বাবুই পাখি পর্ব-৪৮+৪৯

0
1038

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৪৮
Writer-Afnan Lara
.
-‘তুমিও না!হাত-মুখ ধুয়ে আসো যাও।তোমাকে নিয়ে বের হবো।হোটেলে খাবার খেয়ে ডাক্তারের কাছেও তো যেতে হবে’

-‘আমি খেতে গেলেও ডাক্তারের কাছে যাব না।সামান্য জ্বরের জন্য ডাক্তারকে ডিস্টার্ব করার দরকার নাই।স্বামীর সঙ্গে দু মিনিট সুখ দুঃখের আলাপ করলে এমনি এমনি অসুখ সেরে যাবে।আপনি বরং খাবারটা নিয়ে আসুন।আমাকে খাইয়ে দেবেন।তারপর আমরা অনেক গল্প করবো’

-‘মাথা খারাপ??তোমার এই অবস্থায় আমি একা ছেড়ে যাবো?কখনও না।হয় তুমি আমার সঙ্গে যাবা নাহয় না খেয়ে বসে থাকো’

-‘আমি এই শরীর নিয়ে নড়তে চড়তে পারবো না’

-‘এক কাজ করতে পারো’

-‘কি?’

-‘আমার মাথায় মুগুড় দিয়ে একটা বাড়ি মেরে দাও।আমি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকবো’

-‘আন্দাজে এসব বলছেন কেন?চলুন যাই।আমার এই অসুস্থ শরীর নিয়ে এখন আবার বাসা থেকে বের করছেন।পঁচা হাসবেন্ড’

—-
ইমাদ পুতুলকে নিয়ে একটা রিকশা নিয়েছে।এ কদিন কাছের একটা ছোটখাটো হোটেলে তিন বেলা খাবার খেতো সে।পুতুল তো আর সেসব খেতে পারবেনা।তাই ওকে নিয়ে ভালো একটা হোটেলে আসছে সে।পুতুল ওর কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে আছে।ইমাদ লোকমা বানাতে বানাতে বললো,’তোমার কান্নার হার দেখেই বুঝেছিলাম তুমি ঠিক ছুটে চলে আসবে।আর আজ এসেও গেলে।আমার তো এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।হুট করে এসে সারপ্রাইজ দিলে।মাকে ফোন করেছিলাম ধরলো না।হয়ত স্কুলে আছে।’

পুতুল ইমাদের হাতের পশমগুলোতে চিরুনির মতন আঁচড়াচ্ছে আঙ্গুল দিয়ে।ইমাদ ওর মুখে লোকমা দিয়ে বললো,’কি নিয়ে হাসছো এত অসুখের ভেতরে?’

-“মা কাল আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার বমি পায় কিনা’

ইমাদ চোখ বড় করে পুতুলরে দিকে তাকিয়ে বললো,’সিরিয়াসলি?এত জলদি এসব হয় নাকি!’

-“মা তো জানেন না যে তার ছেলে এতদিন আনরোমান্টিক ছিল’

ইমাদ ব্রু কুঁচকে তাকালো একবার পুতুলের দিকে।পুতুল ওর শার্টে মুখ লুকিয়ে মিটমিট করে হাসছে।ইমাদ একটু ঠেলা দিয়ে বললো,’এত গড়াগড়ি খেতে হবেনা।পাবলিক প্লেস এটা।’

পুতুল পানি খেয়ে ফেলেছে হুট করে।ইমাদ তো তার কথায় অটল।ফার্মেসী থেকে প্যারাসিটামল কিনে বাসায় এনে ঔষুধটা জোর করে খাইয়ে ছেড়েছে।
পুতুল জানালার গ্রিল ধরে ঝুলে দূরে ট্রেন দেখছে।খুশিতে সে মনে হয় আজ পাগল হয়ে যাবে।ট্রেন দেখলেই কত ভালো লাগা কাজ করত।দূরে জার্নিতে গেলে ট্রেন দেখতে পেতো তাও অনেক দূর থেকে।আর এখন তার বাসার একটু সামনে দিয়েই ট্রেন যায়।এর চেয়ে খুশির আর কি!!

ইমাদ ফ্রেশ হতে গেছে।তখন তো অফিস থেকে ফেরার পরই পুতুল এসেছিল তাই আর ফ্রেশ হতে পারেনি।পুতুল গ্রিলে গাল আষ্টেপৃষ্ঠে লাগিয়ে ট্রেন দেখছে।যতদূর অবধি দেখা যায়।পারলে গ্রিল বেদ করে চলে যেতো দেখার জন্য।ইমাদ তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে এসে দেখলো পুতুল গ্রিল ধরে ঝুলে আছে।

-‘নেশাটেশা করলে নাকি?ওমন ঝুলে আছো কেন?’

-“আরেহহহ দেখেছেন ট্রেন যাচ্ছে এই জায়গা দিয়ে’

-“দুবার দেখেছি’

-‘আমি মাত্র দেখলাম।কি যে ভালো লাগছে বলে বুঝাতে পারবো না’

-“একটু ঘুমোতে পারোনা?’

-‘কেন ঘুমাবো?আসুন আমরা গল্প করি’

পুতুল গ্রিল ছেড়ে এগিয়ে এসে ইমাদের হাত ধরে টেনে সামনে বসালো।তারপর গালে হাত দিয়ে গোল হয়ে বসে বললো,’কি কি করলেন এতদিন সেসব বলেন তারপর আমি বলছি’

-‘তোয়ালেটা শুকাতে দিয়ে আসি আগে?’

পুতুল রাগ করে মুখ ঘুরিয়ে বসে পড়েছে।ইমাদ তোয়ালেটা খাটের স্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে পুতুলের হাঁটু ধরে এক টান ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বসালো।পুতুল তো হা করে তাকিয়ে আছে।
ইমাদের শক্তি দেখে পুতুল অবাক হয়ে গেছে।
ইমাদ দুষ্টু করে একটা হাসি দিয়ে বললো,”তোমার সঙ্গে আরও তিনজনকে একসাথে এমন করে ঘুরাতে পারবো।এটা আর এমন কি!’

পুতুল ইমাদের পা ধরে নিজে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না।
ইমাদ হাসছে শুধু।পুতুল আরেকটু এগিয়ে বসলো তারপর বললো,’তো বলুন’

-“ভালোবাসি’

-‘সেটা জানি।আমি জিজ্ঞেস করলাম একা একা কি করতেন ওসব বলুন আগে।’

ইমাদ পুতুলের চুলগুলোকে ঠিক করে দিয়ে বললো,’তোমার যেমন কেটেছে তার চেয়ে দুই গুন বেশি খারাপ ভাবে কেটেছে আমার।একটা পরোটা খেতে পারতাম না।তোমার সঙ্গে বসে খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।প্রতি রাতে তোমার হাত মুঠো করে না ধরলে তো ঘুমই ঠিকঠাক হতোনা আমার।কি আর করার! ছেলে মানুষ তো।কষ্টটা কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবেনা।’

-‘আর আমি বুঝি আমার কষ্ট বুঝতে দিতাম?’

-“ঠিক এই কারণে আমি তোমার সাথে গত দিনের কথা শেয়ার করতে চাইছিলাম না।বাদ দাও আর ঘুমাও”

-“ঘুমাবোনা।কি করবেন?’

-“জোর করে ঘুমাতে নিয়ে যাবো’

-“সেট কি করে?’

ইমাদ পুতুলের দুহাত ধরে দুম করে ওকে বালিশ পেতে শুইয়ে দিয়ে হাত ছেড়ে ওর মুখ টিপে ধরে বললো’চুপচাপ ঘুমাবা নাহয় কাঁদাবো’

পুতুল লজ্জায় টইটুম্বর হয়ে গেছে।ইমাদ ও হেসে ফেললো।
পুতুল আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে অন্যদিকে ফিরে গেছে।ইমাদ ওর পাশে শুয়ে ওর বামহাতটা মুঠো করে ধরে বললো,’তোমার এই লজ্জা আর গেলোনা’

-‘আমি চাইনা যাক’
——-
সন্ধার দিকে ইমাদ ঘুম ছেড়ে উঠে বসেছে।মাথাটা ধরে আছে।মাথার চুলগুলোকে টানতে টানতে পাশে তাকালো সে।পুতুল ওর হাতটাকে মুঠো করে ধরে আছে এখনও।সেও ঘুমে।জানালার বাহিরে চেয়ে দেখলো অন্ধকার নেমে এসেছে।মৃদু বাতাসে জানালার গোলাপি পর্দাটা বারবার উড়ছে।ইমাদ পুতুলের হাত ছাড়িয়ে একটু ঝুঁকে জানালা আটকে দিলো।
পুতুলের হাতে পাঁচটা মশা বসে একত্রে রক্ত খাচ্ছে।ইমাদ ঠাস করে মারতেই পুতুল লাফ দিয়ে উঠে বসতে গিয়ে ইমাদের কপালের সঙ্গে জোরে একটা বাড়ি খেয়ে গেছে।ইমাদ কপাল ঘষতে ঘষতে বললো’মশা ছিল রে’

-“ওহ!এমন করে কেউ?আমি কি সুন্দর আপনাকে নিয়ে নদী দেখতে গিয়েছিলাম।মাঝপথে দেখি নদী উধাও’

-‘রাতে যখন ঘুমাবে তখন দেখবে নদী আবার ব্যাক করেছে।এখন যাও চোখে মুখে পানি দেও।সন্ধ্যা নেমে গেছে।আমি দেখি চা বানানোর কিছু আছে নাকি রান্নাঘরে’

পুতুল মাথা নাড়িয়ে উঠতে গিয়ে বেসামাল হয়ে পড়েই যাচ্ছিল।ইমাদ ওকে ধরে ফেলে বললো,’একে তো ঘুমের ঘোর আরেক তো জ্বর’
——-
পুতুল চলে গেছে।ইমাদ রান্নাঘরে এসে সব পেলো শুধু চাপাতা আর দুধের গুড়ি পেলোনা।চিনি ও আছে।পুতুল ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার আগেই বাসার নিচের দোকানটা থেকে গিয়ে নিয়ে আসি বরং।
পুতুল ইমাদের তোয়ালেটা মাথায় দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো ইমাদ নেই।কই গেলো।দরজাও বাহিরে দিয়ে লক।এসময়ে কোথায় যেতে পারে ভেবে পুতুল জানালার গ্রিল ধরে নিচে তাকিয়ে থাকলো।দোকানের ছাদের কারণে কিছুই দেখা যায়না।পুতুল মন খারাপ করে বিছানায় বসে আছে।ইমাদ দশ মিনিট পর ফেরত আসলো চাপাতা আর মিল্ক পাউডার নিয়ে।পুতুল চোখ বড় করে বললো,’বলে যাওয়া যেতোনা?”

-“তোমার যে আবদার ।পরে আবদার করে বসতে নিচের দোকানটায় আমার সঙ্গে যাবে।যেটা কিনা পসিবল না।তাই গেলাম আর আসলাম।’

-“আমি গেলে কি এমন হয়ে যেতো?’

-‘ইহ!!পাইছে উনি!!আমি ওয়াসরুমে গেলে কি তুমিও যাবে নাকি?’

পুতুল মুখে হাত দিয়ে চুপ হয়ে গেলো ইমাদের কথা শুনে।আর কিছু বলবে না।বললেই ইমাদ লজ্জায় সাগর বানিয়ে দেবে।
পুতুলকে এমন লজ্জায় ফেলতে ইমাদের বেশ মজা লাগছে।আবার যদি ত্যাড়ামি করে তাহলে আচ্ছা করে লজ্জা দিয়ে দেওয়া হবে।
পুতুল জানালার পাশে শুয়ে জানালাটা একটু ফাঁক করে রাখলো।ঠিক সেসময়ে কারেন্ট চলে গেছে।ইমাদ কারেন্টের লোকদের বকাবকি করতে করতে মোম খু্ঁজছে।পুতুল জানালা দিয়ে দূর আকাশে সেই বড় তারাটা দেখছে।আকাশে আজ চাঁদ নেই।ইমাদ মোম এনে টেবিলের উপর রেখে বললো,’মশা কামড়ায় না তোমারে?আমি তো দু সেকেন্ড না নড়লে মশা জড়িয়ে ধরে আমাকে’

-এই যে একটু এদিকে এসে শোবেন?”

-“কেন?’

-‘বড় তারা দেখাবো’

-“আমি ছোট তারার প্রতি ইন্টারেস্টেড’

-“ধুর!যান চা বানান গিয়ে’

ইমাদ মোম রেখে চলে গেছে।চা পাতার গন্ধ এসে নাকে লাগছে।পুতুল তারাটা দেখা বাদ দিয়ে বিছানা ছেড়ে নামলো।ছোট থেকে যখন কারেন্ট চলে যেতো অন্ধকারে সে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে বাসার অন্যদের ভয় দেখাতো সে।
এখনও তাই করবে।ভয় দেখাবে ইমাদকে।ইমাদ হাত পা ঝাঁকিয়ে চা বানাচ্ছে, মশার জ্বালাতনে থাকা যাচ্ছেনা।বাসার সামনেই ডোবা।যার কারণে মশা তার গুষ্টিসমেত এসে হাজির হয়েছে।পুতুল একটু একটু করে ওর কাছে এসে পেছন থেকে ঝাপটে ধরে বললো,’ধরে ফেলেছি’

-“ভালো করেছেন”

-“মানেহ!!’আপনি ভয় পাননি?’

-“একটুও না’

-“ধুর!ভয় পাবার কথা তো।আমি ভয় পাবার মতন কাজ করলাম”

-“অন্ধকার তো কি হয়েছে?তোমার হাতের চুড়ির আওয়াজ বলে দিয়েছে তুমি আসছো আমার কাছে”

পুতুল মন খারাপ করে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো।ইমাদ চা পাতা এক চিমটি নিয়ে ওর দিকে মেরে দিয়েছে।সে মুখে মুছে বললো,’মাকে ফোন করেছিলেন?’

-“হুম।ব্যস্ত মনে হয়’

-“ওহ।আচ্ছা কারেন্ট আসছেনা কেন?’

-“জানিনা।এত দেরি কেন।যাই হোক।গিয়ে বসো।এত ছোট রান্নাঘরে অন্ধকারে থাকা ঠিক নয়।ধাক্কাধাক্কিতে চোট পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’

পুতুল ইমাদকে দেখিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ফটাফট হাতের চুড়ি খুলে রেখে দিয়ে আবারও ইমাদের পাশে গিয়ে হাজির।আস্তে করে ইমাদের শার্টটা খাঁমছে ধরলো সে।ইমাদ এবার ভয় পেলো।একেবারে বিশাল আকারের ভয়।পেছোতে গিয়ে পড়েই যাচ্ছিল,পুতুল ওকে ধরতে গিয়ে দুজনে পড়ে গেলো শেষে।ব্যাথা পেলো ইমাদ।
ঘাড়ে হাত রেখে বললো,’আমি শেষ’

-“সরি আমি জানতাম না আপনি এত ভয় পাবেন”

-“তোমার মতন দুষ্ট বউ আর কেউ যেন না পায়।আমি মনে হয় আজ সোজা হয়ে শুতে পারবো না।ঘাঁড় শেষ আমার।সরবা নাকি আমি ধরে সরাইতাম?’

পুতুল জিভে কামড় দিয়ে সরে বসলো।ইমাদ উঠে ঘাড়ে হাত দিয়ে চলে গেছে রুমের দিকে।পুতুল চোরের মতন এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে।
ইমাদ ওর দিকে তাকিয়ে বললো,’শান্তি হয়েছে?”

-“সরি তো।এড বকছেন কেন?আমি কিন্তু একা একা ঢাকায় চলে যাবো’

-‘আমাকে হুমকি দিচ্ছো?গিয়ে দেখাও’

পুতুল নাক মুছে সোজা চললো দরজার দিকে।ইমাদ এগিয়ে এসে আটকালো ওকে।তারপর টেনে এনে বিছানার কাছে দাঁড় করিয়ে বললো,’ঢং করতে হবেনা।আমার ঘাড় চেপে দাও।ব্যাথা কমে আসবে।
হেহ!উনি এখন ঢাকায় যাবেন।টাকা আছে তোমার কাছে?”

পুতুল ভেংচি কেটে বিছানায় উঠে ইমাদের ঘাড়ে হাত রেখে চাপতে চাপতে বললো,’টাকা ঢাকায় গিয়ে আসাদ ভাইয়ার থেকে নিয়ে দিতাম।এ আর এমন কি?’

ইমাদ চোখ বন্ধ করে রেখেছে।ভালো লাগছে অনেক।
চলবে””

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৪৯
Writer-Afnan Lara
.
-‘জানি না কেন!আপনার ঘাড়টা চাপতে গিয়ে মন চাইলো মাথার এই ঘন চুলের বনটাকে টেনে ছিঁড়ে এলোমেলো করে ফেলতে।যদি অনুমতি দেন তাহলে করবো।’

-‘তারপর তোমার চুল আমি ছিঁড়বো।ডিল?’

-“ধুর!!’
——–
ভালোবাসার দিন কটাদিন এগিয়ে এসেছে।বলতে গেলে আজ ইমাদ আর পুতুলের কুমিল্লা থাকার একটা মাস পূর্ন হয়েছে।এখনও এক মাস বাকি।পুতুল এখন বাসাতেই রান্না করে।বাহিরে থেকে খাওয়া হয়না।মনে হয় এখানেই মন টিকে গেছে।ট্রেন কখন আসে আর কখন যায় সে অপেক্ষায় ঘড়ির কাঁটা চেক করে সে।এতটা দিন হলো তাও ট্রেন দেখতে গিয়ে তার বিরক্তি এক ইঞ্চিও আসেনি।এখনও তাই করছে।গ্রিল ধরে ট্রেন আসতে দেখছে সে।ইমাদ অফিস থেকে এই তো এখনই ফিরবে।বাসার মালিকের বউ ফিরনি বানিয়েছিল।ওগুলো দু বাটি পাঠিয়েছেন।সেসব ইমাদ খাবে।পুতুল খাবেনা।তার কাছে ফিরনির স্বাদটা তেমন একটা ভালো লাগেনা।দু বাটি ইমাদই খেতে পারবে।তার আবার ফিরনি অনেক পছন্দের।
ইমাদ চুপিচুপি বাসায় ঢুকেছে।চাবি তার কাছে ছিল।পুতুল গ্রিল ধরে আনমনে চলতি ট্রেন দেখছিল।ইমাদ আস্তে করে হাতের ব্যাগটা রেখে পা টিপে টিপে বিছানায় উঠেছে।এরপর পুতুলকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরলো সে।পুতুল চমকে পেছনে ফিরে তাকিয়ে ইমাদকে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বললো,’আমি ভয়ে মরেই যেতাম।এরকম করলেন কেন?’

-“ট্রেন বেশি নাকি বর বেশি?’

-‘দুটোই’

-“এ্যাহ!!!শোনো মেয়ের কথা!’

-“আপনার ফোন বাজছে দেখতে পাচ্ছেন না?নাকি চোখেমুখে শুধু আমাকেই দেখেন?’

ইমাদ ফোন হাতে নিয়ে দেখলো মায়ের কল।রিসিভ করে সবার আগে জিজ্ঞেস করলো মা কেমন আছে।মা গম্ভীর গলায় জবাব দিচ্ছেন সব কিছুর।

-‘কি হয়েছে মা?শরীর খারাপ নাকি তোমার?’

-‘তোর বিয়ের ২মাসের বেশি হয়েছে অথচ এখনও আমি নাতিপুতি আসার কোনো খবর পাচ্ছি ন
না।আবদার করিনি?’

ইমাদ পুতুলের দিকে তাকালো।পুতুল ইমাদের হাতের আঙ্গুল নিয়ে দুষ্টুমি করছিল। ইমাদ বললো,’খুব শীঘ্রই খুশির খবর পাবে’

মা কল কেটে দিয়েছেন।পুতুল ইমাদের হাত ধরে টান দিয়ে বললো,’মা কি বললেন?’

-“বললেন নাতিপুতির খবর কবে আসবে’

ইমাদের মুখে কথাটা শুনে পুতুলের মন খারাপ হয়ে গেলো।মূহুর্তেই ইমাদের হাত ছেড়ে দিলো সে।অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসলো এবার।ইমাদের মুখেও কথা নেই।পুতুল আবার মাথাটা ঘুরিয়ে বললো,’একই খবর তো আমিও জানতে যাই।এত দেরি কেন তাহলে?’

-“আমি জানি না।বাদ দাও এসব।চলো দুপুরের খাবার খাবো।এসব ভেবে মন খারাপ করতে হবেনা।’

পুতুলের খাওয়া উঠে গেছে মিসেস রওনক কল করার পর থেকে।তাও ইমাদের ভয়ে দু চার লোকমা সে খেয়ে নিয়েছে।ইমাদ ঘুমিয়ে আছে অথচ পুতুলের চোখে ঘুম নেই।ট্রেনবিহীন সেই রাস্তাটা দেখছে সে।
-‘আচ্ছা একটু -আকটু দেরি হওয়া কি স্বাভাবিক??
না এখনও তো তেমন সময় হয়নি।শুধু শুধু মন খারাপ করছি আমি।’
—–
ইমাদের ঘুম ভাঙ্গতেই দেখতে পেলো পুতুল ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে সেখানে বসে বসে বাবুর কাঁথা সেলাই করছে।ইমাদ বিছানা থেকে নেমে বললো,’এগুলো আজকাল রেডিমেড ও পাওয়া যায়।তুমি শুধু শুধু এত কষ্ট কেন করছো?’

-“শুধু শুধু কি বলছেন!নিজের সন্তানের জন্য নিজে বানাতে কোনো কষ্ট হয় নাকি।বরং ভালোবাসা বাড়ে।’

ইমাদ আর কি করবে।সে জানে পুতুলকে এসব বলে লাভ নেই তাই সে নিজের কাজে চলে গেলো।পুতুল সন্ধ্যা থেকে দুটো কাঁথা সেলাই করলো পাক্কা পাঁচ ঘন্টা ধরে।শেষে কাঁথা গুছিয়ে রেখে দিয়েছে।ইমাদ সামনের দোকানগুলোতে গেছে হালকা বাজার করতে।বাসার অনেক কিছুই শেষ হয়ে গেছিলো।বাসায় টিভি নেই বলে পুতুল ফোনে ইউটিউব দেখে সময় কাটায়।এখনও তাই করছে।এখটা নাটক দেখছে।একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখে পুতুলের মন খারাপ চরম পর্যায়ে চলে গেলো।নাটকটাতে নায়িকার বাচ্চা হয়না বলে তাকে তার স্বামী ছেড়ে দেয়।
পুতুল থ হয়ে বসে রইলো।ইমাদ আজ ফেরার সময় ডালপুরি কিনে এনেছে।ভেতরে আসতেই দেখলো পুতুল কাঁদছে বসে বসে।চোখ কপালে তুলে ওর কাছে এসে ইমাদ জিজ্ঞেস করলো যে কি হয়েছে।
পুতুল বললো সে একটা নাটক দেখেছিল।কাহিনীটা বললো সে ইমাদকে।
ইমাদ পুরি মুখে দিয়ে দূরে সরে বললো,’তোমাকে না বললাম এসব নিয়ে ভাববে না।আবারও শুরু করলে?নাও পুরি খাও।সারাদিন ভুলভাল ভাবনা চিন্তা করবে আর কাঁদবে।রেডিমেড চোখে পানি জমিয়ে রাখো তুমি?’

-‘আপনি বুঝবেন না!’

-‘আরে আমি বুঝবো না তো কে বুঝবে?’
——
এমনটা করে আজকে দু মাস পূর্ন হয়ে গেছে।ইমাদ পুতুলকে নিয়ে ঢাকায় ফিরছে আজ।ট্রান্সফার বাতিল করতে কত কাঠখড় তাকে পোড়াতে হয়েছিল এই দুইটা মাস ধরে।অবশেষে সফল হলো সে।পুতুল মন খারাপ নিয়ে বাসে ইমাদের পাশের সিটে বসে আছে।বাইরের এত মিষ্টি বাতাস তার গায়ে লাগলেও মনে লাগছেনা।ঠোঁটে হাসি নেই।রঙহীন হয়ে আছে।ইমাদ হাসতে গিয়েও পারছেনা।পুতুলের এমন মন খারাপ করে থাকা দেখলে তার হাসি আসেনা।ওকে হাজার বার বুঝিয়েও কোনো লাভ হয়নি।পুতুল ধরেই নিয়েছে সে আর মা হতে পারবেনা।মাত্র দু মাস দেখে সে এমনটা কেন বলছে এই নিয়ে আজ সকালেও কথা কাটাকাটি হয়েছিল তাদের।বাসার পৌঁছানোর পর তারা দেখলো মিসেস রওনক টেবিল সাজিয়ে রেখেছেন হরেক রকম মিষ্টি দিয়ে। তিনি ভেবেছিলেন ওরা সারপ্রাইজ দেবে হয়ত নাতিপুতির খবরটা।পুতুলের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে দেখে তিনি ইমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,’কিরে??’

-“মা এসব নিয়ে পরে কথা বলি?অনেক টায়ার্ড ‘

পুতুল ইমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে রুম অবধি এসে ফ্লোরে বসে পড়েছে।ইমাদ ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিরুপায় হয়ে।পুতুল চোখ মুছতে মুছতে বললো,’আমি কিছু শুনতে চাইনা।হয় আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবেন নাহয় বাপের বাড়ি দিয়ে আসবেন’

ইমাদ ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে পুতুলের মুখ দুহাত দিয়ে ধরে বললো,’শোনো!আর কটা মাস দেখো।তারপর নাহয় ডাক্তারের কাছে যাব’

-‘এটা নরমাল না।আপনি বোঝেন না আমার কষ্ট।আপনার মা এসব বুঝবে না।আমাকে খোঁটা দেবে।আমি চাইনা সেসব শুনতে।প্লিজ আমাকে বাবার বাসায় নিয়ে চলুন।আপনাকে থাকতে হবেনা।আপনি এখানেই থাকিয়েন’

-“নাহ।কেউ কোথাও যাবেনা।তুমি এখানেই থাকবে।মা তোমাকে কিছু বলবেনা।’

ইমাদ উঠে গিয়ে আলমারি খুলে ব্যাগ থেকে সব জামাকাপড় নিয়ে এক এক করে রাখছে।
পুতুল ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ইমাদের কাছে এসে বললো,’যেদিন শুনবেন মনের ভয়টা সত্যি সেদিন তো ঠিকই দিয়ে আসবেন”

ইমাদ রেগেমেগে পুতুলের দিকে তাকিয়ে কিছু বললো না। চুপচাপ একটা চড় মেরে দিলো।তারপর ওকে ঝাঁকিয়ে বললো,’বাচ্চার জন্য বিয়ে করিনি তোমাকে।বুঝছো?এই সহজ কথা মাথায় সেলাই করে নাও।আরও দরকার পড়বে।চুপচাপ হাত মুখ ধুয়ে ঘুমাও আর নয়ত খেলে গিয়ে খাও।আমাকে ইমোশনালি টর্চার করবা না।এমনিতেও দু মাস কম টর্চার করোনি।কোনো কিছু অগ্রিম ভাবা ঠিক না’

পুতুল গালে হাত দিয়ে ইমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে
একটুও ব্যাথা পায়নি।তবে চড়ের কারণে মনে হলো তার হুস ফিরে এসেছে।এতক্ষণ কিসের একটা ঘোরের মাঝে ডুবে ছিল সে।ইমাদ ওকে ছেড়ে বারান্দায় চলে গেছে।
মিসেস রওনক মিষ্টি বক্সে পুরতে পুরতে ইমাদের রুমের দিক তাকাচ্ছেন শুধু।এই নিয়ে পঁচিশ বার তাকালেন।দুজনের একজনেও বের হচ্ছে না।সমস্যা টা কি!!

পুতুল চাদর মুড়িয়ে শুয়ে আছে।ইমাদ গোসল সেরে রুম থেকে বের হতেই দেখলো মা মিষ্টির প্লেট নিয়ে হাজির।সেখান থেকে একটা মিষ্টি নিয়ে ইমাদ সোফায় গিয়ে বসলো।মিসেস রওনক রুমের ভেতর উঁকি মারলেন।পুতুল শুয়ে আছে দেখে দাঁত কেলিয়ে ইমাদের সামনে বরাবর বসে গপাগপ দু চারটা মিষ্টি নিজেই খেয়ে ফেলেছেন।ইমাদ টিভি দেখছে।পুতুল উঠে বসে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে।ভাবছে এখন যদি ইমাদ আসতো!!

ইমাদের টিভিতেও মন বসছেনা।এদিকে মা একটা চ্যানেল ধরিয়ে দিছেন, ওখানে বাচ্চাদের কি করে লালন পালন করতে হয় তার টিপস বলে যাচ্ছে অনর্গল।মা আগ্রহ নিয়ে দেখছেন।ইমাদ উঠে গিয়ে তার রুমে ঢুকতেই পুতুলের সাথে চোখাচোখি হলো।পুতুল চোখ নামিয়ে ফেলেছে সাথে সাথে।বোঝাতে চাইছে সে অভিমান করেছে ওর উপর।ইমাদ সোজা রেডি হয়ে হঠাৎ কোথায় যেন চলে গেছে।পুতুলের সঙ্গে মনমালিন্য বলে কথা বলা হয়নি কোথায় যাচ্ছে তা নিয়ে।
মাও কিছু জিজ্ঞেস করেননি কারণ তিনি টিভি শো দেখতে ব্যস্ত।
রাত দশটার দিকে বাবা ফিরেই ইমাদের কথা জিজ্ঞেস করলেন।মা বললেন সে এখনও ফেরেনি।পুতুল ফোন নিয়ে দুবার কল করলো ওকে।শেষের বার রিসিভ করেছে ইমাদ।

-‘আপনার সমস্যা কি?বাসায় আসছেন না কেন?নতুন বউ পেয়েছেন নাকি?’

-“ঠিক করে কথা বলবা।নতুন বউ পেয়েছি মানে?তোমাকে দুপুরে কি বলেছিলাম?বিয়ে করেছি বাচ্চার জন্য?তাহলে এই কথা আবার আসে কেন?”

-“আপনি তো আমায় বিয়ে করেছেন বারবার কষ্ট দেওয়ার জন্য’

-“আমার ইচ্ছা আমি কখন ফিরবো।তোমার কি?ফিরলেই তো শুরু করবা ‘

পুতুল রাগ করে কল কেটে রেখে দিয়েছে।তার সব অভিমান ছেড়ে ইমাদকে বাসায় আসার জন্য কল করেছিল সে।উল্টে কথা শুনিয়ে দিলো।
-‘মনে হয় সব দোষ আমার নিজের।’

ইমাদ রিজবি,চঞ্চলের সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলছিল।দু মাস দেখা হয়নি বলে ওদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল সে।
রাত এগারোটার দিকে বাসায় ফিরেছে সে।মা বাবা ঘুমাচ্ছেন। চাবি নিয়ে গিয়েছিল যাবার সময়।তাই অনায়াসে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে পেরেছিল।পুতুল ডাইনিং টেবিলের কাছে চেয়ারে বসে টেবিলের উপর মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে।ইমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল হয়ত।
ইমাদ ওর কাছে এসে মাথায় হাত রাখতেই জেগে গেলো সে।মুখটা গম্ভীর করে বললো,’খাবারটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।বসুন আমি গরম করে আনছি”

ইমাদ পুতুলের হাত ধরে আটকালো।পুতুল পেছনে তাকিয়ে বললো,’কি হয়েছে আবার?’

ইমাদ পুতুলের প্রশ্নের কোনো জবাব দিলো না।নিচু হয়ে ওকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরলো।পুতুল ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,’আজকে আপনার ওরকম ব্যবহারের কারণ আমি।তাই মাফ চাইতে হবেনা।আমি অতিরিক্ত করেছিলাম এই বিষয়টা নিয়ে।আসলেই তো দু মাস কোনো সময়ই না।আমাদের আরও অপেক্ষা করা উচিত।কিন্তু কি করবো।আপনার মায়ের প্রতিদিনকার হাজারটা কল আমাকে ব্যাকুল করে তুলতো এই ব্যাপারটা নিয়ে। আমি জানিনা কি হবে আমি আসলে….’

ইমাদ পুতুলকে নামিয়ে দিয়ে মুখে হাত দিয়ে থামিয়ে ফেললো ওর কথাবলা।
তারপর ফিসফিস করে বললো,’তুমি তো বাচ্চা।সব কিছু দেরিতে বোঝো।সমস্যা নেই।মেরে মেরে ঠিক করতে পারবো আমি।’

পুতুল ইমাদের গলায় হাত রেখে বললো,’আমাকে অনেক ভালোবাসেন তাই না?’

-‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’

-‘এমনি।মাঝে মাঝে ভালোবাসার মানুষের মুখ থেকে ভালোবাসি শুনতেও ভালো লাগে।যারা বোঝে তারা সারাদিন বলতে থাকে।তখন ওপাশের মানুষটা তার কদর করতে জানেনা।
আর যারা বোঝেনা তারা মাসে একবার বলে আর ওপাশের মানুষটা হারে হারে টের পায় এই কটা শব্দের ভেতর কি মুগ্ধতা লুকিয়ে আছে।কি শান্তি পাওয়া যায় এতে’
চলবে”