বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৩২
Writer-Afnan Lara
.
ফাঁকা রোড ভেবে ঘুরতে এসেছিল দুজনে।এখন মনে হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম মাছ বাজারে তাদের আগমন ঘটেছে।এত এত মানুষ দেখে পুতুল রাগে কটমট করতে করতে ইমাদকে এই নিয়ে ২৪বার দেখলো।ইমাদ চমকিত চোখে পুরো বাজার দেখছে।ভেবেছিল কি আর হয়ে গেলো কি।পুতুল এবার ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,’এই আপনার সরু মেঠো পথ?আমাকে নিয়ে মজা করতে এসেছেন?’
ইমাদ মাথা চুলকে বললো,’মজাই তো করতে এসেছি।ঘুরতে এসেছি।হাওয়া খেতে।’
-‘মাছ বাজারে আমাকে হাওয়া খাওয়াতে এনেছেন আপনি?’
-‘তুমি বিশ্বাস করো।এখানে আমি মানুষদের সমাগম একেবারে দেখিনি তাই তো নিয়ে এলাম।আমার কি দোষ বলো!’
-‘আমি কিছু জানি না।আপনি এখন আমাকে একটা সুন্দর জায়গা থেকে ঘুরিয়ে আনবেন তা নাহলে আজ আপনার একদিন কি আমার চৌদ্দ; পনেরো দিন লাগে!’
ইমাদ পড়েছে মহাঝামেলায়।নিজেকে নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না।কিছুক্ষন আগে দেখে যাওয়া ফাঁকা নির্জন রোডটাতে কিনা এখন মানুষ ধরছে না,উপচে পড়ছে??
চমকিত চোখ তার এবার গোল গোল হয়ে গেলো।মুখে মিষ্টি হাসি দিয়ে সে পুতুলের দিকে তাকালো।পুতুল এতক্ষণ ওর জবাবের আশায় চেয়ে ছিল।
-‘বলছি কি!মাছ বাজারে এসেই যখন পড়েছি তখন আমাদের উচিত এটাকে ইঞ্জয় করা।যে পরিস্থিতিতে মানুষ পড়ুক না কেন,তাকে সেটা উপভোগ করা উচিত’
-‘উপভোগ করারও একটা লিমিট থাকে।আপনি আমাকে সীতাকুণ্ড কাঁচাবাজরেই নিয়ে এলেন।কেমন হাসবেন্ড আপনি??”
ইমাদ চোরের মতন দু পা সরে দাঁড়িয়ে পথচারী একজনকে থামালো।এরপর ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো এখানে আশেপাশে ঘুরার কোনো জায়গা আছে কিনা।পনেরো- দশ মিনিটের জন্য ঘুরে মন ভলো হবে এমন।লোকটা জানালো এখানে একটু পেছালেই সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের অফিস পড়বে।সেটার ঠিক বিপরীত পাশে একটা বিরাট দিঘি আছে।সেটার নাম ‘লাল দিঘি’
ইমাদ লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পুতুলের কাছে ফিরে এলো।পুতুলের হাত মুঠো করে ধরে বললো,’চলো তোমাকে পানি দেখাবো।সবুজ পানি’
-‘সেটা কি?’
-‘চলোই না।গেলেই দেখতে পাবে।’
ইমাদ পুতুলের হাত ধরে হেঁটে চললো।লোকটার কথামতন কুরিয়ার অফিসের সামনে এসে থামলো দুজন।এরপর রাস্তার ওপারে সেই দিঘিটা দেখতে পেলো ওরা।পুতুল খুশি হয়ে বললো,’এখানে বসলে মন ভালো হয়ে যাবে।চলুন ওদিকেই যাই’
ইমাদ তাই করলো।ওকে নিয়ে সেই দিঘিটার কাছাকাছি আসলো।পুতুল একটা সুবিধামতন জায়গা দেখে বসেছে।ইমাদ পাশের একজন ঝালমুড়িওয়ালা থেকে ঝালমুড়ি আনতে গেছে।এতক্ষণ বাজার দেখে পুতুলের যে মেজাজ গরম হয়েছিল এখন তার বিন্দুমাত্র ও আবেশ নেই।সব গলে পানি হয়ে গেছে।তারপর দিঘি।ইমাদকে বেশি বকেছে মনে করে পুতুল নিজেই নিজেকে দোষারোপ করলো।ভাবছে ইমাদকে সরি বলে দেবে।
—
-‘মামা ঝাল ছাড়া ঝালমুড়ি দেন’
-‘তাহলে কি শুধু মুড়ি দেবো?’
-‘আপনি কোন ঝালমুড়ি বানান?ঐ যে চানাচুর মিক্স করে দেয় না আমি ওগুলোর কথা বলছি।জাস্ট মরিচ দিবেন না’
-‘আমার ঝালমুড়িতে কাঁচামরিচ, সরষে তেল,পেঁয়াজ আর সাথে মুড়ি দিই।তো মরিচ বাদ দিলে সরষে মেখে পেঁয়াজ সহ মুড়ি দেবো নাকি?’
-‘ওমা!এটা আবার কেমন ঝালমুড়ি।আচ্ছা মরিচ ছাড়া শুধু সরষে তেল,পেঁয়াজ মেখে মুড়িই দেন।কি আর করার’
মামা স্টিলের একটা ছোট্ট বক্সের ভেতর মুড়ি আর সরষে তেল,পেঁয়াজ দিয়ে ঢাকনা আটকে নাড়ালেন দু মিনিট ধরে তারপর কাগজের কোণ বানিয়ে তাতে মুড়ি ভরে ইমাদের হাতে দিয়ে দিলেন।ইমাদ বিশ টাকার নোট দিয়ে চলে আসলো।পুতুল যে খাওয়া খায় তাই দশটাকার না নিয়ে বিশটাকারই নিলো সে।পুতুলের সামনে ধরে বললো,’নাও ঝাল ছাড়া ঝালমুড়ি’
-‘এত সাদা কেন?চানাচুর নাই?’
-‘জানি না।এই মামা অন্য রেসিপি ফলো করেন।খেয়ে দেখো কেমন’
পুতুল মুখে দিয়ে চিবোচ্ছে।প্রথমে সরষের ঝাঁঝ, পেঁয়াজের কাঁচা স্বাদ, মুড়ির কড়েমড়ে আওয়াজে বেশ লাগলেও পরে যখন ঝাঁঝে চোখের পানি এনে দিলো তখন সে হাতের ঝালমুড়িটা ইমাদের হাতে ধরিয়ে দিলো।এরপর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নাক মুছতে মুছতে পুতুল বললো,’আমার সর্দি হয়নি।আপনি আমাকে এত্ত সরষে মাখিয়ে এটা কি খাওয়ালেন?ঝাঁঝের চোটে মনে হয় মরে যাব।ছোটবেলায় সর্দি বেশি হতো বলো মা সরষে তেল মেখে মুড়ি খাওয়াতো। সর্দি ও চলো যেতো।আর এখন সর্দি হয়নি তাও খেতে হচ্ছে’
-‘আমি ভাবলাম পেঁয়াজ দিয়েছে যখন হয়ত ভালো হবে’
-‘ভালো তো অবশ্যই।বেশ মজার।শুধু ঝাঝটা বেশি।মনে হয় সরষে বেশি পড়ে গেছে’
ইমাদ গালে হাত দিয়ে বললো,’ওহ আচ্ছা আচ্ছা! এবার বুঝলাম।হয়ত মরিচ দিলে সরষে আর মরিচে কাটাকাটি হতো আর টেস্ট টাও ভিন্ন হতো।তাই তো বলি ঝালমুড়িতে মানুষ ঝাল খায়না কেন।আরে ঝাল হলো মেইন।তাই তো এর নাম ঝালমুড়ি।’
পুতুল ছোঁ মেরে ঝালমুড়ি ওর হাত থেকে নিয়ে বললো,’দূরে দোকান দেখা যায়।আমার জন্য মেরিন্ডা এক বোতল আনেন যান।সাথে আইস্ক্রিম ও আনবেন।সদাইপাতি কিছু করতে জানে না।আপনি একেবারে আপনার বাবার মতন হয়েছেন’
-‘আমার বাবা আবার কি করলো?বাবা ও বুঝি সদাই করতে জানে না?কথা সত্য।কিন্তু তুমি জানলে কি করে?’
-‘ডিম আনতো হাতে করে।আমি একবার দেখেছিলাম।হাতে করে ডিম আনা তাও পলিথিন ছাড়া!একবার ভাঙ্গলে নয় টাকা লস!
এটা দেখেই বোঝা যায় সদাই করতে মানুষটি পটু নাকি একেবারে কাঁচা হাত’
-‘আমটা দুজন থাকতাম বাসায়।দিনে দুটো ডিম লাগতো।আবার মাঝে মাঝে লাগতোই না যদি সকালে ভালো নাস্তা রেডি হতো।তাই ডিম কম খাওয়া হতো অনেক সময়।এই জন্য বাবা সচরাচর একসাথে বেশি ডিম কিনতেন না।জানোই তো ফ্রিজে ডিম বেশি থাকলে পানিতে ভাসমান হয়ে যায়।তাই দুটো/চারটে করে কিনতো আব্বু।সাদিকের দোকানে পলিথিন প্রায়ই সময় পাওয়া যায় না বলে বাবা হাতে করে ডিম আনতেন।এবার বলো দোষ কার?’
-‘আপনার।’
-‘আমি আবার কি করলাম?’
-‘আপনার বাবা যখন ঐ দোকানের উদ্দেশ্যে যেতেন,আর আপনি জানতেন ঐ দোকানে জীবনেও পলিথিন পাওয়া যায় না তখন আপনি বাসা থেকে একটা পলিথিন বা ব্যাগ দিতে পারতেন না?বেকুব কোথাকার!’
-‘শুনো!বাবা কখনও বলে যেতেন না যে উনি বাজারে যাচ্ছেন।ধরো তার ফ্রেন্ডের সাথে আড্ডা জমাতে গেলো আসার সময় টুকটাক বাজার করে আনলেন।সেরকম’
-‘হইছে!এবার গিয়ে যা বলছি আনেন।আমার নাকের পানি আটকাচ্ছে না’
-‘সাথে টিস্যু আনবো?’
-‘নাহ থাক।সেই দয়া করতে হবে না।আপনার এ্যাশ কালারের শার্ট আছে না।ওটাতে মুছবো।দেখতে খুব ভালো লাগবে’
-‘ইয়াক!খবিশ’
-‘এই খবিশরে আপনার সারাজীবন সহ্য করতে হবে।ভাবতেই আমার সেই লেভেরের ভাল্লাগছে’
ইমাদ যেতে যেতে বললো,’এই খবিশরে টিস্যু দিয়ে মুড়িয়ে আজীবন রাখবো।তার খবিশিগিরি তার কাছেই থাকুক আর আমার ওয়াইফ হয়ে আমার কাছেই থাকুক।’
কথাটা শুনে পুতুলের মুখে হাসি ফুটেছে।সন্ধার অল্প বাতাসে তার শুষ্ক চুলগুলো একবার দুলে উঠেছে।মুচকি হেসে চুলগুলোকে কানের পেছনে গুজে দিয়ে সে ইমাদকে চলে যেতে দেখলো।শার্টে নাক মোছার কথা মজা করেই বলেছিল।
ইমাদের কিছু কিছু কথা সত্যি মন কেড়ে যায়।
—
কিছুক্ষন পর ইমাদ আবার ফিরে আসলো সাথে করে মেরিন্ডা,টিস্যু আর আইস্ক্রিম।এবার নিজের জন্য ও একটা এনেছে।এরপর পুতুলের পাশে বসে বললো,’নাও।ঠাণ্ডা খেয়ে তোমার নাকের কাঁদানি গ্যাস দূর করো।এমন ঝালমুড়ি জীবনে খাইনি আমি।একেবারে কাঁদিয়েই ছাড়লো তোমায়।জলদি নাও।গলে যাবে।’
পুতুল ইমাদের হাত থেকে আইস্ক্রিম নিয়ে বললো,’আপনার মাকে ফোন দিবেন না?’
-‘আমি দিব না।তুমি দিবে’
-‘কেন?জানেন তো আমি কল করলে আপনার আম্মু রেগে যাবেন।আমাকে তো এখনও মেনে নেননি”
-‘ভুল বললে।মা তোমায় মেনে নিয়েছে শুধু মেনে যে নিয়েছে সেটা মানতে তার কষ্ট হচ্ছে।মা তোমাকে কাল সান্ত্বনা দিয়েছিল মনে আছে?তুমি কল করবা আমি বলছি’
পুতুল মাথা নাড়িয়ে ঢোক গিললো।ইমাদের মাকে ও খুব ভয় পায়।
-‘উনাকে দেখলেই মনে হয় এই বুঝি উনি আমায় ধরে টুপ করে গিলে খেয়ে ফেলবেন।তার এই রণচন্ডি রুপ কবে যে বদলাবে।আর আমার ও ঐ বাসায় থাকতে ভয় দূর হবে।ভালো কথা মনে পড়লো।আচ্ছা শুনেন,আমরা এখান থেকে সোজা কোথায় যাব?’
-‘তমিজ আঙ্কেলের বাসায় আমাদের যে ফ্ল্যাট আছে ওটাতে’
-‘কিন্তু কেন?’
-‘ঐ যে মা পুরোপুরি এসব কিছু মেনে নিক তারপর মা নিজেই এসে আমাদের নিয়ে যাবে।শুধু সময়ের অপেক্ষা’
পুতুলের মুখে হাসি ফুটলো।হেসে হেসে সে নিজের আইস্ক্রিমটা উঁচু করে ধরতেই ইমাদের গালে লাগিয়ে দিলো। ইমাদ কপাল কুঁচকে বললো,’এত খুশি?’
-‘ইশ!একদম দেখতে পাইনি।এই নিন টিস্যু মুছে ফেলুন।আপনাকে দেখতে একেবারে….’
-‘একেবারে?’
-‘উল্লুকের মতন লাগছে।মাইন্ড খাইয়েন না।আচ্ছা আমিই মুছে দিচ্ছি।আসলে এত খুশি হয়েছি বলে বোঝাতে পারবো না’
-‘আমাকে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকাতে খুশি তুমি?’
-‘মোটেও না।আমি চাই আমাদের সেই বাবুই পাখির বাসাটাকে সুন্দর করে মনের মতন সাজিয়ে আপনার আম্মু আব্বুকে ওখানে এনে রাখতে।কারণ ঐ বাসাটা অনেক বড়।তাই না?’
-‘ভালো বুদ্ধি।কিন্তু জানোই তো মা যেটা ভালো বুঝে সেটাই করে।এখন যদি শুনে তোমার ভাবনা এমন তাহলে রেগে আগুন হয়ে যাবে।কিছুতেই এর ভালো দিকের দিকে নজর দেবে না’
-‘তাহলে আর কি করার।আপনার ঐ ছোট বাসাতেই থাকবো।আমার বাচ…’
-‘বাচ?’
-‘ঐ বাঁচা মরার প্রসঙ্গ কিছু না,এই আর কি!এটাই বলছিলাম’
-‘আমার কেন যেন মনে হলো তোমার এই বাচ দিয়ে বাচ্চা বলা ধরছিলে।বাঁচা-মরা না’
পুতুলের কাশি উঠে গেলো।গলা ঠিক করে সে বললো,’খালি নেগেটিভ চিন্তাভাবনা আপনার।আমি ওসব ভাবতে যাব কেন?আন্দাজে বললেই হলো নাকি?’
-‘সেটাই।একটা বাচ্চা কেন আরেকটা বাচ্চাকে নিয়ে ভাবতে যাবে।সে তো বড়দের নিয়ে ভাববে।বড়দের মতন হতে চাইবে।সে উইশ করবে যেন সে জলদি বড় হয়ে যায়।আরও কত কি!’
পুতুল ভ্রু কুঁচকে ইমাদের মুখটা দেখছে।আসলেই সে বাচ্চাকাচ্চা বলতে গিয়ে আটকে পড়েছিল।ইমাদ পরে ওকে নিয়ে হাসাহাসি করবে বলে তাই ভেবে কথা কেটে দিয়েছিল সে।কিন্তু তাও করে লাভ হলো না।ইমাদ বুঝে গিয়ে এখন কথার রস বের করছে।আজব লোক একটা।মুখ দিয়ে দু শব্দ বের করলেও তার থেকে ডজন খানেক সংজ্ঞা বের করে পেশ করতেই থাকে,করতেই থাকে,কিছু বলাও দোষ হয়ে যায় তখন’
-‘চলো যাই।হোটেলে ফিরে মায়ের সঙ্গে কথা বলবে।তারপর বাবার সঙ্গেও।বাবা কিন্তু তোমায় অনেক সাপোর্ট করে।’
-‘জানি।তাই তো আসার সময় সকালে তার পছন্দের স্ট্রভেরি মিল্কশেক বানিয়ে ফ্রিজে রেখে এসেছি’
-‘সর্বনাশ করেছো’
-‘কেন?’
চলবে”””
বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৩৩
Writer-Afnan Lara
.
-‘মানে বুঝলাম না।আপনার বাবার আমার প্রতি টান দেখে আমি খুশি হয়ে স্ট্রভেরি মিল্কশেক বানিয়ে দিলাম তাতে সর্বনাশ হলো কি করে?’
-‘সর্বনাশ সেখানে না।অন্য খানে।বাবার ফ্রিজের কিছু খেলেই শরীর খারাপ করে।আর মা সবসময় বাবাকে ফ্রিজের খাবার না খাওয়ার জন্য বকতেই থাকে।এখন যদি জানে তুমি বাবার জন্য মিল্কশেক রেখে এসেছো আর বাবা এতক্ষণে সেটা সাবাড়ও করে নিয়েছে তাহলে তুমি শেষ।
কল করে এক গাদা বকা আমার উপর দিয়ে তোমায় শুনাবে’
পুতুল অসহায়ের মতন চেয়ে আছে ইমাদের দিকে।ইমাদের কথাতে বিষয়টা হালকা পাতলা মনে হলেও তার কাছে এটা অনেক বড় একটা বিষয়।
-‘ইশ!কি হবে এখন?তার উপর উনি আমাকে বলেছেন কল করার জন্য।আজকে বকুনি খেয়ে ঘুমাতে যেতে হবে মনে হচ্ছে।’
-‘চলো এখন।মায়ের সাথে কথা বলতে হবে তো।আমি বরং আগে কথা বলে নিবো তারপর তুমি বলবে।ঠিক আছে?রাগ থাকলে আমার উপর দিয়েই ঝাড়ুক।’
পুতুল কিছুটা ভয় থেকে বাঁচলো।নাহলে এতক্ষণ দম আটকে যাবার মতন হাল হয়েছিল তার।
_____
হেটেলে ফিরে ইমাদ মাকে ফোন করেছে।
-‘মা ভালো আছো?আমরা বিকালে এসে পৌঁছেছি’
-‘হুম ভালো’
-‘বাবা কোথায়?কি করছো তোমরা?’
-‘আমি ফ্রিজে একটা মিল্কশেক পেলাম।সেটা খাচ্ছি।আর উনি আমার সামনেই।
বুঝলাম না, তোর বাবা আড় চোখে বত্রিশ বার তাকালো আমার দিকে যেন মিল্কশেকটা তার। আমি তার ভাগের খাবার খাচ্ছি।মনে হয় এটা তোর বউ বানিয়েছে।কারণ বাসায় তো আর কেউ নাই যে এটা বানাবে।তুই তো মিল্কশেক বানাতে পারিস না।বানালে মনে হয় পানির সঙ্গে দুধ।’
পুতুল কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসু চোখে ইমাদের উত্তরের আশায় বসে আছে।ইমাদ যদি চোখ বড় করে তাহলে সে ধরে নেবে মিসেস রওনক রণচন্ডি রুপ ধারণ করেছে।কিন্তু ইমাদ তা করছে না দেখে পুতুল ভাবলো হয়ত এখনও এই প্রসঙ্গে কথা ওঠেনি।ইমাদ কান থেকে ফোন নিয়ে পুতুলকে ধরিয়ে দিলো হুট করে।পুতুল ঢোক গিলে সালাম দিয়ে চুপ করে থাকলো।অনিচ্ছা থাকার পরেও ইমাদের মা কথা বললেন
সালাম নিয়ে তিনিও চুপ করে থাকলেন।পুতুল আস্তে করে বললো,’ভালো আছেন?রাতের খাবার খেয়েছেন?’
-‘হুম সব হয়েছে।আমরা এত দেরি করি না।’
-‘বাবা খেয়েছেন?’
-‘হ্যাঁ খেয়েছে।আচ্ছা শুনো।ঐ মিল্কশেক….’
-‘মা আমাকে প্লিস মাফ করে দেন আমি আসলে….’
-‘বলছিলাম মিল্কশেকটা ভালো হয়েছে।থ্যাংকস্।কিন্তু তুমি মাফ চাচ্ছো কেন?’
পুতুল চোখ বড় করে ইমাদের দিকে তাকালো।
ইমাদ দাঁত কেলিয়ে চেয়ে আছে ওর দিকে।পুতুল খুশি হয়ে বললো,’ওয়েলকাম।বাড়ি এসে আবার বানিয়ে খাওয়াবো’
-‘পুরোপুরি সোনায় সোহাগা হয়নি।চিনি বেশি দিয়ে ফেলছো।এরপর কম দিবে।আর নরমালে তোমার বাবার জন্যও একটা বানাবে।আজকে আমি এই মিল্কশেকটা হাতে নেওয়ার পর থেকে খালি আমাকেই দেখছে।খাদক কোথাকার!আচ্ছা আমার ছেলেকে দাও’
পুতুল ফোনটা ইমাদের হাতে দিয়ে দিলো।ইমাদ কানে ধরতেই মা বললেন,’তেল, মসলা জাতীয় খাবার কম খেতে।চিকেন,বিফ এসব বাদ দিয়ে মাছ জাতীয় খাবার খেতে’
ইমাদ ঠিক আছে বলে ফোন রাখলো।পুতুল খুশিতে পুরো রুমটায় হাত লম্বা করে গোল গোল ঘুরছে।ইমাদ হাত ভাঁজ করে বিছানায় হেলান দিয়ে বললো,’সামান্য কমপ্লিমেন্টে এই অবস্থা?যেদিন মা তোমায় ঘোমটা পরিয়ে বরণ করে নেবে সেদিন জানি কি হয়।দেখার অপেক্ষা করছি’
-‘সেটাও কাছে চলে এসেছে।সারাদিন মিল্কশেক খাওয়াবো ধরে।পটে যাবে।আরও যা পারি সব বানিয়ে খাওয়াবো উনাকে।হিহি”
-‘তার ছেলের যত্ন করো আগে।দেখেছো আমার মাথার মাঝখানে একটা পাকা চুলে উঠেছে।এসব তো খবর রাখো না।সারাদিন শ্বশুর -শাশুড়ি করেই বেড়াও’
-‘বুঝলাম না, আপনার এত কম বয়সে চুল পাকলো কি করে?’
-‘যাদের মাথার বায়ু কড়া তাদের চুল জলদি পাকে।মানে যারা অল্পতেই রেগে যায় তারা”
-‘আপনি অল্পতে রাগেন না।পরিস্থিতি অনুযায়ী রাগেন।আর আমাকে বকেন।’
-এখন বসো চুলটা তুলে ফেলো।আয়নার সামনে দাঁড়ালে এই চুলটাই নজরে আসে সবার আগো।আহারে আমি বুড়া হয়ে গেলাম।’
পুতুল ফোনের ফ্ল্যাশ অন করে হাঁটু গেড়ে বিছানায় বসে ইমাদের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে সাদা চুলটা খুঁজছে।
-‘ভাল্লাগছে।চুল টেনে দিতে পারো যদি বিরক্ত না হও’
-‘আপনার চুলে কি শ্যাম্পু দেন বলুন তো।আমার তো হিংসা হচ্ছে’
-‘আমি সাবান দিই।’
-‘কি সাবান?’
-‘কোনোদিন লাইফ বয়, কোনোদিন ডেটল।যখন বাবা যেটা কিনে আনে।আমরা ওমন বাছাবাছি করি না বুঝলে?’
-‘পেয়ে গেলাম সাদা চুল।ছোটবেলায় নানার সাদা চুল খুঁজে তুলে দিলে একটা সাদা চুলে এক টাকা করে দিতো আমায়।আপনি আমায় এক টাকার কয়েন দিয়েন।প্রাণ ম্যাঙ্গো চকলেট খাবো।’
-‘এক বক্স এনে দিব নাহয়।আচ্ছা এক মিনিট,ঐসময়ে তুমি আমার মাথার চুলে মুখ গুজে আবার ভোঁ দৌড় দিয়ে পালিয়েছিলা কেন?’
পুতুল গোল হয়ে বসে বললো,’তাহলে আমিও জানতে চাই আমি যখন চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলাম আমার কপালে চুমু এঁকেছিল কে?’
ইমাদের এবার গিলটি ফিল হচ্ছে।সে উঠে চলে যেতে নিতেই পুতুল হাতটা ধরে আটকালো ওকে।
-‘উত্তর ছাড়া যেতে দিব না’
-‘রাতের খাবার এনে নিই?’
পুতুল মুখ বাঁকা করে হাত ছেড়ে দিয়েছে।ইমাদ চলে গেছে রুম থেকে।মন খারাপ করে পুতুল টিভি চালালো।টিভিতে কার্টুন দেখার বদলে পুতুল দেখছে একটা রোমান্টিক হিন্দি মুভি।যার নাম হলো ‘বিবাহ’।
অনেক পুরোনো ছবিটা।তবে কাহিনী আর নায়ক-নায়িকার অভিনয় ছিল অসাধারণ।পুতুল যখন মুভিটা দেখা শুরু করেছিল তখন মুভিটা সবেমাত্র শুরু হয়েছে।নায়িকার সাথে এখনও নায়কের দেখাই হয়নি।টানটান উত্তেজনা।বালিশ কোলে নিয়ে পুতুল মনযোগ সহকারে দেখছে।নায়ক নায়িকার প্রথমবার একে অপরকে দেখাটা অনেক স্পেশাল হয়।ইমাদ এসেছে পাঁচ মিনিট পর।পুতুল এখনও খেয়ালই করলো না সেটা।ইমাদ ভেবেছিল পুতুল বুঝি একটু রোমান্টিক হয়ে বসে থাকবে তার অপেক্ষায়।কিন্তু তা না করে উল্টে সে অন্যদিকে মন দিয়ে বসে আছে।
ইমাদ খাবারের প্যাকেট টেবিলের উপর রেখে পুতুলের দিলে তাকাতে তাকাতে বিছানা অন্যাটায় গিয়ে বসলো।
বিজ্ঞাপন আসার পর পুতুলের মাথায় আসলো ইমাদের কথা।সঙ্গে দঙ্গে সে পাশে ফিরে তাকিয়ে দেখলো ইমাদ গাল টাকে চালকুমড়া বানিয়ে টিভির দিকে চেয়ে আছে।পুতুল বুঝেছে ঠিক কি কারণে ইমাদের গালের ওমন হাল।সে তার বিছানা থেকে নেমে ইমাদের পাশে গিয়ে বসলো।ইমাদ হালকা সরে বসেছে। পুতুল আরেকটু ঘেঁষে বসলো।
ইমাদ আবারও সরতে যেতেই পুতুল হাতের নখ দিয়ে খাঁমছে ওর হাতটা ধরে বললো,”ঢং করেন অনেক বেশি।এসে যখন দেখলেন আমি টিভি দেখছি, আমাকে নাম ধরে ডাকা যেতো না?আবার গাল ফুলিয়েও রেখেছে।’
-‘আমি কেন ডাকতে যাব?তোমার কাণ্ডজ্ঞান নেই?’
-“না নেই।’
-‘তাহলে অর্জন করো’
পুতুল নিচের ঠোঁট উল্টে বললো’কি করে?’
_____
বাহিরের ব্যস্ত পথটায় মানুষের সমাগম রাত যত হচ্ছে ততই বাড়ছে।কোলাহল থাকলেও এই হোটেলের রুম অবধি বাহিরের এত যানবাহনের আওয়াজ আসে না।মাথার উপর ফ্যান চলছে।মধ্য গতিতে।আর পুতুল বোকার মতন ইমাদের জবাবের আশায় বসে আছে।ইমাদ দেখলো গাল ফুলিয়ে রেখেও লাভ নেই, পুতুলকে উত্তর না দিলে সে এক পা ও নড়বে না।এদিকে পুতুলের কোনো কথার উত্তর দিতে গেলে গায়ে হিম ধরে লজ্জা কাজ করে।আগে কখনও একটা মেয়ের সঙ্গে এসবে আলাপ জমেনি।সিনথিয়ার সাথে তো একদমই না।তার কাছে এটা একেবারে নতুন।তার আর পুতুলের এক প্রকার এরেঞ্জ ম্যারেজই হলো।দুজন দুজনকে বিয়ের পরে ভালো করে জানছে।
পুতুল হাত দিয়ে চুটকি মেরে বললো,’কি হলো?জবাব দিবেন না নাকি গুগল করতে হবে?”
-‘অর্জন করবা মানে,কোন পরিস্থিতিতে তোমাকে কেমন ব্যবহার করতে হবে সেটা বুঝিয়েছি।সেটা যদি না জানো তার মানে তোমার কান্ডজ্ঞান নাই।শূন্য’
-‘তো আপনি যে এখন খাবার নিয়ে ঢুকলেন।আমার কি আপনার হাত থেকে খাবারের প্যাকেটটা নেওয়া উচিত ছিল?’
-‘বাচ্চাদের মতন কথা বলবা না একদম’
-‘কেন বলবো না?আমাকে যখন বাচ্চা বলেন তখন আমার বাচ্চা বাচ্চা কথা আপনাকে সইতেই হবে।যদি সইতে না পারেন তাহলে আর কোনোদিন বাচ্চা বলবেন না।আমি মোটেও বাচ্চা না’
-‘তো তুমি বড়।তাহলে তোমার কান্ড জ্ঞান নাই কেন সেটা বলো আগে’
-‘কে বলেছে আমি বড়?আমি হলাম মাঝারি ছোটবড়।আপনি যদি এটা না বুঝেন তার মানে আপনারও কান্ডজ্ঞান নেই’
কথাটা বলে পুতুল হাসতে হাসতে শুয়ে পড়েছে।ইমাদ ভ্রু কুঁচকে ওর হাত ধরে ওকে উঠিয়ে ফেললো আবার।
পুতুল হাসার চোটে কিছু বলতেই পারছে না মুখ দিয়ে।তার অট্টহাসিতে ইমাদের মনে হচ্ছে আজকের তর্কে বিজয়ী পুতুল।পুতুলের কান টেনে ধরে সে বললো,’কান্ডজ্ঞান আমার অবশ্যই আছে।’
-‘তো দেখান।কেমন কান্ডজ্ঞান আপনার’
-‘হাসি থামাও আগে”
পুতুল মুখ চেপে চেষ্টা করেও হাসি থামাতে পারছে না।ইমাদ রাগ করে ওর কান ছেড়ে দিলো।পুতুল হাসতে হাসতে ইমাদের গায়ে ঢলে পড়েছে।হেসে হেসে বললো,’অনেকদিন পর এত হাসি আসলো বিশ্বাস করেন!কাউকে তার কথা ফিরিয়ে দিলে এমন হাসি আসে।এতক্ষণ কত কথা শুনাইলেন আমার কান্ডজ্ঞান নাই হ্যানত্যান কত কি বলে।এখন কি হলো?
-‘ঐ দিকে তাকাও’
-‘কোন দিকে?’
-‘যেদিকে মন চায়।আশ্চর্য! আমার দিকে তাকাতে বলিনি।অন্য দিকে তাকাও’
পুতুল টিভির দিকে তাকাতেই ইমাদ তার কাছে এসে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,’তখন কপালে চুমু আঁকার আর্টিস্ট আমি ছিলাম।এখন তার প্রমাণ দেবো’
কথা শেষ করে ইমাদ তার ঠোঁটজেড়া পুতুলের গালে লাগিয়ে আবার সোজা হয়ে বসে পড়লো।পুতুল গালে হাত দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।ইমাদ ঠোঁটজোড়া গুছিয়ে বললো,’আমার কান্ডজ্ঞান আছে।তোমার নাই।এখন তুমি চাইলেও কিছু প্রুভ করতে পারবা না।কারণ অলরেডি লজ্জায় তোমার গাল লাল হয়ে আছে।’
পুতুল গালে হাত দিয়ে তার বিছানায় এসে ধপ করে বসে পড়লো।এরপর ঢোক গিলে বললো,’ভাত খাবো,তারপর ঘুমাবো,সকালে গুলিয়াখালী যাব তারপর আবার ফিরবো এখানে,তারপর….’
-‘রোবট হয়ে গেলে?এমন জানলে কান্ডজ্ঞান আছে কিনা প্রমাণ দেখাতাম না,আহারে বাচ্চাটা ভয় পেয়েছে”
পুতুল রাগী চেখে তাকিয়ে বললো,’কে ভয় পেয়েছে?’
-‘তুমি।রুমে তো আমার মতন সুবোধ বালক ছাড়া আর তোমার মতন বোকা বনে গিয়ে বসে থাকা বালিকা ছাড়া কাউকেই দেখছি না’
-‘আমি মোটেও ভয় পাইনি।কই রোবট হলাম?।এই যে আমি একেবারে ঠিক আছি।ফিট আছি’
-‘তাহলে আমার পাশে এসে বসো।গায়ের সাথে লেগে বসো।সমস্যা কই?’
পুতুল ঢোক গিলে বললো,”না মানে গরম তো।আসলেই কি গরম!!একসাথে বসলে গরম বেশি অনুভূত হয়।গরমকালে কারোরই একসাথে বসা ঠিক না।দূরত্ব মেইন্টেন করে বসা উচিত’
চলবে””