বাতাসে তার সৌরভ পর্ব-০৮

0
203

#বাতাসে_তার_সৌরভ–৮

বড় রেস্তোরাঁর রসুইঘরে যে কাজের ঝড় থাকে, তা এমনিতেই গরম; নাফিজের আরও গরম লাগছে।কারণ আজ তার রান্নার পরীক্ষা ; টেনশনে ঘামে কপাল ভিজে যাচ্ছে।তার সামনে পরীক্ষক দাঁড়িয়ে। মানুষটা একটা মাংসের টুকরো মুখে পুরেছেন ।গম্ভীরমুখে ধীরে ধীরে চাবিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করছেন।নাফিজের বারো বেজে যাচ্ছে।

গ্যাব্রিয়েল কিচেনের আধাবাঙালী তরুণ বস কারো সাথেই উঁচুগলায় কথা বলেন না, তবুও মানুষটাকে সবাই প্রচন্ড ভয় পায়।

” খুব ইন্টারেস্টিং, ”

বসের কথায় নাফিজ চমকে উঠলো। দ্রুত বলা আমেরিকান এক্সেন্টে শুরুতে বুঝতে না পারলেও এখন অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে।
এক গ্লাস পানি খেয়ে গ্যাব্রিয়েল স্যার বললেন, ” আচ্ছা চল তোমার রেসিপি আন্দাজ করি, এখানে আছে দুশো গ্রাম মিট কিমা,ওয়ান টি স্পুন ব্ল্যাক পেপার, সলট, ব্রেডক্রাম্প, টু টি স্পুন পার্সলে লিফ”নাফিক অবাক , বস চোখ বন্ধ করে নিখুঁত আন্দাজ করছেন , ” জিঞ্জার, গ্রিন চিলি আর সামান্য ইন্ডিয়ান ফ্লেবারড স্পাইসও এড করা হয়েছে ! একটা কাবাব কাবাব ভাব চলে এসেছে”

নাফিজ বিনয়ে গলে গেল,” জি থ্যাংকস স্যার ”

” এটা কি কাবাব হবার কথা?” গ্যাব্রিয়েল স্যারের ঠান্ডাকন্ঠে প্রশ্ন।

“না স্যার ”

” তোমার মতে এটা কী? ”

” মিটলোফ ”

” মিটলোফের ফ্লেবার কি এটা?”

” আমি ভাবলাম নতুনত্ব আসবে ”

“কিন্তু তোমাকে নতুনত্ব আনার কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে অথেনটিক ক্লাসিক মিটলোফ তৈরি করতে। একটা কাজ করি তোমার জিন্সের প্যান্টটা উলটো করে কেটে ত জামা বানিয়ে দেই, পরে গার্লফ্রেন্ডের সাথে ডেটে যেও, ড্রেসিংয়ে নতুনত্ব আসবে, কী বল; রাজি? ”

নাফিজ চুপ করে আছে।

” রান্না যে করতে জানে সে রাঁধুনি হয়, কিন্তু আলাদা আলাদা রান্নার মাঝে যে ফ্লেবার তৈরি কর‍তে পারে সে শিল্পী হয়। সব জিনিসের এক ফর্মুলা ঢোকাতে যাও বলেই তুমি কখনো সালেমের মতো হতে পারবে না। রান্নার স্কিল না, আগে মেন্টালিটি বদলাও ‘

আজকে কাজের মাঝে নাফিজকে হুট করে এই টাস্ক দেবার অর্থ এখন পরিস্কার হলো। গ্যাব্রিয়েল কিচেনের এসিসট্যান্ট চিফ শেফ সালেম ভাইয়ের সাথে তর্কাতর্কির আজ উত্তর দিলেন স্বয়ং বস।

” দ্বিতীয়বার এমন কোন ঝামেলা দেখলে টাস্ক এত সহজ হবে না ”

সন্ধ্যা বাড়ার সাথে রেস্তোরায় লোক সমাগম বাড়ছে। বস ওভেন থেকে ইটালিয়ান চিকেনের ডিশটা বের করতে বললেন। চিকেন পনির আর মাস্টার্ড পেস্ট মিশেল মোহনীয় সৌরভ ছড়িয়ে যাচ্ছে গোটা কিচেনে। সবার চোখে মুগ্ধতা। চিফ শেফ গ্যাব্রিয়েল সামদানী তার সিগনেচার ডিশগুলো বুঝিয়ে ডিনার বাফেট রেডি কর‍তে বলে কিচেন থেকে বের হলেন।

অবসরে বিনোদনহীন ইটকাঠের এই শহরে মানুষ হন্যে হয়ে সুখ খুঁজে ফেরে। খুঁজে পায় কিনা জানা যায় না; তবে যাদের সামর্থ্য আছে, তারা খরচ করে আনন্দ কিনতে পিছপা হয় না। হোটেল রেস্তোরাঁর চাপও বেড়ে যায় সেই তালে।ছুটির দিনে সন্ধ্যায় রসুইঘর রনক্ষেত্রে পরিণত হয়। লাগাতার হাত চালানো বেকিং, ফ্রাইং, ড্রেসিং। দম ফেলার সময় থাকে না তার ওপর বাড়তি মানসিক চাপ হলো রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজেই যে যেদিন থাকেন চিফ শেফের ডিউটিতে। সপ্তাহের এইদুটি দিন তিনি কিচেনে থাকেন।রান্নার চাপের সাথে একটা আনন্দও থাকে। রেস্টুরেন্টে ভরা গমগমে খদ্দের দেখতেও মন ভরে আসে। ক্ষুদার্ত মানুষকে তৃপ্তি দেবার মতো বড় শিল্প আর নেই।গ্যাব্রিয়েল কিচেনে সাধারণের সাথে বাড়ছে ক্রমেই কর্পোরেট ক্লায়েন্ট।

” কাল ওশানিয়ার কনফারেন্সের ড্রাই শপিং হয়ে গেছে স্যার”বসের দিকে জেরিন হাসিমুখে এগিয়ে এলো৷ ” ব্যাভারেজ গুলো আসবে কাল সকালে”

” ভালো কথা , রিপোর্টিং টাইম কিন্তু সন্ধ্যা ছয়টা ”

“এক্কেবারে ছয়টার মধ্যে হয়ে যাবে”

” ফ্লোর এটেন্ড করবে ন্যান্সি ফাতেমা আর তুষার” গ্যাব্রিয়েল আরেকটু সংযোগ করলো,

জেরিন অল্প কাশলো, ” ইয়ে স্যার,বলা হয়নি ফাতেমা রিজাইন করেছে ওর ভয়টা কাটেনি স্যার ”

” প্রথমে নাইমা তারপরে ফাতেমা, পর পর দুটা মেয়ে.. , কেউ কেন বুঝতে পারছে না, পুরো ব্যাপারটা ফেব্রিকেটেড ”

গ্যাব্রিয়েল নিঃশ্বাস নিতে নিতে আটকে ফেলল। সাফল্য আর দুশ্চিন্তা আলো ছায়ার মত পাশাপাশি হাঁটে। ফাতেমা মেয়েটা এটেনডেন্স হিসেবে বেশ চটপটে ছিলো।দ্রুত কাজ শিখে ফেলেছিল। কিন্তু কয়েকদিন আগে ব্যাক ইয়ার্ডে কিছু একটা দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়েছিল।একই
জায়গায় দুটো মেয়েই।বাড়িটা ভুতুড়ে হবার গুজব কয়েকদিন বন্ধ ছিল। কিন্তু সাইড ইঞ্জিনিয়ার মারা যাবার পর আবার ডালপালা ছড়িয়েছে।

বিচিত্র অব্যবস্থাপনায় ভরা, একটা দেশ যেখানের মানুষের সাহস ছিটাফোঁটা নেই, তবে লোভ আছে ষোল-আনা।ঘুষ ছাড়া লজিস্টিক সাপোর্টও পাওয়া মুশকিল।
এমনকি, ব্যক্তিগতভাবে গত দুই বছরে গ্যাব্রিয়েলের সাথে যে কয়জন মেয়ে ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছে তার পেছনেও কাজ করেছে তাদের নির্লজ্জ লোভ; ডলারের,আমেরিকার ইমিগ্রেশনের, দামী গিফটের। বিরক্তি রাগের দিকে ঝুঁকে যেতে লাগলে গ্যাব্রিয়েলের কথা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মুঠোফোন আবেগ বোঝে না, বেয়াড়ার মতো বেজেই যাচ্ছে, বাংলায় যাকে বলে ঘ্যানঘ্যান। গ্যাব্রিয়েল ঘ্যানঘ্যান বন্ধ করলো, ওপাশে অর্ণবের কন্ঠ তাকে গ্যাব্রিয়েল থেকে রম্য বানালো।

– সমস্যা কী রে রমি সেই কখন থেকে ট্রাই দিয়ে যাচ্ছি।

– এই উদ্ভট দেশে সমস্যা ছাড়া কোন জায়গা আছে?

– কুল, ফাইনালি স্বীকার করলি। অর্ণব হাসলো ভাইয়ের কথায়, ” তো ব্যক করছিস কবে?

– কল দিয়েছিস এটা জানতে?

– তোর মুড বুঝতে,মেজাজ যেহেতু খারাপ তাই আন্দাজ করছি যে এখনো জানিস না।জানলে মন খারাপ থাকতো মেজাজ না।বাদ দে নট ইম্পর্ট্যান্ট।

– আম্মু কেমন?

– টরেন্টো আছে, তোর জানার কথা।

– ভুলে গিয়েছিলাম, আচ্ছা মিশেল কেমন ?

– বললাম তো নট ইম্পর্ট্যান্ট।

রম্য একটা নি:শ্বাস গোপন করলো- আমি জানতে চাই।

– মেয়ে হয়েছে। ফেসবুকে দিয়েছিলো তো তুই দেখিসনি।

– আমি ফেসবুক থেকে অনেকদিন ধরে বাইরে।

– ওহ হ্যাঁ আমিও ভুলে গেছি। এনিওয়ে আমি কনগ্রেজ জানিয়ে ম্যাসেজ দিয়েছি। বলল ফ্রেঞ্চ বয়ফ্রেন্ডের সাথে ভালোই আছে। এই ফলেই (শরৎকাল) বিয়েটা সেরে নেবে।

– ভালো। আমার গুড উইশেজ, রাখি রেস্টুরেন্টে রাশে আছি।

– তুই ঠিক আছিস?

– আমি ঠিকই ছিলাম।

অর্ণবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রম্য ফোন কেটে দিলো৷ তবে নিজেকে প্রশ্ন করা ছাড়লো না আসলেই কি সে ঠিক আছে? কিছু কিছু ঘটনা বন্ধ হিসাবের খাতা অযাচিতভাবে খুলে দেয়। মিশেল হয়তো খুব খুশি, বাচ্চাটা যদি রম্যের আর তার হতো তাহলে কি এর থেকে বেশি খুশি হতো?পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই হওয়ার কথা থাকে না যা ঘটে যায়। বিয়ের দুইদিন আগে মিশেলেরো মন পরিবর্তন হবার কথা না। ওয়েডিং গাউনের ট্রায়েলরূমে রম্যেরো তাকে অন্যকারো সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখার কথা না। রম্যে চিন্তাগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চায় কিন্তু জোর করেই চলে আসে।

” রমি! কাম ওভার হিয়ার”

দোতালায় রোস্তারার সাথে লাগানো ঝুল বারান্দায় সোহরাব সাহেব বেতের চেয়ারে বসা।

” কিছু বলবে? ‘

” তোমার জবাব চাইছিলাম, ”

বাবার কথা গ্যাব্রিয়েল শুরুতে বুঝলো না।পরে মনে পড়লো মৌ নামক মেডিকেল পড়ুয়া মেয়েকে বাবা পছন্দ করেছেন। চাইছেন সেও কথা বলে। একটু অন্তরঙ্গতা হোক। এরেঞ্জ ম্যারেজের খুবই হাস্যকর ইন্ডিয়ান মেথর্ড। রম্য হেসে উড়িয়ে দিয়েছে তবে সোহরাব সাহেবের উৎসাহ কমেনি,এখনো একই সুঁইয়ে আটকে আছেন, ” তোমার কি মনে হয় না যে শাস্তিটা একটু বেশি নিয়ে ফেলছ ”

” আমি ইনজয় করছি শাস্তি ”

” কার আশায়? এখনো কি বোঝনি যে কেউ থেমে নেই তোমার জন্য? মিশেল মা হয়েছে তার ফ্যামিলি হয়েছে এখন কি তার নাতি-নাতনীদের বড় হবার অপেক্ষা করবে? আইমিন লুক এট ইউ।মর্ডান ভার্সন দেবদাস। বিয়ে না কর বেটার গেট হুকড আপ উইথ সামওয়ান এলস। এটা বিষণ্ণতায় সবচেয়ে ভালো মেডিসিন। নিজ জীবনে পরিক্ষিত। ”

রম্য বিরক্ত হয়ে কিছু বলল না। তার সাথে হুকড আপ হবার মেন্টাল স্ট্রেংথ কাউকে পাওয়া মুশকিল। এখানে সবাই খুব মেকি ইনোসেন্স দেখাতে চায়। ভান দেখলে রম্যের কেমন গা গোলায়।।
তার ওপর এইদেশে থেকে থেকে বাবাও দিনে দিনে ইন্ডিয়ান এথিকাল চিন্তা ধারণ করছে। এখানের সব সমস্যার সমাধান হলো বিয়ে।

হোটেল সুপারভাইজার তুষার এর মাঝে ত্রস্ত পায়ে ফোন নিয়ে এলো ” স্যার, কল ছিলো, নদী”

সোহরাব সাহেব ফোন ধরলেন, ” আস সালামু আলাইকুম স্যার”

” ওয়ালাইকুম আস সালাম কেমন আছ নদী? আর তুমি আমাকে স্যার কেন ডাকো? স্ট্রেইট আঙ্কেল ডাকবে। রাবেয়াকে বলেছিলাম সে নিজেই কার্ডটা নিয়ে বিশেষ সোর্স খাটিয়ে ইনক্যুয়ারি করেছে। তোমার সাথে কথা হয়নি ”

“জি না”

” কথা হবে। সে বুঝিয়ে বলবে তোমায়। স্পা আসলেই আছে তবে একেবারেই ঠিক জায়গা না। একেবারে ফ্রড। জায়গাটা যে কতটা ভয়াবহ আরেকটু বড় হলে বুঝতে পারবে ”

বুকে চাপা দুঃখে নিয়েও নদীর কেন যেন কথাটায় দারুণ হাসি পেল।
সোহরাব সাহেব বললেন, ‘ যে তোমাকে এখানে চাকরির জন্য সাজেস্ট করেছে সে আর যাই হোক বন্ধু হতে পারেনা। ”

” আচ্ছা,আমার কপালটাই খারাপ ”

নদীর কন্ঠ বিষন্ন সামদানী সাহেব প্রশ্ন করলেন, ” মানে? ”

” একদিকে চাকরি গেল,অন্যদিকে কাল আমার এডমিশন টেস্টের রেজাল্ট আউট হবার পর আমি সাতক্ষীরা ফেরত যাবো”

” ভেরি গুড চাকরির চিন্তা মাথায় রেখো না। আপাতত ফোকাস কর পড়াশোনায়।ফ্যামিলির সাথে দেখা করে আসো, এডমিট হওয়ার পরে হয়তো সহসা সুযোগ পাবে না ”

” আমার কোথাও কিছু হবে না আঙ্কেল, বড় মামা আমায় নিয়ে যেতে এসেছেন।আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমি কোথায় আকাশ-পাতাল কল্পনা করছি। জানি না আপনাকে ফোন করে এসব কেন বলছি।আপনাকে বিরক্ত করে থাকলে সরি। শুধু একটা রিক্যুয়েস্ট, চন্দ্রমল্লিকার খেয়াল রাখবেন প্লিজ ”

নদী ফোন কেটে দিল। সোহরাব সাহেব অবাক হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলেন। মেয়েটা অসম্ভব দুঃখ আর অসহায়ত্ব নিয়ে তাকে কল দিয়েছিল। অথচ তিনি কী করবেন মাথায় কিছু খেলছে না। চুপ করে বসে থাকাও কাজের কথা নয়। ভেতর থেকে অস্থির লাগছে, রাবেয়াকে কল দিতে দিতে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন।

” তুমি কোথাও যাচ্ছ ড্যাড ”

” রনক্ষেত্রে। জানিনা অস্ত্র ছাড়া লড়ব কীভাবে। তবে একটা বিষয় বুঝিনি এই চন্দ্রমল্লিকা কী জিনিস? ”

******

” বেইব রিল্যাক্স! সামনে বড় স্ট্রাগল আছে বড় মামারে দেইখে তলা ছোটা শুরু হলে তুই দাঁড়াবি কী করে?”

” মনে হয় দাঁড়াতে পারবো না” মোবাইলের ঐ পাড়ে নদীর কন্ঠ ম্লান।

” পুওর সোল, আই উইশ আই ক্যান হেল্প ইউ। আসতে একদিন লাগবে এর মধ্যে একটু ঠেকিয়ে রাখ। বল পেট খারাপ হয়েছে বা সাইনাসাইটিস পেইন জার্নি করতে পারবি না।”

” কিছুই যায় আসে নিশি, আমি তোর মতো ডলারে ভাসা বার্বিডল না। আমার প্রাণটা শরীরে থাকলেই সবার জন্য যথেষ্ট। আচ্ছা কথা বলতে ভালো লাগছে না।আমি রাখি। ”

নিশি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল ওপাশে নদী ফোন কেটে দেয়।নিশির একটু মায়া লাগলো, বেচারা বেশি ভেঙে পড়েছে। নানারবাড়ির সবাইকে ধান্ধাবাজ লাগলেও এই হাঁদারাম মেয়েটাকে কেন যেন নিশির খুব মায়া লাগে৷ এখন দ্রুত যা করতে হবে খাগড়াছড়ি থেকে সোজা বাসের ব্যবস্থা করতে হবে। কোন মতে বারো ঘন্টার মধ্যে ঢাকা পৌঁছাতে পারলেই নদীকে ফাঁকে নিয়ে সটকে যাবে।নিশির কাছে কমবেশি সবাই ধরা খেয়েছে, বড়মামাকেও একটু ব্লাফ দেয়া যাক।

যাত্রা প্রস্তুতির আগে নিশির আরেকটা কথা মনে পড়লো। ওহ ওটা তো এখনো করাই হয় নাই। রাফিনটা পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে আর ঘোতর ঘোতর করে নাক ডাকছে। ঘুমালে রাফিনকে একেবারে বাচ্চাদের মতো দেখায়। তবে মায়াটা গিলে বাথরুম থেকে এসে ছাগলটাকে এক বোতল পানি দিয়ে শাওয়ার করাতে হবে। ভয়ে চিৎকার দেবে তবেই হ্যাঙাউট কাটবে।এরপর লাথি মেরে বাসের টিকিটের খোঁজে পাঠাতে হবে। সস্তার বিয়ার গিলে শালা বেশিই জ্বালিয়েছে রাতে ।

নিশি একটা রেগুলার চেকাপের জন্য ব্যাগ থেকে স্ট্রিপ বের করলো। সাবধানতার জন্য সাথেই থাকে। যদিও রেজাল্ট জানে তার পরও একটু চিন্তা কাটানো।

অপেক্ষা করতে করতে নিশি একবার অনলাইনে ঢু দিচ্ছে, মায়ের সাথে এক ফ্রেঞ্চ ডাক্তার লুই ফ্রাসোয়ের ইদানীং খুব দহরম মহরম। তাকে ছাড়া কোন ছবিই দেয় না। নিশি মনোযোগ দিয়ে মায়ের মুখ পড়ার চেষ্টা করছে। সেল্ফিতে মানুষ সবচেয়ে বড় অভিনয় করে নিজের সাথে। আর নিজের সাথে করা অভিনয় নিখুঁত হয়। নিশি বিরক্ত হয়ে স্ক্রল করে নিচে নেমে গেল। হুট করে মায়ের আজকাল বাড়াবাড়ি ছবি শেয়ারের কারণ আন্দাজ করা গেল।

নিশির নিউরো সার্জন ডাক্তার বাবা আসলাম এই মুহূর্তে চায়নায়। তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে হানিমুনে। রাজকীয় ফরবিডেন সিটিতে সম্রাট সম্রাজীর বেশে ছবি তুলেছে। এইজন্যই এত দিন বাবার কন্ঠ এত নমনীয়। যা চাইছে তাই পেয়ে যাচ্ছে।
নিশির চোখ দুটা জ্বলে উঠলো। হঠাৎ মনে হলো তার নতুন একটা বাইক হলে মন্দ হয় না। ঢাকার রাস্তায় যাতায়াতের জন্য সুবিধা। এটার খরচ আব্বুর। যেহেতু বিয়েটা সেরেই ফেলেছে।

নিশি দ্রুত ভাবতে ভাবতে চোখ পড়লো টেস্টিং স্ট্রিপের দিকে।।
প্রথমে একটা দাগে গিয়েছিল দুই দাগে কখন উন্নিত হলো নিশি খেয়াল করেনি। নিশি চোখ ডলে আরেকবার দেখলো। না দুই দাগই।

“হোলি ক্র‍্যাপ!” বিরক্তিতে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল কথাটা।” শয়তানটাকে সব সময় সাবধান করি কিন্তু শালার পরতে মনেই থাকে না। আমার ঘাড়ে ঝামেলা ফালায় ”

নিশি তীব্র ক্রোধ নিয়ে বাথরুম থেকে বের হতে গিয়ে থমকে গেলো, রাফিন কারো সাথে ভিডিও চ্যাট করছে। কোন মেয়ে। তার সামনেই শর্ট পরে গল্প করে যাচ্ছে। বিষয়টা শুধু এখানে থেমে নেই।কথা বলতে বলতে রাফিনে নিশির পার্স ব্যাগ ঘাটছে, হাতে দুইশো ডলার উঠে এলো ।

” এই দেখ যে দেশে থাকি তার কারেন্সি এখন বিশ্বাস হয়? ”

” যান আমি অবিশ্বাস করি? “মেয়েটার কন্ঠে গ্রাম্যটান।

” তাহলে আমায় দেখতে দাও না কেন? ”
রাফিন বলতে বলতে ডলারগুলো নিজের ওয়ালেটে ভরলো।”আমি তো একা একজন মানুষ, আমাকে আপন ভাবতে কেন পারো না… ”

রাফিন মাঝপথে থেমে গেলো শক্ত জুতোর সোল চলে এসেছে গালে। ‘সে তোরে আপন ভাবতে পারে না, আমি তোরে মেইল স্কর্ট ছাড়া কিছুই ভাবি না, ইউ সান ওফ এ ব…, মা***কার, ” নিশি আরও ক্রুদ্ধ হয়ে ঝাপিয়ে পড়তে পড়তে হঠাৎ করে হোঁচট খেল। তীব্র চপটাঘাতে এভাবে পড়ে যাবে বুঝতে পারেনি।

” আমি মাফা***র আর তুই কী ? শালী হ**র বি**, একটা টয়লেট টিস্যু। মুছে চিবড়ে করে ফ্ল্যাশ করব টেরও পাবি না।

রাফিন গায়ে একটা টি শার্ট গলাতে গলাতে ঘর হতে বের হয়ে গেল। নিশি তখনও স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে।ক্রোধ দু:খবোধ গায়েব হয়ে বুকটা কেমন শূন্য লাগছে। তীব্র জোরে চিৎকার দিতে চেয়েও মনে হচ্ছে কেউ কন্ঠরোধ করে রেখেছে। মেঝেতে পড়ে থাকা খালি চিপসের প্যাকেট, টিস্যু, খালি বিয়ার ক্যান সহ নানা অবাঞ্ছিত জিনিসের মাঝে নিজেকেও কেমন আবর্জনা মনে হচ্ছে।

******

মোজাফফর আহমদ শান্তমুখে তাকিয়ে আছেন নদীর দিকে। কোমল গলায় বললেন – স্যুপ মুখে দে। সারাদিন কিছু খাসনি।

নদী রেস্টুরেন্টে বসে স্যুপের বাটিতে নাড়াচাড়া করছে শুধু।

বড়মামা বললেন – তোর রানুখালা অনেক চেচাচ্ছে। তোরে নিয়ে ব্রাট ব্রাট সব অভিযোগ। বলতিসে নিশিই নাকি তোরে ফুসলে নিয়ে গেসে। এটা কি সত্যি?

– না সত্যি না। আমি এডমিশন টেস্ট দিতে
ঢাকা আসতে চাচ্ছিলাম।

– না বলে এলি কেন?

নদী কোন উত্তর দিলো না।প্রচন্ড বিষন্নতায় কথা বলতে ভালো লাগছে না। তাছাড়া শাহবাজের বিষয়টা বললে বিশ্বাস করবে এই নিশ্চয়তাও নেই।উল্টো তার দিকে আঙুল তোলার সম্ভাবনা বেশি।

বড়মামা মোজাফফর হোসেন কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন,” স্বপ্ন জিনিসটা বুঝে দেখা লাগে। তোর বয়সে আমারও স্বপ্ন ছিল। ভাবতাম পাইলট হবো।জানতাম না উড়োজাহাজ তো দুরের ব্যাপার, ট্রাক চালানোর যোগ্যতা ছিল না। আমার চৌদ্দপুরুষ বন্ধক দিলিও পাইলটের প এর কাছে যাতি পারতাম না। অনেক ধাক্কা খেয়েছি৷ চাকরির জন্য একেকবার ঢাকা আসতে পকেটে দুইশো টাকা হয়তো সাথে থাকতো এতদূর পথ আসতে অনেক রক্ত পানি হয়েছে..

নদীর মনে পড়লো,সে ছোট থাকতেই দাদি মারা যায়। বিশাল পুরনোবাড়িতে মায়ের একা লাগতো৷ ভাইবোনদের ঢাকায় ডেকে নিয়ে এসেছিলেন।
শানুখালা আর বড় মামার পরিবার ছাড়া তাদের বাড়িতে মেজমামা সহ রানুখালা তার ছেলে নিয়ে নদীর দাদারবাড়ির নিচতালায় থাকতেন । খুলনার ওষুধ কোম্পানিতে বড় মামার চাকরিটা হঠাৎই চলে গেল। চাকরির খোঁজে তিনিও ঘনঘন ঢাকায় আসতেন।
ফিরতেন বাবার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে। কখনো বাবা যেচেই দিতেন,
” আরে লজ্জা কিসের? আমার বিপদ আসতে পারে না? তখন কি তুমি দেখবে না বোনকে? তখন না হয় শোধ করে দিও। আমি না থাকলেও আমার বাচ্চাদের তো লাগতেই পারে”

বড়মামা নদীকে স্মৃতি থেকে টেনে আনলেন – আমি কিন্তু বলতেছিনা তুই ভুল কইরেছিস। রেজাল্ট ভালো হয়েছে তোমার চেষ্টা করার ইচ্ছা ছিল চেষ্টা কইরেছ। কিন্তু সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের ঢোকা তো ছেলের হাতের মোয়া না। মন খারাপ করলে কিছু বদলাবে?

নদীর চোখ ফেটে পানি আসছে৷ অনেক দিন পর মরিয়া হয়ে কিছু পেতে চাইছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটা ইউনিটের সাথে ইডেনেও নাম্বার খুঁজে পায়নি।একেকটা ব্যর্থ ফলাফল দেখে নদীর মনে হচ্ছিল যেন সবাই মিলেই ষড়যন্ত্র করে ব্যবস্থা করেছে যেন তার নাম লিস্টে না ওঠে। অযৌক্তিক হাস্যকর চিন্তা। মূলত এই যুদ্ধে যোগ্য সেনাদের সামনে তার দক্ষতা ম্লান ।

” যা হবার হয়েছে, তোর শখ মিটেছে।এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে গুছিয়ে নে,
মাগরিবের নামাজ পড়ে রওনা হব। সন্ধ্যা সাতটার গাড়ি। ”

নদী নিরুত্তর রইল।
বড় মামা স্বগতোক্তি করলেন, রানুরে অনেক বুঝোয়ে শান্ত করেছি। বাড়ি ফিরলে কোন কিচ্ছু বলবে না। চুপচাপ ক্ষমা চেয়ে ভেতর ঢুকে যাবি বাকিটা আমি দেখব।আর ওই বুড়ির ঝামেলাও বেশিদিন নিতি হবে না, ভালো একটা ছেলে পাওয়া গেছে। খুলনা নিউমার্কেটে কাপড়ের দোকান আছে। বাড়িতে বুড়ো মা আর একটা ছোট্ট মেইয়ে, এই বছর পাঁচেক হবে। তারে রেখেই চলে গিয়েছিল বউটা। ছেলে, মানুষ ভালো; কিছু দাবী নেই। শুধু মেইয়েটারি দেখাশোনার জন্য রাজি হয়েছে । তোর মেজমামা আর আমি মিলে খরচটা গুছিয়ে নেব”

– আরে নদী! হোয়াট এ প্লিজেন্ট সারপ্রাইজ!

নদী উঠে দাঁড়ালো। বুক কাঁপছে। রাবেয়া আন্টির কণ্ঠ,তার পেছনে আসছেন সোহরাব সাহেব। দুজনকে বড়মামার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। মোজাফফর সাহেব সোহরাবকে না চিনলেও রাবেয়াকে চিনলেন। নদীর বাবার চাচাতো বোনের সাথে তার পরিচয় ছিলো৷

রাবেয়া এসেই নদীর দিকে মনোযোগ দিলেন-ফোনে তোমার গলা শুনেই মনে হলো দেখা করি কিন্তু এভাবে দেখা হবে বুঝতে পারেনি। রেজাল্ট নিয়ে একেবারে মনখারাপ করো না। এই শহরে ইউনিভার্সিটির অভাব? কয়েকটি প্রাইভেট এখনও এডমিশন টেস্ট নেয়নি।

মোজাফফর হোসেন রাবেয়ার কথায় হকচকিয়ে গেলেও দ্রুত সামলে নিলেন – তা একটু মন খারাপ তো করেছেই ছোটমানুষ। এইবারে সাথে নিয়ে যাই। সামনের বার ইনশাআল্লাহ আরেকবার চেষ্টা করবেনে।

– সামনের বার কি ও আসতে পারবে?

রাবেয়ার কথায় কোন ধারালো দ্যোতনা মোজাফফর হোসেনকে থমকে দিলো।

*******
পরের দিন সকালে–

মোজাফফর ভাগ্নীকে নিয়ে এসেছেন আজিমপুরের একটা সরকারি ক্যাম্পাসে। এইখানে এডমিশন না হলে তাকে ফিরতে হবে মামার সাথে । নদীও মামার কথায় রাজি হয়েছে তবে নিরাশ হয়েছেন সোহরাব সাহেব আর রাবেয়া।কাল তারা হঠাৎ উদয় হয়ে অনেক সময় নিয়ে কথা বলেছেন। মোজাফফর সাহেবের বেশ বিরক্ত লেগেছিল। কিন্তু শান্ত মুখে সামাল দিচ্ছিলেন। শহরের সব মতলববাজ মানুষগুলো,প্রয়োজনের সময় খবর নেই কিন্তু স্বার্থের টান পড়লে দরদ দেখাতে ছুটে এসে বড় বড় বুলি দেয়।রাবেয়াকে ধরা যাক, বাবলু আর মিনুর চল্লিশার পর এই প্রথম দেখা হলো। তাতেই কত মায়ার ফুলঝুরি।

– আমার মনে হয় নদী না হয় থাকুক। এখানে বসে প্রেকটিস করুক। সাতক্ষীরা গেলে গোটা একটা বছর গ্যাপও তো পড়ে যাবে।

– আপা সিচুয়েশন বোঝেন ,বাচ্চা একটা মেয়েকে এতদিন বাড়ি থেকে দূরে একা থাকা তো ঝুঁকিপূর্ণ, আমাদেরও একটা দায়িত্ব আছে।

রাবেয়া মাথা নেড়ে বললেন -দায়িত্ব আপনারা ভালোভাবেই পালনও করছেন। অন্যকোন মূর্খ গোঁয়ার পরিবারে একটু বড়ো হলেই যেমন -তেমন একটা ছেলে দেখে মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব ঝেড়ে দিতো। বাবা-মা মরা মেয়ের কপালে এই দেশে যা হয় আরকি ।

মোজাফফর হোসেন সাহেব একটি অস্বস্তিতে পড়লেন, ” বিয়ে দেয়াটাও আমাদেরই দায়িত্ব। তবে অবশ্যই দেখেশুনে ভালো পাত্রস্থ করে… ”

” হ্যাঁ সেটা সময় হলে, আঠারো বছর বয়সে মেয়েরা নিজে তৈরি করবে। এখন নিশ্চয়ই বিয়ের চিন্তা করবে না।”

“তেমন কোন ব্যবস্থা হলে অবশ্যই পাত্রের খোঁজ খবর করেই নেব। একটা ইয়াং মেয়ের জন্য নতুন জায়াগায় সম্পূর্ণ একা থাকায় অনেক জটিলতা। এর থেকে ভালো একটা পাত্রস্থ করতে চাইলে সেটা ভুলও নয় ” মোজাফফর সাহেব কন্ঠে বিরক্তি লুকালো না, তবে রাবেয়া যা বোঝার বুঝে গেল।

“ভাই একটা কথা বলি, বিয়ে দিলে সেসব সিকিউরিটি পেয়ে যাবে? উল্টো পড়াশোনা নেই, মা-বাবা নেই এইজন্য তার স্বামী সুযোগও নিতে পারে। যেহেতু সে জানে যে মেয়ের যাওয়ার কোন জায়গা নেই, এইজন্যই হয়তো যাচ্ছেতাই আচরণ করে বসলো।

– সেটা কেন হবে..

– কেন হবে না?আপনাকে কি গ্যারান্টি দিয়েছে তারা? এমন কি হয় না? যদি এমন কিছু হয় আপনি কি সেই কষ্ট পূরণ করতে পারবেন? কেন আপনাদের মাথায় এটা ঢুকে বসে থাকে যে বিয়েই একটা এতিম মেয়ের জন্য সেরা সমাধান? বিয়ের নাম নিয়ে দায়িত্ব ঝেড়ে দেন, পরে তার জীবন শুধরে দেবার ক্রেডিটও নিতে আসেন,বাহ ভালোই তো।”

রাবেয়ার কন্ঠস্বরে উদ্যত ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল কোন সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছে। মোজাফফরের কানে এই সকালেও যেন প্রত্যেকটা শব্দ বেজে যাচ্ছে। সেসময় ঘুরে নদীর দিকে তাকিয়েছিলেন। নদী মাথা নামানো ছিলো,তবে আত্মপক্ষ রক্ষায় তিনিও শক্ত থাকার চেষ্টা করেছেন,

” মুখে মুখে দরদ দেখানো সোজা রাবেয়া আপা। আমরা দায়িত্ব নিয়েছি।যা করব নদীর সিকিউরিটির জন্যই করব।

” মোজাফফর ভাই একটা মানুষের সবচেয়ে বড় সিকিউরিটি তার জ্ঞান, দক্ষতা ও যোগ্যতা। যদি তার কেউ দায়িত্ব নেবার না থাকে এই জিনিসগুলোর বলে মানুষ নিজের দায়িত্ব নিজে নেয়। আপনারা কি চাচ্ছেন না নদীর এই বৈশিষ্ট্যগুলো হোক?

মোজাফফর হোসেন এইবার ক্রোধ দমন করতে পারলেন না – আপনারা ক্ষণিকের অতিথি হয়ে একটু বাড়াবাড়ি ভাবছেন ।

” বোন বেঁচে থাকতে তার সুযোগ নিয়ে, এখন তার কন্যাকে অযত্ন তো গ্রহণযোগ্য নয়। ”

” হ্যাঁ এখন তো আমরাই খারাপ। নদী এতিম হওয়ার সময় কোথায় ছিলেন আপনারা?আজকে হুট করে উদয় হলেন, ভাইঝিকে বিরাট বিদ্বান বানাবেন। ওর মা মারা যাবার পর আমরা সব ভাইবোন মিলে ওকে আশ্রয় যদি না দিতাম… ”

“আপন বোনঝিকে কেউ করুণা করে আশ্রয় দেয় না ভাই। “এতক্ষণ পর সোহরাব সামদানী সাহেব কথা বলে উঠলেন। আরও বললেন, “বাবা-মার অবর্তমানে আন্তরিকতার সাথে তার সন্তানের দায়িত্ব নেয় পরিবার নেয়, নিজের সন্তানের মতো পালনও করে। কিন্তু মন থেকে দায়িত্ব পালন করলে কেউ এভাবে জাহির করে না ”

” মামা! ” নদীর কথায় গত বিকেলের কথোপকথনের স্মৃতিতে বাধা এলো।

” মামা আমার ফুডস এন্ড নিউট্রিশনস এ হয়েছে। ”

” হয়েছে! সত্যি?” মোজাফফর হোসেন চমকে গেলেন। ” কিন্তু ফুডসের নিউট্রিশন এটা আবার কি?বাবুর্চিগিরি? এটা শেখার কী আছে?. অবশ্য এই ক্যাম্পাসটাই তো কেমন, হোম ইকোনমিকস! এখানে পড়ে কোন লাভ হয়?”

” লাভ না হলে কেউ কি পড়ে? তারওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদ মামা, কিন্তু কো-এড নাই। কোন ঝামেলা নাই, দেখেন কতো সুন্দর ক্যাম্পাস।কত বড় হোস্টেল! মামা আমি পড়তে চাই, হাত জোর করছি আমি কোন অভিযোগের সুযোগ দেব না”

নদী সত্যি সত্যি হাত জোড় করে ফেলল।
সর্বদা শান্ত দেখা ভাগ্নিকে এইভাবে কাঁদতে দেখে মোজাফফর হোসেন সাহেব কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। তবে এই রেজাল্টে পাশার দান উল্টো পড়ে গেল।নদীর মাঝে বিদ্রোহী একটা সত্তা দাঁড়িয়ে গেল। আনন্দের সাথে রাবেয়াকে কল দিয়ে জানিয়ে দিলো বড় মামা ভাগ্নিকে নিয়ে গেট দিয়ে বের হয়ে রিক্সায় উঠে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন

” একটা সত্যি কথা বলবি নদী, ঐদিন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে রাবেয়া আর সোহরাব ভাইকে কি তুই ডেকে নিয়ে এসেছিলি? ”

“না তো মামা আসলে… ”

” তুই যদি জানিস যে তুই যা করছিস সেটা তোর জন্য ভালো তাহলে এই বিষয়ে মিথ্যা বলবি কেন? তাদের তুইই ডেকেছিলি যেন আমায় বোঝায়। ”

“মামা আমি পড়তে চেয়েছিলাম। আব্বু একজন স্কলার ছিলেন, দাদাজানও প্রফেসর ছিলেন… বিয়ে করলে আমি আগাতে পারতাম না”

বড় মামা হাসিমুখে বললেন, তোর বয়সে আমার মুরুব্বিরা আমাকে উপদেশ দিত, সৎপথে থাকবা, ঈমানদার থাকবা, সত্যি কথা বলবা তাহলে তোমার সফল হতে কেউ বাধা দিতে পারবে না। এই কথাগুলো আসলে ছেলেভোলানো কথা।শুধু সততা আর পরিশ্রম দিয়ে কিছু হয় না। এগোতে হলে মাথায় অসম্ভব বুদ্ধি রাখতে হয়, স্বার্থপর হতে হয়, লক্ষ্যের প্রতি আগ্রাসী হতে হয়।এখন মনে হচ্ছে তোর মধ্যি তেমন বিষয়গুলো আছে। ”

“মামা আমার খুব ইচ্ছা… আমাকে এখানে অনার্স করতে দেন ”

” একটা শর্তে।

মোজাফফর সাহেব কিছু থেমে বললেন , ” এইখানে পড়তে হলে একটা বিষয়ে থেকে তুমি নিজেকে আলাদা রাখবা

-আমি শুধু পড়াশোনাই করব। আমি নিশির মতো হবো না,…।

” সেটা তো হতিই হবে। ঝামেলা জানতি পারলে তো আমি কানে ধইরে তোমারি নিয়ে যাবো। তবে এইখানে আরেকটা বিষয় আছে, মোজাফফর সাহেব একটু থেমে বললেন,

” আমাদের সম্পর্কে তোমার একটা যে বিরূপ ধারণা তৈরি হয়েছে, যে আমরা হয়তো তোমার ভালো চাই না। এই ধারণা কাটাতেই তোমায় একা রেখে যাচ্ছি।
কিন্তু তুমি কিছু বিষয় জানো না, সেটা জানলে হয়তোবা বুঝতে কেন তোমাকে এই শহর থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলাম।
তোমার বাবার বোকামির কারণে আমার বোনের ফ্যামিলি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তুই তাদের শেষ চিহ্ন, আমরা তোকে যেভাবেই রেখেছিলাম তুই কিন্তু সুরক্ষিত ছিলি।
যাহোক তুই এখানে থেকে পড়াশোনা কর।আমি মাসিক খরচ পাঠাবো। শানুও কিছু পাঠাবে বলল। শুধু একটা বিষয়ে সতর্ক থাকিস। ওই পুরনোভিটার ছায়া মাড়াবি না। ওর দশমাইলেও যেন তোর পায়ের ধুলো না পড়ে। মাইন্ড ইট!

নদী ঘুরে তাকালো দিনে দুপুরে কোলাহলে কিন্তু মামার কথার মানে বুঝলো না। রেজাল্টের পর মোজাফফর হোসেন সাহেব সেদিন ঢাকা ত্যাগ করলেন না। দুইদিন পর ভাগ্নিকে ভর্তি করিয়ে নিলেন। এই বাড়তি দুইদিনেও নিশির কোন খবর নেই। বড়মামা সাথে আছে শুনে সে আরও ঝিম মেরে গেল মনে হলো।ফোনও করে না।

মোজাফফর সাহেবের এই মেয়েটাকে নিয়েও চিন্তা হয়। কিন্তু শানুকে বলে লাভ নেই। লাগাম টেনে ধরে রাখার মানুষ উদাসীন হলে তার কি বলার আছে। অবুঝ বিদ্রোহীদের কাছে লাগাম গলার ফাঁসের মতো।বড়মামা এর মধ্যে মেয়েদের হোস্টেলের খোঁজ করলেন। জানা গেল হোস্টেলের এপ্লাই করতে হবে ক্লাস শুরু হবার পর। হোস্টেলে সিট পেতেও সময় লাগতে পারে।
সেকেন্ড সেমিস্টার পরীক্ষা এখনো হয়নি হলে এরপর মেয়েরা নতুন রুমে স্থানান্তর হবে তবেই নতুন সিট পাবে। ততদিন পর্যন্ত ফার্স্ট সেমিস্টারের মেয়েরা ক্যাম্পাসের কাছেপিঠে সাবলেট নিয়ে ক্লাস করে থাকে৷ নদী আপাতত নিশির কাছে আছে। যদিও সেটা বড়মামার পছন্দ না। তবে মামা ভাগ্নিকে নিরাশও করলেন না। নীলক্ষেত থেকে বইখাতা কিনে দিলেন,কিছু কলেজে যাবার যোগ্য থ্রিপিস কিনলেন নিউমার্কেট থেকে। নতুন বছর নতুন দিনে নদীর বুকে তখন হাজার রঙের প্রজাপতি ডানা মেলছে।যেন আগের সব খুশিগুলো বাতাসে মিষ্টি সৌরভের মতো ফিরে আসছে। সবচেয়ে অসাধারণ ব্যাপার হলো ঢাবি হোম ইকোনমিকস ক্যাম্পাস আজিমপুর থেকে ধানমণ্ডি দূরেও নয় তেমন। সোহরাব আঙ্কেল আছেন রাবেয়া ফুপি আছে পারলে যেন উড়েই চলে যাবে চন্দ্রমল্লিকায়।

তবে তার এই খুশিতে সবাই সামিল হতে পারলো না।মোবাইলে রানু খালা সব শুনে অনেক চেঁচামেচি করলেন
বিশেষ করে ঢাকার খরচ কে তুলবে এই নিয়ে অনেক তর্ক জুড়ে দিলেন।। মোজাফফর সাহেব বোনকে ধমকে চুপ করালেন।তবে তার কপালে ভাঁজ লুকালো না। নদী নিজের উচ্ছাস দমিয়ে শান্তমুখে দাঁড়ালো। বিদায়বেলায় বড় মামা দুটো হাজার টাকার নোট গুজে দিলেন হাতে

“মনোযোগ দিয়ে পড়িস।৷ ফিরেই তোর খরচের কিছু টাকা আলাদা করে রাখবো। হোস্টেলের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত নিশির এখানেই থাকতে হবে এই যা ঝামেলা। ছুটি, পার্বন ইদের আগে আমি নিয়ে যাব বা তোর মেজমামা আসবে। তবে এর মধ্যে কোন ঝামেলায় জড়াবি না কোন দিকে তাকাবি না। ”

” কখনো না”নদী মাথা নাড়লো

” অনেক রঙিন ইশারা আসবে কিন্তু সাবধান, আমার কথা মনে রেখো। এই পৃথিবীটা ভালো না। আর হ্যাঁ যেটা বলেছি মনে রাখবি। ওই ধানমণ্ডির ঠিকানায় তুমি পা মাড়াবে না। কোন অবস্থাতেই না। ওই জায়গা তোমার জন্য না।

নদী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বড় মামা খুব শক্ত গলায় কথাটা বলছেন। চন্দ্রমল্লিকার বিষয়েই কি বলছেন?

” ওই বাসায় তোমার ফুপু আর তার বন্ধু হোটেল চালাচ্ছে ভালো কথা। কিন্তু তুমি তার ত্রিসীমায় থাকবে না।”

” কেন মামা? ”

” আমি মানা কইরেসি এইজন্যি। ওটা একটা অপয়া বাড়ি । এখন ওর সাথে কোন সম্পর্ক তোমার নেই। ”

নদী হোঁচট খেয়ে ম্লান হয়ে গেল। যদিও চন্দ্রমল্লিকায় গেলে মামা স্বাভাবিক ভাবেই জানতে পারবেন না।তবে আইনের শেকল ভাঙার মাঝে একটা দ্বিধা কাজ করে।

” আমি যদি জেনেছি তুমি সেখানে কোন কারণে গেছ,পড়াশোনা সেইদিন থেকে বন্ধ।সোজা সাতক্ষীরা নিয়ে বিয়ে দিয়ে দেব, কথা দাও ”

” মামা,কথা দিলাম ”

বড় মামা বিদায় নিলেন। নদী মনক্ষুন্ন হয়ে চোখ বন্ধ করলো। চোখের মাঝে ফেলে আসা পুরনো ঠিকানার ঝলক আসছে, মায়ের রান্নাঘর, চিলেকোঠার ঘর, উঠোনে বাবলুর ফোকলা দাঁতের হাসি লাইব্রেরিতে পড়াশোনারত বাবা…
আবার হঠাৎ ঝলমলে রেস্টুরেন্টের ফোয়ারা, তার দিকে বাড়িয়ে দেওয়া একটা হাত, সুন্দর পুরুষলি একটা শান্তমুখ, গ্যাব্রিয়েল সামদানী! অদ্ভুত নাম। গাঢ় গভীর চোখ। বুকটা কেঁপে উঠে কেন যেন।

নদী মাথা ঝাড়া দিয়ে স্মৃতি তাড়ালো। চন্দ্রমল্লিকার অতীতের স্মৃতির বর্তমান মিশে কেন যাচ্ছে। বদলে যাওয়া বর্তমানের সাথে তো তার কোন যোগ নেই। তবুও কেন সেই নিষিদ্ধ ঠিকানাই তাকে টানছে?সত্যি কী আছে সেখানে?

(চলবে)