বাবুই পাখি পর্ব-৫৪ এবং শেষ পর্ব

0
1858

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৫৪(শেষ পর্ব)
Writer-Afnan Lara
.
ছাদে বসে চা খাওয়া এক দারুণ ব্যাপার।বলতে গেলে অসাধারণ অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়।তবে এটা যদি মনে থাকে তাহলে প্রতিদিন ঠিক সকাল বেলা এবং বিকেলবেলাতে যখন সূর্যের দেখা মিলবেনা সেসময়ে আপনি চায়ের কাপ হাতে ছুটে এসে শান্তমনে চা পান করবেন ছাদে বসে।আর যদি ভুলে যান তাহলে পুনরায় নিজের গৃহে সোফায় নয়ত রুমে বসে চা শেষ করে ফেলবেন।মনে মনে বললেন,’একদিন ছাদে যাব চা খেতে’
ঐ একদিন আসে ঠিক দু তিন মাস পর।ওরকম একদিন একদিন করে অবশেষে আজ বিকেলে ইমাদের বাবা এসে ছাদের শেষ প্রান্তে রকিং চেয়ারে বসে আকাশ দেখছেন।সূর্য ডোবার আগের মূহুর্ত।কি মধুর।চা ও যদি মধুর হতো ঠিক এরকম।
তাহলে কতই না ভালো হতো।বয়সের চাপে চিনি দিয়ে চা খাওয়াই ভুলে গেলাম।নাতিপুতি কোলে আসলে নাকি চায়ের স্বাদ চিনিবিহীন হয়ে যায় আজ তা প্রমাণিত।আচ্ছা আমার চা আসতে এত দেরি কেন??
মাথা তুলতেই দেখতে পেলেন তিনি মিসেস রওনককে।শো কেসে এতবছর ধরে সাজিয়ে রাখা সিরামিকের সেই কাপ সেটে চা ভর্তি করে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।পরনে আবার জামদানি শাড়ী।ইমাদের বাবা ঠিক বুঝলেন না
সূর্য কি ডুবছে নাকি পরে ডুববে।মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে তার।মিসেস রওনক মুচকি হেসে কাপটা হাতে ধরিয়ে দিলেন সোজা।

ইমাদের বাবা চমকে বললেন,’আমি তো পুতুলকে বলেছিলাম চা আনতে’

-‘সে রাহাদের জন্য সেরেলাক গুলছে।হাতে তার আরও কাজ তাই আমিই বানালাম’

ইমাদের বাবা চায়ে চুমুক দিয়ে মুখটা গম্ভীর করে রেখেছেন।মিসেস রওনক হেলছেন দুলছেন।আবার টবের ফুলগাছটা থেকে গোলাপ এক একটা ছিঁড়ে কানে দিয়ে হেলেদুলা বাড়িয়ে দিলেন

ইমাদের বাবা চা আর খেলেন না।ঢোক গিলে বললেন,’আমাকে এত বড় শাস্তি দিও না’

-‘এটা শাস্তি?কাল স্কুলে আমার বিদায় উপলক্ষে আমারই হাসবেন্ড হিসেবে তুমি দু চারলাইন আমাকে নিয়ে প্রশংসা করবে।এটা শাস্তি হলো কি করে?’

-‘শাস্তি না?তুমি তো জানো আমি জীবনে তোমার নিন্দা ছাড়া প্রশংসা কখনও করিনি।তো জীবনের এখন এই স্টেজে এসে তুমি আমাকে সেই টাস্ক দিচ্ছো যেটা আমার দ্বারা ইম্পসিবল? ‘

-‘কবি কালী প্রসন্ন ঘোষ বলেছেন,’এক বার না পারিলে দেখো শতবার’
——-
-‘আচ্ছা পুতুল! কাল যদি তোমাকে জিজ্ঞেস করে শাশুড়ি হিসেবে মিসেস রওনক কিরকম তখন তুমি কি বলবে?’

পুতুল ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে বিছানায় রাহাদকে রেখে ওর নেপি পাল্টাতে পাল্টাতে বললো,’বলবো আমি একজন বেস্ট শাশুড়ী পেয়েছি।প্রথমে তাকে নিয়ে আমার হাজারটা ভুলধারণা ছিল।তবে এখন সেসবের কোনো বালাই নেই।তিনি একজন মা এবং একজন শাশুড়ি হিসেবে বেস্ট।প্রেগন্যান্ট না হলে জানতামই না তিনি আমার কতটা যত্ন করতে পারবেন একা হাতে।
দুজন বুয়া রাখা।একজন স্পেশালি আমার জন্য।আমার পা ফুলে যাওয়ায় উনি নিজে হাতে মালিশ করেছিলেন।এটা তো আজীবন মনে রেখে দেবো আমি’

ইমাদ রাহাদকে কোলে তুলে নিয়ে বললো,’আর তার ছেলের ব্যাপারে কিছু বলার নেই আপনার?’

পুতুল পেছনে ফিরে বসে বললো,’তারে নিয়ে আর কি বলবো?তার যে একবছরের একটা ছেলে আছে।ওকে যে আমায় একা হাতে সামলাতে হয় পড়ালেখার ভেতরে,কারণ তার দাদা দাদি থাকেন অফিসে সেদিকে নজর না দিয়ে সারাদিন অফিস অফিস!!’

ইমাদ ব্রু কুঁচকে বললো,’আমি বুঝি তোমায় টাইম দেইনা?’

-‘দেন তো।খুব দেন।এই যে এখন ঘুরঘুর করছেন অফিসে যাবেন বলে।’

-‘ছেলের এবং ছেলের মায়ের,ছেলের দাদা দাদির মুখে হাসি ফোটাতে এরকম কষ্ট করতেই হয়।বুঝলেন ছেলের মা??’

——
আজকে মিসেস রওনকের বিদায় হিসেবে তারই স্কুলে একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠান করা হয়েছে।মিসেস রওনকের কলিগদের সামনে এখন তার পরিবারের সদস্যরা উক্তি দেবে।এটা সম্পূর্ণ তাদের নিজেদের পরিকল্পিত।শিক্ষার্থীরা এর আওতাভুক্ত নয়।তারা তাদের বাড়ি ফিরে গেছে।
ইমাদের বাবা কাগজে লিখে এনেছেন।শুধু ফটাফট পড়ে যাবেন।
কিন্তু একটা সময়ের পর তিনি বুঝলেন কাগজ দেখে তারা বলা সুন্দর হচ্ছেনা।কেমন যেন খাপ ছাড়া হয়ে আসছে।
তাই কাগজ ফেলে মনে করতে লাগলেন ইমাদের জন্মের আগে মিসেস রওনক কেমন ছিলেন।খুব সুন্দর করে তিনি সেসব বর্ননা দিয়ে গেলেন।মিসেস রওনক আবেগে আপ্লুত হয়ে চোখের পানি মুছছেন রাহাদকে কোলে নিয়ে।ইমাদ আর পুতুল শুধু মিটমিট করে হাসছে।
স্কুলের একজন স্যার পুতুলকে ডাকলেন মিসেস রওনককে নিয়ে কিছু বলার জন্য।সবাই আরেকটু সময় একসাথে থাকতে এখন মিসেস রওনকের পরিবারের সদস্যরা বক্তব্য পেশ করে যাচ্ছেন।পুতুল স্টেজে এসে মুচকি হাসলো মিসেস রওনকের দিকে তাকিয়ে তারপর বললো,’উনি আমার শাশুড়ি হোন তা ঠিক কিন্তু কাজে উনি আমার মা।
ঠিক আপন মায়ের মতন।শুরুতে কিছু ভুলবোঝাবোঝির কারণে তাকে আমি বুঝতে পারিনি।তবে আজ এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমি সত্যি বলতে গেলে বলবো উনি আমায় বড্ড ভালোবাসেন।আমার ছেলে রাহাদ তার হাতেই মানুষ হচ্ছে।পড়াশুনার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম বিয়ের পরেই।কিন্তু তিনি জোর করে আবারও ভর্তি করিয়ে দিলেন আমায়।বললেন,’মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো অনেক জরুরি। নিজের খরচ নিজে দেবে।সবসময় স্বামীর কাছে কেন চাইবে?তার আগে উচ্চশিক্ষিত হতে হবে।মজার কথা কি জানেন?আমার সব বই,পড়াশুনার খরচ উনি বহন করছেন।কয়জন শাশুড়ি এমনটা করে??
আসলে মানুষের কয়েকটা দিনের ব্যবহারে তাকে জাজ করা উচিত না।কটা মাস,কটা বছর গেলে আপনি বুঝতে পারবেন মানুষটা একচুয়ালি কিরকম।
একজন টিচার হিসেবে তার এমন মনোভাব আমার নজর কেড়েছে।দোয়া করবো যেন সুস্থ থাকেন সবসময়।’

মিসেস রওনক ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছেন।রাহাদ এতক্ষণ কাঁদছিল।এখন দাদুর কান্না দেখে সে চুপ করে তাকিয়ে আছে।ইমাদ টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বললো,’মা ধরো চোখ মোছো’

মিসেস রওনক একটা একটা করে টিস্যু নিচ্ছেন আর নাক মুছছেন।কিন্তু শেষের টিস্যু টা ধরে নাক মুছতে গিয়ে আটকে গেলেন।চোখ বড় করে তার লেখা পড়ে বললেন,’এটা দেখি কক্সবাজারের একটা রিসোর্টের বুকিং স্লিপ’

-“একদম ঠিক।তুমি আর বাবা সেখানেই যাচ্ছো।আজকে বিকালে।আর মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকি’

-‘মানে?তোর মাথা ঠিক আছে নাকি?’

পুতুল কোমড়ে হাত দিয়ে এগিয়ে এসে বললো,’সব ঠিক আছে।এতদিন চাকরির দোহায় দিয়ে কোথাও যেতেনা।আজ যেতেই হবে।মানি না মানবো না’

ইমাদের বাবা স্লিপটা নিয়ে চোখ বড় করে ইমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,’তুই আমাকে এই প্রতিদান দিলি?’

-“কেন?কি করলাম বাবা?’

-‘তোর রণচন্ডী মায়ের সঙ্গে আমাকে একা ছাড়ছিস তুই?জানিস না!!ঝগড়া করে আমার মাথা খাবে?’

-“তোমাকে তো আর খাবেনা।শুধু মাথা খাবে। ওটাতে সমস্যা নেই।জলদি বাসায় চলো।প্যাকিং ও তো করতে হবে”

মিসেস রওনক মহা খুশি।আর ইমাদের বাবা অসহায়ের মতন হেঁটে চললো বাসার দিকে।তার কপালে আগামী সাতদিন শনি বিরাজ করবে

বাসায় এসে পুতুল মিসেস রওনকে হেল্প করলো ব্যাগ গুছাতে।দুজনকে বাসস্টপ ওর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসেছে ইমাদ।
বাসায় ফেরার পথে এক গুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে ফিরলো সে।পুতুল রাহাদকে ঘুম পাড়িয়ে বারান্দার সেই মোটা দড়ির দোলনাতে চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসে আছে।
বাচ্চা ঘুমালে মায়ের সব চেয়ে বেশি সুখ লাগে।মনে হয় ঝড়তুফানের রেশ শীতল হয়েছে।ইমাদ চাবি দিয়ে দরজার লক খুলে চুপি চুপি রুমে ঢুকেছে।পুতুল তখনও চোখ বুজে ছিল।ইমাদ আস্তে করে পুতুলের কাছাকাছি আসা ধরতেই দেখতে পেলো রাহাদ ঘুম থেকে জেগে মুখের ভেতর হাত পুরে ওকে দেখছে।
ইমাদ ইশারা দিয়ে ফিসফিস করে বললো,’বাবু আমার।ছেলে আমার।চেঁচিও না কেমন?প্লিজ’

রাহাদ মুখ থেকে হাত সরিয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে।ইমাদ কপালে হাত দিয়ে লুকিয়ে পড়লো পর্দার আড়ালে।পুতুল বারান্দা থেকে ছুটে এসে রাহাদকে কোলে নিয়ে বললো,’কি হয়েছে রাহাদ??কাঁদছো কেন?’

রাহাদ এবার চুপ।ইমাদ ফুলের গুচ্ছটাকে টেবিলে রেখে হাত দিয়ে পুতুলের চোখ পেছন থেকে ঢেকে ধরলো।পুতুল মুচকি হেসে বললো,’রাহাদের ব্যস্ত বাবা।চিনতে পেরেছি’

-‘ব্যস্ত বাবা বললে?? আজ তোমাকে খুব কাঁদাবো দেখো।’

পুতুল রাহাদকে বিছানায় রেখে গোল হয়ে বসে বললো,’কেন?ট্রান্সফার হয়েছে নাকি? ‘

-“হয় নাই।তবে তোমায় ভালোবাসা দিলে যে রকম করে কাঁদতে ঐ সময়ে সেই দিনটা আমার আজও মনে পড়ে।কাউকে ভালোবাসলে সে কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে যায়।হারিয়ে ফেলবে,অনেকদিন দেখবেনা বলে সে কাঁদবে।পরশে কাঁদবে।এসব ভেবে হাসিও পায়’

পুতুল বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে রাহাদের হাত একটা মুঠো করে ধরলো।
ইমাদ ফুলের গুচ্ছটা ওর সামনে এনে অন্য হাত দিয়ে পুতুলের হাত ধরে বললো,’এই নাও তোমার গোলাপ’

-‘আমার হাত ধরলেন কেন?’

-‘কারণ আমি এখন ঘুমাবো।হাত ধরে ঘুমানো সেই পুরোনো অভ্যাস আমার।জানো না?’

পুতুল মুখ ফিরিয়ে রাহাদের হাত ধরে সেও ঘুমিয়ে পড়েছে।আর ইমাদ পুুতুলের হাত ছেড়ে ঘুমানোর আগে উঠে বসে ওদের দুজনকে দেখছে।সে জানে পুতুলের হাত ধরলে সেও ঠিক এই ভাবেই ঘুমিয়ে পড়বে।কিন্তু সে এখন ওদের ঘুমানোটা নিজের চোখে দেখবে।নিজের পরিবারকে শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকতে দেখার যে তৃপ্তি পাওয়া যায় তা বুঝি অন্যকিছুতে খুঁজে পাওয়া দায়।
জানি না।কিন্তু আমার কাছে এই দৃশ্যতে সুখ নিহিত।রাহাদ আমার বাসায় আসার পর থেকে প্রতিদিন এই দৃশ্য আমি দেখি।কিভাবে যে বছর কেটে যায়!!!
এটা আমার ছোট্ট বাবুই পাখির বাসা।
কেউ যদি জিজ্ঞেস করে ইমাদের বাসা কোনটা?বলবেন রাখাল উদ্দিনের বাসার দোতলায় তার বাসা।নাম”বাবুই পাখি’

কোন রাখাল উদ্দিন চেনেন তো??ঐ যে এঁচোড় কান্ড।ঠিক ধরেছেন।সেই রাখাল উদ্দিনের বাড়ি।এই বাড়ির পাশের কাঁঠাল গাছের পাতা ছাগল দিয়ে খাওয়ানো নিষেধ।এই গাছের কাঁঠাল দিয়ে এঁচোড় বানানো নিষেধ।মুচি বানিয়ে খাওয়াও নিষেধ।মোট কথা তাকানো ও নিষেধ।

সমাপ্ত