বাবুই পাখি পর্ব-৩৮+৩৯

0
1011

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৩৮
Writer-Afnan Lara
.
-‘আবদার।মানে কোনো কিছু চাওয়া,পেতে চাওয়া এবং তার রিকুয়েস্ট করা।আমি তোমায় সেসব দিচ্ছি যা তোমার প্রয়োজন,এখনও দিচ্ছি।মুখ ফুটে বলবা আর আমি তোমার আবদার পূরণ করে দেবো।শুধু মুখের হাসি গায়েব হওয়া চলবে না।মন মরা মুখ দেখতে আমার নিজেরই খারাপ লাগে।বর্ষার দিনে নিজের হাতে বানানো চা কিংবা কফি,শীতের রাতে হাঁসের মাংস,পরোটা,গরমে আমার ফু দিয়ে তোমার মাথার সেই চুল ওড়ানো থেকো আরম্ভ করে কোনো কিছুতেই আমি কমতি দেবো না।শুধু একটা জিনিস তোমার থেকে আমার চাই আর তা হলো….

-‘কি?’

-‘সময় হলে চেয়ে নেবো।এখন উঠো তো।বিকাল জয়টা বাজে খেয়াল আছে?ওহ হো!আজকে তো আর মা বাবা ফিরবে না।চলো কোথাও একটা থেকে ঘুরে আসি’

পুতুল তার ডান হাতটা ইমাদের মুখের সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললো,’দেখলেন?বারবার ভুলে যাচ্ছেন কেন?আমার মুড নাই কোথাও ঘুরতে যাবার। এমনিতে ঘুরতে নেয়না,এখন উনি এসেছেন হাত পোড়ার দিনে ঘুরতে নিতে যাবার কথা বলতে।’

-“ঘুরতে গেলে মানুষের মন ভালো হয়ে যায়।যেমন ধরো তার খুব অসুখ।মনে শান্তি নাই শরীরেও শান্তি নাই।ডাক্তার তার প্রেস্ক্রিপশানে লিখে দিলেন,’হাওয়া বদল’
মানে বুঝলে?হাওয়া বদল করলে তার শরীর এবং মন দুটোই ভালো হয়ে যাবে।এবার প্রশ্ন করতে পারো, মন ভালো হলে নাহয় হবে।কিন্তু শরীর ভালো হতে তো ঔষুধ লাগে।তাহলে আমি বলবো শরীরকে ভালো করতে সব ঔষুধের ওপরে কাজ করে সুস্থ মন।তোমার মনে শান্তি থাকলে অসুখ কিছু না।আমার সাথে ঘুরতে গেলে হাতের জ্বালা কমবে তোমার।গ্যারান্টি দিতে পারি’

-‘উহু!তাও যাব না।ভালো লাগছে না আমার।ঘুম আসছে’

কথাটা বলেই উল্টো দিকে ঘুরে পুতুল শুয়ে পড়েছে।ইমাদ কোমড়ে হাত দিয়ে ভাবছে হুদাই কারে এত ভাষণ দিলো।এক কানে দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছে।
-‘থাক আমার কি!আমার তো ঘুম হয়েছে আর ঘুমাতে হবে না।আমি আমার অফিসের অসম্পন্ন কাজ সম্পন্ন করি বরং।’

গায়ের টিশার্টটা টেনেটুনে ইমাদ চেয়ার টেনে বসলো টেবিলের সামনে।ফাইল সব গুছিয়ে সবার উপরের টা হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টালো এবার।
—–
-‘বুঝলেন রওনক আপা!মেয়েরে যার ঘরে দিচ্ছি তারা বিয়ে হতে না হতেই শুধু বাচ্চার নাম নেই।আরে ভাই, আগে বিয়ে তো হতে দিবি!তা না করে বাচ্চা বাচ্চা করছে।একটু ভাবেন!এত বড়লোকি পরিবার হয়ে কিনা এরকম বিহেভ করছে।আমি শুনছিলাম বড়লোকরা বিয়ের দশ পনেরো বছর পরও বাচ্চার নাম নেয় না,বুড়ো বুড়ো বেটিদের কোলে দুধের শিশু দেখতাম।আর এখন এই পরিবারকে দেখুন’

-‘দিনের সাথে ট্রেন্ড পাল্টায়।কদিন পরে দেখবেন মিডেল ক্লাস ফ্যামিলির মানুষেরা দেরি করে বাবু নেবে আর বড়লোকরা বিয়ে করেই বাচ্চার কথা ভাববে।যখন যেটা চলে আর কি’

-“তো আপনার পরিবারে কি চলে?শুনলাম ইমাদ নাকি সিনথিয়াকে বিয়ে না করে আপনার অমতে এঙ্গেজমেন্টের দিনে অন্য একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুলেছে?’

মিসেস রওনক নড়েচড়ে বসলেন।গালের নিচে হাত দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বিরক্ত ভাব নিলেন কিছুটা।এরপর বললেন,’আজকালকার ছেলে কিনা!
ঐ মেয়ে জাদু করেছে জাদু।নাহলে একটু ভাবেন।আমার চাঁদের টুকরোর মতন ছেলে।জীবনে মুখে বিয়ের নাম ও শুনতে পাইতাম না ওর মুখ থেকে আর সে কিনা হুট করে একটা মেয়েকে একেবারে বিয়েই করে নিলো।তাও আমার অমতে,সিনথিয়াকো বাদ দিয়ে।সিনথিয়ার মধ্যে কি খারাপ আছে আপা আমায় একটু বলেন।আপনি তো দেখছেন ওরে।আপনার ননদের বাসার থার্ড ফ্লোরেই তো ও থাকে’

-“হ্যাঁ আপা।ওর মধ্যে তো কোনো খারাবি নাই।ইমাদ একেবারে ভুল করেছে।পরে পস্তাবে।খুব পস্তাবে’

ইমাদের মা ঢোক গিলে বললেন,’না না।থাক যা হয়েছে হয়েছে।পস্তাইছি আমি, সিনথিয়া।
ওকে পস্তাতে হবে না।যতই হোক আমারই তো ছেলে।বুকে পাথর বিঁধে ঐ মেয়েকে মেনে নিতেই হবে।আজ নয়ত কাল!কিছু তো আর করার নাই।কবুল তিনবার বলেই তো বিয়ে করেছে ‘

-“তা অবশ্য ঠিক।

-‘এখন দেখি বলবো নাতিপুতির মুখ দেখতে চাই আমি।অনেক তো হলো।এবার আমার এই বয়সে আর কি ইচ্ছা থাকতে পারে।শেষ এটাই তো ইচ্ছা বাসার সব রুমে ছোট ছোট পায়ে নাতিপুতি ঘুরে বেড়াবে।’

-‘সেটাই।তবে আপনার পুত্রবধূ যদি মডার্ন হয় তাহলে ঐ স্বাদ অনেক দেরিতে পূরণ হবে আপনার”

-“ওসব কি করে রাজি করাতে হয় আমার জানা আছে।
—–
পুতুল ঘুম থেকে উঠেছিল রাত আটটার দিকে
ইমাদ তখন চেয়ারে বসে ফাইল দেখতে দেখতে রিজবির সঙ্গে ফোনে কথা বলছিল।
রুম অন্ধকার করে রেখেছে সে।শুধু টেবিলের উপরে ছোট্ট লাইট জ্বলছে।পুতুল চোখ ডলতে ডলতে বিছানা ছেড়ে ওর কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ তারপর রোবটের মতন হেঁটে চলে গেলো রান্নাঘরে।ইমাদ সব কিছুকে ওলটপালট করে রেখে দিয়েছে।বাম হাত দিয়ে সব গুছিয়ে রেখে পুতুল এবার গেলো মুখে পানি দিতে।চোখে মুখের ঝাপসা ভাব এখনও যায়নি।ইমাদ ফোন রেখে পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেলো পুতুল নেই।তাই সেও চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছে।এতক্ষণ ধরে কাজ করেছে সে।আড়মোড়া ভেঙ্গে সে রুমের লাইটটা জ্বলালো।পুতুলকে একবার ডাক দিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে গেলো সে।
টিভি অন করতেই কারেন্ট গায়েব।এত বিরক্তি আসলো তার। রিমোট রেখে উঠে দাঁড়াতেই পুতুলের সঙ্গে জোরেশোরে ধাক্কা খেয়ে গেলো একেবারে।পুতুল চিৎকার করে বললো, “আমাকে মেরে ফেলবেন নাকি?’

-অন্ধকারে দেখতে পাইনি।সরি।আমার হাত ধরো দেখি’

-‘কোথায় আপনার হাত?পাচ্ছি না’

ইমাদ আন্দাজ করে পুতুলের হাতটা চেপে ধরেছে। পুতুল অন্যহাত দিয়ে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বললো,’ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমার পোড়া হাতটাই আপনাকে ধরতে হবে?’

-‘ইশ!!সরি সরি’

ইমাদ বারবার ভুল করছে দেখে পুতুলের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এসে চেপে ধরলো ওকে।পুতুল ইমাদর কাছাকাছি এসে বললো,’আমার না ভয় করছে।যদি ভূত আসে?’

ইমাদ পুতুলের বামহাতটা ধরে বললো,’এতক্ষণ এই সুর কই ছিল?আর হুট করে কোথা থেকে উৎপত্তি হলো?’

পুতুল ইমাদের শার্টের লোগোটাকে খোঁচাচ্ছে চুপ করে।ইমাদের মুখে একটা রহস্যজনক হাসি ফুটলো।পুতুলের দুষ্টুমির সংজ্ঞা তার মাথায় স্পষ্টতর হয়ে এসেছে।পুতুলের হাতটা নিজের শার্ট থেকে সরিয়ে ইমাদ আরেকটু কাছে দাঁড়িয়ে বললো,’কি চাও তুমি? ‘

পুতুল অন্ধকারে ইমাদের মুখটা দেখার চেষ্টা করছে।পাশের বাসা থেকে একটুখানি আলো এসে পড়ছে তাও মনে হয় আবছা।এরপরেও ইমাদের ঝলঝল করা চোখ সে দেখতে পেলো।ইমাদের বুকে হাত রেখে বললো,’আপনাকে ‘

ইমাদ কিছু বলার আগেই কারেন্ট চলে এসেছে।পুতুল দূরে সরে দাঁড়ালো।ইমাদ মাথার চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিয়ে বললো,’আবারও বলছি ঘুরতে যাবে?’

পুতুল বললো,’যাব চলুন।কোথায় নিবেন?ঐ জায়গায় গিয়ে যদি আমার ভালো না লাগে আপনার খবর আছে’
—-
ইমাদ পুতুলকে নিয়ে অন্য কোথাও না গিয়ে আসলো ছাদে।পুুতুল ছাদের রেলিংয়ে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে নিচের পথটা দেখছে।অনেক উপরে থেকে নিচে দেখতে অনেক ভাল্লাগে ওর।ইমাদ পুরো ছাদে পায়চারি করতে করতে পুতুলের সাথে কত কথা বলে যাচ্ছে।স্কুল জীবনের একটা ঘটনা বলে নিজে হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যাচ্ছিল।পুতুল চুপ করে নিচের গাড়ী দেখতে দেখতে মাথা নাড়াচ্ছে শুধু।ইমাদ হনহনিয়ে ওর কাছে এসে হাত মুঠো করে ধরে ওকে নিজের দিকে ফিরিয়ে দাঁড় করালো।পুতুল কপাল কুঁচকে বললো,’কি?’

-‘আমার কথা শুনতেছো নাকি? ‘

-“অর্ধেক শুনলাম’

-‘বাকি অর্ধেক?’

-‘ছাড়ুন ওসব।চলুন ফিরে যাই।বললাম না,আপনি আমার মুড ঠিক করতে পারবেন না।ঘুরতে আসলেই মুড ঠিক হবে এটার কোনো ঠিকঠিকানা নাই বুঝলেন?’

কথা শেষ হলো নাকি হয়নি।হয়ত হয়েছে।তা বোঝার দিকে এক সেকেন্ডের জন্য ও পুতুল মাথা ঘামায়নি।তার চোখ অন্য কিছু দেখছে।চাঁদের আলোয় ইমাদের এলোমেলো চুল।সাদা,ঘামে ভেজা চিপচিপে কপাল।আর ইমাদ ওর ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে ফেলেছে অবিলম্বে।এমনটা পুতুল কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি আজ পর্যন্ত।সে বোকার মতন ইমাদের হাতের কব্জির উপর নিজের হাত রেখে দিয়েছে।এরপর কি করার তার জানা নেই।নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ দিচ্ছে বোকার মতন দাঁড়িয়ে থেকে।দু মিনিট পর ইমাদ দূরে সরে দাঁড়ালো।পুতুল এখনও মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে।ইমাদ মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,’অনেক রাত, আই মিন রাত নয়টা বাজে।ডিনার করবো।চলো যাই’
এটা বলে ইমাদ হাঁটা ধরেছে।পুতুল প্রতিদিনকার মতন ওর পিছু পিছু চললো।মাথা কাজ করছে না তার।শুধু হেঁটে চলেছে ইমাদ যেদিকে যায় ঠিক সেদিকে।আর জীবনে মুখ ফুটে বলবে না ঘুরতে আসলে মুড ঠিক হয়না।সে ভুল প্রমাণ করে দিলো।
ইমাদ দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে সোফায় বসে টিভিটা অন করে চুপ হয়ে আছে।পুতুল সোজা হেঁটে চলে গেছে রুমের ভেতর।পাক্কা চল্লিশ মিনিট দুজনের একজনেও কোনো কথা বলেনি।শেষে ইমাদই মুখ খুললো।মাথা বাঁকিয়ে রুমের দিকে তাকিয়ে বললো,’খেতে বসো।আমি খাইয়ে দেবো’

পুতুল ইমাদের কথা শুনে কেঁপে উঠেছে।আয়নায় নিজেকে দেখছিল এতক্ষণ।গলা শুকিয়ে গেছে অনেক আগেই।প্রচণ্ড লজ্জার কারণে সে যেতে পারেনি ডাইনিং অবধি।এদিকে রুমে যে পানির গ্লাসটা ছিল ওটা ফাঁকা।
একেবারে খালি।
এক ফোটা পানিও তাতে ছিল না।পানির তৃষ্ণা অনেক পেয়েছিল কিন্তু তা লজ্জার কাছে হেরে গেলো।রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসছে।ইমাদ মনে হয় খাবার নিচ্ছে।পুতুল মাথা তুলে বললো,’আমি খাব না’

ইমাদ রান্নাঘর থেকে বললো,’তুমি খাবে না তোমার বর খাবে’

পুতুল এবার অবাধ্য হয়ে বললো,’বললাম তো খাব না।আপনি আনবেন না প্লিজ।আমার খিধে নেই’

-‘খেতে হবেই।তখন ঐ কাজটা করায় খাবার খেতে চাচ্ছো না?’

পুতুল চুপ হয়ে গেছে আবার।।কিছু বলছে না।মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকলো।ইমাদ প্লেটে চামচ দিয়ে ওর পাশে রেখে যেতে যেতে বললো,’নিজের হাতে খেতে পারলে খাও নাহলে ডাক দিও।আমি খাইয়ে দেবো’

পুতুল প্লেটটা নিয়ে বাম হাত দিয়ে চামচ তুলে খচরখচর করে দু চামচ মুখে দিতে পেরেছিল।এরপর আর পারছে না দেখে রেখে দিলো।ইমাদ দরজায় হাত রেখে বললো,’কি ম্যাডাম?ইমাদের হেল্প লাগবে না?’

পুতুল চোখ বন্ধ করে দম খিঁচিয়ে বললো,’আপনি প্লিজ যান’

-‘না যাব না।দু চামচ ভাতে তোমার ঔষধ খেলে আরও ক্ষতি হবে।হয় আরেকটু খাও নাহয় আমি খাইয়ে দেবো’

পুতুল তাও না না করছে।এরপর দেখলো ইমাদ ওর সামনে বসে ওরই আঁচল দিয়ে চোখ বাঁধছে।পুতুল অবাক হয়ে দেখছে শুধু।
ইমাদ চোখ বেঁধে প্লেট হাতে নিয়ে লোকমা বানাতে বানাতে বললো,’কি আর করার।খুব খারাপ কপাল আমার।
বউ আমার চোখে চোখ রাখতে ভীষণ লজ্জা পায়।যার কারণে নিজের চোখ নিজে ঢেকে বউকে খাবার খাওয়াতে আসলাম।তাও আমার বউ ভালো থাকুক।’

পুতুল ইমাদের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে।ইমাদ লোকমা সামনে ধরে বললো,’আর কত কষ্ট করতে হবে ?তোমার দিলে কি দয়া হয় না?বিয়ের পর থেকে তোমাকে লজ্জিত হতে বহুবার দেখেছি।আর দেখতে চাই না
এবার একটু ম্যাচিউর হও।
তোমাকে যে ছুঁয়েছে সে তোমার নিজের বিয়ে করা বর।বুঝলে?’
চলবে'””

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৩৯
Writer-Afnan Lara
.
পুতুল নিরবতা পালন করছে।তার মুখে টু শব্দ টুকু নেই।ভদ্র মেয়ের মতন ইমাদের কথাগুলো কানের ভেতর ঢোকাচ্ছে সে। তবে আবার অন্য কান দিয়ে বের করবে না বলেও ঠিক করে রেখেছে।সে ইমাদের কথাগুলো মনে ঢুকাবে।
-‘আসলেই তো।আমি তো ছোট বাচ্চা নই।তাহলে লজ্জায় লাল টমেটো হচ্ছি কেন?হয়ত বা প্রথমবার তাই এমনটা
স্বাভাবিক। তবে বেশি বেশি হলে অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াবে।পুতুল নিজেকে ঠিক রাখ।কন্ট্রোল ইউরসেলফ্।তোমাকে ম্যাচিউর ভাব নিতে হবে।নিতে হবেই।কারণ তুমি ম্যাচিউর।’

ইমাদ ব্রু নাঁচিয়ে বললো,’কি ব্যাপার?ভেতরে ভেতরে আত্নবিশ্বাসে ফেটে যাচ্ছো কেন?দূর্বল রুগীর মতন বসে থাকা মেয়ে কিনা টাইট ফিট হয়ে বসেছে।দারুণ!আমার ভাষণ তাহলে কাজে দিয়েছে।একবার ছুঁয়ে পরীক্ষা করে দেখবো নাকি?’

পুতুল চোখ বড় করে বললো,’আজকের জন্য বাদ দেন।’

-‘খাবারটা শেষ করে ঔষুধ খাবে তারপর দুধ এক গ্লাস খাবে।এতে করে জলদি সুস্থ হয়ে যাবে তুমি’

-‘আপনি এরকম হেলথ্ কনসিয়াস কেন বলুন তো?আমাকে তো দুদিনেই হামটি-ডামটি বানিয়ে তুলবেন ভাত খাইয়ে খাইয়ে।আমি আগেই ভালো ছিলাম।’

-‘এখন মাচ বেটার হবে।খাওয়া নিয়ে আমি ছাড় দেই না।
—————
ইমাদ বিছানা করছে আর পুতুল দূর থেকে ওর বিছানা করা দেখছে।ইমাদ এবার বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে বললো,’আমি সিওর মা বাসায় এসে নাতিপুতির কথা বলবে’

পুতুল কোমড়ে হাত রেখে ভেংচি কেটে বললো,’যদি না বলে?বাজি ধরবেন?’

-‘যদি আমি জিতি তাহলে আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবো আর তুমি ভুলেও লজ্জা পেতে পারবে না।ওকে?’

-‘আর যদি আমি জিতি তাহলে আপনি আসাদ ভাইয়ার সাথে বক্সিং খেলবেন।রাজি?’

-‘রাজি’

পুতুল হাসতে হাসতে ড্রেসিং টেবিলের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,’আসাদ ভাইয়া পাঁচবার বক্সিং শো তে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।আপনাকে মেরে ভূত বানিয়ে দেবে’

-‘বাজি হেরে ভূত হতে চাই।ব্যাপার না।’

পুতুল মুখে হাত দিয়ে হেসেই যাচ্ছে।কল্পনা করে সে ভাবছে আসাদ ভাইয়া ইমাদকে মেরে আলুর ভর্তা বানাচ্ছে।ইমাদের ঠোঁট থেকে রক্ত বের হচ্ছে,তা টপটপ করে নিচে গড়িয়ে পড়ছে।ইশ ইমাদের সারা গা ঘেমে একাকার হয়ে আছে।ইমাদ এবার গায়ের গেঞ্জিটা খুলে আসাদ ভাইয়ার গলা জড়িয়ে তাকে ফেলতে গিয়ে সে নিজেই পড়ে গেলো।তারপর হঠাৎ সেখান থেকে উঠে দুম করে কিল বসিয়ে পুতুলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সে।
পুতুল ভয় পেয়ে চোখ খুলতেই দেখলো ইমাদ ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।মুখে সেই হাসি।শুধু রক্তের অভাব।পুতুল হাত দিয়ে ইমাদের গাল ছুঁয়ে চুপ করে থাকলো।হাত ওর মুখটাতে বুলিয়ে আবার সরাতে যেতেই ইমাদ ওর হাতটাকে জড়িয়ে ধরে বললো,’কি দেখো?’

-‘ভাবছিলাম ভাইয়ার মার খেয়ে আপনার কি হাল হবে’

-‘তার বোনের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে কি হাল হবে ওটা দেখার বিষয় এখন।বাজি যে তুমি জিতে যাবে তা কিন্তু নয়।
মা বাবা কাল আসবে।কাল অবধি তোমাকে অপেক্ষা করতেই হবে।বেশি কল্পনা করা ভালো না।সেটা তাহলে কখনওই পূরণ হবে না বুঝলে?’

পুতুল হাতটা ছুটিয়ে দুহাত ভাঁজ করে বিছানার দিকে যেতে যেতে বললো,’আপনার মা আমাকে না মেনে নাতিপুতির কথা বলবে না।দেখিয়েন’

ইমাদ রুমের আলো নিভিয়ে বললো,’বলবে।এবং কাল মা তোমায় মেনে ও নেবে।সিওর থাকো’

পুতুল সোজা হয়ে শুয়ে ছাদ দেখতে দেখতে আস্তে করে বললো,’ধরেন আমি মেয়ে বাবুর আম্মু হলাম।আপনার আম্মু কি আমায় বকবেন?’

-“বকার সম্ভাবনা আছে।তবে আমি সামলে নেবো।মেয়ে হবে নাকি ছেলে হবে এটা আল্লাহ ঠিক করে দেন।সুতরাং তার সৃষ্টি নিয়ে কারোরই উচিত না মতামত দেওয়া।মা সেকেলে মানুষ।তাকে বোঝাতে কাঠখড় পোড়াতে হতে পারে।কিন্তু শেষে বুঝে যাবে’

পুতুল মন খারাপ করে ইমাদের হাতের আঙ্গুল স্পর্শ করে ওর দিকে ঘুরে বললো,’আপনার কি চাই?’

-‘পুতুল?আমি তোমাকে এখনও সেভাবে ছুঁইওনি আর তুমি পর্বত রেখে পাহাড়ে চলে গেছো?সবুর করো।আমি সেটাই চাই যেটা আমাদের জন্য ভালো হবে।একটা সুস্থ বেবি,
এর চেয়ে বেশি আমি আশা করি না।’

পুতুল মুখটা ইমাদের বাম হাতের নিচে লুকিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলো।ইমাদ তার ডান হাত এগিয়ে এনে পুতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।পুরো রাতটাতে এমন ভাবেই ছিল তারা দুজন।সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরও পুতুল নিজেকে সেই ইমাদের হাতের সাথে লেগে থাকতেই দেখেছিলো।সকাল বলতে অনেক সকাল হয়ে গেছে।পর্দা ভেদ করে রোদ কুচি কুচি হয়ে ভেতরে আসছে।পর্দা গুলো কুচিকুচির ডিজাইন করা তাই হয়ত এমন হয়ে আসছে।এই পর্দা নতুন।হয়ত ইমাদের মা লাগিয়েছেন।আগের পর্দাটা এমন ছিল না।রোদ এসে কপালে লাগছে তো নাকে লাগছে না।আবার ঠোঁটে লাগছে তো গলায় লাগছে।কি দারুণ তার আগমন।এগিয়ে এসে পর্দাটা সরিয়ে দিলো পুতুল।এবার সম্পূর্ন রোদ এসে গায়ে মুখে মাখোমাখো হয়ে গেছে।ইমাদ মাথাটাকে বালিশের তলায় নিয়ে লুকিয়েছে।কিছুতেই রোদের কারণে ঘুম ভাঙতে দেবে না সে।পুতুল পেছনে তাকিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’কত সকাল হয়েছে!অফিসে যাবেন না?’

-‘হুম।রুটি তাওয়ায় উঠিয়ে ডাক দিও।পুরুষদের রেডি হতে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগে না’

পুতুল ছেড়ে থাকা অবাধ্য চুলগুলোকে হাতের মুঠোয় বন্দি করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খোঁপা করে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।ঠোঁটে আটকে রাখা খোঁপার কাঠিটা নিয়ে খোঁপাটাকে লক করে ফেললো।
এরপর চুলায় পানি গরম হতে দিয়ে গেলো ওয়াসরুমে ফ্রেশ হবে বলে।ইমাদ এই ফাঁকা বিছানা থেকে উঠে পর্দা টেনে আবার শুয়েও পড়েছে।পুতুল শাড়ীর আঁচক দিয়ে মুখ মুছে ছুটে এসে গরম পানিতে আটা ছেড়ে দিলো।চামচ দিয়ে আটা নাড়তে নাড়তে কাল রাতের ছাদের ঘটনাটা হঠাৎ মনে পড়ে গেলো তার।হাতটা কেঁপে উঠতেই জলদি করে পাতিল নামালো সে।সবসময় দুনিয়ার সব ভাবনা ঐ রান্না করতে গেলেই মাথায় চলে আসে।
-‘আর ভাবা চলবে না।তা নাহলে হয় রুটি পুড়বে,নাহয় ভাজি লেগে যাবে পাতিলে।ডিম অমলেট না হয়ে কুচিলেট হয়ে যাবে।না বাবা ওসব ভেবে কাজ নেই।’

রুটি তাওয়াতে দিয়ে পুতুল ইমাদকে তিনবার ডাকলো।তারপর নিজের কাজে আবার মন দিয়ে ফেলেছে।ওদিকে ইমাদ ঘুমের সাগরে ডুবে ডুবে সাঁতার কাটছে।পুতুল এক এক করে সব টেবিলে এনে খুন্তি হাতে রুমের দরজা অবধি এসে বললো,’অফিস নাই আপনার?পুরুষ মানুষদের নাকি পাঁচ মিনিট ও লাগে না রেডি হতে।আপনার হাতে আছে পাঁচমিনিট।আমি দেখি কি করে রেডি হোন!আমি কিন্তু ঠিক টাইমে ডেকেছিলাম’

ইমাদ মাথা তুলে ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসলো।তারপর নামতে নামতে বললো,’জোরে ডাকতে পারলে না?’

-‘হ্যাঁ যত দোষ নন্দঘোষ। ‘
—–
ইমাদ কোনোমতে খেয়ে চলে গেছে অফিসের দিকে।পুতুল বিছানা করছিল তখন।কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে হাতের কাজ ফেলে ছুটে আসলো দেখবে বলে।দরজা খুলে দেখলো ওপারে বাবা- মা,আসাদ ভাইয়া আর খালামণি দাঁড়িয়ে আছেন।সবাইকে দেখে পুতুল এত খুশি হলো! সালাম দিয়ে ভেতরে নিয়ে আসলো সবাইকে।বাবা সোফায় বসে বললেন,’তোর শ্বশুর বাড়ি দেখার ইচ্ছা ছিল।এড্রেস জানতাম না।এই জায়গায় এসে ইমাদের বাড়ি বলতেই একজন দেখিয়ে দিলো।

-‘খুব ভালো করেছো।বসো না!!ভাইয়া মা বসো।আমি চা আনছি।

-‘ওসব পরে।তোর শ্বশুর শাশুড়ি কই?তাদের দেখছি না যে?আর ইমাদ কই?’

-‘বাবা উনারা বাসায় নেই।বিয়ের দাওয়াতে গেছেন।আর উনি মাত্র বেরিয়ে গেছেন অফিসের দিকে’

-ভুল সময় আসলাম।তোর শ্বশুর শাশুড়ির সাথে পরিচয় হওয়ার ইচ্ছা ছিল অনেক।’

-‘তো কি হয়েছে বাবা?তোমরা তো আর এখনই যাবে না।উনারা দুপুরের দিকে চলে আসবেন বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষে।বসো টিভি দেখো’

পুতুল টিভিটা চালিয়ে দিলো।আসাদ ঘুরে ঘুরে সব দেখছে।আর বলছে,’পুতুলকে খুঁজতে এই বাসার সামনেও এসেছিলাম আমি, অথচ জানতাম না ও এখানেই আছে।হায়রে কপাল’

মা আর খালামণি পুতুলের সঙ্গে রান্নাঘরে এসেছেন।পুতুল চা বানাতে বানাতে তাদের সাথে কথা বলছে।মা বললেন,’বাসাটা অনেক বড় কিন্তু মানুষ কম।’
খালামণি তো বলেই দিলেন এখন বাচ্চাকাচ্চা হলে বাসা পরিপূর্ণ হয়ে যাবে’

পুতুল ইমাদের কথা মনে করে ট্রেতে চায়ের কাপ সাজাচ্ছে খালামনি মাকে একটা রুম দেখাতে নিয়ে চলে গেলেন।সম্ভবত ইমাদ আর পুতুলের রুমটা।আসাদ ভাইয়া ডাইনিং থেকে একটা আপেল নিয়ে খাচ্ছেন হেঁটে হেঁটে।
বাবা টিভিতে খবর দেখছিলেন।পুতুল চা এনে সামনে রেখে ছুটে গেলো বিসকুট চানাচুর আনতে।’
ইমাদ এগারোটার দিকে ফোন করলো।এমনিতে সে ফোন করে না কখনও কিন্তু আজ কেন করলো পুতুল বুঝতে পারলো না।ফোন কানে ধরতেই ইমাদ বললো,’মা আর বাবা ফিরে আসছে।বৌভাতে যাবেন না।সেটা নাকি অনেক দূরে।এত জার্নি তারা করতে পারবেন না।একেবারে যশোর।’

-‘ওহহহ।ঠিক আছে”

-‘শোরগোল শোনা যায়।বাসায় কে আসছে?’

-‘মা বাবা,আসাদ ভাইয়া আর খালামণি এসেছে।আপনি জলদি আসিয়েন’

-‘আজ মনে হয় তোমার দুই পরিবারকে একসাথে বসিয়ে দাওয়াত খাওয়ানোর ইচ্ছে পূরণ হয়ে যাবে’

পুতুল হেসে বললো,’আপনি জলদি আসবেন।অপেক্ষায় থাকবো আমি।

কলিং বেল বাজছে।এবার এসেছে ইমাদের মা বাবা।মিসেস রওনক একটা ভাব নিয়ে ভেতরে ঢুকে ঘরভর্তি মানুষ দেখে ইয়া বড় হা করে তাকিয়ে রইলেন।পুতুলের বাবা মা দুজনেই সালাম দিলেন উনাদেরকে।উনারাও এবার সালাম দিলেন তারপর পুতুলের দিকে তাকালেন দুজনে।কারণ তারা পুতুলের মা বাবাকে চেনেন না।পুতুল জানালো ওর বাবা মা,ভাইয়া আর খালামণি

-ওহ হো!কখন এলেন?’

কথাটা বলে ইমাদের বাবা কোলাকুলি করলেন পুতুলের বাবার সাথে।মিসেস রওনক অনিচ্ছা থাকার সত্ত্বেও হেসে হেসে ওদের পাশে গিয়ে বসেছেন।পুতুল নতুন করে চা বানিয়ে এনে রাখলো তাদের সামনে।এরপর ছুটে আসলো রান্নাঘরের দিকে।একা হাতে মাছ,মাংস পোলাও সব রাঁধছে সে।শেষে খালামণি এসে হাত লাগালো।বাকিরা কথা বলায় ব্যস্ত। খালামণি ফিসফিস করে বললেন,’তোর শাশুড়ির মনে হয় ভাব বেশি’

পুতুল ও ফিসফিস করে বললো,”কি করে বুঝলে?’

-‘শুধু গালে হাত দেয়।কেমন বিরক্তি ভাব দেখায় যেন আমরা তারে জোর করে বসিয়ে রেখেছি কথা বলার জন্য’

পোলাওর সুবাস পুরো বাসায় ছড়িয়ে পড়েছে।মিসেস রওনক কানের দুল খুলতে খুলতে বললেন,’দেখলে?ঐ মেয়েকে দেখে বোঝা যায়?? যে সে একা হাতে এত কিছু বানাতে পারে?তাও দিব্যি বানাচ্ছে।তার মায়ের পরিবারের মানুষ এসেছে কিনা!’

-‘তুমি চাইলে তোমার জন্যও বানাতো।কিন্তু তুমি তো তেল মশলার খাবার খাও না।তুমি খাও সাদা ভাত,সাদা তরকারি,সাদা ডাল’

-‘সাদা ডাল হয় না।ওটা স্যুপ।কর্ন স্যুপ’

-‘ঐ একই।স্যুপ হলো ডালের দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই’
চলবে”