বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_২২
Writer-Afnan Lara
.
পুতুল চমকে গেছে।পেছনে ফিরে হাতটা টান দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো এটা সত্যি নাকি ঘুমের ঘোরে ভুলভাল বুঝছে।পরে ইমাদের চাহনি দেখে বিষয়টা ক্লিয়ার হলো তার কাছে।ইমাদ যখন মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো পুতুলের মনে হলো হাতটা ধরা বুঝি একেবারে নরমাল একটা ব্যাপার।অথচ তার কাছে এটা অনেক কিছু।ইমাদের স্বাভাবিক ব্যবহারে সেও নিজেকে বুঝিয়ে দিলো এটা সত্যি নরমাল একটা বিষয়।এসব ভেবে চোখ দুটোকে বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ হয়েছে।কেউ যদি হাত ধরে রাখে,সারাদিন কেন? জীবনেও ঘুম আসার কথা না।পুতুলের ও হয়েছে তাই।
ইমাদ গভীর ঘুমে।পুতুল হাতটা ছাড়িয়ে উঠে বসলো।তার চোখে ঘুম নেই।সন্ধ্যা থেকে অনেক ঘুমিয়েছে সে।তাই হয়তবা।
ইমাদকে টপকে বিছানা থেকে নেমে গেলো সে।রাতের নিস্তব্ধ পরিবেশটায় গা হিনহিন করছে।পাশে একজন পুরুষ মানুষ সঙ্গী হিসেবে থাকার পরেও মনে ভয় বাসা বাঁধছে।,’রাত এমন হয় কেন?’
অদ্ভুত চিন্তা মাথায় চেপে পুতুল বারান্দায় এসে থেমেছে।বেশ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দূরের লেকটা দেখা শেষে নিচে ফ্লোরের উপর বসলো সে।ল্যাম্পপোস্টের আলোয় পুরো বারান্দা রঙিন হয়ে আছে।
এবার রাতের তারাদের মেলা যেখানে বসে ঠিক সেই জায়গাটার দিকে চেয়ে আছে সে।আকাশ।
-‘কালো আকাশে কোটি -কোটি তারার মেলা।এদের একটাকে যদি ছোঁয়া যেতো।আমাকে যদি অপশন দেওয়া হয় তাহলে আমি বলবো এদের মাঝের সব চেয়ে বড় তারাটাকে ছোঁয়ার কথা।অবশ্য শুকতারাকেও ছোঁয়ার ইচ্ছে আছে।
যদিও এখন রাতের আকাশে শুকতারা নেই।শুকতারা থাকে ভোরের সময় পূর্বের দিকে।সেই তারাটা দিনের শুরুর ভালো লাগার সময়টাতে আকাশে আসে।তার সৌভাগ্য বলিহারি!
ভোর বেলার দৃশ্য দেখার মতন ভালো কিছু আর নেই।
ইশ এখন যদি বৃষ্টি হতো।’
.
-‘আর আপনি ভিজতেন?চড় খেয়েছেন কখনও?’
.
পুতুল মাথা তুলে তাকিয়ে দেখলো ইমাদ কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।পুতুল কপাল কুঁচকে বললো,”আমি চড় খাইনি।তবে মার খেয়েছি”
.
-‘তাহলে এবার চড় ও খাবেন।উঠে আসুন।এরকম ঠাণ্ডা ফ্লোরে বসে থাকা অপরাধ না।কিন্তু জ্বরের সময় বসে থাকা গুরুতর অপরাধ। হাত ধরুন আমার!
আমার ঘুম না ভাঙ্গলে জানতামই না যে আপনি এখানে বসে উদ্ভট চিন্তা মাথায় কষছেন।আসুন বলছি!’
.
-‘এরকম বকছেন কেন?রোগীর যেটাতে ভলো লাগে,সে কম্পোর্ট ফিল করে তাকে সেটা দেওয়া উচিত।বুঝলেন?’
.
-‘রোগী উল্টাপাল্টা জিনিস চাইলে তাকে ধরে কেলানো উচিত।সেটা বুঝলেন?’
.
পুতুল মুখটা ফুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো।অবশ্য ইমাদের হাত ও ধরতে হয়েছে।ইমাদ আর অপেক্ষা না করে ওকে নিয়ে হাঁটা ধরলো।রাত এখন এগারোটা বাজে।পুতুলকে বিছানা অবধি এনে হাত ছেড়ে দিয়েছে ইমাদ।তারপর এক পাশে পা ঝুলিয়ে বসে বললো,”ফোনে মুভি দেখবেন?ঘুম এসে যাবে”
.
-‘নাহ।ভালো লাগছে না।আচ্ছা আপনি গান পারেন?’
.
-‘নাহ।আমার গলা ভীষণ খারাপ।গান গাইলে গাছের পাতা ঝরে যাবে।এত বিদঘুটে।জীবনেও আবদার করবেন না এটা নিয়ে।একবার গান গেয়েছিলাম পুরো স্কুল হেসেছিল সেদিন’
.
-‘কোন গানটা গেয়েছিলেন শুনি?’
.
-‘বলে নিজেকে আবারও হাসির পাত্র করতে চাই না।’
.
পুতুল মুচকি হেসে শুয়ে পড়েছে।ইমাদ নড়েচড়ে বসে বললো,’আপনি গান পারেন?’
.
-‘নাহ।গান পারতেই হবে এমন কোনো নিয়ম আছে নাকি?দেশে কি শিল্পীর অভাব?’
.
-‘সেটাই।এত শিল্পী থাকতে আমরা কেন গান পারি না বলে মন খারাপ করে বসে থাকবো।’
.
পুতুল মাথার নিচে হাত রেখে বললো,”আমি কাল বাবার বাড়ি যাব।জামাকাপড় সব নিয়ে আসবো সেখান থেকে।কিছুই আনা হয়নি”
-‘আফসোস আমি আপনাকে নতুন কিছু কিনে দিতে পারছি না।নতুন বউকে এসব দিতে হয় আর আমি সেখানে ফার্নিচার কেনায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি।’
-‘নতুন বউকে এসব দেওয়া হয় তো পরে দিবেন।আমি পুরাতন হবো না।যতদিন না আমার শাশুড়ি আমায় মেনে নিচ্ছেন ঠিক ততদিন আমি নতুন বউ।’
.
-‘ভালো।ঘুমান এখন।আমার ফোন এসেছে।মনে হয় বাবার কল।আসছি’
.
ইমাদ চলে গেছে।পুতুলের মনে হলো তার পিঠের তলায় কিসের যেন খোঁচা লাগছে।পিঠটা উঁচু করে তলার থেকে ইমাদের সেই শার্টটা টেনে বের করলো সে।এটাকে ধরে ঘুমিয়েছিল।
-‘ভাগ্যিস ইমাদ দেখেনি।তা নাহলে কি না কি ভাবতো কে জানে।বাঁচলাম!’
শার্টটা রাখতে গিয়ে পুতুল আবার থেমে গেলো।কি মনে করে শার্টটাকে ওড়নার সাথে পেঁচিয়ে লুকিয়ে শুয়ে পড়লো পুনরায়।শার্টটার উপর সে ফিদা হয়ে গেছে।এটাকে হাত ছাড়া করা যাবে না।
——
-‘বাবা কেমন আছো?’
.
-‘তোর মা যেমন রাখছে।সারাদিন ঘ্যানঘ্যান করে মাথা খায় আমার।তোর কি আমার জন্য একটুও মায়া হয় না রে ইমাদ?তোর ভোলাভালা বাবাটাকে রণচন্ডী মায়ের সাথে একা বাসায় ফেলে চলে গেলি।এই তোর বাবার প্রতি ভালোবাসা??চা চেয়েছিলাম সাড়ে নয়টার সময়।এখন সাড়ে এগারোটা বাজতে চললো, তোর মা চোখে শশা দিয়ে সোফার উপর শুয়ে আছে।একবার পানি দেয় তো চাপাতা দিতে ভুলে যায়।আরেকবার চা পাতা দিলে চা ঢালতেই ভুলে যায়।দুবার চা বানানোর নাটক করে এখন আমাকে শুধু শুধু বসিয়ে রেখেছে।
আমি শুধু বলেছিলাম আমার যদি পুত্রবধূ থাকতো তাহলে চা বানিয়ে খাওয়াতো ব্যস হয়ে গেলো।মনে হয় যেন বারুদে আগুন লাগাই দিছি।দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো।শুরু হলো গালাগালি।সেসব পরে বলছি,আমি শুনলাম সে নাকি তোকে অনেক কিছু কিনে দিয়েছে?তাহলে আমার কথা হলো এত ঢংয়ের কি আছে? ছেলেরে তুমি সোনায় মুড়িয়ে দেবে খুব ভালো কথা তাহলে বাসা থেকে বের করে দিসো কেন?
তোর মা আসলে পাগল হয়ে গেছে।এটার চিকিৎসা প্রয়োজন।তা নাহলে একটা সময়ে আমাকেও পাগল বানিয়ে দেবে।’
-‘বাবা থামো।শুধু বলো কেমন আছো? মায়ের নামে বিচার দেওয়া ছাড়া আর কোনো টপিক নেই তোমার কাছে?’
-‘তুই শুনতে চাস না সেটা বল।যাই হোক কেমন আছিস?যার জীবন বাঁচাতে বিয়ে করেছিস সেই মেয়েটাকে কেমন লাগে?’
-‘ভালো।পছন্দ করেই তো বিয়ে করলাম’
-‘কথা বলিয়ে দিস কালকে।এখন তো ঘুমায় তাই না?’
-‘হুম।তার অনেক জ্বর’
-‘সে কিরে।ঔষুধ খাইয়েছিস?না সারলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাস।
সালাউদ্দিন আছে না?তার চেম্বারে যাস।আমি বলে দেবো ফোন করে’
-‘আরে ওসব কিছু লাগবে না।ঠিক হয়ে যাবে।বৃষ্টির সিজন তো।একটু একটু এমনটা হবেই।’
-‘তুই ঘুমিয়ে পড় তাহলে।কাল কথা হবে’
-‘ঠিক আছে।’
.
ইমাদ ফোন পকেটে ঢুকিয়ে রুমে আসলো।এরপর পানি খাবে বলে চলে গেলো রান্নাঘরের দিকে।ফোনের ফ্ল্যাশ অন করে পানি খেয়ে পা টিপে টিপে রুমে ফেরত চলে এসে একবার পুতুলের দিকে আলো তাক করে আবার নিজের কাজে যেতে নিতেই কি মনে করে পুনরায় আবার তাক করলো।পুতুলের হাতের সাথে পেঁচানো ওর শার্টটা।ইমাদের ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটলো তা দেখে।তারপর আলো বন্ধ করে পুতুলের পাশে এসে বসলো সে।
-‘সিনথিয়ার কিচ্ছু ভাল্লাগতো না আর এই মেয়েটার বিন্দু পরিমাণ সব কিছু ভাল্লাগে।দুটো মানুষকে দেখার দু রকম দৃষ্টিভঙ্গি।
মন যাকে চায় তাকে দেখার দিকটায় আলাদা বুঝি?মা যদি উনাকে মেনে নিতেন তাহলে প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলতে পারতাম।ওখানে আমাদের দরকার মা বাবার।আর এখানে তাদের দরকার আমাদের।পরিবারটা দুটো পরিবারে ভাগ হয়ে গেলো।এটা কি ভালো দেখায়?’
ভাবতে ভাবতে ইমাদ হাতটা নিয়ে পুতুলের কপালের উপর রাখলো।জ্বর একটু হলেও কমেছে।কাল সকালে বোঝা যাবে এর দৌড় কতদূর। আপাতত কিছু বলা যাচ্ছে না’
——
পরেরদিন সকালে ইমাদই আগে উঠেছে।পুতুলের গায়ে ওর ওড়না জড়িয়ে দিয়ে রুম থেকে বের হলো সে।বাহিরে থেকে খাবার কিনে আনবে।নাস্তা বানানোর মনমাসিকতা নেই।
-‘শরীরটা ম্যাচ ম্যাচ করছে।পুতুলের অসুখ ছোঁয়াছে নাকি।হাত পা ব্যাথা করছে হঠাৎ।আজ তো ব্যাংক একাউন্টে লোনের টাকা চলে এসে যাওয়ার কথা।টাকা দিয়ে সব কিনতে হবে।আর সেসময়ে আমরা দুজন অসুস্থ হয়ে পড়ে আছি।আমার অসুখ নিয়ে ভাবছি না।আমি রোগকে পাত্তা দিই না।তাই পাত্তা না পেয়ে রোগ বেশি সময় থাকে না’
—–
সামনের হোটেল থেকে চারটে পরোটা,ভাজি, ডাল হাতে হাঁটা ধরলো ইমাদ।উপর থেকে তমিজ আঙ্কেল সবটা দেখে ফোন করলেন মিসেস রওনককে।খবর জানিয়ে দিয়ে রেলিং চেয়ারে বসে চায়ে চুমুক দিলেন তিনি।ওদিকে মিসেস রওনক রেগে আগুন।তার ছেলে কিনা বউ থাকতে বাহিরের খাবার খাচ্ছে?
-‘আমি কি তরকারি কিনে দেই না?আমি কি সব দিয়ে আসিনি?সে কোন সাহসে আমার ছেলেকে সকালে নাস্তা বানাই দিলো না?’
ইমাদের বাবা হাতের নিউজপেপার নিচে নামিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললেন,”পুতুলের জ্বর।কাল ইমাদ বলেছিল আমায়’
.
-‘তোমায় মানা করিনি ইমাদের সঙ্গে কথা বলবা না?’
.
-‘তুমি এখানে বসে ওর এ টু জেট খবর রাখছো আর আমি একটু কথা বললেই দোষ?তুমি সব করবা আর আমি কিছু পারবো না?বেশি কথা বললে ওদের এখানে নিয়ে আসবো।ভুলে যেও না ইমাদ আমারও ছেলে’
-‘এনে দেখাও।ডিভোর্স পেপারে সত্যি সত্যি সাইন করে দেবো’
-‘দাও না।মানা করেছি আমি?’
——
পুতুল ঘুম থেকে উঠে ইমাদের শার্টটা ছোটাছুটি করে একজায়গায় রেখে চলে এসেছে।তারপর ফ্রেশ হয়ে চুপচাপ বিছানার এক কোণায় বসে আছে আপাতত।
ইমাদ খাবারগুলো প্লেটে ঢেলে এক এক করে আনছে।পুতুলকে শুভ সকাল বলে ওর পাশে বসলো সে।পুতুল চোরের মতন পরোটা একটা হাতে নিলো।ইমাদ বুঝতে পেরেছে পুতুল কেন এমন বিহেভ করছে।
সে বুঝতে দিলো না।কারণ এমনিতেও সারাদিন লজ্জা পেয়ে মুখটা লাল টমেটোর মতন করে রাখো।ইমাদ চুপচাপ খেয়ে চলেছে।পুতুল ইমাদের হাসি দেখতে পেয়ে ঢোক গিলে প্রশ্ন করলো ও কেন হাসছে।
ইমাদ তো ভালো মানুষ।সোজা মানুষ।স্ট্রেট ফরওয়ার্ড।মুখের উপর বলে দিলো সে দেখে ফেলেছে পুতুল তার শার্ট চেপে ধরে ঘুমিয়েছিল।কথাটা শুনে পুতুলের খাওয়া উঠে গেছে।রোবটের মতন ইমাদের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
ইমাদ বিছানা থেকে নেমে নিজের প্লেটটা হাতে নিয়ে বললো,’আমি এখন অফিসে গেলে এই শার্টটাও চেপে ধরিয়েন,সমস্যা নেই।আপনার বেলায় সব মাফ’
.
পুতুল মুখটা ফুলিয়ে বললো,”থাক!আমাকে এত লজ্জায় ফেলছেন কেন আপনি?খুঁচিয়ে কি পাচ্ছেন?”
-‘আপনি এরকম লজ্জা কেন পাচ্ছেন সেটা বুঝলাম না।স্বামীর শার্ট স্ত্রী নিতেই পারে।এতে কোনো বিধিনিষেধ নেই।’
.
-‘জানি নেই।তাই তো নিয়েছি কিন্তু আপনি হেসে কি বোঝাতে চান কি হ্যাঁ??’
.
পুতুল কথাটা বলতে বলতে ইমাদের সামনে এসে দঁড়িয়েছে কোমড়ে হাত দিয়ে।
ইমাদ মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে পুতুলের গাল টেনে দিয়ে চলে গেলো।পুতুল গালে হাত দিয়ে ওর চলে যাওয়া দেখছে।তারপর নিজের মাথায় নিজে একটা বাড়ি দিয়ে বিছানায় এসে বসে পড়লো।হঠাৎ ইমাদের অফিস যাওয়ার কথা মাথায় আসতেই আওয়াজ বাড়িয়ে সে বললো,”আমার না জ্বর?আপনি আমায় একা রেখে অফিসে যাবেন?”
চলবে””
বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_২৩
Writer-Afnan Lara
.
ইমাদ কথাটা শুনে দুষ্টুমি করে বললো,”যাব।কেন?জ্বর তো কি হয়েছে!শুয়ে থাকবেন সারাদিন।মন চাইলে ভিডিও কল দিবেন।আমি আপনাকে আমার অফিস ঘুরে দেখাবো।কি খাচ্ছি না খাচ্ছি সেটা দেখাবো।আমার কলিগদের সঙ্গে মিট করিয়ে দেবো।’
-‘থামুন!এই আপনার স্ত্রীর জন্য কেয়ার?আপনার বাবার কাছে বিচার দিব আমি’
-‘বিচার দিতে হবে না।মজা করলাম।আপনি আমার সঙ্গেই যাবেন।কিন্তু আপনাকে আপনার বাসায় নামিয়ে দিয়ে আমি অফিস যাব।সারাদিন ওখানেই থাকবেন এরপর আসার সময় আমি আপনাকে ওখান থেকে নিয়ে আসবো’
-‘ভাল বুদ্ধি।মজা লাগছে অনেক।আমাকে পাঁচশ টাকা দিয়েন।কিছু কিনে নিয়ে যাব’
-‘ওসব আপনাকে ভাবতে হবে না।নতুন জামাইয়ের দায়িত্ব- কর্তব্য সম্পর্কে ধারনা আছে আমার।ফ্রেন্ড কাসেমের বিয়ের পর ওর সঙ্গে ওর শ্বশুর বাড়িতে ছিলাম পাঁচদিন।সব শেখা হয়ে গেছে’
-‘তাহলে ঠিক আছে।আমি রেডি হচ্ছি।’
-‘এমন ভাবে বলছেন যেন বাসায় তার শাড়ী আর জামাকাপড়ে ধরে না।আজ টেনে টুনে যা পারেন সব নিয়ে আসবেন।যবে থেকে আপনাকে দেখেছি দুইটা থ্রি পিস,আর আমার দেওয়া আরও দুই থ্রি পিসেই দেখতেছি।শাড়ীও কটা আনবেন।নতুন বউরা শাড়ী পরে থাকে’
পুতুল দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,’আমাকে শাড়ীতে দেখতে ইচ্ছা হয়?’
-‘তা কখন বললাম।চা হয়ে গেছে ঢেলে আনছি।রেডি হোন যান’
—-
পুতুলকে নিয়ে ইমাদ এবার ওদের বাড়িতে এসেছে।পুতুল অনেক জোর করেও ইমাদকে বাসায় ঢোকাতে পারেনি।ওকে গেটের সামনে অবধি দিয়ে চলে গেছে সে।পুতুল মন খারাপ করে বাসায় ঢুকলো।
-‘বাগানে চেয়ারে বসে আছেন বাবা।ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছেন।কালাম তাকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।আমাকে বিয়ে করতে না পারার কষ্ট তার চোখে দেখতে পাচ্ছি।বাবা একবারও তাকাননি আমার দিকে।হয়ত খেয়াল করেননি।ফোনে কথা বলার সময় বাবার আর বাহিরের দুনিয়ার খবর থাকে না।
সোজা হেঁটে ভেতরে গেলাম।মা ডাইনিং টেবিলের পাশে একটা চেয়ারে বসে ডিম পোচ দিয়ে পরোটা খাচ্ছেন আর খালার সঙ্গে কথা বলছেন।খালাকে দেখে খুব খুশি হলাম।এই একটা মানুষ যিনি আমাকে বোঝেন।দৌড়ে তার কাছে গেলাম।মা ও অবাক সাথে খালাও।আমাকে পেয়ে তাদের আনন্দ আর ধরে না।তাদের উল্লাসে বাবা বাগান থেকে ছুটে আসলেন।আমাকে দেখে তার ছুটে আসা স্লো হয়ে গেলো।
মুখটা গম্ভীর করে বললেন,”তোমার বর কই?’
আমি বললাম, তিনি অফিসে চলে গেছেন।বাবা আমাকে একবার বাগানে আসতে বলে চলে গেলেন আবার কানে ফোন ঠেকিয়ে।মা আমার হাত ধরে বসালেন সোফায়।খালা বসলেন আরেক পাশে।দুজনের একই প্রশ্ন!! যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে সে মানুষটা কেমন।আমি এক কথায় উত্তর দিলাম’প্রচণ্ড ভালো’
তারা আমার কথা শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন দুজনে।তারপর হঠাৎ মা আমার কপালে হাত রেখে মুখটা ফ্যাকাসে করে ছুটে গেলেন রান্নাঘরে।ঔষধী কিসব বানাবে।এটা মায়ের পুরোনো অভ্যাস।অসুখ হলে ঔষুধের পেছনে না দৌড়ে তিনি সময় ব্যয় করেন আয়ুর্বেদ বানানোয়।কোনো এক এওয়ার্ড অনুষ্ঠানে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল মা।তার আয়ুর্বেদে কাজ দেয়।বাবার ভয়ে দোকান খুলে বসতে পারলেন না।
তাই তার উপর বিশ্বাস আছে, ভুলভাল কিছু বানাবে না।খালা আমার হাত চেপে ধরে বললেন,’বরের কথা বাদ।শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, ভাবী কে কিরকম?’
আমি জবাবে বললাম পরিবারটা ছোট।তিনজনের পরিবার।ভালো মনের সবাই’
খালা আমার দিকে আড় চোখে তাকালেন তারপর হনহনিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলেন।এই এক সমস্যা!
আমি যদি কোনো কিছু ইঙ্গিত করে না ও বলি তাও খালা ঠিক বুঝে যান।যাই হোক বাবার সাথে কথা বলা দরকার
এই ভেবে বাগানের দিকে গেলাম।বাগানে আসা মানে মন ভালো হয়ে যাওয়া।দুজন লোক সকালে একবার আর বিকালে একবার ঝাড়ু দেয়।এত সুন্দর লাগে তখন।দুবার ঝাড়ু দেওয়ার কারণ হলো গাছগাছালিতে ভরপুর এই জায়গাটা।শুকনো পাতার অভাব নেই।বাবার সামনের চেয়ারটার কোণা ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি।বাবা ফোনটা সবেমাত্র টেবিলের উপর রেখেছেন।কালামকে চা নাস্তা আনতে পাঠিয়ে দিলেন।তারপর আমায় বসতে বললেন।আমিও চুপচাপ বসলাম।বাবা সবার আগে প্রশ্ন করেলন আমার স্বামী কি চাকরি করে।তো আমি বললাম একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে।খুঁটিনাটি অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করলেন।তারপর শেষে বললেন ভালোই পেয়েছি।
অবশ্য আমি ইমাদের মা- বাবার অমিল,এমনকি আমরা এখন আলাদা থাকছি এসব কিছুই বলিনি।কি দরকার তাদের সামনে উনাদের ছোট করার।দু পরিবার এখনও মিললোই না আর আমি কিনা আগেই ঝগড়া বিবাদ তৈরি করবো?
চা এসেছিল কিন্তু বাবা খায়নি।আরেকটা কল এসেছে বলে উঠে চলে গেছে।আমি সোজা আমার রুমে এসে আলমারির ভেতর থেকে ফোনটা নিয়ে নিলাম।ইমাদ অফিসে গেলে তাকে কল করতে ফোন পাই না।এখন থেকে ফোন দেওয়া ইজি হয়ে যাবে।
নিজের সব জামাকাপড়, শাড়ী গুছিয়ে রেডি করে এক কোণায় রেখে দিয়েছি।দুপুর বারোটা বাজে।উনি আসবেন কখন?এখানে মন বসছে না একটুও।তাকে মিস করছি বড্ড বেশি।’
—–
পুতুল মাকে বলে দিয়েছে ইমাদ তার কথা শোনে না।যদি তাকে লাঞ্চের জন্য ডাকতেই হয় তাহলে যেন বাবা নিজে ডাকেন।তাই মা এবার খালাকে নিয়ে ছুটলেন বাবার রুমের দিকে।
বাবা তখন আম গাছের পাতা দিয়ে দাঁত ঘষছিল।মা আর খালাকে দেখে পাতাটা ফেলে বললেন,’কি?ওমন ব্যাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন তোমরা?’
-‘আসলে শুনো না!নতুন জামাইটা অফিস থেকে ফিরবে।তাকে তো এখানে দাওয়াত দেওয়া উচিত তাই না?’
-‘একদম উচিত।তো?’
-‘তো মানে তুমি যদি ফোনে বলতে
ছেলেটা লাজুক প্রকৃতির।আসতে চায় না।যদি তুমি ডাকো নিশ্চয় আসবে।’
-‘ওহ।’
পুতুল মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। বাবার এরকম স্বাভাবিক ব্যবহার দেখে মনটা খারাপ করে চলে আসলো সে।
-‘আজ যদি ইমাদ না খেয়ে যায় তাহলে আমি নিজেও খাব না।যদি খাইতেও বসি গলা দিয়ে নামবে না।’
-‘পুতুল এদিকে আয় একবার!’
বাবার আওয়াজ পেয়ে পুতুল ছুটে চলে আসলো।বাবা আরেকটা আম পাতা হাতে নিয়ে বললেন,’তোমার বরের নাম কি যেন?ইমাদ না?ওরে ডাকো।একসাথে লাঞ্চ করবো’
কথাটা শুনে পুতুল অনেক খুশি হলো।খুশিতে নাচতে নাচতে সে নিজের রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে ইমাদকে কল করলো।তখন দুপুর ১টা বাজে।ইমাদ ফাইলের পাতা উল্টাচ্ছিল বসে বসে।পুতুলের নাম্বার তার অজানা।তাই আননউন নাম্বার দেখে রিসিভ করেই সালাম দিল সে।
-‘আপনি কি ইমাদ হাসান অমি বলছেন?’
-‘জ্বী।আপনি কে?’
-‘আপনার ওয়াইফের নাম কি পুতুল চৌধুরী?’
-‘হ্যাঁ।কেন?আপনি কে?পুতুল কোথায়?’
-‘তাহলে শুনুন’
-‘বলুন’
-‘আমি পুতুল বলছি’
.
-‘মজা করছেন আমার সাথে?আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম একেবারে।এটা কার নাম্বার?’
-‘আমার নিজের।সেভ করে রাখুন।ফোন নিয়ে নিয়েছি।অফিস থেকে ফিরে এখানে লাঞ্চ করবেন।বাবা আপনাকে আসতে বলেছে’
.
-‘সত্যি তো?’
-‘তিন সত্যি’
-‘আচ্ছা জ্বর ভালো হয়েছে আপনার?’
-‘নিম পাতার পাকোড়া খেয়ে জ্বর গিয়ে এখন মাথা ঘুরাচ্ছে।আসুন সব বলবো।জলদি আসুন’
—–
ইমাদ এসেছে দুপুর আড়াইটার সময়।পুতুল দরজা ধরে অপেক্ষা করছিল।অপেক্ষার যেন অবসানই ঘটে না।
-‘জীবনে প্রথম একটা মানুষকে এত মিস করা হলো।সে কি আমায় মিস করেছে?নাকি শুধু আমিই ছটফট করেছি?’
ইমাদ গেট খুলে ভেতরে ঢুকলো সবে।তাকে দেখে মনে হলো কলিজা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
-‘নিজের অজান্তেই এক গাল হাসি এসে গেলো।ইমাদ কিঞ্চিত হেসে আমার সামনে দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,”শরীর কেমন এখন’
আমি মাথা নাড়িয়ে ভালো বললাম।সে বললো মুখ ধুবে, তাই আমার রুমে নিয়ে আসলাম তাকে।আলমারি থেকে তোয়ালে নিয়ে অপেক্ষা করছি আবারও।
তিনি গেছেন মুখ ধুতে।তার গায়ের গন্ধ সারা রুম জুড়ে আছে।পাগল করে দিচ্ছে।একটা মানুষকে বেশ অনেকক্ষণ যাবত মিস করলে যখন সে এসে পড়ে তার গায়ের গন্ধটা তখন নেশার মতো কাজ করে।’
ইমাদ ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে দেখলো পুতুল তোয়ালে ধরে চোখ বন্ধ করে রেখেছে
ইমাদ আস্তে করে এসে ওর হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়ে নিতেই পুতুল চমকে পিছোতে গিয়ে পড়েই যাচ্ছিলো খাটের সাথে ধাক্কা খেয়ে।ইমাদ আরেক হাতে ধরে ফেললো ওকে।পুতুল ঠিক হয়ে দাঁড়িয়ে সরি বলে এক দৌড় মেরেছে।
ইমাদ ওর চলে যাওয়া দেখে মুখটা মুছে বিছানায় বসলো।
-‘পুতুলের রুমটা দারুণ।দারুণ বলতে বাবার একমাত্র মেয়েদের রুম যেমন হয় আর কি।গোলাপি রঙের,তারা,প্রজাপতি ,ফুল,ফলফল-পাকোড় একটা জঙ্গল বানিয়ে রেখেছে রুমটাকে।হিজিবিজি করে রেখেছে।তবে বিছানাটা নরম একেবারে।ঘুম আসছে চোখ জুড়ে।আজকে খাটনি বেশি হয়েছে।একটু ঘুমালে মন্দ হতো না’
.
পুতুল আবার আসলো খাবার খাওয়ার জন্য ডাকবে বলে।এসে দেখলো ইমাদ ওর বিছানায় খুব সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে তার ঘুমন্ত চেহারা দেখে পুতুলের মুখের কথা হাওয়া!
একটু একটু করে এগিয়ে এসে ইমাদের দিকে চেয়ে রইলো সে।
-‘পুরো বাচ্চাদের মতন লাগছে।মন চায় গাল টেনে দিই।কিন্তু গাল টেনে দিলেই তো জেগে যাবে।এমনিতেও উনি সারাদিন আমায় লজ্জায় ফেলেন।’
পুতুল ফিসফিস করে বললো,’শুনছেন?বাবা খেতে বসবে দু মিনিট পর।আপনি কি বাবার সঙ্গে খাবেন না?’
ইমাদ সাথে সাথে চোখ খুলে তাকালো।পুতুল ভয় পেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।ইমাদ উঠে বসে বললো,’আমি ঘুমাই নাই।এমনি শুয়ে ছিলাম।ঘুমানো ভালো ছিল।আপনাকে আর লজ্জা দিতে মন চাইছে না’
.
পুতুল কথাটা শুনে চোরের মতো হেঁটে চলে গেছে। ইমাদ চুল ঠিক করে ডাইনিং রুমে পা রাখলো।বাবা তখন ভাতে হাত রেখেছেন।সালাম শুনে মাথা তুলে তাকালেন ইমাদের দিকে।সালাম নিয়ে ওকে বসতে বললেন। ইমাদ চুপচাপ চেয়ার টেনে বসলো।টেবিলে বিন্দু পরিমান জায়গা খালি নেই।মাছ, মাংস,সবজি,ডাল,সব কিছুতে ভরপুর।
ইমাদ ভাবলো পুতুলের বাবা অফিস নিয়ে প্রশ্ন করবেন হয়ত।কিন্তু তিনি তার উল্টোটা করছেন।শুরুতেই বললেন রুই মাছের মাথাটা ইমাদকে দিতে।পুতুলের মা সেটাই করলেন।এরপর বললেন করলা ভাজিটা মজা হয়েছে সেটাও দাও ওরে।
ইমাদ খাবার মুখে দেওয়ার আগে পুতুলের দিকে একবার তাকালো।পুতুল বাবার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।বাবা খেতে খেতে বললেন,’আমার কিছুর অভাব নেই।মেয়েকে কষ্ট করে বড় করতে হয় নাই।বাপ- দাদার প্রচুর সম্পত্তি ছিল।মানে এত যে এখনও খাই আমরা।আমার নাতিপুতি ও খেতে পারবে।কষ্ট ছিল না।কষ্টের দিন শুরু হলো যেদিন ওকে বিয়ে দিব বলছি ঠিক সেদিন থেকে।আমার মেয়ের গায়ে আমি জীবনে হাত তুলি নাই।সেই আমি ওর গায়ে রাগের তোড়ে হাত তুলেছিলাম ঐদিন।মেয়ে কি করলো!! আমার মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে পালিয়ে গেলো’
চলবে”