বাঁধনহীন সেই বাঁধন অকারন পর্ব-০৮

0
350

#বাঁধনহীন_সেই_বাঁধন_অকারন|৮|
#শার্লিন_হাসান

অবশ্যই জানি শিক্ষক ফাদারের সমান বাট আপনি স্যার আমার ব্রাদা….”

থামিয়ে দেয় রুদ্র। মেঘ খুব গর্বের সাথে কথাগুলো বলছিলো এতেই বেশ চটে যায় রুদ্র। এই মেয়েটা এতো চঞ্চল আর ঠোঁটকাটা স্বভাবের। দেখেই বুঝা যায়!

-শিক্ষক বাবার সমতুল্য। ভাইয়ের মতো না যে আপনি মশকরা,ইয়ার্কি করবেন।

-আসলে স্যার আপনি সম্পর্কের মূল্য বুঝেন না। সবার ক্ষেত্রে ফাদার না কিছুকিছু ক্ষেত্রে ব্রাদারের মতো। এই ধরুন আপনি আমার বেয়াই। বেয়াইকে তো আর বাপ বানানো যাবে না একমাত্র ভাইয়া আর সাইয়া ছাড়া।

-ডোন্ট ওয়ান্না টক। পার্সোনাল ম্যাটার এখানে টানছেন কেন? এটা কলেজ আপনার পারিবারিক সম্পর্কের জায়গা না।

-আমার কাছে পারিবারিক সম্পর্কের গুরুত্ব বেশী স্যার।

-কানে ধরে আসবেন আমার পেছন, পেছন।

কথাটা বলে আর একমূহুর্ত সময় লস করেনি রুদ্র। সোজা তিনতালার দিকে হাঁটা ধরে। মেঘ তার পেছনে আসছে।

-এতো অপমান করি তাও মেয়েটা ঠিক হয়না। রুদ্র শুরু থেকে বুঝেছে মেঘ তার প্রতি দুর্বল। কিন্তু সে চায়না এই মিছে ভাবনা সত্যিই হোক। সবসময় মেঘের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে রুদ্র। মেঘের আগে আলিশা তার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে। আলিশার জায়গা কেউ নিতে পারবে না এবং রুদ্রের ফাস্ট,প্রেজেন্ট এবং ফিউচারে আলিশাই থাকবে।
মেঘকে মেঘের ক্যারিয়ারে ফোকাস করতে হবে রুদ্রর জীবনে না। মেয়েটা সত্যি তাকে ভালোবাসে চোখের ভাষায় বুঝে রুদ্র। সেজন্য মেঘকে যথাসম্ভব ইগনোর করে রুদ্র।

মেঘের ডিপার্টমেন্টে এসে মেঘকে কিছুটা ধমকে স্বরে রুদ্র বলে,

-নেক্সট টাইম এমন বেয়াদবি দেখলে আমি প্রিন্সিপালের কাছে কমপ্লেইন করবো। আজকের মতো এই শাস্তি! আশা করি লজ্জা হয়েছে দু’তালা থেকে তিনতালায় কানে ধরে এসেছেন।

উত্তর দেয়না মেঘ। সে তো ক্লাস থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক ভাবেই হেঁটে এসেছে। রুদ্র পেছনে তাকায়নি সেজন্য বড় বাঁচা বেঁচে গেছে। মনে,মনে কয়েক খানা গালি দিলো রুদ্রকে সাথে টাকলা স্যারকে।

নিজের সীটে এসে বসে মেঘ। রুদ্র পুনরায় ক্লাস করানো শুরু করে। মেঘ বসে,বসে দেখছে। পড়াশোনার প্রতি সিরিয়াস কিছু কাজ করছে না তার। পড়াশোনা করার আগ্রহ নেই। মন চাচ্ছে বিয়ে সাদী করে জামাইয়ের সাথে দেশের একেক জেলায় যাবে ঘুরবে,পিক তুলবে।

পরের দিন ~
ভার্সিটিতে এসেছে আলিশা। তার সাথে সুমাইয়া ও আছে। দু’জনে বসে কথা বলছে। আরেকটু পর প্রীতি আসবে তারই অপেক্ষা করছে দু’জন। সুমাইয়া আলিশার ট্যুরের ঘুরাঘুরি সম্পর্কে জানার জন্য বসে আছে। রুদ্রর সাথে কেমন সময় কাটালো।

শান দিয়ে বাঁধাই করা গোলাকৃতি বসার জায়গা। সেখানেই বসে আছে আলিশা,সুমাইয়া,প্রীতি। এরই মাঝে সুমাইয়া বলে উঠে,

-আয়মান আজকে আসবে না মনে হয়।

সুমাইয়ার কথায় প্রীতি বলে,

-ওই গুন্ডা আসলেই কী না আসলেই কী? ওকে নিয়ে এতো ভাবছিস কেন সুমু?

-আমার ক্রাশ আয়মান।

-ঘোড়ার ডিম। দেখ তোর ক্রাশ কার আবার জামাই হয়ে বসে আছে।

প্রীতির কথায় হাসে আলিশা। আলিশাকে হাসতে দেখে পিঠে চাপড় মারে সুমাইয়া। প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,

-বল না কেমন ঘুরলি রুদ্রর সাথে?

-এই তো আলহামদুলিল্লাহ। রুদ্র এই আংটিটা দিয়েছে।
কথাটা বলে আংটিটা তাঁদেরকে দেখায় আলিশা। সুমাইয়া,প্রীতি বেশ প্রশংসা করেছে। তবে আলিশার তাতে কোন হেলদোল নেই।
ক্লাসের সময় হতে তারা তাঁদের ডিপার্টমেন্টে চলে যায়।

*****

এরই মাঝে কেটে যায় বেশ কয়েক মাস। দেখতে,দেখতে মেঘের ইয়ার ফাইনাল এক্সাম ও শুরু হয়ে যায়। উল্টাপাল্টা চিন্তা মেঘ মাথা থেকে ঝেড়ে নিয়েছে কয়েকদিনের জন্য। নিয়মিত প্রাইভেট,ক্লাস করে ভালো প্রিপারেশন নেওয়ার চেষ্টা করছে। তবুও মাঝেমাঝে চোখ বন্ধ করলে নিজেকে অসহায় মনে হয়। ভালোবাসায় এতো বিরহ আগে জানলে কখনো ভালোবাসা নামক সূক্ষ্ম অনুভূতি মনে জায়গা দিতো না। ভালোবাসা কারোর জন্য সুখ কারোর জন্য বিরহবেদনা। কেউ না চাইতে ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়ে যায় কেউ না হাজারো চেষ্টায় নাগালও পায় না। মেঘের ক্ষেত্রেও তাই।

সেদিনের পর রুদ্রর সাথে তেমন একটা কথা হয়নি মেঘের। মেঘ ও আর আগের মতো আশেপাশে ঘেঁষে না। নিজেকে সরিয়ে নিতে চায়। আবেগ কন্ট্রোলে নিয়ে আসতে চায়। ট্যুর থেকে এসে লিমার কাছে সবটা শেয়ার করে মেঘ। এই সুযোগে হৃদ তাকে প্রচুর পচিয়েছে। লিমা অনেক বুঝিয়েছে। বুঝেছে মেঘ তবুও মাঝেমাঝে মন মানে না। কলম দিয়ে এক্সারসাইজ বুকে আকাবুকি করছে আর ভাবছে মেঘ। পরক্ষণে নিজের গালে নিজেই চ’ড় মারে মেঘ।
-অবশ্যই নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করতে হবে। রুদ্রর থেকেও দ্বিগুণ সুন্দর ছেলেকে বিয়ে করতে হবে। এই ভাবে আবার মনে হয় যতই ভালো রুদ্রর মতো কাউকে আদৌ পাবো? রুদ্রর মতো করে ভালোবাসবো? পাগলামী করবো? সে অবহেলা করবে না তো রুদ্রর মতো? ভালোবাসবে তো? আর অবহেলা করলে আমি নিতে পারবো না। হয়ত বা অবহেলার শো’কেই আমি মা’রা যাবো। ইশশ! মরবো কেন? আল্লাহ তো আমায় সুন্দর একটা জীবন দিলো। কারোর জন্য তো কারোর জীবন থেমে থাকে না। সময়ের সাথে চলে যায়। মানিয়ে নেই আমরা তাহলে এই রুদ্রর জন্য নিজে কেনো ম’রবো?

এতো,এতো ভাবনার অবসান ঘটে যখন রাখি মেঘের রুমে প্রবেশ করে।

-এই মেঘ এই ছবিটা এলবাম করে জুলিয়ে রাখলে কেমন হবে?

হাসি মুখে কথাটা বলে রাখি। তখন মেঘ বলে,
-কোন ছবিটা আপু?

-ওই যে ট্যুরের আমাদের সবার একটা গ্রুপ ফটো।

কথাটা বলে ফোনটা এগিয়ে দেয় মেঘের কাছে। সেখানে রুদ্রর একটা হাসোজ্জল ছবি আলিশার সাথে। দেখতে বুকটা ছ্যাৎ করে উঠে। তবে হাসি দেওয়া রুদ্রকে গম্ভীর রুদ্রর থেকে দশগুণ বেশী সুন্দর লাগছে। মেঘ আমতা,আমতা করে বলে,

-কোথায় গ্রুপ ছবি? এটা তো কারোর পার্সোনাল ছবি।

কথাটা বলে রাখিকে ফোনটা দেয় মেঘ। তখন রাখি জিভে কামড় দিয়ে বলে,

-সরি এটা না টাচ লেগে চলে এসেছে।

কথাটা বলে গ্রুপ ফটোটা মেঘকে দেয় রাখি। যেটাতে তারা সবাই আছে।

-সুন্দর হবে।

-আচ্ছা তাহলে মেহরাবকে বলবো করে দিতে।

-আচ্ছা।

রাখি প্রস্থান করে সেখান থেকে। মেঘের মনে আবারো উথালপাতাল ঝড় শুরু হয়ে গেলো। রুদ্রর আর আলিশার পিকটা না দেখলেই ভালো হতো। মনটা খাঁ,খাঁ করছে। এই অজানা কষ্ট,চিন্তায় আজকের দিনটা তার মাটি হয়ে যাবে। ঠিকঠাক এক্সামটাও মনে হয় দিতে পারবো না। যতই ভুলে যেতে চাই ততোই সেটা সামনে আসে কেন? কলেজে গেলে ও তো
আজকে মেঘের বায়োলজি এক্সাম। বাকী আছে আরো তিনটা এক্সাম। সকাল থেকে খুব ভালোভাবে পড়ছে। বিকেলে এক্সাম শুরু হবে।

লান্স করে রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়ে মেঘ। আজকের দিনের এক্সাম প্রিপারেশন মোটামুটি। ফেইল না করলেই হয়। পাশ করলেই বাঁচে মেঘ।

লিমা র দুই বেঞ্চ পেছনে মেঘের সীট পড়েছে। যথা সময়ে এক্সাম শুরু হয়।

রুদ্র করিডোরে দাঁড়িয়ে আলিশার সাথে কলে কথা বলছে। সন্ধ্যায় তারা মিট করবে।
এক্সাম শেষ হতে,হতে পাঁচটা বেজে যায়। এই দিক সামলে রুদ্র সোজা নিজের ফ্লাটে চলে যায় সন্ধ্যায় বের হবে।
মেঘ,হৃদ,লিমা হেঁটে, হেঁটে কিছুটা পথ আসছে কথা বলতে,বলতে। সামনে গিয়ে গাড়ীতে উঠবে। এরই মাঝে হৃদ বলে,

-কী রে বাঙ্গির ছিলকা! ইউর ক্রাশ বয় হোয়াইট মুরগির কী অবস্থা?

-ওর কথা আমার কাছে আর বলবি না পটল। রুদ্র কে মেঘ তাকে চিনে না। সে তার মতো তার লাইপ পার্টনারকে নিয়ে হ্যাপি থাকুক।

-লিমা বুঝেছিস কিছু? এখন চোখের খাওয়া শেষ ছেড়ে দিলো।

-হা*লা তুই চুপ করবি? এমন ক্রাশ জীবনে কত আসে আর যায় এসব ধরে লাভ নাই। ভার্সিটি গেলে দেখা যাবে কত বফ আর ক্রাশ মেঘের।

-এমন ক্রাশই খাইতে পারবি দুইএকটারে না।

-লিমা ওরে স্কচটেপ লাগিয়ে দেএ। কী খাওয়াখাওয়ি শুরু করলো। পটলের বাচ্চা পরলে আমার কথা ছাড় তুই নিজের দিকে তাকা।

-আমি হ্যান্ডসাম বয়।
চুলগুলো স্লাইড করে বললো হৃদ। তাকে খোঁচা মেরে মেঘ বললো,

-শুধু হ্যান্ডসাম হলেই মেয়ে পটে না সাথে ট্যালেন্ট ও থাকা চাই। আর তোর মতো পটলকে কোন মেয়েই বফ বানাবে? চিকনা মুরগি আইছে হ্যান্ডসাম সাজতে।

-লিমুর বাচ্চা মেঘরে কিছু কবি? বাঙ্গির ছিলকা ছ্যাকা খাইয়া বাঁকা হইয়া এখন আমার সন্মান নিয়া টানাটানি করে।

-এতোদিন যে তোরা দুইটায় মিলে আমার সন্মান নিয়া ফুটবল খেলতি। এখন আমি খেললেই দোষ।

-যা ভাই বাড়ী যা। মনে হয় ফাদারের চিন্তায় মাথা ঠিক নাই তোর।

-হালা আর একবার ফাদার বললে উ’ষ্ঠামু তোরে।

-গেলাম গা রে বাঙ্গির ছিলকা।

কথাটা বলে হৃদ অটোতে উঠে। হৃদ যেতে মেঘ,লিমাও রিকশা ধরে বাড়ীর উদ্দেশ্য রওনা হয়।

*******

বেলকনিতে বসে আছে আলিশা। রুদ্রর সাথে কথা বলতে এখন আর ভালো লাগে না। এক্সট্রা প্যারা মনে হয়। সে তো বিরক্ত আজকাল। এতোদিক সামলাতে হিমশিম খায় আলিশা। এর মধ্যে আবার আগামী কালকে রোশানদের বাসায় যাবে আলিশারা স্ব পরিবারে বেড়াতে। রোশান লন্ডন থেকে দেশে ফিরেছে এক সপ্তাহ হবে। এরই মাঝে রোশানের মা উঠে পড়ে লেগেছে আলিশার সাথে এনগেজমেন্টটা সেরে নিতে রোশানের। আলিশা দোটানায় আছে। কাকে কী বলবে? সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে। একদিকে রুদ্র আরেকদিকে আয়মান আরেকদিকে রোশান। কাকে ছেড়ে কার কাছে যাবে। আপাতত রুদ্রর সাথে প্যাচআপ করে নেওয়াটা ব্যাটার মনে হচ্ছে। কিন্তু কোথাও একটা টান অনুভব করে আলিশা। সাড়ে তিনবছরের সম্পর্ক নষ্ট করে দিবো?

-রুদ্র আমায় ভালোবাসে। বিশ্বাস করে, আমাকে ছাড়া ও কীভাবে কী করবে? তাতে কী ও তো ওর পাস্ট আমায় বলেনি! কেনো বলেনি? আমায় বিশ্বাস করে না রুদ্র। কিন্তু আমি তো ওকে এতেদিন ঠকিয়েছি। জঘন্যভাবে রুদ্রকে ঠকিয়েছি আমি। ও জানলে আমার হাত ছেড়ে দিতে দু’বার ও ভাববে না। ছেড়ে দিক না হাত? আমি অন্য কিছু ভেবে দেখবো। রুদ্রকে যদি বিয়েই না করি তাহলে রিলেশন কনট্রিনিউ করলাম কেন?

আলিশা আর ভাবতে পারলো না। উঠে তার মায়ের রুমে গেলো। আফিয়া ইসলাম তখন কলে কথা বলছিলেন তার বোন রিয়ার সাথে। আগামী কালকে তারা যাবে। আলিশাকে দেখে একগাল হাসলেন আফিয়া ইসলাম।

-কিছু বলবে আলিশা?

-অনেক কিছুই বলবো মা। প্লিজ আমাকে একটু সময় দাও আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।

কথাটা বলে আফিয়া ইসলামের পাশে বসে আলিশা।

-কী হয়েছে আলিশা?

-তুমি রোশানের সাথে আমার বিয়ে দিতে রাজী?

-হ্যাঁ কেনো নয়? আমার একমাত্র মেয়ে আমাদের মাঝেই থাকবে। চাই না অন্য কোথাও যাক জামেলা বাড়ুক। আমার রাজকন্যা যাতে যেখানে যায় সেখানেই রাজরানী হয়ে থাকে।

-ওহ! আচ্ছা আমার কী করা উচিত?

-দেখো আলিশা তোমাকে ছোটবেলা থেকে যথেষ্ট আদরযত্নে বড় করেছি। কোন ইচ্ছা অপূর্ণ রাখিনি। তাহলে বাবা মায়ের এই ইচ্ছেটা মেনে নিতে পারবে না? বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করতে পারবে না?

-এভাবে বলো না প্লিজ। আমি৷ তোমাদের অনেক ভালোবাসি। মেনে নিলাম তোমাদের পছন্দকে।

-এই তো আলিশা আমার গুড গার্ল।

আলিশা হাসে। তবে সেটা আনন্দের হাসি না মলিন হাসি। কী করবে? পরিস্থিতি হাতের বাইরে যেতে সময় লাগবে না। আর সে যা করেছে রুদ্র মরে গেলেও তার দিকে ফিরে তাকাবে না। রুদ্রর ব্যক্তিত্ব প্রখর যেটা সাড়ে তিনবছরে আলিশা হারে,হারে বুঝেছে। আফসোস করবে নাকী নতুন করে সব শুরু করবে ভেবে পাচ্ছে না আলিশা।

#চলবে