাওয়ার পরে তো ওর তুলকালাম কাণ্ড বাঁধানোর কথা ! বিষয়টি বেশ অদ্ভুত লাগছে। যাই হোক ওরা যদি সাপে নেউলে হয়ে যায় তাহলে তো আমারই লাভ। মাঝখান থেকে মণিটা এই সাপুড়ে নিয়ে নেবে। সাপুড়ে শমশের ভুঁইয়া। হা হা হা।

***
আতাউর আলমের চোখ বেঁধে দিতে তার দিকে উদ্যত হচ্ছে আজান। পেছন থেকে আলো তার ভাইকে বলে ওঠে,”আরে ভীতুর ডিম তোকে আব্বুর চোখ বেঁধে ফেলতে বলেছি,কিডন্যাপ করে আনতে নয়। এতো পা টিপে টিপে এগোচ্ছিস কেনো? তাড়াতাড়ি যা।”
আজান আলোর তাগাদা পেয়ে দ্রুত গিয়ে আতাউর আলমের চোখ বেঁধে দেয়। আতাউর আলম চমকে উঠে বলে,”কি হচ্ছে!”

আলো হেসে দিয়ে বলে,”এক মিনিট আব্বু।”

তারপর দৌড়ে গিয়ে জন্মদিনের কেকটা নিয়ে এসে আতাউর আলমের বিছানার পাশে রাখে। সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে আতাউর আলমের চোখ খুলে দিয়ে আলো বলে,”ট্যান ট্যানা! সারপ্রাইজ!”

আজান আয়াত চেঁচিয়ে ওঠে,”শুভ জন্মদিন আব্বু। শুভ বায়ান্নতম জন্মদিন।”

আতাউর আলমের মুখে হাসি ফোটে তার ছেলে মেয়েদের পাগলামি দেখে। বাচ্চাদের মতো কন্ঠে বলে ওঠে,”করেছিস কি!”

আলো তার বাবার মাথায় একটা বার্থডে ক্যাপ তুলে দিয়ে আদুরে কিন্তু নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,”শুভ জন্মদিন আমার জন্মদাতা পিতা। তুমি হাজার বছর বেঁচে থাকো। আমাদের আগলে রাখো।”

আতাউর আলম হেসে মেয়ের মাথায় হাত রাখে। রেহেনা ঘরের পর্দা সরিয়ে অভিযোগের সুরে বলে,”হ্যারে! তোদের কি চক্ষুলজ্জা বলতে কিচ্ছু নেই? আমার থেকে টাকা নিয়ে কেক-ফেক আনিয়ে আমাকে আর দাদীকে রেখেই খাচ্ছিস! একবার তো মুখের বলাটাও বলতে পারতি!”

আলো লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। আয়াত বলে,”তোমাদের দুজনকে বলে কি লাভ? বললেই তো বলতে এইসব জন্মদিন পালন করা হারাম,হারাম।”

রেহেনা বেগম ঘরে ঢুকে আয়াতের কান মলে দিয়ে বলে,”এসব হারাম হালালের পার্থক্য যদি বুঝতি তাহলে শুধু শুক্রবার মসজিদে যেতি না জিলিপির লোভে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তি। আরেকটাকে দেখো, চুল খোলা রেখে বাইরে যায়। বেগানা পুরুষদের সব দেখিয়ে আসে। ফাজিল মেয়ে কোথাকার।”
কথাটি বলে আলোর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকায় রেহেনা।

আতাউর আলম তার স্ত্রীকে বলে,”রেহেনা তোমাকে বোধ হয় মা ডাকছে। যাও গিয়ে দেখো।”

রেহেনা বলে,”কই আমি তো শুনিনি।”
_আমি শুনেছি। যাও যাও, তারাতাড়ি যাও।

রেহেনা চিন্তিত মুখ নিয়ে শাশুড়ির ঘরের দিকে যায়। আজান বলে,”আধা ঘন্টায় থামানো যেতো না বাবা!”

আলো ছুড়ি এনে বাবার হাতে দিয়ে বলে,”নাও এবার কেক কাটো। আমার খুব খিদে পেয়েছে।”

আতাউর আলম হেসে আলোর হাত থেকে ছুড়িটা নিয়ে কেক কাটে, তারপর একে একে তার তিন ছেলেমেয়েকে কেক খাইয়ে দেয়।

***
আজ থেকে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছে সামিন ইয়াসারের লোকজন। দুপুর পর্যন্ত দলের কর্মীদের নিয়ে শহরের তিনটা মহল্লায় চক্কর দিয়ে এসেছে। সূর্য্যের তাপটা আর সহ্য করা যাচ্ছে না। সামিন ইয়াসারের কপাল বেয়ে টপটপ করে নোনা জল গড়িয়ে পরছে। পাঞ্জাবির বুক এবং পিঠের দিকটা ভিজে জবজবে হয়ে গিয়েছে। এসবের অভ্যাস তার আছে কিন্তু আজ একটু বেশিই কাহিল হয়ে পরেছে সে। বাড়ি থেকে ইশিতা বারবার ফোন দিচ্ছে। ফোনটা সাইলেন্ট করে পাঞ্জাবির পকেটে রাখতে রাখতে তার দলের ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলে,” কি? কি বুঝলি? জনগণের রেসপন্স কেমন?”
_ভাই এভাবে তো কিছু বোঝা যায়না। তবে আশি শতাংশ নিশ্চিত এরা আপনার দিকে ঝুঁকে আছে। আপনার মতো তরুণ জননেতাকে রেখে শমশের ভুঁইয়া আর ওই আতাউর আলমের মতো দুটো বুড়োকে কে ভোট দেবে?

সামিন ইয়াসার আরাফের কথাতে বেশ স্বস্তি পায়। একটা প্রশস্ত হাসি দিয়ে বলে,”আজ এখানেই থাকবে নাকি?”

জামিল বলে,”না ভাই। যতক্ষন শরীরে হাঁটার শক্তি থাকবে ততক্ষণ থামা যাবে না। কাল থেকে হয়তো আতাউর আলম নামবে তার লোকজন নিয়ে। এভাবে বসে থাকলে হবে না।”

_গুড। তুই আমার যোগ্য কর্মী জামিল। তোর ছেলে হলে তোকে একটা মটরসাইকেল দেবো।

“কিন্তু জামিল ভাইয়ের তো মেয়ে হবে।”
সবুজ কথাটি বলে ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইয়াসার বলে,”মেয়ে হলে ওর মেয়েকে স্বর্নের আংটি দেবো। ছেলে হলে মটরবাইক,মেয়ে হলে অলংকার।”

জামিল ইয়াসারের কথায় খুশি হয়। ইয়াসার একবার হাতঘড়িতে সময় দেখে বলে,”ঐ মেয়েটার আপডেট কি?”

সবাই ইয়াসারের কথা শুনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। রাহাত ফিসফিসিয়ে সবুজকে বলে,”ভাই দিনে যতবার ওই মেয়েটার নাম নেয় আমরা দিনে ততবার নিজেদের বৌয়ের কথাও ভাবি না।”

_হুস।
ঠোঁটে আঙুল দিয়ে রাহাতকে চুপ করিয়ে দেয় সবুজ। নিচু স্বরে বলে,”ভাইয়ের “চটকনা” খাওয়ার শখ হইছে? ওই মেয়েটার ওপর ভাই ভীষণ ক্ষ্যাপা। আমি ভাইকে আট বছর ধরে চিনি। এতো সহজে ভাই মেয়েটার পিছু ছাড়বে না।”

ইয়াসার গম্ভীর কন্ঠে বলে,”কি সমস্যা? মেয়ে মানুষের মতো গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করছিস কেনো? কি কথা হচ্ছে?”

সবুজ আর রাহাত দু’জনে মাথা নেড়ে বলে,”তেমন কিছু না। সাংসারিক কিছু আলাপ ভাই।”

_কি আলাপ? তেল লাগবে,নুন লাগবে,আটা লাগবে এসব? কতবার বলেছি এইসব স্ত্রীলোকের মামলায় জরাবি না। জীবনটা ভাজাভাজা করে দেবে। আমার মতো চিরকুমার থাকার শপথ নে। তখন শুনলি না।

জামিল কথার মাঝখানে বলে ওঠে,”ভাই মেয়েটাকে নির্বাচনের পরে দেখে নিলে হয়না? দেখার তো মেলা সময় পাবেন।”

_না। ওর খবরাখবর নিয়মিত আমি চাই। কথাটা দ্বিতীয়বার মনে করাতে চাই না আমি।

দলের ছেলে গুলো মাথা নাড়ায়। একজন মেয়র পদপ্রার্থী, বিশিষ্ট জননেতা হাত ধুয়ে একটা পাঁচ ফুটিয়া মেয়ের পেছনে পরে আছে সেটা মানতে ইয়াসারের একনিষ্ঠ ভক্ত এবং কর্মীদের বেশ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ভাইয়ের কথা না শোনার মতো ভুল তারা করবে না। দলের সাধারণ সম্পাদকের পদটা যে সবার চাই!

***
মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে আলোর ঘুম কেটে যায়। পড়তে পড়তে কখন সে বইয়ের ভেতরে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পরেছিলো তা সে জানেনা। গত সপ্তাহে যত নির্ঘুম রাত সে কাটিয়েছে তার খেসারত তাকে এখন দিতে হচ্ছে। সামনে প্রথম ইনকোর্সের ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে ডিপার্টমেন্ট। পড়াশোনার ভীষণ চাপ। মাথা তুলে তাকাতেই দেখে আতাউর আলম তার দিকে তাকিয়ে আছে। আলো হাই তুলে বলে,”টের পাইনি আব্বু।”

আতাউর আলম একটা চেয়ার টেনে মেয়ের পাশে বসে। আলো সামনে খুলে রাখা বইটা বন্ধ করে বইয়ের সাড়িতে সাজিয়ে রেখে বলে,”কিছু বলতে এসেছিলে?”

আতাউর আলম নরম গলায় বলে,”সেদিন রাগের মাথায় অত বড় একটা পদক্ষেপ নিয়ে ফেললি আম্মু। আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।”

আলো একটা হাসি দিয়ে বলে,”তুমি ভয় পাচ্ছো? আতাউর আলম ভয় পাচ্ছে?”

_ঠিক ভয় না মা। তুই একটা মেয়ে। আর ওরা যা ভয়ংকর।

_ভয় পেও না। ভুলে যেও না তোমার মেয়ে কারাতে জানে। জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয়।

আতাউর আলম মেয়ের কথা শুনে হেসে ফেলে। হাসি থামিয়ে মেয়েকে বলে,”সব সময় গায়ের জোরে কাউকে বিপদে ফেলতে হয় না মা। বিপদে আরো অনেক ভাবে ফেলা যায়।”

আলো বাবার দিকে তাকায়। সত্যিই তো! সেদিন তো ইয়াসার তাকে গায়ের জোরে হেনস্থা করেনি। তার সাথে ছলনা করে তাকে দিয়ে পা ধরিয়েছে।
আতাউর আলম বলে,”সাত বছর আগে ওদের পরিবার নিয়ে যে আর্টিকেল টা বের করেছিলাম তার জন্য ওদের ডাউনফল শুরু হয়। ইয়াসারের মেজো ভাইটার নামে শ্লীলতাহানির মামলা হয়েছিলো। টাকা দিয়ে বিষয় টা ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছিলো ইমতিয়াজ মির্জা। গ্রাম থেকে একটা গরীব ঘরের মেয়েকে ধরে এনে ওর সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় যাতে একটু শোধরায় ছেলেটা,শুধরেছে কিনা জানিনা তবে পলিটিক্স থেকে দূরে সরে গিয়েছে। এখন শুধু সামিন ইয়াসার একাই পলিটিক্সের সাথে যুক্ত। ওরা তিন ভাই এক বোন। ছোটোজনকে কখনো দেখিনি,শুনেছি বিদেশে পরে আছে। আমেরিকাতে।
ইমতিয়াজ মির্জার ছোটো ভাই নিজের ভাইয়ের নাম ব্যবহার করে পুরো শহরে আতঙ্ক সৃষ্টি করে বেরাতো। আর্টিকেল টা বের হবার পরে জনগণ ভীষণ ক্ষেপে যায়। ফলশ্রুতিতে এমপি পদ হারিয়ে ঘরে বসে থাকে ইমতিয়াজ মির্জা। সবকিছুর সাথে আমি জড়িত ছিলাম। ওদের শত্রুও বলা যায়।

_জানি তো এসব কথা। আবার বলছো কেনো? আর তুমি চিন্তা করো না আমার জন্য। কিচ্ছু হবে না আমার। আচ্ছা ইমতিয়াজ মির্জার ছোটো ভাই এখন কোথায়?

_ইশতিয়াক? কোথায় আবার। পালিয়েছে কানাডা। আর দেশে ফেরেনি। এতো কিছুর পরে ইয়াসার মির্জাকে জনগণ কিভাবে গ্রহণ করে নিচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছি না।
_কেনো আবার? সবটাই তো টাকা আর জনগণের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। ছাত্রনেতা বলে কথা।

_হ্যা ঠিক বলেছিস। ওদের অনেক টাকা। রিয়েলস্টেটের বিজনেস থেকে প্রচুর উপার্জন হয়।

আলো কিছু বলবে তার আগে ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। আলো অনায়াসেই বুঝতে পেরে যায় ফোনটা কে দিচ্ছে। একটা হাত বাড়িয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখে আলো। আতাউর আলম বলে,”কে ফোন দিয়েছে? কথা বল।”
_গ্রামীনফোনের অফিস থেকে। তুমি বলো।
_না,আর কি বলবো। কাল তো তোর কলেজে প্রোগ্রাম আছে। এখন ঘুমিয়ে পর। বেশি রাত জেগে পড়ার দরকার নেই। আমার কাছে সিজিপিএ ডাজ নট ম্যাটার এট অল!

আলো হেসে তার আব্বুকে শুভরাত্রি বলে। আতাউর আলম চলে যেতেই তড়িঘড়ি করে দরজা বন্ধ করে ফোন বের করে ইশমামকে ভিডিও কল দেয়। রিং বাজার সাথে সাথে ফোনটা রিসিভ করে রেখে দেয় ইশমাম। আলো লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,”মুখটা দেখাও প্লিজ।‌ তোমার রুমের এসি দেখে কি করবো? আজ আমাদের বাসায় এসি নেই বলে শো অফ করছো নাকি?”
ইশমাম ফোনটা মুখের সামনে নেয়। অভিমানী গলায় বলে,”কোথায় ছিলে? এতক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছি।”

_আব্বু ছিলো পাশে।
_তো ? আব্বুকে বলতে পারতে না যে আব্বু তুমি যাও তোমার হবু জামাই ফোন দিচ্ছে,আমি কথা বলবো!

আলো হাসে। ইশমাম বলতে থাকে,”সবসময় আমাকে বলো। অথচ তুমি নিজেই তো তোমার পরিবারকে ভয় পাও। তাদের কেনো বলো না আমার কথা?”

আলো মাথা চুলকে বলে,”আম্মু জুতাপেটা করবে।”

_আচ্ছা জুতাপেটা হতে হবে না।

কিছুক্ষণ দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর আলো বলে,”আমার না তোমার চেহারাটা খুব কমন লাগে ইশমাম। কার সাথে যেন খুব মিল।”

ইশমাম মৃদু হেসে বলে,”হতেই পারে। পৃথিবীতে একই চেহারার সাতজন থাকে,জানো না?”

_একটা ব্যাপার বেশ হাস্যকর। আমাদের দুজনের সামনাসামনি কখনো দেখা হয়নি। ব্যাপার টা যুগ অনুযায়ী কতটুকু গ্রহণযোগ্য?

_একটুও না। যে শুনবে সেই হাসবে। ভাববে আমরা কত বোকা।

_আচ্ছা তোমার বাবার কথা বলেছিলে টিচার। তো উনি কি রিটায়ার্ড করেছেন?

ইশমাম চুপ করে থাকে। তার গলায় কথা আটকে আটকে আসছে। কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে বলে,”না।”

আলোকে কিছু বলতে না দিয়ে পুনরায় বলতে থাকে,”একটা কথা বলি অদ্রিতা?”
_হুম, বলো।
_নাহ কিছু না। আচ্ছা ঘুমাও এখন। কাল তো তোমার কলেজে প্রোগ্রাম হোস্ট করতে হবে। রাখছি। বাই!

ইশমাম ফোন কেটে দিলে আলো ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়। অপরপাশে সুদূর ফ্লোরিডায় নিজের ডরমেটরিতে,ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে দুচোখ বন্ধ করে থাকে ইশমাম। অদ্রিতা আলো নামের মেয়েটির সাথে প্রথম পরিচয়ের দিনগুলো স্মৃতিচারণ করতে থাকে সে।

করোনা মহামারীর সময়ে একটা অনলাইন ফোরামে আয়োজিত একটা বিতর্ক প্রতিযোগিতায় তারা দুজনেই ছিলো প্রতিযোগী। বাংলাদেশী মেয়ে শুনেই খানিকটা কৌতুহলী হয়ে অদ্রিতা আলোর সাথে আলাপ চারিতায় জরিয়েছিলো ইশমাম। হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলো সাংবাদিক আতাউর আলমের মেয়ে আলো। ততদিনে আলোর প্রতি তীব্র ভালোলাগার অনূভুতি, ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়েছিলো। ইশমাম বরাবর সবার কাছে নিজের পরিবার নিয়ে কথা কম বলে,নিজের বাবা-চাচাদের পরিচয় দিতে তার আত্মগ্লানি হয়। আলোর কাছে নিজের আসল পরিচয় দিতে গিয়েও দেয়না। সাংবাদিক আতাউর আলমের মেয়ে আর যাই করুক মির্জা বাড়ির ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাইবে না। এবং এটাই সত্যি,আলো মির্জাদের ঘৃণা করে, প্রচন্ড ঘৃনা করে।

যত দিন যাচ্ছে ইশমাম টের পাচ্ছে সে নিজেই নিজের মিথ্যে জালে আটকা পরছে। কি হবে সামনে? অদ্রিতা সবটা টের পেলে কি করবে? বড় ভাইয়াকে ইশমাম কিভাবে মানাবে? সবটা ভেবে ইশমামের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।

চলমান……..