বসন্ত কন্যা পর্ব-০৭

0
332

#বসন্ত_কন্যা
#পর্ব_৭
#লেখিকা : সাদিয়া

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

আয়নার কল কাটতেই ফোনে আননোন নাম্বার থেকে কল আসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো নিশার। কয়েক সেকেন্ড অতিক্রম করে কলটা রিসিভ করতেই শোনা গেল গম্ভীর পুরুষালী একটা কন্ঠ।

– আমি বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। তাড়াতাড়ি বাইরে এসো।

ধক করে উঠল নিশার কলিজাটা। এতক্ষন যতই আয়নার সাথে ঝারি মারুক এই মুহূর্তে আবসারের কন্ঠস্বর শুনে ভয়ে চুপসে গেল নিশা। এতক্ষন মনের মধ্যে সাজিয়ে রাখা কথাগুলো কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কোনো মতে আমতা আমতা করে নিশা বলল –

– এই রাতে এই বাড়ি থেকে চলে গেলে সবাই কি মনে করবে? তাছাড়া আন্টি আমাকে যেতে দিবে না।

– অত কিছু জানার আমার প্রয়োজন নেই। কার কাছে জিজ্ঞেস করে এ বাড়িতে তুমি এসেছো?

নিশা কোনোরকম সাহস সঞ্চয় করে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল-

– আমি এখন চলে গেলে আন্টি খুব রাগ করবে। আমি এখন যাব না, আপনি চলে যান।

ধমকে উঠলো আবসার।
– তুমি বাড়ির বাইরে আসবে নাকি আমার ভিতরে যেতে হবে ? আমি এত রাতে বাড়ির ভিতরে গিয়ে একটা মেয়েকে নিয়ে আসলে বিষয়টা কিন্তু ভালো নাও হতে পারে।

নিশা তড়িঘড়ি করে বলল : আমি আসছি এখনই আসছি।

কাজলদের বাড়ি থেকে তো কিছুতেই আসতে দিবে না তাও ভুলভাল বুঝিয়ে অনেক কষ্টে বেড়িয়ে এসেছে নিশা। এখন মনে হচ্ছে কেন যে ঐ বাড়ি থেকে এ বাড়িতে আসতে গেল। সেই তো ঐ শয়তানের বাড়িতে শয়তানের সাথেই যেতে হচ্ছে ওকে।

আবসার সামনে সামনে হাঁটছে আর নিশা পিছনে পিছনে। হঠাৎ মাঝ রাস্তায় থমকে দাঁড়ালো আবসার, ওকে এভাবে দাঁড়াতে দেখে নিশাও থমকে দাঁড়ালো। আবসার পিছন ফিরে নিশার দিকে তাকিয়ে বলল –

– তা তোমার তো খুব ইচ্ছে ছিল আমি আমার বউকেও বিয়ের পর রাত ১০ টার মধ্যে ঘুমাতে বলব কিনা। আসলে আমি ভেবে রেখেছি আমার বউকে আমি সারারাতেও ঘুমাতে দেব না। সে ঘুমাবে সারা দিন যখন আমি ডিউটিতে থাকবো। আর মাঝে মাঝে রাতে ডিউটি থাকবে তখন।

এর মধ্যেই নিশা বেয়াক্কেলের মতো একটা প্রশ্ন করে বসলো।

– আপনি সারাদিন ঘুমাবেন না ডিউটিতে থাকবেন আবার সারারাত না ঘুমিয়ে বউকে আদর করবেন, ক্লান্ত হয়ে পড়বেন না?

নিজের করা প্রশ্নে নিজেই আহাম্মক নিশা। এ কি প্রশ্ন করে ফেলল। তাছাড়া আবসার তো বউকে আদরের কথা একবারও উল্লেখও করেনি তাহলে? লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে নিশার। ছিঃ ছিঃ নিজেকে এখন ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করছে নিশার। নিশা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

নিশার কথায় প্রথমে অপ্রস্তত হয়ে পড়েছিল আবসারও। কিন্তু পরক্ষনেই যখন নিশার প্রশ্নের মর্মার্থ বুঝতে পারলো তখন বাঁকা হাসলো। একটু ঝুঁকে নিশার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল –

– ঘুমাবো তো বউকে আদর শেষে শেষ রাতে

এই মুহূর্তে এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো নিশার। এই বেফাঁস মন্তব্য করার স্বভাবটা আর ওর গেল না এর জন্য মায়ের কাছে কত বকা শুনলো তাও এই বেহায়া স্বভাবটা ওর কাছ থেকে গেলোই না। নিশা আর কিছু না ভেবে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটা শুরু করলো। আর ওর পিছন পিছন আবসারও তার ঠোঁটে লেগে আছে মিষ্টি একটা হাসি অবশ্য সেই হাসি কারোরই দৃষ্টিগোচর নয়। পুরো পথ আর দু’জনে মধ্যে কোনো কথা হলো না। পুরো পথটাই নীরবতা বজায় রেখে বাড়ি ফিরেই খেতে বসেছে আবসার সাথে নিশাকেও বসিয়েছে। নিশা অনেকবার বলেছে ওবাড়ি থেকে ও খেয়ে এসেছে তাও শোনাতে পারেনি আবসার নামক প্রানীকে। সে ধমকে ধমকে নিশাকে খাইয়ে ছেড়েছে।

__________________

পরের দিন সকাল থেকে শুরু হয়ে গেল আবার অত্যাচার। তবে আজ সকালে নিশা নিজেই ঘুম থেকে উঠেছে‌। আসলে আজ আর ফজরের নামাজটা পড়ে ঘুমায়নি। জগিং – এ গিয়েও আবসারের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে আয়নার সাথে সাথে ছিল। তারপর সকালের নাস্তা করেই টিউশনির উদ্দেশ্য বেড়িয়ে পড়লো। বের হওয়ার আগে আবিদা বেগম বারবার বলে দিয়েছে নিশাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে। আজ তারা শপিং – এ যাবে‌। নিশার যেন বিষয়টা কেমন লাগছে যে বান্ধবীর ভাইয়ের বিয়ের শপিং- এ যাবে। কিন্তু আবিদা বেগম তো নাছোড়বান্দা। নিশাকে এই দুই দিনে বড্ড আপন করে নিয়েছেন মানুষটা। মায়েরা বুঝি এমনি হয় কিন্তু কই নিশার মামী তো এমন না। সে তো নিশাকে একদম সহ্য করতে পারে না ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিশা। এই দুই দিনে ফয়সালকেও তেমন মনে পড়েনি নিশার, পড়বে কিভাবে এখানে এসে আবসারের অত্যাচারে নিজেকে নিজেই মনে করার সময় পায় না নিশা আবার তো ফয়সাল।

__________________

শপিং – এ এসে এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে নিশা। আর বাকি সবাই কেনাকাটা করছে ওর কেমন যেন ইতস্তত লাগছে। আবিদা বেগম বারবার ওকে শাড়ি কেনার জন্য জোর করছে কিন্তু ওর শাড়ি আছে বলে অন্য শাড়ি নিবে না বলে দিয়েছে। আবিদা বেগম কতক্ষন জোড় করে ব্যর্থ হয়ে অন্যদের জন্য শাড়ি দেখতে চলে গেল। নিশা এক কোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শপিং মলটা দেখছিল। অনেক বড় শপিং মলটা। নিশা সচরাচর এমন শপিং মলে আসে না। এখানকার জিনিসগুলো যেমন সুন্দর দামও তেমন চড়া। ওরা মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্ত মানুষরা বেহুদা টাকা খরচের থেকে টাকাটা জমিয়ে রাখতে পছন্দ করে বিপদের সময়ের জন্য। হঠাৎ আবসারের ধমকে নিজের চিন্তা থেকে বেড়িয়ে এলো নিশা। কি শুরু করেছে এই লোক? শপিং মলে এসেও এভাবে ধমকে যাচ্ছে। এটা কেমন ধরনের আচরণ। ভিতরে ভিতরে চড়ম পর্যায়‌ বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলার সাহস নেই নিশার। সে সাহস থাকলে তো এতক্ষনে আবসারের মুখের উপর ঝামা ঘষে দিতো।

– এখানে সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? তোমাকে কি সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে এখানে নিয়ে এসেছি নাকি?

নিশা বিরবির করে আবসারের গুষ্ঠি উদ্ধার করতে করতে সামনে এগিয়ে যেতেই কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে মাথা চেপে চিৎকার দিয়ে উঠলো ” ও মাগো ” নিশার মাথাটা গিয়ে সোজা লোকটার বুকে গিয়ে ঠেকেছে। একে তো জীবনে ঝামেলার শেষ নেই তার মধ্যে মাঝ পথে এই খাম্বাটা আসলো কোথা থেকে আবার। বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে সামনে থাকতেই বিষ্ময়ে থ হয়ে গেল নিশা। ওর ধাক্কা খাওয়া মানুষটা আর কেউ না ফয়সাল। ফয়সালকে দেখেই দ্রুত সরে এলো নিশা। চোখের সামনে ভেসে উঠল সেদিনের অপমানের ঘটনা। চেহারায় ফুটে উঠল বিষন্নতার ছাপ। নিশার চেহারার এই বিষন্ন ছাপ সামনের ব্যক্তির চোখ এড়ালেও চোখ এড়ালো না ফয়সালের।

– কি রে নিশা তুই এই শপিং মলে, ভুল করে ঢুকে পড়েছিস নাকি? নিশ্চই তাই , তোদের মতো মিডেল ক্লাস মানুষদের জন্য কিন্তু এই শপিং মল নয়। এখানকার জিনিসপত্রের দাম জানিস?

ফয়সালের কথাগুলো নীরবে শুনছিল নিশা। ছলছল করে ওঠে চোখ দুটো। মাঝে মাঝে ও ভেবে পায় না এমন একজন মানুষকে ও কিভাবে ভালোবাসতে পারে যে মানুষকে মানুষ বলেই গন্য করে না। এত নিচু মনের কাউকে ভালোবাসে কথাটা মনে উঠলেই নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃনা চলে আসে। কিন্তু মন যে বড় অবাধ্য, চাইলেও এই মন থেকে ফয়সাল নামক মানুষটাকে ও মুছে ফেলতে পারে না। ওর অবাধ্য মনটা যে ওর কথা শোনে না। এর মধ্যেই একজন মেয়ে এসে ফয়সালের পাশে দাঁড়ালো। নিঃসন্দেহে মেয়েটাকে সুন্দরী বলা চলে, পুরো শরীরে আধুনিকতার ছোঁয়া। পোশাক আশাকেও বোঝা যায় হয়তো মেয়েটা কোনো বড় ঘরের মেয়ে। হবে হয়তো ফয়সালের গার্লফ্রেন্ড। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো আজ ফয়সালের পাশে কোনো মেয়েকে দেখে নিশার কষ্ট হচ্ছে না, বিন্দুমাত্র জ্বলছে না ওর হৃদয় যেখানে একটা মাস আগেও ফয়সালের পাশে ও কাউকে সহ্য করতে পারতো না। তবে কি এটা ফয়সালের অপমানের বল? ও কি ফয়সালকে ভুলতে চলেছে? হয়তো তাই এত বছরে ফয়সালের ওকে অপমানগুলো আস্তে আস্তে ওর মনে ফয়সালের জন্য তিক্ততা তৈরি করেছিল। কিন্তু সম্পূর্ন ভুলে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। এখন হয়তো সেটাও সম্ভব হয়ে যাবে।
মেয়েটা ফয়সালকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল – মেয়েটা কে?

– এমনি পরিচিত।

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো নিশা। এখন বুঝি ফুফাতো বোন হিসেবেও লজ্জা করছে ফয়সালের কারন ওরা মধ্যবিত্ত। মনটা বিষিয়ে গেল নিশার, ভাবতেই অবাক লাগছে এমন একটা মানুষের জন্য এত বছর ধরে ওর মনের মধ্যে অনুভূতি পুষে রেখেছে যে সামন্য অন্যের সামনে ওকে পরিচয় দিতে কুন্ঠিতবোধ করে।

মেয়েটা নিশার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল – আমি নাদিয়া, ফয়সালের ফ্রেন্ড।

ভদ্রতার খাতিরে নিশাও হাত বাড়িয়ে দিল মুখে মৃদু হাসির রেখা টেনে বলল – আমি নিশা।

এতক্ষন পাশে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিল নীরব দর্শকের মতো আবসার। প্রথমে ফয়সালের কথাগুলো শুনেই রাগ তরতর করে মাথায় উঠে গিয়েছিল তার। কিন্তু সে নিতান্তই ভদ্র মানুষ তাই এভাবে পাবলিক প্লেসে কোনো ঝামেলা করতে চায়নি, আর ওদের সামনেও যায়নি কারন ওখানে গেলেই নিজের রাগকে আর কন্ট্রোলে রাখতে পারবে না সে। কিন্তু এবার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আবিদা বেগম আর আয়ান সমান তালে ওদের কল করে যাচ্ছে। এবার রাগটাকে একটু চাপা দিয়ে নিশার কাছে এগিয়ে গেল, গম্ভীর কন্ঠে বলল-

– সারাদিন এখানে দাঁড়িয়ে থাকার প্ল্যান করেছো নাকি? ওদিকে আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি চলো বলে একটু এগিয়ে গেল আবসার।

নিশা এখনও ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছে। নিশাকে আসতে না দেখে আবসার ফিরে এসে নিশার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। হাতে টান পড়তেই টনক নড়লো নিশার। সেও মাথা নিচু করে আবসারে সাথে সাথে পা ফেলে চলতে লাগলো।

এদিকে অবাক এক জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে নিশা আর আবসারের দিকে। পাশ থেকে নাদিয়া বলে উঠলো “ঐটা মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড নাকি” । বয়ফ্রেন্ড কথাটা কর্নকুহরে পৌঁছাতেই ফয়সালের বুকে যেন চিনচিন ব্যথা শুরু হয়েছে। হঠাৎ এমন ব্যথার কারন খুজে পাচ্ছে না বেচারা। বুকে কোনো সমস্যা হলো না তো আবার, গ্যাস্ট্রিকের ব্যথাও হতে পারে, আবার এতক্ষন রোদে রোদে ঘুরেছে তার জন্যও হতে পারে। এমনি বুকে ব্যথার কিছু কারন বের করে নিজের মনকে বুঝ দিতে থাকলো ফয়সাল। কিন্তু মনটা যে বড্ড অবুঝ আজ কিছু বুঝতে চাইছে না, আজ নিজের ভিতরে কেমন অস্থির অস্থিরও লাগছে। কিন্তু এই অস্থিরতার উৎস কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না ফয়সাল। অবশেষে সামনে পরীক্ষা,পড়ার ভীষণ চাপ সেটাকেই নিজের অস্থিরতার কারন হিসেবে ধরে নিল ফয়সাল।

চলবে….