বাবুই পাখি পর্ব-৩৪+৩৫

0
1090

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৩৪
Writer-Afnan Lara
.
বিকালে খাবারটা একসাথে খেয়েছিল তারা কিন্তু রাতের বেলা এসে দুজনে দুদিকে বসে খাচ্ছে।ইমাদ চেয়েছিল পুতুলের সামনা সামনি বসে খেতে কিন্তু পাঁচ মিনিট আগের ঘটে যাওয়া ঘটনায় বিভ্রান্ত হয়ে পুতুল মুখ ঘুরিয়ে বসে গোগ্রাসে গিলে যাচ্ছে তার ভাগের খাবারটা।খাবার শেষ করার পর ইমাদ লাইট অফ করে শুয়ে পড়েছে।
এবার মনে হলো বাহিরে যানবাহন,হাজার হাজার বাতির সমাগম আছে।রুমটা অন্ধকার করার পরই কিন্তু এটা টের পাওয়া গেলো।অথচ এতক্ষণ একবারের জন্য ও মনে হলো না বাহিরে এত গেঞ্জাম।আসলে জীবনে কোনো কিছুর সঙ্গে একেবারে সংপৃক্ত হয়ে গেলে সেটাকে দমিয়ে রেখে ধরুন কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রেখে বাহিরের জগৎটাকে আলাদা চোখে দেখলে বোঝা যায় আমরা আসলে এরই মাঝে থাকি।অথচ টের পাই না।পুতুল বেশ গণিতি ভাবনা চিন্তা করে আস্তে বললো,’আমার খুব ইচ্ছে দুই পরিবার যখন এক হবে সবাই একসাথে লাঞ্চ করবো।খুব ভালো হবে সেটা।পালিয়ে আসায় যে মনমালিন্য তৈরি হয়েছিল সেটা একেবারে নিস্তেজ হয়ে যাবে।খুব ভালো হবে তখন।’

ইমাদ তার মাথার উপর হাত রেখে শুয়েছিল।লাইটটা আগেই সে নিভিয়েছিল বলে পুতুল ভেবেছিল সে বুঝি ঘুমে কাতর।কিন্তু নাহ।সে পুতুলের আস্তে বলা কথাগুলো দারুণ ভাবে শুনতে পেয়েছে।এপাশ করে শুয়ে ইমাদ বললো,’আসো তোমায় একটা কাহিনী শুনাই,কাহিনী না,অনেকটা সত্যি বলতে পারো’

পুুতুল চমকে পেছনে তাকালো ইমাদের দিকে তারপর জিজ্ঞেস করলো সে এখনও ঘুমায়নি কেন।
ইমাদ হেসে বললো,’ঘুমাতে চাইনি তাই ঘুম আসেনি।আমাকে আমার ঘুম নিয়ে বেশি ভাবতে হয় না।সেটা তুমি বেশ জানো’

পুতুল দ্রুত গতিতে হেঁটে ইমাদের পাশে এসে বসলো।ইমাদ ওকে বললো একেবারে শুয়ে পড়তে।গল্প শোনার সময় বসলে সেই অনুভূতি আসে না যতটা না শুয়ে শুয়ে শুনতে গেলে আসে।
পুতুল হাঁটু ভাঁজ করে শুয়ে বললো,’বিছানাটা ছোট’

ইমাদ স্বাভাবিকভাবে বললো,’তো কি হলো?আরেকটু এসো।সমস্যা দেখছিনা।নাকি এটাতেও তোমার মূর্তি হয়ে যাওয়ার প্রকোপ আছে?’

-‘না সেটা নয়।হুট করে কাছে আসা ভালো না।বিচ্ছেদের লক্ষণ।
আস্তে আস্তে একজন আরেকজনকে জেনে নিই তারপর নাহয় কাছে আসা হবে।’

ইমাদ বিরক্ত হয়ে বললো,’আমি সেই কাছে আসা বুঝাইনি।কথা জোরে মাইক লাগিয়ে বলতে পারবো না।
আস্তে আস্তে বলবো তাই কাছে আসতে বলেছি।তোমার যদি শ্রবণশক্তি এতই প্রখর হয় তো আলহামদুলিল্লাহ ‘

-‘নাহ।আসছি।’

পুতুল একটু একটু করে কাছে এসেছে।ইমাদের শার্টের বোতামের উপর তার হাত লেগেছে।ঠিক ততটুকু কাছে তারা।
ইমাদ উপরে ছাদের দিকে তাকিয়ে বললো,’বাবা মায়ের ও এরেঞ্জ ম্যারেজ ছিল’

-‘ও বলতে কি বুঝালেন?আমাদের ও কি এরেঞ্জ ম্যারেজ?আমি এটা নিয়ে বিয়ের পর থেকে ভীষণ ভাবছি।দোটানায় পড়ে গেছি বলতে পারেন।’

-‘তাহলে আমি তোমায় সঠিক জবাব দিচ্ছি। আগে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও। বিয়ের আগে কি আমরা একে অপরকে খুব কাছ থেকে চিনতাম?’

-‘একদমই না’

-‘তাহলে সেটাই এরেঞ্জ ম্যারেজ বুঝলে?আর লাভ ম্যারেজ হলো বিয়ের আগে একজন আরেকজনকে জানা,বুঝতে শেখা,বন্ডিং ভালো,কেয়ারিং আরও হাজারটা ওয়ে থাকে।শুধুমাত্র বিয়ের আগে একজন আরেকজনের নাম জানা আর একসাথে বিকালে চা খেলেই সেটা লাভ ম্যারেজ হয়ে যায় না।যাই হোক যেটা বলতে নিছিলাম ওটাই বলি আগে।বাবা মায়ের বিয়েটা হয়েছিল বেশ অদ্ভুত ভাবে।মানে বিয়ের আগে তাদের শুধু ছবি দেখাদেখি হয়েছে।এমনিতে দেখা হয়নি।বাবা বললো যদি জানত মা এমন রণচন্ডী রুপ নেয় কথায় কথায়, তাহলে তার ছবি প্রথম যেদিন দেখেছিলেন সেদিনই চিবিয়ে গিলে ফেলো বনবাসে চলে যেতেন’

পুতুল কথাটা শুনে খিলখিল করে হাসতে লাগলো।ইমাদ মুচকি হেসে বললো,’আর মা কি বলেছিল জানো?’

-‘কি?’

-‘মা বলেছিল তিনি যদি জানতেন বাবা এমন ঝগড়ুটে,হিংসুক,স্বার্থপর তাহলে বিয়ের দিন থেকে পাক্কা দুদিন ধরে মুগুর ধোলায় দিতো বাবাকে, তাহলে একেবারে সুঁচের মতন সোজা হয়ে যেতো’

পুতুল হাসতে হাসতে বললো,’কেউ কাউকে কখনও মেরেছে?’

-‘নাহ।সেটা করেনি।
তবে মুখ দিয়ে মারামারি তাদের মাঝে প্রচুর হয়।আমি তাদের সব ঝগড়ার একমাত্র সাক্ষী’

-‘আপনি সাক্ষী কি করে হলেন?যখন আপনি জন্ম নেননি তখনকার ঝগড়া কি আর দেখতেন?’

-‘দেখিনি।তবে তখন বাবা মা ঝগড়া করতো না।এমনকি আমি ছোট থাকতে দেখেছিলাম তাদের মাঝে সুমধুর প্রেম ভালোবাসা।আমি ভাবতাম তারা পৃথিবীর বেস্ট কাপল।তাদের একজন আরেকজনের প্রতি এত ভালোবাসা ছিল তোমায় বলে বোঝাতে পারবো না।এরপর আস্তে আস্তে কি থেকে কি হয়ে গেলো।’

-‘আচ্ছা তাদের একে অপরকে বুঝতে কত সময় লাগলো জানেন?’

ইমাদ ভ্রু কুঁচকালো।পুতুল দেখলো না কারণ রুমে ড্রিম লাইট জ্বলছে।তাই সে আবারও জিজ্ঞেস করলো।
ইমাদ হাত ভাঁজ করে বললো,’ভালো হয়ে যাও পুতুল।ভালো হয়ে যাও।তোমাকে আমি অনেক সময় দিয়েছি”

পুতুল বোকার মতন চেয়ে থেকে বললো,’ওমা!সামান্য একটা প্রশ্নই তো করলাম।তাতে ভালো হয়ে যাওয়ার কথা আসছে কেন?আমি তো ভালো সেটা আমিই জানি।তাহলে?’

-‘এত কিছু জেনে তোমার কি হবে?যাও ঘুমাও”

পুতুল ইমাদের বুকের মাঝ বরাবর ধুম করে কিল একটা বসিয়ে দিয়ে বললো,’আপনি তো বললেন কাহিনী শুনাবেন।কই গেলো আপনার কাহিনী?এটা একটা কাহিনী হলো?দুই লাইনে শেষ।আমাকে বড় কাহিনী শোনান।তাহলে ঘুমাবো।’

-‘আচ্ছা তো শোনো।একটা দেশে একটা মেয়ে থাকতো’

-‘আর কেউ থাকতো না?’

-‘আশ্চর্য! কাহিনী বলার সময় তোমাকে কমিটমেন্ট দিতে বলিনি।চুপ করে শুনতে থাকো’।তো ঐ মেয়েটা ছিল পুুতুলের মতন’

-‘আমার মতন?’

-‘তোমার নাম পুতুল।আর আমি বলছি খেলনা পুতুলের কথা’

-‘ওহ।আচ্ছা বলতে থাকুন’

-‘তো ঐ মেয়েটা সারাদিন পুতুল নিয়ে খেলতো।একদিন তার পুতুলটা ভেঙ্গে গেলো।তারপর কি হলো জানো?’

-“কি হলো?’

-‘তার বাবা তাকে আরেকটা পুতুল কিনে দিলো’

-‘ওহহহ্’

-‘ সে আবারও পুতুল খেলা শুরু করলো।একদিন তার পুতুলটা সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে আবারও ভেঙ্গে গেলো।তারপর কি হলো জানো?’

-‘তার বাবা তাকে আরেকটা কিনে দিলো’

-“নাহ।তাকে আর কিনে দিলো না।বললো,’বেয়াদব মেয়ে কোথাকার!একটা পুতুল ঠিকমত যত্ন করতে জানো না।যাও বসে থাকো।মোরাল অফ দ্যা স্টোরি কি জানো?’

-‘কি?’

-‘প্রথমবার যেটা বলছি ওটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকো।বেশি বকরবকর করলে পরেরটা শুনিয়ে কড়া কথা বলে দিব’

-‘আমার না মাথা ঘুরছে।আপনি অনেক পেঁচাইল্লা মানুষ।আগে জানতাম না।জানলে আপনার সাথে বিয়ে হয়েছে শুনে দাঁত কেলাতাম না।সিনথিয়া আপু আপনার সঙ্গে কথা বললে জেলাস হতাম না।’

ইমাদ হাসতে হাসতে শেষ।পুতুল মাথা ধরে মুখটা ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লো।

দশ মিনিট পর ইমাদ পুতুলের ঘাড়ে হাত রেখে আবার সরিয়ে নিয়ে বললো,’পুতুল শুনছো?’

-‘হুম’

-‘আমার না আজ ঘুম আসছে না।শুলেই চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ার রেকর্ডে পোকা ধরেছে মনে হয়।কার নজর লেগেছে খোদা জানে’

পুতুল হেসে ফেললো তারপর হাসি থামিয়ে বললো,’তাহলে কি করতে চান?আবার কোনো কাহিনী শোনাবেন নাকি?আমি শুনতে রাজি।আমারও ঘুম আসছে না’

ইমাদ পুতুলকে হ্যাচকা টানে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বললো,’যদি কখনও মনে হয় তুমি অস্বস্তিতে আছো, প্লিজ আমায় জানাবে।আমি সলভ্ করে দেবো।আমাকে না জানিয়ে নিজের মাঝে কষ্টে চেপে রেখো না।আমার সঙ্গে শেয়ার করলে তোমার মনের ভেতরকার চাপ হালকা হবে।’

-‘এমন কেন বললেন?আমি কি আপনার থেকে কিছু লুকিয়েছি নাকি?’

-‘লুকাওনি।তবে ভবিষ্যতে যেন না লুকাও তাই বলছি’

পুতুল মাথা নাড়ালো কিংবা নাড়ায়নি।ইমাদ সেটা খেয়াল করলো না।পুতুলের নরম আর বেশি তাপমাত্রার হাতটা ধরতেই নিমিষেই ওর চোখে রাজ্যের ঘুম চলে এলো।যখন চোখ খুললো তখন বুঝতে পারলো সকালের আভা সবে শুরু হয়েছে।সূর্য ওঠেনি।ভোরবেলা।হয়ত এখন উঠবে।দেখতে গেলে এতক্ষণে তার মুখ ও দেখতে পাওয়া যাবে।আড়মোড়া ভেঙ্গে ইমাদ উঠে বসলো।নিজের ডানহাতটা উঠাতে যেতেই খেয়াল করলো সে পুতুলের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে।পুতুল মাথাটাকে বালিশের থেকে সরিয়ে খালি বিছানার ওপর রেখেছে।মাথার খোলা চুলগুলো সব তার মুখের উপর এসে মেলা বসিয়েছে।ইমাদ পুতুলের হাতটা সরিয়ে ওর মুখের ওপরের চুলগুলোকে এক টানে সরিয়ে ফেললো।পুতুলের নামের পেছনে হয়ত কারণটা আজ ইমাদ বুঝতে পেরেছে।একেবারে ওকে দেখতে পুতুলের মতনই লাগে।বিশ্বে যেসব মেয়েদের নাম পুতুল দিয়ে শুরু তাদের মা বাবা বুঝি এমন রুপ দেখেই নাম পুতুল রাখতেন।
ইমাদ এবার বিছানা ছেড়ে নেমে বারান্দার সামনের পর্দাটা এক ঝটকায় সরিয়ে ফেললো
দুহাত ভাঁজ করে বারান্দায় পা রাখলো সে।পুতুল নিঃশব্দে ঘুমের ঘোরে কাঁথা টেনে পা খিঁচিয়ে শুয়ে পড়েছে।যত গরমই হোক। সকালে শীত লাগবেই লাগবে।
এই বারান্দা দিয়ে ব্যস্ত রোড,যানবাহন ছাড়া আর কোনো ছাতার মাথাও দেখা যায় না।ইমাদ মুখ বাঁকিয়ে রুমে ফেরত এসে পুতুলের দিকে এক নজর তাকিয়ে গেলো ফ্রেশ হতে।
ফিরে আসার পর দেখতে পেলো পুতুল বিছানার মাঝখানে গিয়ে পুরো বিছানা দখল করে নিয়েছে।তাই আর ঐ বিছানায় না বসে ইমাদ অন্য বিছানাতে গিয়ে নামাজটা পড়ে নিলো।ঘুম যেন পুরোপুরি হয়নি।
আরেকটু ঘুমানো দরকার।ফ্রেশ হলে শুনলাম ঘুম গায়েব হয়ে যায়।’কিন্তু আমার মনে হয় ঘুমই শেষ হয়না।’
চোখ ডলে ইমাদ শুয়ে পড়লো আবার।এরপর পুতুল আগে উঠেছে।তার দেড় ঘন্টা বাদে।ইমাদকে অন্য বিছানায় দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো ওর।সে ভাবলো ইমাদ বুঝি রাতেই আলাদা শুয়েছে।মন খারাপ রেখে মুখ ধুয়ে এসে ঠাসঠুস করে টিভি অন করে বসলো সে।ইমাদ ওর ঠাসঠুস আওয়াজে জেগে গেলো।মাথা তুলে বললো,’কার রাগ কার উপর ঝাড়তেসো?কি করছি তোমারে?’

-‘কি করছেন আমি কি জানি?’

-‘না জানলে এরকম সব ভেঙ্গে ফেলবার মতন করছো কেন?’

-‘আমি এমনেই কাজ করি।ঘুমাননা।এত বকরবকর করেন কেন?’

ইমাদ চট করে উঠে বসলো তারপর মাথার চুলগুলোকে টানতে টানতে বললো,’খোলসা করে বলো তো কি হয়েছে?’

-“আপনার যখন আমার গায়ের সাথে লেগে ঘুমাতে অস্বস্তিই লাগে তো তখন কাল রাতে আমায় পাশে শুতে ডেকেছিলেন কেন?আপনাকে ঠিক বুঝি না আমি’

-‘আমরা সারারাত একসাথেই ঘুমিয়েছিলাম। সকালে নামাজ পড়ে দেখলাম তুমি বিছানায় এক রক্তি জায়গাও খালি রাখোনি তাই’

পুতুল মুখ বাঁকিয়ে টিভি দেখছে।ইমাদ গেলো নাস্তা আনতে।পুতুল মনে করার চেষ্টা করলো।এরপর ওর মনে আসলো ইমাদ তো সারারাত ওর হাত ধরে রেখেছিল।যার কারণে সে নড়তেও পারছিল না।এবার মনে পড়েছে সব।
জিভে কামড় দিয়ে পুতুল ইমাদের অপেক্ষা করতে লাগলো।সরি বলবে বলে।
চলবে”

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৩৫
Writer-Afnan Lara
.
ইমাদ নাস্তা হাতে ফিরে আসার পর এক অদ্ভুত অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেলো।এমনটা এর আগে হয়নি।এখন যে হবে তাও সে ভাবতে পারেনি।
দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই পুতুল ছুটে এসে ওকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে।যেন আর কখনও ছাড়বে না।
বিষয়টা ঠিক বুঝলো না সে।জড়িয়ে ধরবার মতন কোনো ঘটনা তো ঘটেনি?তাহলে পুতুলের এমন কাজের মানে কি দাঁড়াচ্ছে।এতশত ভাবনা মাথায় চেপে ইমাদ হাতে ঝোলানো প্যাকেট টেবিলের উপর রাখলো।এরপর দুহাত দিয়ে পুতুলকে নিজের গায়ের থেকে আলাদা করে বললো,’কি হয়েছে তোমার?’

-‘আমি না ভীষণ খারাপ।শুধু শুধু আপনাকে খোঁচাই,সন্দেহ করি।আর এমন হবে না।মাফ করে দিন প্লিজ।’

-‘ওহ।এই ব্যাপার।মাফ করার প্রশ্ন আসে না।মোট কথা প্রশ্নই ওঠে না।কারণ তোমার কথা আমি গায়ে মাখি না।তুমি তো ছোট।আর ছোটরা কি বলে তারা নিজেরাও জানে না।সুতরাং বড়দের উচিত হয় ঠিক করে তাদের বুঝিয়ে দেওয়া নয়ত তাদের কথায় মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ হ্যাঁ বলে যাওয়া।’

পুতুল চুপচাপ খাবার সার্ভ করতে মন দিলো।ইমাদের কথা এবার সে নিজেই কানে নেয়নি।খাওয়া দাওয়া শেষে দুজনে বের হলো গুলিয়াখালী যাবে বলে।ইমাদের সাথে কথা কাটাকাটি করে শেষে বাধ্য হয়ে থ্রি পিসই পরেছে পুতুল।টিয়া রঙের একটা থ্রি পিস।নিচে দিয়ে পুতির কাজ করা।হাতা দিয়েও কিছু কাজ আছে আর পুরো জামাতে অন্য কোনো ডিজাইন নেই।পুতুলের মায়ের দেওয়া গিফট ছিল এটা
তাও আগের বছর ঈদের।
এখান থেকে তারা একটা সিএনজি ধরে নিয়েছে।
গুলিয়াখালি যেতে বিশ/ত্রিশ মিনিটের মতন সময় লাগবে।বেঁড়িবাধ সড়কেই গুলিয়া খালি সমুদ্র সৈকত।পুতুল সিনএনজির গ্রিলে হাত রেখে বাহিরেটা দেখছে।আসার পথে দুটো নীল রঙের বাড়ির মতন কিছু একটা দেখলো সে।দূরে থাকায় বুঝতে পারলো না ওটা বাড়ি নাকি ফ্যাক্টরি।তারা যে রোড দিয়ে যাচ্ছে তার নাম হাবিব রোড।অনেক বেশি ক্ষেত চোখে পড়ছিল।বেশ কটা সময় নজরে ঐ ক্ষেতই পড়েছে শুধু।ইমাদ ফোন টিপছে।সে নাকি একবার এখানে এসেছিল।বন্ধুদের সাথে।কিন্তু পুতুলের তো এটা প্রথমবার,তাই সে খুঁটে খুঁটে সব দেখছে।প্রতিবার গাড়ীতে চড়ে পুতুল ঠিক করে পথের সব কটা গাছ গুনবে।গুনতে গুনতে যখন গাড়ীর স্পীডের সাথপ হেরে যায় সে তখন অন্য ভাবনায় চলে যায়।এখনও হয়েছে তাই।ক্ষেত দেখা শেষে পুতুল ইমাদের দিকে ঘুরে বসে বললো,’পানিতে নামা যাবে?’

-‘হ্যাঁ।তবে পিছলা অনেক।নামার দরকার নাই।উপর থেকে শুধু দেখবা’

-‘প্লিজ একবার নামবো।আপনি ধরে রাখবেন আমায়।প্লিজ প্লিজ’

সিএনজি চালক বললেন,’আপা নামিয়েন না।ওখানে বৃষ্টির কারণে দাঁড়ানোর জায়গাটাও কাদামাটি হয়ে আছে।এক জায়গায় বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না।তেমন অবস্থা’

ইমাদ হাত ভাঁজ করে বললো,’শুনলে?’
_____
গুলিয়াখালীতে এসে পুতুল ব্যস্ত ছিল ঘুরে ঘুরে সব দেখা নিয়ে আর ইমাদ এক জায়গায় বসে ওর ছবি তুলছিল শুধু।
প্রায় ছাব্বিশটা।পুতুল এটা ওটা দেখতে দেখতে শেষে ক্লান্ত হয়ে ইমাদের কাছে ফিরে আসলো।ইমাদ ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিলো ভালো করে।পায়ে কাদা মাখামাখি করে রেখেছে পুতুল।ইমাদ পকেট থেকে টিস্যু বের করে বললো,’চলো আগে পা ধুবে তারপর মুছবে’

-‘কোথায়?’

-‘পানি আমি ম্যানেজ করবো।এখানে কামাল চায়ের দোকান একটা আছে।ওখানে চা খাওয়া যাবে সাথে তোমার এমন অবস্থার ও উন্নতি হয়ে যাবে’

পুতুল চোরের মতন ইমাদের পিছু পিছু চললো।ইমাদ যদি একটু বকতো তাহলে বুঝি ভালো লাগতো।পরে নিজের কপালে নিজে চড় মেরে পুতুল বললো,’একবার এমন শখ ছিল তার কদিন পর উনি যে বকা দিলেন!! গাধী!! তোর আবার সেই ফিলিংস লাগবে?উফ! আমি এমন কেন!’

চায়ে চুমুক দিতে না দিতেই বাবার কল আসলো।
বাবা জানালেন মায়ের নাকি শরীর অনেক খারাপ।আর এটা সত্যি।এবার নাটক করছে না।ইমাদ চিন্তিত হয়ে পড়েছে।পুতুল ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো ওরা এখন ফিরে যেতে পারে।দেরি না করে গুলিয়াখালিতে চা খাওয়া বাদ দিয়ে তারা হোটেলে ফিরে আসলো।জামাকাপড় গুছিয়ে এক পোশাকে আবার ঢাকার জন্য রওনাও দিয়ে ফেলেছে তারা।
ইমাদ বারবার ফোন করে খোঁজখবর নিচ্ছে মায়ের শরীর কেমন এখন।মায়ের নাকি মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রনা হচ্ছে।চোখের সামনে সব অন্ধকার দেখছেন তিনি।আপাতত বাবা তাকে নিয়ে কাছের একটা প্রাইভেট হসপিটালে এসেছেন।ইমাদ আর পুতুলের আসতে অনেক সময় লেগে গেলো।বাবা মাকে নিয়ে বাসায় ফিরেও এসেছেন।ইমাদ ছুটে গিয়ে মায়ের পাশে যে বসেছে আর একটিবারের জন্য ও নড়েনি ওখান থেকে।
মা ঘুমাচ্ছেন।ডাক্তার নাকি বলেছে উনি বেশি চিন্তা করেন বলে আর মাইগ্রেনের চাপ বেশি ছিল বলে আজ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন গুরুতর ভাবে।পুতুল রান্না করে নিয়েছে আসার পরেই।বাবাকে খেতে দিয়ে সে ইমাদকে ডাকতে গেলো।ইমাদ মায়ের পাশে বিছানায় বসে আছে হেলান দিয়ে।মা ঘুমাচ্ছেন।পুতুল ইশারা করলো ওকে।ইমাদ উঠে এসে বললো,”মায়ের শরীর অনেক খারাপ।কথাও বলতে পারছে না।
আগে কখনও মাকে আমি এরকম সিক হয়ে যেতে দেখিনি।জানি না কি করবো!’

-‘আপনি শান্ত হোন,চিন্তা করবেন না।বাবা ডিনার করছেন।উনার সাথে বসে মুখে কিছু একটা দিন।আসার পর থেকে এক গ্লাস পানিও খাননি’

-‘মায়ের সঙ্গে খাবো।’

কথাটা বলে ইমাদ আবার আগের জায়গায় গিয়ে বসেছে।পুতুল ইমাদের রুমে ফিরে আসলো।রাত বারোটা বাজে।সারাদিনটা কিভাবে শেষ হয়ে গেলো।ভালোভাবে মোটেও শেষ হয়নি।

ইমাদ দেখলো রাত দুটো বেজে গেছে অথচ মা এখনও উঠছে না।বাবা এসে তাড়া দিলো ডিনার করার জন্য তাই বাধ্য হয়ে সে গেলো ডিনার করতে।প্লেট হাতে নিতেই মাথায় আসলো পুতুল খেয়েছে কিনা।প্লেটটা পুনরায় রেখে সে রুমে আসলো পুতুলকে দেখতে।পুতুল শুয়ে পড়েছে। -‘মনে হয় খায়নি।আমার অপেক্ষা করছিল।বাবা বলেছে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে পুতুলেরও খেয়াল রাখতে।জার্নি সেও করেছিল।খালি পেটে রান্নাও করলো অথচ খেলো না।আমার জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে এখন ঘুমিয়ে পড়েছে।এখন আমার খাওয়া মানায় না।কাল ওর সঙ্গেই খাবো নাহয়।এখন সে ঘুমাক।’

ইমাদ মুখটা ধুয়ে এসে পুতুলের পাশে বসলো।পুতুলের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে সেও ঘুমিয়ে পড়েছে একটা সময়ে।সকালে চোখ জোড়া খোলার পর পুতুল খেয়াল করলো ইমাদ ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রেখেছে।সে ঘুরে ওর দিকে ফিরে তাকালো।ইমাদ ওর এত কাছে যে ওর প্রতিটা শ্বাস নিশ্বাস বিন্দু পরিমাণও টের পাওয়া যাচ্ছে।পুতুল ইমাদের হাতটা ওর হাতের ওপর থেকে সরিয়ে নিজে সরতে গিয়ে বুঝতে পারলো তার চুলের বেশ অর্ধেকটা ইমাদের পিঠের তলায় আটকে আছে।চুলের গোড়া মুঠো করে ধরে পুতুল ইমাদকে সরানোর চেষ্টা করছে।এদিকে পেটে খিধে আর ওদিকে ইমাদকে ঘুম থেকে তোলা যাবে না।কাল নিশ্চয় রাত করে ঘুমিয়েছিল।পুতুল তাই ইমাদকে সরানো বাদ দিয়ে চুল টানছে ধীরে ধীরে। ঠিক সেসময়ে মায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো।
মা দরজায় নক না করেই ঢুকে পড়েছেন।পুতুলকে এমন অবস্থায় দেখে চোখ বড় করে তাকিয়ে রইলেন তিনি।পুতুল ইমাদকে চিমটি কেটে জাগিয়ে দিলো ঘুম থেকে।ইমাদ চোখ খুলে বললো,’ঘুমোতে দাও’

মা চোখ বড় করে বললেন,’ওকে জাগাতে হবে না।সোজা হয়ে বসো।এমন ব্যাঁকা হয়ে বসে আছো কেন?’

-‘ঐ আসলে আমার চুল…’

ইমাদ মায়ের গলার আওয়াজ পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসেছে।মাকে দেখে সে ভূত দেখার মতন ভয় পেয়ে গায়ের শার্ট টেনে, চুলগুলো ঠিক করে নিলো।পুতুল ততক্ষণে রুমের বাহিরে চলে গেছে।মা ইমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’ঘুমা।আমি তো তোকে দেখতে এলাম।’

-‘তোমার শরীর কেমন এখন?’

-‘এখন ভালো আছি।ঘুমা তুই’

-‘নাহ,ঘুম আসছে না।আমি বরং গিয়ে নাস্তা নিয়ে আসি বাহিরে থেকে’

-‘কেন?পুতুল বানাবে তো।গেলো না রান্নাঘরে’?

-“নাহ ওকে বানাতে হবে না।আমার এখন খিধে পেয়েছে। ৩০মিনিট ও সইবে না।আমি বরং নিয়ে আসি’

ইমাদ তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে নেমে গেলো ফ্রেশ হতে।
আসলে পুতুলের এখন খালি পেটে নাস্তা বানাতে সমস্যা হবে বলেই সে এখন যাবে বাজার থেকে নাস্তা আনতে।পুতুল আটা ধরতে যেতেই মা এগিয়ে এসে বললেন,’থাক।ইমাদ নাকি বাজার থেকে আনবে খাবার’

পুতুল মাথা নাড়িয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে গেলো রুমের দিকে।রুমে ঢোকার সময় ইমাদের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে গেলো একেবারে বড়সড় ধাক্কা।ইমাদ বুকে হাত দিয়ে বললো,’তোমার মাথার বাড়িতে আমার বুক শেষ।ঝাঁঝরা হয়ে গেলো।ক্ষতবিক্ষত ‘

-“আর আমার মাথা ঠিক আছে তাই না?’

-‘পরে বলছি।
আগে গিয়ে খাবার আনি।প্রচুর খিধা পেয়েছে।তুমি খাওনি বলে আমারও খাওয়া হয়নি”

ইমাদ দ্রুত গতিতে হেঁটে চলে গেলো।পুতুল ওর চলে যাওয়া দেখলো এক চাহনিতে।
মা টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস নিতে নিতে বললেন,’বিয়ের পর ছেলেরা মাস ফুরোলেই বউয়ের জন্য পাগল হয়ে যায় আর আমার ছেলে বিয়ের আগে থেকেই হাফ মেন্টাল হয়ে এখন বিয়ের পরে পাকাপোক্ত পাগলে পরিণত হয়েছে।হায়রে কপাল!’

বাবা ভেতরের রুম থেকে এসে বললেন,’এসব ভাবো বলেই তো তোমার মাথায় এত গেঞ্জাম।গেঞ্জাম ব্লাস্ট হয়ে এখন মাইগ্রেনের ব্যাথা বেশি হয়ে গেছে’

-‘যেটা সত্যি সেটাই বললাম’

-‘এটা সত্যি না।তোমার অসুখের কথা শুনে ওরা দুজনে ছুটে এসেছিল।দুজনের একজনেও এক দানা খাবারও খায়নি।আর তুমি আসছো বলতে ছেলে তার বউয়ের পাগল?’

মিসেস রওনক আর কিছু বললেন না।তার রুমে চলে গেলেন চুপচাপ।পুতুল সব শুনেছে।সেও চুপচাপ বসে আছে বিছানার ওপর।
ইমাদ হোটেলে খাবার প্যাক করার অর্ডার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তখন দেখা হয়ে গেলো মিরাজের সাথে।মিরাজ হলো ইমাদদের বাসার নিচতলার বাসিন্দা। সে খেতে বসেছে।ইমাদ ভ্রু কুঁচকে বললো,’একি মিরাজ?এখানে খাচ্ছো যে?’

-“অফিসে আজ জলদি যেতে হবে,মামা চিকেন লেগ পিস দেখে প্যাক করবেন’

-‘ভাবীর জন্য নিচ্ছো?’

-‘না আমি দুপুরে খাবো।টিফিনে করে নিয়ে যাবো।তোমার ভাবী তো ঘুম থেকে উঠবে দুপুরে, তখন নিজে যা পারে খাবে’

-‘আঙ্কেল আন্টি তো এখন মতিঝিলে থাকে তাই না?তোমার ছোট ভাইয়ের বাসায়? ‘

-‘হুম।’

ইমাদ মিরাজের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
মিরাজের বিয়ের আগে তার বাবা মা ওর সঙ্গেই থাকতো।বিয়ের আগে একদিনের জন্য ও তাকে বাহিরে খেতে হয়নি।বউয়ের আর মায়ের ঝগড়া লাগায় সে মা আর বউয়ের মধ্যে বউকেই চুজ করলো।অথচ তাদের দুজনের সমস্যার সমাধান চাইলেই করা যেতো।আচ্ছা সব পরিবারে কি সেম ঝামেলাই হয়?এটার কি কেনো সমাধান নেই?’

মিরাজ যাওয়ার সময় ইমাদের ঘাড়ে হাত রেখে বললো,’কি ভাবো?’

-‘ভাবছি শাশুড়ি বউমা কি কখনও মা মেয়ে হতে পারে না?’

-‘ভাইরে এটা আমিও ভাবতাম।পরে দেখলাম অসম্ভব ব্যাপার।তাই একটা পথ বেছে নিতে হলো।’

কথাটা বলেই মিরাজ চলে গেছে।ইমাদ ভাবছে অন্যকিছু।
-‘সবসময় সবকিছু আলাদা করে দিলেই তার পরিণতি ভালো হয়না।জোড়া লাগালেই পরিণতি হয় দেখার মতন সুন্দর।আর আমি তাই করবো।আমার মা আমায় ভালোবেসে পুতুলকে অবশ্যই মেনে নেবে এবং সেটা অল্প কয়েকদিনের মাঝামাঝিতে।সেটা করতে যদি আমাদের কদিন আলাদাও থাকতে হয় সেটাও থাকবো।আমি চাই মা বাবার সঙ্গে পুতুলকে নিয়ে থাকতে।’
চলবে”””