বাদামী চোখ পর্ব-০১

0
946

গল্প’ #বাদামী_চোখ
পর্বঃ [০১]
লেখা’ #তাজরীন_খন্দকার

ঈদের ব্যস্ত শপিংমলে হঠাৎ কাঁধ চাপড়ে একটা মেয়ে বলে উঠলো,
” আপু আপনার চোখের রঙ দেখে আমি থমকে গেছি! কোনো লেন্স ব্যবহার করেছেন নাকি?
কথাটা শুনে আমি পেছনে তাকিয়েই ভীষণরকম আৎকে উঠলাম। কারণ মেয়েটার খুব পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা অতি পরিচিত মুখ। যে কিনা আমার চোখের রঙ বাদামী বলে দেড় বছর আগে তার সাথে আমার বিয়ে ভেঙে দিয়েছিলো!
অবশ্য সে পরিবারের অজুহাত দেখিয়েছিলো। বলেছিলো তার পরিবার আমাকে শুধুমাত্র চোখের রঙের জন্য মেনে নিবেনা। কেননা তাদের বিশ্বাস আমাকে বিয়ে করলে আমাদের সন্তানদেরও এমন চোখ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর চোখের মনি যদি কালো না হয় সেটা আমাদের সামাজিকতায় অস্বাভাবিক। শরীরের একটা অঙ্গ বিকলের ন্যায় এটাও নাকি দূর্বলতা। কি জানি? আমার তো কখনো মনে হয় না আমি অন্যদের থেকে চোখে কম দেখি, কিংবা এই চোখে অন্যদের তুলনায় কোনো কিছুর ঘাটতি আছে বলে!

এই মূহুর্তে আমি মেয়েটাকে না চিনলেও বুঝেছিলাম তার স্ত্রী হবে। সে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার মাত্র পনেরোদিন পরেই সবার মতামতে বিয়ে করেছিলো। আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলাম, মেয়েটা চোখেও কোনো লেন্স ব্যবহার করেছে। আমি তার চোখে একবার খেয়াল করে সেই চেনা মুখটাই লক্ষ্য করলাম, খুব অবাক হয়েই আমার দিকে তাকিয়ে আছে সে।

এবার আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম,

” না আপু, আমার চোখ জন্ম থেকেই এই রঙের। কোনো লেন্সের দরকার হয়না। আর আমি এতেই সন্তুষ্ট!

মেয়েটা উৎসুক হয়ে তার স্বামীর হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,

” দেখেছেন কি সুন্দর এই রঙের চোখ? আমি এতো সুন্দর চোখ বাস্তবে আর দেখিনি। ইশ! আমাদের যদি এমন বাদামী রঙা চোখের একটা বেবি হতো!

আমি মেয়েটার কথার কোনো জবাব না দিয়ে আলতো হেসে অন্যদিকে চলে এলাম।
কিন্তু অনেক কথা হুট করেই ভেতরে এসে জড়ো হয়েছে। অতীতের তলহীন দৃশ্যকাব্যগুলো ভেসে উঠছে হুড়হুড় করে!

হ্যাঁ এই ছেলেটাই একদা বলতো,
“নিবিতা তোমার চোখ দুটো আমাকে খুলে দিয়ে দাও! অল্পসময় তোমার আঁখিজোঁড়ায় তাকিয়ে থেকে আমার মন ভরেনা!

ওর কথায় আমি আমার ছোটবেলা ভুলে যেতাম।
ভুলে যেতাম এই চোখগুলো একটা সময় আমাকে বিষিয়ে তুলেছিলো, নিজের চোখকে নিজেই ঘৃণা করতাম তখন!

সবাই আমাকে সুন্দর বলে প্রশংসা করে তাদের পরের বাক্যটায় কণ্ঠস্বর ক্ষীণ করে ফেলতো। ধির কণ্ঠে আমার মা’কে বলতো,
” ভাবী আপনার মেয়েটা ভীষণ সুন্দর হয়েছে, গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা, গোলগাল চেহেরা কিন্তু সে তো বিড়ালচোখা! আপনাদের মধ্যে তো কারো এমন চোখ নেই, সে কোথা থেকে পেলো? বিয়ের সময় কিন্তু আটকাবেন!

ওদের কথায় আমার মায়ের মুখটাও বিরাট আকারে ব্যথিত হতো। আমারও ভীষণ খারাপ লাগতো।
এমনকি আমার সাথীসঙ্গীরাও আমাকে বিড়াল বলতে গিয়ে বিলাই বলে ক্ষেপাতো! আমিও একটা সময় আয়নায় তাকিয়ে বলতাম, আমার চোখের রঙটা ছাড়া আমার মধ্যে আর কিছুরই ঘাটতি নেই! অন্যদের তুলনায় আমি অনেক সুন্দর, কিন্তু আমার চোখগুলো কেন সবার মতো কালোমনির হলোনা?
যতবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছি শুধু ভেতর থেকে আফসোসের সাথে দীর্ঘশ্বাসই বেড়িয়ে এসেছে।

কিন্তু ধিরে ধিরে বড় হলাম, শখের বশে কয়েকবার কালো লেন্সও লাগিয়েছি, কিন্তু আমাকে কালো লেন্সে একদমই ভালো দেখায়না। তারপর বুঝতে পারলাম সৃষ্টিকর্তা আমাকে ভীষণ যত্নে এবং মানিয়েই সৃষ্টি করেছেন! তখন থেকে নিজের চোখের প্রতি নিজের ভালোলাগা বাড়তে লাগলো। ভুল করেও আমার চোখের জন্য আমার আফসোস হয়না।
আফসোস হয় তাদের জন্য, যারা আমার চোখ নিয়ে এই ধরনের অপ্রীতিকর কথাবার্তা বলে।

এরই মধ্যে আমার জীবনে এসেছিলো সেই লিয়ন। ভীষণ সিনেমাটিক ছিল আমাদের প্রেম কাহিনী!
তার আমাকে ভালোবাসার মূখ্য উপাদানই নাকি ছিল আমার বাদামী রঙের চোখ। আমার চোখ দেখেই সে আমার উপর মুগ্ধ হয়েছিলো। আজকাল মনে হয় ওইসব হয়তো আমাকে পটানোর কৌশল ছিল।
সত্যিকার ভালো লাগলে তো এর জন্যই আবার বিয়ে করতে অরাজী হতোনা। কিংবা এমনও হতে পারে আমার চোখ প্রেমিকাযোগ্য ভালোলাগার, কিন্তু বিয়ের জন্য নয়। জানিনা আমি, কতকিছুই হতে পারে!

আমি নিজের কিছু কেনাকাটা করে বেড়িয়ে পড়লাম। আজকের আবহাওয়া ততটাও উত্তপ্ত নয়,তবুও আমি ঘামছি! লিয়নের স্ত্রী দেখতে খারাপ না, আছে ভালোই। মেয়েটা আবার বেশ খাটো! তবে ভীষণ স্মার্ট, আধুনিকতার ছোঁয়া তার মধ্যে অত্যাধিক সেটা দেখলেই বুঝা যায়।
সবকিছু কেমন কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছিলাম, তার মধ্যেই আবার পুরনো ক্ষতবিক্ষত ঘাঁ উঁকিয়ে আবার সেসব উতলে দিচ্ছে।

আমি একটা রিক্সা ডেকে নিজের গন্তব্যে রওয়ানা দিয়েছি। এই শহরের যেদিকে তাকাই আমি লিয়নের সাথে আমার অস্তিত্ব দেখতে পাই। ওর সাথে পুরো শহরটাই আমার দেখা হয়ে গেছে!
শুধু দেখা হয়নি আমার জন্য ওর ভেতরকার হৃদয়টা, এটা কি তাহলে বাদামী বর্ণের চোখের একমাত্র দূর্বলতা? এই চোখে কারো ভেতর দেখতে পাওয়া যায়না?স্পষ্ট বুঝা যায়টা সেখানে লেখা বাক্যগুলোর এক একটা অক্ষরও?
হয়তো তাই হবে, নয়তো আমি কেন এই একটা অজুহাতে ওর হতে পারলাম না!?

বাসায় এসে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে ফোন হাতে বিছানায় বসলাম।
লিয়ন আমার চেয়ে প্রায় ৬ বছরের সিনিয়র। তাও অদ্ভুতভাবে আমাদের প্রেমটা বেশ জমজমাট ছিল। সে ছিল ক্যাম্পাসের প্রাক্তন ছাত্র, আর আমি তখন সদ্য ভর্তি হয়েছি। আশ্চর্যের বিষয় বলো, ওর বয়স যে এতো বেশি সেটা তখন আমার বিশ্বাসই হয়নি।
একদিন ইংরেজি লেকচারারের বদলে তার উপস্থিতি আমাকে অবাক করেছিলো, যেই ছেলেটা ইতোমধ্যে আমাকে প্রপোজ করেছে, তাকে ক্লাসে শিক্ষক হিসেবে দেখাটা সত্যিই চমকপূর্ণ।
সে শিক্ষক নয়, কিন্তু তাকে মেধাবী শিক্ষার্থীর অন্তর্ভুক্ত করে আমাদের শিক্ষকরাই পাঠিয়েছিলো সেদিন।

জানিনা তখনি কীভাবে ওর প্রতি আমার ভালোবাসা জন্ম নিতে থাকে।
ধিরে ধিরে কথা বলতে বলতে সেটার গভীরতা হয়ে উঠে অভাবনীয়! ওর সাথে সম্পর্কের তিন বছরেও ভুল করে আমার মনে হয়নি আমরা কখনো একে অপরকে হারাবো! স্বাভাবিকত মানুষের বিচ্ছেদের কারণ হয় ছেলের বেকারত্ব, কিন্তু সে গো সেসময়ই ছিল যোগ্যতাসম্পন্ন, তার ভালো একটা জবও ছিল।

কিন্তু এরপরও সামান্য চোখের রঙ নিয়ে বিয়ে ভেঙে দেওয়ায় আমি বুঝেছিলাম, বেকারত্বের দিকে আঙুল তুলে মেয়েরা যেমন অন্যত্রে বিয়ে করে অন্যায় করে, তেমন ছেলেরাও বেকারত্বের অবসান হলে আর পেছনে ফিরে তাকায়না, তার পা আর মাটি ছুঁয়না, আর তখন সেও ভালোবাসার সাথে কঠিনতম অন্যায় করে।


আমার জন্য অসংখ্য জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে, কিন্তু আমি ফিরিয়ে দেই। এইতো কাল রাতেও মা একটা সমন্ধ নিয়ে কথা বলতে এসেছিলো। আমি মা’র কথা শেষ হওয়ার আগেই উঠে চলে গেলাম।
কিন্তু এই মূহুর্তে একটা বিশ্বস্ত মানুষের শূন্যতা আমাকে চেপে ধরেছে! সে পারলে আমি কেন নয়?
সিদ্ধান্ত নিলাম পরবর্তী সমন্ধকে আমি দেখবো, অতীতের জন্য নিজের জীবন থামিয়ে রাখবোনা।

ঠিক তাই হলো, এর দুদিন বাদেই একটা সমন্ধ আসলো, এবং আমার কথা অনুযায়ী মা ছেলেকে আগেই বলে দিলো আমার চোখ নিয়ে বিস্তারিত। চোখের রঙ বাদামী শুনে নাকি ছেলেটার কণ্ঠস্বরে উৎফুল্লের রেশ ফুটে ওঠেছিলো।
প্রথমেই দুই পরিবার বললো, পাত্রপাত্রীর দেখা সাক্ষাৎ আগে হোক। পছন্দ হলে পরে তারা কথা আগাবে।

বাবার কথা শুনে আমি আমার ভাবীকে আমার সঙ্গে নিয়ে গেলাম রেস্টুরেন্টে।
কিন্তু জগতের নিয়ম আমাদের সাথে উল্টো হলো, ভেবেছিলাম পাত্র এসে অপেক্ষা করবে কিন্তু নাহ আমরা সেখানে আগে পৌঁছালাম।
প্রায় ২০ মিনিট পর লজ্জাভর্তি মুখমণ্ডল নিয়ে একজন চুপচাপ বসলো। বসে কোনো কথা বলছেনা। আমার ভাবী নিজ থেকে কিছু বলছিলো, সে শুধু জ্বী জ্বী করে মাথা নাড়ছে। প্রথমবার কোনো ছেলেকে এতো লজ্জা পেতে দেখলাম। আমি আমার হাসিকে যথাসম্ভব আটকে রাখার চেষ্টায় ছিলাম।
হঠাৎ আমার পেছন থেকে আওয়াজ আসলো,

” কিরে ভাই! কাল তো পাত্রী নিয়ে আমার সাথে কতো কথা বললি। এখন মুখ থেকে কিছু বের হচ্ছেনা কেন?

সামনে এগিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
” সে আপনার চোখের প্রশংসা….

বলেই থেমে গেলো। বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে সে! আর আমিও অবাক চোখে তাকিয়ে আছি লিয়নের দিকে।
আমি জানিনা এই সমন্ধের সাথে লিয়নের সম্পর্ক কি?
তবে এই মূহুর্তে দুদিকেই বিষ্ময়কর পরিস্থিতি।
অনেক কথা হয়েছে, আমিও না চাইতে অনেক কথা বলেছি। পাত্রের সাথেও আমার কথা হয়েছে। যতটুকু বুঝলাম পাত্র আমাকে অসম্ভব পছন্দ করেছে, আর তাকেও কোনোভাবে অপছন্দ করার কারণ পাচ্ছিলাম না। সবাই অল্প খাওয়াদাওয়া করলো।
একদম শেষ সময় আমি আর ভাবী ওয়াশরুমে গেলাম, ভাবী আমাকে বলছে..
” নিবিতা লিয়নের সম্পর্কে তো আমি জানি, আর যা জানলাম পাত্রের সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নাই, কিন্তু এখন পাশাপাশি থাকা ফ্ল্যাটে কি করে বউ হয়ে যাবে বলোতো ? ওদের দুই পরিবারে নাকি সম্পর্ক খুব ভালো।

আমি ভাবীর কথা শুনে বিনা জবাবে হাসলাম। পাত্রকেও এদিকে এসে ফোনে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে।
তারপর আমরা সবাই আবার এক হলাম। একে অন্যকে বিদায় জানালাম।
আমি এক হাতে সামনের টিস্যুটা টেনে হাতে নিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে গাড়ীতে উঠে নিজের মুখ মুছতে যেতেই অবাক হলাম।
টিস্যুতে কিছু লেখা আছে, আমি তাড়াতাড়ি করে সেটাকে খুলতেই দেখি সেখানে লেখা..

” আবেগীয় পাগল ভেবে তোমার একটা কথাকে সেদিন হেসে অপমানিত করেছিলাম, তুমি বলেছিলে তোমার মতো এতো তীব্র ভালোবাসা আমি কারো কাছে পাবোনা। আমার মনে হতো এটা একটা প্রচলিত বাক্য, এটা বিচ্ছেদের সময় ভেঙে যাওয়া ব্যক্তির হাস্যকর একটা অভিব্যক্তি মাত্র! কিন্তু আমি এখন প্রতিটাদিন অনূভব করি, সত্যিই কেউ বাসেনি। এটা একটা সময় হয়তো প্রতিটা মানুষ একবার হলেও বুঝতে পারে, কিন্তু বলতে পারেনা! বাক্যটা খুব বেশি অভিশপ্ত নিবিতা! এর ছোঁয়া তোমাকে না ভীড়ুক!
তুমি খুব সুখী হবে, ভীষণ ভালো রাখবে তোমাকে পাওয়া কাঙ্ক্ষিত সে মানুষ! ”

(লিয়ন)

আমি বেশ কিছুক্ষণ ধরে এর দিকে তাকিয়ে আছি!
তবে কি সে ইচ্ছে করে আমার সাথে বিচ্ছেদ টানিয়েছিলো? আমি তো ভেবেছিলাম তার পরিবারের জন্য তার ভালোবাসা বিসর্জন দিয়েছে। নাকি এমন হয়েছে যে আমার কথা তার পরিবারে একদমই জানায়নি?

চলবে?……