বাতাসে তার সৌরভ পর্ব-০৩

0
321

#বাতাসে_তার_সৌরভ–৩

“আব্বু আমার দৌড়াতে ভাল্লাগে না, পা ব্যথা করে”

” আরে বুড়ি, এতটুকু থেকে এতটুকু: এতেই দৌড়ে পা ব্যথা করে,আট বছরেই ”

” তুমিই তো আমারে বুড়ি ডাকো, আমার টায়ার্ড লাগে..”

” মা সবাই নাম দিয়েছে, তুই একটু দৌড়ঝাঁপ না করলে ওজন কমবে কীভাবে? ”

তখনই নদী বুঝেছিল বাবার তাকে দৌড়ের জন্য জোর দেওয়ার আসল উদ্দেশ্য কী।
দৌড়েছিলো নদী, অভিমান রাগ জেদ সব ভর করে জোরেই দৌড়েছিলো। এখন ছোটবেলার সেই নাদুসনুদুস শরীরটা আর নেই, তবে সাহসটা যেন জবাব দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু থামলে চলবে না। তীব্র ভয়ে থেকে থেকে শরীর শিউরে উঠছে৷

হোটেলের বাথরুমের একজাস্ট করা ফ্যানটা সম্ভবত নতুন লাগানো ছিলো।মাপমতো হয়নি, একটু ছোট , ধাক্কা দিতেই আলগা হয়ে গেলো। সেই চাপা ভেন্টিলেটর দিয়ে নদী নিজের শরীর কিভাবে গলিয়ে এসেছে সেটা এখন ভাবতে চায় না৷ গায়ে ল্যাপ্টে গিয়েছিল শত সহস্র মাকড়সার জাল। তবে সেগুলো নিয়ে মেতে থাকলেও হতো না। দোতালার বাথরুমের সানশেড থেকে ঝাপ দিয়ে নেমেছিল সেখানে হোটেলের সেপ্টিট্যাংক নেমে গেছে। কোন এক অংশ ফেটে গিয়েছি, তার থেকে চুয়ে পড়ছিল হলদে বর্জ্য। তবে সেই মুহূর্তে এত ভাবনার সুযোগ ছিলো না। সরু স্যাতস্যাতে দুর্গন্ধের দম আটকে এলেও নদী দেয়াল টপকে নেমেছে৷ সেটা আরেক বিল্ডিংয়ের পেছনের চাপা গলি। তার ভাঙা দেয়াল দিয়ে বেরিয়ে কতক্ষণ ছুটেছে জানে না। পেছন ফিরে তাকানোর সময় ছিলো না।

এর মধ্যে জুতোর একটা স্ট্রিপ ছুটে গেল বড়োবাজারের কাছে। লাল রঙের মখমলের চটি দেড়শো টাকায় কিনেছিল। নদীর এই একটাই চটি!

” তোমার পায়ে কী হয়েছে”

“হ্যাঁ? ”

ড্রইংরুমে বসা ভদ্রলোকের প্রশ্নে নদী নড়েচড়ে উঠলো। তার নজরও নদীর পায়ের দিকে।

” ব্যান্ডেজ করা কেন,কী হয়েছে? ”

” ওহ, গ্লাসের টুকরো ফুটেছিলো ”

” আচ্ছা”

নদীর সামনে একজন টকটকে ফর্সা পুরুষ বসে আছেন, অনেক লম্বা; ছয়ফিট হবেনই। গালভরা চাপদাড়ির ভদ্রলোক বেশ সুপুরুষই। কার সাথে যেন চেহারায় অনেক মিল। হ্যাঁ, অনেকটা ওই টিভির সুলতান সুলেয়মানের মতো দেখতে, তবে এই লোকের মাথায় কিছু চুল আছে কানের দুই পাশে একটু পাকা। তুর্কি টিভির সুলতান সাহেব টেকো।

ভালোই তো লাগে,এই লোককে নিশির পছন্দ হয়নি কেন কে জানে। কিন্তু এখন এর সামনে নদী এসে কী করবে তাও বুঝতে পারছে না। রানু খালা জোর করে একটা তাঁতের শাড়ি পরিয়ে চায়ের কাপের ট্রে ধরিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। নদীকে বিয়ে দেয়ার তাল করছেন নাকি? সত্যি!রানু খালার এত সুমতি কি হবে ! এই প্রায় সুলতান সুলেয়মানের বউ হলে মন্দ হয় না। অন্তত এই বাড়ির কারাগার থেকে কুৎসিত পৃথিবী থেকে মুক্তি মেলে।

” তুমি কোথাও গিয়েছিলে? না মানে এখন তো বাচ্চারা ঘরে শাড়ি পরে না”

নদী চমকে উঠলো, এই লোক বাচ্চা কাকে বলছে? “কেন আপনার পছন্দ না” নদী আহ্লাদী গলায় কথাটা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। আচ্ছা সে কী করছে? নিশির জন্য আসা একটা মধ্যবয়স্ক পাত্রকে নিজের দিকে টানার চেষ্টা করছে, হ্যাংলার মতো।সে কি এতটাই নির্লজ্জ?

আসলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে সে হ্যাংলাই হয়ে গেছে৷ হ্যাংলা ও ভাবলেশহীন। তার অভিব্যক্তি দেখে তার সাথে কি হয়েছে কিছু বোঝার উপায় নেই। আজপাশের বাড়ির ভাড়াটিয়া আনু তাকে বিক্রি করে দিচ্ছিল সুপার মডেলরূপী লেডিস স্মাগলারের কাছে। লেডিস স্মাগলারই তো বলে এদেরকে নাকি? আচ্ছা এরা কী করতো তাকে নিয়ে?নেশা মেশানো ওষুধ খাইয়ে বেহুশ করতো … তারপর? নদীর ভাবনা চিন্তা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। নি:শ্বাস আটকে যাচ্ছে।

” নাসিরের সাথে শেষ বার যখন দেখা হলো, তুমি তখন তিনচার বছরের?” নদী মাথা তুলে তাকিয়ে আছে সোহরাব সামদানী আরও বললেন ” আমেরিকা থেকে ওটাই শেষ আসা, এরপর লম্বা সময় আর দেশে ফেরা হয়নি ”

” নাসির মানে..?”

” মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন সাজ্জাদ তোমার আব্বু”

“আপনি আব্বুকে চিনতেন? ”

“হ্যাঁ অবশ্যই! ভালো বন্ধু ছিলাম, একই ফ্যাকাল্টির না অবশ্য; তবে অনেক সময় একসাথে কাটিয়েছি।”

নদী কী বলবে বুঝতে পারছে না। এই লোকটা তার আব্বুর বন্ধু! এও মেনে নিতে হবে? ভদ্রলোক তার মোবাইলের গ্যালারি থেকে ছাত্রজীবনে কিছু ছবি বের করলেন। ক্যামেরাই প্রিন্ট করা ছবি ভদ্রলোক মোবাইলে রেখেছেন।

” দেখ, মধুর ক্যান্টিনে আমরা ।সবচেয়ে লম্বা মতো বামের ছেলেটাকে চিনতে পারো? ”

নদী চিনতে পারলো।তার বাবার সরল হাসিটা তার যুবক অবস্থাতেও একই রকম ছিল।

” ঢাকায় আমার নিজের আত্মিয়ো কেউ ছিল না, তখন তোমার বাবা অনেক হেল্প করেছে আমার। তার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা ছিল ।আমেরিকা যাবার পর জীবনযুদ্ধে যোগাযোগটা ছুটে গেল। আসলে জীবনের এক পর্যায়ে আমরা সবাই স্বার্থপর হয়ে যাই ”

নদী চুপ করে রইলো। বাইরে থেকে তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি দেখা যাচ্ছে না। তবে সত্যি বলতে তার মাথা আর চিন্তার ওজন আর নিতে পারছে না। মাথার মাঝে জটিলতর অংকের হিসেব। মানে এই লোক যে নিশিকে দেখতে এসেছে, যাকে বড়খালা শানু ঠিক করেছেন, সে তার বাবাকে চেনে কীভাবে?

” তবে আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি যে এত ভয়াবহ কিছু ঘটে যাবে, হ্যাংলা-পাতলা নাসির এভাবে এত অল্পবয়সে স্ট্রোক করবে, আর তার ছয় মাসের মাথায় স্ত্রী ছেলেটাও… আসলে এভরি থিং ইজ ডেসটাইন”

সামদানী সাহেব বলতে বলতে থেমে গেলেন। সামনে বসা কিশোরী মেয়েটার চোখের তারায় বিষাদের গাঢ়ছায়া। অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া নতুন জীবনের হারানোর কষ্টটা হয়ত সে ভুলেই থাকে । তিনি আসলে নিজের অজান্তেই খুব ফালতু বাঙালিদের আচরণ করছেন। একাকী এতিম মেয়েকে জীবনের কঠিন একটা স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দেওয়া কখনো শুভ ভব্যতা না। তবে তিনি বুঝতেও পারছেন না কথা কীভাবে আগাবেন। কীভাবে কথা বললে মেয়েটা সহজ হবে।

“আচ্ছা তুমি পড়াশোনার করছ তো ”

” এইচ এস সির রেজাল্ট হয়নি ,সামনের মাসে ইনশাআল্লাহ ”

” ওহ ওয়ান্ডার ইয়ারস। সাইন্সের? ম্যাট্রিকে কি ছিল?”

” ম্যাট্রিক?”নদী শুরুতে বুঝল না,” ওহ এস এস সি?এ গ্রেড ছিলো তবে গোল্ডেন না ”

” তুমি বাবার মতোই ব্রিলিয়ান্ট তো! ইউনিভার্সিটিতে কি নিয়ে পড়বে ঠিক করেছ? ”

ইউনিভার্সিটি! নদী ঠিক কি জবাব দেবে জানে না। এইচ এস সির পর উচ্চশিক্ষার জন্য ইউভার্সিটি নিয়ে সবাই ভাববে এটাই স্বাভাবিক। তবে তার পরিস্থিতি আলাদা। এত ভয়ংকর পরিবেশে তার এই পর্যন্ত আসাই অবিশ্বাস্য। মনে আছে এস এস সির পর রানুখালা বেকে বসলো। আর খালুও কেমন গাইগুই করতে লাগলেন। কিন্তু তখন একটা দৈবিক চমৎকার হলো। বড় মামার আগমন হলো আশ্চর্যজনক ভাবে, তার হুশিয়ারীতেই কলেজে পড়া সম্ভব হয়েছে। শেষ মুহূর্তে এসে এডমিট করিয়ে দিলেন। বড় মামির একটা অকাট্য যুক্তি ছিল , “আপদ বিদায় করতে গেলেও কিছু ধৈর্য্য ধরতে হবে। মেট্রিকপাস বউ আজকাল কেউ ঘরে তোলে না, রেগুলার নাহয় পড়লো না ইন্টার পড়াতে পড়াতে একটা ভালোমন্দ দেখে দিলেই হবে। ”

নদী নিয়মিত ক্লাসে যেতে পারেনি রানুখালার ছেলে শাহীনের বইগুলো ছিলো বলে রক্ষা। কিন্তু কলেজ যাবার ভালো জামা ছিল না; লম্বাপথ, রিক্সাভাড়া খালা দিতে চাইতো না। দুই মাইল হেঁটে আসতে আসতে খিদে লাগতো প্রচন্ড। পড়া এভাবেই বন্ধ হয়ে যেত। পাশের বাড়ির ডাক্তার দিলারা আপা কাজের ফাঁকে যদি না সাহায্য করতেন, সাইন্সের সাবজেক্টগুলো উদ্ধার হতো না। এখন নদী সাহস করে বলতে পারে অন্তত বি গ্রেডে পাশ জুটবে। আঠেরো বছরে এত এত অবিশ্বাস্য ঘটনা নিয়ে এগোনোর কারণেই সম্ভবত তার কোন বিষয়ে বিস্মিত হবার ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে।

” তোমার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের কালি নারায়ণ স্কলার ছিলেন আর তোমার দাদাজান তো ইকোনমিকসের প্রফেসর ছিলেন ”

” দাদুকেও চেনেন? ”

” আমার টিচার ছিলেন, কেন চিনবো না?”

” আপনি কে বলুন তো?

” তোমার খালামনি বলেননি? আমার নাম সোহরাব সামদানী ”

“আপনি নিশিকে দেখতে আসেন নাই? ”

” তুমি মেহেরোজ সাজ্জাদ হলে আমি তোমাকে দেখতে এসেছি ”

“কেন? “নদী বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে।

সামদানী একটু যেন হোঁচট খেলেন, আসলেই তো কেন?আসল কারণটা তো ততটা স্বস্তিদায়ক নয়। দ্রুত নিজেকে সামলে বললেন, ” না মানে খোঁজ নিতে। বিশেষ করে তোমার বাবা আর দাদুর প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা ছিলো আমার । ইকবাল হলে সিট পাবার আগে তোমাদের ওই ধানমন্ডির বাড়ির চিলেকোঠাতে আমি থাকতাম। তোমাদের বাড়িতে দেশিফুলের অনেকগুলো গাছ ছিলো।আমগাছ ছিলো অনেক গুলো, একটা বিরাট গাছ ছিলো কাঠগোলাপের।পেছনের গোটা উঠানটা ছায়া দিয়ে রাখত।
নদী স্থির তাকিয়ে আছে ভদ্রলোকের দিকে, সোহরাব সামদানী একটু কেশে আরো বললেন,
” তোমাদের বাড়ির ঘটনাটা যখন হয়েছে আমি এরিজোনায় ।টেলিফোনে বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছিলাম, মন খারাপ হয়েছিল।কয়েকবছর ধরে একটা ব্যাবসা সেটেল করতে যাচ্ছি, সেই কাজে মংলাপোর্টে এসেছিলাম, ভাবলাম দেখা করার একটু ট্রাই করে দেখি। ”

“তার মানে আপনি সেইভাবে দেখতে আসেন নাই? ”

” বুঝলাম না ”

” বাদ দেন ” নদী আর প্রসঙ্গ টানলো না।

” এখানে আসার আগে যতটা মন খারাপ হবে ভেবেছিলাম তোমাকে দেখে আরো বেশি মন খারাপ লাগছে। আই জাস্ট কান্ট বিলিভ, নাসেরের মেয়ে, ফিরোজ স্যারের নাতি তুমি৷ ”

নদী শক্ত মুখে নড়েচড়ে বসছে। এমন সহমর্মিতার কন্ঠ শুনলে তার ভালো লাগে না। উঠে চলে যেতে ইচ্ছে করে। এমনিতেও দীর্ঘক্ষণ দৌড়ে তার পা টনটন করছে। এই লোক তাকে তার স্যারের নাতি হিসেবে দেখতে এসেছে? কী দেখতে এসেছে সে মরে গেছে না বেঁচে আছে?আজাইরা দরদ! এখন শুরু হবে নীতিকথা। সেটা আরো অসহ্য।

সামদানী সাহেব বললেন, ” যাহোক, তুমি যে ভালো আছ এটাই বড় কথা কিন্তু ভালো থাকলে চলবে না। তোমাকে শক্তভাবে সার্ভাইভ করতে হবে।মেরিট তোমার জিনে আছে।ভালো কিছু অবশ্যই হবে। দেখা হবে ইনশাল্লাহ, ইউনিভার্সিটি এডমিশনের জন্য ঢাকা তো আসবেই। ।”

“জানি না ” কথাটা নদীর মুখে চলে এলো কিন্তু বলল না।

” ঢাকা এসেই একটা কল দেবে। ধর আমার কার্ড, ফোন নাম্বার লেখা আছে, কার্ডটা ভালো মতো পড়ো কেমন? এনিওয়ে তুমি তোমার নাম্বার দাও ”

” আমার ফোন.. “কথাটা বলতে বলতে নদীর মনে পড়ে গেল তার বাটন ফোন ওই হোটেল রুমে রেখে এসেছে। সাথে দামী মেকাপ কিটসগুলো।সব গেল। চোখ ফেটে কান্না আসছে।
” আমার ফোন নাই ” নদী ঠোঁট চেপে বলল।

সামদানী সাবধানে নিজের বিস্ময় লুকালেন । এই দুইহাজার আঠেরোতে কোন অষ্টাদশীর মোবাইল নেই এটা ভাবাও অবিশ্বাস্য৷

” ওকে আমার কার্ডটা রাখ আর এটা দিয়ে আইসক্রিম খাবে”

নদী তাকিয়ে আছে কার্ডের সাথে একটা খাম।

‘ ধর, কিচ্ছু না! বড়রা সালামি দেয় এভাবে, রাখ লক্ষ্মী মেয়ে; ঢাকায় এলে অবশ্যই দেখা করতে আসবে। কার্ডটা পড়লে ঠিকানা চিনেই নেবে। তোমার সাথে কথা আছে। অনেক গল্প করব ইনশাআল্লাহ ”

ভদ্রলোক তেমন কিছু মুখে দিলেন না , খুব স্বাভাবিকভাবে নদীর মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। খালামনি এর মাঝে অনেকবার বসতে বললেন। হায়দার খালু রাস্তায় আছেন বলেও জানালেন। কিন্তু সামদানী সাহেবের তাড়া ছিল, তিনি পরে কথা বলে নেবেন বলে গাড়িতে উঠলেন।

কার্ড আর খামটা হাতে নিয়ে নদী কি বলবে বুঝতে পারছে না। নিশি ড্রইংরুমে একবার ফুচকি দিয়ে দেখে আবার ভেতর ঢুকে গেল৷ সম্ভবত স্রষ্টা ঠিক করেছেন যাবতীয় অদ্ভুত ঘটনা সব আজকের দিনেই তিনি ঘটাবেন।

*******
গাড়ির জানালার ফ্রেমে চলমান গ্রামীণ বাংলাদেশ। বিস্তৃত চৌকো ছককাটা ধান সরিষার ক্ষেত; সবুজ হলুদের অদ্ভুত কন্ট্রাস্ট। মাঝখানে মাঝখানে খেজুর গাছের বাগান। প্রচুর খেজুর গাছ বলেই কি জায়গাটার নাম খাজুরা? সামদানী সাহেবের যখন সামর্থ্য ছিলো না, তখন পয়সা হলে এমন একটা অজপাড়াগাঁয়ে টিনেরবাড়ি করে থাকার পরিকল্পনা ছিলো।এখন যথেষ্ট ক্ষমতা আছে কিন্তু ইচ্ছাটা মরে গেছে৷ টাকার ক্ষমতা মানুষের ছোট ছোট স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা কেড়ে নেয়। তবে তৃষ্ণাটা বাড়িয়ে দেয়৷ সোহরাব সামদানী সাহেব মন ঘোরানোর জন্য নানা কথা ভাবতে চাইছেন কিন্তু মনের ভারাক্রান্ত ভাবটা কাটছে না।

ম্যাসেঞ্জারে গ্রুপ কল আসছে। আগেও কয়েকটি এসেছিল, কিন্তু নেটওয়ার্ক না থাকায় মিসকল উঠে আছে। দেখা যাচ্ছে দুটো বাচ্চাই লাইনে।ছেলেদের দেখে সোহরাব সাহেবের মন ভালো হয়ে গেল।

– থ্যাংক গড! তুমি ফাইনালি তুললে। আমি তো ভেবেছিলাম…
রম্য উত্তেজিত হয়ে আছে৷

– নেটওয়ার্ক ছিলো না। সামদানী সাহেব আশ্বস্ত করলেন।

– “ওহ! “অর্ণব মাথা ঝাকিয়ে বলল,” এই ডাস্টল্যান্ডে এর থেকে আশাই বা কি করা যায়। ”

-” অনু ল্যাঙ্গুয়েজ প্লিজ!” সামদানী মৃদু ভৎসনা করলেন। দেশ নিয়ে কটুবাক্য শুনতে তার ভালো লাগে না।

– সরি, বাট যা বলেছি সেটা পয়েন্ট! অর্ণব দ্রুত শুধরে নিলো।

– সব জায়গার নেটওয়ার্ক খারাপ না অনু এখন তো কথা বলতে পারছি। রম্য মাথা নেড়ে বলল।

– তুই তো কথাই বলিস না , এই উদ্ভট জায়গা গত ছয়মাসে ব্ল্যাক ম্যাজিক করেছে তোকে।

রম্য হেসে বলল,- ব্ল্যাক ম্যাজিক করার মতোই অবস্থা! আজকে ওল্ড ঢাকার একজন আশি বছরের শেফের আস্ত ছাগলের রোস্ট করা দেখলাম। ছাগলের ভেতর চারটা আস্ত মুরগীর রোস্ট আই মিন ওয়াট আ প্রসেস! তুই দেখলে পাগল হয়ে যাবি অনি।”

অর্ণব তার ভাইয়ের কথা তেমন গুরুত্ব দিলো না। বাবার দিকে ঘুরে তাকালো,- তুমি পেয়েছ যাকে খুঁজছিলে?

– এখনো বুঝতে পারছি না। সামদানী ক্ষীণ স্বরে বললেন।

– মানে বুঝলাম না, পাও নাই?

– পেয়েছি, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না তাকে দিয়ে হবে কিনা। একেবারেই ছেলেমানুষ। সতেরো, বড় জোর আঠেরো বছরের একটা মেয়ে।

রম্য একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল -ড্যাড তোমার মনে হয় না সে অনেক ছোট, মানে তোমাকে পিডো না বলে সবাই।

সামদানী সাহেব ভ্রুকুটি করে তাকালেন – এক্সকিউজ মি? আমাকে কেউ পিডো কেন বলবে, একটু এক্সপ্লেইন কর?

– কাম অন ড্যাড , আমরা জানি তোমার আজ একটা ইম্পর্ট্যান্ট এপয়েন্টমেন্ট ছিলো, যার সাথে তুমি অনেকদিন ধরে দেখা করতে চাইছিলে…

রম্য বলতে বলতে থেমে গেলো। অন্য স্ক্রিনে স্যান ফ্রান্সিসকো থেকে অর্ণব মিটিমিটি হাসছে। রম্য বলল,মমের সাথে ডিভোর্সের পরে তুমি এগিয়ে যেতে চাচ্ছ এটা খুব ভালো কথা । আমরা তোমার জন্য খুশি, কিন্তু একটু ভেবে দেখ,একটা টিনএজ মেয়ে তোমার জন্য কি সঠিক?

সামদানী নিজের উত্তেজনা সামলে আড় চোখে তাকালেন প্রাডোর ড্রাইভারের দিকে। তিনজনের গ্রুপ কলের কথোপকথন আমেরিকান ইংলিশ হওয়ায় আশা করা যায়, যে সে তেমন কিছু বুঝতে পারেনি। নয়তো বিব্রতকর অবস্থা হতো।

– রম্য! আমি বুঝতে পারছি না তুমি কী বিষয়ে কথা বলছ। আমি এগিয়ে যেতে চেয়েছি, কেন এগিয়ে যেতে চাইবো?

” তুমি বিয়ে কর‍তে চাইছ! সিম্পল। এটা ঠিক আছে কিন্তু মানে একেবারে ছোট সতেরো বছরের একটা মেয়ে, আমরা নিজেরাই ছাব্বিশ…

” বিয়ে! আমি এই কথা কখন বললাম!”

সামদানী খেয়াল করলেন রম্য কাচুমাচু করে কথা বললেও অর্ণব হেসে খুন হয়ে যাচ্ছে।

” অনি তুমিই এই গোবর ওর মাথায় ঢুকিয়েছ তাই না? ”

” আমার কষ্ট করা লাগেনি রম্যর মাথায় ওটা আগেই ঢুকে বসে আছে। আমিতো শুধু বলেছিলাম ডেড একটা মেয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে , বাকি তার ইমাজিনেশন; ওয়াট ক্যান আই ডু? ”

রম্য মাথা নাড়ছে ” খুব বেশি যদি ভালো লেগে থাকে আমার কিছু বলার নাই তোমার খুশিই সবচেয়ে বড় ”

অর্ণব আরেক পশলা হাসি শেষে বলল ” আমরা খুশি থাকব তুই যখন একটু কম ভাবনা চিন্তা করবি রমি ”

অর্নবের কথায় রম্য একটু বিভ্রান্ত।অর্ণব সেটা পাত্তা না দিয়ে বাবার দিকে ঘুরে গেল। ” মেয়েটা ছোট হলে তো ভালোই। আমরা ইজিলি প্রসিড কর‍তে পারব”

সামদানী মাথা নাড়লেন ” এটা এত সহজ না ছেলে। আঠেরো বছর হলে তার একটা মতামত আছে। ”

” আমার মনে হয় না তুমি যতটা কঠিন ভাবছ এটা ততটা কঠিন। কারণ তোমার কাছে টাকা আছে। এই দেশে ধনবান মানুষ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। দিনের বেলা সূর্যের পাশে চাঁদ বসিয়ে দিতে পারে। ”

” সূর্যের পাশের চাঁদ বসিয়ে দেওয়া মানুষগুলো নিজেদের ঈশ্বর ভাবতে পারে ,আমি নই। তুমি জানো আমি নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনো কাজ করিনা ”

” তুমি যেটা করতে চাইছ এই প্রসেস ছাড়া আর অপশনও নেই ড্যাড৷”

সোহরাব সামদানী উত্তর দিলেন না। স্ক্রিনে জমজ পুত্র তার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। সামদানী সাহেবের চোখে একটা ফুটফুটে বাচ্চামেয়ের মুখ। ঘন পল্লবের টানা টানা চোখে অদ্ভুত বিষণ্নতা বা ভাবলেশহীনতা যা এই বয়সী মেয়েদের দৃষ্টিতে দেখা যায় না। স্বার্থপর পৃথিবীর রূঢ় শেকলে আটকে আছে একটা অসহায় প্রাণ। তার অল্প কিছু সহমর্মিতার বাণী এই শেকল কি ভাঙতে পারবে?

#শারমিন_আঞ্জুম
(চলবে )