বাতাসে তার সৌরভ পর্ব-০৯

0
198

#বাতাসে_তার_সৌরভ–৯

এইশহরে এভাবে ঝিঁঝি পোকার ডাক সহসা শোনা হয় না। তবে লিয়েনা শুনতে পাচ্ছে। এই বাড়ির তিন তালার বেডরুম সংলগ্ন অর্ধ গোলাকৃতির ঝুলবারান্দা আছে।যেটার পুরাটা ঘিরে আছে বিশাল একটা কাঠগোলাপ গাছ। মুলত এইবাড়িফ ব্যাকইয়ার্ড পুরোটা অংশেই গাছ ঘেরা। দিনের বেলাও ছায়া দিয়ে রাখে। এইজন্যই রাতে ঝিঁঝিপোকার অভয়ারণ্য। গাছের পাতার ফাঁকে পঞ্চমীর ফর্সা আকাশটা দেখা যাচ্ছে। ডিনার সেরে বারান্দায় মুগ্ধ হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য হলো লিলিয়েনা। জোছনার সাথে ঝিঁঝিডাকা রাত,তার সাথে অসম্ভব রহস্যময় একজন ! একাবারে একান্তে!!বুকটা কেঁপে ওঠে থেকে থেকে।

“লিলি, এই নাও;লেমনেডে আশা করি একটু ভালো লাগবে”

পেছন থেকে গ্যাব্রিয়েল একটা গ্লাস এগিয়ে দিলো। লিলি আড়ষ্ট হেসে গ্লাস হাতে নিলো।
গ্যাব্রিয়েল হাসিমুখে বলল, আমি কিন্তু জানতাম না যে তোমার অভ্যাস নেই।

” আমি কী জানবো বল, রেডগ্রেপ জুস ভেবে মুখে দিয়েছিলাম, এখনো মাথাটা কেমন ঘুরছে”

” সমস্যা নেই, একটু রিল্যাক্স কর,আমি নিজে ড্রাইভ করে তোমাকে দিয়ে আসবো ”

লিলি হঠাৎ যেন চমকে উঠলো, ” আরে তাই তো গ্যাব্রিয়েল, কটা বাজে বলতো? দশটার ওপরে নয় নিশ্চয়ই ”

” টেন ফিফটি ”

” মাই গড! এখন তো ঝামেলা হয়ে গেল! আমার ল্যান্ডলর্ড তো গেটই খুলবে না”

গ্যাব্রিয়েল অবাক, ” গেট খুলবে না মানে? কেন খুলবে না?

” হাউজ রুলস খুব কড়াকড়ি। একা ব্যাচেলর মেয়েদের সময় মতো রাতে না ফিরতে হবে নয়ত..”

” অদ্ভুত রুল ”

” এইদেশে মেয়েদের জন্য সব রুলসই অদ্ভুত।”

” কোন রিলেটিভ বা ফ্রেন্ডের এড্রেস তো আছে … ”

” সব ভ্যাকেশনে,শুধু আমিই যাইনি।থেকে গেছি তোমার ইনভাইটেশন এর জন্য ” ভারসাম্যতা রাখতে লিলিয়েনা ঝুঁকে এলো গ্যাব্রিয়েলের দিকে,” সব তোমার দোষ।এত্ত অসাধারণ ডিনার রেডি করেছ তার ওপর এত সুন্দর কথা। তোমার সাথে সময়ের জ্ঞানই থাকে না আমার।দেখ কত বড় বিপদে পড়ে গেছি ”

“আমি তোমাকে বিপদে পড়তে দিলে তো “লিলিয়েনা শরীরের সম্পূর্ণ ভারটা ছেড়ে দিয়েছে গ্যাব্রিয়েলের উপর। ভেতরের বৈরাগী রম্যের মন হুটকরে বিদ্রোহী হচ্ছে,তাকে দ্রুত সামলে গ্যাব্রিয়েল বলল, ” তুমি আগে একটু ফ্রেশ হয়ে নাও মুখ-হাত ধুয়ে ফেল,আমি ভেবে দেখি কী করা যায় ”

” কী করবে? “লিলিয়েনা ঠোঁটে আহবানের হাসি যা পৃথিবীর সব জাতীর পুরুষেরই বোধগম্য।

-” পরিস্থিতি বলে দেবে,হোপ ইউ ওন্ট মাইন্ড ” গ্যাব্রিয়েল হেসে গাঢ় গলায় বলল,” এখন একটু ফ্রেশ হয়ে এসো। গৃহকর্তার অনুচ্চারিত অনুমতিতে লিলিয়েনা ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো।

আজ ডেটে গ্যাব্রিয়েলের ফ্ল্যাটে ক্যান্ডেল লাইটে ইংলিশ ডিনারের আয়োজন ছিলো। লিলিয়ানা দেখে যাকে বলে বাকরুদ্ধ। লাইটিং টেবিল ড্রেসিং খাবার পরিবেশ এবং খাবার সব কিছু অসামান্য। সবই নাকি গৃহস্বামীর নিজে হাতে তৈরী। বাঙালি মেয়েদের জন্য এটা একেবারে অবিশ্বাস্য। লিলিয়েনা যারপরনাই আচ্ছন্ন।

খাওয়া শেষে গ্যাব্রিয়েলও সুচারু ভাবে টেবিল গুছিয়ে রাখতে রাখতে নিজের চিন্তাও গুছিয়ে নিচ্ছে। বুকটা অন্য উত্তেজনায় কাঁপছে। তিনবছর পর কোন নারীসঙ্গ! এমন নয় যে কনজারভেটিভ কান্ট্রি বলে তার জন্য কোনো অভাব হয়েছিল।এখানে গোড়ামি গুলো সব ওপর ওপর। তাই সমস্যা সেটা ছিল না। তবে কোন ইমোশোনাল অ্যাটাচমেন্ট ছাড়া রম্যর আগাতে বাধো বাধো ঠেকেছে।

ছয়মাস আগে লিলিয়েনা মেয়েটার সাথে পরিচয় হয়েছিলো কক্সবাজার থেকে ঢাকা আসার ফ্লাইটে। চিটাগংয়ের মেয়ে ঢাকায় একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে এমবিএ করছে। মিষ্টি, সরল। শুরুর কয়েকমাস সোশ্যাল নেটওয়ার্কেই যোগাযোগ ছিলো হাল্কা টুকটাক চ্যাট। রম্যের রেস্টুরেন্টের ব্যস্ততার মাঝেও উত্তর দিতো।বিশেষত্ব হলো দশটা বাঙালি মেয়েদের মতো বানোয়াট ন্যাকামির অভ্যাস নেই। আর দশজনের মতো এই দেশ আর সংস্কৃতি নিয়ে তাকে লম্বা লম্বা লেকচার দেয়নি, বা ফ্যামিলির কালচার নিয়ে গপ্প জুড়ে দেয়নি। এইদেশের মানুষের এইসব প্রবণতা গুলো মাথা ধরিয়ে দেয় গ্যাব্রিয়েল ওরফে রম্যের।

একাকিত্বর সময় যখনই দেখা করতে চেয়েছে মেয়েটাকে এভেলেবল পেয়েছে। একসাথে বিভিন্ন জায়গায় ফুড ব্লগিংও করেছে।রম্যের বেশ ফানিই লেগেছে। কথায় কথায় অন্তরঙ্গতা আরও বেড়েছে সান্নিধ্যের উষ্ণতায় ভিন্নমাত্রা দিলে মন্দ হয় না। বাবার কথাই হয়তো ঠিক, মিশেল তার জমজ মেয়েকে নিয়ে খুশি তাহলে রম্যের দেবদাস বনে থাকার অর্থ হয় না

একান্ত আলাপে লিলিয়েনা কতটা সাবলীল সেটাও দেখা যাক, আমেরিকান পুরুষ হলেও ব্রহ্মের এখানে অভিজ্ঞতা একটু সীমিত। অন্তরঙ্গতা মানে শুধুমাত্রই মিশেল।তবে জেনুইনলি মেয়েদের চেনার থিওরিতে তার জমজ অর্ণবের কিছু অদ্ভুত ইম্প্রাভাইজেশন আছে —

‘মিষ্টি কিউট ব্যবহারের মেয়েরা বেসিক্যালি কত সুইট সেইটা বোঝার সহজ উপায় হলো লিপস্টিক , কাজল ,
নেইলপলিশ দেবার সময় হাল্কার উপ্রে তাকে একটা ধাক্কা দিবি; যদি সেই সুইট ,ইনোসেন্ট, কিউট বান্দি মুহূর্তের মধ্যে ভ্যাম্পায়ার হয়ে তোর রক্ত খেতে চলে আসে, তাহলে বুঝবি এই মেয়ে নর্মাল। না আসলে বুঝবি কিছু গড়বড় আছে ডাইনী বা জ্বিন পরি’

রম্য অনির কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। সাতাশ বছর বয়সে আঠেরো নম্বর সিরিয়াস গার্লফ্রেন্ড যার, তার বাক্য নেহাৎ ফেলনা নয়।তবে লিলিয়েনার সুইটনেস টেস্টিং করা হয়নি।আর মনে হয় হবেও না। লিলির আহবানে ভেতরের পুরুষটা জেগেছে অনেক আগেই। কিন্তু দ্বিধাও আছে সাব-কন্টিনেন্টাল মেয়েদের ভনিতা অনেক বেশি থাকে।
অনির মতে মেয়েরা নাকি আহলাদি করে ভয় ভয় দেখায়। তুই ফার্স্ট এপ্রোচে টের পেয়ে যাবি কার ভেতর রাক্ষসী লুকানো!
তবে হ্যাঁ কিপ ইউর মাউথ ফ্রেশ। আগে জিজ্ঞেস করিস এডাল্ট কি না। আর তোর পেটে গ্যাস আছে কি না। গ্যাস থাকলে আগেই বাথরুমে খালি করা ভালো। এটা তোর বউ নয়, যে যেখানে সেখানে ছেড়ে দিবি। বেটার কন্ট্রোল নয়তো কিসের জায়গায় কিক জুটবে। ”

শয়তানের উদ্ভট থিওরি ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢোকার মুখেই শয়তান হাজির।রম্য মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হলো ক্যালিফোর্নিয়ায় এখন ভোর সকাল এখন হঠাৎ?.

” কী রে ঘুম হয় নাই? ”

” টাইগার শিকারে নামবে আমার ঘুম হয় কী করে? ”

“মানে কী? ”

“মানে ওই জিনিস কি নাম লিলি, সে বিদায় হয়েছে? ”

রম্য একটু হোঁচট খেলো যেন, মনে করতে পারলো না অর্ণবকে এই বিষয়ে বলেছিলো কি না।
” চুপ কেন বল?”

” আছে, ভুল করে ওয়াইনে মুখ দিয়ে ফেলেছিল। একটু শরীর খারাপ করেছে”

“শরীর খারাপ মাই ফুট,অতি দ্রুতই ঝামেলাটাকে বের কর। ”

” মানে? ”

“মানে এটা তোর শান্তির আজরাইল অতিদ্রুত এটাকে বের কর ”

রম্য ভাইয়ের কথা কিছুই বুঝল না।
সন্দেহ হলো রাতের হাংআউট হয়তো এখনো কাটেনি। রম্য ভাইকে জেরা কর‍তে করতে নিজের বেডরুমের দিকে উঁকি দিলো।লিলিয়েনা এখনো বের হয়নি?

লিলিয়ানার পা উত্তেজনায় কাঁপছে। সত্যি সত্যি সব কিছু পরিকল্পনা মতো হচ্ছে, যা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সে এখন সত্যি গ্যাব্রিয়েল সামদানীর বেডরুমের দাঁড়িয়ে। লিলিয়ানা জানে এখন কী করতে হবে। দ্রুত নিজের পার্সব্যাগটা বেডসাইড টেবিলে সেট করলো। ছোটো চেম্বার থেকে কায়দা করে ভাঁজকরা লেস দেয়া সিল্ক স্লিপিং শেমিজটা নামিয়ে বাথরুমের হ্যাঙারে ঝোলালো। তার সামনে গারো নীল জাকুজি। পাশের কাঁচের তাকে সুগন্ধি ক্যান্ডেল। এই দৃশ্যে মোহিত না হয়ে তাকে আগে একটু মুখের মেকাপটা ঠিক করতে হবে । পারফিউমটা শরীরের খাঁজে আরেক দফা স্প্রে করে নিতে নিতে মনে হলো আয়নায় কালচে কোন ছায়া সরে গেল। লিলিয়েনা ঘুরে তাকালো। কেউ নেই।বাথরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে বাইরের কোন চলমান গাড়ির আলো পড়েছে হয়তো। আয়নায় ঝুঁকে গেল আবার, বুকের ভেতর বল্কে ওঠা ঢেউ। গ্যাব্রিয়েল!

খুব ভালো মতো খোঁজ খবির নিয়ে এগোনো একটা ক্যাচ। আমেরিকায় মেক্সিকান মায়ের রেস্টুরেন্টের ব্যবসা আর সুপারশপের ব্যাপার তো বাদই দেয়া হলো। একটা ভাই আছে তবে নিজের মতো। কিন্তু সমস্যা হলো একান্ত সময়ে এই ছেলে শিং মাছের মতোই পিছলে যায়। অনেকে গেও বলে।

আজ তার সত্যতাও প্রমাণ হয়ে যাবে।গুছিয়েক এসেছে লিলিয়ানা। গ্যাব্রিয়েলের রান্নার প্রশংসা করে করে একেবারে তার নিজের বাড়িতেই আমন্ত্রণ আদায় করেছে ।
নিচে রেস্টুরেন্টের লোকজন সবাই আজ দেখেছে তাদের বসের অতিথি কে। কাজেই এই প্রমাণ তো আছে তার সাথে আরও সিকিউরিটিও আছে। লিলিয়েনা দ্রুত নিজের মেকাপ নিখুঁত করে হ্যাঙারের দিকে গেল। জাকুজি দেখে লোভ লাগছে তবে এখন নয় গ্যাব্রিয়েলকে সহ টেনে নিয়ে যেতে হবে এখানে..!

বাথরুমের হ্যাঙারে শেমিজ নেই। অবাক কান্ড! একটু আগেও এখানেই রেখেছিলো এখন কোথায়..! লিলিয়ানার হঠাৎ মনে হলো তার পেছন থেকে সাবধানে কেউ সরে গেল।সূক্ষ্ম কিন্তু তীক্ষ্ণ একটা অস্তিত্ব।

ঘুরে তাকাতেই কেউ নেই। বাথরুমের আলো হঠৎ নিভু নিভু হয়ে হুট করে জ্বলে উঠলো কয়েক মুহূর্তের জন্য।
এরমধ্যে লিলিয়ানা তার শেমিজ আবিষ্কার করলো। তবে অন্য কারো পরনে।
******
” মানে কী বলছিস তুই।? “রম্যের কন্ঠে অবিশ্বাস।

” যা বলছি ঠিক বলছি রোমিও। সে আছে কোথায় এখন?”

” বাথরুমে ফ্রেস হতে গেছে”

“গুড ওর পার্সব্যাগটা চেক কর ”

রম্য বিরক্ত হলো,” অনি দিস ইজ ক্রেজি ”

” রমি আমি বেইসলেস কথা বলি না। এই মেয়ে দুইদিন আগে সিক্রেট ক্যামেরা কিনেছে সেটা দেখতে বাটনের মতো। ”

” অনি তুই এখন বলিস না যে তুই এই মেয়ের একাউন্ট হ্যাক করেছিস ”

” ভাইকে রক্ষা করা পূণ্য কাজ! তুই ইদানিং এত ইন্টারেস্ট নিচ্ছিলি।ভাবলাম একটু খোঁজ নেই ”

” অনি তুই..

” ওর সব প্ল্যান আমার জানা, তোরই বাসায় তোকে আজকে সিডিউস করে কিছু দিন পরেই বিয়ের চাপ দেবে। নয়তো তার ফুটেজ তো আছেই বলবে মদ খাইয়ে তুই তাকে রেই*প করেছিস অর্থাৎ দেয়ার ইজ নো ওয়ে আউট ”

” ও নো ”

” ওহ ইয়েস মাই বেইবি ব্রো। আমাদের গ্রেটেস্ট ড্যাডের দেশ বিশিষ্ট চিট ফ্রডের ভান্ডার”

রম্য কথা বলতে বলতে লিলিয়ানার ব্যাগের ওপরই চাকতির মতো একটা ডিভাইস সাটানো দেখলো। রম্য দ্রুত ভাবছে কি করবে,
” কি আর করবি এই মালকে রেখে ফ্ল্যাটে দরজা দিয়ে চলে আয় একা থাকুক ”

” পাগল এটা আমার বাড়ি”

“না আ আ এটা আমার বাড়ি”

ভারী গমগমে কোন নারীকন্ঠ ঘরের জানালা কাঁপিয়ে দিলো।

” ভূউউউউত! ”

রম্য ঘুরে তাকালো বাথরুমের দরজা খুলে লিলিয়েনা চিৎকার করে বেরিয়ে এসেছে। রম্যকে জড়িয়ে ধরে বিকার গ্রস্থের মতো চিৎকার করছে।

” মাথা কাটা ভূত! আমার শেমিজ পরে বসে আছে! মাথা কাটা ভূ ভূ ত জাকুজিতে বসে আছেন..”

রম্য দ্রুত বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল। কোথাও কেউই নেই।ঘরে ফিরে দেখলো কিছুক্ষণ আগের নেশায় ঢুলতে থাকা লিলিয়েনা দ্রুত তার পার্সব্যাগ গোছাচ্ছে।

” আরে কোথায় যাচ্ছ”

” বাসায় ”
” তোমার বাড়িওয়ালাতো ঢুকতে দেবেনা ”
” সেটা আমার হেডেক তোমার ভাবতে হবে না “লিলিয়ানা দ্রুত তার পায়ে জুতা গলালো।

” কিন্তু তোমার তো শরীর খারাপ”

” ভূতের ভয়ে মরে যাওয়া তার থেকে বেশি খারাপ ”

**********
এডমিশনের দুই সপ্তাহ পরেই নদীর ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। তার নতুন ক্যাম্পাসের প্রাইভেট ভার্সিটির ঝকমকে ঠাটবাট নেই, সরকারি ছাপোষা পুরনো বিল্ডিংয়ে ক্লাস হয়। একটাই আরাম সব কিছু খোলামেলা আর বেশ বড়।সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে বিশাল ক্যাম্পাসে এসে হঠাৎ হঠাৎই দিশাহারা লাগে।তবে যার কেউ নেই সে হারিয়েই বা কোথায় যাবে ভেবে সহজ হয়ে যায় নদী।

নদীকে রেখে বড়োমামা ফিরে যাওয়ার পর শুরু দিকে নিয়োমিত ফোন দিলেও সেই কল এখন সপ্তাহে একবার গিয়ে ঠেকেছে। স্বার্থ সংসারের জাল আপাত মায়াকে ম্লান করে দেয়। সোহরাব সাহেবও আমেরিকা চলে যাবার আগে দেখা করতে এসেছিলেন,

“কিছু হলো না প্ল্যান মতো। ছাপোষা একটা সাবজেক্টে ভর্তি হলে। রাবেয়া আর আমি ভেবেছিলাম আরো কোথাও চেষ্ট করব।তোমাকে রম্যের সাথে ভালোভাবে পরিচয় করিয়েও দেয়া হয়নি।”

” অসুবিধা নেই আঙ্কেল আমার ওদিকে আর হয়ত যাওয়াও হবে না”

” অবশ্যই যাবে,যখনই ইচ্ছে হবে তবে আগে পড়ায় ফোকাস কর। ইউ হ্যাভ টু লং ওয়ে টু গো গার্ল, সমস্যা হলে রাবেয়া তো আছেই সে খেয়াল রাখবে তোমার”

কথাগুলো ভরসার হলেও সোহরাব সামদানীর কাছ থেকে শোনা কাম্য নয়৷ নদীর বাবার চাচাতো বোন রাবেয়া যেন কিছুটা ছাড়া ছাড়া। প্রতুত্তরে নদীরো দ্বিধা। তাই নাম্বার থাকলেও কেন যেন আগবাড়িয়ে ফোন দিতে ইচ্ছে করেনি। অগত্যা নিজে নিজেই অচেনা শহরটাকে চিনতে লেগেছে। ঝিকাতলা থেকে আজিমপুর ক্যাম্পাস সাথে নিউমার্কেট, নীলক্ষেত এই তার তিন চার মাসের শহরের চেনা গন্ডি।

শুরুতে খুব যে রুটিন করে ঝড়েরগতিতে হয় তা না, তবে ধীরগতিতে নিয়োমিত হয়। নদীর শুরু শুরু দিকে তেমন কারো সাথে বন্ধুত্ব করা হয়নি। সরকারি ক্যাম্পাসে বড়োলোকের সন্তানরা পড়ে না বলে একটা ভুল ধারণা আছে। সাধারণ ছাপোষা মেয়েদের মাঝেই দামী দামী গাড়িতে হিল খটখটিয়ে পুতুল পুতুল মেয়েরা আসে। কলকল করতে করতে ক্লাসে ঢোকে। যেন এই ক্লাস তাদের জন্য নতুন কিছু না ।এই মেয়েগুলো তাদের ব্যক্তিত্ব আর পোশাকের বলে রাজ-রানীর মতো ঘুরে বেড়ায় অন্য মেয়েদের করুণার চোখে তাকায়। বাকি মেয়েরা এদের আচরণের জন্য নাম দিয়েছে ভি আই পি।

শহুরে মেয়েদের মাঝে একটু নদী ম্লানই ছিলো।তবে এটা তার জন্য খুব একটা বিব্রতকর নয়। তার অবস্থান ভাদড়াতেও যে খুব ভালো ছিলো বলা যায়না। তবে সুখের কথা হলো তার মতো বেচারা দর্শন দিশেহারা বান্দির অভাবও নেই।

আলাদা আলাদা পৃথিবী থেকে আসা নানান রকম চরিত্র।মনের অজান্তেই মানুষ নিজ নিজ গোত্র খুঁজে দলবন্ধ হয়েই যায়। একসময় নদীও হলো।তার দুজন সঙ্গীর একজন নারানগঞ্জের তৃষা যার আড়ালে নাম হলো একেভি। একেভির অর্থ তৃষা বুঝতে পারেনি, তবে নদী বের করেছে “এক কাপড়ের ভিখিরি।” তৃষা একটা তাতের থ্রি পিস দিনের পর দিন পরে অবলীলায় ক্লাস করে যায়।

আরেকজন হলো নেত্রকোনার মেয়ে
“তনিমা তানজিম আক্তার সুবর্ণা”। মূলত এই মেয়েটাকে ক্লাসের প্রথম কয়েকদিন যতজন তার নাম জিজ্ঞেস করেছে, সে টেনে টেনে বাচ্চাদের মতো পুরোনাম বলেছে। তাই এখন থেকে ক্লাসের ফাজিল মেয়েগুলোও সুর করে তাকে পুরো নাম ধরেই ডাকে।নিজের নাম শুনেও কেউ বিব্রত হতে পারে তা সুবর্ণাকে দেখলে বোঝা যায়। নিরীহ এই দুজনের সাথেই নদী একটু সহজ ভাবে কথা বলতে পারে। তবে খুব দ্রুত সে জানলো যে এই দুজনের সাথে তারও একটা নাম দিয়েছে ক্লাসের এই ভি আই পি গ্রুপ।

গতকাল ক্যাম্পাসের ক্যানটিনে বসে নদী ক্যামিস্ট্রির একটা লেকচার তুলছিলো। তৃষার শরীর ভালো না আগেই চলে গেছে। সুবর্ণা সেদিন আসেইনি। নদীর বসা টেবিলে ভি আইপিরা হুট করে এসে জাঁকিয়ে বসলো। দামী পারফিউম আর ডিজাইনার বুটিকের জামায় নজরকাড়া একেকজন।ইংরেজির বার্ডস ওফ ফেদার ফ্লক টু গেদার বাক্যটা এদের ক্ষেত্রে খুব মানানসই। নদী একক্লাসের হয়েও এদের সমীহ করে উঠে অন্য টেবিলে বসলো তারা খেয়ালও করলো না। নিজেদের মধ্যেই কী একটা বিষয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ এর মধ্যে একজন এলো তার টেবিলের দিকে, হাতে একটা ছোট বিরানির প্যাকেট ।

” ধরো মেহরোজ। শায়রীর বার্থডে তো এইজন্য পাঠালো দোয়া করো ওর জন্য কেমন? ”

নদী অবাক। এই ঝকঝকে রাজকন্যাদের মধ্যে শায়েরি কে চিনলো না।কিন্তু বিরানির প্যাকেটটা দেখে দুপুরের মরে যাওয়া খিদেটা আবার চাগাড় দিয়ে উঠলো ।মাসের মাঝখানে হাতে টাকা আছে সারে ছয়শ।বড় মামা টাকা পাঠাতে আর দুই সপ্তাহ।এদিকে নিশিরটার চাকরি নেই সারা দিন ঘরে পড়ে থাকে।খাওয়া বলতে কোন আর নুডুলস সেদ্ধ। খুব টিপেটিপে খরচ করতে হয় । এই প্যাকেটটা তাকে স্বর্গসুখ দিলো। নদীর মনে হলো মেয়েগুলোকে অন্যমেয়েরা যতটা খারাপ ভাবে ততটা হয়তো নয়। কেউ সুন্দর বা বড়োলোকের মেয়ে হলে নিশ্চয়ই সেটা তাদের দোষ নয়। বাকি মেয়েরা আসলে হীনমন্যতায় গুজব ছড়ায়। নোট শেষ করে মুখ-হাত ধুয়ে শায়েরি মেয়েটাকে খুঁজে শুভ জন্মদিন বলার চিন্তা ছিলো,

” বিরানির প্যাকেটটা দিয়েছিস? ”

” হ্যাঁ নিয়েছে”

” যাক ভালো হয়েছে, মানত ছিল, কিন্তু গেটের বাইরে কোন ভিখিরিই পেলাম না। আলুভাতেটাকে দিয়ে দিলাম ”

” খুশীই হয়েছে মনে হলো, ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছিল বেচারির স্যান্ডেল জোড়া দেখেছিস?

” হ্যাঁ একেবারে মহেঞ্জোদারো সভ্যতা থেকে উদ্ধার করা পাদুকা।”

” সাদকার সাথে গাউসিয়া থেকে একজোড়া জুতো কিনে দিলে হতো, আরও বেশি দোয়া দিতো তোকে হি হি হি ”

তারা দুজন দরজার বাইরেই ছিল, নদীকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। নদী বাথরুম থেকে বের হলো যেন কিছু হয়নি। কিছু শোনেনি।ক্যন্টিনের টেবিল থেকে ফাইল তুলে নেবার সময় একমুহূর্তে ইচ্ছে করছিল প্যাকেটট সেখানে ফেলে আসে। কিন্তু আত্মসম্মানের আঘাত আসলে পেটের খিদের চাইতে বেশি কষ্টদায়ক নয়।
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া স্বরূপ মাঝরাতে বাথরুমের দরজা ধরে নিশি বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো।
” নদু, তুই মুখে আঙুল দিয়ে বমি করছিস কেন?”

নদী উত্তর দেয়নি। নিশিও ঘাটায়নি। লবঙ্গ এগিয়ে দিয়েছে। -চাবিয়ে খা ভালো লাগবে।

আজকাল লবঙ্গ নিশির হাতের কাছেই থাকে। ঘরে বসে সারাক্ষণ লবঙ্গ চাবিয়ে যায়।বান্দরবান থেকে ফিরেই তার কোন সমস্যা হয়েছে, ঘরে ঝিম মেরে বসে থাকে।খাওয়া-দাওয়ারও কোন ঠিক ঠিকানা নেই। নদী নিজে টুকটাক রান্না করে কিন্তু নিশি দেখা যায় তেমন কিছুই খায় না। নিশির বাঁসিটা ফেলে না দিয়ে পরের বেলা নদী নিজে খেয়ে ফেলে। রাফিনকে নিয়ে প্রশ্ন করলে ক্ষেপে যায় নিশি। সম্ভবত ব্রেকাপ হয়েছে, যাক এই জিনিস মাথা থেকে নেমেছে এটার জন্যই নদী বেশ খুশি। বিরহ বাড়াবাড়ি উঠলে নিশি ছাদে গিয়ে এক ধ্যানে বসে থাকে। সেই রাতে নিশির সাথে নদীও ছাদে থম ধরে বসে রইলো। ওপরে পঞ্চমীর চাঁদের আকাশ, ঘুমিয়ে যাওয়া পাথুরে শহরের কোথাও কোথাও টিমটিমে আলোগুলোকে কেন যেন খুব নিষ্ঠুর লাগে।

ভোরে হুট করে নিশি ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলো তার নাকি মর্নিংওয়াক করতে ইচ্ছে হচ্ছে একা বের হতে ভয় লাগছে। নদীকে যেতে হবে। কলেজ বন্ধের দিনে নদীর হাতে কাজ জমে থাকে কাপড় ধোয় ঘর গোছায়, বাজার করে এবং বক্স বন্দী করে ফ্রীজে তোলে। নিশিটা ফ্রিজ আছে বলে এই বিষয়ে রক্ষা। কিন্তু নিশির মাথায় জারি উঠলে ঘ্যানঘ্যান থামবে না সহজে। বাধ্য হয়ে সাতটার সময় বের হতে হলো।তবে বের হয়ে মন ভালো হলো, ঢাকা শহরে ভোরবেলাটা স্নিগ্ধই নিরহই লাগে।

তবে নিশির আচরণ একটু যেন অদ্ভুত।
“বুঝলি নদু এখন থেকে রেগুলার আসতে হবে৷ আজকাল সকাল বেলা ঘরে থেকে সাফোকেটেড লাগে এখন থেকে রোজ আমরা মর্নিং ওয়াকে আসবো ”

” আমার এত তেল নাই, এরপর তোর ইচ্ছে হলে তুই একা আসবি “নদী মুখ গোমড়া।

” আরে রাগ কিসের বাবা কাল থেকে দেখতেসি ঝিম ধরে আছিস ”

” রাগ করার যোগ্যতাও আশ্রিতদের থাকে না” নদী বিড়বিড় করে বলল।

“কী বলিস সমস্যা কী? ”

” পার্টটাইম জব, চাকরি লাগবে। আমার স্যান্ডেল দেখেছিস? মিউজিয়ামে পাঠালে একশো বছরের পুরনো ভেবে রেখে দেবে ”

” আমারটা পর ”

” তোরটা হয় না আমার, যাক আর না হাটি বাসায় চল! নয়ত যেটা আছে সেটাও ছিড়বে, বন্ধের দিন নাস্তা রেডি করে কাপড় ধুতে হবে”

” একটা জায়গায় তোর চাকরির খোঁজ দিতে পারি আমি “নিশি রহস্য নিয়ে বলল।

” ফাজলামি ভালো লাগছে না নিশি ”

” সত্যি আমি সত্যিই একটা জায়গা চিনি যেখানে তোর মনে হয় হবে কিন্তু তার জন্য এফোর্ট দিতে হবে ”

দুই বোন হাঁটতে হাঁটতে রবীন্দ্র সরোবরের পাশ কাটিয়ে একটা গলিতে ঢুকেছে।

” কোথায়? ”

নিশি বলল, সামনের বাঁ সাইডের দেয়ালে মুখ করে দাঁড়ানো ছেলেটাকে দেখছিস।নদী একঝলক দেখে মুখ বিগড়ে ফেলল।এই জিনিসগুলো নিশির আমোদের বিষয়, নদীর দেখা রুচিতেও আসেনা। এই শহরে এমন দেয়ালের সৌন্দর্য দেখা পুরুষের অভাব নেই। ধনী-গরিব শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে অতি উচ্চ পর্যায়ের বোদ্ধা তারা। হাল্কা হতে হতে মুগ্ধ নয়নে দেয়ালের সৌন্দর্য অবলোকন করেন।

নিশি বলল, ” এই লোকটাকে যদি পেছন থেকে পা*ছায় কিক করে স্কিপ করতে পারিস আমি সেখানে নেব যেখানে তোর চাকরি হবে ”

“নিশি রিকসা ধরি অনেক প্যাচাল পাড়সিস ”

” পারলে সত্যি কিন্তু নিতাম তবে বাদ দে তুই হলি লুজার ক্যাটাগরির জিনিস, কাবাব জুটবে না আলুভাতে সুখী থাক ”

নদীর মাথায় কী যেন একটা হলো, অদ্ভুত একটা তপ্ত ঘোর তাকে অন্ধ করে দিলো। চোখ মুখ শক্ত করে হেঁটে গেল প্রাকৃতিক সাড়াদানকারী যুবকটির কাছে।মানিপ্ল্যান্টের ঝাড় ঘিরে থাকা দেয়ালের সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে গাইছে একটা চলতি হিট হিন্দি গান —

” কামারারিয়া হিলা দে হিলা দে হিলা দে…”

********
সারারাতে ঘুম না হবার পরেও ভোর সকালে জগিংয়ে উঠতে রম্যর মিস হলো না। শরীরের ব্যাপারে নিয়মানুবর্তিতা তার সব সময় পছন্দ। তবে রাতের ঘটনায় ভেতর থেকে ক্লান্ত আর কিছুটা বিরক্ত।

ঘটনার আকস্মিকতায় মন্দের ভালো যে ঝামেলা সহজে কেটে গেছ্র। মৃদু বোঝানোর চেষ্টা করলেও লিলিয়েনা দেখা গেল ভালো ভয় পেয়েছে। বাধ্য হয়েই তাকে রাতে তাদের বাড়ি নামিয়ে দেয়া লাগলো।তাকে নামিয়ে ফিরতে ফিরতে আড়াইটা বেজে গেল। রম্যের মনে অদ্ভুত মিশ্র অনুভব। একটা ফ্রডের হাতে বেচে গেল বলে কি তার খুশি হওয়া উচিত নাকি,বানোয়াট ভূত সরাসরি তার ঘরে ঢুকেছে বলে আতঙ্কিত হওয়া উচিত ঠিক বুঝতে পারছিল না। বাড়ি ফিরে দেখলো ঘরের সবকিছুই ঝকঝকে-তকতকে কোথাও কারও উপস্থিতি নেই।বাবা সোহরাব ঢাকাতেও নেই।বাড়িটা ছমছমে লাগছিল। অর্ণব অনেকক্ষণ লাইনে থেকে কথা বলে গেছে কিন্তু তারও অফিস থাকায় সেই ফোন ছাড়তে হলো। রাতে ছাড়া ছাড়া ঘুমে মাথা ধরে এলো।

সকালে উঠে কফি মুখে দিয়ে মনে হলো বিষয়টা বানোয়াট। ধানমন্ডি লেকের পাশ দিয়ে জগিং করতে করতে দিনের আলোয় সবই কেমন খেলো লাগছে। মনে মনে নতুন করে বিষয়গুলো আতশি কাচের নিচে রাখছিলো রম্য।

লিলিয়েনার ভাষ্যমতে তার স্লিপিং সেমিজ পরে একটা কিশোরী মেয়ে জাকোজির মাঝে-মাঝে বসে ছিল। হঠাৎ মেয়েটা তার মাথা ঘাড় থেকে আলাদা করে তার কোলে নামিয়ে নিলো।দৃশ্যটি অস্বাভাবিক আতঙ্কের তবে কোথাও যেন একটু হাস্যকরও। তার ওপর ভূতের না হয় কোন শারীরিক অস্তিত্ব নেই, কিন্তু লিলির শেমিজটার তো আছে। মেয়ে ভূত শেমিজটা পরবে কেন? আর এই বাথরুমে তারা ঢুকলো কীভাবে?

জাকুজির পানি ভরাট ছিল। লিলি সেখানে নামেনি, তার গা ভেজা ছিল না, কিন্তু মেঝে ভেজা ছিল তার মানে কেউ অবশ্যই নেমেছিল যে মানুষ। রাতে ভালমতো খেয়াল করেনি নয়তো পায়ের ছাপ পাওয়া যেত। কিন্তু প্রশ্ন হলো বাথরুম থেকে সে উধাও হলো কী করে? মৃদুগতিতে রম্য বাড়ির কাছাকাছি এলে হঠাৎ মনে পড়লো বাথরুমের ক্যাবিনেটের পেছনে আরেকটা দরজা সেট করা।

বাড়িটা প্রায় পয়ষট্টি বছরের পুরানো। পুরনো দিনের বাথরুমের ডাবল ডোরের ব্যবস্থা থাকতো যেন অন্য রুম থেকেও বাথরুম ব্যবহার করা যায়।তামান্না আধুনিক ডিজাইনের ক্যাবিনেট করার সময় এটা রিমুভ করতে চেয়েছিল। তবে সোহরাব সাহেব নিষেধ করলেন।।
দরজাটাকে কেবিনেট দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো।এই বাড়ির পেছন দিকে সার্ভেন্টস এট্রি। যেটা নিচ থেকে সিড়ি দিয়ে উঠে গেছে তিনতালা পর্যন্ত। যেটা তামান্না ডিজাইন করার সময়ই দেখিয়েছে। তার মতে নিরাপত্তার জন্য এমন একটা এন্ট্রি রাখা দরকার।

সম্ভবত তামান্না ছাড়াও এই এন্ট্রির কথা অন্যকেউ জানে যে বিষয়টার সুযোগ নিচ্ছে।গ্যাব্রিয়েল কিচেন যার গাত্রদাহের কারণ। গাঢ় গভীর চিন্তা মাথায় নিয়ে বাড়ির দিকে আগাতে গিয়ে ঝাঁজ একটা গন্ধে নাকে আটকে গেল রম্যের ।

অভিয়াসলি চোখের সামনে ইন-হাইজিনিক ফুটপাত যেখানে দাঁড়িয়ে এই দেশের মানুষ অকাজ করতে দ্বিধা করে না। সামনেই অভিজাত একটা বাড়ির দেয়াল বরাবর দাঁড়ানো একজন পুরুষ। আরামে দেয়াল ভিজিয়ে হাল্কা হচ্ছেন। সবচেয়ে অসস্তিকর বিষয় হলো একই রাস্তায় দুজন তরুণী ছেলেটার সামনে দিয়ে হেঁটে আসছে। কিন্তু ছেলেটার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তার প্রাকৃতিক কর্ম একটা বীরত্ব জাহির করার বিশেষ পন্থা।

কী বিচিত্র একটা জাতি মেয়েদের কাপড়-চোপড়ে এদিকওদিক হলে এদের দারুণ লজ্জা, কিন্তু দশজনের সামনে জিপার খুলে দেয়ালে উল্টা হয়ে দাঁড়াতে লজ্জা লাগে না। রম্য নিজের রাগ সামলাতে সামলাতে পাশ কাটিয়এ এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থেমে গেল। আগত মেয়ে দুটোর মধ্যে লম্বা মেয়েটা হঠাৎ ছেলেটার দিকে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে।হঠাৎ ছেলেটার পেছন বরাবর এক লাথি দিলো; হ্যাঁ লাথিই তো দিলো!
ছেলেটা তাল সামলাতে না পেরে তার ভেজানো দেয়ালেই মুখ থুবড়ে গেল।মেয়ে দুটো ছুটে পালাচ্ছে। পুরো দৃশ্যে রম্য হতভম্ব, এতই যে হাসতেও ভুলে গেল।

*****

” নদু, পাশের টেবিলের দিকে তাকা।”

নিশির নিচু গলায় নদী একবার তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল।বিরক্ত হয়ে বলল,
‘দেখসি অনেক আগেই ”

‘দেখবিই তো, ওই ম্যাডাম আসছেই দেখানোর জন্য। থার্টি টু টোয়েন্টি ফাইভ থার্টি সিক্স, মাপঝোঁকটা দেখানো লাগবে না?”

” বাদ দে তো নিশি, আমরা এখানে কেন আসলাম, খিদায় পেট জ্বলছে ”

” খাবার আসতে আসতে এইন্টারটেইনমেন্টের ব্যবস্থা করি। দেখ না ওইটার পেন্সিল হিল জুতা, সোনালী ডাই করা চুল, ডেনিম জিন্স, সব পারফেক্ট। কিন্তু চিকন ক্লাচ ব্যাগে দুইটা টেকাও নাই ওই শালি নাগরের সাথে ফ্রী খাইতে আসছে, এইখানে সব সময় ফ্রী খাইতেই আসে”

” তোরে বলসে?”

” বলবে মানে, আমি জানি নাই। চ্যালেঞ্জ নিবি? জিতলে কী দিবি বল ? ”

“দেওয়া? আমি উঠবো এখান থেকে। তুই এই রেস্টুরেন্টে আমাকে আনবি জানলে জীবনেও আসতাম না ”

” তোর চাকরিটা খুব দরকার বললি…”

” এইখানে !” নদী নিজের উত্তেজনা সামলে নিল দ্রুত ” এইখানে কে দেবে চাকরি? ”

” যার কারণে তুই আসতে চাইছিলি না, তোর রাবেয়া ফুপি”

” তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আমি এখানে এসেছি, বড়োমামা জানলে আমায় আর পড়তেই দেবে না ঢাকা”

” আরে রাখ বড়োমামা! ওই গুষ্টি তো বসেই আছে আমার মা আর তোকে চুষে খাবার জন্য। ব্লাডি বেগারস, লিসেন তুই তোর প্রায়োরিটি নিয়ে ভাব, তোর ওই ফুপি গতকাল তোর ফোনও দিয়েছিল তুই বাথরুমে ছিলি; উনি তোর সাথে দেখা করতে চাচ্ছিল”

” আমায় বলিসনি কেন? “নদী হতভম্ব।

“বলিনি, সরাসরি নিয়ে আসলাম “নিশি মাথা নেড়ে বল,”পড়ানোর জন্য এত তরফদারি করলেন,রিক্যুয়েস্ট করলে একটা ব্যবস্থা তিনি করেও দেবেন। এই সুবাদে ভালো রেস্টুরেন্টে কমপ্লিমেন্টারি লাঞ্চ হয়ে যাবে। ”

নিশি সত্যি বলছে কিনা জানার জন্য নিজের ফোনটা একটু চেক করল নদী।দেখা গেল ঘটনা সত্যি। রাবেয়া ফুপি ম্যাসেজও করেছেন আজ দুপুরে তার অফিসে আসতে বলেছেন৷

কিন্তু রাবেয়াকে এই রেস্টুরেন্টে তারা কোথায় খুঁজে পাবে বলা মুশকিল। নদী একটু দ্বিধা নিয়ে ঘুরছিল, এরমাঝে তুষার আন্তরিক হাসি দিয়ে এগিয়ে এলো। তুষারের সাথে সেদিন রবীন্দ্র সরোবরেই ভাল মতো পরিচয় হয়েছিল।সে বলল রাবেয়া ম্যামের অফিস দোতালার ডান দিকের ইউনিটে।নিশি আর আগে গেল না, তার মাথা ঘোরাচ্ছে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে চলে গেল।

দোতালায় অফিস-রুমে রাবেয়াকে পাওয়া গেল না। ম্যানেজার জেরিনের সাথে কথা বলেও তুষার কিছু জানতে পারলো না। রাবেয়া নাকি এক ঘন্টা আগেই বেরিয়ে গেছেন কোথায়৷ নদী নিচে নেমে যাচ্ছিল। জেরিনের চোখাচোখি হতেই,

” তুমি কি জব ভেকেন্সির জন্য এসেছ? ”

” জি” নদী কিছু না বুঝেই উত্তর দিলো৷ তুষার অবাক।

” তাহলে এই দিকে কেন এইরুমে আসো। ”
” নদী আর ইউ শিওর? “তুষার নিচু গলায় জানতে চাইলো।নদী যে মালিকপক্ষের পরিচিত এতোটুকু সে জানে।

” শিউর” বলতে বলতে নদী আড়চোখে নিজের জুতো দেখে নিলো। নিশির পাম শুটা কোনমতে পায়ে গলিয়েছিল তাই এই যাত্রা হয়তো ইজ্জত বেচে যাবে।লবি দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে নদী নিজের বিস্ময় লুকাচ্ছে। তার চেনা গোটা বাড়ি ঘষেমেঝে আজ ঝা চকচকে বিশাল রেস্তোরা। দারুণ ইন্টেরিয়র, দোতালায় রেস্টুরেন্টের সব ফ্যামিলি স্পেস,
নিচতলা থেকে একটু আলাদা ডিজাইন।

ফ্যামিলি স্পেস এর পেছনেই নির্দিষ্ট অফিসরুমে দেখা গেল কয়েকজন ছেলে মেয়ে বসা। সবার পোশাক পরিচ্ছদই নদীর থেকে অনেক বেশি ঝকঝকে। তবে মেয়েগুলো অল্পবয়সী। নদীর বুকে একটাই সাহস, সে রাবেয়া ম্যামের পরিচিত। রাবেয়া যেহেতু আসতে বলেছে এই কাজের জন্যই হয়তো। ভেতরের ঘরে দুজন দুজন করে ঢুকছে, কিছুপর বের হয়ে আসছে। কীসের চাকরি কেমন চাকরি কিছুই জানে না নদী। জিজ্ঞেস করলে কী জবাব দেবে বুঝতে পারছে না। এদিকে নিচে নিশি বসে আছে। তুষার ভেতরে ঢুকে গেল, কিছুপরই নদীর সাথে দুটা মেয়ের ডাক পড়লো।

ভেতরে টেবিলে বসা যে নারী তার সাজগোজের সাথে এয়ারহোস্টেজের সাজের মিল আছে। টেবিলের ন্যামপ্লেটে নাম লেখা রাজিয়া আহমেদ। ফ্লোর সুপারভাইজার।ফাইল থেকে মুখ তুলে ধারালো নজরে এক ঝলক দেখে নদীর সাথের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল,
” মিতা হক কী পড়ো ”

” জি? ”

“পড়ো না কর? “মহিলা দ্বিরুক্তি করলেন।

” ওহ এস এস সি শেষ দুই বছর আগে,।কিছুদিন আগে একটা কম্পোজিট টেক্সটাইলে প্যাকেজিং ডিপার্টমেন্টে ছিলাম ”

” গার্মেন্টসে কাজ করতে তাই তো?” রাজিয়া শীতল গলায় বললেন ” ইংরেজি পারো”

মেয়েটা উত্তর দিল না সম্ভবত প্রশ্নই বুঝেনি “রাজিয়া আবার বললেন ,” ইংরেজি বলতে পারবা? এখানে প্রচুর বিদেশি ক্লায়েন্ট আসবে। ইয়েস, নো ভেরিগুড বাদ দিয়েও অনেক কথা বলা লাগবে পারবা? ”

” শিখে নেব ম্যাম ”

রাজিয়া তর্কে গেলেন না, একজোড়া হাই হিল জুতো আর একটা কাঁচের গ্লাস ভরা ট্রে দেখিয়ে বললেন ” এই জুতো জোড়া পরে ট্রে টা ওই টেবিল পর্যন্ত নিয়ে যাও দেখি ”

নদী প্রশ্ন নিয়ে তাকালো তুষারের দিকে। তুষার নিচু গলায় বলল, ” ওয়েট্রেসের জব।ডে শিফট নাইট শিফট, টু থাউজ্যান্ড পার আওয়ার।বড় বড় কর্পোরেট হাউজের ফাংশন হতেই থাকে।।ডিল করতে হবে হাইক্লাস সব ক্লায়েন্ট। এইবারে খুব কড়া সিলেকশন হচ্ছে।

– কী বলেন?

– ঠিকই বলি।ঢাকায় থাক না তো তাই জানো না, এটা গ্যাব্রিয়েলস কিচেন। এখানে সবই এক্সক্লুসিভ। এনিওয়ে আমি গিয়ে দেখি রাবেয়া ম্যাম এলো কি না।

নদীর মাথা ঘুরে উঠছে।এত বেতন! এইজন্যই এত ভিড়। তবে দামী চাকরির পরীক্ষাও কঠিন। মিতা হক নামক মেয়েটার হাইহিল পরে গ্লাস ভরা ট্রে বয়ে আনতে বেশ বেগ পেতে হলো। কোন মতে ট্রে রেখে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলো। তাকে জানানো হলো সময় মতো ফোন দেওয়া হবে।।মিতা দ্রুত বিদায় নিলো।

“তাবানি ”

” ইয়েস ম্যাম ”

নদীর সাথের মেয়েটা বেশ সাবলীল ভাবে এগিয়ে গেল। আগা থেকে গোড়া জ্বলজ্বল করছে, রেস্টুরেন্টের অভিজাত ক্লায়েন্টের বেশভূষা। সে কিনা এসেছে চাকরির খোঁজে।রাজিয়ার সাথে কি কথা বলছে নদী শোনার চেষ্টা করেও লাভ হলো না। হয়তো পরিচিত। এদিকে নদী প্রমাদ গুনলো এখানে না সোহরাব সাহেব আছেন, না রাবেয়া এসেছেন।

রাজিয়া হেসে কথা বলছে,এই মেয়েটা মনে হয় সিলেক্ট হয়ে যাবে। ভাবনার মধ্যেই নদীর চোখে পড়লো চেয়ারে রাখা একটা হ্যান্ড স্যানিটাইজার বোতলের দিকে।কার ওই তাবানি মেয়েটার?

এরমাঝে তুষার চলে এলো, ” রাবেয়া ম্যাম ফ্লাইটে। হুট করেই ইন্ডিয়া যাচ্ছেন আজ দেখা হবে না”

নদী কী বলবে বুঝতে পারছে না। এই বাড়ি যা তার জন্মস্থান, সেই চার দেয়াল আজ অচেনা, তার মাঝে নিজেকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ঝনঝন শব্দে তুষার আর নদী ঘুরে তাকালো।তাবানি মেয়েটা মাটিতে বসে আছে। তার হাতের ট্রে পড়ে কয়েকটি গ্লাস ভেঙেছে।

“আমি ঠিক বুঝলাম না আন্টি এটা…” তাবানি আহ্লাদী গলায় বলল।

” ইটস ওকে, তোমার কি অভ্যাস আছে? শখ করে চলে এলে ইন্টারভিউ দিতে ” রাজিয়ার কন্ঠে সমবেদনা ” এপয়েন্ট হবার পর কিন্তু রেস্টুরেন্ট প্রপার্টির হিসেব দিতে হবে।”

নদীর ক্রোধে গা রি রি করছে। বড়োলোকের আহ্লাদী মেয়ে এসেছে চাকরির শখ মেটাতে। এদের শখের রাস্তায় সেনিটাইজার ঢেলেও পিছল করা যায় না; সব পিচ্ছিলতা শুধু নদীদের জন্য। নিজের ওপরই বিরক্ত লনদী, বোতলটাই নষ্ট হলো।রাজিয়া দুজন নতুন মেয়ে সিলেক্ট করে ফেলেছে। বাকিদের আজ ইন্টারভিউ নেওয়া হবে না ঘোষণা হলো।

নদী মন খারাপ করে তুষারের সাথে বেরিয়ে এলো।

” রাবেয়া ম্যাম এক সপ্তাহর জন্য গেছেন। তুমি চিন্তা করবে না আমি ওনার সাথে কথা বলব।তবে উনি তোমাকে কাজটা করতে দেন কিনা সেটাও তো একটা প্রশ্ন যেহেতু তুমি রিলেটিভ ”

তুষারের কথাগুলো শুনে বিরক্ত লাগলেও নদী কিছু বলল না।বেচারা সমবেদনাই হয়তো দিচ্ছে। আসলেই তো ছেলেমানুষী, সোহরাব সাহেব রাবেয়া কাউকে না জানিয়ে সেওবা এত মরিয়া কেন? আর চেষ্টা করলেও তাঁর হবে কেন? এমন কী আছে তার মধ্যে?.

নদীর ঘাড় নামানো দীর্ঘ অবয়ব রাজিয়ার অফিস থেকে করিডোর দিয়ে ধীর লয়ে পার হচ্ছিলো। তবে দেয়ালে সাঁটানো একটা যান্ত্রিক চোখ তখনও স্থির তাকিয়ে। দেয়ালের ওইপারে একজন মানুষ খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে তাকে। এর আগেই কোথাও মেয়েটাকে দেখেছে সে, হঠাৎ মনে পড়লো, আজ সকালেই! সকালে জগিং থেকে ফেরার সময়। শ্যামলা টিপিকাল বোকা বোকা বাঙালি চেহারার মেয়ে অথচ কী যেন একটা আছে…।

” এই মেয়েটা এখানে?এই যে সবুজ ড্রেস পরা ইয়াং লেডি?” নিজের কেবিনে মনিটরের দিকে ঝুঁকে গ্যাব্রিয়েলের বিস্মিত দৃষ্টি।

জেরিন বলল, “ওয়েট্রেস ভেকেন্সির জন্য এসেছিল স্যার।বাট নট সিলেক্টেড”

” কেন নয়? আই ওয়ান্ট হার… ”

বসের কথায় জেরিন অবাক হয়ে তাকিয়ে, গ্যাব্রিয়েল দ্রুত কথাটা শেষ করলো , ” টু বি এপয়েন্টেড; পলিশ হার, শি ইজ গাটসি এন্ড স্মার্ট। এরা দ্রুত কাজ শেখে। রাজিয়াকে আমার কথা বল, ওকে চাই আমি ”

জেরিন মনোযোগ দিয়ে নিরিখ করছে, তার বস এতটা কথ বলতেই কিশোর বালকের ন্যায় কান লাল করে ফেলছেন। ব্যাপারটা কি?

#শারমিন_আঞ্জুম
(চলবে)