বাদামি চোখ পর্ব-০৭

0
463

#বাদামি_চোখ [০৭]

আমার মাথা পুরো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
মাথায় বিরাট পাথর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে যেন। আমি আড়চোখে দেখছি তনয় পেছনে আসছে কিনা! আর আসার সময়ই বা আমি কি দেখলাম?
আমার সন্দেহের তীর সেখানেই বা হঠাৎ কেন বিধঁলো? আমার ধারণা কোনো অংশে সঠিক নয়তো আবার?

এদিকে তনয়ের মা আমাকে একটা রুমে বসিয়ে বললো,
‘ বোকা মেয়ে, খিদে পেয়েছে আরো আগে বলবে না?

আমি উনার কথা শুনে পুরো হা হয়ে উনার দিকে তাকালাম। কি বলছে এসব? আমার খিদে পেয়েছে এই কথা কখন বললাম?
তারপরই মনে হলো তনয় বোধহয় তার মায়ের কানে কানে বলেছে আমার খিদে পেয়েছে।

তিনি আমাকে বসিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে গেলেন। আর কয়েক মিনিটের মধ্যে তনয় ভেতরে আসলো, তার হাতে খাবারের প্লেট ।
আমি ওকে দেখেই বললাম,
‘ আরে এতক্ষণ ধরে ওখানে যা যা খাচ্ছি এতেই পেট ভারী হয়ে আছে, আপনি কোন হিসেব করে মাকে খিদে পেয়েছে কথাটা বললেন, বলেন তো?

তনয় হাসতে হাসতে বললো,
‘ আরে তুমি না খেলে আমি খাবো, কিন্তু সেখান থেকে উঠে আসার জন্য আর কিছু বলার মতো পাচ্ছিলাম না। এখন বলো কিসের জরুরী কথা?

আমি ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়লাম এবার। ফোনটা বাড়িয়ে বললাম,
‘ নাম্বারটা ভালো করে দেখুন আরেকবার। ভালো করে দেখে বলুন এমন কোনো নাম্বার জীবনে একবার হলেও দেখেছেন কিনা!

তনয় আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বললো,
‘ তোমাকে কি বলেছে ? আচ্ছা আমি ফোন দিয়ে দেখবো কে? কিন্তু তুমি এতো বেশি সিরিয়াস হচ্ছো কিসের জন্য, বলোতো?

আমি সোজাসাপ্টা বললাম,
‘ বলেছে আমি আপনার সাথে সুখী হবোনা, সে আমাকে থাকতে দিবেনা। কেননা আমি তার ভবিষ্যৎ সংসারে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে এসে পড়েছি, এই জায়গায় তার থাকার কথা ছিল! সে একটা মেয়ে ছিল এবং আপনাকে সে পেতে চায়, এখন শুধু আমাকে সরে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। বলছে এখনো নাকি সময় আছে!

বলেই আমি আমার গালে কপালে হাত রেখে তনয়ের জবাব শোনার আকুলতা প্রকাশ করছি, মাথা ঝিমঝিম করছে খুব! আমার জানা নেই সে এখন কি বলতে পারে!

কিন্তু তনয় কিছু বলছেনা। আমি ওর দিকে তাকাতেই দেখি সে পুরো মুখটা সার্কাসের ন্যায় করে ফেলেছে। আমি তাকাতেই সে হাত বাড়িয়ে কপাল ছুঁয়ে বললো,
‘ তুমি ঠিক আছো তো নিবিতা? শরীর খারাপ লাগছে? সবকিছু ঠিকঠাক দেখতে কিংবা শুনতে পাচ্ছো?

আমি এবার রাগ নিয়ে বললাম,
‘ আমাকে দেখে তাই মনে হচ্ছে? আরে বলুন না সে কে হতে পারে? আমার মাথায় প্রচন্ড রকম ব্যথা হচ্ছে, বিশ্বাস করুন আমি মিথ্যে বলছিনা। আপনি ফোন দিয়ে দেখুন। আর আপনার পূর্ব কোনো সম্পর্ক থাকতেই পারে তাইনা!

তনয় তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
‘ ওয়েট তাহলে ফোন দিয়ে দেখাচ্ছি। কার এতো বড় সাহস আমার সম্পর্কে এসব কথা বলে? আমার নাকি পূর্ব সম্পর্ক!হাহাহাহা, এখনি ফোন দিচ্ছি, সব খোলাসা হয়ে যাবে!

বলেই তনয় কল করলো। রিং হচ্ছে!
আমি তনয়কে ইশারা করলাম স্পিকার বাড়াতে।
তনয় স্পিকার বাড়িয়ে ফোনটা সামনে নিয়ে রিসিভ করার অপেক্ষা করছে।
প্রথম কলটা রিসিভ হলোনা, দ্বিতীয়বার আবার কল করলো।
রিংয়ের একদম শেষ পর্যায়ে রিসিভ করেই একটা ছেলের ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে আওয়াজ আসলো,

‘ নিবিতা কেন ফোন দাও আর? আমাকে ঠকিয়ে আরেকজনের সাথে বিয়ের পিড়িতে বসেছো, আমার জীবনটাকে সিগারেটের ছাইয়ের মতো করে দিয়েছো, আর সেই ছাই তুমি এখন পা দিয়ে পিষো সর্বক্ষণ ! বিশ্বাস করো আমি শেষ পর্যায়ে আছি, আর মাত্র অল্প জ্বলে নিঃশেষ হয়ে যাবো! এরপর আমি তোমার চোখের মায়াতেও কোনোদিন সামনে এসে দাঁড়াবোনা। ভালো থেকো তুমি তোমার ভালো লাগার মানুষের সাথে, এমন না হোক আমার মতো একদিন তার উপর থেকেও তোমার ভালো লাগা উঠে গেছে!

তনয় বড়বড় চোখ করে আমার দিকে তাকালো। তার থেকেও বড় বিষ্ময়ে আমি এবার বুঝতে পারছি বসার স্থিরতা নেই আমার। কিসব শুনছি আমি? মাথা দুলছে, আমি হেলে যাচ্ছি এইটুকুই বুঝতে পারলাম।
তনয় আমাকে শেষ ঝাকিয়ে বলছে,
‘ নিবিতা কি হয়েছে? এই এই চোখ খোলা রেখো, ডক্টর ডাকছি।

অতঃপর আমি পরবর্তীতে আমাকে আবিষ্কার করলাম হাতে স্যালাইন দেওয়া অবস্থায়। চোখ খুলেই আমি দেখলাম আম্মু পাশে বসে বিরবির করে কিছু বলছে। আমি আম্মুকে দেখেই বললাম,
‘ আম্মু কি হয়েছিল আমার?

আম্মু আমাকে ধমক দিয়ে বললো,
‘ খাওয়াদাওয়া ঠিক করে করিস না কেন? শরীর এতো দূর্বল হয়ে গেছে, যে তুই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি। তনয়ের মা বললো তুই খাবার চেয়েছিলি, উনি নাকি দিয়েছিলো। আর ততক্ষণে তুই! হুহহ আমাকে তো বলতে পারতি তাইনা?!

আমি আম্মুর দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বললাম,
‘ স্যালাইন খুলে দিতে বলো মা। আমার কিছু হয়নি। আর তনয় কোথায়?

আম্মু মাথায় হাত রেখে বললো,
‘ একদম চুপ করে শুয়ে থাক। এখন সবাই ঘুমিয়ে আছে। ভোর ৫ টা বাজতে চলেছে। তনয় অনেক্ষণ ছিল এখানে, একটু আগেই আমরা ওকে রুমে পাঠালাম, ছেলেটা কতো অস্থির হয়ে আছে জানিস?
মানুষ কি নিজের শরীরের প্রতি এমন বেখেয়াল হয়?

আম্মুর কথা ভালো লাগছেনা একদম। আমি হাত বাড়িয়ে বললাম,
‘ মা আমার ফোনটা দাও তো।

মা চোখ এদিক ওদিক করে বললো,
‘ তোর ফোন তোর ভাবির কাছে ছিল না?

‘ আরে না মা খেতে যাওয়ার সময় আমার কাছেই ছিল।

‘ তোর কাছে কোনো ফোন ছিল না, আমরা তো তনয়ের ডাকের সাথে সাথেই ওখানে গেছি। আর ডক্টর ডেকেছি। ডক্টর বললো তোর প্রেসার অনেক লো হয়ে গেছে, আর কোনো কিছু নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করছিস তাই এভাবে অজ্ঞান হয়ে গেছিস। কিসের চিন্তা তোর? আমাদের ছেড়ে চলে যাবি বলে খারাপ লাগছে? আরে মেয়েরা কি চিরকাল নিজের বাড়িতে থাকে বল? তুই কি অবুঝ নাকি?

আমি রাগী স্বরে বললাম,
‘ মা তুমি ঘুমাও। এসব কিছু না! উল্টা পাল্টা বলছো তুমি!

মা মুখ বাঁকিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

আর আমি চোখ বন্ধ করলাম। আমার ফোন কি তাহলে তনয় নিয়ে গেছে?
কিন্তু এটা কে ছিল? আমাকে নিয়ে কেন এভাবে বললো?
আমার সাথে যখন কথা বলছিলো তখন তো সেটা একটা মেয়ে ছিল, আর তনয় ধরাতে সেটা ছেলে কি করে হতে পারে?
তাও আবার তনয়ের কাছে আমাকে নিয়ে আজেবাজে বলেছে, আবার তার আগে আমার কাছে তনয়কে নিয়ে বলেছিল!

আর এই অনেকগুলো বিষয় মাথায় জোরালো চেপে বসার জন্যই হয়তো আমি আর স্থিরতা বজায় রাখতে পারিনি। থাকবো কি করে? একে তো আমি প্রস্তুতি নিতে গেছি লিয়নের ব্যপারে সব বলবো, এর মধ্যে যদি আরেকজন এসব বলে, তনয় কোনটা বিশ্বাস করবে?
দূর মোবাইলটাও পাচ্ছিনা, সিমটা এক্ষুনি খুলে ফেলে দিতাম! আমার নাম্বার পেলো কি করে?
কেন যে সবাই আমার পেছনে উঠেপড়ে লেগেছে কে জানে? কার কি ক্ষতি করেছিলাম আমি?

তবে একটা গভীর ভাবনা এই মূহুর্তে উদয় হয়েছে, সেটা আমার ভাবনাকে পুরোপুরি ছাড়িয়ে গেছে!
সেটা হলো আমি যখন ফোন রিসিভ করি তখন আমার এখানে প্রচন্ড আওয়াজ ছিল, আশেপাশে অনেকদূর সেই আওয়াজ যাবে। কিন্তু ফোনের অপরপ্রান্তে কোনো রকম শব্দ ছিল না। আবার তনয়কে যখন ছেলেটা কিছু বলেছিলো তখনও কোনো মিউজিকের শব্দ পাইনি, অথচ তখনও বেশ আওয়াজেই গানবাজনা চলছিলো! তাহলে সে কি এখানকার কেউ নয়? আমার সন্দেহ সেই ব্যক্তির আশপাশও ঘিরতে পারছেনা?
কে হবে যে আড়াল থেকে এসব করছে? কি চাচ্ছে সে!

আমার ভাবনার কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিনা আমি!
ভাবতে ভাবতে আবারও ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে খাবার নিয়ে এসে ভাবি আমাকে ডাকলো।আমি দেখলাম কেউ হাতের স্যালাইন ইতোমধ্যে খুলে দিয়েছে, কেননা এটা শেষ।
আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে এসে বসলাম আর ভাবিকে বললাম,
‘ ভাবি আমি যখন অজ্ঞান হয়েছিলাম তুমি তখন কোথায় ছিলে?

ভাবি হেসে বললো,
‘ ওইতো আশেপাশেই ঘুরাঘুরি করছিলাম।

আমি মুখটা ফিরিয়ে খাবারের প্লেট হাতে নিলাম। আর খেতে লাগলাম। ভাবি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো,হয়তো আমি এই প্রশ্নটা কেন করলাম এটা ভাবতেই উনি ভেবাচেকা খেয়েছেন! এটা নিয়ে কোনো কিছু বলতে চেয়েও বললোনা। উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ কিছু লাগলে ডেকো আমায়।

আমি হাত নাড়িয়ে বললাম কিছু লাগবেনা আর।

আমার খাওয়া শেষ হতেই তনয় আর তার মা একসাথে আসলো। তাদের দেখেই আমি নড়েচড়ে ঠিক হয়ে বসলাম। তনয়ের মা আমার কাছে বসে বললো,
‘ নিবিতা এখন শরীর ভালো? সুস্থবোধ করছো কিছুটা?

আমি হেসে জবাব দিলাম,
‘ আলহামদুলিল্লাহ সম্পূর্ণ ভালো এখন। রাতে আসলে..

তিনি এগিয়ে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘ দেখো আমিও তো এখন থেকে তোমার আরেকটা মা। যা কিছু লাগবে একদম খোলা মনে বলবে বুঝেছো?

আমি হ্যাঁ সম্মতিতে মাথা ঝাকালাম। তখনি তনয় বললো,
‘ খোলামনে বলার অধিকার আমার থেকে হরণ করে নিওনা আবার। আমার জন্য খাওয়ার কিছু আনো, নইলে আমিও জ্ঞান হারাবো!

তনয়ের মা এটা শুনে হাত বাড়িয়ে ঠাস করে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো,
‘ ফাজিল! বস আমি আনতেছি।

বলেই তিনি উঠে চলে গেলেন।
উনি যাওয়ার পরেই তনয় একটু এগিয়ে এসে বললো,
‘ এই যে তোমার ফোন। রাতে আমার কাছেই ছিল, আমি বুঝার চেষ্টা করেছিলাম কে সে! কিন্তু আর কল রিসিভ করেনি।

আমি মন খারাপ করে চুপচাপ বসে আছি। তনয় আমার ব্যপারটা বুঝতে পেরে বললো,
‘ নিবিতা আমাকে বিশ্বাস করো তো তুমি?

আমি ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললাম,
‘ হ্যাঁ খুব করি।

তনয় এবার আমার হাতটা একটু ছুঁয়ে বললো,
‘ তাহলে দুনিয়ার সব মানুষ আমাদের পিছে পড়ুক, কিন্তু আমাদেরকে আটকাতে পারবেনা। কেননা আমিও তোমাকে ভীষণ ভীষণ ভরসা করি। আর যাই হোক তুমি কারো সাথে অন্যায় করতে পারোনা।
আমাদের বিয়ে আটকানোর ক্ষমতা এসব দুষ্টলোকের কখনোই হবেনা, তুমি প্লিজ শান্ত হও!
দুজন মিলে ব্যপারটা অনুসন্ধান করবো।

আমি তনয়ের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে এবার হেসে ফেললাম!

চলবে…..

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার