বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে পর্ব-১৮+১৯+২০

0
636

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_১৮
#Esrat_Ety

দরজা লক করে সামিন আলোর দিকে তাকায়। তাকে দেখে আলোর হঠাৎ খুব ভ’য় হচ্ছে। এতোটা ক্ষে’পে যেতে ইয়াসারকে সে কখনো দেখেনি। আলো প্রথম দিন থেকে ইয়াসারকে যত অপমান করেছে, গায়ে থুতু মে’রে’ছে, গায়ে হা’ত তুলেছে,ইয়াসার কখনো মে’জা’জ দেখায়নি। ঠান্ডা মাথায় আলোকে বরদাস্ত করে গিয়েছে। কিন্তু আজ সামিন ইয়াসার যেন অন্য রূপ ধারণ করেছে। আলো একটা ঢোক গিলে ফেলে কন্ঠে তেজ ফিরিয়ে এনে বলে,”ভ’য় দেখাচ্ছেন? ভ’য় দেখাচ্ছেন আপনি আমাকে? শুনুন ইয়াসার মির্জা। আমি আপনাকে ভ’য় পাই না। আমার সাথে উলটো পাল্টা কিছু করতে এলে না! ঠ্যাং খোঁ’ড়া করে দেবো আপনার!”

ইয়াসার দাঁত কিড়মিড় করে আলোর দিকে এগিয়ে যায়,
“আচ্ছা! তাই নাকি?”
আলো ভয় পেয়ে গেলেও টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ইয়াসার আরেকটু এগিয়ে গিয়ে আলোর হাতের কব্জি ধরে। দাঁত খিচিয়ে বলে,”বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছি না আলো? বেশি বোঝো তুমি? আজ তোমার এই হাল তোমার বেশি বোঝার কারনে তা কি তুমি জানো? কেন আমায় চ’ড় মেরেছিলে সেদিন?”

আলো ইয়াসারের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে গায়ের সমস্ত শক্তি খরচ করে। ইয়াসার তার দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে,”কই? তোমার অর্জন কোথায়? একটা স্টেপ দেখাও তো। দেখি কেমন কারাতে জানো তুমি!”

আলো দুমিনিট গ’লা’কা’টা মুরগির মতো ছটফট করে নিস্তেজ হয়ে পরে। নিষ্প্রাণ গলায় বলে,”রাত দশটার সময় মানুষ কম্পোস্ট বানাতে যায়? আমার যায়গায় অন্য কেউ হলে সেটাই ভাবতো, যেটা আমি ভেবে ফেলেছি!”

_সেজন্য আমাকে খু’নী বানিয়ে দেবে?
_কেন? ভুল বললাম কোথায়? আমার ভাইদের মে’রে বড় বাজারের ব্রিজের নিচে কচুরিপানার মধ্যে কিংবা মিউনিসিপ্যালিটির ড্রেনে ফে’লে দিয়ে আসবেন। বলেন নি এমন কথা?

সামিন থতমত খেয়ে যায়। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মিনমিন করে বলে,”ভ’য় দেখিয়েছি শুধু। করতাম না কিছু। খু’ন খারাবি কখনো করিনি।”

_রাত দশটার সময় কম্পোস্ট কে বানাবে পাগল ছাড়া?
_আমি রাত তিনটার সময় বানাবো। তাতে তোমার কি গোয়েন্দা বাপের গোয়েন্দা কন্যা?
কন্ঠে তেজ নিয়ে বলে উঠল সামিন।

আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন আবারো আগের মূর্তি ধারণ করে বলে,”আর যদি কখনো দেখি আমি বেশি লম্ফ ঝম্প করেছো তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে আলো‌। আজ কিছু বললাম না। চেয়েছিলাম শাস্তি দিতে। দিলাম না। মেয়ে মানুষ। দুর্বল প্রজাতি তাই।”

_কি করতেন? গায়ের জো’র দেখাতেন? আপনার মতো কা’পু’রু’ষে’রা আর কিই বা পারে। সব পারিবারিক শিক্ষা। নিজের মা চাচীকে দেখেছেন আজীবন বাবা চাচার পায়ের তলায় পি’ষ্ট হতে। সেটাই শিখেছেন‌। আপনার মতো পুরুষেরা ঐ তথাকথিত পুরুষধর্মের অনুসারী,পূ’জা’রী!

_আচ্ছা! আর তোমার বাবা কি করতো? তোমার মাকে মাথায় উঠিয়ে নাচতো সারাদিন?
ঠান্ডা গলায় বলে ইয়াসার। আলো কিছুক্ষণ চুপ করে ইয়াসারের চোখে চোখ রেখে বলে,”আমার বাবাকে দেখেছি সারাজীবন আমার মাকে বু’কে রেখেছে। না মাথায়,না পায়ের তলায়। একজন স্ত্রীর স্থান তার স্বামীর বুকে!”

আলোর এই একটা কথায় কি ছিল সামিন জানে না। কিন্তু এই কথাটিতে সামিন থ’ম’কে গিয়েছিলো। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের সমীকরণের পাঠের হাতেখড়ি হলো সামিনের, সেটা টের পেলো না কেউই।

দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়। আলো বলতে থাকে,”অবশ্য আপনি এসব বুঝবেন কি করে? আপনার বাবা আপনার সামনে কখনো আপনার মাকে বলেছে “ভালোবাসি?”
সামিন রোবটের মতো মাথা নাড়িয়ে “না” বলে। যেন সে আলোর হাতের চাবি দেয়া পুতুল হয়ে গিয়েছে। আলো বলে,”কিন্তু অসংখ্য বার আপনার সামনেই আপনার মাকে ধ’ম’কে’ছে। তাই তো? সেজন্যই তো শুধু শিখেছেন স্ত্রী ধ’ম’কে’র জিনিস,তুচ্ছ।”

কিছুক্ষণ চুপ করে আলোর দিকে তাকিয়ে সামিন হঠাৎ করে নরম গলায় বলে ওঠে,”বেশী চেঁচিয়ে কথা বলবে না আর। পাড়া প্রতিবেশী ভয়ংকর লেভেলের কু’চু’টে। উল্টো পাল্টা কথা বানাতে ছাড়বে না। আমি সেটা বরদাস্ত করবো না। অনেক রাত হয়েছে। শুয়ে পরো। আমি কোনো জোর খাটাবো না। দুর্বল জাতি তোমরা। জোর খাটানোর প্রয়োজনও নেই। আজ যে শাস্তি তোমায় দিতে চেয়েছিলাম সেটা হলো তোমার মুখে স্কচ টেপ লাগিয়ে রাখতাম। ”

***
“স্যার ম্যাম এসেছে।”

ইলহাম চোখ তুলে তার পিএ সিফাতের দিকে তাকায়। তারপর হাতের ফাইলটা দেখতে দেখতে বলে,”ইহান এসেছে সাথে? পাঠিয়ে দাও।”

সিফাত বলে,”না না স্যার। আপনার বৌ ম্যাডাম না। জুঁই ম্যাডাম!”

ইলহাম হাতের ফাইলটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে যায়। জুই কেবিনের পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢোকে। সিফাত চলে যায়। ইলহাম জুই এর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে, বেগুনী রঙের পাতলা জরজেটের শাড়ি,বড় গলার ব্লাউজ। ঠোঁটে কড়া করে লিপস্টিক। ইলহাম গম্ভীর কন্ঠে বলে,”এভাবে সেজে অফিসে এসেছো কেনো?”

জুই একটা অনর্থক হাসি হেসে ইলহামের সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলে,”প্লিজ ইলহাম। এসব তোমার ঐ হার হাবাতে বৌয়ের সাথে করো। আমার সাথে নয়। আমি একজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ওম্যান। আমার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে সাজবো।”

ইলহাম হেসে গদগদ হয়ে বলে,”ওকে ওকে! রাগ করো না। আসলে তোমার এই সৌন্দর্য অন্য কেউ দেখলে আমার হিংসা হয়। কেনো বোঝো না এটা?”

জুই ইলহামের দিকে সামান্য ঝুঁকে বলে,”এসব কথায় আর চিড়ে ভিজবে না ইলহাম। আসল কথা বলো! বিয়েটা কবে করছো আমায়? কেনো তোমার ঐ বৌকে ঘার ধরে বের করে দিচ্ছো না! তোমার বড় ভাইকে কেনো এতো ভয় পাচ্ছো?”

ইলহাম একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”ভাইয়াকে ভয় পাচ্ছি না জুই। ইহানের কথা ভাবছি। মা ছাড়া কিছুই বোঝে না ও। আরেকটু বড় হোক, তারপর না হয়….”

জুই ইলহামের কথা শুনেই কপাল কুঁচকে ফেলে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”আর এক বছর সময় দিলাম। তারপর যদি ওকে না তাড়িয়ে দাও না,তাহলে আমাকে তুমি হারিয়ে ফেলবে ইলহাম।”

“ভাবী।”
ইশিতার ডাকে রিতু শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে ব্যাস্ত হয়ে পরে। ইশিতা এসে রিতুর কাঁধে হাত রেখে চিন্তিত হয়ে বলে,”কাঁ’দ’ছো কেন? ভাইয়ার সাথে কিছু হয়েছে?”

রিতু কান্নাভেজা কন্ঠে বলে,”ঐ মেয়েটা আবার তোমার ভাইয়ের অফিসে এসেছে আপু।”

ইশিতা রেগে গিয়ে বলে,”আমি বারবার বলি,চলো বড় ভাইয়াকে বলি। চলো। তুমি কেনো আমার কথা শুনছো না?”

_ভাইয়া ওনাকে শাস্তি হিসেবে ব্যাবসা থেকে দূর করে দেবে আপু। আমি ওনার ভোগান্তি চাচ্ছি না।

“তাহলে মরো তুমি। মরে যাও।”
আলোর কন্ঠ শুনে রিতু আর ইশিতা চ’ম’কে ওঠে‌। আলো তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রিতু চোখ মুছে ওদিকে মাথা ঘুরিয়ে নেয়।
আলো কন্ঠে বিদ্রুপ মিশিয়ে বলে,”এই যে তুমি। এদিকে তাকাও। এই বাড়ির লক্ষী মেজো বৌমা। তাকাও বলছি।”

রিতু ধীরে ধীরে তাকায় আলোর দিকে। আলো বলে,”তুমি একটা জড়বস্তু। একটা অবজেক্ট তুমি। তোমার মরে যাওয়া উচিত।”

ইশিতা আলোকে বলে,”এভাবে কথা বলবে না আলো। ভাবী এমনিতেই কষ্ট পাচ্ছে।”

আলো ইশিতা কে উপেক্ষা করে বলে,”কেনো ওকে লা’ত্থি মেরে চলে যাচ্ছো না এখনো? তোমাকে কি আমার মতো জিম্মি করে রেখেছে? রাখেনি । তাহলে কেনো একটা চরিত্রহীনের মায়ায় আঁটকে আছো। কবুল বলেছো বলে? ওর বাচ্চা পেটে ধরেছো বলে?”

_হ্যা তাই। তাই।
ডুকরে কেঁদে ওঠে রিতু। আলো কন্ঠে তেজ নিয়ে বলে,”তোমাদের মতো অবজেক্ট দের মরে যাওয়াই উচিত।”

রিতু কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়। ইশিতা তার পিছু পিছু ছুটে যায়।

আলো দাঁড়িয়ে আছে। ইশমাম পেছন থেকে বলে,”এখানে কি নারী মুক্তির আন্দোলন চলছে?”

আলো ঘুরে পেছনে তাকিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। ইশমাম আলোর দিকে এগিয়ে যায়। নিচু স্বরে বলে,”তোমাকে যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি অদ্রিতা। বেগম রোকেয়ার থেকে কোনো অংশে কম না তুমি।”

_আর আমি তোমাকে যত দেখছি তত আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। রিতুর চেয়েও বড় জড়বস্তু তুমি। একটা ক্রি’মি’না’ল ভাইয়ের হনুমান তুমি।

ইশমাম চুপ করে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো দ্রুত পায়ে হেঁটে সামিনের ঘরে চলে যায়। ইশমাম ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে বলে ওঠে,”বারবার বলেছি, এসবে জরিও না,জরিও না। কিন্তু না। তোমার তো সাহসীকতা দেখাতে হবে। তোমার আর ভাইয়ার সংঘাতে আমার অনূভুতিকে জলাঞ্জলি দিতে হলো অদ্রিতা!”

****
গাড়ি থেকে নেমে ইমতিয়াজ মির্জা শান্তিনীড়ের অন্দর মহলে প্রবেশ করে। রিয়াজ গাড়ি থেকে তার ব্যাগ নামিয়ে লিভিং রুমে রেখে চলে যায়। গায়ের ব্লেজার খুলে একটা ডিভানের উপর রেখে ইহানকে ডাকতে থাকে। রান্নাঘর থেকে রিতু বের হয়ে অবাক চোখে তাকায়,”বাবা আপনি! আপনার তো সামনের সপ্তাহে আসার কথা ছিলো।”

_ছিলো। কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে তাই আর বসে থেকে কি করতাম। ইহান দাদুর কথা খুব মনে পরছিলো। সে কোথায়?

_তার ফুপির কাছে।
রিতু আমতা আমতা করে জবাব দেয়। সে আসলে চিন্তায় পরে গিয়েছে, সামিন ইয়াসার বাড়িতে নেই। এই অবস্থায় তার শশুর যদি আলোকে দেখে তাহলে রিতু কি বলবে!

সিঁড়ি বেয়ে ইশমাম নিচে নেমে দাঁড়িয়ে পরে। ইমতিয়াজ মির্জা উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ইশমামের দিকে। ইশমাম কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে বলে,”কেমন আছেন বাবা!”
_ভালো। তুমি হঠাৎ? কি মনে করে? আমি তো ভেবেছিলাম একেবারে আমার জানাযায় এসে উপস্থিত হবে!

ইশমাম এগিয়ে গিয়ে বাবার সাথে সৌজন্যমূলক কোলাকুলি করে নিচু স্বরে বলে,”কাজ ছিলো কিছু।”
_ও আচ্ছা আচ্ছা। আমাদের জন্য আসোনি তাহলে।

ইশমাম কিছু বলে না। ইমতিয়াজ স্বাভাবিক গলায় বলে,”এসেছো যখন,নিজের ভাগ টা বুঝে নিও আর তার সাথে নিজের দায়িত্বটাও।”

সিঁড়ি বেয়ে আলো নিচে নেমে আসে। রিতু মাথায় হাত দিয়ে বিড়বিড় করে বলে,”এর ও ঠিক এই মুহূর্তে নিচে নামার ছিলো! ইয়া মাবুদ! আমি এখন কি করবো!”

ইমতিয়াজ মির্জা অবাক হয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো ‘
নেমে দাঁড়িয়ে পরে লিভিং রুমে। রিতু একবার আলো আর একবার ইমতিয়াজ মির্জার দিকে তাকায়। ইমতিয়াজ মির্জা আলোর দিকে তাকিয়ে ধ’ম’কে ওঠে,”এই মেয়ে! এখানে কি তোমার?”

“ও এখন এ বাড়ির লোক বাবা। তোমার বড় ছেলের বৌ।”

সামিন ইয়াসারের কন্ঠ শুনে ইমতিয়াজ মির্জা সদর দরজার দিকে তাকায়। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে সামিন। এয়ারপোর্টে নেমেই ইমতিয়াজ বড় ছেলেকে ফোন করেছিলো। সামিন তাই ছুটে এসেছে যাতে আলোকে নিয়ে কোনো ঝামেলা তৈরি না হয়।

_বড় ছেলের বৌ মানে?
হতভম্ব হয়ে যায় ইমতিয়াজ মির্জা। সামিন বলে,”মানে আমার বৌ। ওকে আমি বিয়ে করেছি।”

আলো সামিন ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে তার বাবার দিকে তাকায়। সে মনে মনে খুব চাচ্ছে এখন বাবা ছেলেতে যুদ্ধ লেগে যাক।

ইমতিয়াজ মির্জা ছেলের দিকে হা হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,”তুমি কি আমার সাথে মজা করছো ?”

_তোমার সাথে মজা করতে আমি আতাউর আলমের মেয়েকে বাড়িতে এনে শাড়ি, চুড়ি পরিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে রাখবো বাবা?

_কোন সাহসে তুমি এই কাজটা করলে! তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছো? শেষে ওই আতাউর আলমের মেয়েকে? যে আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নষ্ট করেছিলো? এই মেয়েটা তোমাকে চ’ড় মেরেছিলো ভরা জনসভায় সেটা ভুলে গেলে?

সামিন বাবার কথার উত্তর না দিয়ে আলোর দিকে তাকায়। তারপর বলে,”তোমার শশুর। সালাম দাও।”

আলো একবার সামিন, একবার ইমতিয়াজকে দেখে হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। সামিন কোনো এক অজানা কারনে হেসে ফেলে। সে আসলে আগে থেকেই জানতো আলো ঠিক এই কাজটাই করবে। ইমতিয়াজ মির্জা বলে,”কী ঔদ্ধত্য এই মেয়ের। এটা তুই কি করলি বেটা! তাও আমাকে না জানিয়ে! গদি ছেড়েছি দেখে দাম দিচ্ছিস না দেখছি! কেনো করেছিস ওই মেয়েকে বিয়ে তুই! বল!”

_ভালো লেগেছিলো।

সামিন বাবাকে আসল কথাটা বলে না। ইশমাম ভাইয়ের কথা শুনে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকায়। সামিন বলতে থাকে,”মেয়েটা একটু আলাদা তাই ভালো লেগেছিলো। আমি সংসার করতে পারলে তোমার অসুবিধে হবার কথা না বাবা! আমি যে বিয়ে করি সেটা তো তুমিও চাইতে!”
_তাই বলে আতাউরের মেয়েকে?

সামিন এক রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে,”হ্যা। আতাউরের মেয়ে অদ্রিতা আলোকে।”

***
বাসার পরিস্থিতি কিছুটা থমথমে হয়ে আছে। ইমতিয়াজ মির্জা ছেলের ওপর প্রচণ্ড অভিমান করে নিজের ঘরে বসে আছেন। ইহানকে ছাড়া কাউকে সে ঘরের ভেতর ঢুকতে দিচ্ছে না। সামিন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খাওয়া দাওয়া করে দোতলায় উঠে গিয়েছে। যেন কিছুই হয়নি।

দোতলা থেকে পরী তার ব্যাগ গুছিয়ে নেমে ডাইনিং রুমে ইশিতার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ইশমামের দিকে এক পলক তাকিয়ে ইশিতাকে বলে,”আসছি আপু।”
_আবার সামনের সপ্তাহে আসবি। বারবার ফোন দিতে আমার ভালো লাগে না।
পরী মাথা নাড়ায় ঠিকই কিন্তু মনে মনে বলে,”তোমার এই রামগরুরের ছানা ভাইটা যতদিন এখানে আছে আমি এ পথে
আসছি না।”

পরী চলে গেলে ইশমাম বলে,”মেয়েটার কি কোনো সমস্যা আছে?”

_কেনো বলতো?
_কেমন এবনরমাল। হাঁটাচলা করে অদ্ভুত ভাবে। সামান্য কথা বললেই লাফিয়ে ওঠে। অতিরিক্ত ন্যাকা মনে হয় না তোর? ও কি পোনা চাচার প্রিম্যাচিওর বেবি ছিলো?

ইশিতা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। গম্ভীর কন্ঠে ইশমামকে বলে,”বিদেশে থেকে থেকে ক্ষ্যা’পা মেয়েদের দেখে দেখে পরীর মতো মিষ্টি,নম্র ভদ্র মেয়েকে ন্যাকা লাগবেই। স্বাভাবিক।”

ইশমাম ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,”তুই এতো ক্ষে’পে যাচ্ছিস কেনো? আচ্ছা ন্যাকা শব্দটা আমি ফিরিয়ে নিলাম। পরী হচ্ছে খাঁটি বাঙালি নারী। হয়েছে?”

ইশিতা কোনো কথা বলে না, নাক চোখ কুঁচকে খেতে থাকে। এ বাড়ির একটা ছেলেও একটু ভদ্র স’ভ্য হলো না। এটাই তার আফসোস!

***
সামিন খেয়াল করেছে সকাল থেকে আলোর মুখটা অস্বাভাবিক অন্ধকার হয়ে আছে। খেতে পর্যন্ত যায়নি নিচে। পাত্তা না দিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে জামা বদলে বেরিয়ে আসে সে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গায়ে পারফিউম মাখতে মাখতে আবারো আলোর দিকে তাকায়। আলো মাথা নিচু করে বিছানায় বসে আছে। গাড়ির চাবি আর সানগ্লাস নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সামিন। আলো দৃষ্টি ঘুরিয়ে দরজার দিকে চায়।

ইহানকে স্কুলের জন্য বিদায় জানতে পোর্চের নিচে এসে দাঁড়ায় রিতু। পোনা চাচা ইহানকে স্কুলে আনা নেওয়া করে। রিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সামিন বলে,”একটা কাজ করে দেবে রিতু?”
_কি কাজ ভাইয়া?
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রিতু।

“ভাবী আসবো!”
রিতুর কন্ঠস্বর শুনে আলো নড়েচড়ে বসে। গম্ভীর কন্ঠে বলে,”এটা আমার ঘর না। এতো পারমিশন নেওয়ার কিছু নেই।”

রিতু ভেতরে ঢোকে। আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”কাঁদছিলেন নাকি ভাবী!”
_কিছু বলার থাকলে বলে বিদায় হও এ বাড়ির লক্ষী মেজো বৌমা।

রিতু এগিয়ে গিয়ে বিছানার একপাশে বসে। আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনি কি কোনো কারনে কষ্টে আছেন?”

আলো রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”জোর করে তুলে এনে বিয়ে করেছে তোমার ভাসুর। প্রতিটা দিন কতটা মানসিক যন্ত্রনার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আমি,আর তুমি আমাকে এই প্রশ্ন করছো?। না। আমি আনন্দে আছি। এতো আনন্দে আছি যে আনন্দে তোমাদের সবাইকে খু’ন করতে ইচ্ছে হচ্ছে!”

রিতু বলে,”ঠিক সেটা না ভাবী। বলতে চাইছি শারীরিক কোনো সমস্যা? ডাক্তার ডাকবো কি না!”

আলো চুপ করে বসে থাকে। রিতু বলতে থাকে,”শারীরিক সমস্যার কথা আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন ভাবী। আমি তো আপনার বোনের মতোই।”

কয়েক মুহূর্ত পরে আলো বলে ওঠে,”ভাই দুটোর আজ জন্মদিন। প্রত্যেক বছর এই দিনে আমি কত কিছু করি ওদের নিয়ে। আজ দেখো, মুখটাও দেখতে পারছি না আমি আমার ভাইদের।”

এতটুকু বলে আলো থেমে যায়। কাদের এসব বলছে সে? এদের বলে কি লাভ! কোনো লাভ নেই! কোনো লাভ নেই!

***
আজ বৌবাজার এলাকার ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে মিটিং বসেছে। শহরের নবনির্বাচিত মেয়র সামিন ইয়াসার মির্জা কাগজপত্র ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। পাশ থেকে চা দিতে আসা পঞ্চাশোর্ধ এক মুরব্বি সালাম দিয়ে বলে,”ভালো আছেন মির্জা সাহেব?”

সামিন কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে লোকটাকে দেখে। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলে বলে,”ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমি ভালো আছি। আপনি?”
_আল্লাহ যেরকম রেখেছে। আপনাদের দোয়ায় ভালো আছি।

সামিন কাগজ গুলো একজন প্ল্যানিং অফিসারের হাতে দিতে দিতে বলে,”আপনি আমাকে আপনি আপনি করে বলছেন কেনো চাচা? আমি তো আপনার ছেলের বয়সী!”

লোকটা খুশি হয় সামিনের কথায়, কিন্তু বলে,”তুমি কত বড় একজন মানুষ। নগরপিতা আমাদের।”

সামিন ভ্রু কুঁচকে ফেলে, তারপর শুকনো একটা হাসি দিয়ে বলে,”আমি শুধু সেবক চাচা। এসব কথা বলবেন না। এগুলো বলা ঠিক না।”

রাহাত কোথা থেকে এসে সামিনকে বলে,”ভাই সাইডে চলেন একটু কথা আছে।”

সামিন অবাক হয়ে রাস্তার পাশে গিয়ে বলে,”কি?”
_লিজের কাগজ নিয়ে ঝামেলা করছে ভুঁইয়ার দল। লিজের মেয়াদ শেষ কিন্তু দখল ছাড়ছে না।

সামিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,”যাস্ট ক’টা দিন অপেক্ষা কর। ওদের ইচ্ছে মতো উড়তে দে। আমি দেখবো বিষয় টা।”

রনি এসে বলে,”ভাই কি কাজ বলেন। কি করতে হবে?”

_একটু বয়েজ কলেজে যা।

রনি হা হয়ে সামিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর রাগ দেখিয়ে বলে,”ভাই এর জন্য কিন্তু আমাকে আলাদা বেতন দিতে হবে বলে দিলাম। আপনার ঐ দু’দু’ভা’তু শ্যালক দু’টোকে দেখভাল করা চাট্টিখানি কথা না।”

সামিন রনির কথায় হেসে ফেলে।

***
ফুলির মা একবার আলোর দিকে তাকিয়ে আবারো নিজের কাজে মন দেয়। তারপর কিছুক্ষণ যেতেই বলে ওঠে,”বিয়ের সময় ফুলির বাপটারেও আমার পছন্দ ছিলো না ভাবী। বাপ মা এক প্রকার জোর করে বিয়ে দিছিলো। প্রথম প্রথম আমিও আপনার মতো স্বামীরে কাছে ঘেঁ’ষ’তে দিতাম না। পরে কেমনে কেমনে জানি মায়ায় পইরা গেলাম মানুষটার। আপনিও পরবেন,দেইখেন। ভাইজান আমার লাখে এক।”

আলো চোখ রাঙিয়ে ফুলির মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”ঘর ঝাঁড় দেওয়া হয়ে গিয়েছে? এবার যাও।”

ফুলির মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আপন মনে বিড়বিড় করে বলতে থাকে,”এই শহরের কত বড় বড় লোক তাদের মেয়ে বড় ভাইজানের কাছে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব পাঠাইতো , আমাদের বড় ভাইজানরে হেলাফেলা ভাবনের দরকার নাই।”

আলো উঠে দাঁড়িয়ে ফুলির মাকে একটা কঠিন কথা বলতে যাবে অমনি নিচতলা থেকে কেউ ডেকে ওঠে,”আপু।”

আলো থ’ম’কে যায়। একপলক ফুলির মায়ের দিকে তাকায়। ফুলির মা কিছু বুঝতে পারছে না। নিচে কেউ আবারো ডেকে ওঠে,”আপু‌।”

আলো কয়েক মুহূর্ত থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে ছুটে ঘর থেকে বের হয়। না,সে ভুল শোনেনি। আজান আয়াতই ডাকছে তাকে। কিছু ভুল শোনেনি সে। দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে থাকে আলো, মাঝ খানে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরে নিচে তাকায়। আজান আয়াত লিভিং রুমে দাড়িয়ে আছে । আলো ছুটতে ছুটতে নিচে নামতে থাকে। সামিন ইয়াসার সিঁড়ির কাছটাতে দাঁড়িয়ে আছে। আলো দ্রুতপায়ে নামতে গিয়ে হোঁ’চ’ট খেয়ে পরে যাচ্ছিল, সামিন তাকে ধরে ফেলে। আলো বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে। একপলক সামিন ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে সে কপাল কুঁচকে ফেলে ইয়াসারের হাত সরিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। আজান আয়াত বোনের দিকে ছুটে আসে। দুহাতে নিজের ভাই দুটোকে আগলে নিয়ে আলো চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে। কয়েক মূহুর্ত তিন ভাইবোন চুপ করে থাকে। সামিন ওদের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে ওদেরকে।

নীরবতা ভেঙে আলো বলে ওঠে,”তোরা? তোরা এখানে কিভাবে!”

আজান আয়াত চুপ করে সামিনের দিকে ভীত চোখে তাকায়। এর মধ্যে একটা লোক এসে বেশ বড় সাইজের একটা বক্স রেখে চলে যায়। আলো আজান আয়াতের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামিনের দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে ফেলে। তারপর আজান আয়াতের দিকে ঘুরে বলে,”কি করেছে ঐ লোকটা তোদের সাথে? মে’রে’ছে তোদের? ভয় দেখিয়েছে? কি করেছে বল!”

আজান আয়াত কিছু বলার আগেই সামিন ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়,”ওসব কিছু করিনি। শুধু কলেজের সামনে থেকে ধরে এনেছি।”

আলো হতভম্ব হয়ে সামিনের দিকে ফিরে তাকায়। রাগী গলায় বলে,”ধরে এনেছেন মানে? কেনো ধরে এনেছেন? গু’ন্ডা কোথাকার! ক্রিমিনাল।”

সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,” যা বাবা, সকাল থেকে তো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছিলে ভাইদের দেখতে পারছো না বলে। এনে উপকার করলাম তাতেও আমি গু’ন্ডা? ইয়ে তো না ইনসাফি হে!”

আলো সামিনের দিকে তে’ড়ে যায়,”সেজন্য ওদের তুলে আনবেন? সব কিছু গায়ের জোরে করবেন? ক্ষমতার জোরে?”

_তুলে আনিনি। কলেজের গেইটের কাছে আমার লোক দাঁড়িয়ে ছিলো। ওরা বের হতেই ওদেরকে জিজ্ঞেস করা হয় ওরা তোমাকে দেখতে চায় কিনা। ওরা হ্যা বলেছে তারপর নিয়ে এসেছে ওদের‌। জিজ্ঞেস করো। ওদেরকে জিজ্ঞেস করো।”

আলো আজান আয়াতের দিকে তাকায়। আয়াত বলে,”খুব দেখতে ইচ্ছা করছিলো তোমাকে আপু।”

আলো ভাইয়ের গায়ে দুমদাম কি’ল ঘু’ষি মারতে মারতে বলে,”সেজন্য গু’ন্ডাদের সাথে চলে আসবি? তোদের বুদ্ধি হবে না? ওরা কি করেছিলো মনে নেই? যদি তোদের মে’রে দিতো? যদি ই’য়া’বা ভরে দিতো ব্যাগে? জানিস না ওরা কত ভয়ংকর। জানিস না?”

সামিন আলোকে কয়েক মুহূর্ত দেখে কন্ঠস্বর গম্ভীর করে বলে ওঠে,”ব্যস! নাটক হয়েছে অনেক। এসব এখন বন্ধ। ভাইদের নিয়ে কেক কাটো আর হ্যাপি বার্থডে খতম করো। ওদেরকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবো নয়তো তোমার বাবা স্ট্রো’ক করবে।”

সামিন বক্স খুলে একটা বিশাল সাইজের কেক বের করে একটা টেবিলের ওপর রাখে। একে একে বাড়ির সবাই লিভিং রুমে চলে এসে ওদের দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সামিন আলোর হাতে ক্যান্ডেল ধরিয়ে দিয়ে বলে,”নাও এটা।”

আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর হাতের ক্যান্ডেল টা ছুড়ে ফেলে দেয় সে। আজান এসে আলোর হাত ধরে, নরম গলায় বলে,”থাক না আপু‌ । চলো কেক কাটি। এমন সুযোগ যদি আর কখনো না পাই?”

আলো ভাইয়ের শুকনো মুখটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলে,”চল।”

তিন ভাইবোন মিলে কেক কা’ট’ছে। সামিন একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে আছে। ভাইদের কেক খাইয়ে দিয়ে তাদের কপালে গভীর চুম্বন এঁকে দেয় আলো। চোখ ছলছল করছে তার। ঠোঁট কাঁপছে।

কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর নীরবতা ভেঙে আলো সামিনের দিকে কঠিন দৃষ্টি দিয়ে তাকায়। কন্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে বলে ওঠে,”ওদেরকে সেইফলি বাড়ি পৌঁছে দেবেন। ভদ্রতার সাথে। আর কোনো গু’ন্ডা’মি নয় ইয়াসার মির্জা!”

***
রাতের খাবার খেতে আলো নিচে যায়নি। সিতারা সামিনের কথায় আলোর ঘরে দিয়ে গিয়েছে খাবার। খাবার টেবিলে ইমতিয়াজ মির্জা খেতে বসেছেন ছেলেদের নিয়ে‌। খেতে খেতে বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”চাচ্ছো কি আসলে তুমি? এত বড় একটা অঘটন ঘটিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারছো না! শত্রুর মেয়ের সাথে আর যাই হোক সংসার হয় না, এতটুকু বোঝার ক্ষমতা নেই তোমার?”

সামিন চুপচাপ খাচ্ছে। বাবার কথার উত্তর দিতে ইচ্ছুক নয় সে। ইমতিয়াজ নিজের ছেলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে
হাত ধুয়ে উঠে পরে। এখন বলে তো লাভ নেই। এসব তো তারই ভুল। নিজের হাতে ছেলে গুলোকে জেদী আর বেপরোয়া তৈরি করেছে। এখন কার কাছে অভিযোগ জানাবে সে!

অন্ধকারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আলো চোখ দিয়ে দুফোঁটা অশ্রু ঝরায়। কিছু সময় ভাইদের কাছে পেয়েছিলো সে, তাতে কি আর মন ভরে! মনটা কেমন অশান্ত হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে ঐ লোকটাকে খু’ন করে এখান থেকে পালিয়ে যেতে। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে নেয় আলো। করবে না, কখনোই ক্ষ’মা করবে না ঐ পি’শা’চ টাকে সে। কখনোই না।

কিছুসময় যেতেই আলোর কেমন অদ্ভুত ঠেকে, শুকনো পাতার মচমচ শব্দ হচ্ছে। মাথা ঘুরিয়ে ডানপাশে ফিরে তাকায় সে। আজ বিকেলের দিকে ঝড়ো হাওয়া বয়ে গিয়েছিলো কিছুক্ষণ। খোলা বারান্দাটা শুকনো পাতায় ভর্তি হয়ে গিয়েছে। পরিষ্কার করা হয়নি। আলো মেঝের দিকে তাকায়। পাতাগুলো অমন নড়ছে কেনো! বেশ অবাক হয় আলো। খানিকটা ঝুকে তাকাতেই শি’উ’রে ওঠে সে।

বিকট শব্দে চেঁচিয়ে ওঠে,”সাপ…….!”

সামিন ঘরেই ছিলো। আলোর চিৎকারে ছুটে যায় বারান্দায়। আলোর ফ্যা’কা’শে মুখটা দেখে বারান্দার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পরে। আলো উন্মাদের মতো ছুটতে ছুটতে এসে সামিনের বুকে হুমরি খেয়ে পরে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় সামিনের চোখ দুটো রসগোল্লা সাইজের মতো বড় হয়ে যায়। আলো আ’ত’ঙ্কে এতটাই জমে গিয়েছে যে সে খেয়ালই করেনি সে কাকে আকরে ধরে রেখেছে।

কয়েক মুহূর্ত কেটে যায়। সামিন আলোর মাথার দিকে দৃষ্টি রেখে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,”একটা সাপের ভয়ে ফে’রা’উ’নে’র বুকে আশ্রয় নিলে আছিয়া?”

চলমান………..

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_১৯
#Esrat_Ety

আলো নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সরে দাঁড়ায়। সামিন একপলক আলোর নিচু করে রাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,”কোথায়? কোথায় সাপ?”

আলো সামিনের দিকে ফিরে তাকায় না। ওদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে তর্জনী আঙ্গুল তুলে বারান্দার ডান দিকটা দেখিয়ে নিচু স্বরে বলে,”ওদিকে ছিলো।”

সামিন সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যায়। রেলিং এর কাছে গিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে পোনা চাচাকে ডেকে বলে,”চাচা রিয়াজকে একটু পাঠিয়ে দিন তো।”
নিচ থেকে পোনা চাচা উত্তর দেয়,”তোমার ঘরে বাবা?”
_হ্যা আমার ঘরে। তাড়াতাড়ি।

কথাটি বলে সামিন আলোর দিকে এক পলক তাকিয়ে বারান্দার এমাথা থেকে ওমাথা পায়চারি করতে লাগলো। আলো এখনো আ’ত’ঙ্ক থেকে বের হতে পারছে না। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে দাঁড়িয়ে।
রিয়াজ এসে দরজায় নক করতেই সামিন গিয়ে দরজা খুলে দেয়।

তারপর বলে,”বারান্দায় একটা সাপ দেখা গিয়েছে।”

রিয়াজ বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,”কতবার বলেছি হাসনাহেনা গাছটা উ’প্রে ফেলে দেই। ওটার জন্যই এমন হচ্ছে। এই নিয়ে দুইবার। আমার কথা তো বিশ্বাস করেন না স্যার।”

_ওসব কিছু না রিয়াজ। তুমি শেষ কবে কার্বলিক এ’সি’ড স্প্রে করেছিলে বাগানে?
_দুই সপ্তাহ আগে।
_এখন আবার ছড়িয়ে দাও। ফুলির মা কে বলো বারান্দা থেকে এইসব শুকনো পাতা পরিষ্কার করে দিতে।

রিয়াজ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে চলে যায়। কোথাও কিছু নেই। ফুলির মা এসে বারান্দা সহ পুরো ঘরটাই পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। আলো তখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে।
সামিন হালকা কেশে আলোর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। আলো চোখ তুলে তাকায়। সামিন বলে,”সাপ তোমার চিৎকার শুনেই মাগো বাবাগো বলে পা’লি’য়ে’ছে। আরাফ ঠিকই বলে, তোমার গলায় একটা অদৃশ্য মাইক রয়েছে। তুমি পলিটিক্স করলে মানাবে। মাইক ছাড়াই ভাষণ দিলে তিন কিলোমিটার দূরে থেকে শোনা যাবে।”

আলো খুব অপমানিত বোধ করলো কথাটায় যেন। তার কন্ঠস্বর নিয়ে এমন কু’ৎ’সি’ত মন্তব্য এর আগে কেউ করেনি। কপাল কুঁচকে ফেলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই মাত্র সে এই লোকটার কাছে একটা ভী’তু মেয়ে প্রমানিত হয়েছে।
আলোর নীরবতা দেখে সামিন ঘোর লাগা কন্ঠে বলে ওঠে,”বাহ। এই না হলে নারী। ভয় পেয়ে কাঁচুমাচু মুখ করে রাখবে, মাথা নিচু করে রাখবে, তা না করে কখনো বৈশাখের বিলের নতুন কৈ মাছ কিংবা ঝিলের চিংড়ি মাছের মতো হাত পা ছুড়ে লাফা লাফি করতে থাকো। তোমাকে মানায় না আলো‌।”

আলো সামিনের দিকে তাকায়। কিছুটা সময় নিয়ে বলে,”আত্মবিশ্বাসী মেয়েদের পুরুষ অপছন্দ করে জানি। কারন শক্তি’শালী, আত্মবিশ্বাসী মেয়েদের পাশে তারা ই’ন’সি’কি’উ’র ফিল করে। এ দেশের পুরুষরা স্বভাব গত কারনে দুর্বল শ্রেনীর মেয়েদের পছন্দ করে এসেছে। কারন টা হলো নরম মাটিতে আ’চ’র কে’টে খুব আনন্দ পাওয়া যায়। পুরুষের পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে থাকে বোকা বোকা সুন্দরী মেয়ে, যে কথায় কথায় কুর্নিশ করবে। জেদ দেখাবে না।”

সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”খুব কথা জানো তুমি আলো। বয়সের তুলনায় বেশি ভারি ভারি কথা বলো। তা এতো আত্মবিশ্বাসী মেয়ে একটা সাপ দেখে কেনো ভ’য় পাবে? সাপটার দিকে তে’ড়ে যেতে। কারাতে করতে সাপটার সাথে!”
কথাটি বলেই সামিন উচ্চশব্দে হেসে ওঠে। আলো কপাল কুঁচকে রাখে। হাসি থামিয়ে সামিন বলে,” আমি ভাবতাম পৃথিবীতে তুমি আমাকে বেশী ঘৃণা করো‌‌। এখন দেখছি ঐ সাপটা বেশি দুর্ভাগা।”

আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,”সাপটাকে ভয় পাই আমি। আর আপনাকে ঘৃণা করি। দু’টো আলাদা ইয়াসার মির্জা।”

আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ডিভানের দিকে চলে যায় সামিন‌। কথাবার্তা যেদিক থেকেই শুরু হোক না কেন শেষ হয় সামিনের প্রতি আলোর ঘৃণার ঘোষণার মাধ্যমে। রোজ রোজ দর্শক বিহীন এই স্টেজে একই সংলাপ শুনতে শুনতে সামিনের কানে পোকা ধরে গেছে। শুধু একটাই কথা,”ঘৃণা করি ইয়াসার মির্জা! পি’শা’চ ইয়াসার মির্জা, ফে’রা’উ’ন ইয়াসার মির্জা।‌ বিরক্তিকর মেয়ে একটা।”
ডিভানে গা এলিয়ে দিতে দিতে সামিন নিজের চিন্তাভাবনা দেখে নিজে বেশ অবাক হয়। মনে মনে বলে ওঠে,”জোরপূর্বক বিয়ে করে তুমি কি আশা করো সামিন! তোমার বৌ তোমাকে মাথায় উঠিয়ে নাচবে? তোমার কাছে এসে বলবে “প্রাননাথ” ? ঘুমের মধ্যে ঐ মেয়েটা তোমাকে বালিশ চা’পা দিয়ে মে’রে ফেলেনা,সেটাই তোমার সৌভাগ্য ইয়াসার মির্জা!”

আলো দাঁড়িয়ে আছে। সামিন এসির পাওয়ার কমিয়ে দিয়ে নিজের গায়ে একটা চাদর টেনে নিয়ে ওদিক ফিরে শুয়ে বলে ওঠে,”ঘুমোও‌। ঐ বেচারা সাপটা তোমার কাছে ইহজনমে আর আসবে না। মারাত্মক ভয় পেয়েছে আজ সে।”

***
ইংরেজিতে স্পষ্ট করে এ্যালেক্স বলে ওঠে,”কেনো এমন করছো ইশমাম। তোমার ভাইকে বলো সত্যিটা!”

ইশমাম স্ক্রিনে এ্যালেক্সের দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বলে,”সম্ভব না এ্যালেক্স। একটা বিশ্রী ব্যাপার হয়ে যাবে।”

এ্যালেক্স ইশমামের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশমাম বলে ওঠে,”লাভ কি কিছু হবে এ্যালেক্স? সবটা কি আগের মতো হবে? মাঝখান থেকে আজীবনের জন্য ভাইয়া আর আমার মধ্যে অদৃশ্য একটা দেয়াল তৈরি হবে। এসব করে আমি কি অদ্রিতাকে ফিরে পাবো? এতকিছুর পরে অদ্রিতা মানবে আমাকে? আর ভাইয়া! আমি চাই না ঐ লোকটা সব জেনে আত্মগ্লানিতে ভুগুক। চাই না তার মনে ঝ’ড় তুলতে। ভাইয়ার সাথে আমার সম্পর্কটাকে অস্বাভাবিক করতে চাই না।”

_তোমার অনূভুতি ঠিক আগের মতোই আছে ইশমাম। আমার খুব দুঃখ হচ্ছে তোমার জন্য।
_এমন কথা বলো না এ্যালেক্স। সে এখন আমার ভাবী। কোনো অনূভুতি নেই আমার। এসব ভাবাও অন্যায়। কোনো অনূভুতি নেই।

এ্যালেক্স চুপ করে থাকে। ইশমাম প্রসঙ্গ পালটে বলে,”তোমার কথা বলো এ্যালেক্স। সোফি কি রাজি হয়েছে?”
_আর বলো না । রাজি ঠিকই। কিন্তু দেখাচ্ছে সে রাজি না। এই মেয়ে মানুষ এতো অদ্ভুত কেনো ইশমাম!

ইশমাম এ্যালেক্সের কথায় হেসে বলে,”তুমি ঠিকই বলেছ এ্যালেক্স। পৃথিবীতে সবথেকে অদ্ভুত এই মেয়ে মানুষ!”

***
আজ ইহানের ইচ্ছে হয়েছে বাগানে বসে পড়াশোনা করার। তার ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে বাগানে একটা টেবিল এবং দুটো চেয়ার পেতে দেওয়া হয়েছে। শান্ত খুবই মনযোগ সহকারে ইহানের হোমওয়ার্ক দেখছে। দোতলার বেলকোনি থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে ইশিতা। ইশিতার কাছে লোকটাকে বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ভদ্র মনে হয়। লোকটা নিজেকে যতটা সভ্য,স্পষ্টবাদী, শিক্ষিত জাহির করে আদৌ কি সে ততটা? কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ইশিতা নিচে রান্নাঘরে চলে যায়। একটা প্লেটে কিছু খাবার সাজিয়ে সোজা বাগানে যায়। শান্ত ইহানকে রংধনু সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে। পেছন থেকে নরম গলায় ইশিতা বলে ওঠে,”আসবো!”

শান্ত মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। সে কিছুটা অবাক হয় ইশিতাকে দেখে। ইশিতা বলে,”আপনার জন্য ভাবী পাঠিয়েছে। খেয়ে নিন।”

শান্ত ইশিতার হাতের প্লেটের দিকে একবার তাকিয়ে ইহানের হোমওয়ার্ক খাতা দেখতে দেখতে বলে,”আমি এতটাও গরীব নই। তিন বেলা ভাত খেতে পারছি। এভাবে এতকিছু দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ভাবীকে বলে দিবেন। এতে আমার অভ্যাস নষ্ট হবে।”

ইশিতা শান্তর দিকে একপলক তাকিয়ে প্লেট টা শান্তর সামনে রেখে বলে,”গিটার কার?”

শান্ত টেবিলের পাশে রাখা গিটারের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার কাছে যেহেতু। তার মানে আমার।”

_আপনি গান জানেন?

_মোটামুটি।

ইশিতা বেশ অবাক হয়। এই লোকটার সাদাসিধে ভাব দেখলে মনেই হয়না এ লেখাপড়া ছাড়া অন্য কিছু জানে। শান্ত ইহানকে লিখতে দিয়ে ইশিতার দিকে না তাকিয়ে বলে,”আপনি নাস্তা নিয়ে এলেন যে। এটা তো আপনার কাজ না।”

_দেখতে এসেছি। আপনি ইহানকে ঠিকঠাক মতো পড়াচ্ছেন কি না। মাস শেষে এতো গুলো টাকা মাইনে দেওয়া হয় আপনাকে। সেগুলো সব জলে যাচ্ছে কি না সেটাই দেখতে এসেছি।

***
ঘুরেফিরে আলো ইমতিয়াজ মির্জার সামনে পরে গেলো। একপলক তার দিকে তাকিয়ে আলো চোখ নামিয়ে নেয়। ইমতিয়াজ মির্জা ভ্রু কুঁচকে আলোকে কয়েক পলক দেখে সিঁড়ির দিকে যায়। হুবহু এই লোকটার চেহারা পেয়েছে এর তিন গুণধর ছেলে। সবগুলো একেবারে বাবার কপি। চারদিকে একই চেহারার কতগুলো পুরুষ মানুষ। যেদিকে তাকাও ইয়াসার মির্জা। রাবনের দশ মাথার মতো, কোনটা রেখে আলো কোনটা ব’ধ করবে ! আলোর জীবন টা দুর্বিষহ হয়ে উঠছে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এদের দেখতে দেখতে।

দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকে বারান্দার দিকে যায় আলো , ইয়াসার কিছু কাগজ উল্টে পাল্টে দেখছিলো। আলোকে দেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”মেঝে তো কোনো দোষ করে নি। শুধু শুধু ওকে কেনো শাস্তি দিচ্ছো। ধীরে হাটো।”

আলো দাঁড়িয়ে পরে,ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে বলে,”কেনো? মেয়ে বলে? মেয়ে বলে ধীরে হাঁটতে হবে?”

_হ্যা। ওটাই নারীর সৌন্দর্য।

_হাটবো না ধীরে। আমি এমন করেই হাটবো। লাফিয়ে লাফিয়ে। আর এতোই যখন নারীর সৌন্দর্য, নারীর সৌন্দর্য করেন,তাহলে ওরকম একটা দেখে বিয়ে করে নেন। আমাকে মুক্তি দিন‌। আমি তো যেচে আপনার ঘাড়ে উঠিনি। আমার কাছ থেকে নারীর সৌন্দর্য আশা করতে লজ্জা করে না? আমাকে মুক্তি দিয়ে আপনাদের বাড়ীর মেজো বৌ রিতুর মতো একটা নমুনা বিয়ে করে আনুন। যে আনন্দের সাথে আপনার পায়ের তলায় পি’ষ্ট হতে চাইবে।

সামিন উঠে দাঁড়ায়। আলোর চোখে চোখ রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”রিতু পায়ের তলায় পি’ষ্ট হচ্ছে?”

আলো তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। কন্ঠে বিদ্রুপ নিয়ে বলে,”না, আপনার চরিত্রহীন ভাই তাকে মাথায় তুলে রেখেছে। শুধুমাত্র সন্তান জন্ম দিয়েছে বলে দয়া করে থাকতে দিয়েছে এই বাড়িতে।”

সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো বলতে থাকে,” আপনি তো আপনি। এসব আপনার চোখে পরবে না। নিজেই যেখানে একটা আস্ত ক্রি’মি’না’ল।”

_বেশি বলে ফেলছো না আলো? কোনো প্রমাণ আছে এসবের? বলো!

_যার সাথে ঘটেছে তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। রিতুকে জিজ্ঞেস করুন।‌ তার স্বামীর পরকীয়ার সম্পর্ক আছে।

_আমি মানছি ইলহাম কিছু অন্যায় করেছিলো অতীতে। কিন্তু ওসব এখন অতীত। ও মন দিয়ে সংসার করছে।

_আপনাকে যারা ভোট দিয়েছে তাদের জন্য খুব আফসোস হচ্ছে আমার।

কথাটি বলে আলো চলে যেতে নিলে সামিন পথ আগলে দাড়ায়। আলো ধমকের সুরে বলে,”কী?”

_ইলহামের ব্যাপারে যেটা বললে এইমাত্র সেটা যদি মিথ্যা হয়?
_মিথ্যা কেনো হবে। আমি নিজের কানে স্পষ্ট শুনেছি।

_আচ্ছা। আমি রিতুকে জিজ্ঞেস করবো। যদি মিথ্যা হয় তাহলে কি করবে তুমি?
_তাহলে আর কি,শাস্তি তো আমি পাচ্ছিই নতুন করে আর কি দেবেন? আর যদি সত্যি হয় তাহলে আমি যা বলবো সেটা শুনবেন? বলুন!

সামিন কয়েক মুহূর্ত আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,”শুনবো।”

এমন সময় হঠাৎ সামিনের ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। ফোনটা হাতে নিয়ে কানে ধরে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর উত্তেজিত কন্ঠে বলে ওঠে,”আসছি আমি।”

***
“কোথায়। তোমার সেই শুভাকাঙ্ক্ষী সব কোথায়? কেউ জিজ্ঞেস করেছে তুমি কেমন আছো? সেদিনের পর থেকে খোজ নিতে এসেছে কেউ?”

আতাউর আলম বিছানায় শুয়ে শূন্যে দৃষ্টি রেখে আছে। রেহেনা চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলতে থাকে,”নির্বাচন করো, নির্বাচন করো বলে খুব উস্কেছিলো তখন। এখন কোথায় তারা?”

আতাউর আলম শোয়া থেকে উঠে বসে।

“তুমি একটা কা’পু’রু’ষ আতাউর আলম।”

স্ত্রীর এহেন কথায় আতাউর আলম আহত হয় কিন্তু প্রতিবাদে কোনো শব্দ বের হয় না তার ভেতর থেকে। ঠিকই তো। সে কা’পু’রু’ষ।

“এখন ? এখন তুই কি জবাব দিবি সামিন ইয়াসার? আমি জানতাম। জানতাম আমি এর মধ্যে একটা ঘা’প’লা অবশ্যই আছে। খালি চোখে যেটা মনে হয় সেটা সবসময় সত্যি নয় সামিন‌ । এখন তুই জবাব দে।”

সামিন ফুয়াদের কথার উত্তর না দিয়ে জামিলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে,
“তুই কিভাবে বলছিস ওরা আতাউর আলমের লোক নয়?”

_আমি ওদের চিনি ভাই। ওদের প্রত্যেকটাকে আমি চিনি। ওদের আমি আগেও দেখেছি। ওদের কন্ঠস্বর আমার খুব চেনা। ওদের মধ্যে একজনের হাতে অদ্ভুত দেখতে কিছু আংটি ছিলো। আপনার মনে আছে শিমুল তলার সমাবেশে ঝামেলার কথা? ওরা ছিলো সেখানে। ওরা আর যাই হোক আতাউরের লোক না ভাই। ওরা ভুঁইয়ার লোক‌।

_হেনা বলেছে আমাকে, ওরা নিজের মুখে বলেছে আতাউর আলমকে বিজয়ী দেখতে চায়……..

জামিল ক্ষীণ কন্ঠে বলে ওঠে,”আরে ধূর ভাই। আপনি আবার কবে থেকে মেয়ে মানুষের কথায় এতো গুরুত্ব দিতে শুরু করলেন। ও কিছু জানে নাকি আগাগোড়া? ওকে যেটা বলা হয়েছে বিশ্বাস করে নিয়েছে।”

রাহাত দাঁত খিচিয়ে জামিলের বেডের দিকে এগিয়ে যায়,”তুমি উঠলে কেন? যেভাবে পরেছিলে পরে থাকতে! কতবার ভাই বলেছিলো সাবধান হতে , সাবধান হওনি। আজ যদি না নিজে বিপদে পরতে। তাহলে ভাই এতো বড় একটা অঘটন ঘটাতো না।”

জামিল কিছু বুঝতে পারছে না রাহাতের কথা। ফুয়াদ রাহাতকে ধমক দিয়ে বলে,”কথায় কথায় ভাইয়ের কোল টেনে কথা বলা বন্ধ কর। পুরোটা তোর ভাইয়ের বোকামি সেটা বল। আমি বারবার বলেছি রাগের মাথায় কোনো অঘটন ঘটাস না। দেশে আইন আছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা।”

জামিল সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”কি হয়েছে? কেউ খুলে বলো। ভাই কি করেছে?”

_তোর ভাই, রাগের মাথায়, নির্বাচনে জেতার জন্য আতাউরের মেয়েকে তুলে এনে বিয়ে করেছে। আমিও ছিলাম সাথে। আমিও সাথ দিয়েছি।

হতভম্ব মুখটা নিয়ে জামিল সামিনের দিকে তাকায়। সামিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ফুয়াদ চেঁচিয়ে বলতে থাকে,”কেমন লাগছে সামিন ইয়াসার? একটা নিরপরাধ ব্যক্তিকে ভুগিয়েছিস তুই।”

ফুয়াদের দিকে সামিন এক পলক তাকিয়ে হনহন করে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। ফুয়াদ পিছু পিছু ছুটে যায়।

হসপিটালের গেইটের কাছে এসে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হাত মুঠি করে সজোরে একটা ঘুষি মেরে দেয় সামিন। ফুয়াদ এসে হাত ধরে ফেলে সামিনের। চেঁচিয়ে বলতে থাকে,”এখন এসব বন্ধ কর। যা হবার হয়ে গেছে। সামনে কি করবি সেটা ভাব। শাস্তি শাস্তি খেলা হয়ে গিয়েছে? শান্তি পেয়েছিস? এখন গিয়ে ক্ষমা চা ওদের কাছে। তালাক চাইলে তালাক দিয়ে দিবি। আমি তোকে চিনি সামিন। তুই স্বস্তি পাবি না! আত্মগ্লানিতে ধুকে ধুকে মরবি।”

সামিন ফুয়াদের দিকে তাকায়। ফুয়াদের বলা কথাটা তার কানে বাজছে,”তালাক দিয়ে দে।”

ফুয়াদ বলে,”এখন ভুঁইয়াদের কি করবি বল! সাগরের একটা বোন আছে,ওকে তুলে আনি? ওকে বিয়ে করবি?”
রাগ দেখিয়ে ফুয়াদ বলতে থাকে।

সামিন কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট করে। ফুয়াদ পাশের সিটে বসে সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বলে,”কথা বলছিস না কেন? জবাব দে!”

_তালাক দেবো না আমি। আর ভুঁইয়া দের উপযুক্ত শাস্তি ওরা পাবে।

সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে ঠান্ডা গলায় বলে সামিন। ফুয়াদ সামিনের দিকে তাকায়। সামিন বলতে থাকে,”বিয়ে করা বৌকে বিনা কারণে কেনো তালাক দেবো।”

_মানে? তুই ওর সাথে সংসার করবি?
_হু। সেজন্যই তো বিয়ে করেছি। বারবার একই কথা জিজ্ঞেস করিস কেন তোরা?

কিছুক্ষণ চুপ থাকে সামিন। তারপর হুট করে বলে ওঠে,”একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছি রে ফুয়াদ।”

_আবার কি?
চেঁচিয়ে ওঠে ফুয়াদ।
_আমি সম্ভবত আমার বৌয়ের প্রেমে পরে গিয়েছি।

ফুয়াদ সামিনের দিকে তাকায়। সামিনের মুখ হাসি হাসি। সে বলতে থাকে,”কাল রাতে টের পেয়েছি। এখন আর তালাক দেওয়া সম্ভব না।”

_তাহলে মাফ চা ওর কাছে,ওর পরিবারের কাছে। ভুলটা স্বীকার করে নে নিজের।

সামিন সে কথার উত্তর না দিয়ে বলে,”খুবই আলাদা ও। কি অদ্ভুত দেখ, সামিন যে ধরনের মেয়েদের পছন্দ করতো না ও সে ধরনের মেয়ে। তবুও কি থেকে কি হয়ে গেলো!”

_শরীরের ওপর জোর চলে সামিন, মনের ওপর চলে না। ভুলে যাস না।
_আমি তো জোর করে বিয়েটাই করেছি শুধু, অন্য কোনো জোর তো দেখাইনি।

_উফফ। তুই আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বি সামিন‌।

সামিন বাঁকা হাসি হাসে। ফুয়াদ বলে,”ও আলো সামিন। এ জন্মে ও তোর নিয়ন্ত্রণে আসবে না। রমনীর মন, সহস্র বছর সাধনা করতে হয় পেতে হলে। আর তোর ধৈর্য নেই। তুই সামিন ইয়াসার মির্জা।”

_দেখা যাক…..
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় ইয়াসার।

***
ইশমামকে দেখে আলো কপাল কুঁচকে ফেলে। ইশমাম নিচু স্বরে বলে,”সরি। আমি ভাইয়ার কাছে এসেছিলাম। জানতাম না ভাইয়া ঘরে নেই।”
_তোমার ভাইয়ের ঘরে তোমার ভাইয়ের স্ত্রী থাকে ইশমাম। এভাবে আর কখনো নক না করে ঢুকবে না।

ইশমাম কয়েক পলক আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,”আচ্ছা।”

আলো মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ইশমাম চলে যেতে নিলে আলো হঠাৎ বলে ওঠে,”একটা মানুষকে তুমি ভালোবাসতে, তার প্রতি প্রচন্ড রকমের অনূভুতি জন্মানোর পরে হঠাৎ দেখলে পৃথিবীতে সেই মানুষটার কোনো অস্তিত্বই নেই। একজন ভান ধরে থাকা ছদ্মবেশীর সাথে তোমার পরিচয় হয়েছিলো। তখন এর চেয়ে বেশি ঘৃণা করতে তুমি তাকে,যতটা আমি তোমাকে করি।”

মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইশমাম। আলো বলতে থাকে,” নিজের জীবন টা গুছিয়ে নাও তুমি। এক সময়ের অধিকার বোধ থেকে বলছি, তোমার পরিবারের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ো না। দয়া করে হয়ো না।”

আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে ইশমাম বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। আলো দরজার দিকে দৃষ্টি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

***
আজান কয়েক মুহূর্ত সামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রচন্ড জোরে তার বাবাকে ডাকতে থাকে। আতাউর আলমের শরীরটা ভালো নেই। রেহেনা এসে দরজার কাছে দাড়ায়। সামিন আজানের দিকে তাকিয়ে বলে,”দুলাভাইকে ভেতরে আসতে দেবে না শা’লা?”

আজান দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। সামিন ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,”তুমি কোনটা? আজান না আয়াত”
_আজান।
_আয়াত কোথায়?
_ফার্মেসীতে গিয়েছে।

সামিন সোফায় বসে পরে। ভেতরের ঘর থেকে আতাউর আলম বলে ওঠে,”কে এসেছে রেহেনা? কে?”

_আপনার জামাই। ইয়াসার মির্জা।

আতাউর আলম সামিনের কন্ঠ পেয়ে তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামে। অসুস্থ শরীর নিয়ে বসার ঘরে এসে সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। আতাউর আলম সামিনের এমন অদ্ভুত আচরণে বেশ অবাক হয়। তার দিকে তাকিয়ে জানতে চায়,”তুমি কেনো এসেছো!”

সামিন মৃদু হাসে। তারপর জবাব দেয়,”আপনাদের দাওয়াত জানাতে। আমার বাবা ইন্ডিয়া থেকে ফিরেছে। আমার আর আপনার মেয়ের বিয়ের রিসিপশনের আয়োজন করেছি, আগামী পরশু। কার্ড ছাপানো হচ্ছে। সময় মতো পৌঁছে যাবেন। পুরো শহরের সাথে আমার শশুর শাশুড়ির পরিচয় করিয়ে দেবো আমি।”

***
সিতারা দরজা খুলে দিতেই অলস ভঙ্গিতে সামিন ঘরের ভেতরে ঢোকে। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত বারোটা প্রায়। সিতারা নিচু স্বরে বলে,”টেবিলে খাবার দেবো ভাইজান?”
_না।
একশব্দে বলে সিঁড়ির কাছে গিয়ে ফিরে সিতারার দিকে তাকায় সামিন,”তোর বড় ভাবী খেয়েছে?”

সিতারা মাথা নাড়িয়ে বলে,”জ্বি।”
সামিন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। খুবই সন্তর্পনে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে বিছানার দিকে তাকায় সে। আলো ঘুমিয়ে আছে। দরজা বন্ধ করে বিছানার কাছটাতে এসে বসে পরে। কিছুক্ষণ আলোর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলোকে দেখে এখন ঠিক একটা গোলাপের মতো লাগছে। যে গোলাপে কাঁ’টা আছে। ছুঁয়ে দিলেই হাতে ফুটে যাবে যার কাঁ’টা।

দীর্ঘসময় পরে মনে মনে বলতে থাকে,”তুমি ঠিক বলেছিলে আলো। আমি কা’পু’রু’ষ। ভুল স্বীকার করার সাহস নেই আমার।”

বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়। একটা মশা এসে বসে আলোর গালে। কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে সামিন একটা আঙ্গুল ছুঁইয়ে দেয় আলোর গালে। হুট করে ঘুম ভেঙে যেতেই আলো লাফিয়ে উঠে বসে। সামিন কিছুটা চ’ম’কা’য়। আলো হতভম্ব ভাব কাটিয়ে তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,”আপনি আমার গালে হাত দিচ্ছিলেন কেনো?”

সামিন থতমত খেয়ে বলে,”মশা পরেছিল।”

_হাতি পরে থাকুক। আপনার কি?
চেঁচিয়ে ওঠে আলো। সামিন উঠে দাঁড়ায়। আলো বলতে থাকে,”দেখছেন ঘুমিয়ে আছি আর অমনি সুযোগ নিতে চলে এসেছেন তাই না?”

সামিন কিছু বলে না। সে জানে, রোজকার তর্কাতর্কি শুরু হতে যাচ্ছে,যার শেষ হবে “আমি আপনাকে ঘৃণা করি ইয়াসার মির্জা” কথাটির মাধ্যমে। তাই কথা না বাড়ানোই ভালো।

আলো বিছানা থেকে নামে। সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”জামিল কথা বলেছে? কি বলেছে সে?”

_ওর সাথে আমার কথা হয়নি।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় সামিন‌। আলো বলে ওঠে,”কেনো কথা হয়নি? কেনো কথা বলছেন না? সত্যিটা জানলে মুখে চুন’কালি মাখা হয়ে যাবে সেই ভয়ে?

সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”ঘুমাও আলো।”

_কেন? আমাকে ঘুম পাড়ানোর এতো তাড়া কিসের? আমি ঘুমিয়ে গেলে সুযোগ নিতে আসবেন সেজন্য?

সামিন প্রচন্ড বিরক্ত হয় আলোর এমন আচরণে। সে তার বিরক্তি প্রকাশ না করে ঠাট্টার ছলে বলে,”নিজেকে কি ভাবো তুমি? অনেক সুন্দরী? নিজের গায়ের রং দেখেছো? ঐ সামান্য উজ্জ্বলতা টুকু সৃষ্টি কর্তা তোমায় দয়া করে দিয়েছে। ভেবো না আমি সুযোগ নেওয়ার জন্য বসে আছি।”

আলো হা হয়ে তাকিয়ে আছে। কথাটি বলে সামিন মুখ টিপে হাসে।

আলো সামিনকে অবাক করে দিয়ে বলে ওঠে,”নিজে একটু ফরসা বলে নিজেকে কি ভাবেন আপনি? অন্যের গাঁয়ের রং নিয়ে কথা শোনাচ্ছেন। আর আপনি অনেক সুন্দর? নিজের চেহারা কখনো আয়নায় দেখেছেন ? একটা সাদা মুলার মতো লাগে আপনাকে!”

চলমান…….

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_২০
#Esrat_Ety

“ওরা নারী জাত, পুরুষকে ঘা’য়ে’ল করতে কারাতে, মা’র’পি’ট জানতে হয় না, মুখটা একটু “মাসুম মাসুম” করে রাখলেই পুরুষ ঘা’য়ে’ল হয়ে যায়। ভাইয়ের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে।”

রনির এমন কথায় সবাই তার দিকে তাকায়। সামিন ইয়াসারের পার্টি অফিসে আজ সবাই জমায়েত হয়েছে। মাস শেষে একটা দিন তারা দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ করে। আজ সেই দিন। সামিন রাহাতের সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছে। এ পাশে বসে বাকিরা সবাই সামিনের সমাচার পাঠ করছে ।

আরাফ কপাল কুঁচকে বলে,”ভাই ঐ মেয়েটার মুখের ভাষা এতো জ’ঘ’ন্য। গালাগাল ছাড়া কথাই বলতে পারে না। ইয়াসার ভাই কিভাবে ওর প্রেমে পরলো বলতো!”

রনি আরাফকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”ঐ মেয়েটা না। ভাবী বল। ভাই শুনলে কাঁচা খে/য়ে ফেলবে।”

সবুজ বলে ওঠে,”যাই বল। ভাই যে আলো ভাবীর প্রেমে পরবে তা জানতাম কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি ঐ সিংহ একটা মেয়ের কাছে কাবু হয়ে গিয়েছে এটা মানতে পারছি না।”

_তোর চোখের সামনে সারাদিন চুড়ি পরে, লাল শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে একটা মেয়ে ঘুরঘুর করবে। তোর পুরুষ মনে সু’ড়’সু’ড়ি লাগবে না? তোর প্রেম প্রেম পাবে না?

রনির এই কথাটায় আরাফ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বলে,”হু। তাও ঠিক। ওরা নারী। ওরা সব পারে। কিছু না করেও। ওই যে নারী দিবসের একটা স্লোগান আছে না? আমরা নারী। আমরা সব পারি। কথাটা এজন্যই বলেছে।

তৌফ হাসতে হাসতে বলে ওঠে,”হু ভাই। আমরা নারী। আমরা পাথরেরও মন গলাতে পারি।”

“তোরা আমার কথা না শুনে নিজেরা কি আলোচনা করছিস?”
সবাই সামিনের দিকে তাকায়। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলতে থাকে,”দলের কাজে মন না বসলে বলবি। একেবারে বের করে দেবো ঘা’ড় ধরে।”
_তেমন কিছু না ভাই।

_সব বুঝিয়ে দিয়েছি। আমার এখন উঠতে হবে। আজ কয়েক যায়গায় বৃক্ষ রোপন কর্মসূচি আছে‌। সেখানে যেতে হবে। কাল সবাই আসবি পরিবার নিয়ে। মনে থাকে যেন।

দলের সবাই মাথা নাড়ায়। সামিন উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বসে পরে। তার দৃষ্টি টেবিলের উপর রাখা একটি ছোটো আয়নার ভিতরে তার নিজের প্রতিবিম্বে নিবদ্ধ। কয়েক পলক সেদিকে তাকিয়ে থেকে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলে,”আচ্ছা বলতো।‌ আমি দেখতে কেমন!”

সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে সামিনের কথায়। রাহাত বলে,”সুন্দর। আপনি অনেক সুন্দর। কেনো ভাই?”

সামিন বলতে থাকে,”আমি ফর্সা। সেজন্য কি আমাকে সাদা মুলার মতো লাগে?”

তৌফ দাঁত বের করে বলে,”কি যে কন ভাই। আপনি কত সুন্দর। আপনি পুরো ঋত্মিক রওশানের মতো দেখতে। শুধু আপনার চোখের মনি ঘন কালো আর ঋত্মিকের চোখ বিলাইয়ের মতো। আপনিই বেশি সুন্দর ভাই।”

সামিনের কাছে তৌফের কথাটা মন মতো হয় না। এরা তার ছেলে,এরা তো তার প্রশংসা করবেই। একটা মেয়ে বোঝে কোন পুরুষ সুন্দর। আলো একটা মেয়ে। সে যখন বলেছে তাহলে হয়তবা সত্যিই সামিন কে সাদা মুলার মতোই লাগে।

***
বাড়িতে কেটারিং-এর লোকজন এসেছে। সাজাচ্ছে বাড়িটাকে। আলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে সব। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তার ঘরে বিছানার উপরে কিছু শাড়ি রেখে গিয়েছে কেউ। শাড়ি গুলো অনেক দামী,দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এসব কি হচ্ছে আসলে, আবার কি নতুন তামাশা করতে চাচ্ছে ইয়াসার মির্জা!

“ভাইয়া তুমি জামিলকে কেনো এপয়েন করেছো সিমেন্টের বিজনেসে? ও এসবের কি বোঝে? ও তো তোমার দলের।”

ইলহাম সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন কেটারিং-এর এক লোকের সাথে কথা বলছিলো। ইলহামের প্রশ্নে ঘুরে তাকায়। তারপর বলে,”ওকে দলে রাখছি না। ওকে ব্যাবসায় ঢুকিয়ে দেবো আমাদের।”

_ভাইয়া তুমি জামিলের জন্য একটু বেশি বেশি করছো না? ওকে কেনো পারিবারিক ব্যাবসা ধরিয়ে দেবে!

_ওকে কাজ দিচ্ছি শুধু ইলহাম। তোর ভাগের সম্পত্তি দিয়ে দিচ্ছি না। আর হ্যা,ওর জন্য আমার আলাদা দুর্বলতা আছে। বাপ মা ম’রা এতিম ছেলেটা অন্যের লাত্থি উষ্ঠা খেয়ে আমার কাছে,এই পরিবারের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলো। বরাবর বিশ্বস্ততা দেখিয়েছে। আমি ওকে স্নেহ করি। তোদের যেমন করি।

ইলহামের কাছে সামিনের কথাটা পছন্দ হয় না। একটা বাইরের ছেলেকে তাদের মতো স্নেহ করবে,এটা ইলহাম মানতে পারবে না।

রিতু কফির মগ এনে সামিনের হাতে দেয়। সামিন ইলহামের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”আজকাল তুই কোথায় কোথায় যাচ্ছিস আমাকে ইনফর্ম করছিস না। কিছু উড়ো খবর আসছে আমার কাছে। ব্যাপার কি!”

ইলহাম কপাল কুঁচকে রিতুর দিকে তাকিয়ে সামিনকে বলে,”কে দিচ্ছে এসব খবর তোমাকে?”

_কেউ না। যা করবি একটু বুঝে শুনে করবি ইলহাম। ইহানের ফিউচারে প্রভাব ফেলে এমন কিছু আমি বরদাস্ত করবো না।

_ভাইয়া তুমি আমাকে সন্দেহ করছো?
_না,তোকে বোঝাচ্ছি। তোর বড় ভাই আমি। বোঝাতে পারিনা?

কথাটা বলে সামিন কফির মগে চুমুক দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। ইলহাম রিতুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে যায় সেখান থেকে।

“ওগুলো তোমার। দেখো কোনটা পছন্দ হয়।”

আলোকে বিছানায় রাখা শাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে পেছন থেকে সামিন বলে ওঠে। আলো ঘুরে দাঁড়ায়। সামিন বলতে থাকে,”কাল আমাদের রিসিপশন। তোমার বাবা মা আসবে।”

আলো তর্জনী আঙ্গুল তুলে শাড়ি গুলোর দিকে তাক করে বলে,”এসব পরে সং সাজতে হবে কেন আমাকে? চাচ্ছেন কি আপনি?”

সামিন মনে মনে বলে,”চাচ্ছি তোমাকেই।”
কিন্তু মুখে বলে,” আপাতত চাচ্ছি এসব পরে লক্ষী বৌয়ের মতো বসে থাকবে চুপচাপ। সবাই এসে সামিনের বৌকে দেখে যাবে।”

_আপনার ভয় নেই? কাল যদি সবাইকে আমি সত্যিটা বলে দেই?

সামিন কফির মগে এক চুমুক দিয়ে বলে,”বলবে না। তুমি উন্মাদ আমি জানি। তবে এতটাও উন্মাদ নও যে নিজের ভালো বুঝবে না।”

***
হাতের কাগজটা ছিঁড়ে সাগর টুকরো টুকরো করে ছুঁড়ে মারে।

শমশের ভুঁইয়া আহাজারি করে বলে,”মোক্ষম চাল টা চেলেছে ইয়াসার। কোর্ট অর্ডার এসে গিয়েছে। তিন দিনের মধ্যে ঘাটের দখল ছেড়ে দিতে হবে। কতগুলো টাকা লস হয়ে গেলো সাগর।”

_মেয়রের ক্ষমতা দেখিয়েছে ও। ওকে আমিও আমার ক্ষমতা দেখাবো। ও আতাউরের মেয়েকে বিয়ে করেছে কেনো কিছু জানতে পারলেন? এটা কোনো স্বাভাবিক বিয়ে না জানি। আতাউর আলম কখনো ওর সাথে মেয়ের বিয়ে দেবে না, না ঐ মেয়ের সাথে ইয়াসারের প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। তাহলে বিয়েটা কিভাবে হলো! এর মাঝে কিন্তু আছে। কারনটা খুজে বের করেন।

ইয়াসার মির্জার সাথে আতাউর আলমের মেয়ে অদ্রিতা আলোর বিয়ে হয়েছে। খবরটা বাতাসের গতিতে ছড়িয়ে গেলো সর্বত্র। আগামীকাল তাদের রিসিপশন। সবাই দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর চেষ্টা করছে।
পাড়া প্রতিবেশীরা বিভিন্ন বাহানায় বাড়িতে এসে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খবর বের করার চেষ্টা করছে।

সকাল থেকেই আতাউর আলমের শরীরটা বেশ খারাপ। এমনিতেই মানসিক এবং শারীরিক ভাবে সে দিনকে দিন বেশ ভেঙে পরছে। তার উপর সকাল থেকে পাড়া প্রতিবেশীর উটকো ঝামেলা আর নেওয়া যাচ্ছে না। সবাইকে সত্যিটা সে বলে দিতেই পারে। কিন্তু মেয়েটা যে এখনো ইয়াসারের কাছে!
আরাম কেদারায় হাত পা এলিয়ে শুয়ে শুয়ে ছটফট করছে সে। বুকের ব্যাথাটা বারছে। তার সাথে হুট করে মাথা ব্যথা হচ্ছে খুব। ঘামছে সে। একটা অনিশ্চিত জীবন আদরের মেয়েটার সামনে। অথচ সে বাবা হয়ে কিছু করতে পারছে না। এক সময় নিজের জীবনের পরোয়া না করা আতাউর আলম এখন একটা দুদিনের ছেলের ইশারায় নাচছে। এর থেকে লাঞ্ছনার আর কি হতে পারে!

সন্ধ্যার দিকে শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখে একটু হাঁটাহাঁটি করতে নেমেছিলো আতাউর আলম। পাড়ার বড় দোকানটার সামনে কিছু প্রতিবেশী আলো আর ইয়াসারের আলোচনায় মেতে আছে। আতাউর দূর থেকে কথাবার্তা শুনে এড়িয়ে যেতে চাইলো। সে ঘুরে দাড়াতেই পেছন থেকে কেউ তাকে ডাকে।

_আরে আলম ভাই। এদিকে আসুন। যাচ্ছেন কোথায়?

আতাউর আলম তাদের দিকে তাকায়। ব্যারিস্টার ফখরুল তাকে ডাকছে। ধীরপায়ে সে এগিয়ে যায় তাদের কাছে। সবাই তার দিকে খুবই উৎসুক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। ফখরুল খুবই আন্তরিকতার সাথে আতাউর আলমকে বসিয়ে শুরুতেই যে প্রশ্নটি করে সেটি হলো,”প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো নাকি আলম ভাই? সেজন্যই কি আপনি নির্বাচন বর্জন করেছিলেন?”

আতাউর আলম সবার মুখের দিকে তাকায়। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। পাশ থেকে একজন বলে ওঠে,”শুরুতেই সন্দেহ হয়েছিলো। আপনার ভাবী তো বলাবলি করছিলো, এতদিন হয়ে গেলো মেয়েটার খোজ নেই। আচ্ছা আতাউর ভাই, আলো কি নির্বাচনের আগের দিন রাতে পালিয়েছিলো?”

***
“এই ছেলে। কি চাও তুমি।”
কড়া গলায় আলো ইহানকে বলে কথাটি । ইহান ভয় না পেয়ে উল্টো কপাল কুঁচকে বলে,”এটা আমার বড় বাবার ঘর। আমি বড় বাবার কাছে এসেছি।”

আলো মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। ইহান বলে,”তুমি খুব পঁচা।”

_হ্যা হ্যা,আমিই খারাপ। আর তোমার বাবা চাচারা এবং তুমি খুউউব ভালো।

ইহান ভেংচি কেটে বলে,”ইইইইইইই।”

আলোও হুট করে ইহানকে নকল করে বলে,”ইইইইইইই।”

সামিন ঘরে ঢুকে আলোর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,”তুমি একটা বাচ্চার সাথে তর্ক করছো। এভাবে ভেংচি কাটছো! তুমি তো ভারি অদ্ভুত মেয়ে।”

আলো কপাল কুঁচকে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন ইহানকে কোলে তুলে নিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে,”তুমি না গুড বয়? বড়দের ভেংচি কাটতে নেই তোমাকে শেখাইনি?”

ইহান মাথা নাড়ায়। সামিন বলে,”কেনো এসেছিলে?”
_খেলতে। টিচার চলে গিয়েছে।
_কিন্তু এখন তো খেলতে পারবো না। সকালে খেলি? তুমি এখন যাও বাবা। মাম্মা তোমাকে ডাকছে।

ইহান তার বড় বাবার কোল থেকে নেমে চলে যায়। সামিন আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে বিছানার উপরে রাখা শাড়িগুলো হাতে তুলে নেয়‌। সেগুলো আলমারিতে তুলে রেখে বলে,”একটা বাচ্চা তোমার কোনো ক্ষতি করেনি। তার সাথেও তুমি সমানে সমান তর্ক চালিয়ে যাচ্ছো। নির্ঘাত একটা পাগল মেয়ে তুমি অথবা বিয়ের পরদিন থেকে পাগল হয়ে গিয়েছো।”
কথাটি বলে কিছুক্ষণ ঠোঁট টিপে হেসে নেয় সামিন।

তারপর আলমারির দরজা চাপিয়ে ঠাট্টার ছলে বলে,”সারাদিন তো কোনো কাজই করো না। বিছানায় অলস বিড়াল ছানার মতো গুটিসুটি মেরে বসে থাকো। স্বামীর সেবা নাই বা করলে, নিজের জিনিসপত্র তো গুছিয়ে রাখতে পারো। এই শাড়ি গুলো তো তোমার।”

আলো সামিনের দিকে তে’ড়ে আসে,”এসব নাটক বন্ধ করুন ইয়াসার মির্জা। স্বামী স্বামী নাটক আমার সাথে দেখাবেন না।”

_দেখাবো। এখন থেকে তো আরো বেশি দেখাবো।

_বলে তো দিয়েছি। আপনার যা করার আপনি করে নিন। আমি আপনাকে মানবো না।

সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,”জামিল মুখ খুলেছে।”

আলো উত্তেজিত হয়ে পরে। বলে,”কি বলেছে? আমার বাবা কিছু করেনি। এটাই তো তাই না? বলুন!”

_হু। সেটাই। তোমার বাবা কিছু করেনি।

আলোর মুখে হাসি ফুটে ওঠে, চেঁচিয়ে বলতে থাকে,”দেখেছেন? দেখেছেন তো? এখন কি বলবেন। বলুন ইয়াসার মির্জা ‌। বলুন। যেখানে আমার বাবা কিছু করেই নি সেখানে কিসের শাস্তি পাচ্ছি আমরা। এখন ছেড়ে দিন‌। দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন। তালাক দিয়ে দিন আমায়।”

সামিন ম্লান হাসে। অস্ফুট স্বরে বলে,”বিয়ে করা বৌকে বিনা কারণে কেনো তালাক দেবো!”

আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন ঠান্ডা গলায়,”এজন্মে তা হবে না আলো।”

_কেনো! এখনো কেনো! সবটা তো জানলেন। তবুও কেন!

_আমি তোমাকে ভালবাসি আলো।
স্পষ্ট এবং দৃঢ় ভাবে শব্দ গুলো উচ্চারণ করে সামিন। সে আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত যেতেই স্ব-শব্দে সামিনের গালে আলো এক চ’ড় বসিয়ে দেয়। সামিন মাথা ঘুরিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।

আলো দাঁতে দাঁত চেপে,সামিনের কলার ধরে চেঁচিয়ে বলতে থাকে,”এই! এই ইয়াসার মির্জা! আবার কোন নাটক শুরু করেছেন আপনি? উদ্দেশ্য কি আপনার?”

নিজের কলার থেকে আলোর হাত দুটো ছাড়িয়ে দিতে দিতে নরম গলায় বলে,”উদ্দেশ্য তোমার সাথে সংসার করার।”

আলো চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। সামিন বলতে থাকে,”আমি স্পষ্ট কথা বলি। তাই স্পষ্ট ভাবে বলে দিলাম। তোমাকে আমার ভালো লেগেছে, তোমার প্রতি আমার অনূভুতি জন্মেছে। যেটা দমিয়ে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব না। বিয়েটা যেভাবেই করি না কেন, একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়তে চাই তোমার সাথে আমি। আর হ্যা, ভুল করেছি আমি। সামিন ইয়াসার ভুল করেছে। তার ভুল সে স্বীকার করে নিলো। তোমার বাবা মায়ের কাছে ক্ষমা চাইবো, তোমার ভাইদের কাছে ক্ষমা চাইবো। যা করতে বলবে করবো। কিন্তু তোমাকে তালাক দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।”

_জোর করেই পারবেন সব। কখনো আমি আপনাকে মানবো না। কখনো না।

নিস্তেজ কন্ঠে বলে ওঠে আলো। সামিন কিছুক্ষণ আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,”আমাকে মা’রো, ঘৃ’ণা করো, জেদ দেখাও যা খুশি করো। সবকিছু আমার সীমানার মধ্যে থেকে করবে। আমার থেকে দূরে যাওয়ার কথা ভুলেও ভাববে না।”

ধপ করে বিছানার উপর বসে পরে আলো। কিছুক্ষণ পর ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বলে,”এর থেকে আপনি আমাকে মে’রে ফেলছেন না কেনো? আমাকে ছেড়ে দিলে আমি আপনার নামে মামলা করবো বলে ভয় পাচ্ছেন? তবে আমাকে মে’রে দিন। সবকিছু ধামাচাপা পরে যাবে। তবু এই জ’ঘ’ন্য খেলাটা বন্ধ করুন!”

কাঁদতে থাকে আলো। সামিন কয়েক মুহূর্ত আলোকে দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

অসময়ে সামিনের নাম্বার দেখে ফুয়াদ মুখে চ কারন্ত শব্দ করে, ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”তুই, তোর বৌ, তোর রাজনীতি, তোর প্রতিশোধ ছাড়াও আমার আরেকটা জীবন আছে সামিন। বাড়িতে এসেও একটু শান্তিতে থাকতে পারবো না আমি?”

_মানুষ নিজের পায়ে নিজে কু’ড়া’ল মা’রে। আমি ব্যতিক্রম তাই বিয়ে করেছি।
ঠান্ডা গলায় বলে সামিন। ফুয়াদ বলে,”কি হয়েছে ঝেড়ে কাশ!”

_আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কি করবো এখন? ভালোবাসার কথা বললাম, কত নরম গলায় বললাম। চ’ড় মেরেছে, এখন কাঁদতে বসে গিয়েছে।

ফুয়াদ সামিনকে বিদ্রুপ করে বলে,
_তো? তুই আমাকে ফোন দিচ্ছিস কেনো? তুই তো ইয়াসার মির্জা। যার কাছে স্ত্রী কেবল বিছানার সৌন্দর্য। সে কেনো স্ত্রীর চ’ড় হজম করে নেবে। ওকেও চ’ড় মার। জোর জবরদস্তি কর। কত বড় সাহস ওর,তোকে ভালোবাসবে না! ইয়াসার মির্জাকে ভালোবাসবে না! ওর হাত পা বেঁধে মা’র। চ’ড় মেরে ওর মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটা বের কর।

ফুয়াদ রাগে কাঁপতে থাকে কথাটি বলে। সামিন নিস্তেজ কন্ঠে বলে,”বাজে না বকে কিছু একটা সাজেশন দে ভাই। আমি পুরো এলোমেলো হয়ে আছি।”

_তুই ম’র।
ফুয়াদ ফোন কেটে দেয়। সামিন চুপচাপ নিচতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু সময় যেতেই তার কাছে রনির ফোন‌ আসে । সামিন ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে।

ঘরের বাইরে থেকে ইশিতা উঁকি দেয়। আলো হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদছে। ইশিতা কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে ঘরের ভেতরে ঢোকে। আলোর পাশে বসে আলোর মাথায় হাত রাখে। কান্না থামিয়ে আলো তাকায়। ইশিতা কোনো কথা বলে না। আলো চোখের পানি মোছে। তারপর ধরা গলায় বলে,”আপনার ভাইকে বলুন আমায় মে’রে ফেলতে। দোহাই আপনার।”

ইশিতা কিছু বলতে যাবে তখনি সামিন হন্তদন্ত হয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে। আলোর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলে,”তুমি আমার সাথে চলো আলো। তোমার বাবা একটু অসুস্থ!”

***
ড্রাইভ করতে করতে সামিন আড়চোখে আলোকে দেখে। শাড়ির আঁচল মুখে চেপে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদছে আলো। বেশ মায়া হচ্ছে আলোর প্রতি সামিনের,সেই সাথে বুকে সুক্ষ্ম যন্ত্রনা হচ্ছে তার। আলোর এই কান্না তো তার কারনেই। কিছুক্ষণ আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে গাড়িটা হঠাৎ থামিয়ে দেয় সে। আলো কেঁদেই যাচ্ছে। সামিন একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে আলোর সিটবেল্ট বেঁধে দেয়। আলোর গায়ে সামিনের হাত লাগতেই এক ঝটকায় সেই হাত সরিয়ে দেয় আলো। সামিন নিচুস্বরে বলে,”সিটবেল্ট না বাঁধলে সমস্যা হতে পারে।”
আবারও গাড়ি চলতে শুরু করে এবং সোজা হসপিটালের সামনে এসে থামে। গাড়ি থেকে নেমে এসে দরজা খুলে আলোর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। আলো তাকে উপেক্ষা করে নেমে দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। সামিন ধীরপায়ে তার পিছু পিছু যায়।

করিডোরে মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মায়ের গায়ে হুমরি খেয়ে পরে আলো। আজান আয়াত এসে আলোকে ধরে। রেহেনা দীর্ঘদিন পরে মেয়েকে দেখেও তাকে বুকে টেনে নেয়না। মেয়ের মুখের দিকে থাকে শুধু। আলো কান্নাটাকে নিয়ন্ত্রণ করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”কিভাবে হলো আম্মু এসব!”

_কারন উপর ওয়ালার ইচ্ছা।
ধরা গলায় জবাব দেয় রেহেনা। খুবই ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত লাগছে তাকে। সামিন ধীরপায়ে হেটে করিডোরে এসে দাঁড়ায়,তার মুখটা খুবই শুকনো দেখাচ্ছে। রেহেনা সামিনের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে তার দিকে এগিয়ে যায়। কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”এসেছো তুমি। এখানে দাঁড়িয়ে কেনো? লোকটাকে দেখবে না? এসো আমার সাথে। এসো।”
সামিনের হাত ধরে রেহেনা টানতে টানতে আইসিইউর সামনে নিয়ে গিয়ে দাড় করায়। বলে,”দেখো। মন ভরে দেখো তুমি! শান্তি পাচ্ছো না? বলো বাবা!”

সামিন অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”আন্টি…..”
সামিনকে কিছু বলতে না দিয়ে একটা চ’ড় মারে রেহেনা তাকে। গালে হাত দিয়ে মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে সামিন। রেহেনা বলে ওঠে,”আর কিসে শান্তি হবে তোমার?”

ছুটে গিয়ে আজান আয়াতকে টেনে এনে সামিনের সামনে দাঁড় করায়, তারপর চেঁচিয়ে বলতে থাকে,”ওদের মে’রে ফেললে হবে? নিয়ে যাও। পু’তে ফেলো ওদের।”

তারপর গিয়ে আলোকে টেনে এনে সামিনের দিকে ধাক্কা দিয়ে বলে,”ওকেও মে’রে দাও। তাহলে তো শান্তি অবশ্যই হবে।”

সামিন চোখ তুলে তাকায় না রেহেনার দিকে। রেহেনা চেঁচিয়ে বলতে থাকে,”আমাকে মারো বাবা। অবশ্যই শান্তি পাবে তুমি।”

কথাটি বলে কান্নায় ভেঙে পরে রেহেনা। কিছুক্ষণ পরে মাথা ঘুরে পরে যেতে নিলে ইয়াসার এসে ধরে ফেলে। আজান আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে,”ওনাকে বসিয়ে দাও।”

আজান আয়াত তাদের মাকে ধরে একটা বেঞ্চিতে বসিয়ে দেয়। সামিন ঘুরে আলোর দিকে তাকায়। কান্না থামিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন তার দিকে এগিয়ে যায়। পাশে বসে আলোর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,”আলো….”

_আজ যদি আমার বাবার কিছু হয়, তাহলে জেনে রাখুন ইয়াসার মির্জা। আমার বাবার খুনী হিসেবে আমি আপনাকেই জানবো, আজীবন!”

ঘৃণা মিশ্রিত কন্ঠে কথাটি বলে ওঠে আলো।

চলমান……