বাতাসে তার সৌরভ পর্ব-০৬

0
185

#বাতাসে_তার_সৌরভ–৬

নিশি ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে।তার থেকে বয়সে দুই বছরের ছোট মিনমিনে স্বভাবের মেয়েটাকে আপাতত দেখে লাগছে মানসিক বিকারগ্রস্ত। দুই লিটারের বোতল খুলে এমনভাবে পানি মুখে ঢালছে, যেন গত একসপ্তাহে পানি খায়নি। পানির ঝাপটায় গলা ঘাড়ের অনেকটুকু ভিজিয়ে ফেলেছে। নিশির এখন একটু ভয় ভয় লাগছে,

” নদু শোন, আমি না ডায়পারের ব্যবস্থা করতে পারবো না। ”

” ডায়পার?” নদী মাথা ঘুরিয়ে তাকালো।

” যেভাবে পানি গিলে যাচ্ছিস পেট ফুলিয়ে ঢোল বানাবি। মাঝরাতে গাড়িতে বসে কেলেঙ্কারি হবে.. থাম একটু। ”

নদী পানি খাওয়া বন্ধ করলো। কিন্তু তার শরীর কাঁপা বন্ধ হচ্ছে না। নদী একহাতে নিশির হাত পেচিয়ে ধরলো ছোট বাচ্চাদের মতো। নিশি বিরক্ত হয়ে বলল,
“বাস চলে আসছে, আমার সাথে যেতে হলে এখন বাথরুমে গিয়ে হাল্কা হয়ে আয়। আর কোন পানি টানি খাবি না” নদী দেখলো অদূরেই পাভেলের দুজন লোক দাঁড়িয়ে নিশির সাথে এসেছে তারা। তবুও নদীর ভয় যাচ্ছে না।

অত:পর নিশির প্রচন্ড ধমকে নদী অনিচ্ছা নিয়ে বাথরুমে গেল। মাথার মাঝে সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।এটাও বুঝতে পারছে না সে সত্যিই নিশির কাছে এসেছে নাকি স্বপ্ন দেখছে। মনের একঅংশ বলছে বাড়ি ফিরে যেতে অন্য অংশ তীব্র ভয়ে শিউরে যাচ্ছে। শাহবাজের সদাপরিচিত মিচকে হাসিটা কতটা কদর্যরূপ নিতে পারে, কিছুক্ষণ আগেই সে জেনেছিল।

” রাগ কচ্ছ কেন নদী, কতঘাটের পানি খেইয়ে এইসে এখন ননীর পুতুল সাজলি তো হবে না, আনুর সাথে তুমি কই গিয়েছিলে তা আমি সেইদিনই বুইঝেছি…,

নদী স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে ছিলো। সেই মুহূর্তে যেন অদৃশ্য কেউ মুখচেপে ধরেছিল তার। শাহবাজ স্বাভাবিকভাবে হেসে বলল, ” তবে কি আমার তুমারি বড় পছন্দ, এইজন্যিই কাউরি বলব না।আমি বড় একা, বড় দুঃখী বুইঝলে… ”

” রানু খালা! ”

দরজার দিকে তাকিয়ে নদীর কন্ঠটা বেশ স্পষ্ট ছিলো। শাহবাজ চমকে ঘুরে তাকিয়ে কাউকে পেলো না। নদীর মাথা কাজ করছিল না, হয়তো এটা অন্য কেউ তাকে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু সময় ক্ষেপণ করলো না। ঝড়ের বেগে বারান্দার দরজা খুলে দ্রুত উঠানে চলে যেতে চাইলো ৷ ভয় পেয়ে সম্বিত হারানোর অবস্থাও তখন নেই। পেছন বারান্দায় উঠোনের দরজার কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ ভারি একটা শরীর পেছন থেকে নদীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কানের কাছে যেন এক আঠালো শরীরের অজগরের ফিসফিসানি…

” মা**ী ঘরের মা**ী , হোটিলি যায়ি চুনকালি মেইরে আমার সাথে তামাশা? তোর শরীরের গরম আজ বের কত্তিসি,

শাহবাজ হিংস্র হয়ে যাচ্ছে। টানা হেচড়ার এক পর্যায়ে নদীর আঙুলে বারান্দার গ্রিল দরজার ছিটকিনি খুলে গেল। শাহবাজ সে সময় নদীর চুল ধরে হেঁচকা টান দিয়ে টেনে আনার সময় নদীর মনে হলো তার শক্তি জবাব দিয়ে দিচ্ছে,সিগারেটের সাথে কড়া গা গোলানো আতরের গন্ধ নাকে মুখে ঢুকে তাকে নিস্তেজ করে দিচ্ছে।

তখনই হঠাৎ বাঘের গর্জন! উঠোনের এক কোণায় ভুলুটা কখন আঁধারে ঘাপটি মেরেছিলো। হুটোপুটি দেখে ঝাপ দিয়ে শাহবাজের হাত কামড়ে ধরলো।

” নদী কিরে! হয় নাই?”

নিশি বাথরুমের অন্যপাশ থেকে তাড়া দিচ্ছে। নদী দ্রুত পানির ঝাপ্টা দিয়ে বের হলো। বাস চলে এসেছে৷ নিশি আর দেরি করতে চাইলো না।

” কাপড়চোপড় কিছুই আনিস নাই? শুধু এই ফাইল? ”

” মার্কসিট এডমিটকার্ড এইগুলা লাগবে না? ”

” এই কাগজ পরেই ঘুরিস ঢাকায়, আর কিছু লাগবে না। আজিব ক্যারেক্টর! ”

নিশির বিরক্তিতে নদী চুপ করে রইলো। আশ্চর্য ব্যাপার হলো কাপড়ের কথা মাথাতেই আসেনি। ব্যাগে ভরতে গেলে হয়তো সময় নষ্ট হতো। টেবিলের ওপর মার্কসিট আর এডমিট কার্ডের ফাইলটা ছিল, হাতে ছিল সেই চাবির রিং আর টাকার খামটা।নদী আর কিছু ভাবেনি। শাহবাজ তখন ভুলুর আক্রমণে চাপা স্বরে চিৎকার করে যাচ্ছিলো উঠানে; নদী ঘরে ফিরে ফাইলটা তুলে মেইনডোর দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। পুরো ঘটনা চোখের সামনে হয়েও তখন মাথা ঠান্ডা ছিলো, এখন বাসস্ট্যান্ডে এসে কেমন গা গোলাচ্ছে। বারবার চোখের সামনে অগ্রসরমান শাহবাজের লুঙ্গির গিট খোলার দৃশ্য মনেপড়ে যাচ্ছিল । পেটে এখন কিছুই নেই তবুও বমি আসছে। শুধু শাহবাজই নয়, গোটা পৃথিবীটাই যেন কয়েকদিন ধরে কাপড় খুলে তার কুৎসিত রূপটা দেখাতে মরিয়া।

” মোবাইল অফ করসিস? ”

” আনি নাই ”

” ভেরিগুড। রানুখালা তো মনে হয় বাড়ি কাঁপিয়ে ফেলছে এতক্ষণে। “বলতে বলতে নিশি হেসে ফেলে,” থ্যালথ্যালে বস্তা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে চিৎকার করছে দেখার মধ্যেও এক্সাইটিং ব্যাপার ছিলোরে, মিসিং দ্যা সিন ”

বাস মৃদু কেঁপে উঠছে একটু একটু মহা সড়কে উঠে এগিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে সরিয়ে দিচ্ছে চেনা জনপথ৷ নতুন পথ কি চেনা?

” সাড়ে দশটার দিকে ফাইনালি জার্নি শুরু হলো। “নিশি নিশ্চিত শ্বাস নিয়ে বলল।

” যদি কিছু না হয়? যদি আবার ফিরতে হয়? ”

” সাহস করে বের যখন হয়ে গেছিস, কিছু তো হবেই। ভুলে যাচ্ছিস কেনো, ওইটাই তোর শহর,তুই এখন নিজের ডেস্টিনেশনে ফিরে যাচ্ছিস। এতদিন এইখানেই তুই মেহমান ছিলি। ”

নদী উত্তর দিলো না। ‘বিসমিল্লাহি মাজরিহা ওয়া মুরসা-হা, ইন্না রাব্বি লা গাফুরুর রহিম, মুখ থেকে নিসৃত যাত্রা প্রারম্ভের দোয়া মায়ের মতোই বলে গেল আজ।

” নেহ তোকে গুডবাই জানাতে ভুলুও চলে আসছে। ” নিশির কথায় নদী জানালার দিকে তাকালো। সড়কের ঢাল দিয়ে কালো একটা সিংহ দাঁড়িয়ে।আঁধারে জ্বলছে তার সবুজ চোখ। শাহবাজ নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে একে কিছু করে ফেলে নাকি তা নিয়ে চিন্তিত ছিলো। চেনা আশ্রয়ের জন্য নয়, অবোধ প্রাণীটার জন্য মায়া হচ্ছিল নদীর।

” বাই দ্যা ওয়ে, ভুলুর মুখে কিরে কাপড়ের মতো? ”

নদীও খেয়াল করলো মনে পড়লো, রানুখালার বাড়িতে এর আগে দুইবার চোর এসেছিলো। তবে খালুর একজোড়া ছেড়া স্যান্ডেল আর দুটো গামছা ছাড়া কিছু নিতে পারেনি৷ প্রতিবারই ভুলুটা কোথা থেকে উদয় হয়ে দাবড়ে ভাগিয়েছে৷ তবে ভুলুর নিজেস্ব স্টাইল আছে। একেকবার চোর ভাগায় আর বীরত্বের চিহ্ন হিসেবে সকালে সে চোরের লুঙ্গির টুকরো মুখে নিয়ে তাকে ঘুরতে হয়।ভুলু খুব বিচিত্র ভাবে জায়গা মতো টান দেয়। একবার তো কামড় থেকে বাঁচতে একজন খুলেই দৌড়।

নিশির বড় আমোদ হতো, ” খালা হারানোর হিসেব নিচ্ছে আমি চিন্তা করতেসি চোরব্যাটা তার বাড়ি ফিরসে ক্যামনে, বউ কিছু বলে নাই আমাদের লুটতে এসে নিজের ইজ্জত লুটিয়ে চলে গেল, হি হি হি”

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভুলুর মুখে আজও লুঙ্গির টুকরো। সবুজ বাটিকের লুঙ্গি। শত্রু পরাস্ত করে দৌড়ে এসেছে নদীকে দেখাতে।

” আবারও কি বাড়িতে চোর এসেছিল নাকি”

” চোর না ছ্যাচড় এসেছিলো হি হি হি”

নদী প্রথমবার খিলখিল করে হেসে ফেলল। কেন যেন মনে হচ্ছে এই যাত্রা জয়ের যাত্রা। যে করেই হোক জয়ী হয়েই ফিরবে সে। নয়তো নয়।

*********

” আমার গলাটা চেপে ধরেছিল ম্যাডাম, নি:শ্বাস নিতে পারতেসিলাম না সালেম ভাইরে কীভাবে ডাকতাম বলেন?

গ্যাব্রিয়েল কিচেনের একজন ডিরেক্টর রাবেয়া আফরিন শীতল চোখে তাকিয়ে আছেন।ফাতেমা মেয়েটা ভালো ভয় পেয়েছে। দুইদিন জ্বরে ভুগে আজ মাথা তুলেছে। সেইরাতে ফাতেমাকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে গ্যাব্রিয়েল কিচেনের শেফ সালেম। সময় নষ্ট না করে দ্রুতই রাবেয়া ম্যাডামকে কল দেয়। তিনি দ্রুতই হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

গ্যাব্রিয়েল কিচেনের ম্যানেজমেন্টকে অনিচ্ছা নিয়েও স্বীকার করতে হচ্ছে, যে এমন ঘটনা আজকে প্রথম নয়। ক্যাফে প্রতিষ্ঠার দুই বছর থেকে ছেড়ে ছেড়ে এই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হচ্ছে। লম্বা বিরতির পর নতুন করে পর পর দুইজন উল্টোপাল্টা দেখলো। দুই মাস আগে দেখেছে আমিন নামে একজন ওয়েটার। অফ টাইমে ছাদে গিয়েছিল। তিনতালার ছাদে নাকি একটা বাচ্চামেয়ে তাকে কলার ধরে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দিয়েছে। এখন এই নতুন ঘটনা। অচিরেই গ্যাব্রিয়েল ক্যাফের নতুন এক্সটেন্ডেড রূপ উন্মোচন হবে। রেনোভেশনে খরচও হয়েছে তেমন। নামকরা আর্কিটেক্ট দিয়ে ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা হয়েছে। রীতিমতো চোখ ধাঁধানো। কিন্তু হঠাৎ এই ভূতুড়ে বিষয়টি যেভাবে এগোচ্ছে, তা রেস্টুরেন্টের ইমেজের জন্য মোটেও ভালো নয়।

আজ অফিসে সোহরাব সাহেবও দেখা গেল বেশ গম্ভীর। রাবেয়াকে দেখে মাথা তুললেন।

-কী অবস্থা দেখলে?

– বেশ ভয় পেয়েছে। জ্বর যেহেতু উঠেছে কিছু তো আছে।

– তার মানে তুমিও বিশ্বাস কর যে এখনে ভূত আছে।

– আরে নাহ আমি এটা কবে বললাম। তবে কিছু একটা তো আছে, দীর্ঘদিন জায়গাটা খালি পড়েছিল। আমি বলি কি একজন ভালো হুজুরর ডেকে জায়গাটা একটু বেধে ফেলা যায় না?

সোহরাব সাহেব ভ্রুকুটি করে তাকালেন – হুজুর কীসের জন্য?.
রাবেয়া একটু অস্বস্তি নিয়ে বললেন, না মানে বড় অঘটন ঘটার পর এসব জায়গায় কিছু আন- ন্যাচারাল এন্টিটি আসে। হতেও তো পারে এমন কিছু। টেকনিকালি ইনভেস্টিগেশনের সাথে স্পিরিচুয়াল ভাবে..।

-রাবিয়া প্লিজ একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে তোমার মুখে এসব মানাচ্ছে না,

– কিন্তু..

– কিছু একটা কিন্তু তো আছে এটা সবাই জানে ” সোহরাব সাহেবের কন্ঠ কঠিন, “এর পেছনে কে বা কারা আছে সেটাও অনেকে স্পষ্ট জানি৷ কিন্তু আমি দমার পাত্র না। এটা রমির খুব শখের একটা প্রজেক্ট। এর জন্য যত এফোর্ট দিতে হবে আমি দেবো।

এফোর্ট বাক্যটা শুনে রাবেয়ার অন্য একটা কথা মনে পড়ল , আচ্ছা ভালো কথা তুমি সাতক্ষীরা গিয়েছিলে, সেই ট্যুরের বিষয়ে বলবে বলেছিলে..

– গিয়েছিলাম, তোমার দেয়া ঠিকানা খুঁজতে অর্ধেকবেলা বেরিয়ে গেছে। তারপর বাচ্চাটাকে দেখেও মন খারাপ হয়েছে। ফুটফুটে একটা মেয়ে। কতটা অযত্নে আছে। ইচ্ছা হচ্ছিল সাথে করে নিয়ে আসি। আচ্ছা রাবেয়া, তুমি একবার যাও না কেন?

রাবেয়া মাথা নাড়লো – নদীর মায়ের দিকে আত্মিয়োর সাথে আমার ওঠাবসা নেই তেমন, শুধু বড় মামাকে চিনতাম।তার ওপর এতদিন যোগাযোগ নেই হুট করে গিয়ে উপস্থিত হলে তারা কি না কি ভাবেন…

– এই হেজিটেশনেই সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হচ্ছে।

– বড় ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গেছে সোহরাব। নদীর বাবার কৃতকর্মের ফলই ভোগ করছে মেয়েটা।

রাবেয়া কি ভেবে সোহরাব সাহেবের কাছ থেকে নদীর খালার নাম্বার চেয়ে নিলেন। অনেক ছোটকালে দেখেছে রাবেয়াকে। দীর্ঘদিন পর চিনতে পারবে কিনা কে জানে। কিন্তু মেয়েটাকে সাতক্ষীরা থেকে আনা জরুরি।সময় বয়ে যাচ্ছে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। রাবেয়া রিং দিয়ে অপেক্ষা করছেন ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ নেই। মোবাইল বন্ধ। রাবেয়ার বিরক্তিতে ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে গেল। কিন্তু ধৈর্য হারালে চলবে না।

*******
“আমি..আর পারছি না….”

দূর থেকে ভেসে আসা শব্দগুলো শুনতে লাগছে হাহাকারের মতো। পুরনো হারিয়ে যাওয়া কন্ঠগুলো, যার অস্তিত্ব বিলীন হয়েও মায়াময়।

” আর কতটা লোন নিলে তুমি দায়মুক্ত হবা! একে একে সব শেষ করে দিচ্ছ। আমাদের ছেলেমেয়েরা কি মানুষ হবে না? ”

” অল্পকয়টা দিন মিনু, একটু ধৈর্য ধরো ”

” ধৈর্য ধরার আগে আমার মরা মুখ না দেখলেই হলো”

নদীর বুক কাঁপছে।মায়ের মুখটা স্পষ্ট নয় কিন্তু তীক্ষ্মকন্ঠ শুনতে পাচ্ছে। তবে বাবাকে দেখতে পাচ্ছে স্পষ্ট । মুখটা মলিন করে দরজা দিয়ে বের হলেন।বাবলু জেদ করছে সাথে যাবার, বাবা গেট পর্যন্ত সাথে নিয়ে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন।

” আব্বা যেও না আব্বা, গেলে তুমি আর ফিরবে না”

নদী প্রাণপণে ছুটে যেতে যেতে আব্বা চলে গেলেন। একটা ঘটে যাওয়া ঘটনা স্বপ্নের মধ্যেও কেন পরিবর্তন হয় না। একঝলকের মাঝে সব যেন ঘটে যাচ্ছে। বড়মামার কন্ঠ শোনা যাচ্ছে…

” এত দায়িত্বহীন কীভাবে হয় মানুষ? ডায়বেটিস এর ওষুধ খেতো না, যা ইচ্ছে খেয়ে যেতো। হঠাৎ স্ট্রোক করে এভাবে চলে গেল! বউ বাচ্চাদের জন্য একটা কানাকড়িও রেখে যায় নাই।এটা বিশ্বাসযোগ্য?

ছোট মামার মঞ্জুরের কন্ঠ ভেসে আসছে “কোথাও কিচ্ছু নাই, ব্যাংকের কাছে তো এই বাড়িটাও মডগেজ দেওয়া! এখন কি করবি মিনু? হাউজিং কোম্পানিকে দিয়ে দিবি? এটাই ভালো হবে… ”
নদীর চোখের সামনে আলোর গতির চেয়ে দ্রুত দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে

“নদী, বাবলু খেতে আয়… ”

দোতালার বারান্দা থেকে মায়ের শেষ ডাক.. নদী লুকিয়ে আছে ভাঙা বাথরুমের দরজার আঁড়ে। বাবলু ভূতের ভয়ে ছুটে যাচ্ছে ঘরের দিকে…।নদীর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,

” বাবলু যাস না …”চিৎকার করে বলতে গিয়েও অদৃশ্য কেউ যেন গলা চেপে ধরেছে।প্রবল প্রলয় কোথাও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। তার শরীর দুলছে সময় তরঙ্গ ভেঙে সামনে গড়াচ্ছে। নদীর মুখে আওয়াজ নেই , তবে আশেপাশের অনেক আওয়াজ এসে শুনতে পাচ্ছে

” মেয়েটা সম্পূর্ণ একা রয়ে গেল.. সম্পূর্ণ একা…”

” ওই নদু! ওঠ! ওওওঠ! নদুউউউ”

চোখে কড়া আলোর তাপে চোখ মেলল নদী রুমের বিছানার ঠিক উলটো দিকে পুবমুখী জানালা। পর্দা সরালেই চোখ ঝলসে যায়।নদী বিছানায় থম ধরে বসে আগে বুঝতে চেষ্টা করছে সে আছে কোথায়, এবং কেন। নতুন পরিবেশ আর ক্লান্তির মধ্যে নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় নিলো।তারপর বুঝলো যে এটা নিশির ঘর। দুই দিন ধরে সে এখানে। তবুও প্রতিদিন সকালে নতুন লাগে।
বিছানা আর একটা ছোট টেবিল বাদে ঘরটাকে এলোমেলো কাপড়ের গোডাউন বললেও ভুল হবে না।নদী দুইদিন ধরে আছে প্রতিদিনই গোছায়। নিশি নিয়ম করে প্রতিদিন আউলায়।বেশি পরিপাটি ঘরে থাকতে নাকি তার দম বন্ধ হয়ে আসে।
নদী উঠতে যাবে এরমাঝে একটা ট্রেতে দুটা স্লাইস পাউরুটি আর একটা ডিম পোচ একমগে চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো নিশি।

” নে মহারানী আজ খেয়ে বেরোতে হবে। ”

” কোথায়? ”

” কোচিংয়ে ভর্তির জন্য, নাকি শেকড় গজিয়ে গেছে? তোর কোচিংয়ে হিল্লে করে আমিও কাল জবে জয়েন করব।।

” কোচিং সেন্টার কাছে এখানে ”

নিশি ঠোঁট উল্টে বল্লল ” ঢাকার প্রতি পাড়ায় পাড়ায় ব্যাঙের ছাতা না থাকলেও কোচিং থাকা মাস্ট। সামনের দুটা বিল্ডিং পরেই ,আছে। আপাতত ঢুকে যা পরিচিত মানুষ আছে এডমিশন ফিসও নেবে না ”

” এই জায়গাটা তো জিকাতলা? এখান থেকে ধানমন্ডি কতদূর?”

নিশি বাথরুমের গিয়ে নিজের পোশাক পাল্টাতে পাল্টাতে বলল ” জিকাতলার পাশেই। ধানমন্ডিতে আরও কয়েকটা কোচিং আছে। আপাতত এটায় ঢোক তো ”

নদীর বুক কাঁপছে। সে সত্যি আবার ঢাকা এসেছে এটা ভাবতেও অদ্ভুত লাগছে। ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরের কাছে ছায়াঘেরা পুরনো ধাঁচের একটা বাড়ি, চন্দ্রমল্লিকা নাম! ভয়ংকর যার চুম্বকীয় টান।

“ওই, কল আসছে কথা বল”

নিশির হাতে একটা মোবাইল, সেখানে রানুখালার নাম উঠে আছে। ঢাকায় আসার দুইদিন পর তলব। নদী নাস্তা করতে করতে কি বলবে বুঝতে পারছে না। নাম দেখেই শরীর কাঁপছে।

নিশি বিরক্ত হয়ে বলল, টক টু হার ইউ এসোল! তোর পুরান সিমটা তুলে এখানে ভরা হইসে। এখন কথা বল তোরে ভাগায় নিয়ে আসার পর সাতক্ষীরার সবার ফেটে বসে আছে। একটু ইনজয় করি ”

নিশির কথা নদী ফোন কানে দিতেই চিল চিৎকার –” কীরি বারো ভাতারিরি সাথে থেইকে শরীরির জ্বালা জুড়োয়েছে,না ফুর্তি এখনো বাকি?
” জি খালা?”
” ওহ আমার জি খালা মারাচ্ছে!বেঈমানের বাচ্চা হারামজ***ী এই ছিল কপালে,আমি শুরু থেকেই দুধ কলা দি কালসাপ পুইষেছেলাম ”

” দাদী ভালো আছে খালা?

” সে মরুক কি বাঁচুক তোর কী? তোর যদি আমরা কিছু হই তো সোজা আজকের বাস ধরবি নয়তো সারা জীবনের জন্যে আমার দরজা বন্ধ ”

নদী কি বলবে বুঝতে পারছে না। রানুখালা তীক্ষ্ণ কন্ঠ তাকে ধরাসায়ী করে দিচ্ছে।

রানুখালা সিদ্ধান্ত দিয়ে যাচ্ছেন, “যা হইয়েসে আমি ভুইলে যাব,আজ বিকালে আমার এক দেবর থাকে গাবতলি, সে তোর টিকিট কেটে নিয়ে আসবে। সোজা চলে আসবি কোন দেরি যেন না হয়”

” একটু দেরি হবে খালা,” নদী অনেক সাহসে ভর করে আওয়াজ বের করলো”আমি আসব তবে এডমিশন পরীক্ষা দিয়ে ”

“মানে তুই.. ”

” এখন আসব না ”

” নটির সাথে থেইক্কে মুখি চুনকালি মেইরে আসবি, না মেইরে ফেলেসিস? জানিস ওই শহরে তোরি পেলে কিরাম ছিড়েখুঁড়ে খাবে? ”
রানুখালার কন্ঠ বিকারগ্রস্ত রোগীর মতো শোনাচ্ছে। এর মাঝে নিশি মোবাইল ফোন নিয়ে কেটে দিলো।

নদী ম্লান গলায় বলল, ” খালা মন খারাপ করতেসে”

” এই শরীর নিয়ে বুড়ির হাগু-মুতু সাফ করলে মন ভালো থাকার কথাও না, আপাতত নাম্বার ব্লক দিলাম এডমিশন।পরীক্ষা দেবার আগে ওপেন করবি না”

নদী সাতক্ষীরায় খালার চেচামেচি যদিও তেমন বল পায়নি, তার কারণটা হলো বড়মামা। মোজাফফর হোসেন নদীর নানারবাড়ির সর্বেসর্বা ধরনের চরিত্র। উল্লেখ্য, নদীর স্কুল কলেজ ও দুটো বোর্ড এক্সামের রেজিষ্ট্রেশন খরচ তিনিই বহন করেছেন।
তিনি যখন শুনলেন নদী এডমিশন টেস্টের জন্য ঢাকায়, ঠান্ডা গলায় জানতে চাইলেন নদী কোথায় উঠেছে বাড়ির ঠিকানা কি। নদী ঠিকানা বলল।

“আচ্ছা গেছ যখন পরীক্ষা দাও, রেজাল্ট যখন ভালো এসেছে এতটা ট্রাই করাই যেতে পারে। আমি এখন একটু বিজি আছি তোমার পরীক্ষা হয়ে গেলে আমি নিজেই নিতে আসবো।।

বড় মামার গ্রিন সিগনাল মানে বিশাল ব্যাপার। তবে টেনশনের ব্যাপার হলো বড় মামা নদীর কথা শুনেই চুপ করে থাকবেন না। তিনি রানুখালার সাথে কথা বলবেন, বাকি মামাদের সাথে বুঝবেন। কপালে কতটা দুর্গতি আছে নদী জানে না। তবে এসব চিন্তায় সময় নষ্ট না করে নিশির বাড়ির কাছে একটা কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে গেল। পাঁচহাজার টাকার মধ্যে বেশ কিছু চলে গেল বলে বুকটা কচকচ করছিল; সাথে কিছু হতাশবাণীও শুনতে হলো।

“ইঞ্জিনিয়ারিং মেডিকেল কোচিং তো এখন হবেই না। বাকি ছেলেমেয়েরা অনেক এগিয়ে গেছে, এখন সমানে মডেল টেস্ট হয়ে যাচ্ছে। তুমি সেগুলো এটেন্ট করতে থাকো। এখন কম্পিটিশন অনেক বেশি, বোর্ড ফাইনাল দেয়ার পরপরই কোচিং না করলে ভালো জায়গায় এডমিশন কল্পনা করাও বোকামি ”

নদী উত্তর দেয় না, একটা ভার্সিটির সিট পাবার যুদ্ধ থেকে তার যুদ্ধটা কত জটিল এটার ব্যখ্যা কাউকে দিতে ভালো লাগে না। এইযুদ্ধের পরিণতি কী তাও জানে না।

” এমন একটা লাইফ তুমি ডিজার্ভ কর না সোহরাব ভদ্রলোকের কথাটা হঠাৎ হঠাৎ কানে বাজে। দু:খজনক হলো লোকটার কার্ড হুড়োহুড়িতে নদী হারিয়ে ফেলেছে।

হারানো পাওয়ার হিসেব কাটিয়ে নতুন নিয়মে নিজেকে ধাতস্থ করাই ঠিক করলো নদী। তবে ধাতব শহরে সবারই তাল-লয় নদীর গতি থেকে অনেক দ্রুত।

নিশিরও দেখা গেল ঢাকাতে অনেক ব্যস্ততা। একটা বিউটি সেলুন সেন্টারে রিসিপশনিস্টের চাকরি। সকালেই টিপটপ সেজে বেরিয়ে যায়। তার ফ্ল্যাটের অন্য সাবলেটের মেয়েগুলোও দেখা যায় নিজের কাজে সারাদিন ব্যস্ত। নদী কোচিং সেন্টার থেকে বাড়ি ফিরে একটা ম্যাগি নুডুলস সেদ্ধ করে খায়। বিকালে দরজা লাগিয়ে টেস্ট পেপার খুলে বসে। সব সময় মনোযোগ আসে তাও কিন্তু না। উদাস হয়ে কখনো চলে যায় আট দশ বছরের অতীতে।জানালায় দেখা আকাশকে জিজ্ঞেস করে তার পুরনো ঠিকানা হালহকিকত।
কখনো একেবারে নিচ্ছিদ্র দুপুর কখনো পাশেরঘরের রুমের মেয়েদের চিৎকার তার চিন্তার ছন্দপতন করে, ” তুমি আমার সাবান ধরবা না! ছোটলোক একটা…। ”

নিশির কথায় এইখানে জিনিস পত্র দেখে শুনে রাখতে হয়।বারো রকমের মেয়েরা সাবলেটে থাকে। কখন কী হাপিশ হয়ে যায় বলা যায় না। নদী জাগ্রত থাকে। এতদিন হাপিশ হবার ভয় না থাকলে এখন তার হাতে পাঁচ হাজার টাকা মতো আছে। এতগুলো টাকা এই লোকটা তাকে দিলেন কেন তাও জানা হলো না। লোকটা কি সত্যি পাত্রী দেখতে এসেছিলেন না বন্ধুর মেয়েকে?

এই অসম্পূর্ণ কৌতুহলের দমন হলো একদিন বিকালে,

এডমিশন টেস্ট এগিয়ে আসছে, সেদিন মডেল টেস্ট ছিলো কয়েকটা। ফিরতিপথে কি মনে করে নদী জিকাতলা না গিয়ে রবীন্দ্র সরোবরের দিকে রিক্সা ঘোরাতে বলল। ঢাকা শহরে ঘোরার জায়গা কম বলেই সরল উন্মুক্ত স্থানগুলো ব্যবহার হতে থাকে পন্যরূপি নারীর মতো। মেকি কোলাহলে ঝিলের স্নিগ্ধ আবেদন আর স্নিগ্ধ থাকে না। ভিড় কাটিয়ে লেক ঘেষে তৈরি করা খোলা মুক্তমঞ্চের কাছে নদী ঠিক করে নিচ্ছে এর সোজা সোজি গলি কোনটা। কয়েকটা গলি চোখের সামনে। শেষবার এই জায়গাটা দেখেছিল দুই হাজার দশে।

এখন দুই হাজার আঠেরো, মাঝে স্পষ্ট আট বছরের দূরত্ব। একটা এলাকা এর মাঝে এত অচেনা হতে পারে?.বিশাল বিশাল সব এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সগুলো কেমন অহংকারীর মতো দাঁড়িয়ে। মাঝামাঝি একটা বড় ঝকঝকে আলিশান রেস্টুরেন্ট।নদীর কেমন বোকা লাগছে এই শহরটা কি প্রতিমুহূর্তে খোলস পাল্টায়?

তবে একটা জিনিস চিনলো। রাস্তার মুখে একটা ছড়ানো আমগাছ এখনো আছে।
নদীর মনে হলো চন্দ্রমল্লিকা বাড়িটা এর আশেপাশেই কোথাও ছিল। এপার্টমেন্ট হাউজ গুলোর নাম্বার আটচল্লিশ উনপঞ্চাশ, ষাট, একষট্টি কিন্তু পঞ্চাশ নাম্বার বাড়িটা নেই। বাড়ি ভেঙে অট্টালিকা হলেও প্লট নাম্বার তো থাকবে।

প্লট নাম্বার গায়েব অথচ গলির বাতাসে সেই বাড়ির বাগানের চেনা কামিনীর সৌরভ…। বাড়িটা গায়েব অথচ নদীর ক্রিস্টালের চাবির রিংয়ে এই বাড়ির সদর দরজার চাবিটা আছে।

নদীর অস্থির লাগছে।হয়তো সময় নষ্ট। এখান থেকে বের হবার রাস্তাও পাচ্ছে না। খালিপেটেও টান পড়ছে।

“গ্যাব্রিয়েলস পেস্ট্রি ফেস্টিভ্যাল! ফিফটি পারসেন্ট ডিস্কাউন্ট অন পেস্ট্রি ‘

রাস্তায় দাঁড়ানো ছোট ছোট বাচ্চাদের হাত থেকে পাওয়া লিফলেট ছুড়ে ফেলে দেবার আগেই হঠাৎ স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলো নদী। এর প্ল্যাকার্ডের নিচে চাপা পড়ে আছে তার পরম কাঙ্ক্ষিত ঠিকানা।

গ্যাব্রিয়েল ক্যাফে
ধানমন্ডি রোড নং — সিক্স এ
বাড়ি নং-৫০

বনেদি ঝকঝকে রেস্টুরেন্টটা মাত্রই ছাড়িয়ে এলো নদী। আবার পেছন ফিরে গেল একটা চুম্বকীয় অমোঘ টানে।গ্যাব্রিয়েল কিচেনের জাঁদরেল নামের নিচে চাপা পড়েছে চন্দ্রমল্লিকার পরিচয়।

এখন বাড়িটার সামনে ছোট ঝিলের মতো করা, সেখানের সবুজ জলে লাল কালো মাছ, একটা কাঠের সাকো পার হয়ে মূল হোটেলে যেতে হয়। নদীর চোখে ভাসছে হারানো এক গাড়ি বারান্দা। তবে আজ তা বিলীন।

জমজমাট রেস্তোরাঁয় কোন একটা অনুষ্ঠান চলছে বেশ লাইটিং করে সাজানো। ঝলমলে বিলাসী ডেকোরেশন বুক কাঁপিয়ে দেয়। চোখ ধাঁধানো সজ্জা। ঝকঝকে টালির মেঝে, থেকে থেকে সেটা কাচের হয়ে গেছে। তার নিচে চকমকে পাথর বালি দিয়ে লাইটিং করে সাজানো। সেই কাচের উপর মানুষ হিল পরে খটখটিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

একপাশে রঙবেরঙের অর্কিড ফুলের ঝাঁক ,জায়গায় জায়গায় বিশাল বিশাল মাটির কলস যার থেকে উপচে উঠছে ফোয়ারা। হাল্কা মিউজিক বাজছে কোথাও।এর মাঝে মাইকে কারো আওয়াজ, ভেতরের কোথাও কনফারেন্স হচ্ছে। বাইরে খদ্দের সমাগমও কম নয়। দ্রুত ক্ষিপ্র পায়ে ওয়েটাররা খাবার নিয়ে যাচ্ছে টেবিলে। সব চকচকে চেহারার মানুষ বসে আছে সেখানে।কেউ হাসছে, কেউ বন্ধুদের সাথে সেলফি তুলছে।আনন্দময় ঝলমলে পৃথিবীর লোক সবাই।

নদী জড়োসড়ো হয়ে ভেতরে ঢুকলো।নিশির ডেনিম জিন্স আর ফতুয়াটার সাথে কায়দা করে জড়ানো স্কার্ফ তাকে পশ্চিমার ছাপ দিয়েছে বলে রক্ষা।এদিকে
বেকিংয়ের চনমনে গন্ধে পেটের খিদে চো চো করে গুড়ি মারছে।এখানে কিছুক্ষণ থাকতে হলে কিছু অর্ডার করতে হবে।নদীর ব্যাগে দেড়হাজার টাকার মতো আছে। নদী একটা টেবলে চেয়ার টেনে বসলো। ঝকঝকে সুপুরুষ একজন ওয়েটার হাসিমুখে এগিয়ে এলো,

” স্লামালাইকুম ম্যাম আর ইউ আলোন? ”

নদী ফ্যাকাসে হাসলো।

” খাবেন নাকি কি গিভ আওয়ে নেবেন ম্যাম”

” গিভ আওয়ে”

” আজ পেস্ট্রি ফেস্টিভ্যাল হিসেবে খুবই নাইস কিছু আইটেম আছে। সব ফিফটি পার্সেন্ট ডিস্কাউন্টে আপনি সিলেকট করুন ”

নদীর হাতে মেনু দিয়ে ছেলেটা চলে গেল। নদী মন মরা হয়ে পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছ
চারিদিকে মানুষ নিয়ে ভাবনা হচ্ছে। এমন জীবনগুলো কখনো কুৎসিত কিছু কি দেখেছে?এরা কি জানে, দুইদিনের আঠালো বাঁসীভাত খাবার স্বাদ কেমন? তার মতো মাঝরাতে শীতের কাথায় না পুশলে তোশকে ঘুমিয়েছে কেউ?

এই রাজসীক জায়গার প্রাক্তন মালিক পক্ষ হিসেবে এত ছোটলোকি ভাবনা হয়তো বেমানান। নদী চিন্তা ঘোরাতে খাবার মেনু দেখছে। অকল্পনীয় একেকটার দাম।পেস্ট্রি একেকটা চারশোর নিচে নয়, ইটালিয়ানো স্পেগেটি ওয়ান ইজ টু ওয়ান নাকি সাড়ে ছয়শো।সাড়ে ছয়শো! এগুলো বানায় কী দিয়ে?সোনা?

” Thank you for loving my little cafeteria so much. My dream would not have been big without your encouragemen… and I really appreciate that,

ভেতরের কোন ঘর থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে৷ নদী বেছে বেছে একটা দেড়শো টাকার পেস্ট্রি অর্ডার দিয়ে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেল।

অতীতে দেখা চোখ নিজের মতোই মাপঝোঁকে ব্যস্ত। কত বোকার মতোই না ভেবেছিল বাড়িটা বুঝি এখনও একাই দাঁড়িয়ে হাহাকার করছে, হয়তো হয়ে আছে পুরাতন পলেস্তারা খসে যাওয়া ভূতের বাড়ি। বাস্তব হলো এই শহরের বেনিয়ারা ভূতেদেরো পাত্তা দেয় না।লুকিয়ে আস্তানা গাড়লেও খেদিয়ে ভাগায়।

চচন্দ্রমল্লিকা আজ ঝলমলে একটা ক্যাফেটেরিয়া যেখানে আলোর নিচে কারো হারানো সময়, হারানো মায়ার স্থান নেই। নদী মনে মনে ভাবতে চাইলো তার টেবিলে যেই জায়গায় আছে, এই জায়গাটা সম্ভবত ছিলো বৈঠকখানা।
এত বড় ছিল কি? না ডাইনিংয়ের দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়েছে। তবে আজও ওয়াশরুমের বামপাশের দিকে চাপা একটা দরজা রয়ে গেছে । সার্ভেন্টস এন্ট্রি। এই দিকটা দিয়ে পেছনের উঠানে যাওয়া যেত। নদীর বুক কাঁপছে।

” বাবলু চল লুকোচুরি খেলি”

” না তুমি খালি ভয় দেখাও”

দরজা বরাবর চাপা করিডোর আজও আছে।যেটা সোজা নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে। আজও কি গাছে ঘেরা? নাকি নতুন মালিক সব কেটে ফেলেছে?ওখানের মাঝামাঝি তুলসি মঞ্চটা নেই হয়তো…নাকী আছে?

আশেপাশের উঁচু বাড়ির থেকে আসা আলো থেকে জায়গাটা দেখা যাচ্ছে আবছা। চারিদিকে গাছ ঘিরে ছায়া দিয়ে আছে আজও। তবে উঠোনের মাঝখানের জায়গাটা পানি চিকচিক করছে। পাথর দিয়ে বাঁধানো, ছোট কৃত্রিম সরোবর। যার মাঝামাঝি চলে গেছে একটা চিকন সিমেন্টের সেতু,সেখানেই ছিল তুলসিমঞ্চ..

” Ladies and Gentlemen, it is a gift of your love and support, that today Gabriels Cafe has become Gabriels Kitchen.”

চারিদিকে করতালিতে কানপাতা দায়।নদীর চোখে একরাশ ঝলসে যাওয়া আলো। এদিকে ঝিরিঝিরি পানিতে শরীর ভিজে যাচ্ছে। অসংখ্য জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে। সবার মুখে হাসি, চোখে কৌতূহল। নদী পাথর হয়ে রইল। পুরনো তুলসী মঞ্চের জায়গায় আজ একটা ফোয়ারা তৈরি করা। নদী সেই ফোয়ারার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে বোকার মতো । কৃত্রিম ছোট ঝিলটার চারিদিকে টুপি আর পোশাক পরা শেফরা বার্বিকিউয়ের কয়লায় আগুন ধরানোর কথা, তারাও ফোয়ারার মাঝখানে জীবন্ত মানবী দেখে চোয়াল ঝুলিয়ে তাকিয়ে । নদীর কী করা উচিত বুঝতে পারছে না।তার অর্ডার নেওয়া ওয়েটার ছেলেটাও দেখা গেল অদূরে হা করে আছে।

কিছুক্ষণ পর একজন বেশ লম্বা কমপ্লিট পরা মানুষ সাবলীলভাবে এগিয়ে আসতে দেখা গেল।মুখটা স্বাভাবিক যেন এমন হবারই কথা ছিল। মূলত সদ্য উদ্বোধন হওয়া ফোয়ারার মাঝামাঝি অতিথিকে উদ্ধার করতে এগোচ্ছে সে। কালো চুল, কালো চোখ, কিন্তু সাহেবদের মতো টকটকে রঙ। মুখে একটা আন্তরিকতার হাসি হলেও বোঝা গেল এটা বানোয়াট। সুক্ষ্ম বিরক্তি ঢাকতে অনেকেই এভাবে হাসে।

” সো শেল উই মুভ ম্যাম, আমার মনে হচ্ছে তুমি ভিজে যাচ্ছ”

এক হাত বাড়িয়ে স্পষ্ট আমেরিকান উচ্চারণে বলল মানুষটা।তবে কেন যেন নদীর কন্ঠস্বরটা চেনা লাগছে। নদী একটু দ্বিধা নিয়ে এগিয়ে গেলো,” আমি এখানে আসলে…”

” আসলে এখানে তুমি কী কড়ছিলে সেটা পড়ে জানবো,” নদী খেয়াল করলো যুবকটা কেমন টেনে টেনে বাংলা বলছে,সে নিচু গলায় আরও বলল’ ” আমার সাথে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে আসো
সবাই তাকিয়ে আছে, ব্যাপারটাকে আড় ইমবেরেসিং কড়ো না”

নদী চমকে গেল হঠাৎ তার মনে পড়েছে একটা বিষয় এই লোকটাকে সে চেনে আগেও দেখেছে। ফুড ফেস্টিভ্যালে চপ খেয়ে চাবির রিং উপহারদাতা, হ্যাঁ সেইই তো নাকি? তবে চমকের জন্য আরও কিছু বাকি ছিলো, ফোয়ারর সেতু থেকে নিচে নামতেই লোকটা সে ওয়েটার ছেলেটাকে ইশারা করলো, ” তুষার, প্লিজ দেখ কী সমস্যা, কী করছিল এবং কে, ”

” ও মেহেরোজ সাজ্জাদ! ও মাই গড ওয়াট আ প্লিজেন্ট সারপ্রাইজ! ”

নদীর সাথের সাহেব যুবকটাও অবাক হয়ে তাকিয়ে। সোহরাব হাসিমুখে সোজা
নদীর দিকে এগিয়ে আসছেন।

” বিশ্বাস করবে, কয়েকদিন ধরে আমি ভাবছিলাম তোমার কথা ”
নদী কিছু বলল না। তার সাথে সাহেব তাকিয়ে আছে ভ্রুকুটি করে।
সোহরাব সামদানী তার দিকে হেসে বললেন,”তোমার চিন্তিত হবার কিছু নেই রম্য, শি ইজ মাই গেস্ট, এ ভেরি স্পেশাল গেস্ট ”

” ইউর গেস্ট ইজ এ জেম ফর আস”

গ্যাব্রিয়েল সামদানী রম্য শীতল কন্ঠে উত্তর দিলো। তার বাবার চোখের চকচকে নেশাটা সম্পর্কে সে অপরিচিত নয়। এইজন্য অস্থিরতা দমন করা কষ্টকর। শুভদিনে এমন কিছু যেন অমঙ্গলের বার্তা আনে। বাতাসে ভেসে আসে অশরীরীর হাসি…

” ওয়েলকাম টু চন্দ্রমল্লিকা মাই কুইন ”

(চলবে)
#শারমিন_আঞ্জুম