বাল্য বিবাহ পর্ব-০১

0
501

১ম পর্ব
গল্পের নামঃ #বাল্য_বিবাহ
লেখিকাঃ #তাসনিয়া_জামান

জানো আপু তোমার ভাগ্যটা অনেক ভালো৷ তোমার আব্বু নেই তবুও তুমি পড়ালেখা করতে পারছো। তুমি ২ বছর ধরে কলেজে পড় তবুও তোমাকে তোমার মা, ভাইয়া কখনো বিয়ের জন্য চাপ দেয় না।
আর দেখ আমার ভাগ্যটা কত খারাপ। আমার মা-বাবা, ভাইয়া সবাই থাকতেও আমাকে পড়ালেখা করাতে কেউ চাই না। আমি মাত্র ক্লাস এইটে উঠলাম তাই আমার মা-বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলছে।কাল আমার কাবিন। সামনে শুক্রবারে উঠিয়ে নিবে জানো তুমি।

আমার ফুপাতো বোন সুমাইয়া আজ আমার কাছে প্রাইভেট পড়তে এসে এমন একটা কথা বলবে কখনে কল্পনাও করি নেই।

সুমাইয়ার মুখে সুমাইয়ার বিয়ের কথা শুনে আমি সুমাইয়ার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম,,

কি বলিস সামনে শুক্রবার তোর বিয়ে মানে। সামনে শুক্রবার যদি তোর বিয়ে হয় তাহলে আমাদের ফুপু বলল না কেন?

আমার বয়স কম। বেশি মানুষ জানলে ঝামেলা হবে তাই আগেই কাউকে জানাই নাই শুধু তোমার ভাইয়া, মামাদের, আর আমার চাচাদের বলছে। তোমার ভাইয়া হয়তো তোমাকে আমার বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলে নাই।
কাল আমার কাবিন আপু। অল্প বয়স দেখে কাল কোর্টম্যারেজ করে রাখবে। তারপর শুক্রবারে আমাকে আমার শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাবে । কাল বিয়ে হওয়ার পর সবাই কে বলবে আর দাওয়াত দিবে।
আপু আমার ভালো লাগছে না। আমি আজ আর পরব না। এখন যায়?

আচ্ছা যা।
____________

সুমাইয়ার আম্মুর আমাদের বাড়ির পাশেই বিয়ে হয়ছে।
আমাদের বাড়ি থেকে সুমাইয়াদের বাড়ি হেটে যেতে পাঁচমিনিটের মতো লাগে।
আমি যখন ক্লাস সিক্স এ পড়ি তখন সুমাইয়া ক্লাস ওয়ানে পড়ে। সুমাইয়া যখন ক্লাস ওয়ানে পড়ে তখন থেকে সুমাইয়া কে আমি প্রাইভেট পড়ায়। ক্লাস ওয়ান থেকে আমার কাছে পড়ছে। এক টানা ৭ বছর সুমাইয়াকে আমি পড়াচ্ছি । এইট এ উঠার পরও আমার কাছে পড়ছে এখনও ।
সুমাইয়ার বয়স ১৪ তে পড়ছে এবার।এত অল্প বয়সে ফুপু কেমনে বিয়ে দিচ্ছে বুঝছি না।

৮ টার এর এর্লামে এসব ভাবনা থেকে বের হয়ে এলাম।
আমার ক্লাস ৮ঃ৪৫ এ। তাড়াতাড়ি যোগাড় হতে হবে কলেজে যাওয়ার জন্য।
আমি তাড়াতাড়ি যোগাড় হয়ে কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্য রওনা দিলাম।
বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় যখন আসলাম তখন আমার ছোট ফুপুর( সুমাইয়ার আম্মু) সাথে দেখা হলো।
কিরে তানজিলা কলেজে যাচ্ছিস নাকি?

জ্বি ফুপু। তুমি সুমাইয়ার বিয়ে ঠিক করছো। আমাকে একটু বললা না।

আরে সময় হলে সবাইকে জানাবো।

ফুপু সুমাইয়া এখনও অনেক ছোট। এত অল্প বয়সে সুমাইয়াকে বিয়ে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না।

কি করব বল। আমাদের অবস্থা তো তুই জানিস।
আমি আগে গার্মেন্টসে কাজ করতাম।
তারপর সুমাইয়ার আব্বু আমাকে দিয়ে ২ বিয়ে করছে। আর সুমাইয়ার কাকাতো বোন মিম জানিস তো কয়দিন আগেও একটা ছেলের সাথে পালিয়ে চলে গেছিলো। সেই ছেলের সাথে ৩ দিন থেকে বাড়ি চলে আসছে। ছেলেটা ৩ দিন রেখে আর রাখে নাই। সুমাইয়া যতই ভালো হোক যে কোন মানুষ বলবে যার কাকাতো বোন এত খারাপ সেও খারাপ হবে।

তারপর বাবা আবার ২ বিয়ে করছে তাহলে মেয়ে কেমন জানাই আছে। সুমাইয়া যতই ভালো হোক, যতই সুন্দর হোক না কেন আমাদের পরিবারের এমন অবস্থার জন্য সুমাইয়া কে ভালো কোথাও বিয়ে দিতে পারতাম না।
সুমাইয়ার যে ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক সে ছেলে আমাদের সব জেনেই বিয়ে করতে চাচ্ছে সুমাইয়াকে। ছেলে বিদেশে থাকে। বিয়ে করার জন্য দেশে আসছে। বিয়ে করে ১ মাস দেশে থেকে আবার বিদেশ চলে যাবে। ছেলেরা ২ ভাই ১ বোন। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। সুমাইয়ার বর ছোট। বড় ভাই বিয়ে করে আলাদা থাকে। শুধু একটা শ্বাশুড়ি, শ্বশুর নেই। পারিবারিক কোন ঝামেলা নেই তারপর ছেলেটা অনেক ভালো আছে। এমন ছেলে পরে আর পাবো না তাই এই ছেলেটার সাথে বিয়ে দিচ্ছি।
তারপর আমার অবস্থা তো জানিসই আমি অসুস্থ মানুষ কবে মরে যায় ঠিক নেই। সুমাইয়ার আব্বু তার ছোট বউ নিয়ে থাকে আমাদের সংসারের খরচ দেয় না।
মামুন( সুমাইয়ার বড় ভাই) এবার ইন্টারে ভর্তি হয়ছে। পড়ালেখা করছে আবার পাশাপাশি স্টীলের দোকানে থাকে। স্টীলের দোকান থেকে মাসে ৪০০০ টাকা পায়। এই টাকায় মামুনের পড়ালেখার খরচ হয় না। প্রাইভেট তারপর কলেজের সব খরচ দিয়ে।
আমি সেলাই এর কাজ করে যে টাকা পায়। সে টাকা দিয়ে সুমাইয়া আর মামুনের পড়ালেখার খরচ, সংসার খরচ, কিস্তি সব খরচ চালাতে হিমশিম খায়।

আমি বেঁচে থাকতে সুমাইয়া কে বিয়ে দিয়ে যেতে চায়।

ফুপু সবাই জানে সুমাইয়া অনেক ভালো মেয়ে । সুমাইয়া পর্দাশীল। মিম ৫ টা ছেলের সাথে রাত কাটালেও সুমাইয়াকে কেউ খারাপ বলবে না। কারন সবাই জানে মিম কেমন আর সুমাইয়া কেমন। মিম খারাপ তার জন্য সুমাইয়া কে কেউ খারাপ বলে না। যে ভালো তাকে সবাই ভালো বলবে, যে খারাপ তাকে সবাই খারাপ বলবে। একজনের জন্য আরেকজন কে কেউ খারাপ বলে না।
সুমাইয়ার চেহারা অনেক সুন্দর। সুমাইয়া কে এসএসসি পাস টা করাও দেখবা আরও ভালো ঘরে সুমাইয়াকে বিয়ে দিতে পারবা। সুমাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখছো সুমাইয়া কত শুকনা। এই অল্প বয়সে বিয়ে দিলে সুমাইয়ার অবস্থা একেবারেই খারাপ হয়ে যাবে।

বিয়ের পর মেয়েরা মোটা হয়ে যায়। সুমাইয়াও মোটা হয়ে যাবে। সুমাইয়ার বর অনেক ভালো। সুমাইয়াকে অনেক ভালো রাখবে। সুমাইয়া দেখবি মোটা হয়ে যাবে।

তোমার সাথে আমি তর্ক করতে চাই না ফুপু। সুমাইয়া তোমার মেয়ে। তোমার মেয়ের ভালো তুমিই বুঝবা। আমি তাই কিছু আর বলব না। বলেই আমি গাড়িতে উঠে গেলাম। কলেজে যাওয়ার জন্য।
_______
তারপরের দিন
কলেজে যাওয়ার সময় মামুনের সাথে দেখা হলো।

মামুন শুন।

হুম বল। ( মামুন আমার থেকে ৬ মাসের ছোট। কিন্তু পড়ালেখায় পিছিয়ে গেছে। একসাথে ছোট থেকে বড় হয়ছি তাই তুই করে বলে)

এত অল্প বয়সে সুমাইয়ার বিয়ে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। তুই তো ফুপু ফুপাকে বেঝাতে পারিস। এত অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া অন্যায়।

আমি অনেক বলছি রে।তাদের মেয়ে তারা যা মনে চায় তাই করুক আমি আর কিছু বলব না। আমি যদি অনেক টাকা ইনকাম করতে পারতাম এখন তাহলে এই বিয়ে হতে দিতাম না বলেই মামুন চলে গেল।

আমিও কলেজে চলে আসলাম।

কলেজ থেকে বাড়ি আসতে লাগছি, তখন আমার ছোট চাচির সাথে দেখা হলো,

কিরে তানজিলা তোর স্টুডেন্টের আজ বিয়ে হয়ে গেল তুই বিয়ে করবি কবে?

যখন সময় আসবে তখন বিয়ে হবে বলেই আমি বাড়িতে চলে আসলাম,
বাড়িতে আসার পর,
আপু সুমাইয়ার আজ বিয়ে হয়ছে জানেন?

আমার ভাবির কথায় আমি বললাম হুম জানি আমি।

জানেন আপু ছেলের বয়স বলে ৩২+ । সুমাইয়ার বয়স ১৪। সুমাইয়ার থেকে ১৮ বছরের বড়। সুমাইয়ার সাথে এত বয়স্ক ছেলে মানায় নাকি বলেন। ফুপু ফুপা তবুও সুমাইয়াকে এই ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছে।

ভাবি এসব কথা বাদ দিন। ফুপু ফুপা কে বুঝিয়ে লাভ নেই।

_________
আজ সুমাইয়ার গায়ে হলুদ।
সুমাইয়ার ৩ জন বান্ধবী মাইশা, রুমা, রিমি আরও ৪/৫ জন প্রাইভেট পড়ে আমার কাছে । একই গ্রামের সবাই। তাই ওদের সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়ছে।

মেডাম সুমাইয়ার তো আজ গায়ে হলুদ। আমরা সবাই হলুদ শাড়ি পরব। আপনারও হলুদ শাড়ি পড়তে হবে আমাদের সাথে।
না আমি হলুদ শাড়ি পড়তে পারব না। আর সুমাইয়াকে গায়ে হলুদও দিতে যেতে পারব না আমি।

মেডাম আপনি যদি হলুদ শাড়ি পড়ে সুমাইয়াকে গায়ে হলুদ দিতে না জান তাহলে আমরাও কেউ সুমাইয়াকে গায়ে হলুদ দিতে যাবো না।

মাইশা, রুমা ওদের সবার অনুরোধে আমি গায়ে হলুদের শাড়ি পড়ে সুমাইয়াদের বাড়িতে গেলাম।

সুমাইয়াদের বাড়িতে যেয়ে দেখি সুমাইয়া হলুদ শাড়ি পড়ে নাই। থ্রিপিস পড়ে আছে।

সুমাইয়ার কয়দিনে মুখ টা শুকিয়ে গেছে। সুমাইয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার।

কিরে সুমাইয়া তোর আজ গায়ে হলুদ আর তুই হলুদ শাড়ি না পড়ে থ্রি পিস পড়ে আছিস কেন?

আপু আমি হলুদ শাড়ি পরব না।

গায়ে হলুদের দিন পড়তে হয়। তুই শাড়ি নিয়ে আয় আমি তোকে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছি।

আপু জানো আমার অনেক ইচ্ছা ছিল তোমার বিয়েতে আমি অনেক আনন্দ করব। তোমার গায়ে হলুদে আমি হলুদ শাড়ি পরব সবার সাথে মজা করব। কিন্তু দেখ আমার ইচ্ছাটা পূরন করার আগেই আমাকে বিয়ে দিয়ে দিল। তোমার বিয়েতে গায়ে হলুদে আমি মজা করব কি উল্টো তুমি আমার বিয়ে গায়ে হলুদে মজা করছো।

সুমাইয়ার কথা শুনে মনটা আরও অনেক খারাপ হয়ে গেল আমার। তবুও মুচকি হেসে বললাম,

আরে তোরও ইচ্ছা পূরন হবে দেখিস। তোর বিয়ের আগে যদি আমার বিয়ে হতো তাহলে তো তুই একা মজা করতি কিন্তু এখন তোর বর হয়ছে এখন ২ জনে আরও বেশি আনন্দ করবি।

আপু তোমার অনেক ইচ্ছা অনেক পড়ালেখা করার তাই না।

হুম অনেক ইচ্ছা পড়ালেখা করার।
সুমাইয়া তুই ফুপু কে বুঝাতি। তুই পড়ালেখা করতে চাস বিয়ে করতে চাস না।

এই কথায় সুমাইয়া আরও মনটা খারাপ করে বলল।
জানো তো গরীব হয়ে আর মেয়ে হয়ে জন্মানো টা একেক সময় ভুল মনে হয়। আবার তোমার কথা যখন মনে পড়ে তখন আবার ভাবি তোমরাও তো গরীব। তোমার তো বাবা নেই। তোমার ভাইয়া তোমার সব আশা পূরন করছে। তোমাকে কখনো কোন কিছুর জন্য কস্ট পেতে হয় না। তুমিও তো গরীব আর মেয়ে হয়ে তোমার সব ইচ্ছা পূরন করতে পারছো। তাহলে তো মেয়ে হয়ে আর গরীব হয়ে জন্মানো টা ভুল না৷ সব হলো ভাগ্য।

কিন্তু আমি আমার কোন ইচ্ছা পূরন করতে পারি না। আমার ভাগ্য খারাপ হয়তো সেজন্য আমার ইচ্ছাগুলো আমি পূরন করতে পারলাম না।
আম্মু আব্বু কে অনেক বুঝিয়েছি তবুও কেউ বুঝল না আমার কস্ট।
জানো আমারও অনেক ইচ্ছা ছিল আমিও অনেক পড়ালেখা করব।
কিন্তু আমার ইচ্ছা টা পূরন হলো না। আমার ইচ্ছা পূরন করার আগেই আমাকে বিয়ে দিয়ে দিল।

বিয়ে হলে যে পড়ালেখা করা যায় না এমন কোন কথা নেই। বিয়ের পরও অনেক পড়ালেখা করা যায়। দেখ আমার ছোট খালামনি একটা ছেলে হওয়ার পরও পড়ালেখা শেষ করছে। তুইও বিয়ের পর পড়ালেখা করবি।

তোমার খালামনির বর তোমার খালামনি কে পড়ালেখা করতে দিছে। তাই পড়ালেখা শেষ করতে পারছে।

তুই ও তোর বরকে বলবি তুই পড়ালেখা করতে চাস।

আপু আমি পড়ালেখা করতে চেয়েছিলাম। পড়ালেখা করতে চাই আমার বর কে বলছিলাম কিন্তু আমার বর আমাকে পড়ালেখা করাবে না বলেই সুমাইয়া কেঁদে দিল।

সুমাইয়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম,

সুমাইয়া কাঁদিস না। বলেই রুমাকে বললাম,,

ফুপুর কাছে থেকে সুমাইয়ার হলুদ শাড়ি নিয়ে আয় তো সুমাইয়া কে শাড়ি পড়িয়ে দেই,,,

[ ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন ]