বাবুই পাখি পর্ব-৩০+৩১

0
1229

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৩০
Writer-Afnan Lara
.
পুতুল দেয়ালে কান পেতে শুনার চেষ্টা করছিল ভেতরের রুমে কি কথা হচ্ছে।অবশ্য তার যে কান পাতার অভ্যাস তাতে বিন্দু মাত্র লাভ তার হয় না।কানকে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে নিলেও সে এক ফোটা কথা শোনে না।তাও হুদাই শোনার চেষ্টা করে।কান লাগিয়ে শুনতে গিয়ে প্রায় ঘুমিয়েই পড়ছিল সে।ধপাস করে পড়ে যাওয়ার আগেই ইমাদের গলার আওয়াজ পেয়ে তার দু মিনিটের ঘুমটা গায়েব হয়ে হুস ফিরে আসলো।হকচকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে সে।ইমাদ খেয়াল করেনি পুতুলের কান পাতার দিকে।সে হাতের ঘড়িটাকে এক ঘুরান্তি দিয়ে পুতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,’নাও।রেডি হয়ে নাও।তমিজ আঙ্কেলের বাসায় যাব।সেখান থেকে সব গুছিয়ে যাওয়ার পথে মাকে মাইগ্রেনের ঔষুধ কিনে দিয়ে যাব।এরপর সোজা বাস স্টেশন’

পুতুল কথা গুলো শুনেছে ঠিক কিন্তু তার পরেও সে মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে ইমাদের মুখের দিকে চেয়ে।ইমাদ ভ্রু নাচিয়ে বললো,’কথা কি শুনেছো নাকি আবার বলতে হবে?’

-‘না মানে শুনেছি।কিন্তু আরেকটা কথা শুনার ছিল।আপনার মা কি মত দিয়েছেন আমাদের ঘুরতে যাবার কথা নিয়ে??আপনি তো বলেছিলেন গেলে আপনার মায়ের মতামত নিয়ে যাবেন’

-‘বলেছিলাম।কিন্তু এটা জানতাম না যে মা কিছু না কিছু করে হলেও অমত পোষণ করবে তাই বাধ্য হয়ে আমাকেই দ্বিমত পোষণ করতে হলো’

কথাটা বলে ইমাদ রুম থেকে বেরিয়ে গেছে।পুতুল চোখ দুটোকে ঘুরিয়ে- ঘারিয়ে মাথা চুলকে ওর পিছু পিছু চলে গেলো।বাবা- মা ঝগড়া করছেন।ইমাদ সেদিকে খেয়াল না করে বের হয়ে গেছে।পুতুল ও ওর পিছু নিলো।বাসার সামনে থেকে একটা রিকশা নিয়েছে তারা।পুতুলের মনে পড়লো কাল ইমাদ ওর সঙ্গে বাজে ব্যবহার করেছে আর তাই সে একটু সরে বসলো।ইমাদের গায়ের সাথে ওর হাত লেগেছিল এতক্ষণ, এখন হাত লাগছে না।ইমাদ ওর দিকে তাকিয়ে বললো,’তোমাকে ঠিক বুঝি না’

পুতুল ভেংচি কেটে দিয়েছে।ইমাদ ও আর কিছু বললো না।বাসায় আসার পর পুতুল চৌদ্দটা শাড়ী রেডি করেছে সীতাকুণ্ড নেবে বলে।ইমাদ বিষয়টা খেয়াল করেনি।তার মাথা ধরেছিল বলে চা বানাচ্ছিলো রান্নাঘরে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে যখন সে রুমে এসে এমন কান্ড দেখলো একটুর জন্য হাত থেকে সিরামিকের কাপটাই পড়ে যাচ্ছিলো।
-‘একি পুতুল? তুমি কি পার্মানেন্টলি থাকার জন্য ব্যাগ প্যাক করতেছো?’

পুতুল ব্রু কুঁচকে ব্যাগের চেইন আটকিয়ে বললো,’আপনি ওসব বুঝবেন না।এই শাড়ীগুলো আমার তিনদিনের জন্য এনাফ’

-‘তুমি তিনদিনে ১২/১৪টা শাড়ী পরবে?মাই গড!আমরা যাচ্ছি চারদিনের জন্য’

-‘ওহ তাই?তাহলে আরও কটা নিতে হবে মনে হয়’

-‘পুতুল শুনো মজা করবা না।এতগুলো শাড়ী নেওয়ার কোনো দরকার দেখছি না আমি।দুটো সেলোয়ার লামিজ আর দুটো শাড়ী নাও ব্যস হয়ে গেলো”

-‘বেশি কথা বললে একদম যাবোই না।একা একা গিয়ে ট্যুর দিয়ে আসেন।ওহ হ্যাঁ! আপনি কেন ট্যুর দিবেন।আপনি তো অফিসের কাজে যাচ্ছেন।আমার মুড ঠিক করতে এবার আমাকেও সাথে নিচ্ছেন।নাহলে আপনার সাধ্য কই মাকে বলে হানিমুনে কক্সবাজার যাওয়ার’

-‘কে বললো অফিসের কাজে যাচ্ছি?মা যাতে সরাসরি মানা না করে তাই বললাম অফিসের কাজে।এমনিতেই সীতাকুণ্ড যাচ্ছি আমরা’

পুতুল কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’তাহলে কক্সবাজার বলা যেতো না?দুনিয়ায় আর কোনো ভালো জায়গা পেলেন না?আমি ভাবলাম সত্যি সত্যি মনে হয় অফিসের কাজে যাচ্ছে’

-‘কক্সবাজারে কাজে যাচ্ছি, এটা বললে মা বিশ্বাস করতো?আর সীতাকুণ্ড কম কিসে?
সাড়ে তিন কিলোমিটার উঁচু চন্দ্রনাথ পাহাড়। সেটার শীর্ষে আছে চন্দ্রনাথ মন্দির।আবার আছে সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক।সব সমতল ভূমি আর পাহাড়ে ভরা।তারপরে আছে বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত,এরপরে গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত।আর কি লাগবে তোমার?গুলিয়াখালীতে গেলে তোমাকে তো টেনেও আনতে পারবো না মনে হয়’

-‘ওহ!গুলিয়াখালি সীতাকুণ্ডতে??জানতাম না তো।তাহলে ঠিক আছে’

ইমাদ তার তিনটে ফুল হাতার শার্ট আর দুটো টিশার্ট নিলো ব্যাগে।এরপর কি মনে করে মাথা তুলে বললো,’তুমি সেখানে গিয়ে শুধু শাড়ীই পরবা নাকি?’

-‘না তো।শাড়ীগুলোর নিচে থ্রি- পিস ও আছে’

-‘এত কিছু নিলে।এই জন্য বুঝি ছোটবেলায় মা -বাবার সঙ্গে ঘুরতে যাবার সময় তাদের দুজনের ব্যাগ প্যাকিংয়ে এত ঝামেলা কেন হতো’

মাইগ্রেনের ঔষুধ বাবার হাতে দিয়ে ইমাদ পুতুলকে নিয়ে বাস ধরেছে সীতাকুণ্ডর উদ্দেশ্যে।পুতুল তার ফোন টিপে মাকে কল করে জানিয়ে দিলো তারা সীতাকুণ্ড যাচ্ছে।সীতাকুণ্ড পৌঁছাতে পাঁচ ঘন্টার মতন সময় লাগবে।ইমাদ কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।পুতুল অনেকক্ষণ ধরে জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে বাহিরে দেখছিলো।সবুজ গাছ গাছালি।আবার ছোট নদী।আবার পুকুর।এমন করে অনেক কিছু দেখলো সে।ফেরিওয়ালা দেখলো পাঁচ -ছয়জন।এক কাতারে লাইনে লাইনে হেঁটে চলেছে তারা।কি সুন্দর লাগছিল।বাসের গতি বেশি বলে ছবিটা তোলা হলো না।এরপর দেখলো একটা পুকুরে মাঝ বরাবর দালান।দেখতে অনেক অদ্ভুত মনে হলো বলে পুতুল দালানটা যতদূর দেখা যাচ্ছিল ততদূর পর্যন্ত চেয়ে ছিল।চারতলা দালান তাও আবার পুকুরের মাঝে।কি দারুন!এবার মনে হচ্ছে ফোন হাতে নিয়ে বসতে হবে।কত ভালো ভালো জিনিস মিস করছি।ছবি তুলে রাখলে পরেও দেখা যাবে।তবে ছবি না তুলে এমনি দেখাতেও কিছু লাভ আছে।আর তা হলো চোখের দেখাটা আসল।ফোনে একশোবার দেখলেও সেই তৃপ্তি আসে না।এই ভেবে মনটাকে সান্ত্বনা দিলো সে।ইমাদ রোবটের মতন বসে আছে।সাড়া- শব্দ নেই।মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে।পুতুল বেশ কিছুক্ষন ধরে ইমাদকে দেখলো।
-‘সে সুদর্শন পুরুষ।মুখে প্রচুর ভাবের ছাপ তবে তার মাঝে আমি ভাব দেখি না।মানুষকে দেখে নাকি বোঝা যায় সে ভাবওয়ালা মানুষ।কিন্তু এই মানুষটর ক্ষেত্রে ঠিক তার উলটা।তার মধ্যে তো আমি ভাবের ‘ভ’ ও দেখি না।তাহলে এই ক্ষেত্রে উক্তিটি খাটলো না।
ঠিক সেসময়ে বাস ব্রেক কষাতেই ইমাদ সামনের সিটের সাথে হালকা/ পাতলা বাড়ি খেলো।মাথায় হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে হকচকিয়ে সে পুতুলের দিকে তাকালো সে ব্যাথা পেয়েছে কিনা দেখতে।
পুতুল দাঁত কেলিয়ে বললো,’পুরুষ মানুষ চিতায় উঠেও যদি একবার চোখ মেলার সুযোগ পায় তবুও সেটা মেলবে মেয়েদের দিকে।বলেছেন সমরেশ মজুমদার’

ইমাদ মাথা থেকে হাত সরিয়ে বললো,’সেই মেয়েটা আমার বউ হয়’

পুতুল দাঁত কেলিয়ে জানালার দিকে ফিরে বসলো আবার। ইমাদ ওর গা ঘেঁষে বসে বললো,’রাগ গেছে নাকি আছে?’

-‘বলেছিলাম না এত সহজে আমার রাগ যায় না।বকতেন নরমাল দিনে।আমার জন্মদিনটা খারাপ করে দেবার কোনো অধিকার আপনার নেই।আপনি একটা খারাপ লোক’

ইমাদ মুচকি হেসে হাতটা বাড়িয়ে পুতুলের পিঠের উপর দিয়ে নিয়ে কাঁধের উপর রাখলো।পুতুল চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে।ইমাদ ওর মুখ দেখছে না।পকেট থেকে ফোন বের করে কাকে যেন কল করছে।পুতুল ওর হাতটা সরাতে সরাতে বললো,’মেজাজ বিগড়াবেন না একদম।কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবো আপনাকে’

ইমাদ ফোন কানে ধরে বললো,’হ্যালো স্যার।গুড নুন।কেমন আছেন?জ্বী আমিও ভালো।আসলে একটা কথা বলার জন্য ফোন করেছিলাম।আপনার জিমেইলের ইনবক্সটা চেক করিয়েন।আমি পাঁচদিনের ছুটির জন্য একটা লেটার সেন্ড করেছি।জানি স্যার ওটা আপনি এমনিতেও দিয়ে দিতেন।তারপরেও রুলস তো রুলসই হয়।ওকে স্যার।থ্যাংক ইউ’

পুতুল ইমাদের হাত সরাতে না পেরে চিমটি কাটলো।
ইমাদের খবর নাই।সে আবার কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিয়েছে।

-‘হাত সরান।নাহলে চেঁচিয়ে কমু এই লোকটা ইভটিজিং করে’

-‘বউকে ইভটিজিং করা অপরাধ?’

-‘অবশ্যই।ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের কেসে ফালাবো আপনাকে।চেনেন আমায়?’

-‘আমি জেলে গেলে আমার মায়ের সঙ্গে থেকো তুমি।জেলে থেকে খিলখিল করে হাসবো তোমার আর মায়ের কান্ড দেখে।বাবা আমায় সব খবর দিবেন টাইম টু টাইম’

নিদারুণ খুনসুটি শেষে অবশেষে তারা সীতাকুণ্ডতে এসে পৌঁছালো।সেখানে এসে বিপাকে পড়লো ইমাদ।হোটেল সাইমুনে যে একটা রুম খালি আছে সেটা হলো ডাবল বেড।পুতুল হাসতে হাসতে মরে যাচ্ছে।ইমাদ শেষে উপায় না পেয়ে সেই রুমটাই বুক করেছে।রুমে এসে পুতুল সামনের বিছানাটায় বসে বললো,’আপনি আর আমি আলাদা।দূরে থাকবেন আমার থেকে”
ইমাদ অন্য বিছানায় বসে বললো,’ইহ!কবে মনে হয় দুজনে এক ছিলাম।ডাবল হলেও কি আর নাহলেও কি।আমরা তো নামে স্বামী- স্ত্রী।আমার স্ত্রীর গায়ে মাথা ঠেকিয়ে রাখলেই যত দোষ হয়।সেই স্ত্রী আবার আমাকে নিয়ে উপহাস করে।বাহ দারুন!’

পুতুল ভ্রু কুঁচকে ইমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো
-‘মানুষটার হলো কি?আমি তো মজা করে বললাম।এই কথাটাকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেলেন।আমার কি দোষ?প্রচণ্ড রাগের সময় যদি কেউ ভালোবাসতে আসে সেটা তো বিফলে যাবেই।আমার জায়গায় অন্য মেয়ে থাকলে ধরে ঝাঁটাপেটা করতো।হুহহ!!আর সেখানে উনি আমাকেই দোষ দিচ্ছেন।জানি তো।সব ইচ্ছে করে করেছে।জীবনে কোনোদিন আমার হাত ধরলো না।আর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যেদিন আমার মেজাজ চড়গ গাছে ছিল ঠিক সেদিনই তিনি আমায় ছুঁতে গেলেন।বুঝি না আমি এসব??’

ইমাদ লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে।পুতুল বিছানায় গোল হয়ে বসে ইমাদকে দেখে যাচ্ছে।এরপরে কি মনে করে তার বিছানার উপরে থাকা একটা কুশন নিয়ে ইমাদের দিকে ছুঁড়ে মেরে বললো,’এখন আসেন না কেন?’

ইমাদ পুতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,’কেন আসবো?তোমার রাগ হয়েছে আবার?’

-“তার মানে শুধু রাগ হলেই আপনি আসবেন আমার কাছে?’

-“সম্ভবত হ্যাঁ।তবে এখন মনে হচ্ছে রাগ হলেও তোমার কাছে যাওয়া উচিত না।তুমি একটা অবুঝ মেয়ে।হুদাই সব উল্টাপাল্টা বোঝো।সুতরাং, আমি ঠিক করেছি এমনি- ওমনি কিছুতেই তোমার কাছে যাব না’

-‘যাইয়েন না! আই মিন আসিয়েন না।আমার বয়ে গেছে আপনার পথ চেয়ে বসে থাকতে।শুনেছি সীতাকুণ্ডতে সুন্দর সুন্দর ছেলে থাকে।একটা চয়েজ করে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে নেবো, বেশ হবে’

ইমাদ আরেকদিকে ফিরে শুয়ে বললো,”দেখো আবার! ঐ ছেলে তোমাকে পেয়ে বিয়ে করতে না ভুলে যায়”

-“ভুলবে কেন?আমি মনে করিয়ে দেবো। আমাকে বিয়ে করতে’

-‘তার মনে আসলেও বিয়ে করার ব্যাপারটা ভুলে থাকার চেষ্টা করবে সে। যাও দরজা তো লক নেই’

পুতুল ও শুয়ে পড়লো বিছানায়।পুতুলের নিরবতা দেখে ইমাদ মাথা ঘুরিয়ে বললো,’কি হলো।যাবে না? সুন্দর সুন্দর ছেলেরা অপেক্ষা করছে তো”

-‘যাব না।”

ইমাদ শোয়া থেকে উঠে বসলো।পুতুল কানে আঙ্গুল দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।মিনিট পাঁচেক পর নিজের কপালে কারোর চুমুর স্পর্শ অনুভব করে পুতুল চোখ খুলে লাফ দিয়ে উঠে বসে গেলো।সামনেই ইমাদ বসে আছে।
চলবে”

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৩১
Writer-Afnan Lara
.
-‘কিছুক্ষন আগে যেটা ঘটলো সেটার মূল হোতা কি আপনি নাকি আমার মনের ভুল ধরে নিতাম?’

ইমাদ হালকা কেশে বারান্দার দিকে চলে গেছে।যেন সে এর কিছুই জানে না।পুতুলকে ভুল প্রমাণ করতে চায় সে।বোকা বনে গিয়ে পুতুল কপালে হাত দিয়ে ওর চলে যাওয়া দেখলো।
-‘ছেলেটাকে আমি বুঝতে পারি না।কখনও বৃষ্টির সময়টাতে মন খারাপ থাকলে রাগ ভাঙ্গায়,তো কখনও বকা দিয়ে পুনরায় মন খারাপ করায়।আবার মন চাইলে ছোঁয়,মন চাইলে দূরে দূরে থাকে।সেকি আমায় পছন্দ করে?নাকি ভালোবেসে ফেলেছে?
না কি ধরে নিতে হবে সে প্রেমে পড়েছে।কিন্তু অনেক প্রেমে তো ভালোবাসা থাকে না।প্রেম আর ভালোবাসার সংজ্ঞা তো আলাদা আলাদা।আবার সেই দুটো শব্দ একই ভাবে মিলতে পারে যদি এই প্রেমেটা শুদ্ধ হয়।আমার আর উনার প্রেম কি শুদ্ধ?
আমরা বিবাহিত।এই সেই শুদ্ধতা নয়।এটা হলো প্রেমে কোনো খুঁত না থাকার শুদ্ধতা।এসব সঠিক করে বলতে পারবেন উনি নিজেই।’

এতসব ভাবতে ভাবতে পুতুল ইমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।ইমাদ হাতটা রেলিংয়ের উপর রেখেছিলো।পুতুলও হাত রাখলো তার ঠিক পাশে।তবে ছোট আঙ্গুলটাকে ইমাদের আঙ্গুলের সাথে মিশিয়ে।ইমাদ খেয়াল করেছে তাও চুপ হয়ে আছে।পুতুল ইমাদের অনুভূতি প্রকাশের অপেক্ষাতে ওর মুখের দিকে চেয়ে ছিল।কিন্তু ইমাদের বিন্দুমাত্র নড়াচড়া না দেখে সে এবার খোঁচাই মেরে দিলো নিজের নখ দিয়ে।ইমাদ হাতটা সরিয়ে অন্যদিকে ফিরে দাঁড়িয়েছে এবার।পুতুল কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’এই যে?’

সে কিছু বলছেনা দেখে পুতুল এগিয়ে এসে পা উঁচু করে ইমাদের মাথার চুলে মুখটা ডুবিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলো।ইমাদ মাথায় হাত দিয়ে পেছনে তাকালো।পুতুল নিরুদ্দেশ। এটা এক প্রকার প্রতিশোধ ছিল নাকি সত্যি সত্যি এটা করতে মন চেয়েছিল তার সেটা ভেবে মাথায় রেলগাড়ি ঘুরপাক খাচ্ছে ভীষণ দ্রুত গতিতে।দূর থেকে খনিকের জন্য একটা হালকা শীতল হাওয়া উড়ে এসে গায়ে লেগে আবার চলে গেলো।সেই ভালোলাগাটাকে সুন্দর করে অনুভব করাতেই বুঝি হাওয়াটার আগমন ঘটেছে।ইমাদের ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটেছে।
-‘মেয়ে মানুষ অল্প কিছু দিয়েই খুশি করতে জানে।তাদের সেই অল্প কিছু সেই সব মানুষদের কাছে শ্রেষ্ঠ যারা মেয়েটার মূল্য বোঝে।মূল্য বুঝতে বেশি কিছুর প্রয়োজন হয় না।সেই মেয়েটাকে নিজের মন দিয়ে দেখতে হয়।আমি হয়ত ওকে মন দিয়েই দেখেছি তাই বুঝি ওর ছোট ছোট কাজগুলো আমার এত ভালো লাগে।’

পুতুল ঘড়িতে চোখ রেখে দেখলো বিকাল চারটা বাজে।অথচ তাদের এখনও লাঞ্চই করা হয়নি।
-‘দুপুরের খাবার না খেলে চলে কিন্তু যখন মনে আসে দুপুরের খবার খাওয়া হয়নি,অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে তখন নিজেকে রোগা অসহায়,ক্ষুধার্ত মনে হয়।শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেলাম ওরকম!ইমাদকে ডাকবো?না থাক।কিছুক্ষন আগে যা করেছি তাতে উনার সামনে যাওয়া ঠিক হবে না মোটেও।গেলাম উনি কি করেছেন তার কৈফিয়ত নিতে আর ফিরে এলাম নিজের মাথায় কৈফিয়ত চেপে।এবার উনি আসবেন আমার থেকে কৈফিয়ত চাইতে।আমি আস্ত একটা গন্ডার।ঐ যে কাদায় লুটোপুটি খায় ঐ গন্ডার আমি’

-‘কাকে কি বলছো ওমন দাঁতে দাঁত চেপে?’

-‘না কাউকেই না।কিছু খাবেন না?আমাকে না খাইয়ে রাখতে আপনার ভাল্লাগে?’

ইমাদ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করে ওয়ালেটটা নিতে নিতে বললো,’কাল রাতে কম আকুতি -মিনতি করিনি খাবার খাওয়ার জন্য।আর কি করার ছিল আমার?যে ইচ্ছে করে খেতে চায় না তাকে কি আর খাওয়ানো যায়?’

-‘তো আমি এখন খেতে চাচ্ছি।খাবার আনুন নাহলে শ্বশুর মহাশয়কে ফোন করে জানিয়ে দিবো ‘

-‘বিচার দেওয়ার হুমকি দিতে হবে না।আমি এমনিতেও খাবারের অর্ডার দিতে যাচ্ছিলাম।এই রুমটাতে একে তো দুজনের সিট আলাদা আলাদা।এরপর দুজনের ঝগড়া লাগলে যে হেল্পলাইনে কল করে শান্তি চাইবো তার ও উপায় নাই।মিসিং ল্যান্ডলাইন।সেটা নিয়েও কথা বলে আসবো।তুমি বসে থাকো।এই মিনি সাইজের টিভিটা চাইলে দেখতে পারো।আমার আসতে তেমন সময় লাগবে বলে মনে হয় না।নিচ তলাতেই ম্যানেজারকে পেয়ে যাবো’

পুতুল মাথা নাড়িয়ে রিমোট হাতে নিয়ে বসলো।ইমাদ চলে গেছে।সাড়ে চারটা বাজছে ইমাদের আসতে আসতে।অবশ্য এটা পুতুল খেয়াল করেনি।টিভিতে একটা কার্টুন দেখায় মনযোগ দিয়েছিল সে।কার্টুনটার নাম ‘ডোরা দি এক্সফ্লোরা’
ডোরা মেয়েটা দর্শক কিছু বলা অবধি জিজ্ঞেস করতেই থাকে! করতেই থাকে।তো এই বিষটা বিনোদন আকারে নেয় পুতুল।কোনো বাচ্চা হলে স্বাভাবিক ভাবে ডোরার সঙ্গে হ্যাঁ হ্যাঁ করতো।পুতুল ছোটবেলায় তেমনটাই করতো।
দরজায় নক শুনতে পেয়ে রিমোট রেখে এসে দরজা খুললো সে।ইমাদের হাতে নেটের ব্যাগে দুটো প্যাকেট।তার সাথের আবার পানির বোতল ও আছে।পুতুল ব্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,’খাবার ওরা পাঠাবে না?’

-‘যে মেনু দেখলাম ওটা তুমি খেতে না আমার জানা আছে। তাই নিজেই অন্য হোটেল থেকে কিনে আনলাম’

-‘কি মেনু ছিল?’

-‘আসলে হলো কি।আমাদের কপাল খারাপ।চিকেন তারা আজ বানিয়েছিল সেগুলো শেষ।রাতের জন্য আবার বানাবে।আর এখন বিকাল।মাছ পেয়েছি পাবদা আর শিং।ওগুলো তুমি খাও না।আমিও কম খাই।আর আছে ডাল।বাকি সব শেষ।তাই আর কি করার’

-‘পাবদা মাছ আমি একটুও খাই না।তবে কখনও টেস্ট করা হয়নি।ঐ যে মাছের চামড়া দেখে আর খাইতে মন চায় না।একবার বাসায় মা মধু -পাবদা রেঁধেছিল।আমি সেদিন দুপুরে ডিম,রাতে ডিম ভেজে খেয়েছিলাম।মাকে বলেছিলাম মাছের সঙ্গে আলু দিতে।তাহলে ঝোল আলুই মিলিয়ে খাওয়া যাবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা।মা বাবার মন রাখতে মাছের ঝোল বানিয়েছিল শুধু।’

-‘তোমরা এত বড়লোক মানুষ।দুপুরে এক পদ দিয়ে খাও?’

-‘আরে সাথে ডাল ছিল।তাও কোন ডাল?ফেলন ডাল।আমার মন চাইছিলো বাসা থেকে চলে যাই’

-‘হাহা!সেই চলে তো গেলাই।বসো এখন।সবটা খাবে।না খেয়ে না খেয়ে আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছো তুমি’

-‘আমি শুধু কাল রাতে খাইনি।আপনি না খেয়ে না খেয়ে ট্যাগ লাগালেন কেন?’

-‘তোমার সাথে তর্কে যেতে শক্তি প্রয়োজন।আগে খেয়ে নিই তারপর আবার লজিক দিয়ে তর্ক শুরু করবো কেমন??’

-‘তর্কর কোথায় মনে পড়লো আমি ক্লাস টেনে থাকতে স্কুল থেকে তর্ক/বিতর্ক অনুষ্ঠানে আমাদের দল জিতেছিল তাও আমার কারণে।’

-‘আরেহ্ বাহ।দারুণ খবর।তাই তো বলি আমার নিজেকে বিপক্ষ দল কেন মনে হয় বারবার।এবার খাওয়া শুরু করুন প্লিজ’

পুতুল ভেংচি কেটে খাওয়া শুরু করেছে।ইমাদের খাওয়া ওর আগেই শেষ হয়েছিল বলে সে বিশ্রাম নিতে শুয়ে পড়েছে তার বিছানায়।পুতুল হাতটা ধুয়ে এসে ইমাদের গভীর ঘুম দেখে ভাবলো,’কিছু কিছু মানুষের জীবন কত সহজ।যখন শুয়ে পড়লো তখন চোখ জুড়ে ঘুম নেমে এলো।আবার যখন উঠতে মন চাইলো চোখ খুলে উঠে বসলো।আর আমাদের দেখো।চোখের পাতা রাতের দশটায় বন্ধ করলেও সেটাতে ঘুমের একশান আসতে রাত ১/২টা বেজে যায়।
মাঝে মাঝে ভোর রাত ও হয়ে যায়।আবার সকালেও চোখ খুলতে চায় না।এই মানুষটার থেকে কিছু টিপস নিতে হবে।কি করে মনমত ঘুমানো আর ঘুম থেকে ওঠা যায়।অবশ্য উনি যেমন লোক।সোজা কথায় বলবেন,’আমার মত করে চোখ বন্ধ রাখো দেখবে ঘুম এসে গেছে’
আচ্ছা! একবার জিজ্ঞেস করে দেখি কি বলে।’

পুতুল বিছানা ছেড়ে ফ্লোরে পা রেখে জুতো খুঁজে বের করলো।সেটা পায়ে পরে পা দুটোকে নাড়িয়ে চাড়িয়ে ইমাদের বিছানায় গিয়ে আবার ধপ করে বসে পড়লো।যেন তাকে সোজা হয়ে একবারও দাঁড়াতে হয়নি।বসা অবস্থায় স্থান পরিবর্তন হয়ে গেছে।এমনটা কজনে পারে??
-‘শুধু তারাই পারে যারা আমার মতন আলসেমি দলের প্রধান।এই যে??আপনি কি ঘুমাচ্ছেন?’

-‘না।গুনছি কইটা ভেড়া এলো আর কয়টা ভেড়া গেলো’

-‘সবেমাত্র হালকা করে নাক ডাকার আওয়াজ পেলাম।ঐ যে ফুুুউউউউউউসসসস ফুরফুউউউউউসসসস’

-‘তোমার বার্মিজ জুতোর সাথে টাইলসের খসখস আওয়াজ আমার স্বাদের ঘুম শেষ করে দিয়েছে।’

-‘আমি তো হাঁটলামই না।আওয়াজ পেলেন কি করে?’

-‘জুতা পায়ে ঢুকিয়ে টাইলেসের সাথে ঘষাঘষি করোনি তুমি?’

-‘ওহ।সরি সরি।যা বলতে এসেছিলাম।আপনার এরকম হুটাহাট ঘুমিয়ে পরার টেকনিকটা আমায় শিখিয়ে দেবেন?’

ইমাদ চোখ বন্ধ রেখে বললো,’আমার মত করে চোখ বন্ধ রাখো, দেখবে ঘুম এসে গেছে’

-‘জানতাম এটাই বলবেন।আরে ওভাবে যদি ঘুম আসতো তাহলে মানুষ ডাক্তারের কাছে যেতো না।গাদা গাদা ঔষুধ খেতো না।স্লিপিং পিল ইনভেন্ট হতো না।নিব্বা- নিব্বি ঘুমের ঔষুধ খাওয়ার ভয় একে অপরকে দেখাতো না’

-‘ওগুলো তোমাদের জন্য তৈরি হয়েছে।আমার মতন সুস্থ সবল,সহজেই ঘুমিয়ে পড়া মানুষদের জন্য এগুলো আসেনি।বুঝলে?আর এখন কি ঘুমাবার সময়?বিকাল পাঁচটা বাজে এখন।
চাইলেও তো এখন ঘুম আসবে না তোমার’

পুতুল কপাল কুঁচকে বললো,’তাহলে যে আপনি দিব্যি শান্তিতে ঘুমাচ্ছিলেন সাথে নাক ডাকাও ফ্রি ছিল’

-‘আমার সাথে নিজেকে মেলাবা না।আমি সকালে রুটি খাই তিনটা আর আরেকটার অর্ধেক।তুমি খাও শুধু অর্ধেক।আমি এগারোটার দিকে আবার মুড়ি, চানাচুর খাই, তুমি সেসময়ে টইটই করে ঘুরে বেড়াও।আমি দুপুরে দু প্লেট ভাত খাই আর তুমি এক প্লেট মাটিতে শুয়ে শুয়ে খাও।বসে খাও।গড়িয়ে গড়িয়ে খাও,কেঁদে খাও।বিকালে….’

-‘আর বলতে হবে না।আপনি বুঝাতে চান আমি খাওয়া- দাওয়া বেশি বেশি করে করলে ভালো ঘুম হবে?’

-‘অনেকটা সেটা না।বেশি খাওয়া আবার স্বাস্থ্যের জন্য হানিকারক।যেটা একচুয়েল রেট সেটাই খাবে।যতটা তোমার প্রয়োজন।বেশি খেলে তোমাকে ঘুমের রাজ্য থেকে আমি টেনেও ফেরাতে পারবো না।মা আমাকে ইচ্ছামত বকবে সারাদিন। সেই বকুনিটা শুনার অবস্থাতেও থাকবে না তুমি।কারণ তুমি তো সেময়ে ঘুমিয়েই যাবা!ঘুমিয়েই যাবা’

পুতুল আর ইমাদের সঙ্গে তর্কে যায়নি।একটা কথা মাথায় ভয় জাগাচ্ছে।ইমাদ ওর থেকে বেশি তর্ক জানে না তো?
-‘তাহলে ভবিষ্যতে আমার বাচ্চারা কি বলবে?ওরা বলবে বাবা মায়ের চেয়েও ভালো লজিক দিয়ে কথা বলতে জানে?তখন আমি মুখ কোথায় লুকাবো?না না এটা হতে পারে না।অবশ্য উনি তো তর্কের জন্য আর পুরস্কার পাননি কোনোদিন।আমি তো পেয়েছিলাম।বাসায় কোথায় যেন রেখেছিলাম এওয়ার্ডটা।মনে আসছে না।ওহ হ্যাঁ এওয়ার্ডটা তো স্যাররা রেখে দিয়েছিল।ইশ!!এবার ইমাদ আর আমার কথায় তফাৎ রইলো না।আমি প্রমাণ করতে পারবো না যে আমি এওয়ার্ড পেয়েছিলাম।ধুর!
আমার কথার কোনো প্রমাণ থাকলো না।সেদিন আমার বিপক্ষ দল ছিল আঞ্জুমানের দল।ওর নাম্বারটা যদি পেতাম তাহলে সেদিনের তোলা ছবি পাওয়া যেতো!!
আচ্ছা এত কিছু না করে কলেজেও তো যেতে পারি।সেখানে নিশ্চয় পাবো?গুড আইডিয়া!ছেলেমেয়েদের বিশ্বাস করাতে আমার ঐ ছবি লাগবেই’

এবার পুতুল ইমাদকে বললো তাকে নিয়ে বাহিরে থেকে ঘুরে আসতে।যেখানে ইমাদ যাবে বলেছিল ওগুলোতে কাল ছাড়া যাওয়া সম্ভব হবে না।কারণ এখন রাত হয়ে গেছে।তাই আপাতত হোটেলের সামনের পথটা থেকে ওকে ঘুরিয়ে আনবে বলে ঠিক করলো ইমাদ।
চলবে””