বাতাসে তার সৌরভ পর্ব-০৪

0
253

#বাতাসে_তার_সৌরভ–৪

নদী ঘরে ফেরার পর স্বাভাবিক ভাবেই রানুখালার জেরার মুখে পড়তে হয়েছে।

“আর কী বললরে ওই লোক ? ভুলভাল কিছু বলে নাই তো ”

নিশি চুলে হেয়ার ড্রায়ার চালাতে চালাতে বিরক্ত হয়ে বলল,” লোকই তো ভুল ছিল , ছোট খালুর বন্ধু ছিলো, নদীর সাথে দেখা করতে আসছিল ; তুমিই উল্টাপাল্টা ভেবে বসে আছ।

রানু বিষয়টি বুঝেছে তবুও দুইদিন ধরে আশ্বস্ত হতে পারছে না। সাহেব গোত্রের লোক। এমন জাঁদরেল ব্যক্তিত্ব দেখে সন্দেহ হচ্ছিলো কিন্তু এত জেরা করার সাহস হয়নি। স্বামী হায়দার সাহেবকে জিজ্ঞেস করার পর বললেন সোহরাব সামদানী নামে আসলেই একজন দেখা করতে চেয়েছিলেন।নদীর বাবার বন্ধু, তবে তার নাকি সামনের সপ্তাহে আসার কথা।

– আসছে কী কাজে? রানুখালার জেরার নিশানা স্বামীর দিকে ঘুরে গেল।

-বাপের দিকের পরিচিত দেখতে আসতে পারে না?

-শুধু দেখতে এতদূর আসবে? মনে তো হচ্ছে না।

– বিয়ে করতেও আসে নাই, নিশ্চিন্তে থাকো।

– নিশ্চিন্তে থাকা কিসের, এই শয়তানরে বিয়ে করবি কিডা, বাকে বাপ-মা নেই এই শুনেই তো সবার মুখ ঝুইলে যায়।

হায়দার সাহেব হাসলেন,কলেজ পড়তে পড়তে বাড়ন্ত গড়নের নদীর একটা দুটো বিয়ের ঘর এসেছিল। কিন্তু বাবা মা ছাড়া আশ্রিত এতিম মেয়ে শুনে সবাই পিছিয়ে যায়। মোটামুটি চলনসই তো নয়ই নিম্নমধ্যবিত্ত গোছের পরিবারপ হিসেব করে। একটা বিপত্নীক ত্রিশোর্ধ্ব পাত্র ঠিক হয়েছিল। কিন্তু পাকা কথা হবার আগ মুহূর্তে ছেলের মায়ের হঠাৎ শরীর খারাপ করলো। সরাসরি না হলেও উড়ো কথায় আসল ঘটনা ভেসে আসে।

” আসলে আমরা কিছু চাইনে কিন্তু কী, জামাই শ্বশুরবাড়ি গেলে একটু ভালো আপ্যায়ন যদি না হয়।তাহলি বিচারার মন খারাপ করবে না? শ্বশুর-শাশুড়ী থাকলি যিরাম আদর-যত্তর করতো সেটা কি আর পাবে? ছেইলে মানুষির একটু খায়েশ আছে না? ”
যেন ছেলে মানুষরা শ্বশুরবাড়ির ভালো মন্দ গেলার জন্যেই সারাবছর উপোস দিয়ে ঘোরে।বিয়ে আর আগালো না, ছোটবোনের চিহ্নটা বোঝা হয়ে রইলো রানুর ঘাড়ে।। যদিও সত্যি কথা হলো নদী হুট করে বিয়ে হয়েগেলে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বে রানুই । অসুস্থ বিছানায় পড়া শাশুড়ীর খাওয়া, শৌচকর্মের জন্য বাড়িতে কোন ছুটাবুয়া থাকতে চায় না। এই অষ্টাদশী মেয়েটাই ভরসা। হায়দার সাহেবের মাঝেমধ্যে চিন্তা হয় বাচ্চা মেয়েটা এতকিছু পারে কী করে ; করিডর দিয়ে যাবার পথে কখনো কখনো হায়দারের নিজেরই অর্থব বৃদ্ধা মায়ের জৈব দুর্গন্ধে পেটের নাড়ি উলটে আসে।নদী মুখে ওড়না বেঁধে নির্বিকার হয়ে করে যাচ্ছে।অথচ কতবড় বাড়ির মেয়ে!

রানু ঘরের কাজের মাঝেও জেরা অব্যাহত রাখল।

– মিষ্টিকথায় ভুইলে আবার টেলিফোন নাম্বার দিয়ে দিসনি তো?

ফোন যে এখনো উদ্ধার হয়নি রানুখালাকে এই কথা বলার বিশেষ সাহস হচ্ছে না। নদী মুখ গোঁজ করে জাও ভাতের হাড়িতে খুন্তি নাড়াচ্ছে।রানুখালার শাশুড়ীর মাড়ির কয়েকটি দাঁতপড়া, চাবাতে পারেন না। এই নরম ভাত বসানো লাগে। মূলত সেটাও বসানো হয় গতকালের বাসি ভাত দিয়ে। একটা দানাও নষ্ট করতে চান না রানুখালা। নদী মাঝে মধ্যে ডাল কষিয়ে সবজি দিয়ে পুরান ভাত মিশিয়ে খিচুড়ির কতো করে দেয়।। কিন্তু বুড়ির হজমশক্তি আর আগের নেই। কয়েকদিন ধরে পেট খারাপ যাচ্ছে।খালাকে বলে লাভ নেই। কিন্তু পেট খারাপ হলে মাঝরাতে সেগুলো পরিষ্কারের দায় নদীর। তাই আজকাল বাঁসীভাতটা ভুলুকে অল্পডালে চটকে মাখিয়ে দেয়। ভবঘুরে নেড়িটা নদীর খুব বাঁধক, গেটের সামনে ঘুমায় কিছু দিলে চেটেপুটে খায়। বুড়ির নতুন চালের জাওটা এখন খেয়াল না করলেই হলো।

-আমি কিন্তু তোর ফোনে চেক করব। হাবিজাবি কোন ঝামেলা দেখলে এক্কেবারে,

– এক্কেবারে!হাবিজাবি হলেই নদুকে আমার সাথে ঢাকায় নিয়ে যাবো।

নিশি কথায় রানুর মুখ বিগড়ে গেল। এই বদমাশ মেয়েটাই যত নষ্টের গোড়া। আসার দুইদিন আগে পাত্রকে ফোন দিয়ে উল্টপাল্টা কথা বলে বিয়েটা ক্যানসেল করেছিল। ওই দিন সামদানী ভদ্রলোকের সামনেও ইচ্ছেকরে নাটক করলো। আজ সকাল থেকে বচন শুরু করেছে ঢাকা যাবে। কি না কি চাকরি হয়েছে। ভার্সিটি পাশ করলো না, কিছু না ; হুট করে চাকরি ঠিক হয়ে গেল?আগা গোড়া মিথ্যার উপর বসে থাকে বদমাশ মেয়েটা।
রানু শুরুর দিকে গুরুত্ব দিলো না।নিশি
বাবার সাথে কথা বলে তার অনুমতি ম্যানেজ করেছে। কিন্তু মা মোটেও রাজি না।
শানু বোনকে ফোন দিয়ে বলেছে, মেয়েকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে।শুনে রানুর পিত্তিজ্বলে গেছে। বাদর মেয়ে পয়দা করার সময় হুঁশ ছিলো না, সামলাতে না পেরে দূরে বসে ছড়ি ঘোরানো। এই মেয়ে চৌদ্দবছর বয়সে আমেরিকায় কোন কান্ড ঘটিয়েছিলো। শানু মেয়েকে দেশে রেখে গেল।প্রথম দুই বছর ছিলো ঢাকায় চাচার বাসায়। শানু মেয়েকে শোধরাতে দেশে পাঠিয়েছিল, বাবা-মার ছায়া থেকে ছুটে মেয়এ আরও বিগড়ে গেল।

ভাস্তির রকম-সকম দেখে চাচা একটু কড়াকড়ি করেছিলেন ওমনি নাকের চোখেরপানি এক করে বাবা-মাকে বলল। সাথে সাথে পাঠানো হলো আরেক ফুপুর কাছে। সেখান থেকে ঠেলা খেয়ে সোজা এই সাতক্ষীরা। নিশির ব্যাপারে মামারা আগেই হাত তুলে নিয়েছে। উঠতি বয়সী মেয়ে দেশে রেখে শানু টাকার পেছনে ছুটছে।
অর্থনৈতিক ভাবে যেকোনো প্রজেকটে লাভ আর ক্ষতি দুটাই নিয়ে আসে।
নিশিকে বাসায় রেখে লাভ হলো একাউন্টে ভারী একটা খরচ আমেরিকা থেকে পাওয়া ,খারাপ হলো নিশির উড়নচণ্ডী স্বভাবের জন্য আতঙ্কে চুল পড়ে যাওয়া ।

শানু সবাইকে শাসনের ভার দিয়ে বলেন প্রয়োজনে মেয়েকে শাস্তি দিতে ;
কিন্তু সত্যি হলো মেয়ের সামনে একটা হাঁচিও দেওয়া যায় না, মায়ের কাছে খবর চলে যায়। তারপর বসে আবার বিচার সালিশ। এই আপদটা বিদায় করলে রানুও বাঁচে। কিন্তু ঝামেলা আছে আপদ বিদায় হলে ডলার আসাটাও বন্ধ হয়ে যাবে।

– আমার গাড়ি কালকে বুঝলা খালা, তুমি বললে নদীকেও নিয়ে যাই।

– নদীর কথা বাদ, তোমার যাবার ব্যাপারে তোমার মা বইলে দিয়েসে। এখন আর ডায়লগবাজি চলবে নানে।

– আমি ডায়লগবাজি করিনা যা করার, করে ফেলি। তাছাড়া নদীর এডমিশন টাইম চলে আসছে।ঢাকায় গিয়ে ওর ফর্ম তুলতে হবে…

-দেখ নিশি, তুই নিজে গাঁজার মধ্যি পইড়ে থাকিস তোর মায়ের মেলা টাকা আছে সামাল দিতি পারবে। নদীর বাপ-মা কেউ নেই।এই এতিম মেইয়েটারি নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলি…

– তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমিও মাকে বলে দেব যে তাদের ডিভোর্সের ব্যাপারে সত্যিটা তুমি আমাকে বলস,

নিশির কথায় রানু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন। নদীও অবাক হয়ে দেখছে।তার বড় খালার ডিভোর্সের ব্যাপারে কিছুই জানে না। নিশির মুখটা হিংস্র হয়ে আছে,

– আমার মায়ের সমস্যা আমাকে হাবাগোবা ভাবা ,আর তোমার সমস্যা হলো দুনিয়ার সবাইকে হাবাগোবা ভাবা। কেউ কিচ্ছু বুঝে না। তারা পরকীয়া করে অশান্তি করে সামাল দিতে পারেনা, এজন্য আমাকে দেশে পাঠায়ে দিসে। এগুলো কি আমি জানি না?
রানুখালা দ্রুত চিন্তা করছেন রাগের মাথায় কখনো, এমন কোন কথা বলে ফেলেছেন কিনা। শানুর নির্দেশে তার আর নিশির বাবার তালাকের বিষয়ে কিছু ফাস করা কঠিন ভাবে নিষেধ।

নিশি কড়া গলায় বলল,” বেশি হেরিতেরি করলে আমি আম্মাকে সোজা বলে দেব তুমিই সব খুলে বলস। দিনরাত আমার মায়ের বদনাম আমার কাছে কর।

-সেইদিনের মেইয়ে তুমি আমারি কি তুই ভয় দেখাচ্ছিস? “রানু ভেতরে ভেতরে যথেষ্ট ভড়কে গেলেও দ্রুত সামলে নিতে চাইছেন, “বলগে যা ইচ্ছে, আমার মনি হয় বা** ছেড়া গেল বললি পর!

– কী ছিড়বে তা তো দেখতেই পাবা। এরপর তোমার খরচ কোথা থেকে আসবে? আমার মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়েই তো ইন্ডিয়ায় তোমার খুনে ছেলেকে পাঠাও।আমি জানি না ?

রানু খালা রাগে ফুসছেন গজগজ করতে করতে পাকের ঘরের দরজার দিকে পা বাড়ালেন -এত্ত বড় কথা! আমি এই দায়িত্ব নিতি চাইনি। তোর বড়মামা জোর কইরে চাপিয়ে দেলো।নিজের ছেলেরে পাশে বসায় দুখন খাওয়াতে পারিনে মানুষের বোঝা টেইনে টেইনেই আমার জীবন গেল। আজকি এর একটা বিহিত হবে, তোর খালু আসুক…

– আসুক,খালু দিয়ে আমারও বা** ছেড়া গেল

– নিশি চুপ কর! কী শুরু করলি?
খালা পাকেরঘর ছাড়লে নদী এবার এগিয়ে এলো।

– ঠিক করসি৷ আমার মায়ের পয়সায় ব্যবসা করতেসে, সংসার করতেসে, আবার ইন্ডিয়ায় শাহিন ভাইকেও পাঠাচ্ছে। এখন পেয়ে বসছে একেবারে। বুড়ির গু মুত সাফ করা আয়া হয়ে তুই থাক। এই বেটির বিষ তো আমি নামায়ে ছাড়বো ।

-কারো বিষ নামানো লাগবে না। তুই দয়া করে একটু ভালো হয়ে যা, শানু খালামনি যা বলসে..উফ!

নদীর হাতে গরম মাড় পড়ে গেলে। বেশ জ্বলছে। আজ সকাল থেকে গা হাত পা কাঁপা বন্ধই হচ্ছে না। চারদিন আগে চব্বিশ ঘন্টায় কয়েকটি ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। একসাথে সব হবার জন্যই ঘটনাগুলোর আলাদা গুরুত্ব নদী বুঝতে পারেনি। .

বুঝতে পারল পরদিন সকালবেলা। নদীদের বাড়ির পশ্চিম পাশে রহমত চাচার ভাড়াটে আনোয়ারাকে খুঁজে দেয় যখন পুলিশ এলো। এদিকে ঘরে তালা দিয়ে ভাড়াটে গায়েব। বেশ কয়েকটা থানায় নাকি রিপোর্ট আছে তার নামে। পুলিশ এবাড়িতেও এসেছিলো। রানু খালা আনুর ঘটনা শুনে চোয়াল ঝুলিয়ে ফেললেন।

” না না দেখি নাই এক সপ্তাহের মধ্যি আসেনি ” শাহবাজ তখন ঘরেই ছিলো। দ্রুতই টুকটাক কথা বলে পুলিশ বিদায় দিয়ে দিলো। কিন্তু যতদূর মনে পড়ে আনোয়ারা সাথে তার বের হবার দৃশ্যটা শাহবাজ দেখেছে। এতটা উপকার শাহবাজ করবে আশা করা যায় না। তবে মানবজাতি বড়ই বিচিত্র,তার মনে কোন কোণা আলোকিত আর কোন অংশ আধারিত বোঝা মুশকিল।

পুলিশের কাছ থেকে জানা গেল এই আনোয়ারা মূলত মেয়েদের দালাল। কয়েকটা সোর্সও নাকি আছে খুলনার সোনাগাজি এলাকায় কয়েকটি মেয়ে পাচার করেছে।তাদের মধ্যে কয়েকটা ভদ্রঘরের মেয়েও আছে। প্রেমের ফাঁদে ফেলে চাকরির প্রলোভন দিয়ে, ভালো কাজের আশায় ষোল থেকে আঠেরো বছরের মেয়েদের টার্গেট করে। অনেক পাওয়ারফুল নেটওয়ার্ক। রীতিমতো দলবদ্ধ হয়ে কাজ করে। টিমলিডার হলো আনোয়ারা।

পুলিশের কথা শুনতে শুনতে নদীর মনে হচ্ছিলো কেউ তার শক্তি নিঃশোষিত করে নিচ্ছে। আনোয়ারর সাথে সেদিন নদী ছিল এই বিষয়টা রানুখালা ঘুনাক্ষরে জানতে পারলে ভূমিকম্প হয়ে যাবে। তার সাথে মাথার মধ্যে অন্যরকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, সেটা হলো নদী আনোয়ারাকে দেখেছে। তার গ্যাংকেও দেখেছে। কোন অবস্থাতে তারা যদি আবার আসে?

” মেয়েটার পরিবারের আর কেউ রইলো নারে.. ”

মায়ের চল্লিশার দিন একমহিলার আহাজারিটা কানে বড় ধাক্কা খায়।এই স্মৃতি মনে পড়লে নদী প্রচন্ড অসহায় লাগে। সবকিছু অন্ধকার মনে হয়। যে করেই হোক নদীকে বেঁচে থাকতে হবে।

” নদু কিসসে রে? ”

” কী হবে”

” ঘুমানোর আগে এমনে জাবরাজাবরি? লেসবিনের মতো করতেসিস ক্যান? সমস্যা কী?

– ধুত-তরি!
নদী সরে গিয়েছিল নিশির কাছ থেকে। এই বেয়াদবটা শুধু বয়সেই তার থেকে তিনবছরের বড়। ছোটবোনের সাথে কথায় কোন লেহাজ নাই।

– ধুত-তিরির কী আছে? কনভার্ট হয়ে গেলে বল, ম্যানেজ করে দিব।আমার কাছে সব আইটেম এভেলেবল, ইটস এ চয়েজ বেবি।।

– অফ যা তো নিশি।

নিশি হাসলো -ঝেড়ে কাশ, আমি অফ যাচ্ছি। ওই বুইড়ার প্রেমে পড়সিস? তুই তো বিয়ের পাত্র ভাবসিলি না?

নদী চুপ করে রইলো।সেই পরিস্থিতিতে নদীর বুকে কতটা ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো কাউকে যদি বলতে পারতো, সত্যি কি কাউকে কি বলতে পারবে? ” ঢাকায় তো আসবেই এডমিশনের জন্য ” -সামদানী নামক মানুষটাই বোধহয় প্রথম নদীর উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে কোন কথা বললেন।আট-দশটা মেয়ের জন্য সেটা স্বাভাবিক হয়তো কিন্তু নদীর জন্য নয়। নিশি নিজের মতো বলে যাচ্ছে,

” বাই দ্যা ওয়ে এই লোক তোকে বিয়ে করলে কিন্তু খারাপ হয় না।ঝুনা নারকেলের আলাদা টেস্ট।এর সাথে একটু এডজাস্ট করতে হবে, তবে এই দোজখ থেকে মুক্তি মিলে যাবে। বুড়ো জামাইগুলো খুব লক্ষ্মী হয়। রাফিনটা মাঝেমধ্যে যা ঝামেলা করে না।

– রাফিনটা কে আবার? নদী মাথা তুলল, “তোর না পাভেল ভাইয়ের সাথে..

– “‘আরে ধুর! ওইটার বে** আছে? ও হলো টিস্যু পেপার গোত্রের ক্যারেক্টর।রাত গায়ি বাত গায়ি” নিশি বিরক্তি ঝেড়ে বলল, আচ্ছা একটা কথা বল,”তোকে গতবছর এক স্কুল মাস্টার হুইডোয়ার ছেলের প্রস্তাব এসেছিল না?

নদী হেসে ফেলল- পছন্দ হয় নাই, আমি তো তোর মতো ফর্সা না।

নিশি বিচিত্র চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো।এই ধনুকের মতো শরীরের গড়ন দেখে মাঝে মাঝে নিশির হিংসে হয়। নদীটার এখনো নিজের সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয়নি, হলে মাটিতে পা পড়বে না।সেই বিয়েটা কেন হয় নাই সেটা নিশি জানে। নদীটা জানলে মন খারাপ করবে। পৃথিবীটা খুব নোংরা স্বার্থপর লোকে ঠাসা। নদী হঠাৎ মাথা তুলে বলল – তবে নিশি ওই সোহরাব সামদানী না নাম্বার দিসে,তোর ফোন দিয়ে একটা কল দিব?

– মোটেও না, আজাইরা!এন্টনি হপকিনস গুডলুকিং কিন্তু তার সাথে প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার মানায় না।

– আমার মা-বাপ নাই এন্টনি হপকিনস দিয়েই কাজ চালাইতে হবে। প্রিন্স চার্মিং শুধু স্বপ্নেই আসে, আর সিনড্রেলার গল্পে।

কথাটা বলতে বলতেই নদীর মনে পড়ে গেল লোকটার সাথে কার চেহারার সুক্ষ্ম মিল আছে ।সেই দিনও মনে পড়ছিলো না।সামদানী লোকটার সাথে একটা ছেলের খুব মিল৷ নাহ সেই মধ্যবয়স্ক স্কুল টিচারের না। বোর্ড পরীক্ষার একমাস আগে শানু খালার সাথে যে বার ন্যাশনাল আইডি তুলতে ঢাকা গিয়েছিল। বিজ্ঞাপনের পোস্টারে ছেপে থাকার মতো একজন ব্যক্তিত্ব চোখের সামনে একেবারে কাছে চলে এলো। ওই সামদানী ভদ্রলোক অনেকটাই যেন তার মতো। তবে চোখ আর হাসিতে সে যেন আরও একটু নিখুঁত ছিলো। সবচেয়ে বড় কথা ,জীবনে সেই প্রথম কোন যুবকের চোখে তারজন্য মুগ্ধতা দেখেছিলো। এই মুগ্ধতা তার ঠোঁট বা বুকের দিকে তাকিয়ে দেখা জৈবিক মুগ্ধতা নয় , একটা স্বচ্ছ মুগ্ধতা।আচ্ছা, কী নাম ছিলো তার? নদী জানে তার আসল নাম কখনো জানা হবে না। যাত্রাপথে কিছু পথিক সবসময় অজানা রয়ে যায়, শুধু তাদের সৌরভ আচ্ছন্ন করে রাখে অনেকক্ষণ ।
*****

পরপর কয়েকদফা মেয়ের সাথে কথা বলে শানু আপসে আসতে পেরেছেন । নিশি নতুন পাত্রর সাথে দেখা করতে নিমরাজি। শর্ত একটাই বিয়ে ঠিক হলে তার ফ্যাশন ডিজাইনিং এর কোর্স টা শেষ করতে দিতে হবে ঢাকায় থাকতে দিতে হবে।

প্রস্তাব শুনে রানু বাঁকা হেসেছে। ইংরেজী ভার্সনে আই এস সি পাশের পর, একটার পর একটা কোর্সে ভর্তি হয়ে মায়ের টাকার শ্রাদ্ধ ছাড়া এই মেয়ে আর কিছুই করেনি। ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়ে কত উল্টে দেবে তা সবার জানা আছে।

অবশেষে পাত্র আজ আসছে মহাসমারোহে। দ্বিতীয় দফা সারাবাড়ি ঝাড়পোঁছ করা হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে ডিপফ্রিজে তোলা মুরগির মাংস আবার তেলে দিয়ে গরম করে রাখা হচ্ছে। যদিও আজকের বাজারের জন্য কত খরচ হলো সেটা শানুর কানে ইতোমধ্যে তোলা হয়েছে। নিশি সকাল থেকে মুখে একটার পর একটা উপটন মেখে আছে। মাথায় মেহেদি মেখে বসে রইল চিলেকোঠায়।

” ঢং! মায়ের পয়সার বিষ হইয়েছে, সেগুলোন ওড়াচ্ছে৷ ওই মাতারিরি বে দিয়ি কোন লাভ হবে নানে, চোদ্দঘাটের পানি খাওয়া মা**ী এগের রসের অভাব নেই বুইসিস! একতাতে (একটাতে) এগের মন ভরে না, একশো হাত দূরি থাকবি এর থেকে। ”

রানুখালার শাশুরি গজগজ করে নিজের মনেই বলে যাচ্ছেন। নদীর কান ঝাঁ ঝা করছে শুনে। অর্থব বুড়ির শরীর কোন কোনদিন ছেড়ে দেয়, সেদিন কন্ঠ সমস্ত জোর পেয়ে যায়। মেহমানরা যেকোনো সময় চলে আসবে, নদী নাহার বেগমের মুখে জাওভাত তুলে দিতে দিতে ইশারায় থামতে বলেও লাভ হচ্ছে না। নাহার বেগমের কথা শুনে মজা পাচ্ছে বাইরের ইলেট্রিশিয়ান। এদিকে বিশাল লাটবহর নিয়ে ছেলের পরিবারের সবাই আসছে। পছন্দ হলে কাবিব হয়ে যাবে।

-নদী এই যে বইটা।

নদী বেশ চমকে গেল। সেইদিনের পর মনোয়ারের সাথে দেখা এই প্রথম। ছেলেটাকে ধন্যবাদও দেওয়া হয়নি। একটা বই হাতে উঠানে দাঁড়িয়ে।নদী নাহারের মুখ মুছিয়ে উঠে গেল। বুক কাঁপছে।

– সেইদিন ওখান থেকে এইসেছিলে কীভাবে? পুলিশি যে ডাকবো তার সাহস পাইনি তারা বাইরি থেকে ঘিরে রেইখেসেল।আমি তো এক মনি দোয়া পইড়ে গিলাম..।

নদী বলল,” দোয়া তো পড়বেনই আপনি তাদের দলেরই একজন তাই না? ধর খেলে আপনিও ফাসতেন। আমি গিয়েছিলাম বলে ভড়কে গিয়েছিলেন। বুঝতে পারেননি আনু আমাকে নিয়ে যাবে ‘

-আল্লাহ মাবুদ এইগুলা তুমি কী বলসো,

– আমি বলিনি, নিশির নেতা বড়ভাই পাভেলের কাছে শুনেছে।আপনাদের সব গোমড় শেষ। পুলিশ খুঁজতেসে। কিছুক্ষণ আগেও পাভেল ভাইয়ের লোকজনকে গলির পথে দেখেছি। দেখলে সেই ঠ্যাঙানি..

-ফালতু কতা, ফোন দিতি এইসেসিলাম। তুমি কাহিনি শুরু কইরেসো, এইজন্যিই মানুষের উপকার করতি নেই …

মনু দ্রুত বেরিয়ে গেল। নদী স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে। অদ্ভুত ব্যাপার আজ সকালেও ঘরের বাইরে বারান্দায় যেতে তার ভয় লাগতো।এখন তার কেমন যেন ভাবলেশহীন মনে হচ্ছে মনুর যে এখানে সম্পৃক্ততা থাকতে পারে নদীর কিছুক্ষণ আগেও ধারণা ছিল না। পুলিশের ভাষ্যমতে ওই হোটেলের প্রায় সবাই জড়িত। হুট করে বলে আন্দাজ লেগে গেল কী করে? মনু তাকে বাঁচাতে এসেছিলো না ফাঁদ পাততে? সে কি এতই তুচ্ছ যা বিক্রি করে দেয়া যায়?ওই ঘটনা একটা লাভ হয়েছে নদীর ভেতরে বিশ্বাস উঠিয়ে নিয়েছে, সবাইকে কেন যেন সন্দেহ হয়।

– একটু পানি খাওয়ান।

বারান্দার কারেন্টের লাইন ঠিক করা ইলেকট্রিশিয়ান কেমন আদেশের সুরে বলল।নদীর পরিচ্ছদে বাড়ির পরিচারক ভাবাই স্বাভাবিক।

-রুনি বু, এই ইলেকট্রিক ভাইয়ারে পানি দেও

ঠিকেঝিকে নদী বেশ রুক্ষ গলায় নির্দেশ দিয়ে ঘরে চলে এলো। বিনাকারণে রাগ ওঠা ভালো নয় তবে এখনো হঠাৎ হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

রানুখালা ততক্ষণে ঘরে নতুন অতিথি তুলেছেন। মুখে আর হাসি ধরে না। নদী বুঝতে পারছে না অতিথিদের সামনে যাবে কি যাবে না। প্লেট বাটি সব টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে এসেছে। কিছু দরকার হবার কথা না। এর মাঝে একটু গোসল সেরে নেওয়া যাক। স্নানের পর তাকে দেখতে সুন্দর লাগে। নিশির চেয়েও কি লাগে?মনের মধ্যে সম্ভাবনার তরঙ্গ খেলা করছে, নতুন অতিথিদের কারো চোখে যদি নদী পড়ে যায়?খালার বাড়িতে আশ্রিতর তার পরিচয়ের থেকে কারো স্ত্রীর পরিচয় পাওয়াটা বেশি শ্রেয়। যদিও এতিম হয়ে কারো বাড়ির আশ্রিতা আর কারো স্ত্রী হওয়ার মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই।

” আরে বসেন তো আমি ভেতরটা একটু দেইখে আসি।” মেহমানদের আপ্যায়নের কথা মুখে নিয়ে রানুখালা ঘরে ঢুকলেন।

” বুড়ির খাওয়া হয়েছে না? তো এইখানে কী? বলেছি না মেহমান থাকলে বাইরে আসবি না?

– গোসলে যাচ্ছিলাম খালা। নদী অস্বস্তি নিয়ে বলল। হিসেব করে আজও শাহবাজ একটা ছুতো ধরে বাসায় আছে।নিশিকে পাহারা দিতে তার মাছের ঘেরের দুজন লোকও আছে গেটের বাইরে। হায়দার খালু আর শাহবাজ মেহমানদের আপ্যায়ন করছেন, শাহবাজ ফাঁকেচোরে জুলজুলে চোখে ভেতর বাড়ি দেখে নিচ্ছে।

– গোসলির কোন দরকার নেই, এরা গেলে পরি, যাবি৷ এখন নিশিরি রেডি হতি বল তাড়াতাড়ি।

– ও তো ছাদে উপটন নিয়ে বসে ছিলো।

– ছিলো মানে! কখন থেকে?

-সকাল থেকে। আমি তো রাঁধতেসিলাম।,
এতোক্ষণে তো হয়ে গেছে, দাঁড়ান আমি ডেকে নিয়ে আসি।

রানু খালা অনুমতি দিয়েও আবার ফিরিয়ে নিলেন। ছাদের সিঁড়ি বৈঠক ঘরের পাশ দিয়ে উঠে গেছে। নদীটাকে তারা ঢুকতেই দেখে ফেলবে। আর এই পাকামেয়েও ছুতো ধরে যাবে মেহমানদের সামনে। নদীটার নিশির মতো মাজা রঙ নেই, তবে ছিপছিপে গড়নের বেশ লম্বা, কাটাকাটা মুখচোখ, বেশ চটক আছে। শাহিনের আব্বারো যা আক্কেল,মোবাইলে নদীর সাথে তোলা নিশির ছবিটাই তাদের আগে দেখিয়ে বসে আছে। এই ইঞ্জিনিয়ার ছেলের নাকি নদীকেই আগে পছন্দ হয়েছিল।

এখন ঝুঁকি নেবার দরকার নেই। গল্প কবিতায় একদিনে ভাগ্য বদলানোর কথা থাকলেও আসল পৃথিবী বেশ কঠিন। এতিম মেয়ে বিশ্বসুন্দরী হলেও বিয়ে দেয়া ঝাক্কি। তার ওপর বড় ঘরে দিতে গেলে খরচের বহর ।নদীর জন্য এতটা কে টানবে? ওই বুড়ি মরার সময় হয়ে এলো বলে, কিছু একটা হলে তারপর ভাবা যাবে। শাহিনটার কেসের ঝামেলা মিটলে রানুরও একটা পরিকল্পনা আছে।
তবে সবার আগে ঘরের এই উটকো ঝামেলা দূর করা যাক। শাহবাজ বুদ্ধি দিয়েছে ছেলেরা আজ ভালোয় ভালোয় রাজি হয়ে গেলে, কাজী ডাকিয়ে আকত পড়িয়ে দেবেন। বিদেশি ডলারের গন্ধ বলে কথা, লোভ যেখানে দুর্বলতাও সেখানে। তারপর যা মাল সে নিয়ে যাবে, টিকলে টিকলো না টিকলেও দেখার বিষয় তাদের না।

নিশির খোঁজে রানু নিজেই সিড়ি ভেঙে ছাদে উঠলেন। শাড়ি চুড়ি নিয়ে উঠলে ছাদের বাথরুমেই গোসলটা সেরে নিতে পারতো ।কী করেছে কে জানে। আবার বলে না বসে শাড়িই পরবো না।

তবে সকাল থেকে যেভাবে ছেলের ছবি দেখে লাফাচ্ছে পারলে কাজি ডেকে এখনই তিনবার কবুল বলে ফেলে। ছেলের লাল্টু মুখ দেখে গলে গেছে, বেহায়া একটা।নিশির মাও ছিল একটা বেহায়া। কতবার রানুকে দিয়ে চিঠি পাঠাতো এর তার কাছে…

মাতা কন্যার বিষেদাগার কর‍তে করতে রানু ছাদের চিলেকোঠার দরজা ঠ্যালা দিলেন।
ঘরে নিশির কোন চিহ্ন নেই; ছাদে কেন, গোটা বাড়ি ত্রিসীমানায় নিশির কোন দেখা নেই। সে ততক্ষণে বাস-স্টেশন থেকে ঢাকাগামী গাড়ির টিকিট নিচ্ছে।

(চলবে)

#শারমিন_আঞ্জুম