বাবুই পাখি পর্ন-৪৬+৪৭

0
1019

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৪৬
Writer-Afnan Lara
.
পুতুল নাস্তা নিয়ে আসার আগেই মিসেস রওনক এসে হাজির হয়েছেন।সিনথিয়াকে দেখে তিনি এত খুশি হলেন যা বলার বাহিরে।হাতের ব্যাগপত্র নিচে রেখে ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরেছেন তিনি।ইমাদের বাবা ভেঁচি কেটে ভেতরে ঢুকলেন চুপচাপ।সিনথিয়া কাঁদছে।হঠাৎ কাঁদছে কেন তার মানে অন্তিক ও বুঝলো না,ইমাদের বাবা ও বুঝলেন না।মিসেস রওনক ভাবলেন তাকে অনেকদিন দেখে না বলে হয়ত আবেগে কাঁদছে।পুতুল ধরে নিয়েছে ইমাদের শোকে কাঁদছে।বাকি রইলো ইমাদ, সে এতসব পরোক করতে যায়নি।পুতুলের শাড়ীর আঁচলের কোণা দিয়ে হাতে গিট্টুর উপর গিট্টু দিয়ে ফেলেছিল এতক্ষণে।এখন মায়ের আওয়াজ পেয়ে চটজলদি সেই গিট্টু খোলায় ব্যস্ত সে।
পুতুল ট্রে হাতে নিয়ে বিরক্ত হয়ে বললো,’কি বাচ্চাদের মতন শুরু করলেন?ছাড়ুন আমার আঁচল।নাস্তা দিতে দেরি হচ্ছে আবার চা বসাতে হবে।মা বাবা এসেছেন তাদের ও তো দিতে হবে নাকি?’

-‘জলদি করছি তো।আহা বিরক্ত হচ্ছো কেন?আমার গিট্টু দেওয়া এত টাইট হয় যে পৃথিবীর অন্য মানুষ ও দূরে থাক আমি নিজেই খুলতে পারিনা।কি করি বলো?’

-‘আমার এত স্বাদের শাড়ী ছিঁড়লে আপনার খবর আছে।জলদি করুন।পারিনা বললে কোনো কাজ হয়না।’

ইমাদ এক প্রকার তড়িগড়ি করেই কাজে মন দিয়েছে।পুতুল ট্রে হাতে উঁকি দিয়ে শুধু দেখছে উনারা কি করছেন।মিসেস রওনক সিনথিয়াকে পাশে বসিয়ে ওর চোখ মুছে দিচ্ছেন।ইমাদের বাবা এদিকে এসে বললেন,’জন্মের বাঁচা বেঁচে গেছি।এমনিতেও আমাদের ঘরে এক ড্রামা কুইন ছিল,সিনথিয়া নামক আরেক ড্রামা কুইন আসলে ঘর ঠাস ঠুস,দুম্মুর দাম্মুর করে একদিন ফেটে যেতো।এই জন্যই বুঝি বলে আগুনের জন্য পানি!’

ইমাদ খিলখিল করে হাসতে হাসতে গিট্টু খুলছে।পুতুল ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে ফিরে পায়ে জোরে চাপা দিয়ে বললো,’নিজের কাজ করতে পারেননা?আবার হে হে করে হাসে।দশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমি”

-‘কিরে ইমাদ কি করিস?’

-‘বাবা আসলে সমস্যায় পড়েছি।যেটা বলা যাবেনা।তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।আমি এটা সলভ্ করতে পারবো।’

পুতুল ট্রেটা শক্ত করে ধরতেই টের পেলো তার আঁচল টান খাচ্ছেনা। খুশি হয়ে সে ইমাদের দিকে তাকিয়ে বললো,’গিট্টু খুলতে পেরেছেন?’

ইমাদ বটি উপরে তুলে জিভে কামড় দিয়ে আরেক হাতে কান ধরলো।পুতুলের মেজাজ গরম হয়ে গেছে।ইমাদ ওর এত সুন্দর শাড়ীটা কিনা বটি দিয়ে কেটে দিলো।রাগটা প্রকাশ ও করতে পারছেনা।ইমাদ সরি বলতে বলতে শেষ।পুতুল চলে যাবার সময় ফিসফিস করে বলে দিলো,’সেম একটা শাড়ী এনে দেবো প্রমিজ’

পুতুল ট্রে এনে সেন্টার টেবিলের উপর রেখেছে।মা একটা বিসকিট নিয়ে সিনথিয়র দিকে ধরে বললেন,’ইশ!মেয়েটা কত শুকিয়ে গেছে।অন্তিক!! ওকে জোর করেও তো খাওয়াতে পারো।তোমার হবু স্ত্রী বলে কথা’

ইমাদ পুতুলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।পুতুল আবার চললো চা বানাতে। ইমাদ ও সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছিল সেসময়ে মা ডেকে বললেন এখানে বসতে অন্তিকের সাথে।তাই সে বাধ্য হয়েই থেকে গেলো।
সিনথিয়ার চোখ ইমাদের উপর থেকে সরছেনা।আর ইমাদের চোখ হলো রান্নাঘরের দিকে।পুতুল চা বসিয়ে তাকের সাথে হেলান দিয়ে মুচকি হাসছে ইমাদকে দেখে।দুজন চোখে চোখে কথা বলছে।সিনথিয়া কার্ডটা দিয়েই উঠে দাঁড়ালো।বললো তার দেরি হচ্ছে।কথা আটকে আটকে আসছিল তার।মিসেস রওনক জোর করেও ওকে রাখতে পারেননি।অন্তিককে নিয়ে চলে গেছে সে।পুতুল চায়ের কাপগুলো সবেমাত্র টেবিলে এনে রেখেছিল।ওরা চলে যাওয়ায় ইমাদ বসে বসে ওদের ভাগের চায়ের কাপ খালি করেছে।চা দেখলে তার আর কিছু লাগেনা।মিসেস রওনক রেগে মেগে চলে গেছেন তার রুমে।কেন রাগলেন তার কারণ কেউ জানে না।পুতুল কোমড়ে আঁচল গুজে সব প্লেট বাটি পরিষ্কার করছে।ইমাদ পুতুলের ফোনে নিজের কটা ইন্সট্যান্ট ছবি তুলে রেখে দিলো।পুতুল যদি ফোন দেখে হয়ত একটুর জন্য হলেও ওর মুখে হাসি ফুটবে।
দশ পনেরো মিনিট পর হাত মুছতে মুছতে পুতুল এসেছে রুমে।ইমাদ তখন ফোন দেখছিল।পুতুল ওর পাশে বসে বললো,’সিনথিয়া আপু বললো উনি এখনও আপনাকে চায়’

-‘বাহ কি মিল!!’

-‘কিরকম?’

-‘আমি এখনও ওরে চাইনা।আগের মতনই’

-‘আপনিও না!!
——
পরেরদিন সকাল সকাল নাস্তা করে ইমাদ তৈরি হয়ে নিলো যাবে বলে।পুতুল এক কিণারায় দাঁড়িয়ে ছিল চুপ করে।ইমাদ বাবা মাকে বলে পুতুলের দিকে এক নজর তাকিয়ে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে গেছে।পুতুল দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ছিল এতক্ষণ। ইমাদ চলে যাওয়ার পর হুস আসলো।ছুটে গেলো বারান্দায়।ইমাদ রোডে নেমে উপরে তাকিয়ে পুতুলকে আরও একবার দেখছে।পুতুল চোখ মুছে অন্য দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে পড়লো।ইমাদের ও খারাপ লাগছে কিন্তু পুতুলের মতন তার চোখ দিয়ে এক ফোটা পানিও আসলো না।কিছুদূর গিয়ে একটা সিএনজি ধরলো সে।সায়দাবাদ থেকে বাস ধরবে।কুমিল্লা যেতে দুই ঘন্টার থেকে একটু কম সময় লাগলো।কোটবাড়ি এসে চঞ্চলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এখানের একটা বয়েজ ম্যাচ নিতে পারলো সে।চারতলা দালান।ম্যাচ একেবারে চারতলায়।একটা লিফট নেই।দেখে মনে হয় ১৯২০ সালের দালান।এখনই ভেঙ্গে পড়বে।ব্যাগ টানতে টানতে চারতলা অবধি উঠতে ইমাদ তার গায়ের শার্টখানাও খুলে ফেলেছে।এখন বাসার দরজার নিচে বসে হাঁপাচ্ছে।শেষে হাঁপানো বাদ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজা ধাক্কালো।একটা ছেলে এসে দরজা খুলেছে।গলায় গামছা ঝোলানো।আশ্চর্য হলো তার পরনে আরেকটা গামছা।মুখের ভেতর ব্রাশ ঢোকানো।সে দাঁত মাজার বদলে ব্রাশ মুখে দিয়ে চিবোচ্ছে আর ইমাদকে দেখছে।পেছনে বিছানায় বসা একটা ছেলে বই পড়ছিল।চশমা ঠিক করে বললো,’নতুন রুমমেট।ওরে বলো ভেতরে আসতে।লাহারকান্দি মনে হয় পাঠাইছে এরে!
কোলে শোয়ামু এই বেডারে?’

ইমাদের মনে হলো সে জোর করে ঢুকছে।ব্যাগ টেনে ভেতরে ঢুকে দেখলো রুমের সব এঙ্গেলে একটা করে সিঙ্গেল খাট।সবগুলোতে কেউ না কেউ বসে আছে।তাহলো ইমাদের কোনটা?ভাবতে ভাবতে লাহার মিয়া আসলেন এখানে।তিনি এই দালানের মালিক।
ইমাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন,’রাকিব তোমার খাটটা একটু সরিয়ে ওখানে আরেকটা খাট বসবে।সেখানে ইমাদ হাসান থাকবে।’

এটা বলে চলে গেছেন তিনি।এখানের সবাই মজা করে তাকে লাহারকান্দি ডাকে।
তার পাঁচ মিনিট পর দুটো রোগাপাতলা ছেলে আসলো তাদের চেয়ে পাতলা খাট নিয়ে।খাটটাকে বসিয়ে চলে গিয়ে তারা পুনরায় ফিরে আসলো তোষক আর বালিশ নিয়ে।সব ফিটফাট করে গেলো শেষে।ইমাদ খাটে বসে সবার দিকে তাকালো।একটা ছেলে কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’কিসে পড়ো তুমি?দেখে তো বাচ্চা মনে হয়’

দাঁত ব্রাশ করা ছেলেটা আবারও ব্রাশ চিবোতে চিবোতে বললো,’আচ্ছা মত টাইট দিব সকাল বিকাল’

ইমাদ উপরে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে বললো,’মাস্টার্স পাশ করে চাকরি করছি’

কথাটা শুনে সবার মুখ থেকে যেন কথাই হাওয়া হয়ে গেলো।ব্রাশ বের করে ছেলেটা তার চকচকে ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে বললো,’সরি ভাইয়া।আমরা ভাবলাম আপনি জুনিয়র।এখন দেখি সিনিয়র।সরি সরি’

-‘ইটস ওকে’

ইমাদ ফোন নিয়ে পুতুলকে কল করেছে এবার।বাসে একবার কথা হয়েছিল।ওর গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না বলে ইমাদ লাইন কেটে দিয়েছিল।এখন আবার ফোন করেছে।পুতুল তুললো না।কারণ সেসময়ে মিসেস রওনক ওকে দিয়ে সুজির পিঠা বানাচ্ছিলেন, তার নাকি খুব খেতে ইচ্ছে করছিল।
ইমাদ ফোন রেখে গায়ের জামাকাপড় বদলে নিয়েছে।
-‘এরচেয়ে ভালো ছিল একেবারে ফ্ল্যাট নিয়ে নেওয়া।এরকম পরিবেশে থাকা যায়?দু মাস আমার পক্ষে এমন একটা জায়গায় থাকা অসম্ভব।আরে আমি এখন জব করি।ভালো পরিবেশে থাকার অধিকার আছে আমার।কোনোমতে আজকের দিনটা কাটাই।কাল সকালে অফিসে যাবার সময় কিছু বাসার খোঁজ নেবো।’
——-
পুতুল পিঠা বানিয়ে দিয়ে ছুটে আসলো ফোন দেখবে বলে।ইমাদের কল দেখে এবার সে কলব্যাক করলো।এখন ইমাদ ধরলো না।কারণ সেসময়ে ইমাদ ঘুমাচ্ছিল।ফোন সাইলেন্ট করে।জার্নিতে টায়ার্ড হয়ে পড়েছিল সে।পুতুল মন খারাপ করে ফোন রেখে দিয়েছে।
রাত হয়ে গেছে।ইমাদের খবর নেই।পুতুল আলমারি খুঁজলো আধ ঘন্টা ধরে কিন্তু ইমাদের সেই টিশার্টটা পেলো না।
-‘তার মানে উনি সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন।আমি কি নিয়ে থাকবো?ভেবেছিলাম টিশার্টটা আঁকড়ে ধরে ঘুমাবো।তার আর হতে দিলেননা উনি। নিজের সাথে করে নিজের স্মৃতি টাও নিয়ে গেলেন।’
—-
ইমাদ ঘুম থেকে উঠে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে ম্যাচ ছেড়ে গেলো বাহিরে থেকে খাবার খেতে।এখানের খাবার দেখে ওর মাথা ঘুরানো শুরু হয়ে গিয়েছিল।মনে হয় ডালে দুই বালতি পানি মেশানো,তরকারিতে হলুদ দেয়নি,সাদা সব।হোটেলে এসে তেলাপিয়া মাছ দিয়ে ভাত খেলো সে।ফোন বের করে পুতুলকে কল করলো।পুতুল বারান্দায় ফ্লোরে বসে আকাশ দেখছিল।কলের আওয়াজ শুনে ছুটে গেলো রিসিভ করতে।হ্যালো বলতেই ইমাদ বললো,’নেটে আসো, ভিডিও কল দিব”

পুতুল নেট অন করতেই ইমাদের আইডি থেকে ভিডিও করল আসলো।পুতুল রিসিভ করে ফোনটা ওর সামনে একটা ডালিয়া ফুলের টবের সাথে হেলান দিয়ে রেখে দিয়েছে।ইমাদ গালে হাত দিয়ে বললো,’চোখ মুখের ওমন অবস্থা কেন?আমি তো ভালোবাসা দিয়ে আসিনি তাহলে কাঁদার কারণ কি?’

-“এবার উল্টোটা হয়েছে।ভালোবাসা দেননি বলেই কাঁদছি অনেক।ওসব বাদ দেন।খেয়েছেন কিছু?’

-“হ্যাঁ।ম্যাচের বুয়া যা জোস রান্না করে!!’

-“তাই তো আপনি হোটেলে বসে আছেন।’

ইমাদ জিভে কামড় দিয়ে পেছনে তাকালো।পুতুল মলিন মুখে তাকিয়ে আছে।ইমাদ হেসে হেসে
বললো,”মা কি করছে?’
-‘টিভি দেখে।তো এখন কি করবেন?’

-“একটু হেঁটে চলে যাব ম্যাচে।’

-“ভালো লাগে ওখানে?”

-“একটুও না।তাও থাকলাম।আজ হয়ত কাল ও।এরপরে আর থাকা যাবেনা।আমার কাছে অসহ্য লাগছে।কিসের না কিসের যেন পোকা কামড়ে হাত ফুলিয়ে ফেলেছে।জলদি একটা বাসার বন্দবস্ত করে নিতে হবে।’

-“হুমমম।আচ্ছা রাখছি।মা ডাকছেন’

-“ওকে।কাল কথা হবে।রাত তো হয়েই গেলো’

-“আচ্ছা।সাবধানে থাকিয়েন”

ইমাদ ফোন পকেটে পুরে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই দেখতে পেলো একটা পোস্টার।বড় বড় করে লেখা টু -লেট।জায়গাটা একটু দূরে তাও চলবে।নাম্বারটা সেভ করে কল করতে করতে ইমাদ হাঁটা ধরেছে।বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলে বুঝলো তিনি ব্যাচেলর ভাড়া দেননা।ইমাদ বললো সে বিবাহিত, চাকরিসূত্রে এখানে এসেছে। কে শোনে কার কথা।লাইন কেটে দিলেন লোকটা।ইমাদ এবার অন্য পোস্টার খুঁজতে খুঁজতে ম্যাচ অবধি চলে আসলো। ম্যাচের সবাই গড়গড় করে পড়ছে।ইমাদ চাদর টেনে শুয়ে শুয়ে মাথার উপরে আস্তে গতিতে গটর গটর আওয়াজে চলা ফ্যানটা দেখছে।রুমমেট সবগুলোর পড়ার গড়গড় আওয়াজ আর এই ফ্যানের গটগট আওয়াজ দুটোই মিলে মনে হয় সার্কাসের ভেতর বিছানা পেতে শুয়ে আছি।মাঝে মাঝে কে যেন বাঁশিও বাজাচ্ছে।চাদর সরিয়ে ইমাদ পাশে তাকালো।রাকিব নামের ছেলেটার ফোনের রিংটোন বাঁশির বাঁজানোর আওয়াজ।প্যাঁ প্যাঁ আর পুঁ পুঁ।
-‘বাহ কি চয়েস মানুষের!এরকম রিংটোন চয়েস করা মানুষ আজকাল দেখতে পাওয়া যায়না’

রাকিব ইমাদকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,”বিশ্বরোডের পাশেই ম্যাচটা কিনা!!সারাদিন এমন যানবাহনের হর্নের আওয়াজ শুনতে শুনতে এখন একটু খানি না শুনলে মনে শান্তি পাইনা তাই রিংটোন ও তাই সেভ করে রাখলাম’
চলবে”

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৪৭
Writer-Afnan Lara
.
-‘জ্বী মা বলুন।ডেকেছিলেন আমায়?’

-‘বমি পায়?মাথা ঘুরায়?’

মিসেস রওনকের মুখে এমন উদ্ভট কথা শুনে পুতুল ভাবলেশহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মিসেস রওনক কিন্তু এখনও ওর উত্তরের আশায় এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন।

-‘কি হলো?কিছু বলছো না কেন?’

-“নাহ তো।হঠাৎ বমি পাবে কেন?’

-‘হঠাৎ কি বলছো?তোমার কাছে যে আমি নাতিপুতির আবদার করেছিলাম,মনে নেই তোমার?এসব কি ভুলে যাবার মতো কিছু হলো?’

-‘ওহ!না মানে…..’

-‘সে যাই হোক।বমি পেলে আমাকে বলবে সঙ্গে সঙ্গে।তখন একটা কাজও তোমাকে করতে দেবো না।’

পুতুল মাথা নাড়িয়ে চোরের মতন ঐ জায়গা থেকে কেটে পড়েছে।ইমাদের রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পেটে হাত দিয়ে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো সে।
—-
রাত তখন এগারোটা বাজে।ইমাদের বাবা- মা ঘুমোচ্ছেন।পুতুল বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে ইমাদের বালিশটার উপর হাত রেখে ভাবছিল ওর কথা।
-‘টিশার্টটা না নিলে কি হতো?সব নিয়ে গেলো লোকটা।আমার মনের ভেতরটা শূন্য হয়ে আছে।ভালো লাগছেনা কিছু।কবে আসবেন?ওহ হো।উনি তো আজকেই গেলেন।ধুর ভালো লাগেনা।ফোন করবো?করেই দেখি।তাকে দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়বো নাহয়।
পুতুল উঠে বসে কল করলো ইমাদকে।প্রথমে নাম্বারে কল দিলো সে।ইমাদ কানে তুলা গুঁজে ঘুমাচ্ছিল।ফোন ভাইব্রেট হওয়ায় টের পেলো যে কল এসেছে।কানের থেকে তুলা বের করে ফোন নিয়ে একটু দূরে গেলো সে।পুতুল হ্যালো বললো।ইমাদ সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলো সব ঠিক আছে কিনা।

-“আপনি ঘুমাচ্ছিলেন?’

-“কি আর করবো।কাজ নাই তাই।তুমি ঠিক আছো তো?’

-“হুম।এত জলদি তো আপনি ঘুমাননা তাই ফোন করেছিলাম”

-“আমার হাতে কাজ ছিল না।শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমে তলিয়ে গেলাম।আর আমার বউ জাগিয়ে তুললো।অবশ্য এখন সার্কাস বন্ধ হয়েছে।রুমমেট সবগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে’

-“ভিডিও কল দিই?’

-‘আমাকে দেখতে দেখতে ঘুমানোর অভ্যাস তো।থাক ছাড়াতে হবে না।ভার্চুয়ালি নাহয় দেখো’

পুতুল ভিডিও কল দিয়ে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছে।ইমাদ তার বিছানায় গোল হয়ে বসে ওকে দেখতে লাগলো।পুতুল ফোনে হাত রেখে ইমাদকে ছোঁয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।তাও পারলো না।চোখ ভিজে আসছে বারবার।কোনোমতেই নিজেকে সামলে নিতে পারছেনা সে।ইমাদ কেন এত দূরে?

-‘মন খারাপ?’

–‘উহু’

-‘সময় আছে।চলে আসো।এমনিতেও কাল পরশুর দিকে আলাদা বাসা নেবো আমি।’

-‘সেটা হয়না।’

ইমাদ এবার রাগ করে লাইনটাই কেটে দিয়েছে।পুতুল উঠে বসে প্রচণ্ড রেগে আবারও কল করলো ওকে।
ইমাদ রিসিভ করছেনা।
-‘আশ্চর্য! এমন করলো কেন?আমি কি করলাম?


ইমাদ ফোন রেখে পাশে তাকিয়ে দেখলো রুমমেট অন্য একটা ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে।ওর নাম ইসমাইল।সে ভেটকানি দিয়ে বললো,”বিবাহিত জীবনে সবচেয়ে বড় প্যারার নাম বউ।সে হুদাই প্যারা দেয়’

-“নাহ।আমার বউ আমায় প্যারা দেয় না’

-‘কি দেয় সেটা তো আপনার চোখে মুখে রাগ দেখেই বুঝছি।এসব দেখলে ভাবি বিয়েই করবো না।’

-‘তোমার এখনও বিয়ের বয়স হয়নি।পড়াশুনা শেষ করো।চাকরিবাকরি করো।ফ্যামিলি মেয়ে দেখে বিয়ে দেবে।তখন সব ভাল্লাগবে’

-“আপনারও বুঝি ভালো লেগেছিল?’

-‘ছিল না।এখনও লাগছে।একটু আকটু ভুল বোঝাবুঝি সবারই সংসারে হয়ে থাকে।এটা সমস্যা নাহ।তবে আমার ভুল বোঝাবুঝি হয়নি।রাগের ঘটনা ঘটলো তাই রাগ দেখালাম।ওসব শুনে তোমার কাজ নেই।পড়াশুনায় মন দাও’

ইসমাইল অন্য দিকে মুখ করে শুয়ে পড়েছে।ইমাদ ফোন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে সেও শুয়ে পড়লো।
পুতুলের চোখে ঘুম নেই।কিছুক্ষণ বারান্দায়,কিছুক্ষণ বিছানায়,কিছুক্ষণ টিভির পর্দার সামনে।তাও তার সময় কাটেনা।এত একাকিত্ব সামলে নেওয়া যায়?দুইটা মাস কি করে থাকবো?ভেবে খারাপ লাগে সেসব মেয়েদের জন্য যাদের স্বামী কিনা বছরের পর বছর প্রবাসে জীবনযাপন করে।আহারে তাদের কষ্ট আমি হারে হারে টের পাচ্ছি।ইমাদ থাকলে জোর করে ডিনার করিয়ে ছাড়ত।আর আজ আমি খেলাম না।সেও জোর করলো না।কারণ সে তো নেই।
—–
পরেরদিন সকালে অফিসে আসার পর একটু সময় ও ইমাদ পেলো না যে অন্য একটা বাসা খুঁজবে।এদিকে পুতুলের সঙ্গে রাগ বলে সকাল থেকে কল করাও হয়নি।পুতুল ও করেনি।তার খাওয়া দাওয়া সব উঠে গেছে।মুখে দিচ্ছে না কিছু।
মিসেস রওনক খবরটুকু ও নেননা।খেয়ে দেয়ে তিনি অফিসে চলে গেছেন।বাসা খালি।পুতুল খালি পেটে দুপুরের রান্না করে রেখে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো।শরীর মন দুটোই খারাপ।চোখ জুড়ে ঘুম নেমে এলো তার।কাল সারারাত ভালোমতন ঘুম হয়নি।ইমাদ বিকালে ফ্রি হয়ে রাগ বাদ দিয়ে ফোন করেছিল ওকে।কিন্তু সে রিসিভ করেনি।
অনেক খুঁজে অবশেষে একটা বাসা পেলো ইমাদ।কুমিল্লা রেলস্টেশনের পাশাপাশি। বাসার দোতলায় থাকবে সে।কথা সব ঠিক করে ছুটে গেলো তার ব্যাগটা আনতে।ঐ ম্যাচে আর এক মিনিট ও থাকা যাবেনা।যে বাসা সে নিয়েছে তা দেখে মন একেবারে ভরে গেছে ইমাদের।দূর থেকে ট্রেন দেখা যায়।এখনে দু মাস কেন?দু বছর থাকতেও কোনো সমস্যা হবেনা।খুশিতে ব্যাগ নিয়ে হাজির ইমাদ সেখানে।চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখলো মোটামুটি সব সাজানো গোছানো।মালিক আগেই বলেছিলেন,খাট পালংক সব রেডিমেড আছে।চিন্তার কিছু নাই।ইমাদ বিছানায় বসে পুতুলকে আবারও কল করেছে।পুতুল ধরছে না।
-‘মানে প্রচুর রেগে আছে। এই মেয়েটা সবসময় উল্টো রাগ করতে পারে।আর কিছু পারেনা।ভালো আমিও কল দিব না ওকে।যাই বাহিরে রেস্টুরেন্ট থেকে ডিনার করে আসি।অনেক দখল গেছে।এসে ঘুমিয়ে পড়বো।’
—–
-“দেখেছো মেয়ের হাল??আমি স্কুল থেকে আসছি কয় ঘন্টা হলো এখনও পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।বলি কি নিজোর হাতে ভাত বেড়ে খেয়েছি।বিকালের নাস্তাও কি আমি বানাবো?এই মেয়ে?’

পুতুল শোয়া থেকে উঠে মাথা ধরে মিসেস রওনকের দিকে ফিরে তাকালো।তারপর নামতে নামতে বললো,’সরি মা।এই তো এখন বানিয়ে দিচ্ছি।কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম টের পাইনি।’

পুুতুল চট জলদি নাস্তা আর চা বানিয়ে মিসেস রওনকের সামনে হাজির করে ফেললো।পুতুলের চোখ মুখ লাল দেখে উনি হাতটা বাড়িয়ে ওর কপালে রাখলেন তারপর গম্ভীর গলায় বললেন,’না খেলে মানুষ অজ্ঞান হয় শুনছিলাম।কিন্তু তুমি দেখি জ্বর বাঁধিয়েছো।এখন আমি কদিক সামলাবো?দুপুরে খেয়েছো?’

-“না’

-“এসব কি বলছো তুমি?না খেয়ে না খেয়ে পরে অজ্ঞান হলে আমি কি করবো?ইমাদের বাবা ফেরেন রাতে।দিনে কিছু হয়ে গেলে কে দেখবে তোমায়?আমি নিজেও তো আসি বিকালে।ইমাদ একটা নেই।এত কিছুর ভেতরে তুমি অনশন শুরু করেছো?’

-“আমি খাব পরে’

-“এখন খাবে।তারপর ঔষুধ
যাও বলছি!’

মিসেস রওনকের ধমকে পুতুল খাবারটা বাধ্য হয়েই খেলো।ঔষুধ আর খেলো না।মনে নেই তার।মিসেস রওনক চা খেয়ে কিসব খাতা নিয়ে বসলেন চোখে চশমা লাগিয়ে।পুতুল ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ইমাদের কল।রাগ করে আবার রেখে দিলো সে।কথা বলবে না ভেবে রেখেছে।
পরেরদিন সকালটাও জলদি এসে গেলো।মিসেস রওনক দু মিনিট ধরে কোমড়ে হাত দিয়ে পুতুলকে দেখছিলেন।পুতুল ঘুমাচ্ছে।সকাল আটটা বাজে তখন।
তার স্কুলে যেতে হবে সাড়ে আটটায়।কানে ফোন রেখে পপিকে ডাকলেন উনি।পুতুলকে একটা খোঁচা দিয়ে উঠিয়ে তুললেন।পুতুল ভয় পেয়ে এক দৌড় দিলো রান্নাঘরের দিকে।মিসেস রওনক ওর পিছুপিছু এসে বললেন,”হাতে আধ ঘন্টা আছে।তুমি এসময়ে আমাকে আর কি নাস্তা করে খাওয়াবে?আমি ইমাদের বাবাকে বলেছি হোটেল থেকে খাবার আনতে।কি শুরু করছো এসব?তোমার গায়ে তো জ্বর কমার জায়গায় আরও বেড়ে গেছে।কাল তুমি ঔষুধ ও খাওনি?আমার মনেই ছিল না।’

——-
ইমাদ অফিস থেকে আজ দুপুরে ফিরেছে।বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে এখন।খাওয়াটা পরে হবে আগে জিরোবে।ফোন বেজে উঠলো হঠাৎ।তড়িগড়ি করে হাতে নিলো সে।ভাবলো পুতুলের কল হতে পারে।ওমা দেখলো পুতুলের ভাইয়া আসাদের কল।চমকে গেলো সে।সোজা হয়ে বসে রিসিভ করলো।

-“হ্যালো।ইমাদ?তুমি কোথায়?’

-‘আমি তো কুমিল্লা।কেন?’

-‘কুমিল্লা তা তো জানি।কিন্তু কোন জায়গায় কুমিল্লার?’

-‘এই তো রেলস্টেশনের কাছাকাছি একটা জায়গায় আমি বাসা ভাড়া নিয়েছি।কেন বলুন তো?’

-“বাসা থেকে বের হও।আমি আসতেছি’

ইমাদ তো আরও অবাক হলো।আসাদ ভাইয়া কিনা এখানে আসছে?কি হলো?পুতুল ঠিক আছে তো?
ইমাদ দরজা খুলে বাসা থেকে বেরিয়ে হাঁটা ধরলো।অল্প একটু হেঁটে দাঁড়িয়ে থাকলো।দশ পনেরো মিনিট পর একটা সিএনজি এসে থামলো ওর সামনে।ভেতরে আসাদ ভাইয়ার সঙ্গে পুতুলকে দেখে ইমাদর মাথা ঘুরে উঠলো।পুতুল সিএনজি থেকে নেমে ইমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।

-“পুতুল এখানে?কিছু বুঝলাম না’

-“শোনো ইমাদ!যা বলার পুতুল বলবে।আমার দায়িত্ব ছিল ওকে দিয়ে য়াওয়ার।আমি যাই এখন।অনেক কাজ বাসায়।বাবা একটু অসুস্থ বলে বিজনেস আমাকে দেখতে হচ্ছে।তোমরা বাসায় যাও।বাই’

আসাদ ভাইয়া চলে গেলেন।ইমাদ হা করে পুতুলের দিকে তাকিয়ে আছে।পুতুলের চোখ মুখের অবস্থা কাহিল।পুতুল আর কোনোদিক না ভেবে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।ইমাদ আশেপাশে তাকিয়ে পুতুলকে সরিয়ে বললো,’এখানে মানুষ অনেক।বাসায় চলো আগে’

ইমাদ পুতুলের হাত ধরে দোতলায় নিয়ে আসলো।বাসায় ঢোকার পর পুতুল সেই আবারও জড়িয়ে ধরেছে ওকে।ইমাদ ওর শরীর স্পর্শ করতেই চমকে বললো,’একি।তোমার গায়ে তো জ্বর’
পুতুল কিছু বলছেনা।ইমাদের শরীরের উষ্ণতায় তার বেশ লাগছে। ইমাদ ওকে বুক থেকে সরিয়ে সোজা করে দাঁড় করিয়ে বললো,’কিছু বলছোনা কেন?এত জ্বর আসলো কি করে?আর আমাকে না জানিয়ে হুটহাট এখানে চলে আসলে?কি হয়েছে তোমার?বাবা মা কেমন আছে?”

-“ভালো’

-“তাহলে?এত জ্বর আনলে কি করে।দেখি বোসো এখানে।’

ইমাদ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।পুতুল ওর হাত শক্ত করে ধরে ওকে কাছে বসতে বললো।ইমাদ তাই ওর পাশে বসে বললো,’খুব তো বলেছিলে আসবেনা।এখন আসতে হলোতো?’

-“মা পাঠিয়েছেন”

-“মজা করছো?”

-“সত্যি।মা বললেন আপনাকে ছাড়া আমার এই দু মাস শরীর খারাপ থাকবে।আমি কিছুতেই ভালো থাকতে পারবো না।আর উনি অফিসের কাজ ফেলে আমার দেখভাল করতে পারবেন না।তাই পাঠিয়ে দিলেন’

-“তোমার এই অবস্থা আর তুমি আমাকে একটিবার ফোন ও করলেনা?”

পুতুল ইমাদের হাত ছেড়ে দিয়ে গাল ফুলিয়ে বললো,”কেন দেবো?সেদিন রাতে আমার কল কেটে দিয়েছিলেন মনে আছে?তার পরেরদিন সকাল থেকে একটা কল ও করেননি আপনি।’

ইমাদ পুতুলের হাত দুটো ধরে হাতে চুমু খেয়ে বললো,’সরি তো।তাই বলে তুমি আমাকে জ্বরের কথাও জানাবেনা?’

-“জেনে কি হতো?আপনি চলে আসতেন?’

-“সেটা তখন দেখতে পেতে।যাই হোক,সকালে কিছু খেয়েছো?’

-‘আসাদ ভাইয়ার সঙ্গে হোটেলে খেয়েছি’
চলবে ”