বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_২৪
Writer-Afnan Lara
.
-‘তোমাকে বলতে লজ্জা হচ্ছে।কি ভাবো আমাদের নিয়ে কে জানে!’
-‘আঙ্কেল।পুতুল পালিয়ে গিয়ে আমার কাছেই ছিল এতদিন’
কথাটা শুনে বাবার চোখ লাল হয়ে গেছে।মুখে কথা নেই।পরের লাইন শুনার জন্য মনটাকে শক্ত করছেন তিনি।হাত মুঠো করে রেখেছেন।
ইমাদ পুতুলের দিকে এক নজর তাকিয়ে বললো,’পুতুলকে আমি চিনতাম না।আর সেও আমায় চিনতো না।ওকে আমি বাঁচিয়েছিলাম সেদিন।আমার সামনে এসে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।ওকে আশ্রয় দিয়েছিলাম আমি।ব্যস এই টুকুই’
-‘অচেনা একটা মেয়েকে আশ্রয় কজনে দেয়।ভালো করেছো।আমি তো ভাবলাম হয়ত তুমি আর ওর আগের সম্পর্ক ছিল।যাই হোক।মেয়ে পালিয়ে যার কাছে গিয়ে থেকেছিল তার সাথেই ওর বিয়ে হয়েছে এটা ভালো কথা।খাও।বেশি করে খাও।ছেলে মানুষ এরকম পাতলা হলে ভালো লাগে না।যদিও তুমি মোটামুটি আছো।কিন্তু এই মোটামুটিতে হবে না।স্বাস্থই সকল সুখের মূল বুঝলে?আমার মত,আসাদের মতো খাও বেশি করে।শরীর স্বাস্থ ঠিক থাকলে নিজের মধ্যে আলাদা ভাব আসে।আচ্ছা পুতুলের আম্মু! আসাদ কই?’
-‘ও তো কাজে বেরিয়েছে এখনও আসেনি।রাতে আসবে মনে হয়’
-‘আসাদ থাকলে তোমার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়া যেতো।আচ্ছা পরে আরও সময় পাবে কথা বালর’
-‘না আঙ্কেল।আসাদ ভাইয়াকে আমি অনেক আগ থেকেই চিনি।উনিও আমাকে চেনেন।’
-‘তাই নাকি।তা কি করে চিনো?’
-‘বাবা আমি বলছি।এরে আমি চিনি রোডে একটা মেয়েকে কিস করার সময় দেখেছিলাম।এরে চিনবো না!!!খুব ভালোমতন চিনি’
ইমাদ মুচকি হেসে বললো,’যে মেয়েটাকে কিস করতে দেখেছিলেন সে আপনারই বোন।যদিও ওটা কিস ছিল না।এক্টিং করেছিলাম আপনি আর সাইমনের থেকে রক্ষা পেতে’
বাবা খিলখিল করে হেসে ফেলেছেন।কোনোমতে হাসি কাবু করে ইমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,”তোমাকে দেখে মনে হয় না তুমি এত দুষ্টু! যাদের ভয়ে এত অভিনয় করলা আজ তারাই তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।হাহাহা!
আসাদ আয় বস।তুই না রাতে আসবি?’
-‘কাজ জলদি শেষ হয়ে গেলো তাই চলে আসলাম।তুমি না পুতুলকে আর কখনও বাসায় জায়গা দেবে না?তাহলে ও এখানে কি করে?এরকম লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় উঠিয়েছিলে।হলো তো!’
-‘অতীত মনে রেখে জীবনে আর কি হবে।বরং অতীত ভুলে গেলে নতুন কিছু আসে।আমিও তাই চাই।’
——
খাওয়া শেষে ইমাদ পুতুলের রুমে ঘুমাতে একটু শুয়েছিলো।পুতুল জাগাতে গিয়েও পারেনি।মা মানা করে বললেন আজ এখানে থেকে যেতে।
সন্ধ্যার সময় মাগরিবের আজান দিতেই ইমাদ জেগে গেছে।চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে মাথার চুলগুলোকে ঠিক করলো সে।
-‘সব ঝাপসা মনে হচ্ছে।মাথা ঘুরছে।বেশি ঘুমালাম নাকি?’
ইমাদ হাতের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে চমকে বিছানা থেকে নেমে গেলো তাড়াহুড়ো করে।
-‘এত দেরি কি করে হলো!!’
.
-‘ মা আজকে আপনাকে থাকতে বলেছেন।তাই আর জাগালাম না।’
-‘ইশ!!এত কেন ঘুমালাম।আজ ব্যাংকে যাওয়ার কথা ছিল।’
-‘কাল যাবেন।নামাজ পড়ে নিন।আমি চা আনছি’
পুতুল চলে গেলো।ইমাদ কপাল টিপতে টিপতে ওয়াসরুমে চলে গেছে।পুতুল মুচকি মুচকি হাসছে আর চা বানাচ্ছে।তার হাসির রহস্যে লুকিয়ে আছে তার পরনে কমলা রঙের শাড়ী।হাতে সোনালী রঙের চুড়ি।যদিও স্বর্নের না।সিটি গোল্ডের।চুল খোলা।এত সেজে লাভ হলো না।ইমাদ খেয়াল করেনি।তাও মুখে হাসি ফুটেছে কারণ চায়ের কাপটা নিতে গেলে সে নিশ্চয় খেয়াল করবে।এই ভেবে মুখ লাল হয়ে আসছে পুতুলের।চায়ের কাপটা নিয়ে রুমে ফিরে আসলো সে।ইমাদ বিছানায় বসে ফোন দেখছিল।পুতুল ওর কাছে বসে চায়ের কাপটা এগিয়ে ধরলো।ইমাদ শুধু চায়ের কাপটার দিকে তাকিয়ে সেটা নিয়েছে।
পুতুলের মেজাজ চড়গ গাছ।রাগে কটমট করছে বসে বসে।
ইমাদ চায়ে চুমুক দিয়ে উহু করে উঠলো।চা একেবারে গরম।এটা বলে পুতুলের দিকে তাকালো সে।পুতুল রেগে- মেগে হাত দুটো উঠিয়েছিলো ইমাদের কলার টেনে ধরবে বলে। ঠিক সেসময়ে ইমাদ ওকে দেখলো।
হেসে বললো,”রাক্ষুসী রাণী কটকটি সাজলেন?’
-‘আচ্ছা আপনি ফান ছাড়া কিছু জানেন না?’
-‘আমি ভাবতাম আমি সবসময় সিরিয়াস।কিন্তু আপনি বলায় বুঝলাম আমি একজন ফান করা মানুষ।আসলে আমি কি বলতে পারবেন?’
-‘জানি না।কাঁচকলা খান বসে বসে’
পুতুল উঠে চলে যাওয়া ধরতেই ইমাদ শাড়ীর আঁচলের এক কোণা ধরে ফেললো মুঠোবন্দি করে।
পুতুল থেমে গিয়ে পেছনে তাকালো।ইমাদ সঙ্গে সঙ্গে আঁচলটা ছেড়ে দিয়ে বললো,’আপনি চা খাবেন না?’
-‘আমি এত দেরিতে চা খাই না।অনেক আগেই মায়ের সাথে খেয়ে ফেলেছি।আপনাকে এত ভাবতে হবে না”
পুতুল চলে গেলো।ওখান থেকে বাহিরে যাওয়ার পর ওর মনে আসলো তার রুম থেকেই সে চলে এসেছে।চেঞ্জ করবে তো সেখানেই।তাই পুনরায় আবার গেলো রুমে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কষ্টের নিশ্বাস ফেলে চুলগুলোকে খোঁপাতে বন্দি করে ফেললো।বাহিরে বাগানে ব্যাঙ ডাকছে।বৃষ্টির জন্য।মাথার উপর ফ্যান চলছে খুব জোরে।তাও মেজাজ বিগড়ে আসছে।বাতাসের অভাবে না।কারোর প্রশংসার অভাবে।চুল বেঁধে এবার ব্যাগ থেকে একটা থ্রি পিস নিলো পুতুল।ইমাদ সব খেয়াল করছে।সেটা হাতে পুতুল হনহনিয়ে ওয়াসরুমের দিকে যাওয়া ধরতেই ইমাদ বললো থামতে
-‘আবার কি?’
-‘এভাবেই থাকুন না।সুন্দর লাগছে’
-‘থাক জোর করে বলতে হবে না।’
-‘জোর করে শাড়ী পরিয়ে রাখতে তো পারবো নাকি?সেটাও পারবো না?’
-‘আপনি চাইলে সব পারবেন কিন্তু আপনি করবেন না।কারণ আপনি তো একটা…. ‘
-‘একটা??’
-‘ছাগল।একেক ছাগল আছে…..’
-‘থাক আর বলতে হবে না।মিসেস রওনক যদি শোনে তার একমাত্র ছেলেকে আপনি ছাগল বলেছেন আপনাকে তরকারি দেওয়া বন্ধ করে দেবে’
-‘আমার বাসায় তরকারির অভাব নাই।বাবার সাথে সুসম্পর্ক গঠন হয়ে গেছে।প্রতিদিন শাকসবজি আসবে বাসায় হুহ!”
-‘আমি ছাগল হলে আপনি কি জানেন?’
-‘কি?’
-‘বলদ!
ভুলক্রমে ছাগলের সঙ্গে বলদের বিয়ে হয়ে গেছে।ভবিষ্যতে তাদের বাচ্চা হবে গরু।কি জোস না?’
পুতুল হাত মুঠো করে কচলাতে কচলাতে বললো,”আপনি আজ বেশি উল্টাপাল্টা কথা বলেই যাচ্ছেন। ভালো হচ্ছে না কিন্তু’
-‘চুপচাপ শুয়ে থাকুন এখানে।সারাদিন টইটই।আপনার না জ্বর?’
পুতুল ইমাদের পাশে এসে বসলো চুপচাপ।হাতের চুড়িগুলোকে কয়েকবার ঝাঁকিয়ে নিজের ফোন হাতে নিলো।ইমাদের দিকে তাকাচ্ছেও না।কিছু বলছেও না। ইমাদ তার ফোন রেখে পুতুলের এক্সট্রিম লেভেলের ভাব-সাব দেখছে।কি ভাবটাই না সে দেখাচ্ছে যেন সে কোনো মন্ত্রীর আত্নীয় লাগে।ফোন টিপছেই তো টিপছে।ইমাদ খেয়াল করলো ফোন উল্টো ধরে টিপছে সে।
ইমাদ ফিক করে হেসে দিয়ে পুতুলের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ঠিক করে ধরিয়ে দিলো।পুতুল লজ্জায় মনে হয় আজ মরেই যাবে।
ইমাদ হাসি থামিয়ে বললো,’ভাব দেখাতে হলে ভাব দেখানোর কারণ গুলো অর্জন করতে হয়।বুঝলে বাবু মেয়ে?’
-‘আমি বাবু না।ঠিক আছে?আমার ফোন উল্টে ধরলেও সেম কাজ হয় তাই মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই উল্টো ধরি’
কথাটা বলে পুতুল গেমস খেলায় মন দিয়েছে।ইমাদ ওর দিকে এক চাহনিতে মগ্ন।পুতুলকে শাড়ীতে প্রথম দেখেছিল খোকনের এঙ্গেজমেন্টে যাওয়ার সময়।তারপর বিয়ের দিন।এরপর আজ।
-‘আজকেই হয়ত এমন করে তাকানো।পুতুলকে শাড়ীতেই বেশি ভালো লাগে।ইশ! সে যদি সবসময় শাড়ী পরে থাকতো।এই জন্যই বুঝি বলা হয় শাড়ীতে নারী।নারীর সাথে শাড়ী জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। মনে হয় শাড়ী তৈরি হয় নারীদের রুপলাবন্য অধিক বাড়িয়ে দিতে।শাড়ী পরলে তুমি কালো হও,কিংবা শ্যামলা,নতুবা ফর্সা!! তোমাকে ভালো লাগবেই।ছেলেরা পাগল হয়ে যাবে।শুধু একটিবার প্রাণ ভরে দেখার নেশা তাকে ধরে রাখবে যতক্ষন শাড়ী পরা রমনী চোখের সামনে থেকে চলে না যায়।পুতুলকে শাড়ীতে দেখেছিলাম ঘুম থেকে হঠাৎ চারটার সময় জেগে যাওয়ার পরে।এক ঝলক তাকে দেখে আবার ঘুমে তলিয়ে পড়েছিলাম।কিন্তু আমার বেশ মনে আছে তাকে আমি দেখেছি।কমলা রঙের শাড়ী আর সাথে খোলা চুল আমার চোখজোড়াকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে রেখেছিল।’
-‘এই যে মিঃভাবুক।কি হলো বলুন তো?এতক্ষণ ভুলেও তাকাচ্ছিলেন না আর এখন ড্যাবডেবে চোখে চেয়েই আছেন।রাক্ষুসী দেখলেন নাকি?’
-‘উহু।পরী দেখলাম।কেন দেখতে পারি না?’
-‘অবশ্যই পারেন।তবে আমাকে দেখতে হলে মন থেকে প্রশংসা করতে হয়।আমি প্রশংসার পোকা।প্রশংসা শুনলে আমার আর কিচ্ছু লাগে না।গলে পানি হয়ে যাই একেবারে’
-‘বাহ।তার মানে আপনার দূর্বলতা জেনে গেলাম।আপনাকে আয়ত্তে আনতে হলে আগে গাড়ি গাড়ি প্রশংসা করতে হবে তাই তো?’
-‘কখন বললাম আমি প্রশংসা শুনলে আপনার কথায় উঠবো বসবো?আমি বললাম আমাকে দেখতে হলে আগে ভালো ভালো বলতে হবে।শুধু তাই না।মন থেকে বলতে হবে।যেন আপনার প্রশংসা শুনে আমার মুখে হাসি ফোটে।ঠিক ওরকম’
ইমাদ গালে হাত দিয়ে মুখটা এগিয়ে এনে বললো,”তো শুনো রমনী।তোমার রুপে আমি হলাম ফিদা!!!
তোমার এই রুপের ঝলক এতদিন চোখে পড়েনি।আজ পড়লো আর বুঝতে পারলাম আমি কি বিয়ে করেছি!’
-‘কি বিয়ে করেছেন?’
-‘আগুনের ফুলকি’
-‘মন ভালো হওয়ার জায়গায় খারাপ হয়ে গেলো।আমি বুঝি আগুনের ফুলকি?ধুর!’
-‘আগুনের ফুলকি এক প্রকার প্রশংসা।প্রশংসা পেতে হলে আগে জানতে হয় প্রশংসা কেমন হয়।না জেনেই খালি প্যানপ্যান করলে হবে?’
-‘যাই হোক।আমাকে আগুনের ফুলকি বলবেন না।অন্য কিছু বলুন’
-‘আপনি এত সুন্দর।আপনাকে দেখলে মনে হয় আগুনের লাভা।যেন উতলিয়ে পড়ছে’
-‘বের হোন আমার বাসা থেকে।দুনিয়ার সব ফালতু প্রশংসা করে যাচ্ছে।আপনি একটা নিরামিষ লোক,আনরোমান্টিক,অরোমান্সকর!’
-‘সব বুঝলাম।কিন্তু অরোমান্সকর আবার কি জিনিস?জীবনে শুনি নাই তো তাই জিজ্ঞেস করছি।বাংলা নিয়ে এত পড়াশুনা করার পরেও জানলাম না অরোমান্সকর কি’
-‘সেটা মানে আপনি রোমান্স কি জানেন না তাই আপনি অরোমান্সকর’
-‘হায় রে!!যাই হোক।আমার প্রশংসায় আপনার মন গলে পানি হয়েছে?’
-‘নাহ।উল্টে জমাট বেঁধেছে।’
-‘সত্যি আমি কিছু জানি না।অরোমান্সকর একটা!’
পুতুল হাসলো ইমাদের কথা শুনে।ইমাদ ও হেসে ফেলেছে।পুতুলের হাসি এত বেশি এসেছিল যে সে ইমাদের হাত ধরে হাসতে হাসতে বালিশের তলায় মুখ লুকিয়ে ফেলেছে।ইমাদ ওকে টেনে ধরে উঠিয়ে বললো,’আমি একটু বাহিরে থেকে ঘুরে আসি।
আপনি থাকেন।আম কাঁঠাল পাহারা দেন’
-‘কখন আসবেন?’
-‘আমি বাহিরে যাওয়ার কথা বললেই মুখটা ওরকম ফ্যাকাসে করে ফেলেন কেন বলুন তো?’
-‘আপনি সামনে না থাকলে ভালো লাগে না।আপনাকে সামনে দেখলে ভালো লাগে।নতুন বর আমার তাই’
-‘আপনি বলায় মনে আসলো।আপনিও তো নতুন বউ হলেন’
কথাটা বলে ইমাদ শার্ট টেনেটুনে ঠিক করে উঠে দাঁড়ালো।তারপর ফোন পকেটে ঢুকিয়ে বললো,’জলদি চলে আসবো।ডিনার আমার সাথেই করিও’
কথাটা বলে সে চলে গেলো।
পুতুল অবাক হয়ে ইমাদের চলে যাওয়া দেখছে।এই প্রথম ইমাদ ওকে তুমি করে বললো।
চলবে”
বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_২৫
Writer-Afnan Lara
.
কয়েক কদম হাঁটার পর ইমাদ নিজেও বুঝতে পারলো সে পুতুলকে তুমি করে সম্বোধন করেছে সবেমাত্র।জিভে কামড় দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো সে।পুতুল ঘুরছে আর নাচছে।উল্টা পাল্টা একটা গানের সঙ্গে সম্ভবত।ইমাদ মুচকি হেসে বের হয়ে গেলো বাসা থেকে।ভাবলো পুতুলকে তুমি করে বলায় পুতুল হয়ত খুশি হয়েছে।
-‘কাউকে খুশি করতে যদি তুমি বলতে হয় তাহলে আমি আজ থেকে পুতুলকে তুমি করেই বলবো।তার এরকম খুশি রোজ দেখতে চাই।
মেয়েটা অনেক সরল।স্বচ্ছ পানির মতো।সব কিছুর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে জানে।আমি জানি সে আমার মায়ের মনটাও জয় করে নিতে পারবে।মা ও তাকে মেনে নেবে কারণ আমার মা ওতোটাও খারাপ না।শুধু রাগটা একটু বেশি।কিন্তু তার রাগের পরের আফসোস আমি দেখেছি।এসব মানুষদের দোষ দিতে নেই।তারা ছোট্ট শিশুর মতন নিষ্পাপ হয়।রাগটা দেখায় কন্ট্রোল রাখতে না পেরে, কিন্তু এরপরে তাদের চেয়ে হয়ত আর কেউ এতবেশি অনুশোচনা করতে জানে না যতটা তারা করে।তখন তারা নিজেই নিজেকে দোষারোপ করে কেন তারা রাগ দেখালো।আমি আমার মাকে চিনি।তার এখন এক রক্তি ও রাগ নেই।শুধু একটা ভালো সময়ের অপেক্ষা করছেন পুতুলকে মেনে নেওয়ার।যদি মানতে নাও চান আমার মুখের দিকে চেয়ে মেনে নেবেন।আমার জন্য মা সব করতে পারে।ছোটবেলায় আমাকে নিয়েই তো বাবার সঙ্গে বেশি ঝগড়া লাগতো তার।আমার স্কুলের ফিস দিতে দেরি হয় বলে মা সিদ্ধান্ত নিলেন চাকরি করবেন।বাবার কড়া নিষেধ।এত নিষেধ উপেক্ষা করে উনি চাকরি নিলেন।কেন??আমার কেয়ার যেন ভালোমতন করতে পারেন।আমি মাকে ভালো বুঝি।বাবাও বোঝে তাও ইগোর জোরে ঝগড়া করে সারাদিন। মা ও কম না।বাবার রাগ বাড়াতে ওস্তাদ।
আচ্ছা!এদিকে আমার কোন ফ্রেন্ডের বাসা যেন।ভুলে গেলাম।মহল্লাটায় আসা হয়নি আগে।কিছুই চিনি না।’
-‘ইমাদ দাড়াও’
ইমাদ থেমে পেছনে তাকালো।সিনথিয়া ছুটে আসছে।ইমাদের সামনে এসে থামলো সে।হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,’কেমন আছো?’
-‘ভালো।তুমি?’
-‘ভালো।তা কি করা হচ্ছিল?’
-‘শ্বশুরবাড়িতে এলাম।এখন একটু ঘুরতে বের হয়েছি।তুমি এখানে?’
-‘আমার বাসা তো এখানেই।হাঁটতে বের হয়েছিলাম আমাদের প্রতিবেশীর সঙ্গে তখন তোমায় দেখলাম।তোমার বউ কই?’
-‘বাসায়।’
-‘চলো কফি খাব।এখানে একটা ক্যাফে আছে।জোস কফি পাওয়া যায়’
-‘নাহ।আমি আসলে পুুতুলের ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছি।উনার সঙ্গে ঘুরতে যাবো।পরে কোনোদিন আমি আর পুতুল একসঙ্গে তোমার সাথে কফি খেতে যাব”
-‘একটা কথা বলবে?’
-‘কি?’
-‘আমার আর পুতুলের মধ্যে তফাৎ কি একটু বলবে?আসলে তুমি তো বিয়ের নাম শুনতেও আপত্তি করতে।সেখানে বাবা -মাকে না জানিয়ে তুমি নিজেই বিয়ে করে নিয়েছো।আমার কথা হলো, আমার মাঝে কি সমস্যা ছিল?আমাকে তো তোমার মা নিজেই পছন্দ করেছিলেন।আমরা তো আগে প্রস্তাব দেইনি।দুই মাস তোমার এত কাছে ছিলাম অথচ তুমি একটিবার নিজ থেকে আমার হাত ধরোনি।হুট করে একটা অপরিচিত মেয়েকে বিয়ে করে নিলে।মানে সমস্যাটা আমার মাঝে ছিল তাই তো?’
-‘বিয়ে আমি পুতুলকেও করতাম না।বিয়েই করতে চাইনি আমি।পুতুলকে বাঁচানো জরুরি ছিল বলে বিয়েটা করেছি।আর যদি বলো, এত মেয়ে থাকতে কেন ওকেই বাঁচাতে গেলাম! তাহলে বলবো ওকে আমি পছন্দ করি।ওর সাথে আমার আগ থেকেই পরিচয় ছিল।পছন্দের জেরেই আমি ওর জীবনটা বাঁচালাম।আর পুুতুল নিজেও আমায় পছন্দ করে।তোমার আর কিছু জানার আছে?’
-‘আছে।আমার মধ্যে কি সমস্যা বলো?’
-‘তোমার মধ্যে কেনো সমস্যা নেই।সমস্যা আমার।কারণ আমি তোমাকে ভালেবাসতে পারিনি।আমার মন সাড়া দিচ্ছিল না।সব কিছু জোর করে হচ্ছিল ‘
-‘পুতুলের বেলায় মন সাড়া দিল?’
-‘বলতে পারো “হ্যাঁ” ‘
সিনথিয়া মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে।ইমাদের পাশে একটা ফুলের দোকান ছিল।ওখান থেকে একটা সাদা রঙের গোলাপ কিনলো সে।তারপর সেটা সিনথিয়ার দিকে বাড়িয়ে ধরে মুচকি হেসে বললো,’মানুষের মধ্যে কমতি থাকে না।মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব।
আমাদের সবাইকে আল্লাহ নিজে সৃষ্টি করেছেন।তার সৃষ্টিতে কি করে কমতি থাকে বলো??তার সৃষ্টি সুন্দর।তুমি সুন্দর।এই ফুলটা তোমার।আমি তোমার রুপ আর পুতুলের রুপে ডিসাইড করি নাই কাকে আমি পছন্দ করি।আমি তো বিয়ের এতদিন পর আজকে পুতুলকে ঠিক ভাবে দেখলাম।এতদিন সেভাবেই তাকানো হয়নি।।আর তোমাকে তো ওর আগে দেখেছি।তোমার মধ্যে বিন্দু মাত্র খুঁত ও নেই।মা তাই তো তোমায় আমার জন্য পছন্দ করেছে।কিন্তু ঐ যে, যার জন্য যার মন কাঁদে।
পুতুলের ভাগ্যে আমি ছিলাম।তোমার ভাগ্যে হয়ত অন্য কেউ আছে।কিন্তু আছে।জোড়ায় জোড়ায় তো পাঠানো হয়েছে তাই না??আর তুমি কি জানো, তোমার ভাগ্যে যে আছে সে তোমায় তোমার চেয়েও বেশি ভালোবাসবে?আমি তোমাকে সে ভালোবাসা দিতে পারতাম না কখনও।তাই না?’
সিনথিয়া চোখের কোণার অশ্রু মুছে ইমাদের হাত থেকে সাদা গোলাপটা নিলো।তারপর হাসলো।
ইমাদ ফুলের দোকান থেকে একটা লাল গোলাপ ও নিলো।সিনথিয়া গোলাপটাকে মুঠোবন্দি করে ধরে ইমাদকে টাটা দিয়ে চলে গেছে বাসার দিকে।ইমাদ লাল গোলাপটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে পকেটে ঢুকালো।যদিও গোলাপটা সম্পূর্ন ঢুকেনি পকেটে।এরপর ফোন বের করে তার একটা ফ্রেন্ডকে কল করলো যার বাসা এখানেই।তার সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দেবে সে তারপর ফিরে যাবে।
—
পুতুল খালার সাথে বসে ইমাদকে নিয়ে কথা বলছে।খালা এক কথার মানুষ।তার মতে ইমাদ ভদ্র।নিরামিষ টাইপের।মানে তাকে হাঁটু গেড়ে আই লাভ ইউ বললে সে বলবে, আরে তাই তো।আমিও তোমায় ভালোবাসি।
এরকম টাইপের ছেলে সে।পুতুল হাসতে হাসতে শেষ।তবে হাসির শেষে তার কান্না এসে যাওয়ার মতন অবস্থা হয়েছে।কারণ সে বুঝে গেছে ইমাদ তাকে নিজ থেকে এসে কখনও বলবে না সে আদৌ ভালোবাসে কিনা।
তাই সে মন খারাপ করে রুমে চলে আসলো।এসেই দেখলো বিছানার মাঝখানটায় একটা গোলাপ রাখা।লাল গোলাপ।পুতুল খুশি হয়ে ফুলটা হাতে নিয়ে এদিক ওদিক তাকালো।ইমাদকে দেখতে পেলো বারান্দায়।ফোনে কথা বলছে সে।
পুতুল ফুলটা নিয়ে সেদিকে গেলো।ইমাদ ফোন পকেটে পুরে পাশে তাকাতেই দেখলো পুতুল ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
-‘তুমি নিয়েছো?ভালো।তোমার জন্যই এনেছিলাম’
পুতুল ফুলটা ইমাদের দিকে ধরে বললো,’বিয়েরদিন কখন আমার মাথায় ফুল লাগিয়ে দিয়েছিলেন বুঝতে পারিনি।অনুভব করতে পারিনি।পরে মাথায় হাত দিয়ে টের পেয়েছিলাম।
তবে আজ অনুভব করতে চাই।আজ শুরুতেই টের পেতে চাই’
ইমাদ ফুলটা পুতুলের হাত থেকে নিলো।পুতুল মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়েছে।ইমাদ ফুলটার ডাঁটা ছোট করে পুতুলের ঘাড়ে বাম হাত রাখলো তার।
তারপর ডান হাত দিয়ে খোঁপায় গোলাপটা আটকে দিলো সে।পুতুল চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে।ইমাদ ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করিয়ে বললো,’অনুভব হলো নাকি টেরই পেলে না?’
-‘পেলাম।ফুলটার জন্য থ্যাংক ইউ’
-‘ওয়েলকাম। ‘
—
মিসেস রওনক মাথায় বরফের থলি রেখে টিভিতে টম এন্ড জেরি দেখছেন।তার মাথা ঠাণ্ডা রাখা প্রয়োজন এটা ইমাদের বাবার ধারনা,আর মিসেস রওনকের ধারনা কিছুই না।তিনি প্রচণ্ড রেগে আছেন।এত রাগ যে বরফ গলে যাচ্ছে তাও তার রাগ কমছে না।তার এত রাগের একমাত্র দোষী পুতুল।অবশ্য ইমাদ ও কিছুটা দোষী।
তো তারা যেহেতু মূলহোতা তাদের দোষটা বলা যাক।তাদের দোষ হলো ইমাদের মাকে না জানিয়ে পুতুল কেন ইমাদকে নিয়ে বাপের বাড়ি থাকতে গেছে।এটা সমস্যা ছিল না।মিসেস রওনক নিজের রাগ কাবু রেখে ছেলের কাছে ফেরত গিয়েছিলেন আজ বিকালে।গিয়ে দেখলেন একটা নতুন তালা ঝুলছে ইমাদ আর পুতুলের বাসায়।চৌকিদার তমিজউদ্দিন তার গোয়েন্দাগিরির ফল প্রকাশ করেছেন আজ সন্ধ্যাবেলায়।তাও মিসেস রওনকের রাগ চড়া দেখে।তিনি জানালেন ইমাদ গেছে শ্বশুরবাড়ি। ব্যস হয়ে গেলো।আগুনে ঘি ঢেলে দিলেন।মিসেস রওনক রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বাসায় ফিরে আসলেন।নিজের সব চাইতে বড় শত্রু ইমাদের বাবাকে সবটা জানালেন।
তিনি এসব শুনে সোফা থেকে আস্তে করে উঠে ফ্রিজে যত আইস কিউব রাখা ছিল ওগুলো ব্যাগে পুরে মিসেস রওনকের মাথায় রাখলেন।এরপর ফোনটা চোরের মতন নিয়ে ইমাদকে ফোন করলেন তিনি।
—
-‘মানেহহহ্?মাকে বলে যাইনি বলে এত রাগ?’
-‘কথা সেটা না।তুই তো বলেছিলি পুতুলের পরিবার ওকে পছন্দ করে না।তোকেও না।তাই তোরা আলাদা বাসায় থাকছিস।এখন হুট করে ওদের বাসায় রাত্রিযাপন মানে তোর মা বুঝেছে তোরা তাকে ভুলে নতুন পরিবার গঠন করবি এরপর তোর মাকে ভুলে যাবি।হ্যানত্যান আরও কত কি।তোর মা আসলেই একটা পাগল।পাবনার টিকিট কাটতে কি কি করতে হয় ওসব বল।দেরি করলে মনে হয় আমিও পাগল হয়ে যাব ‘
-‘বাবা তুমি মাকে ফোনটা দাও।আমি কথা বলবো’
-‘শোন ইমাদ!আমার এই ফোন দুই মাসের বেতনের টাকা থেকে জমিয়ে কিনেছি কদিন হলো।তোর মাকে এখন ফোন দিলে এক আছাড়ে ভেঙ্গে গুড়িগুড়ি করে ফেলবে।আমি সেটা চাই না।তোর যদি কথাই বলতে হয় তাহলে কাল আসিস বাসায়।সামনা সামনি কথা হলে ম্যাটারটা চুকে যাবে’
-‘ওকে।তুমি আপাততর জন্য মাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করো।আমি দেখি কি করতে পারি’
-‘কি হয়েছে আপনার মায়ের?’
-‘বাচ্চামো শুরু করেছে।বাদ দাও।ডিনার করবে কখন?’
-‘আমাকে এত সুন্দর করে তুমি বলতে পারছেন কি করে?মানে একবারও আটকাচ্ছে না কেন?’
-‘কারণ তুমি বলার পর আমি দেখলাম একটা মানুষ তিড়িংবিড়িং নাচছে।তাই সে সুবাদে তুমি বলা শুরু করে দিলাম’
পুতুল লজ্জা পেয়ে মুখে হাত দিয়ে দু মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল এরপর ভ্রু কুঁচকে বললো,’আপনি সবসময় আমাকে লজ্জা দেন কেন বলুন তো?সব কিছু আপনার জানতে হবে?সারাদিন চব্বিশ ঘন্টা আমার উপরই নজর রাখেন আপনি?’
-‘নাহ তো।কে বললো?আমার কত কাজ থাকে।কিন্তু কি করবো।আপনি লজ্জাকর সব ঘটনা আমার সামনেই ঘটান’
-‘মোটেও না।আপনি লুকিয়ে দেখেন আমাকে।আর একটা কথা আবার আপনি করে বলছেন কেন আবার?তুমি তো ভালো ছিল’
—
-‘রাতে খাবারটা এলোমেলো ভাবে শেষ হয়েছে।বাবা আর আসাদ ভাইয়া বাহিরে ছিল।তাই আমি আর উনি ডিনার করলাম একা একা।মা আর খালা পাশের বাসায় গেছিলেন।’
ইমাদ বালিশ বুকে ধরে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।পাশের বাসার কারা যেন পুরোনো দিনের গান চালিয়েছে।
-‘আমার সারাটাদিন মেঘলা আকাশ’
-‘ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম।’
গানটা শুনলে মন হারিয়ে যায় সবসময়।এখনও তাই।চোখ বন্ধ করে ইমাদ ফিল করছে গানটা
চলবে”””