বাবুই পাখি পর্ব-৫০+৫১

0
916

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৫০
Writer-Afnan Lara
.
পরেরদিন সকালে ইমাদ একটু জলদি চলে গেছে অফিসে।অনেক কাজ।তার উপর বস খেঁপে আছেন ওর উপর।ট্রান্সফার ক্যানসেল করেছিল তাই।পুতুল নাস্তা রেডি করে না খেয়েই বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে।তার উদ্দেশ্য হসপিটাল।
ডাঃ শায়লা উর্মির চেম্বারে যাবে।কাল রাতে ইমাদের ছোঁয়ায় তার মনে হয়েছে ইমাদ যদি তাকে ছেড়ে যায় সে নিজেকে বাঁচাতে পারবেনা।ইমাদকে তার চাই।তাই আগে থেকেই ডাক্তারের শরণাপন্ন হবে।মিসেস রওনককে কিছু বলতে হয়নি।কারণ তখন উনি বাসায় ছিলেন না।
সকাল সকাল জগিংয়ে গিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছেন।হয়ত রোডে কোনো কলিগের দেখা পেয়েছেন।মিসেস রওনক আবার কলিগ পেলেই সময় বরবাদ করেন।এমনি এমনি গসিপিংয়ে সময় নষ্ট করেন না।
ত্রিশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করার পর পুতুলের সিরিয়াল এসেছে।কপালের আর গলার ঘাম মুছে সে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলো।
ফর্সা মতন একজন ভদ্র মহিলা বসে আছেন।তিনিই শায়লা উর্মি।পুতুলকে দেখে মুচকি হেসে বললেন,’কি সমস্যা বলুন’

পুতুল ঘাম মুছে চুপ করে আছে।কি থেকে শুরু করবে তাই ভেবে পাচ্ছেনা।

-‘শান্ত হোন।নিন পানি খান’

পুতুল ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে সোজা হয়ে বসে বললো,’আমি বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করছি বিগত দুমাস ধরে..কিন্তু!!!’

-‘আচ্ছা বুঝলাম।কিন্তু দুমাস তো একেবারে কম সময়।আরও অপেক্ষা করা উচিত আপনার’

-“না মানে আমি জানতে চাই আমি মা হতে পারবো নাকি পারবো না?কোনো পরীক্ষা নেই এমন?’

-‘অবশ্যই আছে।তবে পরীক্ষাটা আরও এক মাস পর করেন।আমি সাজেশন দিলাম’

-‘না প্লিজ।আমি আজকে করতে চাই।’

-‘আপনার এসব বিষয়ে ধারনা একেবারেই কম।তারপরেও আমি টেস্ট গুলো লিখে দিচ্ছি।এটার রেসাল্ট এক সপ্তাহ পরে আসে।ততদিন তো অপেক্ষা করতে পারবেন নাকি?’

পুতুল মাথা নাড়িয়ে কাগজ হাতে বেরিয়ে গেলো।সব টেস্ট করিয়ে বাসায় ফিরতে ওর দুপুর দুটো বেজে গেছে।এসে দেখলো ইমাদ সোফায় বসে আছে।তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই পুতুলের হাঁটা বন্ধ হয়ে গেছে।ইমাদ উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’কোথায় গিয়েছিলে?’

-‘বাবার বাসায়’

-‘কেন? ‘

-“এমনি’

-‘দুপুরের রান্না তো করোনি তাহলে।আমি বাইরে থেকে কিনে আনছি’

পুতুল মাথা নাড়িয়ে রুমের ভেতর চলে গেছে।টেস্টের কাগজটা আলমারিতে লুকিয়ে দম ফেললো সে।ইমাদ হোটেলে খাবার অর্ডার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সেখানে দেখা হলো পুতুলের বাবার সঙ্গে।উনি এখানে একজন দাঁতের ডাক্তার দেখাতে এসেছিলেন।কদিন ধরে তার দাঁতে অসহ্যকর ব্যাথা হচ্ছিল।অবশেষে এখন ডাক্তার দেখাতে এলেন পুতুলের মাকে নিয়ে।ইমাদকে দেখে থেমেছেন তিনি।ইমাদের সঙ্গে কথার ছলে পুতুলের কথা জিজ্ঞেস করলেন উনি।

-‘ও তো আপনাদের বাসায় গিয়েছিল আজ।’

-‘তাই নাকি?কখন?বাসায় তো তালা ঝুলানো।পুতুলের খালা নাই,আসাদ ও নাই। সে বন্ধুদের সঙ্গে জাফলং গেছে। ‘

ইমাদ বুঝতে পারলো পুতুল তাকে মিথ্যা বলেছে।।তাও সে মুচকি হেসে কথা কাটিয়ে দিলো ওর বাবা মায়ের সঙ্গে।অনেক জোর করেও তাদের আনতে পারলো না।তারা চলে গেছে বাসার দিকে।খাবারের প্যাকেট হাতে বাসায় ঢুকে দরজা লাগালো ইমাদ।পুতুল রুমে পায়চারি করছে শুধু।ইমাদ রুমে আসতেই ওর পায়চারি বন্ধ হলো।ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বললো,’বসুন।আমি খাবার রেডি করছি’

ইমাদ পুতুলের চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গেলো ডাইনিং টেবিলের দিকে।পুতুল আঁচল কোমড়ে বেঁধে ইমাদের জন্য খাবার প্লেটে নিচ্ছে।ইমাদ ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

-“কি হলো?খাচ্ছেন না কেন?’

-‘তুমি সহ খাও।বসো’

-“আমি পরে খাব।খিধে নেই’

-‘মা ভালো রান্না করেছিল বুঝি?’

-“হ্যাঁ।মুগ ডাল,মাংস….’

-‘আর একটা কথাও না পুতুল।আমি খবর পেয়েছি তুমি তোমার বাবার বাসায় যাওনি ‘

পুতুল কথাটা শুনে চুপ করে থাকলো।ইমাদ আর কিছু বললো না।খাবার শেষ করে রুমে চলে গেছে সে।পুতুল তার খাবার ঢেকে রেখে ইমাদের পিছু পিছু আসলো।ইমাদ বিছানায় গিয়ে বসতেই পুতুল ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,’আমি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম’

-“তো ডাক্তার কি বলেছে?’

-“টেস্ট করতে দিয়েছি।এক সপ্তাহ পরে আসবে’

-“ওহ তাহলে ততদিন তুমি টেনসনে থাকবে।যদি আসে তুমি মা হতে পারবেনা তাহলে আমি তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি সেই ভাবনা।তাই না?’

পুতুল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।ইমাদ মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লো।পুতুল এবার ওর পিঠে হাত রেখে বললো,’আমি জানি আপনি আমাকে কখনও ছেড়ে যাবেন না। কিন্তু বিশ্বাস করেন।আমি এত চিন্তা মাথায় নিতে পারছিনা।একটা রাত ও ভাল করে ঘুমাতে পারিনা এসব ভাবতে গিয়ে।যাই হোক না কেন।
পজিটিভ খবর কিংবা নেগেটিভ।শুধু জানতে চাই ভবিষ্যতে আমার ভাগ্য কোনদিকে যেতে পারে।’

ইমাদ উঠে বসে পুতুলের হাত ধরে ওকে সামনে বসালো তারপর দুহাত দিয়ে ওর মুখ গোল করে ধরে বললো,’শোনো!এমন অনেক কাপল আছে যাদের দশ বিশ বছর পর বাবু হয়েছে।সুতরাং যাই হয় আল্লাহর ইচ্ছাতে হয়।তুমি যে বললা ভবিষ্যত তোমার জন্য কি বয়ে আনবে তা জানতে চাও। হয়ত টেস্টে আসলো মা হতে পারবেনা।কিন্তু বছর পেরোতে না পেরোতেই তুমি সুখবর পেলে।তখন?’

-‘আপনকে আর সান্ত্বনা দিতে হবেনা।’

পুতুল সোজা চলে গেলো ভাত খাবে বলে।ইমাদ মুখ বাঁকিয়ে শুয়ে পড়েছে।আজকে বসের চিল্লানি শুনেছে অনেক সময় ধরে।
-‘ট্রান্সফার ক্যানসেলই তো করেছি।কি এমন ক্ষতি হলো?আর অফিসের সুমন নামের একজন আছে সে আমার চেয়ে ভালো কাজ পারে।তারে পাঠালে কি হয়?’
——–
আজকে বুধবার।টেস্টের রেসাল্ট আসার দিন।পুতুলের কাল সারারাত ঘুম হয়নি।চোখের নিচে কালো দাগ বসেছে।মিসেস রওনক আজকে ছুটি নিয়ে বসে আছেন বাসায়।তার নাকি শরীর ভালো লাগছেনা।এখন টেস্টের পেপার আনতে যাবে কি করে তাই ভাবছে পুতুল।কোনোমতে একটা বাহানা দিয়ে বের হলো সে।জলদি পায়ে হেঁটে একটু দূরে গিয়ে রিকশা নিলো।মনের ভেতর চাপা ভয় মনে হয় ফুলে ফেঁপে এবার আকাশ ছোঁবে।
বারবার হাত মুঠো করছে পুতুল।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।হসপিটালে এসে চৌদ্দ বার রিসিপশানে গিয়ে তাড়া দিয়েও লাভ হয়নি।রেসাল্ট আসতে নাকি এক ঘন্টা লাগবে আরও।
এদিকে পুতুলের অজ্ঞান হবার মতন হাল।খাওয়া দাওয়া সব ছেড়ে দিয়েছে এই খবর শোনার জন্য।ইমাদ ফোন করে দুবার খবর নিয়েছে ওর।
পুতুল চোখ বন্ধ করে বসে আছে।শেষে তার ডাক পড়লো।শায়লা উর্মির চেম্বারে।সালাম দিয়ে ভয় নিয়ে চেয়ার টেনে বসলে সে।শায়লা উর্মি টেস্টের রেসাল্টের পাতা উল্টাচ্ছেন।মুখটা তার গম্ভীর।

-‘কি হলো??বলুন না।আমি আর অপেক্ষা করতে পারছিনা।’

-‘যে সমস্যা টা হলো সেটা কোনো বড় সমস্যা না।হয়ত দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার আওতায় আসলে আপনি অব্যশই মা হতে পারবেন।’

পুতুলের মনে হলো পায়ের তলার মাটি সরে গেছে।সবসময় নাকি নেগেটিভ ভাবলে পসিটিভ হয়।আজ পর্যন্ত সে নেগেটিভ ভেবে এসেছিল আর আজ ফলাফল সেই নেগেটিভই আসলো।মাথা ঘুরছে তার।শায়লা উর্মি এসি বাড়িয়ে বললেন,’আপনি চিন্তিত হবেন না।আমি একটা কার্ড দিচ্ছি। এই ডাক্তার সেসব দম্পতির উপকার করতে পেরেছেন যারা বছরের পর বছরেও সন্তানের মুখ দেখতে পারেননি।তার চিকিৎসা মতন চললে আপনিও সুখবর পাবেন।’

পুতুল কার্ড হাতে রোবটের মতন হেঁটে চলেছে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে।কেন তার সাথেই এমন হলো?
ইমাদের মাকে সে কি জবাব দেবে?উনি যদি বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন?যদি ইমাদের অন্য কোথাও বিয়ে ঠিক করেন?আমার কি হবে?ঐ নাটকের নায়িকার মতন হাল কি আমারও হবে?

পুতুলের মাথা ঘুরছে।হাঁটতে পারছেনা।মনে হয় এই বুঝি পড়ে যাবে।শেষে অনেক কষ্টে বাসায় পৌঁছালো সে।মিসেস রওনক টিভি দেখছিলেন। পুতুলকে দেখে বললেন,’তোমার বাড়ির সবাই দুপুরের খাবার না খাইয়েই তোমাকে আসতে দিলো এত জলদি?’

পুতুল উনার দিকে তাকিয়ে মুখটা ফ্যাকাসে করে রুমে চলে গেছে।ফোন নিয়ে ইমাদকে কল করলো সবার আগে।ইমাদ ওকে বললো চিন্তা যেন না করে।সে এসে প্রবলেম সলভ্ করবে।
পুতুলের কান্না পাচ্ছে।চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।কিন্তু পারছেনা।কষ্ট চেপে রাখতে হবে।মিসেস রওনক জানা মানে তার এই বাসায় থাকা অসহনীয় হয়ে ওঠা।
আচ্ছা উনি তো একদিন না একদিন ঠিক জানবেন।তখন কি হবে আমার??
এটা ভেবে পুতুল মাথা ধরে নিচে বসে গেছে।ইমাদ অফিসের কাজ জলদি সেরে বাসায় ফিরে আসলো।মা একা একা ভাত খাচ্ছেন।মায়ের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসি দিয়ে সে রুমে ছুটে গেলো।পুতুল রুমের এক কোণায় ফ্লোরে বসে আছে হাত পা ছড়িয়ে।কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখের অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে।ইমাদ রুমে ঢুকে দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে ওর কাছে এসে বসলো নিচে।চোখ মুছে দিয়ে বললো,’আমি আছি না?এভাবে কাঁদছো কেন?উঠো’

পুতুল ইমাদের হাত জড়িয়ে ধরে বললো,’আপনি আমাকে ছেড়ে দেবেন না তো?’

ইমাদ একটা ধমক দিয়ে পুতুলকে উঠিয়ে দাঁড় করালো।পুতুল কান্নার কারণে কিছু বলতে পারছেনা।ওকে বিছানায় বসিয়ে ইমাদ হাঁটু গেড়ে বসলো নিচে।
ওর দুহাত ধরে বললো,’আই লাভ ইউ পুতুল।কখনও কোনো সিচুয়েশন আসবেনা যেটাতে কিনা আমি তোমায় ছাড়ার কথা ভাববো।আজ যা হয়েছে তা আমাদের কপালে ছিল।এর মানে তুমি কি করে ধরে নিতে পারলে আমি তোমায় ছেড়ে দিবো?আগেও বলেছি এখনও বলছি।আমি তোমায় বাচ্চার জন্য বিয়ে করিনি।টেস্ট এই জন্য করাতে মানা করেছিলাম।ভবিষ্যতে খারাপ ঘটবে তা আগে থেকে জানলে মানুষ বেঁচে থাকা ভুলে যায়।তুমি করেছো তাই।অথচ কাল সকালেও আমি তোমার মুখে হাসি দেখেছিলাম আর আজ অশ্রুর জন্য কিছুই দেখছিনা।
পুতুল এমন কেন করছো?আমাকে কি তোমার সন্দেহ হয়?’
পুতুল উত্তর দিচ্ছেনা দেখে ইমাদ উঠে দাঁড়িয়ে টিস্যু বক্সটা পুতুলের দিকে বাড়িয়ে ধরেছে।
পুতুল মাথা তুলে ওকে একবার দেখে চট করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। ইমাদ ওর মাথায় হাত দিয়ে বুকে টেনে নিলো ওকে।

-‘আমি আপনাকে বাচ্চার মুখ দেখাতে পারবো না ইমাদ।’

-‘কেন পারবেনা।অবশ্যই পারবে।অপেক্ষা করবো নাহয়।ক্ষতি কি?এই সমস্যার সমাধান নিশ্চয় হবে’

-‘আপনার মাকে কি জবাব দিব বলুন।আমি আর ভাবতে পারছিনা’

-‘মায়ের মুখোমুখি আমি হবো। তুমি না।’

-‘ইমাদ শুনছিস??’

-‘আসছি মা’

ইমাদ পুতুলকে ছেড়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
দরজার ওপারে মা কোমড়ে হাত দিয়ে ইমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন।ইমাদ জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে বললো,’কি হয়েছে?’

-‘তোর বউয়ের কি কোনো সমস্যা আছে?”

-“মানে?’

-“মানেটা তুই জানিস।আমি শুনতে পেয়েছি,
কিসের সমস্যার কথা বলছিলি তোরা?’

ইমাদ বড় করে শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো,’আমার সমস্যা। ওর না’

-‘মানে?’

-‘মানে বাচ্চা না হবার কারণ আমি।আমার সমস্যা আছে’

চলবে”

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৫১
Writer-Afnan Lara
.
-‘আমি এক বিন্দু ও বিশ্বাস করিনা।মিথ্যা কথা বললেই সেটা সত্য হয়ে যায়না’

মায়ের আপত্তি দেখে ইমাদ হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়েছে।সে বোঝাতে চায় তার নিজের কথায় সে অটল।
মা এখনও ওর উত্তরের আশায় চেয়ে আছেন।
ইমাদ আবার বললো,’বিশ্বাস করলে করো।না করলে নাই।এটাই সত্য’

কথা শেষ দিয়ে ইমাদ এক প্রকার পালিয়েই এসেছে সোফার রুম থেকে।পুতুল দরজার কিণারায় দাঁড়িয়ে সব শুনছিল।ইমাদ স্বাভাবিক ভাবে আলমারি থেকে বাসায় পরার কমন টিশার্ট একটা নিয়ে চলে গেছে বাথরুমে।পুতুল চোখ মুছতে যেতেই দেখলো তার সামনে মিসেস রওনক এসে দাঁড়িয়েছেন।ওকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বললেন,’আমি জানি যা সমস্যা সব তোমার।আমার ছেলের মাথা তো অনেক আগেই খেয়েছো।জানি তো সে তোমাকে বাঁচাতে মিথ্যে বলেছে।তবে আমি হার না মানা মানুষ।সত্যটা সামনে আসবেই।তখন দেখো আমি কি করি।মায়ের অবাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে কিনা!হারে হারে টের পাবে।বাচ্চা হলো সুখের মূল।সংসারে একটা বাচ্চা এসে আলোকিত করে তোলে।আর আমার ছেলে জেনে শুনে একটা বন্ধ্যাকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছে।তোমাকে দেখেই মনে হয়েছে তুমি একটা অকর্মার ঢেকী।এবার সেটা প্রমাণ হলো।তবে যেদিন সত্যটা আসবে সেদিনই আমি আমার ইমাদের সাথে তোমার ডিভোর্স করিয়ে নেবো।আমার ছেলে কি তোমাকে নিয়ে আজীবন একা জীবনযাপন করবে নাকি।তার ও তো ইচ্ছা থাকতে পারে।’

পুতুল মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে মিসেস রওনকের সব কথা শুনছে।এসব যে উনি বলবেন তা আগে থেকেই জানত সে।ইমাদ মিথ্যে বলেও সত্যটাকে চাপা দিতে পারলো না।
মিসেস রওনক রেগে মেগে চলে গেছেন।পুতুলের মাথা ঘুরছে।একটা সময়ে সে পড়ে গেলো নিচে।ইমাদ সেসময়ে বের হয়েছিল বাথরুম থেকে।পুতুলকে পড়ে যেতে দেখে ছুটে আসলো সে।মা বলে ডাক দিয়ে ওকে বিছানায় নিয়ে আসলো।মিসেস রওনক পাশে দাঁড়িয়ে মনে মনে ভাবছেন পুতুল নিশ্চয় নাটক করছে।তাই মুখ বাঁকিয়ে চলে গেছেন উনি।ইমাদ পানির ছিঁটা দিচ্ছে তাও জ্ঞান ফিরছেনা।
জলদি করে ফোন নিয়ে কাছের একটা ফার্মেসীতে বসা ডাক্তারকে কল করলো আসার জন্য।তার নাম পাপন।
চিন্তায় ইমাদের কিছু ভালো লাগছেনা।পাপন আসতেও দেরি করছে।মা বসে বসে টিভি দেখছেন নিরিবিলি।ইমাদ পুতুলের হাত ধরে ভাবছে পুতুল নিজের ক্ষতি করেনি তো।উল্টো পাল্টা কিছু খায়নি তো।
পাপন আসতে বিশ মিনিট লাগিয়েছে।পুতুলের চোখ, মুখ নাড়ি চেক করে বললো,’ঠিক বুঝছিনা।ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করেনা?’

-“নাহ।তা অবশ্য ঠিক।খািয়া দাওয়ার প্রতি মন উঠে গেছে ওর।সেটা নিয়েই ভাবছি আমি।আর আজ সেন্সলেস হয়ে গেলো’

-“আমার ধারনা অন্য কিছু।ইমাদ তুমি ওর প্রেগনেন্সি টেস্ট করাও।’

ইমাদ কপাল টিপে পুতুলের পাশে বসে বললো,’সেসব বাদ দাও।আমাদের পোড়া কপাল।এর কারণেই পুতুল আজ অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’

-“মানে?’

-“ও কখনও মা হতে পারবেনা।রিপোর্টে এসেছে।মাকে বলবা না এই কথা।খবরদার!’

-“ওহ সরি।কিন্তু হাবভাবে মনে হলো সি ইজ প্রেগন্যান্ট ।আচ্ছা যেহেতু টেস্ট করিয়েছো তাতে তো আর ভুল হতে পারেনা।’

-“হুম।’

-‘আচ্ছা আমি ঔষুধ লিখে দিচ্ছি। বলতে পারো ডেইলি রুটিন।খাওয়া দাওয়ার দিকে মন দিতে হবে।আগের মতন চললে ডেইলে সেন্সলেস হবে।নারীরা এই বয়সে আসলে বেশি খাওয়া দাওয়ায় মেতে থাকতে হয়।তোমাকে বলে দিলাম।নিজের ওয়াইফের খেয়াল রেখো।আমি বরং আজ আসি’

ইমাদ পাপনকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখলো মা দাঁড়িয়ে আছেন।তিনি দাঁত কেলিয়ে বললেন,’আমি তো আগেও জানতাম তুই মিথ্যে বলছিস।পুতুলের সমস্যা আছে তোর নয়।আজ সিওর ও হয়ে নিলাম।
সব শুনেছি আমি।পাপনকে বলেছিস আজ রিপোর্ট এসেছে।পুতুল কখনও মা হতে পারবেনা।আরও কত কি’

কোনো কথার জবাব না দিয়ে ইমাদ পাশ কাটিয়ে চলে গেছে।মা গাল ফুলিয়ে কিসব ভাবতে ভাবতে চলে গেলেন তার রুমে।পুতুলের জ্ঞান ফিরেছে মিনিট দশেক পরেই।মাথা ধরে উঠে বসে ইমাদকে দেখে জড়িয়ে ধরলো সে।তারপর আস্তে করে বললো,’আপনার মা আপনার কথায় বিশ্বাস করলো না।করবেই বা কি করে।হাজার হোক সেটা তো মিথ্যে।সত্যটা তিনি জেনে গেছেন’

ইমাদ পুতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো’সেসব বাদ দাও।সব ভুলে আমরা আমাদের বাবুই পাখির বাসা গড়বো’

-‘মানে?’

-‘মানে সহজ।
মা আর একদিনের ভেতরে এসে আমাকে বলবে তোমাকে ছেড়ে দিতে।আর সেটা আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই বাধ্য হয়ে তোমাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে।সোজা তমিজ আঙ্কেলের বাসার ফ্ল্যাটে’

পুতুলের চোখের পানি বাঁধ ভেঙ্গে আসছে। ইমাদ কেন এত ভালোবাসে তাকে।তার নিজেরই হিংসা হচ্ছে।এই হিংসার ভেতর শুধু ভয় জমে আছে।বেশি ভালোবাসার কারণই তো হলো এই ভয়।হারানোর ভয়।
—–
ইমাদ পুতুলকে আগে কার মতন নিজ হাতে খাইয়ে দিলো।পুতুল কিছুতেই ওর হাত ছাড়ছেনা।অনেকবার দরজার দিকে তাকালো।মিসেস রওনককে তার জীবনের অন্যতম ভিলেন মনে হচ্ছে। যদি কসম দিয়ে বসে?এই ভয়ে ঢোক গিলে ইমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো সে।ইমাদ ওকে বুকে টেনে শুয়ে পড়লো।তার খাওয়া হয়নি।পুতুলের মুখের দিকে তাকালে তার আর অন্য কোনো কাজে মন বসেনা।খাওয়া তো দূরেই থাকুক।সবার আগে পুতুলকে সুস্থ করে তোলা জরুরি।
—-
মিসেস রওনক ভাবছেন তার চাচতো বোনের মেয়েকে বাসায় এনে রাখবেন।ও ছোটবেলা থেকে ইমাদকে অনেক পছন্দ করে।যদি একবার লাইন হয়ে যায় তাহলে কেল্লা পথে।
ফোন করে ওকে পাঠিয়ে দিতে বললেন।তার নাম একা।একা আসতে সময় লাগবে।তার বাসা সোনারগাঁও।
পুতুল ঘুমিয়েছে দেখে ওকে রেখে রুম থেকে বের হলো ইমাদ ভাত খাবে বলে।মা গেস্ট রুম পরিষ্কার করছেন একা আসবে বলে।ইমাদ বিষয়টা খেয়াল করে পরে ভাবলো হয়ত বাবার সঙ্গে আবার ঝগড়া করেছে তাই আলাদা রুমে শোবেন বলে ঠিক করেছেন।
যদি সে জানত একা আসবো তাহলে মায়ের হাতে পায়ে ধরে হলেও ওর আসা আটকাতো।কারণ সে জানে একা ওর জন্য কি লেভেলের পাগল।
—-
খাওয়া শেষ করে ইমাদ পুতুলকে দেখতে আসলো আবার।পুতুল উঠে বসে আছে আগে থেকেই।ওকে দেখে ইমাদ দুষ্টু করে একটা হাসি দিয়ে বললো,”চলো তোমায় আমার জগৎয়ে নিয়ে যাই।আবার কাঁদাবো।ভালোবাসার কাঁদন’

পুতুল ইমাদের কথা শুনে হাসার চেষ্টা করেও পারলো না।হাসতে ভুলে গেছে তার ঠোঁটজোড়া।গায়ের শার্ট খুলতে খুলতে ইমাদ বললো,’আমি কিন্তু সিরিয়াস’

পুতুল মুখ ঘুরিয়ে ধবধবে সাদা সেই কুচিকুচি পর্দাগুলো হালকা বাতাসে ওড়া দেখছে।
ইমাদ মুখটা ফ্যাকাসে করে ওর পাশে বসলো।।ওর মুখ ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,’আমি কি দোষ করেছি?আমার সাথে একটু হাসো।সব ভুলে যাওয়া যায়না?যে অতীত কষ্ট দেয়।সেই অতীত মনে রেখে লাভ কম ক্ষতি বেশি হয়।তাহলে কেন সেই অতীতকে আমরা এত প্রাধান্য দেবো?
আমার জন্য তুমি আছো।আর তোমার জন্য আমি।আর কি চাই?”

পুতুল ইমাদের চোখে চোখ রেখে বললো,’আমি চাই স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপন করতে।কিন্তু ঠিক তখনই আপনার মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে।তার দোষ একেবারেই দিচ্ছি না।কারণ তিনি তার জায়গায় সঠিক।কোনো ছেলের মা মানতে পারবেন না তিনি কখনও নাতিপুতির মুখ দেখতে পাবেন না।আর আপনার তো ভাই বোন ও নাই।তার যত চাহিদা সব আপনার থেকেই চাইবেন।নাতিপুতি কত জরুরি তার চেয়ে ভালো আর কে জানে?বুড়ো বয়সে তারাই তো সম্বল। আমি ঠিক কি করলে তার মুখে হাসি ফোটাতে পারবো তাই ভাবছি।অতীত নিয়ে একটুও ভাবছিনা।মা হতে পারবো না সেটা আমি মাথা থকে সরিয়ে নিয়েছি।শুধু ভাবতে চাই তার মুখে হাসি ফোটাবো কি করে’

-‘শোনো।মাকে মানিয়ে নেওয়া আমার দায়িত্ব।আমি পারবো।তুমি নিজের খেয়াল রাখো।কাউকে হাসিখুশিতে রাখতে চাইলে আগে নিজেকে হাসিখুশিতে রাখতে হয়।’
—-
পুতুল এবার হাসলো।হয়ত জোর করেই।তাও তাকে হাসতে হবে।ওকে হাসতে দেখার জন্য ইমাদ চোখের পাতা ফেলছিল না।
এই ছেলেটাকে সারাদিন জড়িয়ে ধরে রাখতে ইচ্ছে হয়।এত্ত ভালোবাসে সে আমাকে।অথচ যেদিন প্রথমবার আমার তার সাথে দেখা হয়েছিল।আমাকে বলেছিল বেরিয়ে যেতে।আর আজ সে আমাকে চোখে হারায়।

-‘কি দেখো এতো?কাঁদতে চাও নাকি?’

পুতুল এবার সত্যি সত্যি হেসে ফেললো।ইমাদ মুগ্ধ হয়ে ওকে হাসতে দেখছে।এত ক্ষণের কষ্ট ওর সার্থকতা পেয়েছে।
——-
রাত বারোটা বাজে।মিসেস রওনক একবার তার রুমে হাঁটছেন তো আরেকবার সোফার রুমে।একা এসে পড়বে তাই।তিনি বলার সঙ্গে সঙ্গে সে রওনা দিয়েছে।এতক্ষণে এসে যাওয়ার কথা।
কেন যে আসছেনা।এদিকে চোখ ধরেছে ঘুমের প্রকোপে।টমের মত চোখে কসটেপ মারতে ইচ্ছে করছে।হাঁটতে হাঁটতে কলিং বেলের আওয়াজ কানে আসতেই এক দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন তিনি।ওপারে একা আর তার ছোট বোন তিয়াশা দাঁড়িয়ে আছে।দুজনকে দেখে অনোক খুশি হলেন মিসেস রওনক।হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসলেন ওদের।একা ভেতরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,’ইমাদ ভাইয়া কই?”

-‘ইমাদ শুনছিস?একটু এদিকে আয়’

ইমাদ পুতুলের গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে টিশার্ট পরতে পরতে বেরিয়ে আসলো।একা কে দেখে ও চোখ কপালে তুলে ফেলেছে।

-‘কেমন আছো ভাইয়া?’

-“ভভভভভভভ…..

-“ভালো।তাই না ইমাদ ভাইয়া?’

-“ভীষণ খারাপ।’

-“আমি আসছি না।দেখবে ভীষণ ভালো যাবে দিন।তোমার বউ কোথায়?’

-“সে ঘুমায়’

ইমাদের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব।মিসেস রওনক দাঁত কেলিয়ে একাকে টানতে টানতে গেস্ট রুমে নিয়ে গেছেন।নীল শার্টে ইমাদকে দেখে একা মনে হয় এখনই জ্ঞান হারাবে।মিসেস রওনক শেষে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে হইছে ওকে।তিয়াশা চশমা ঠিক করে ইমাদের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে যাচ্ছিল

-“তুমি তিয়াশা?’

-“হু”

-‘ওরে কত বড় হয়ে গেসো।তোমাকে আমি এক চিমটি সমান দেখছিলাম’

তিয়াশা থেমে গিয়ে বললো,’এক চিমিট সমান তো আম্মুর পেটে থাকতে ছিলাম।আপনি কি বোঝাতে চান হু?’

ইমাদ ব্রু কুঁচকে বললো,’তোমার বাবা আল্ট্রাসোনোগ্রাফিতে তোমাকে দেখে সেই কালো ছবি ফেসবুকে দিয়েছিলেন।তো আমি সেখানে দেখছিলাম।তখন তো ছোটই ছিলে’

-“তাও এক চিমটি ছিলাম না’

-‘আরে ভাই ওটা কথার কথা বললাম’

-‘ভাই না বোন।ওকে বাই’

তিয়াশা ভেংচি কেটে চলে গেলো।ইমাদ কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’একজনে পারেনা গায়ে পড়ে আর আরেকজনে আমার কথা সহ্যই করতে পারেনা।বাহ!!কি অমিল দুজনের।যদি একা তিয়াশার মত হতো তাহলে শান্তিতে দম ফেলতে পারতাম।এই মেয়ের হুট করে আসা মাথায় ধরছেনা।জ্বালিয়ে খাবে আমাকে।’
চলবে”””