বাবুই পাখি পর্ব-২৬+২৭

0
1193

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_২৬
Writer-Afnan Lara
.
-‘গানটা আপনার প্রিয় বুঝি?আমারও ভাল্লাগে তবে মাঝখানে যে একটা সুর দেয় বড় টানের ওটা বেশি ভালো লাগে।কেন যেন না মনে হয় গভীর রাতে এসে পড়েছি।বাহিরে বৃষ্টি।বিদ্যুৎ নেই।কিছু কিছু গান আছে মনে সত্যিকারের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।এই গানটা তার মাঝে একটা। গানটা বৃষ্টির সময় শুনি কিংবা অসময়ে, মনে হয় বাহিরে তুমুল ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে।গা হিন হিন করে ওঠে তখন’

পুতুলের কথা শেষ হতেই ইমাদ চোখ খুললো।গায়ে বালিশটা চেপে ধরে মুচকি হেসে বললো,’শীত করছে তাই না?’

-‘তাই তো।আমি খেয়ালই করিনি।শুধু দুহাত চেপে ধরে ভাবছি লোম খাড়া হয়ে আছে কেন।বাহিরে কি বাতাস শুরু হয়েছে?’

-‘শুধু বাতাস না একেবারে বৃষ্টি।ছাদ থাকা বাসার এই এক সমস্যা। কখন বৃষ্টি হয় একদমই টের পাওয়া যায় না যতক্ষন না জানালা দিয়ে উঁকি মারা হয়।টিনের ঘরে থাকা মানুষ বৃষ্টির আসল ফিলিংস নিতে পারে।ঝনঝন আওয়াজ।আহ মনে আসতেই মনটা ভালো হয়ে যায়’

-‘আপনি আগে কখনও টিনের ঘরে ছিলেন?’

-‘হ্যাঁ।আমার দাদার বাড়ি টিনের ছিল।সাইড ওয়াল উপরে টিন।পেস্ট রঙ করা।তোমাকে নিয়ে একদিন যাব বেড়াতে।আগে মায়ের মন গলুক।সবাইকে নিয়ে তারপর যাব’

-‘ঘুমাবেন না?দশটা বাজে’

-‘আমি কি এত জলদি ঘুমাই?অবশ্য তোমার যে বিছানা যে কেউ শুয়ে পড়ে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যাবে।এরকম গদিতোশক পাওয়া মুশকিল।তোমার বাবা তোমায় রাজকন্যা হালে রেখেছে যা বুঝলাম আমি।উনাকে জিজ্ঞেস করবা, কোন দোকান থেকে কিনেছে।মায়ের জন্য আর আমাদের জন্য কিনবো’

-‘আমাদের তোষক বানানোর মস্ত বড় কারখানার আছে।পাপন আঙ্কেলর সাথে বাবার শেয়ার।তো সেই জায়গা থেকেই বাসার সব তোষক আসে ‘

-‘কারখানা মানে?এগুলো কি রপ্তানিও হয় নাকি?’

-‘নাহ।পুরো দেশে সাপ্লাই দেওয়া হয়।ব্র্যান্ড আছে।নামটা পাপন আঙ্কেলের মেয়ের নামে।ডালিয়া এন্ড ফ্রেন্ডস’

-‘নাম শুনেছি মনে হয়।আচ্ছা যাই হোক তার মানে ফ্রি পেয়ে যাব তোষক।এবার বসো, আমার গল্প করি’

-‘টপিক কি?’

-‘টপিক হলো তোমার বয়ফ্রেন্ড ছিল?’

পুতুল চোরের মতন লুক নিয়ে ধপ করে বিছানায় বসলো।ইমাদের থেকে বালিশটা নিয়ে কোলে রেখে ঢোক গিললো সে।কি বলবে না বলবে ভেবে পাচ্ছে না।ইমাদ গালে হাত দিশে ভ্রু নাচিয়ে বললো,’মোট কজন হতে পারে?’

-‘ওভাবে বলছেন কেন?আমার বয়ফ্রেন্ড ছিল বলতে দু- মাস প্রেম ছিল।ভালো ভালো মিষ্টি-মধুর কথা হতো।তো একদিন সে বললো দেখা করবে।আমিও রাজি হলাম।যেহেতু প্রথম কোনো ছেলের সাথে দেখা করবো।মনে ভয় ছিল।ভয় কাবু করে সাথে একটা ফ্রেন্ডকে নিয়ে গেলাম আমি।সে আমার সাথে দু তিন লাইন কথা বলে আসাদ ভাইয়ার নাম শুনে ঐ যে কাজের কথা বলে গেলো।আর ফিরলো না।ফেসবুক আইডিটা তার আর কখনও এক্টিভ দেখলাম না।’

-‘মানে তোমার ভাইয়ার কথা শুনে পালিয়েছে।হাাহাহাহা!’

-‘হাসবেন না তো।ছেলেটা অনেক কিউট ছিল।একেবারে নায়ক নায়ক ভাব’

-‘আর আমি বুঝি কুৎসিত?’

-‘তা কখন বললাম।আপনি তো সুন্দর।সুন্দর না হলে কি সিনথিয়া আপু এত পাগল হয়ে যায়?যাই হোক একটা কথা বলার ছিল।সিনথিয়া আপু কি আপনাকে আর ডিস্টার্ব করেছে?কল বা অন্য কিছু করে?’

-‘আজ দেখা হয়েছিল।ওদের বাসা নাকি এখানেই।তুমি ওরে চিনতে?’

-‘আমি বাসা থেকে কম বের হতাম তাই কখনও দেখিনি আগে।জানিও না।
আচ্ছা তো কি বললো আপনাকে?’

-‘তাকে বুঝিয়ে দিলাম।এরপর সাদা গোলাপ একটা গিফট করলাম আর সে চলে গেলো।কিসসা খতম’

-‘একটা কথা বলি?মাইন্ড করবেন না আগে থেকে বলে রাখছি।আন্টি রাগ হলে একদম না করে দেবেন আমাকে।ঠিক আছে?’

ইমাদ নড়েচড়ে বললো,’শুনছি,বলো’

পুতুল বালিশটা চেপে ধরে একটু একটু করে এগিয়ে আসলো তারপর ফিসফিস করে বললো,’ঘুরতে যাবেন?মানে বিয়ের পর যে যায়।হানিমুন আর কি’

-‘মা রাগ হবে মানে!!সোজা না করে দেবে।কিন্তু মেইন কথা হলো মাকে না জানালেই হয়।তাও আমি বুঝি না আমার বাসার খবর কেমনে যে মায়ের কাছে পৌঁছে যায়।কোন নিন্দুক খবর পাচার করে তা বের করতে পারলে ওরে আমি বের করবো।যাই হোক।আপনি তেমন ঘটা করে আমার থেকে কখনও কিছু চাননি।এই চাওয়া আমি অবশ্যই পূরন করবো তবে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে।মায়ের মন ভালো হোক।মাকে জানিয়ে যেতে চাই।মাকে না জানিয়ে গেলে ওখানে একটুর জন্য ও শান্তি পাবো না আমি’

-‘ওহ।আসলে গিফট হিসেবে চেয়েছিলাম।আচ্ছা থাক’

-‘গিফট?কিসের গিফট?’

-‘নাহ কিছু না।ঘুমান।আমার ঘুম আসছে অনেক’

পুতুল বালিশটাতে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।কাঁতা দিয়ে মাথাটাকে ঢেকে ফেলেছে সে।ইমাদ ভাবছে ও কিসের গিফটের কথা বললো।
-‘সচরাচর মানুষ হুট করে গিফট চায় না।তাও পুতুলের মতন মেয়ে তো একদমই না।তার মানে ওর জন্মদিন আসতে চলেছে।কারণ জন্মদিনেই মানুষ নিজ থেকে গিফট চাওয়ার চিন্তাধারা রাখে।এবার বুঝলাম।তাহলে তো মাকে জলদি মানাতে হয়।কিন্তু মা তো এত জলদি মানার মানুষ নাহ।দুই দিক থেকে বিপদে পড়েছি।একটা সুতা ধরে ঝুলে আছি।পুতুল টানছে এদিকে, মা টানছে ওদিকে’

-‘ঘড়ির কাঁটারও মুখের ভাষা আছে।টুং টুং টুং টুং টুং টুং
টুং টুং টুং টুং টুং টুং।এতবার বাজছে কেন?
ওহ আচ্ছা এগারোটা বাজলো।
একেক ঘড়ির আওয়াজ একেক রকম।এই ঘড়িটা মন চাইলেই টুং টুং করে।আমার বাসার ঘড়িটার মতন।তবে এটার আওয়াজ কেমন যেন লেগে যায় কানে।
মনে হচ্ছে বারোটা বাজলেই পুতুলের জন্মদিন।এটা যদি সত্যি হয় তাহলে ওকে কিছু দেওয়া উচিত।আমি জানি সে পাওয়া গোলাপটা নিয়েই খুশি কিন্তু সেটা তো আমি ওর জন্মদিনের উপহার হিসেবে দিই নাই।এখন তো কিছু দেওয়া উচিত।পকেটে টাকা আছে চার হাজার।টাকা দিয়ে কি হবে?গিফট তো নাই।তার উপর পুতুলদের বাগানে একটা ফুলগাছও নাই।সব আম, কাঁঠাল, লিচু।কি দেওয়া যায়?
বের হয়ে দেখবো?তার আগে ওর মাকে জিজ্ঞেস করে নিই আদৌ ওর কাল জন্মদিন কিনা।’

পকেটে হাত ঢুকিয়ে ইমাদ বিছানা ছেড়ে উঠলো।পুতুলের দিকে তাকাতে তাকাতে রুম থেকে বের হলো সে।পুতুলের মা আর খালা সবে পাশের বাসা থেকে এসেছেন।দুজনেই ভিজে গেছেন।কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছিল তাই।দুজনে কাঁপতে কাঁপতে বাসায় ঢুকছে এখন।

-‘আন্টি একটা কথা জানার ছিল”

পুতুলের মা মাথায় হাত দিয়ে ঘঁষতে ঘঁষতে বললেন,’হুম বলো কি হয়েছে?’

-‘আন্টি কাল কি পুতুলের জন্মদিন? ‘

-‘কাল তো রবিবার!এক তারিখ!!ইশ আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম।পুতুলের বাবা জানলে এলাহি কান্ড হবে।কিভাবে ভুলে গেলাম ধুর’

মা আর খালা রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন এবার।তাদের ভেজা কাপড় বদলানোর সময় তাদের হাতে নেই।গোলাপ পিঠা বানাতে বসে পড়েছেন সম্ভবত।পুতুলের নাকি গোলাপ পিঠা অনেক পছন্দের।রাত বারোটায় সব জন্মদিনে তাকে এই পিঠা খাইয়ে দেয় বাবা।
ইমাদ পকেটে পুনরায় হাত ঢুকিয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে চলে গেলো বাসার বাহিরে। আধা ঘন্টা ঘুরেফিরে চলে আসলো।বারোটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি।
পুতুল গভীর ঘুমে।ইমাদ বাসায় ঢুকে দেখলো পুতুলের বাবা আর আসাদ ভাইয়া ডিনার করছেন।ইমাদ বাবাকে সালাম দিয়ে রুমে চলে এসেছে।মা আর খালা এখনও পিঠা বানাচ্ছেন।পিঠা ভাজা হচ্ছে।তেলের গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে।এখনও সিরাতে ঢালা হয়নি।
-‘গোলাপপিঠা মা জীবনে একবার বানিয়েছিল।তাও সেটা গোলাপ হয়নি।হয়েছিল আলুর ভর্তার গোল গোল শ্যাপ।যাই হোক এবার দেখা যাবে শাশুড়ির হাতের গোলাপপিঠা কেমন।’

পুতুল এদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে ফিরে শুয়েছে।ইমাদ তাই ঘুরে গিয়ে বসলো।বারোটা বাজতে আর দু মিনিট বাকি।পুতুলের বাবা রান্নাঘরে গিয়ে চেঁচামেচি করছেন,কেন গোলাপ পিঠা এখনও বানানো হয়নি।
ইমাদ পকেট থেকে রসমালাইের একটা বক্স বের করলো।এখানের একটা মিষ্টির দোকান থেকে কিনেছে।বাসা থেকে বের হবার পরে আসাদের সঙ্গে দোখা হয়েছিল তার।তখন সে বাসায় ঢুকছিল।আসাদকে থামিয়ে ইমাদ জিজ্ঞেস করলো পুতুলের সব চাইতে পছন্দ কি।
আসাদ সবার আগে খাবারের নাম বললো।গোলাপিঠা তারপর বললো রসমালাই পেলে আর কাউরে খেতে দেয় না সে, এটা বললো।
আপাতত কিছু না পেয়ে ইমাদ এক বক্স রসমালাই কিনে নিয়েছে।
সবসময় জন্মদিনের গিফট হিসেবে অন্য কিছু কেন দিতে হবে?খাওয়ার জিনিসে যে তৃপ্তি থাকে তা কি অন্য কিছুতে হয়?’
বারোটা বেজে গেলো।ঘড়িটা আবার প্যানপ্যান শুরু করে করেছে।ইমাদ পুতুলের হাতটা উঁচু করে ধরে বললো,’পুতুল??’

-‘কি?’

-‘ঘুমাচ্ছো?’

-‘না।নাচতেছি।
আসুন আপনি সহ নাচবেন’

-‘উঠবে একটু?’

-‘কেন?’

-‘উঠোই না।দেখাচ্ছি’
পতুল চোখ তুলে তাকালো ইমাদের দিকে তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে সব স্বাভাবিক দেখে উঠে বসো ভাবলো তার জন্য কোনো সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে না।ইমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো কেন জাগিয়েছে ওকে।
ইমাদ পেছন থেকে রসমালাইয়ের বাটিটা এগিয়ে ধরে বললো,’খাও’
পুতুল বক্সের ঢাকনা খুলে এক গাল হাসি দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে
ইমাদ ওর গাল টেনে দিয়ে বললো,’হ্যাপি বার্থ ডে’

পুতুল মাথা তুলে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,’জানলেন কি করে?’

-‘আন্টিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।যাই হোক তারাও তোমার জন্য সারপ্রাইজ রেডি করছে।জলদি রসমালাই কয়েকটা খাও বেশি খেতে হবে না।পরে পেটে জায়গা থাকবে না’

-‘কেন?’

-‘আহা! খাও না’

পুতুল টপাটপ কয়েকটা রসমালাই খেয়ে ঢাকনা দিতেই দরজা খুলে এক এক করে বাবা, আসাদ ভাইয়া আর মা, খালা ঢুকে পড়লেন।মুচকি হেসে সবাই একসাথে বললেন,”শুভ জন্মদিন’

পুুতুল ভেবেছিল এ বছর তার জন্মদিন এমন করে পালিত হবে না।কিন্তু সব দেখলে আগেরমতই আছে। খুশিতে তার চোখে পানি এসে পড়েছে।বাবা গোলাপ পিঠার বাটিটা নিয়ে এসে ওর পাশে বসলো।ইমাদ রসমালাইয়ের বাটি সরিয়ে রেখেছে।বাবা নিজের হাতে পুতুলকে গোলাপ পিঠা খাইয়ে দিচ্ছেন।
ইমাদ গোলাপ পিঠাটার দিকে তাকিয়ে আছে।মায়ের বানানোরটার চেয়েও সুন্দর হয়েছে দেখতে।একবার খেতে পারলে মনের স্বাদ মিটতো।পুতুলের হাতে গোলাপ পিঠার বাটি দিয়ে সবাই চলে গেলেন ঘুমাতে।ইমাদ একবার এক জায়গায় বসছে আর পিঠাগুলো দেখছে।
পুতুল বিষয়টা খেয়াল করেছে।পরে ওর মনে পড়ে গেলো ইমাদকে পিঠা খেতে দেওয়া হয়নি।
পুতুল ঘুরে বসে বললো,’আমাকে রসমালাইয়ের বক্সটা দিন তো।এখন পিঠা খেতে মন চাইছে না।আপনি খান এগুলো’

ইমাদ রসমালাইের বক্সটা দিয়ে ওর থেকে গোলাপ পিঠার বাটিটা নিলো।
স্বাদ মায়ের বানানোর গোলাপ পিঠার মতন না।একটু অন্যরকম।মনে হয় লবঙ্গ গুড়ো দিয়েছে।টেস্ট ভালোই।তাও কেন যেন মায়ের গোলাপ পিঠা দেখতে খারাপ হলেও স্বাদটা ভালো ছিল।
চলবে””

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_২৭
Writer-Afnan Lara
.
-‘আপনার ও কি গোলাপ পিঠা পছন্দের?আগে জানলে আমি নিজেই বানিয়ে খাওয়াতাম আপনাকে’

-‘না সেটা নয়।তবে নতুন কিছু টেস্ট করার ইচ্ছা আমার অনেক।
যখন যেখানে নতুন মেনু দেখি তখন সেটা খাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগি।’

-‘তার মানে আগে কখনও গোলাপপিঠা খাননি?’

-‘খেয়েছিলাম।আমার মা বানিয়েছিল।সাইজ অন্যরকম হয়েছিল এই আরকি।মানে গোলাপ পিঠা নাম হলেও ওটা দেখতে তালের মতন হয়েছিল।যাই হোক, দুজনের বানানো পিঠার টেস্ট আলাদা আলাদা।দুটোই ভালো ছিল’

-‘রসমালাই খাবেন একটু?আমার বেশি হয়ে যাচ্ছে’

-‘নাহ।আমি রসমালাই কম খাই।শুয়ে পড়ো হাত ধুয়ে এসে।অনেক রাত হলো।কাল কথা হবে।’

কথাটা বলে ইমাদ পকেট থেকে ফোন বের করে টেবিলের উপর রেখে শুয়ে পড়লো।পুতুল রসমালাইয়ের বক্সটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ফ্রিজে রেখে আসলো।তারপর হাত ধুয়ে রুমে এসে লাইটটা বন্ধ করলো।ড্রিম লাইটে দু-তিন বার টিপ দেওয়ার পরেও জ্বলছে না।
-‘মনে হচ্ছে খারাপ হয়ে গেছে।কি ঝামেলা।অন্ধকারে কিছুই দেখছি না আমি।কোনোমতে বিছানার নাগাল পেয়েছি।ইমাদের কি কান্ডজ্ঞান নেই?তার বউ অন্ধকারে মরে গেলো নাকি বেঁচে গেলো সেটা দেখার জন্য একবার ডাকলো ও না।আশ্চর্য!’

-‘এরকম ঠুসঠাস আওয়াজ আসছে কোথা থেকে?পুতুল তুমি শুয়েছো?’

-‘নাহ।নাচতেছি।আসুন আপনি সহ অংশগ্রহণ করবেন।ভালো হবে।সালসা ডান্স হবে।
একজন আরেকজনের চুল ছিঁড়া হবে’

-‘নাচের কিছু জানি না।তাও এতটুকু জানি যে সালসা নাচে একজন আরেকজনের চুল ছিঁড়ে না।তুমি কি রাগ করে আছো?তাহলে রাগের কারণ কি?ঘুমাতে বলেছি বলে নাকি অন্য কিছু?’

-‘ঘুমাতে বললে রাগ করবো কেন?রাগ করছি!! রুমের ড্রিম লাইট নষ্ট হয়ে গেছে আর আমি অন্ধকারে কত কষ্ট করে বিছানা অবধি এসেছি তা জানেন আপনি?জানবেন কি করে।আপনার তো আমার সাথে একটাই সম্পর্ক, আর সেটা হলো স্বামী হিসেবে দায়িত্ব কর্তব্য পালন করা’

-‘ওমা!তুমি এরকম সিরিয়াস হয়ে গেলে কেন?কি এমন দোষ করলাম আমি।এত রেগে যাওয়ার কারণ কি?
আচ্ছা তুমি তো বললে আমি খালি দায়িত্ব পালন করি।তো বলো এখন আমার না ঘুমিয়ে কি করা উচিত।সেটাই করবো নাহয়’

-‘থাক!অনেক হয়েছে।আমি ঘুমাই।বাই’
————
পরেরদিন সকাল হতেই ইমাদ নাস্তা না করেই চলে গেছে অফিসে।তার বস কল দিয়েছিল।পুতুল আস্তে ধীরে নাস্তা করে বাসায় ফিরে এসেছে।
মা অনেক করে মানা করেছিল তাও শুনেনি।সে চায় একা জন্মদিন মানাবে। বিয়ের পরে তার প্রথম জন্মদিন।ইমাদ নিশ্চয় কিছু না কিছু করবে।সে জানে।ইমাদ গম্ভীর হয়ে থাকলেও সব কাজের সময় এক পা এগিয়ে।এটা ভেবে পুতুল বাসায় ফিরে এসেছে।শুরুতে রুম সব পরিষ্কার করে নিলো।বিছানা ঝেড়ে ফোনটা হাতে নিয়ে ইমাদকে দুবার কল দিলো।সে ধরলো না।
পুতুল এবার শাড়ীর আঁচল কোমড়ে বেঁধে গেলো রান্না করবে বলে।আজ তার জন্মদিন।তাই নিজের পছন্দে একটা রান্না করলো।কাঁচকলা দিয়ে ইলিশ মাছের তরকারি
শাশুড়ির দেওয়া সব।মাছটা তমিজ আঙ্কেলের বাসার ফ্রিজ থেকে নিয়ে এসেছে এক ছুটে গিয়ে।রান্না ও সেই দেড় ঘন্টার মাঝা মাঝি সময়ে শেষ হয়ে গেছে।বোরিং লাগছে খুব।ফোন খুঁজে আবারও ইমাদকে কল করলো সে। এবারও ইমাদ ফোন ধরেনি।রেগে ফোনটা বিছানার উপর রেখে পুতুল ছাদে আসলো।কয়েকটা ফুল ছিঁড়ে আঁচলে করে বাসায় নিয়ে আসলো আবার।বাসার সামনের দোকানটা থেকে সুঁই- সুতাও কিনে এনেছে সে।ইমাদ অফিসে যাওয়ার সময় রিকশাভাড়া একশো টাকা দিয়ে গেছিলো।রিকশাভাড়া গেছিলো পঞ্চাশ টাকা।বাকিগুলো ওর কাছ রয়ে গেছে।
সুই সুতা দিয়ে গাজরা বানিয়ে সে চলে গেলো গোসল করবে বলে।ফুলগুলোর মধ্যে হলো মধুমালতি ফুল আর গোলাপ।গোসল করে একটা টিয়া রঙের শাড়ী পরলো পুতুল।মাথায় ফুলের মালা গেঁথে বসে থাকলো ইমাদের অপেক্ষায়।দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চললো ইমাদের কেনো খবর নেই।দিন কাটার নামই নিচ্ছে না।তার জন্মদিনটা এত খারাপ যাবে জানলে হয়ত বাবার বাসা থেকে আসতোই না।বিকাল চারটা বাজে।ফোন খুঁজে আবারও কল করলো সে ইমাদকে।
আজ ইমাদের অফিসে অনেক চাপ।বস যেন কয়েক মাসের কাজ একসাথে করতে দিয়েছেন।দম ফেলার সময়টুকু ও নেই কারোর হাতে।সবাই একসাথে ব্যস্ত। ইমাদ একটু বেশি ব্যস্ত কারণ সে কালকের কাজটা অসম্পূর্ন করে চলে গেছিলো।ফোন বেজেই যাচ্ছে।পিওন যাওয়ার সময় বললো,’স্যার আপনার ফোন বাজে’
ইমাদের খবর নেই।সে কম্পিউটারে টাইপ করেই চলেছে সে।পুতুল এতক্ষণ কল দিয়েও পাচ্ছিলো না বলে,কল দুবারের জায়গায় দশ বার হয়ে গেছে এখনও করেই যাচ্ছে জেদ ধরে।
ইমাদ ১২তম বারের সমশ কল রিসিভ করলো।

-‘হ্যালো?আপনি ফোন ধরছিলেন না কেন?’

-‘কি সমস্যা?? ‘

-‘আগে বলুন ফোন ধরছিলেন না কেন?’

-‘আমি অফিসে মজা করতে আসি?জানো না, আমার কত কাজ থাকে?ফোন না ধরা মানে আমি ব্যস্ত আছি।এই সামান্য একটা ব্যাপার বুঝতে তোমার কত সময় লাগবে?ফোন করেই যাচ্ছো খালি।আমাকে ডিস্টার্ব করে কি লাভ হচ্ছে?’

পুতুল কথাগুলো শুনে আস্তে করে লাইনটা কেটে দিলো।
চোখ বেয়ে পানি পড়ছে তার।হাত উঠিয়ে মাথার ফুলগুলোকে ছিঁড়ে ফ্লোরে ফেলে দিলো সে।তারপর চোখ মুছে বাসায় তালা মেরে চলে গেলো।

ইমাদ বাসায় ফিরেছে রাত আটটায়।পুতুলের মা বলেছিল পুতুল সকালেই চলে গেছে।তাই অফিস থেকে সোজা বাসায় গেছে সে।তালা মারা দেখে অবাক হলো ইমাদ।তালা খুলে ভেতরে গিয়ে হাতের ব্যাগটা রাখলো বিছানার উপর।ফ্লোরে ছিঁড়ে ফেলা ফুলগুলো দেখতে পেলো সে।তাতেই মনে পড়লো আজ পুতুলের জন্মদিন।আর সে কত কি না বললো ওকে।নিজের কপালে নিজে বাড়ি দিয়ে পুতুলের নাম্বারে ফোন করলো।কল হচ্ছে কিন্তু রিসিভ করছে না সে।ইমাদ এবার ফোন করলো পুতুলের মাকে।উনি জানালেন পুতুল তো সকালেই গিয়েছিলো।আর তো আসেনি।
ইমাদের এবার ভয় লাগলো।পুতুল কোথায় গেলো তাহলে?তার যাওয়ার কারণ ইমাদ নিজেই।ওভাবে বকা ঠিক হয়নি।ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে।পানি খাওয়ার ইচ্ছে নেই।ফোন পকেটে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো সে।পুরো মহল্লা খুঁজেও পুতুলকে সে পেলো না।মাথায় হাত দিয়ে ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে আছে এখন ইমাদ।
পুতুলের সঙ্গে আগে এমন ব্যবহার সে কখনও করেনি।আজ কেন করলো সেটাই ভাবছে।যা হলো একদমই ঠিক হয়নি।এসময়ে বাবার কল আসলো।

-‘হ্যালো বাবা’

-‘কিরে।কই তুই?’

-‘বাসার সামনে’

-‘ওহ!ভালো।খুব ভালো।তোকে বলেছিলাম না পুতুলের সঙ্গে আমার কথা বলিয়ে দিস।সেটা তো করলি না”

-‘আসলে বাবা পুতুল আমার সাথে রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে।এক ঘন্টা ধরে খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছি না ওকে।অনেক টেনসনে আছি এখন’

-‘থাক আর টেনসন করতে হবে না।আপনার বউ আমাদের কাছে এসেছে।আপনিও এখানে আসুন”

-‘কি বললে?পুতুল তোমাদের কাছে গেছে?’

-‘হ্যাঁ।কেঁদে কেঁদে নাজেহাল অবস্থা করেছিল নিজের।শেষে কি ঘটেছে তা শুনলে তোর মাথা হ্যাং হয়ে যাবে’

-‘কি ঘটেছে?’

-‘তোর রণচন্ডি মা কিনা ওকে সান্ত্বনা দিয়েছে।আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।তুই তাড়াতাড়ি এসে আমার হাতে চিমটি কেটে আমাকে বিশ্বাস করা প্লিজ।’

ইমাদ লাইন কেটে এক দৌড় দিলো।রিকশা নেওয়ার কথা ভুলে গেছে।ছুটে চলে আসলো সে বাসায়।পুতুল বাবা- মায়ের কাছে আছে সেটা শুনে মনে শান্তি লাগলো একটুখানি।
কলিংবেলে চাপ দিয়ে ইমাদ কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো।ভাবলো পুতুল খুলবে দরজা।কিন্তু খুলেছে বাবা।

-‘থাক আর কানে ধরতে হবে না।দোষ জরে আবার কানে ধরা হচ্ছে’

-‘কেমন আছো তুমি?’

ইমাদ এগিয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।মা রান্নাঘর থেকে আসতেই মাকেও জড়িয়ে ধরলো ইমাদ।মা চুপ করে আছেন।কিছু বলছেন না।
ইমাদ বাবা মাকে ছেড়ে তার রুমের দিকে তাকিয়ে বললো,’পুতুল কোথায়?’

-‘বেচারি কাঁদতে কাঁদতে মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে।যা গিয়ে রাগ ভাঙ্গা’

-‘আমার ছেলে অফিস থেকে ফিরে কিছু মুখে দেয়নি।আর তুমি ওকে আরেক কাজ দিচ্ছো?’

-‘মা তুমি খাবার টেবিলে আনো, আমি পুতুলকে পাঠাচ্ছি তোমায় হেল্প করতে’
এটা বলে ইমাদ রুমের দিকে গেলো।রুমে পা রেখে লাইট জ্বালালো সে।পুুতুল এক কোণায় শুয়ে আছে কাঁথা মুড়ি দিয়ে। ইমাদ দরজাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে আস্তে করে হেঁটে ওর কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো।ওর চোখের নিচে এখনও ভেজা।
-‘সামান্য বকা তে কেউ এমন কাঁদে?এটা জানলে আমি রাগটা যত কষ্টই হোক কন্ট্রোল করে রাখতাম।
এই পুতুল?উঠো না।ঘুমাচ্ছো?’

পুতুল চোখ খুলে ইমাদকে দেখে একটু পিছিয়ে গেলোৃ তারপর সোজা হয়ে বসলো শোয়া থেকে উঠে।ইমাদের মুখটা কালো হয়ে আছে।অফিসের কাজের চাপে তার অবস্থাও নাজেহাল,তার উপর খাওয়া- দাওয়াও করতে পারেনি।পুতুল হাত দিয়ে চোখ মুছে বিছানা থেকে নেমে চলে গেলো রুম থেকে।সে ইমাদের সাথে কোনো কথা বলতে চাইছে না।ইমাদ পিছু পিছু রুম থেকে বের হয়ে দেখলো পুতুল মায়ের কাছে চলে গেছে।ওখান থেকে তো আর ধরে আনা সম্ভব বা।এই ভেবে ইমাদ তার আলমারি খুললো এসে।সব জামাকাপড় মা ট্রলি ভরে পাঠিয়ে দেওয়ার পরেও পুরোনো টিশার্ট আর জিন্স একটা রয়ে গেছে।সেটাই পরে নিলো ইমাদ।এরপর ফ্রেশ হয়ে এসে ডাইনিংয়ের দিকে গেলো। পুতুল বাবার পাতে ভাত বাড়ছে।মা তার প্লেট সাজিয়ে বসেছেন।ইমাদের প্লেট খালি দেখে তিনি নিজেই ওকে খাবার সার্ভ করে দিলেন।পুতুল বাবার পাতে ভাত আর মুরগীর মাংস দিয়ে চলে গেছে রুমের দিকে।
ইমাদ খেতে পারছে না।খাবার গলা দিয়ে নামছে না তার।কারণ সে জানে পুতুল ও খায়নি।

-‘কি ঢং!তার এই ঢংয়ের কারণে আমার ছেলেটাও খাচ্ছে না এখন।আরে তুমি রাগ দেখাও আমাদের কি!কিন্তু জানো না তোমার রাগের কারণো আমার ছেলেটারও খাওয়া হবে না!আজিব!’

ইমাদ তার প্লেটটা নিয়ে রুমের দিকে চলে গেছে।

-‘ব্যস হয়ে গেলো।বিয়ে হতে না হতেই ছেলেরা পাল্টে যায়।হায় রে!আমার কপালে এসব লেখা ছিল জানলে সিনথিয়ার সাথে যেদিন ইমাদের বিয়ের কথা পাকা করেছিলাম, ঐদিনই বিয়েটা করিয়ে নিতাম।তাহলে আজ এত কিছু দেখতে হতো না’

-‘সিনথিয়া তোমার ছেলেকে বিয়ে করলে বুঝি রাগ করতো না এমন??সারাদিন দাঁত কেলিয়ে হাসতো??’

-‘তোমাকে কে বলে এক চামচ দিতে?আমি আমার পুত্রবধূ নিয়ে কথা তুলছি,তুমি নিজের খাবার খাও না।কথার মাঝখান দিয়ে এক চামচ না দিলে তোমার শান্তি হয় না তাই না?’

-‘আমি তো হ,য,ব,র,ল যাই বলি তাই দোষ হয়ে যায়।যাই হোক,আমাকে মাংসের ঝোল দাও বকবক না করে’

-‘এগুলো ইমাদের জন্য রেখেছি’

-‘ইমাদকে না সবে এতগুলো মাংসের পিস দিলে’

-‘আরেহ ওগুলো তোমার ছেলে নিয়ে গেলো না?সে একটুও খাবে না দেখো।সব ঐ ঢংগি মেয়েটাকে খাওয়াবে।তাহলে ইমাদের জন্য ও তো কিছু রাখতে হবে তাই না?তাও তুমি যখন চাইছো এই বাটি থেকে ঝোল খাও।আলু খাবে না একদম! ওটা আমার বাটি।’
চলবে”