বন্য প্রণয় পর্ব-০৬

0
261

#বন্য_প্রণয়
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৬

(প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)

তাহমি বিছানা থেকে নেমে একপা একপা করে সহনের দিকে এগোতে লাগলো। সহন ততক্ষণ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। সমস্ত বিস্ময় এখন বিরক্তিতে পরিণত হয়েছে। এটা কে রে ভাই? কোথা থেকে জুটেছে! পারলে মনে হয় ধর্ষ*ণ করে ছেড়ে দিতো। সহনের চিন্তাভাবনার মধ্যেই তাহমি এসে চুল ধরে টান দিলো। নড়েচড়ে উঠলো সহন। চোখমুখ কুঁচকে ফেললো বিরক্তিতে। পারলে কয়েক ঘাঁ দিয়ে দিতো এই মেয়েকে।
” অসভ্য একটা। সরর এখান থেকে। তোকে ছোঁয়ার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। তুই আমাকে জোরাজোরি করবি না। ”
” তা থাকবে কেন? ছোঁয়াছুঁয়ি তো সব নীলার সাথে। ঘরের মধু হলো রেডিমেড, তেঁতো লাগে? আর বাইরের মধু হলো প্রাকৃতিক একেবারে, মিঠা-ই মিঠা-ই?”
কীভাবে যে তাহমিকে চুপ করাবে বুঝতে পারছে না সহন। মাঝরাতে ঘুম রেখে এসব কোন বরের শুনতে ইচ্ছে করে?
” ভাই তুই থামতে কত টাকা নিবি? না না বউ! বউ তুই স্বেচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায়, বউ হোস আমার। আমি অসহায় বর। তুই আমাকে আজকের মতো ছাড়। তোর সাথে ঝামেলায় আমি পারছি না।”
সহন ফ্লোরে বসে রাগে,দুঃখে নিজের চুল টানাটানি করছে। তাহমির ভীষণ মজা লাগছে। আরো যাবি নীলার কাছে? তাহমিও আস্তে করে সহনের পাশে বসলো। গাল টেনে দিলো আস্তে। সহন কিচ্ছু বললো না। বললে যে তাহমি আরো ক্ষেপে যাবে সেটা এতক্ষণে সহন বুঝতে পেরে গেছে।
” সবকিছুই বুঝলাম কিন্তু তুই রোজা কেন ভাঙলি?”
” কাল থেকে একটা রোজাও মিস যাবে না। এখন আমি সোফায় গিয়ে শুই? চারটার দিকে উঠবো সেহেরি খেতে। ”
সহন এ কথা বলেই হুড়মুড়িয়ে বসা থেকে উঠে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। তাহমিও যেনো নাছোড়বান্দা! কোনো কিছুতেই ক্লান্ত হয় না সে। সহনের পায়ের উপরেই গিয়ে বসলো। সহনের একটু ব্যথা লাগছে বটে কিন্তু সেসবে পাত্তা না দিয়ে তাহমির দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
” আমার ভয়ে সব রোজা রাখবি বললি,অথচ যে আল্লাহ সৃষ্টি করলেন তাকে ভয় পাস না? আমি তোকে জোর করে রোজা রাখাতে পারলেও তোর অন্তরে আল্লাহর প্রতি প্রেম সৃষ্টি করতে পারবো না। সময় থাকতে ধর্মের দিকে মন দে। হারাম জিনিস ত্যাগ কর। শুভ রাত্রি। ”
তাহমি বিছানার দিকে এগোলো। সহন কিছু বললো না। কোথাও গিয়ে নিজের ভেতর কথাগুলো বাড়ি খাচ্ছে। আসলেই ইবাদত করতে হবে সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য পাওয়ার আশায়,মানুষকে ভয় পেয়ে কিংবা দেখনদারি করার জন্য নয়।

” আয়ান তৃষা ইদানীং কেমন জানি চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে। ”
ছুটির দিন আজ,শুক্রবার। বাসায় সবাই আছেন। তৃষার বাবাও ফিরেছেন বাসায়। তবে গতকাল জার্নি করে ছিলো বলে ফজরের নামাজের পরে ঘুমিয়ে গেছেন। বেলা এগারোটা বাজলো তবুও এখনো জাগেননি। কথা হচ্ছে মা – ছেলের সঙ্গে। আয়ানের ঘরের বারান্দায় বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ আছে। গোলাপ,অর্কিড, টিউলিপ, ডালিয়াসহ আরও নাম না জানা ফুল ফোটে সেখানে। গাছগুলোর দিকে মনোযোগ ছিলো আয়ানের। হঠাৎ বোনের বিষয় এমন কথা শুনে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলো সে। আমেনা ইসলাম দরজায় দাঁড়িয়ে কথাটা বললেন।
” হু আমিও খেয়াল করেছি। বাসা থেকেও বের হয়নি দু’দিন। প্রাইভেট কি পড়াচ্ছে না?”
মায়ের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে রইলো আয়ান। মা আমেনা ইসলাম চিন্তিত মুখশ্রী নিয়ে বলেন,
” এমনিতে পড়াচ্ছে কিন্তু দু’দিন ধরে নিজেই যাচ্ছে না। সেখানে আবার কোনো ঝামেলা হয়েছিল নাকি?”
” আমি যতদূর জানি তৃষা যেখানে পড়ায় সেই দুই বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ থাকে না। চাকরির জন্য দূরে থাকেন দু’জনেই। ”
মায়ের মন স্বাভাবিক হতে পারছে না। মায়ের চিন্তাযুক্ত চেহারা দেখে আয়ান ফের বলে,
” তুমি চিন্তা কইরো না। আমি কথা বলবো বিকেলে। ”
” ঠিক আছে। যা বাজারে গিয়ে ভালোমন্দ কিছু কিনে নিয়ে আয়। কতদিন পরে তোদের বাবা ফিরলো! ইফতারির জন্য যা যা লাগবে লিস্ট করে দিয়েছি। ”
” আচ্ছা ঠিক আছে মা।”
আয়ানের দিকে ছোটো একটা চিরকুট এগিয়ে দিলেন আমেনা ইসলাম। আয়ান সেটা নিয়ে প্যান্টের পকেটে রেখে দিলো। ইফতারের পরে বোনের সাথে কথা বলবে বলে মনস্থির করলো আয়ান। সারাদিন হৈহৈ করতে থাকা মেয়েটাকে নীরবতা মোটেই মানায় না। তৃষা বেশি তাহমির থেকে শান্ত তবে মোটেও শান্ত স্বভাবের নয়। সে তুলনায় আয়ান শান্ত প্রকৃত বটে।

দু’দিন হলো চঞ্চল মেয়েটাকে এ বাড়িতে আসতে দেখছে না ডাক্তার অনিক চৌধুরী। বোনের কাছে সে নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করাও সমীচীন মনে হচ্ছে না তার। ওহি কি কোনো কারণে ছুটি চেয়েছে কয়েকদিন? নাকি সেদিন ওরকম কথা বলার জন্যই মেয়েটা আসা বন্ধ করে দিলো? আনমনে বারান্দায় হাঁটছে আর এসব ভেবে যাচ্ছে অনিক। চিত্ত তার তৃষার জন্য আকুল হয়ে আছে। অথচ নিজেকে তৃষার কাছাকাছিও নিতে পারছে না। কী এক অদ্ভুত যাতনায় ভুগছে ডাক্তার সাহেব সে কাউকে বুঝাতে পারবেন না।
” ভাইয়া! কিছু হয়েছে? ”
বোনের কথায় সংবিৎ ফিরে পেলো অনিক। ল্যাপটপের দিকে দৃষ্টিপাত করেই আনমনা হয়ে ছিল এতক্ষণ।
” কিছু হয়নি দিনা। ওহি কই? বাড়িটা নিশ্চুপ লাগছে! ”
ওহির মা দিনা ভাইয়ের পাশে বসলো। বাবা-মা মারা গেছেন সেই কবে। আপন বলতে পৃথিবীতে শুধু দুই ভাইবোন।
” ওহি একটু পাশের বাসায় গেছে খেলতে। একটু পর ফিরবে। দু’দিন হলো প্রাইভেট নেই তো এজন্য লেখাপড়ার দিকে অমনোযোগী হয়ে গেছে। ”
অনিক আগ্রহী হয়ে সোজা হয়ে বসে।
” প্রাইভেট নেই কেনো?”
” কল দিলাম আজকে তৃষাকে,ওর না-কি একটু অসুবিধা আছে। পরশু থেকে আসবে।”
মনটা খারাপ হয়ে গেলো অনিকের। কারণ আগামীকাল সকালেই অনিক তার বাসায় ফিরবে। ওহিদের বাড়ি আসে সপ্তাহে দুই কিংবা তিন দিনের জন্য। এখানকার হসপিটালেও চেম্বার আছে তার। কিন্তু এ সপ্তাহে আর তৃষার সাথে দেখা হবে না ভাবতেই মনটা কেমন করছে। আগে তো এমন হয়নি! মেয়েটাকে আঘাত দিয়ে কথা বলার জন্যই হয়তো এরকম অপরাধী লাগছে নিজেকে।
” দিনা একটা কথা বলবো।”
হঠাৎ ভাইয়ের ভরাট গলায় কথা বলায় দিনা নড়েচড়ে বসে। স্থিরভাবে বসে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
” বলো ভাইয়া। এনি থিং সিরিয়াস? ”
” ইয়েস। আমার পর্যবেক্ষণ ভুল না হলে তৃষা আমাকে পছন্দ করেন।”
” কী!”
চমকাল দিনা। অনিক মাথা নেড়ে “হু ” বলে। মিনিট পাঁচেক দু’জনেই চুপ করে থাকে। ফের মুখ খোলে দিনা।
” সেটা বুঝেই কি তুমি তৃষাকে কিছু বলেছো? সেজন্য মেয়েটা আসেনি দু’দিন। ”
” হুম।”
” কেনো করো এমন? প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই একটা অতীত থাকে। কারো অতীত ঝলমলে সুন্দর আর কারো অতীত নিকষকালো অন্ধকার। তবে অতীত তো অতীতই হয়! সেটাকো বর্তমানে টেনে এনে কেনো ভবিষ্যতকে বরবাদ করতে চাচ্ছ?”
” দিনা শান্ত হ। তৃষার বয়স কম। আমার সাথে যায় না। তাছাড়া সবকিছু শুনলে ও নিজেই আমাকে ভুলে যাবে। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম এমনি বললেই হয়তো…. ”
” হয়তো স্বাভাবিকভাবে নিবে তাই তো?”
” হু।”
” কিন্তু স্বাভাবিক নিলে তো আসতো বাসায়। নিশ্চয়ই তৃষা কষ্ট পেয়েছে ভীষণ। ”
” কী করবো তাহলে? ”
” নিজেই ভাবো। জীবনটা তোমার। তোমার জীবনের সিন্ধান্ত তোমাকেই নিতে হবে। ”
অনিক চুপ করে থাকে। কী বলবে বুঝতে পারছে না। মনে মনে এ সপ্তাহে ওহিদের বাসায় থেকে যাওয়ার প্ল্যান করে। তৃষাকে সবকিছু খুলে বলবে সে। তারপর তৃষা তাকে এমনিতেই ভুলে যাবে। ফলে অনিকের অপরাধবোধ কিছুটা কমবে।

বিকেল চারটা। প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কেনাকাটা করতে সহনকে নিয়ে মার্কেটে এসেছে তাহমি। অবশ্য সহন যে নিজের মর্জিতে আসেনি সেটা আমরা সবাই জানি। আসার আগেই বেঁধেছিল ছোটখাটো তুলকালাম।
একটু আগের ঘটনা –
” সহন বিছানায় আর গড়াগড়ি না খেয়ে উঠে রেডি হ।”
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে খোপা করতে করতে বললো তাহমি। সহন বিছানায় শুয়ে ফোন টিপছিল। তাহমির কথায় টনক নড়ল।
” কেন? কই যাবো? তুই যা জাহান্নামে। তোর সাথে কোথাও যাচ্ছি না।”
” ভালো কথায় আজকাল কাজ হয় না। সেটা তোর সাথে কথা বললেই বোঝা যায়। ”
” হুঁশ! ”
” বদ লোক একটা তুই। হুঁশ কী? এ্যাঁ হুঁশ কী? আমি কি গরুছাগল! ”
” তুই একটা আস্ত পিশাচিনী।”
” হ্যাঁ যা বলিস তাই। ইফতারের আগে বাসায় ফিরতে হবে। অফিস থেকে তো তাড়াতাড়ি ফিরলি এখন বউয়ের সাথে চললল।”
তাহমি সহনকে চুল ধরে টেনে বসালো। ফলে সহনও রেগে তাহমির গালে মাঝারি সাইজের একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। তাহমিও কম যায় না। হুট করে মাথা থেকে ছোটো একটা ব্যান্ড খুলে সহনের নাকের ডগায় আঁটকে দিলো। মুহুর্তেই ব্যথায় “আহহ” করে শব্দ করে উঠে ছেলেটা। নিজেই খুলে ফেলে তারপর।
” তোর সাথে যা যেতাম এখন তা-ও যাবো না। ”
” তুই যাবি নাকি মামনিকে বলবো নীলার কথা? ”
” ব্লাকমেইল করছিস?”
বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সহন। তাহমি নাকের ডগায় হুট করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলে,
” বেসিক্যালি তুই একটা ব্লাক মেইল-ই। ”
” আমি কালো? এটাকে শ্যামলা বলে কালো না। শ্যামলাকে শ্যামলা বলতে শেখ।”
” শ্যামবর্ণ পুরুষ তুই কি যাবি না?”
তাহমির দাঁত খিঁচিয়ে কথা বলায় সহন মিইয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে,” রেডি হয়ে আসছি।”

এখন-
” তোর আর কিছু কেনার বাকি আছে? ”
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে শুধালো সহন। তাহমি আশপাশে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেলো। নিজের হাতের ব্যাগ দু’টোও সহনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
” তোর হাঁটতে সমস্যা হলে এখানে বস। আমি গিয়ে বাকি জিনিসগুলো কিনে নিয়ে আসছি।”
” আমি কি তোর চাকর? তোর ব্যাগ নিয়ে এখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবো!”
চলবে,