বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৪২
Writer-Afnan Lara
.
মুখের উপর দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে গাল ফুলিয়ে বিছানায় এসে বসেছেন মিসেস রওনক।তার আপন মানুষরা তার সাথে শত্রুতামি শুরু করেছে।এটা ভাবছেন বসে বসে।এরপর নাতিপুতির কথা মাথায় আসতেই দাঁত কেলিয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি।
পুতুল আয়নার সামনে একটা টুল টেনে বসে গলায় হালকা পাতলা একটা স্বর্নের চেইন লাগাচ্ছে।ইমাদ হজমি চকলেট মুখে দিয়ে আলমারি খুললো তার কালকের অফিসে পরে যাওয়ার জন্য জামা আছে কিনা তা দেখার জন্য।খুলতেই সবার আগে নজরে আসলো জলপাই রঙের একটা কাঁথা।ছোট সাইজের।ইমাদ সেটাকে হাতে নিয়ে সম্পূর্নটা মেলে ধরেছে।একটা বাবাুর জন্য বানানো কাঁথা।সেলাই গুলো সমান নয়।ত্যাড়াব্যাঁকা।তবে খুব সুন্দর ডিজাইন।কাঁথাটাকে অানকমন বানাতে পুতুল যথেষ্ট চেষ্টা করেছে তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।মাথাটা বাঁকিয়ে ইমাদ আয়নাতে চোখ রাখলো।পুতুল গলায় হাত দিয়ে হারটা দেখছিল।ইমাদের তাকানো দেখে সে ঘুরে বললো,’কি?’
-‘এটা কি?’
পুতুল জিভে কামড় দিয়ে তাড়াহুড়ো করে উঠে এসে ইমাদের হাত থেকে কাঁথাটা নিয়ে পেছনে লুকিয়ে ফেললো।তারপর থতমত খেয়ে বললো,’ও কিছু না।প্রথম প্রথম সবার হাতের বানানো জিনিস এমনই হয়।আপনি মজা নিতে ধরছেন তাই না?’
-‘একদম না।আমি তো বাহবা দিতে তোমাকে কথাটা বলতে চাইলাম’
পুতুল কাঁথাটাকে গুছিয়ে রেখে দিয়ে চুপচাপ বিছানায় এসে বসে পড়েছে।ইমাদ তার শার্ট প্যান্ট রেডি রেখে বারান্দায় গিয়ে একটা চেয়ারে বসে আছে।ঘুমাতে আসলো না।ওদিকে পুতুল রাত নয়টা থেকে দশটা অবধি ঘুমিয়েছিল বলে তার চোখেও ঘুম নেই।রাতে চারিপাশে থাকা ছোট ছোট পোকাদের ডাক কানে এসে লাগছে।ব্যস্ত শহরের মানুষেরা তাদের ক্লান্তি কমাতে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে তাই হয়ত চারপাশটা এত নিস্তব্ধ হয়ে আছে।ইমাদ রেলিংয়ের উপর এক পায়ের উপর আরেক পা রেখে কালো আকাশ দেখছে।কালো আকাশে শত শত তারার মেলা দেখার দর্শনার্থী সে এখন।কোনো তারা একটু বেশি উজ্জ্বল ,সেগুলোর দিকেই চোখটা সবার আগে পড়ে।আবার তার পাশের সুক্ষ্ম আলোর তারাগুলোর প্রতি প্রবল আগ্রহ জমে।
জাতে কিন্তু তারাও তারা।তাদের নাম ‘তারা’।তারা সবাই কিন্তু একসাথেই এক জায়গায় থেকে জ্বলছে।সাইজে বড় ছোট বলে কি তাদের অবজ্ঞা করা যায়?তারা কি এটা নিয়ে মন খারাপ করে না?যদি মন খারাপ করে তাহলে কেন করে?তাদের জানা উচিত তাদের ছোট দেখতে বলেই পৃথিবীর অনেক অনেক মানুষ আগ্রহ নিয়ে চোখ ছোট করে তাদের দেখার চেষ্টা করে।দূরবীন হলে তো কথায় নেই।
-‘যেমন আমি ঐ ছোট তারাটাকে দেখছি ঠিক তেমন।আফসোস তো বড় তারাটার করা উচিত।’
ফ্যানের বাতাসে আর বাইরের দূর থেকে আসা নাম না জানা হাওয়া এসে পর্দাসবগুলোকে নাড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমান্বয়ে।পুতুল ইমাদের ফোন টিপে গান চালু দিয়ো হাঁটু ভাঁজ করে বিছানার মাঝখানে বসে ইমাদকে দেখছিল।আর তার ইমাদবাবু তারা নিয়ে গবেষণা করছেন।একটিবার তাকালে কি হয়?মন চায় ইট পাথর ছুঁড়ে মেরে আমার দিকে তার চোখ ফিরাই।নাহ!সেটা করবো না।হাতের কাছে কাগজ আছে।সেটা গোলাকার করে মুড়িয়ে মারা যায়।ব্যাথা পাবে না সাথে এটেনশান সিকারের কাজ করবে।জোস আইডিয়া!!
খাতার একটা পাতা ছিঁড়ে সেটাকে হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে ইমাদের দিকে ছুঁড়ে মেরেছে পুতুল।ইমাদ ঠিক সেসময়টায় পুতুলের দিকে তাকিয়েছে মাত্র।
কাগজের দলাটা গিয়ে তার মুখ বরাবর পড়েছে।পুতুল জিভে কামড় দিয়ে মুখে হাত দিয়ে ফেলেছে।ইমাদ চোখে হাত দিয়ে ফেললো।কাগজটা গিয়ে সোজা চোখে লেগেছে।পুতুল ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসলো।ইমাদের মুখ ধরে ফু দিতে দিতে বললো,’আমি না আপনার মুখে মারতে চাইনি।পিঠে মেরেছিলাম।আমি সেসময়ে তাকালেন বলে এমনটা হলো।আই এম সরি।চোখ খোলেন।আমি ফু দিচ্ছি’
ইমাদের চোখ থেকে পানি পড়ছে।পুতুল হাত দিয়ে মুছে শাড়ীর আঁচল দিয়ে ভাঁপ দিয়ে দিলো।ইমাদ এবার একটু নরমাল ফিল করছে।তারপরেও চোখ লাল হয়ে আছে।পুতুল ওর চোখের চারপাশ বারবার মুছে দিচ্ছে।চোখে মুছে দুঃচিন্তার ছাপ ওর।
ইমাদ ওকে টান দিয়ে কোলে বসিয়ে বললো,’অন্ধ হবো না।চিন্তা কমাও’
-‘আন্দাজে কথা বলতেই হবে?সামান্য খোঁচাতে কেউ অন্ধ হয় না’
-‘যেভাবে টেনসন করছিলে সেটাই বুঝাচ্ছিল’
পুতুল ইমাদের গলা জড়িয়ে সেখানে মাথাটা রেখে বললো,’আপনি না বড্ড আনরোমান্টিক’
-‘রিয়েলি?’
-‘ভাবতাম!এতক্ষণ পরে যখন আমায় কোলে বসিয়ে নিলেন তখন মাথা থেকে এই চিন্তা চলে গেলো।এবার বুঝছি ইমাদ হাসান অমির মাঝে রোমান্স আছে’
-‘কোলে বসানো রোমান্সের আওতায় পড়ে?হাহাহাহা।আজ আমি হাসতে হাসতে মরে যাবো’
-‘না মরবেন না।বেঁচে থাকবেন সবার জন্য।স্পেশালি আপনার মায়ের জন্য।তার দুনিয়া একদিকে,আর আপনি একদিকে’
-‘মা আমাকে কতটা ভালোবাসে তা আমি জানি।যদি কেউ এসে আমায় পাকাপোক্ত প্রমাণ দেখিয়েও বলে মা আমায় ভালোবাসে না, আমি সেটা মানতে পারবো না।একবার কাউকে বুঝে গেলে এরপর আর যাই হোক না কেন ঐ মানুষটার জায়গা ঠিক থাকে।কোনো নড়চড় নেই।’
ইমাদের গলায় মাথা রেখে পুতুল টের পাচ্ছে ইমাদ ঢোক গিলছে কয়বার।শেষে মাথা তুলে সে জিজ্ঞেস করলো ইমাদ এতবার ঢোক গিলছে কেন।ইমাদ ওর দিকে না তাকিয়ে বললো,’দূরের ঐ হালকা নীল রঙের দালানটা দেখছো?’
-‘হুম’
-‘ওটার উপরে সেরা টাংকি দেখছো?’
-‘হুম।তাতে কি হয়েছে?’
-‘আমার মনে হচ্ছে আমি ঐ টাংকি কোলে নিয়ে বসে আছি।’
পুতুল রেগে ইমাদের বুকে কিলঘুষি দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’আমি মোটা?’
-‘আশ্চর্য! তোমাকে কে মোটা বললো?তুমিই দেখো।ঐ টাংকিটা কি মোটা?’
-‘চিকন সাইজের।ঐ মোটাই তো”
-‘আমার কাছে একদমই মোটা মনে হচ্ছে না। শুধু শুধু বলছো।আসো বসবে’
-‘দরকার নাই।ঢং!!”
পুতুল রুমে চলে এসেছে।ইমাদ উঠে দাঁড়িয়ে টাংকিটা একবার দেখে বললো,’নাহহহ।এ হতে পারে না।ভুল বললাম।এই টাংকি আমার ওয়াইফ না।আমার ওয়াইফ তো পুতুলের মতন দেখতে’
পুতুল ভেঁচি কেটে শুয়ে পড়েছে।ইমাদ সুইচ টিপ দিয়ে লাইট বন্ধ করে পাশে এসে বসলো ওর।
পুতুল চুপ।সেও চুপ ছিল পরে পুতুলের আঁচলটা টেনে আঙ্গুলে বাঁধতে বাঁধতে বললো,’তোমার ভাইয়া এখনও আমায় পছন্দ করেন না।আজ কেমন করে যে তাকালো।
তার কি ক্ষতি করছিলাম?’
পুতুল মাথা ঘুরিয়ে বললো,’আপনার মা যেমন আমাকে মেনে নেন না।ঠিক সেরকম হলো’
ইমাদ বালিশ পেতে সোজা হয়ে শুয়ে পড়েছে।দুপরিবারের দুজনকে মানাতে মানাতে, মন জয় করার প্রেক্ষাপট তৈরি করতে গিয়ে বিয়ের আজ কতটা দিন হয়ে গেলো অথচ এখনও তারা আগের জায়গাতেই রয়ে গেছে।কিন্তু তারা জানে না, তারা মেনে নিলে সবার মুখে হাসি ফুটবে।এমনকি তাদের নিজের মুখেও।মানুষ এই সত্যটা বিশ্বাস করতে চায়না।যদি বিশ্বাস করত তাহলে পৃথিবীতে মনমালিন্য বলে কিছু থাকত না।’
পুতুল গুটিয়ে ইমাদের গায়ের সাথে লেগে চুপ করে আছে।ইমাদ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল আর খালি গলায় একটা গান শুনালো এই ফাঁকে।সম্ভবত ইংরেজী গান।গানটা ইদানিং প্রচলিত বলে শুনতে শুনতে মুখ দিয়ে এসে গেলো তার।পুতুল ঘুমিয়ে পড়েছে ততক্ষণে।
পরেরদিন খুব সকালে ঠাস ঠুস আওয়াজ পেয়ে পুতুল ইমাদ দুজনেই উঠে পড়লো একসাথে।ইমাদের ঘুম বেশি ছিল বলে সে আবারও শুয়ে পড়েছে।পুতুলের একবার ঘুম ভাঙ্গলে তা আর আসে না।তাই সে বিছানা ছেড়ে গেলো দেখতে।ইমাদের মা ইচ্ছে করে আওয়াজ করছেন।পুতুল দরজা ফাঁক করে দেখছিল সেটা।পুতুলকে দেখে তিনি আওয়াজ করা বন্ধ করে ধপ করে নিচে বসে ইয়োগা করা শুরু করলেন।পুতুল দরজাটা আবার লাগিয়ে পেছনে তাকালো।ইমাদ মাথা তুলে আস্তে করে বললো,’ভোর পাঁচটা বাজে।এসে শুয়ে পড়ো আমার পাশে।মায়ের কাজে মন দিও না।মায়ের মাথায় নিশ্চয় কিছু ঘুরছে তাই তোমাকে উঠানের চেষ্টা করেছে’
পুতুল মাথা চুলকে ইমাদের পাশে এসে বসলো আবার।মিসেস রওনক ওকে কেন জাগিয়ে তুললো তার রহস্যভেদ করা হলো না।এসব ভেবে পুতুল যেই না শুয়ে পড়লো ওমনি আবারও আওয়াজ বেড়ে গেলো ড্রয়িং রুমে।পুতুল উঠতে যেতেই ইমাদ ওকে থামিয়ে নিজে গেলো। দরজা খুলে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো ইমাদ।মা জুস খাচ্ছিলেন। ইমাদকে দেখে বললেন,’কিরে উঠেছিস?’
-‘হুম।ঘুমাতে পারছি কই?পাশের বাসা থেকে ধুরুম ধুরুম আওয়াজ আসে।মনে হয় যেন কেউ ফ্লোরে লাথি দিচ্ছে। কি করি বলোতো?’
মিসেস রওনক ঢোক গিলে বললেন,’আমি কমপ্লেন করবো।তুই যা ঘুমোতে যা।পুতুল কই?”
ইমাদ বললো,’সে ঘুমাচ্ছে।’
কথাটা বলে আবার চলে গেলো সে রুমের ভেতরে।মিসেস রওনক বিড়বিড় করে কিসব বললেন।তার প্ল্যান ছিল পুতুলকে রুম থেকে বের করার।তারপর ওকে আচ্ছা মত বকবে ইমাদকে দিয়ে সব কাজ করানোর জন্যে।সেটা আর পারলেন না।উল্টে ইমাদ নিজে এসে হাজির।পুতুল উঠে বসে ছিল। ইমাদ দুম করে শুয়ে পড়ে বললো,’তেমন ইম্পর্টেন্ট না।শুয়ে পড়ো তুমি ‘
পুতুল ভালো মেয়ের মতন শুয়ে পড়ে ভাবছে কি এমন হতে পারে যার কারণে ইমাদের আম্মু এমন করলো?আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় তা তো বুঝলাম।কিন্তু এটা তো সোজাসুজি ডেকেও বলতে পারে।এরকম হিচকিচ করছে কেন?ইমাদ গেলে আজ আমার উপর দিয়ে টর্নেডো যাবে যা বুঝছি।
ঠিক সাতটার দিকে পুতুল চুপিচুপি রুম থেকে বের হয়েছে।মিসেস রওনক সোফায় কাত হয়ে শুয়ে আছেন।পুতুল পা টিপে টিপে রান্নাঘরে ঢুকেছে রান্না করবে বলে।হালকা আওয়াজে মিসেস রওনক জেগে গিয়ে এক ছুটে রান্নাঘরে এসে হাজির হলেন।পুতুল ভয়ে ভয়ে তার দিকে তাকালো।তিনি কিছু বলতে যাবার আগেই মাঝখানে এসে দাঁড়ালো ইমাদ।পকেটে হাত ঢুকিয়ে বললো,’মা শরবত খাবে?’
-“নাহ।তুই খা’
এটা বলেই মা চলে গেলেন হনহনিয়ে।ইমাদ মায়ের চলে যাওয়া দেখে বললো,’মায়ের কি হলো বলোতো?আমার আসা এক্সপেক্ট করেনি নাকি?’
পুতুল ফিসফিস করে বললো,’আপনি প্লিজ আজকে ছুটি নেবেন?’
-‘কেন?”
-“এমনি।প্লিজ প্লিজ!’
-‘আচ্ছা তা নাহয় নেবো।কিন্তু কারণটা কি?’
-“পরে বলবো।গিয়ে ডাইনিংয়ে বসে থাকেন।আমি নাস্তা বানাচ্ছি।আপনি এখানে থাকলে আমার রান্না করা হবে না’
ইমাদ তাকে উঠে বসে বললো,’যাব না।এবং দেখবো তুমি কি করে রান্না ভাল করতে পারো’
-‘শত্রুতা করছেন?’
-“বউয়ের সাথে মাঝে মাঝে মজা করতে হয়।আমি আজকে করবো।প্রচুর জ্বালাবো তোমাকে।একসময়ে তুমি রেগে বলবে,’আপনি প্লিজ অফিসে যান।আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না প্লিজ”
পুতুল মুখ বাঁকিয়ে কাজে মন দিয়েছে।ইমাদ তার পাশ থেকে পানির মগ নিয়ে হাত ডুবিয়ে পুতুলের গায়ে পানি ছিঁটানো শুরু করে দিলো।পুতুল রেগে তাকাতেই ইমাদ নিজের গায়ে পানি ছিঁটিয়ে বললো,’অনেক গরম তাই না?’
চলবে”
বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৪৩
Writer-Afnan Lara
.
ইমাদের মা পাশের রুমে বলে পুতুল তার রাগটা প্রকাশ করতে গিয়েও পারছে না।এদিকে ইমাদ সুযোগের সঠিক ব্যবহার করছে।যখন দেখলো পুতুল তার ডিস্টার্ব করাতেও কোনো রিয়েক্ট করছেনা তখন সে ডিস্টার্ব করার হার বাড়িয়ে দিলো।মিসেস রওনক জগিং করতে চলে গেছেন।ইমাদের বাবা ঘুমাচ্ছেন এখনও।মা চলে যেতেই ইমাদ আস্তে আস্তে কাছে ঘেষে দাঁড়ালো পুতুলের।ততক্ষণে পুতুল ও বুঝতে পেরেছে তার শাশুড়ি নেই।তার মানে এখন খুব সহজেই তার গুনধর ছেলেটাকে মাছের মত করে ভাজা যাবে।পুতুল রুটি ছেঁকার খুন্তিটা দিয়ে ইমাদের হাতে একটা বাড়ি দিয়ে বললো,’যাবেন আপনি?’
-‘ব্যাথা পেলাম না।তাও যাচ্ছি।মা আসলে আবার আসবো জ্বালাতে।দেখবো শাশুড়ির সামনে কি করে বরকে সহ্য করতে পারো’
পুতুল ইমাদের পিঠে ধাক্কা মেরে বের করে দিলো ওকে।
রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে বসেছে ইমাদ।বসের কল পাঁচটা।ইমাদ ফোন নিয়েছিল আজকের ছুটির আবেদন করবে বলে।কিন্তু বসের এত কল দেখে কলিজায় কামড় দিয়ে উঠেছে।তাড়াহুড়ো করে সে বসকে কলব্যাক করলো।বস ধরলেন না।এরপর কল দিলো তার পি.একে।সে জানালো আজ ইমাদকে অফিসে আসতেই হবে।জরুরি কাজ আছে, ছুটি নেওয়া পসিবল না।ইমাদ মন খারাপ করে ফোনটা রেখে দিয়েছে।
-‘পুতুল এমন করে চাইলো না করতে পারিনি,কিন্তু ছুটি তো নেয়া যাবে না এটাও আরেক ঝামেলা।কি করি!’
——
মিসেস রওনক তার চাকরি ছেড়ে দিবেন।শরীরে বল থাকলেও মনে বল পাচ্ছেন না।অনেক সময় বয়স তাজা থাকলেও মনের কারণে সেই তাজাটা ফিকে পড়ে যায়।উনার হয়েছে তেমন।শরীর চাইলেও মন চাইছে না।অনেক তো হলো।
ইমাদের বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদের দু বছর আগে তিনি এই শিক্ষতায় যোগ দিয়েছিলেন।এতগুলো বছর হয়ে গেলো।সরকারি হলে ছাড়তেন না।কিন্তু এটা তো বেসরকারি। পিছুটান নেই।ছেড়ে দিলেও কি আর না দিলেও কি।চাকরি শেষে তো আর পেনশন পাবে না।সরকারি হলে হয়ত মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে হলেও চাকরির বয়স শেষ হওয়া অবধি আঁকড়ে ধরে রাখতেন।আর এখন নিজের ছেলেই কত টাকা আয় করে।এসব ভেবে তিনি হেড স্যারের সঙ্গে আলাপ ও করেছিলেন।হেড স্যার অনেক দিনের পরিচিত। তিনি সোজা কথায় বলে দিয়েছেন এক মাসের জন্য গুম থাকতে।চাকরির প্রতি ইন্টারেস্ট আবার ফিরে আসবে।তাই এই কদিন ধরে মিসেস রওনক তার পরিবারের সাথে সময় কাটাচ্ছেন।এই তো আজকেই শেষ দিন, কাল থেকে আবার চাকরিতে জয়েন।এই এক মাসের বেতন পাবেন না।মন চায় বলতে যে আমি ঐ চাকরি করবো না।আমার ছেলে এবং হাসবেন্ড ভালো বেতনের চাকরি করে।আমি রেস্ট নিতে চাই। এই শব্দগুলো মুখ দিয়ে বের হয় না।এটাই সমস্যা।যাই হোক!হইতো হেড স্যারই ঠিক।কাল জয়েন করলে মনে হয় আবার ভালো লাগা শুরু হবে।আর যাই হোক আমার পেশাই তো!!’
—–
বসের কল আসলো এক ঘন্টা পর
ইমাদ বারান্দায় বসে নিউজপেপার পড়ছিল।মা এখনও ফেরেনি।পুতুল রান্নায় ব্যস্ত।আর বাবা টিভি দেখছেন।বসের মতে ইমাদের ট্রান্সফার হয়ে গেছে। কুমিল্লায়।এত বড় বিপদের কথা শুনে ইমাদ থ হয়ে বসে আছে।পুতুলকে কি করে বলবে সেটাই ভাবছে।হুট করে এই ট্রান্সফার দিলো বস।
-‘এর পেছনে দোষটা আমারই।আমি কেন ঐ প্রোজেক্টে এক্সপার্ট হতে গেলাম?এই জন্যই তো বেছে বেছে আমাকেই পাঠাচ্ছে।পুতুল রেগে আগুন হবে।এমন একটা সিচুয়েশন যে ওকে সাথে করে নিয়েও যেতে পারবো না।পারলেও সময় লাগবে।আর আমি ট্রান্সফার কেনসেল করতে করতে এক /দু মাস লাগবে।এই একটা মাস যদি পুতুল কষ্ট করতো তাহলে আমাকে এত ঝামেলা মাথায় নিতে হবে না।’
-‘নাস্তা রেডি!!!’
পুতুল ইমাদের গলা জড়িয়ে ধরেছে পেছন থেকে।ইমাদ হাত থেকে ফোন রেখে পুতুলকে ঘুরিয়ে নিজের সামনে এনে দাঁড় করালো।পুতুল হেলেদুলে বললো,’আজকে তো ছুটি নিয়েছেন।চলুন না আমরা কোথাও থেকে ঘুরে আসি?’
-‘পুতুল একটা কথা বলার ছিল’
-‘বলুন শুনি’
ইমাদ বলতে গিয়েও পারলো না।শুধু কিছু না বলে বাবার কাছে চলে আসলো।পুতুল নিচের ঠেঁটটা উল্টো করে নিউজপেপার টা গুছিয়ে ড্রয়ারে রেখে দিয়েছে।
মিসেস রওনক বাসায় ঢুকেছেন মাত্র।বাবার সামনে বরাবর বসে বললেন,’করলাম বহুত শান্তি।কাল থেকে আবার অফিস জয়েন।আমার আর ভাল্লাগে না’
ইমাদ চ্যানেল পাল্টে বললো,’তোমাকে কতদিন বলছি ছেড়ে দাও।আমি আছি না?ছেলে ইনকাম করে কি জন্য?’
-‘নিজের খরচ নিজে চালানোর মাঝে এক বিশাল ভালো লাগা কাজ করে।এটা অন্তত তুই বোঝ!’
-‘সেই তুমিই আবার বলো চাকরি করবে না।এতকথা বলো কেন?ইমাদ তো ঠিকই বলেছে’
-‘আমি দোটানায় পড়ে গেছি।বুঝছি না আমার কি করা উচিত।৫০% না,আর ৫০% হ্যাঁ’
পুতুল রুম থেকে বেরিয়ে বললো,’নাস্তা করতে আসতে’
মিসেস রওনক মাথা তুলে বললেন,’আমি কিন্তু ভাজি খাব না’
-“জানি।আমি আপনার জন্য ডিম সিদ্ধ করেছি আর তেল ছাড়া মুগ ডালের ভুনা করেছি’
-‘ঠিক আছে’
—
ইমাদের মন ভীষণ খারাপ।সব চাইতে বেশি খারাপ লাগছে পুতুলের জন্য।বসকে বলে আজকের দিনটা সে ম্যানেজ করতে পেরেছে।কিন্তু পুুতুলকে আজ সময় দিয়ে যখন কাল সকালে বলবে সে কুমিল্লা যাচ্ছে এক/দু মাসের জন্য তখন কি হবে।পুতুল তো মানতেই চাইবেনা।’
বাবা -মা উঠে গেছেন খাওয়ার জন্য।ইমাদ আসছে না দেখে পুতুল ওকে কয়েকবার ইশারা করে ডাকলো।ইমাদ বাধ্য হয়ে খেতে বসেছে শেষে।খাওয়া উঠে গেছে ওর।মন চাইছে না।পুতুলকে অন্তত এই সময়ে সে খবরটা জানাতে চাইছে না।পুতুলের মুখে হাসি দেখে কথাটা গলা অবধি এসে গায়েব হয়ে যায়।নাস্তা শেষ করে বাবা অফিসে চলে গেছেন।মা তার আগের বাসায় কিছু জামাকাপড় আছে ওগুলো আনতে গেছেন আর সেই বাসার ভাড়া দিতে গেছেন।
পুতুল একটা সবুজ রঙের শাড়ী নিয়ে পরে এখন চুলে খোঁপা করছে।ইমাদ রেডি হয়ে বসে আছে গালে হাত দিয়ে।পুতুল ওকে কিছু বলার সময়ই দিচ্ছে না।সেজেগুজে রেডি সে ঘুরতে যাবে তাই।মা বিকাল ছাড়া আসবেন না।এটাই আসল সুযোগ।
রান্নাবান্না সব করে গুছিয়ে রেখেছে পুতুল।ইমাদের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলো।বেশিদূর না।হেঁটেই যাবে।বনানী লেক।ইমাদ মন খারাপ করে আস্তে আস্তে হাঁটছে আর পুতুল লাফিয়ে লাফিয়ে।একটা বেলুন কিনে ইমাদের দিকে তাকালে সে।ইমাদ মানিব্যাগ বের করে টাকাটা দিয়ে দিয়েছে।পুতুল ইমাদকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,’কি হয়েছে আপনার বলুনতো?মুখটা ওমন করে রেখেছেন কেন?’
-‘পুতুল আমার ট্রান্সফার হয়ে গেছে,কুমিল্লাতে’
পুতুল কিছু বললো না।চুপ করে ইমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।ও কিছু বলার আগেই ইমাদ ওর হাত ধরে বললো,’আমি আবেদন করবো ব্যাক আসার।কিন্তু তাতে এক/ দুমাস সময় লাগবে।’
পুতুল হাতের লাভ শেপের বেলুনটা ছেড়ে দিল।ঘুরে ঘুরে বেলুনটা উপরে আকাশের পানে চলেছে।তার ইচ্ছা অনেকদূর যাবে।যতদূর গেলে আকাশটাকে ছোঁয়া যেতো।
হয়ত আকাশ ছোঁয়ার আগেই মেঘ এসে হাতছানি দেবে।পুতুল আকাশের দিকে তাকিয়ে বেলুনটা চলে যেতে দেখলো।
লাল রঙ বলে বেলুনটা যতদূর গেলো ততদূর পর্যন্ত তাকিয়ে রইলো পুতুল।ইমাদ আইসক্রিমের দোকান থেকে দুটো আইস্ক্রিম কিনে ওর দিকে ধরে বললো,’আমার সঙ্গে যাবে?যদি তোমার উত্তর হ্যাঁ হয় তাহলে আমি মাকে মানানোর চেষ্টা এখন থেকে করতে চাই’
পুতুল আইসক্রিমের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে গম্ভীর গলায় বললো,’মা তো কাল থেকে অফিসে যাবেন।বাসার রান্না করবে কে?’
-‘বুয়া এনে দিবো।এটা কোনো বড় বিষয় না পুতুল’
-‘আমি স্বার্থপরের মতন তাদের একা ছেড়ে চলে যাবো?’
-“তুমি এক মাস থাকতে পারবে?’
পুতুল কিছু বললো না।চুপচাপ হাঁটছে।দুজনে একটু দূরে এসে বসেছে লেকের পাশে।আইস্ক্রিমের কাঠিটা ওলটপালট করতে করতে পুতুল দূরের একটা বাড়ি দেখছে।ইমাদ ওর বামহাতটা টেনে ধরে বললো,’রেগে আছো?’
-‘কেন?’
-‘আমি চলে যাব যে?’
-“রাগ করলে কি আর এটা আটকানো যাবে?যদি যেতো তাহলে রাগ করতাম।অনেক রাগ করতাম।যাতে করে আপনাকে থামানো যায়’
-‘চলো বাসায় ফিরে যাই।’
-‘বাসায় গিয়ে কি আর আপনার পাশে বসে থাকতে পারবো?এভাবে করে?’
ইমাদ মাথা নিচু করে বললো,’জড়িয়ে ধরতে পারবে।’
পুতুল উঠে দাঁড়িয়েছে সাথে সাথে।ইমাদ ওকে নিয়ে উল্টো পথে চললো,বাসার উদ্দেশ্যে।আইস্ক্রিমের কাঠিটা নিয়ে পুতুল ঘুরাচ্ছে আর রোডটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটছে।ইমাদের পা চলছে না।পুতুলকে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে তার।এক মাস থাকাটা অনেক কঠিন হয়ে যাবে।
—-
বাসায় আসার পর পুতুল এক কোণায় বসে গলার আর কানের দুল খুলছিল আনমনে।ইমাদের মুখেও কথা নেই।সে পুতুলের ঠিক সামনে বসে ওকে দেখছে।সকাল এগারোটা বাজে সবে।পুতুল কানের দুলগুলোকে একটা বক্সে গুছিয়ে রেখে বললো,’এক মাস শেষ হতে কতদিন লাগে?এই মাস তো ৩১দিন।আপনি কি ৩১দিনই থাকবেন নাকি ৩০দিন?’
ইমাদ মুখটা ফ্যাকাসে করে বললো,’দুই মাস ও থাকতে হতে পারে।সরি পুতুল।আমার হাতে কিছুই নেই’
পুতুলের মন আরও খারাপ গয়ে গেছে।এবার আর আটকাতে না পেরে কেঁদে ফেলেছে সে।ইমাদ অফিসে গেলে কখন আসবে তার অপেক্ষা করতে করতে সারাটাদিন কাটায় সে।দু মাস কি করে কাটবে তাহলে?
ইমাদ এগিয়ে এসে পুতুলকে জড়িয়ে ধরতেই ও সরে বসলো।চোখ মুছতে মুছতে বললো,’আর মায়া বাড়াইয়েন না।আমার বেশি কষ্ট হবে’
ইমাদ উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’আর আমার কষ্ট হচ্ছে না?
পুতুল অন্যদিকে মুখ করে বসে আছে।ইমাদ রুম থেকে বেরিয়ে এসে সোফায় বসলো।মা আসবে বিকালের দিকে।বাসা ফাঁকা।বাবা তো আসবে রাতে।পুতুল মিনিট দশেক পর রুম থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করলো খাবার খাবে কিনা।ইমাদ গম্ভীর ভাবে উত্তর দিয়েছে খাবেনা।
পুতুল আর জোর করলো না।চুপচাপ রুমের ভেতর চলে গেছে।ইমাদ না খেলে সেও খাবেনা এটা পুরান হেবিট ওদের।দুইটা পর্যন্ত ইমাদ অপেক্ষা করলো পুতুলের।
-‘অসহ্য লাগে যখন রাগটা আমার করা উচিত অথচ সে রাগ করে বসে আছে।আমি কি করলাম?ট্রান্সফার হওয়া কি আমার হাতে?অন্যান্য চাকরিতে ট্রান্সফার ডিইলে করতে কত মাস লেগে যায় আর আমি দু মাস সময় নিয়েছি। এটা কি আমার দোষ?কোথায় আমাকে সে সাপোর্ট করবে।তা না করে শুধু রাগ দেখাচ্ছে।’
শেষে বাধ্য হয়ে ইমাদই গেলো রুমের দিকে।রুমের ভেতর পা রাখতেই বালিশ একটা এসে মুখে পড়লো তার।পুতুল ছুঁড়ে মেরেছে।ইমাদ বালিশটা ঠিক করে ধরে বললো,’আমি কি করলাম আবার?
-“এতক্ষণ সোফায় শুধু শুধু বসে থাকতে পেরেছেন
আমার কাছে বসলে কি এমন হয়ে যেতো?’
-‘আজিব!তুমি তো বললে জড়িয়ে ধরতাম না। তোমার পরে কষ্ট হবে’
-‘আপনি না সত্যি কারের আনরোমান্টিক একটা মানুষ।আমি না করলাম।জোর করে জড়িয়ে ধরা যেতো না?এমন ভাব করছেন যেন তিনি খুব মানেন আমার কথা?বিয়ের আগে একদিন রাতে রেগে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম বাসা থেকে,তখন আমাকে জোর করে আটকে রেখেছিল কে?’
চলবে’