বাতাসে তার সৌরভ পর্ব-০২

0
413

#বাতাসে_তার_সৌরভ–২

একপাশে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, অন্যপাশে বাঁশঝাড়ের সারি; মাঝ বরাবর চিকন ইট বিছানো রাস্তায় একজন সুটবুট পরা টকটকে সাহেব দাঁড়িয়ে । কাজ থেকে ফেরতি মানুষের ঘুরে এক ঝলক তাকিয়ে সামনে হেঁটে যাচ্ছে।শহুরে নির্লিপ্ততার বিচিত্র অভ্যাসের ছোঁয়া বোধকরি গ্রামদেশেও লেগেছে।

সোহরাব সাহেবের একটু বিভ্রান্ত লাগছে। তারজন্য এলাকাটা একেবারেই নতুন। দেশে থাকতেও সাতক্ষীরার ভাদরা নামক সীমান্তবর্তী এলাকায় কখনো আসেননি। একটা কাজে যশোরে এসে হুট করেই কৌতূহলটা চাপলো ঝুঁকিটা নিয়েই ফেললেন। সোহরাব সাহেব মূলত হায়দার আলি নামের ফার্নিচার ব্যবসায়ীর খোঁজে এসেছেন যার স্ত্রী নাম দরিয়া এ নুর রানু বেগম। ভাদড়া পাইকপাড়া হাইস্কুলের পেছনে বলে ঠিকানায় উল্লেখ। হাইস্কুল খুঁজে বের করা হয়েছে, কিন্তু তার পেছনে কোন বাড়ি ঘর দেখা যাচ্ছে না ছড়িয়ে থাকা বটগাছ আর বিশাল বাঁশ ঝাড় মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে। এখম কোথায় যাবেন কাকে জিজ্ঞেস করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না বড় গাড়ি একপাশে পার্ক করে এদিক-ওদিক দেখছেন। একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে যাবেন অমনি বাধা।

” will you be late today?
তুমি কি আজকে আসতে দেরি করবা?”

প্রিয়কণ্ঠ শুনে সোহরাব সাহেবের কিছুটা স্বস্তি লাগলো, ” তুমি ঘরে ফিরেছ? ”

উত্তর দ্বাতা টেনে বাংলায় বলল,”উনেক আগেই, কিচেনে আমি এখন ”

” কুকিং?

” আজ লাজানিয়া হবে ডিনারে তাড়াতাড়ি এসে পড়ো”

“মনে হয় না সম্ভব হবে, আমি আউট অফ টাউন ”

” কতক্ষণ লাগবে? ”

“এটা বাংলাদেশের আউট অফ টাউন। একেবারে বর্ডারে। এখানে যার সাথে দেখা করতে এসেছি তাকে দশ মিনিটের মধ্যে খুঁজে পেলে ফিরব, নিয়ার এবাউট কাল সকাল বা দুপুর”

” মানে কী? ” ওপাশের কথক একটু বিরক্ত। ” আমি আশা করি তুমি কোন ঝামেলায় জড়াচ্ছ না ”

” ঝামেলা মেটাতে এসেছি ”

” এটা কি জরুরি? ”

” কিছুটা। এটার পেছনে ইতোমধ্যে অনেক সময় ইনভেস্ট করে ফেলেছি। এখন কোন হ্যাসেল চাই না। মেয়েটাকে দেখা জরুরি ”

” যা ইচ্ছে কর! তবে বুঝে ডিল কর প্লিজ। this country is full of greedy Gold diggers যার সাথে দেখা কড়থে ছাইচো, you better know her well…!
একটা ফ্রড করাপ্টেড মাটি!

সোহরাব সামদানী সাহেব ছোট নিঃশ্বাস ফেললেন। এইদেশের মাটি কখনো করাপ্টেড ছিলো না৷ করাপ্টেড এই মাটিতে জন্ম নেওয়া লোকগুলো। মুখে ধর্মভীরু তলে তলে সব লোভের আন্ডিল; তাই যদি হয় তাহলে সামদানী সাহেব নিজেও ব্যতিক্রম নন ; প্রবণতা উত্তরাধিকার সূত্রেই রক্ত বয়ে চলে।কিন্তু কষ্ট বিনে কেষ্ট মেলে না। সোহরাব সাহেব বাঁশঝাড়ের বামপাশ দিয়ে চলে যাওয়া পথ দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। বাড়ি আশেপাশে কোথাও হবে। সদরে বড় আসবাবের দোকানের মালিক হায়দার সাহেবের বাড়ি পাকাই হবার কথা। কাকে খোঁজ করবেন? নিজের উপর বিরক্ত লাগছে আজ কি সত্যি মেয়েটার সাথে দেখা হবে?তিনি তো এটাও নিশ্চিত নন মেয়েটা এখানে আছে কি নেই। আর দেখা হলেই কি কাজ আগাবে? তবে এতদূর এসে চেষ্টা না করে চলে যাওয়াটাও বোকামি

******

” ছি**ল মাগ***ঈ, তুমি কী মনে করো তোমার কাজকাম কিছু জানিনে? ”

আনোয়ারাকে উদ্দেশ্য করে রানুখালার রাগেফুসে ওঠা কথাগুলো তাহলে এমনি এমনি ছিলো না। বড় ফিল্মস্টার পাঁচ হাজার টাকা মেকাপের জন্য দেবে! কোন দিক থেকে বিশ্বাসযোগ্য ছিলো? নদীর বুদ্ধি কি হালচাষ করতে গিয়েছিল?জীবনে ভাবেনি এই খুপড়ি বাথরুমে বসে কখনো খালার বাড়ির সীমানা পার হবার আপসোস হবে। নিশির জন্য পাত্র আসছে শুনেই দমবন্ধ হয়ে আসছিল। এখন সেই ঈর্ষার কারণ নিজের পায়ের চটি খুলে গালে মারতে ইচ্ছে হচ্ছে।

নদী শান্ত থাকার চেষ্টা করেও পারছে না।মনে হচ্ছে বাথরুমের দাঁড়িয়ে তার হৃদপিণ্ডের ধ্বনি বাইরেও শোনা যাচ্ছে। আর বাইরে খাবার নিয়ে ওই ষন্ডামতো নুরুল ছেলেটা বসে আছে।
নদী আবার টিসু পেপারটার দিকে তাকালো। মনু ফাজলামো করলো না তো। নিশিকে চিঠি দিতে গিয়ে কঠিন ভাবে ধরা খেয়েছিলো রানুখালার কাছে। মনুর সমস্যাই হলো ভয়ংকর জটিল জিনিসে আগ্রহ। অংকে যার পয়তাল্লিশের ওপর উঠতো না সে এস এস সিতে পিউর সাইন্স নিয়ে ফেলল। তাকে ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। যদিও ইংরেজিতে ইঞ্জিনিয়ার বানানটা করতে সমস্যা। তেমনি ইংরেজি বেগম নিশিকে তার বেশি পছন্দ ছিল। নিশি তাকে দুবার জুতো ছুড়ে মারার পরেও লাভ হয়নি৷
এই মনু নদীকে ভয় কেন দেখাবে? নদীর সাথে তো ঝামেলা ছিল না। কিন্তু আনোয়ারা বু এমন কেন করবে?

-কী হইলো মেয়ে কই?

-বাথরুমে

রানুর মনে হলো বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷হোটেল ঘরের মধ্যে অন্য কেউ ঢুকেছে৷ লোকটা তার সাথে কথা বলছে৷

” খাইসে?”

” মুখ হাত ধুইতে গেসে ”

তুমি আগে খাওয়াইবা না? আকামগুলা কর?

নদী কী মনে করে বাথরুমের বেসিনের কল ছেড়ে দিলো।

” আয়া পড়বো, তুমি যাও।

” ঘটনা ঘইটে গেলে দেরি করো না। আজকের মধ্যি ডেলিভারি যাতি হবে। ”
” এটা ইন্ডিয়া যাবে? ”

” আর বলসি কী, অন্য মতলব রাইখো না এবার কলাম ফেরেশ মালের অর্ডার…”

নদী আর খুব একটা কিছু শুনতে পেলো না। তবে যতটুকু শুনলো তারজন্য যথেষ্ট। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ? মাথা ঠিক কাজ করছে না।। পাঁচ বাই চার ফিট ছোট একটা বাথরুমের দেয়াল ক্রমে যেন চেপে আসছে। মনে হচ্ছে স্বপ্ন কিন্তু এটা স্বপ্ন নয়।বাবার স্ট্রোকের পর পরই যখন মা আর বাবলু চলে গেল না ফেরার দেশে তখনও হঠাৎ মনে হয়েছিল স্বপ্ন। নদী ছাড়া সবাই কাঁদছিল,নদী অপেক্ষা করছিল স্বপ্ন ভাঙার। অথচ স্বপ্নে এত স্পষ্ট স্মৃতি মনে থাকেনা। নদীর মনে আছে পাশের বাড়ির আন্টির কী চিৎকার করে কান্না, “মেয়েটা ছাড়া বাড়ির কেউ বেঁচে নাই। একটা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল! এ কেমন বিচার আল্লাহর এ কেমন বিচার? ”

নদী নিজেকে ঝাঁকুনি দিলো জোরে।অতীতের আহাজারির মধ্যে ডুবে গেলে আরও সর্বনাশ। ঝামেলা হলো তার মোবাইলটাও ঘরে ফেলে আসা। বাথরুমের ভেন্টিলেটরের জায়গাটায় বড় করে একটা একজাস্ট ফ্যান বো বো করে ঘুরছে।

সেটার তারট দেয়ালের ওপর দিকে একটা প্লাগে লাগানো। নদী খেয়াল করলো একজাস্ট ফ্যানটা কোমড বরাবর। একজাস্ট ফ্যানটা প্রথমতো বন্ধ করতে হবে প্লাগ খুলে দিলে বন্ধ হয়ে যাবে এরপর …। বুক ধরাস করে উঠছে।এতক্ষণ লাগলে লোকটা যদি টের পাওয়া যায়?.নদী বুঝতে পারছে না কী করবে। ধরা পড়লে?

ধরা পড়লে তখন দেখা যাবে, এখন চেষ্টা করা যায়। একটা পরিবার এভাবে নিশ্চিহ্ন হবে না। কিছুতেই না। নদী সাবধানে কোমডের ফ্ল্যাশের ওপর একটা পা দিলো।সিরামিকের ঢাকনা নড়বড়ে লাগলো যদি কোন ভাবে,

– এই! কী কর এতক্ষণ।

দরজার ওপাশ থেকে আওয়াজ! নদীর মনে হলো যে পড়ে যাবে।
******

” তুই নিকি পারলারি যাস” রানু চিলের মতো তীক্ষ্ণ গলায় বললেন।

” পারলারে যাইনি জিমে গিয়েছিলাম। “নিশির হাই তুলতে তুলতে উদাস গলা।

” কী বললি, ক’নে গিয়েছিলি?”

” জিমে খালামনি..টাউনের দিকে পিচ্চি করে হয়েছে, পুরাই ফালতু,দুটা ট্রেডমিল আর ডাম্বেল বসিয়ে বলে জিম। ওয়াটেভার, তুমি বুঝবা না৷ এখন একটু জুস দাও টায়ার্ড লাগছে।”

“জুস তোর আমি পু**কির মধ্যি ভইরে দোবো, নটিগিরি কইরে ঘরে ঢুইকে অর্ডার মারতিসে…”রানু ঠোঁটের তলে গালির মেলা বসিয়ে নিজেই গুটিয়ে নিলেন।এটা নদী না, বহুত জটিল জিনিস। বড়বোনের এই আপদটা ভালোয় ভালোয় বিদায় না নিলে অচিরেই কেলেঙ্কারিতে এই পাড়া ছাড়তে হবে।নিজের ছেলে শাহিন যে কান্ড ঘটিয়ে বসে আছে সেটা সামাল দিতে কপর্দকশূণ্য হয়ে যাচ্ছেন। তার ওপর নিশি এমন জায়গার বিষফোঁড়া না বলা যায় না সহা। এগুলোকে হ্যান্ডেল করতে হয় ঠান্ডা মাথায়। মেজাজটা গিলে খেয়ে রানু এগিয়ে এলেন, ” মা গো, পাগলামি আর করিসনে। তোর মায়ের কথাটা একটু ভাব। আমেরিকার মতো দেশে খেইটে মরতিসে। আমরা কি ঠিক কইরেসি বল? তোর মাই অনেক খুঁজেঘেটে ছেলের ঘর এনেছে, তোর ভালোর জন্যিই তো।গোসলটা কইরে একটু রেডি হয়ি যাও সোনা ময়না, তারা এইসে পড়বেনে ক্ষণ।

“তার এসে কী করবে আমার হাঁটাচলা দেখবে? মার্কিং করবে? ”

” সে হয়তো একটু করবে বিয়ে-শাদির আগে জানাশোনা… ”

“পয়েণ্ট! লাইফ পার্টনার মেটেরিয়াল দেখে শুনে নেওয়াক ভালো। আমিও কিন্তু করব খালা। ”

রানু মাথা নাড়লেন ” তা করবে বটেই সারাজীবনের ব্যাপার ”

নিশির চোখ ছোট ছোট ঝুঁকে এলো ” আগেই বলে রাখি, আমিও পাত্রের মেটেরিয়াল দেখবো ওইগুলাই তো ইম্পর্ট্যান্ট, নাও আই এম লাইকিং দিস দেখাদেখি রিচুয়াল ”

রানুর কেমন অসহায় লাগছে। মনের অজান্তেই ইয়া নাফসি জিকির তুলছেন । বুঝতে পারছেন না আজ আর কী কান্ড হবে।” রানু আমি জানি ও যন্ত্রণা করছে, ওর ব্যবস্থা আমি দ্রুত করছি একটু ধৈর্য ধর। কয়েক দিন একটু বাড়িতে রাখ..”
হাজার মাইল দূর থেকে শানুর কথা শুনে শরীর জ্বলে গেছে। পাড়ার ত্রাস, বিশিষ্ট সন্ত্রাসী আঙুলকাটা তাজুল যেই মেয়ের সিগারেটে আগুন দেয় তাকে বাড়িতে রাখা আর গ্রেনেড রাখা এককথা।

” চাচ্চুইইই! এত্তদিন পর মনে পড়লো, আমরা কত্ত মিস করসিলাম আপনাকে জানেন? ”

নিশি নিজের ঘরে যেতে সময় শাহবাজের সাথে চোখাচোখি হলো শাহবাজ ফ্যাকাসে হাসলো, দৃষ্টি সরু।

নিশি বাঁকা হেসে বলল” আমার রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে কী করতেসেন পাহারা নাকি উঁকি ”

“কাজে আসছে” রানু ধমক মেহমান আসবে কত কাজ পড়ে আছে নদী মহারানী কলিজির রেজাল্ট দেখতি”

” কিসের রিজাল্ট গো খালা,” ঠিকেঝি একাই বলে উঠলো, নদী আপারি যে দেখলাম আনু বুজির সাথে কুতায় যাচ্ছে”

” নদী কার সাথে?” নিশি ঘুরে তাকালো।

” এই না কতা নিশ্চয়ই পাশের বাড়ির কারোর মেকাপ মারাতি গিয়ে চুনকালি করে আসপে! এত কইরে বললাম ঘরে থাক, ওমা নিশি তুই যাচ্ছিস কনে? ”

নিশি উত্তর দিল না। চোখমুখ শক্ত করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো। আজ মূলত মহান নেতা তাজুলের বাম হাত হিরনের সাথে সদরে গিয়েছিল । ফিরতি পথে খেয়াল করেছিল সামনের বাড়ির ভাড়াটিয়া ঘর তালা। বাড়ি বদলেছে। হিরন দেখে বলল, ‘সর্দারনী আনুর বাড়ির পাশের বাড়িটাই তোমাগের?তাতো জানি নে

” সর্দারনী মানে?

” আরে মেইয়ে মানুষের দালাল। মেয়ে তুইলে তুইলে ঢাকার নামীদামি জায়গায় বেইচে দেয়।ওপারেও পাঠায়। বুঝতি পারোনি? পুরোন পাপী কবার ধরা খেলো। এইবাড়ি ভাড়া নিয়েসে সেই কবে।শালীর মতলব ভালো হলিই হলো। বড়ভাই দুবার ছুটোয় এইনেসে।

নিশি অবাক হয়েছিল। এখন কেমন খটকা লাগছে। গাজার প্রকোপে টাল থাকা হিরন বেশি কথা বলল না তো? নদীটা চুপচাপ থাকে বলে এত হাঁদারাম তো মনে হয় না। তবে এখন ওকে খোঁজার বাহানায় এই পাত্রপক্ষ ঝামেলাটা স্কিপ করা যায় না? যদিও দেখা হলে আরেক মজা হতো। কিছু জটিল জটিল সব প্রশ্ন রেডি করে রেখেছিল, পাত্র দুর্বল হলে দাঁড়িয়ে থেকে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলবে। এদিকে নদীর জন্য একটু চিন্তা হচ্ছে,গাধীটা ঝামেলায় না পড়ে। নিশি দ্রুত ভাবছে কী করবে। বিকেলের আকাশ লালচে হয়ে আসছে, কাউকে ডেকে জিজ্ঞেস করবে? দূরে মাঠের কাছে দাঁড়ানো বৃদ্ধের বকবকানি কানে আসছে,

“শাহজাহান আলী বইলে তো এইখানে কেউ থাকে না।এক ছেল শাহজাহান সর্দার তা সে মুদি দোকানদার। ইস্মল শপ ওনার! আরে আমি চেনবো না আমার নাম হলো গিয়ে আলী হোসেন মাস্টার সবাই একনামে চেনে ,এভরি ওয়ান নোজ… ”

নিশির বিরক্ত লাগলো। এই দেশে গ্রামের সবাই নিজেকে জগৎবিখ্যাত মনে করে কেন? সবাইকে সবাই এক নামে চেনে৷ বৃদ্ধ কথা বলছে এক শহুরে সাহেবের সাথে। মেইনরোডের একপাশে দাঁড় করা বেশ দামী প্রাডো গাড়ি দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত এই ভদ্রলোকেরই হবে।

এদিকে দীর্ঘক্ষণ বুড়োর বকবক শুনে সামদানী সাহেবের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। গত দশ মিনিট ধরে বলেই চলেছে। এই এলাকার গত চল্লিশ বছরে কতগুলো শাহজাহান ছিল তার ফর্দ ধরিয়ে ছাড়বেন। খোঁজাখুঁজির রাশ টেনে সোহরাব সাহেব ফিরে যাওয়াই ঠিক করলেন,

” আর ইউ লুকিং ফর সাম ওয়ান স্যার ?”

সোহরাব ঘুরে তাকালেন, কুড়ি একুশে বছরের গোলগাল মুখের খর্বাকৃতির বেশ ফর্সা এক মেয়ে। অবাককরা বিষয় তার ইংরেজি উচ্চারণ আর পশ্চিমা পোশাক। তবে এখন মুঠোফোনের নীলচে আলোর যুগে এই দেশের সংস্কৃতি চোখের পলকে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।সবজায়গায় সবকিছু সম্ভব । সোহরাব সামদানী বললেন।

” শাহজাহান আলি ফার্নিচার ব্যবসায়ী.. উনার ওয়াইফ দরিয়া নুর বেগম ”

” সাজু ব্যাপারিরি খুঁজতিছেন? “আলি মাস্টার আকাশ থেকে পড়লেন। ”

” জি ওনার ঠিকানাটা হারিয়ে গেছে তাই। ”
” আপনি কি মেয়ে দেখতে এসেছেন? “নিশি হঠাৎ বলল।

সামদানী দারুণ চমকে গেলেন, ” না মানে হ্যাঁ, মানে ওনার বাড়িতে যে ওনার যে বোনঝি থাকে… ”

“আমিই ওনার বোনঝি, ” নিশি রাগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,” সাজু ব্যাপারি মানে শাহজাহান সাহেব আমার খালু, আর দরিয়া নুর বেগম হলেন আমার খালা”

সামদানী সাহেব বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বিড়বিড় করে বললেন ” আন বিলিভেবল ”

” কেন আমার কি চারটা হাত ছয়টা পা?” নিশির কথায় সোহরাব প্রতুত্তরে করতে পারলেন না, নিশি বলল আমার পেছনে আসেন। সকাল থেকে আপনার অপেক্ষা হচ্ছে ”

” আমার জন্য? আর ইউ শিউর?”

“ইয়েস, আই গেজ ”

” দ্যাটস অলসো আনবিলিভেবল”
‘সোহরাব সাহেব পেছনে আসতে আসতে বিড়বিড় করে দ্বিরুক্তি করলেন।

******

” ওমা তোমার হাত তো ছিলে গিয়েসে, কোত্থে পইড়ে গিয়েসিলে না গাছে চইড়েসিলে? ”

চাপকলে বালতি ভরতে আসা মহিলার প্রশ্নে নদী জবাব দিলো না।একহাতে কল চেপে দ্রুত মুখে পানি দিচ্ছে। সে রণ-ক্লান্ত বিধ্বস্ত। বাম পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ ভেঙেছে, হাতের কুনুই চড়ে গেছে জামা কাপড় ভালোই আছে, পায়জামা হাটুর কাছে ছিড়েছে৷

” এইয়েসো কোত্থে? ”

” জাহান্নাম! “নদী উত্তরটা দিতে দিতে হঠাৎ চমকে পিছন ফিরলো। পেছনে দ্রুত পায়ের হেঁটের আসার শব্দ। ঘুরে দেখলো মেজখালুর বন্ধু আবুল কাকা দলবল নিয়ে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে কোথাও। নদীর খেয়াল হলো সে এলাকায় চলে এসেছে। ঘন বাঁশঝাড়ের পেছনে বড় পুকুরটার ওইপাড়েই, রানু খালার বাড়ি।চলন্ত ভ্যানগাড়ি থেকে ঝাপ দিয়ে আন্দাজে নেমে গিয়েছিল,তারমানে পথ ঠিক ছিলো। কখনো ভাবেনি এই বাড়িটা দেখে আনন্দে কান্না পাবে। নদী হাতে চিমটি কেটে দেখলো। পেছনে কারো পায়ের শব্দ…
******
‘ তুই যাবি না মানে?”রানু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন। নিশি শরীর এলিয়ে দিয়েছে বিছানায়। রানুর উত্তর দেওয়ার তেমন আগ্রহ নেই। ” যাবি না কেন? ”

” বুইড়া খাসি! পঞ্চাশ ষাটের কাছে বয়স এই এন্টিকপিস পাত্রকে নিজেকে দেখানোর কোন শখ নাই”

” ইয়া আল্লাহ এমন বলতে আছে?ও চল্লিশ হবে।কোন বয়সই না। স্ট্যাবলিশ হতে হতে একটু হয়েই যায়। এত সুন্দর চেহারা এমন টকটকে রঙ ”

” আরে টকটকে রঙে তোমার তো লেলুপ দৃষ্টি লোভ লাগলে তুমিই বিয়ে বইসা যাও। ছয়মাসের পেটওয়ালা খালুর থেকে বেটার”

রানুর ইচ্ছা করলো ঘুরিয়ে চড় বসিয়ে দেন কিন্তু মাথা ঠান্ডা করলেন।পাত্রকে ঢুকিয়ে দিয়ে বলছে দেখা করতে যাবে না।।এদিকে শাহিনের বাবাটাও নেই যিনি সামাল দেবেন। তার আজ বন্দর থেকে কাঠ আসছে সেখানে গেছেন।ফিরতে লাগবে দুদিন । পাত্রের একারই আসার কথা বলেই রানু রাজি হয়েছিলেন খানাপিনার ঝাক্কি কম।তবে শানু বয়সটা সম্পর্কে ধারণা দেয়নি।মেয়ের রকম-সকম দেখে তার মা বুঝেই হয়তো ঠিক করেছে৷ বুড়ো বলেই বোধহয় জড়তাও নেই,

ভদ্রলোক এসেই নিজের পরিচয় দিলেন, “আপনি তো দরিয়া এ নুর , আমি আসলে আমার বোনঝির সাথে দেখা করতে চাচ্ছিলাম, ফোনও দিয়েছিলাম হায়দার সাহেবকে।একবার কথা হয়েছে তবে আজ তিনি তুলছেন না৷ ”

এতেই যা বোঝার তা বুঝে গেছেন রানু।। বিশাল ঝকঝকে নীল গাড়ি থেকে একঝুড়ি ফল নেমেছে, কয়েক কেজি মিষ্টি। সব ঠিক ঠাক করে এগোলে বোন শানুও খুশি থাকবে। তখন একটা ভারী অংক চেয়ে রাখা যায়। কিন্তু এই নটিটা ঘরে এসেই যন্ত্রণা করা শুরু করলো।
” বাপের বয়সী বুইড়া খাসী,কচি ডাব খোঁজে, শখ কত ! ”

রানু আর উপায়ন্তর না পেয়ে মোবাইল হাতে নিলেন, ওভারসিজ কলে কটাকা কেটে নেয় কে জানে। তবে শানু ফোন মনে হয় কোলে নিয়েই বসেছিলো।

” তারা এসে গেছে ?”

” এসেছে কিন্তু তোর মেইয়ে আরেক নখড়া শুরু কইরেছে দেখা করবেনা পাত্র নাকি বুড়ো”

” কী বলে! এক্কেবারে পারফেক্ট ছেলে।এত্ত স্ট্যাবলিশ ফ্যামিলি। ওর কান মলে দিলা না কেন? দাও ওকে ফোন দাও আমি বোঝাই। ”

রানু ফোন দিতেই চাইছিলেন নিশি চিৎকার করে বলল,” আম্মাকে বল আমি যাচ্ছি না বলেই পাত্র বহাল তবিয়তে আছে, আমি গেলে কিন্তু পেন্সিল হিল দিয়ে বুইড়া খাসির *** গালায় দিব,নাতিপুতি হবাএ বয়সে আসছে মেয়ে দেখতে আসছে, খাটাশের বাচ্চা ”

ওপাশ থেকে শানুর কন্ঠে অনুনয়, ” যেভাবে পারিস রাজি করা, তাদের পছন্দ না হলিও একটু ভদ্রতার খাতিরে যেন দেখা কইরে আসে।পরে আমি এক বাহানা মেরে আটকে ফেলবনে।ছেলে আমার নিউইয়র্কের পুরনো বান্ধবীর আত্মীয়। সম্মানের ব্যাপার ”

” তা আমি কী করব বইলে দেও, তোমার যে একখান মেইয়ে জন্ম দিয়েছাও,এক বছর ধইরে আমার হাড় চাবায়ে খাচ্ছে ”

“ওহ তোর কী ব্যাপার? ঝড়ো কাক হয়ে কোত্থেকে আসলি?” নিশির কন্ঠ শুনে ফোন থেকে রানুর মনোযোগ ঘুরে গেল। পেছনের বারান্দায় নদী কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে।

“কী রে মেকাপ শেষ? ” রানু রাগে গজগজ করতে করতে প্রশ্ন করলেন, ” আনুর সাথে মেকাপ মারাতি গিয়েসিলি না? আজ মেহমান যাক আগে তোর যদি খবর না করি”

নিশি ভ্রুকুটি করল ” তুই মেকাপের কাজে গেসিলি? তোকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ ধরে মারধর করসে মেকাপ পছন্দ হয় নাই,এমা তুই আমার কামিজ ক্যামনে ছিড়লি? ”

” সে গপ্প হবে নানে, ওই শংখুনি গোসল করতি যা।ডইলে গোসল কর। আসতে পথি মনে হয় গু পাড়ায়েসিস। গন্ধ থাকা যাচ্ছে না?এখনি যা ”

” তা ওরে গোসলের জন্য ঠেলসো ক্যান মাত্র বাইরে থেকে এলো” নিশির প্রশ্ন।

” এইসেছে এখন মেহেমান আপ্যায়ন করতি যাবে। ”

” মানে কী? আমার জায়গায় ও যাবে বুইড়ার কাছে? করতেসো কী ”

” তোমার মায়েরই ইজ্জত বাচাচ্ছি। এই নদী গোসলি যা! ফিরে এইসে শাড়ি এই পরবি ”

” ও লো বউ কী হইয়েসে। নদী কি এইয়েসে। বাথরুম যাতি হতো,কথা কসসো না ক্যান? ” পাশের ঘর থেকে রানুর শাশুড়ী নাহার বেগমের কন্ঠ ।

নিশি গা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে রানু নদীকে ঠেলছে বাথরুমে। নদী বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। কানে বাজছে কিছু শব্দ, ফ্রেশ মাল! আজই ডেলিভারি! পনেরোতে আনু ছাড়তেসে।

পনেরো মানে কী পনেরো হাজার? নদী নিজ কানে তার দর কষাকষি শুনে এসেছে। একটু দেরি হলে যা বাস্তবায়ন হতো। শুধু একটু দেরি হলেই। তীব্র ভয়ে শরীর শিউরে উঠছে। কাঁদতে ইচ্ছে হলেও কাঁদতে পারছে না। কান্নাটা কেন আসে না।।
” ডলে ডলে গোসল করবি, মেহমান অপেক্ষা করতিসে ”

(চলবে)

#শারমিন_আঞ্জুম