চিলেকোঠার প্রেম পর্ব-০১

0
1121

#চিলেকোঠার_প্রেম
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
#পর্ব_১

রক্তাক্ত অবস্থায় ছেলেটা হুট করে সামনে আসতেই স্কুটি থামিয়ে দিল সায়েন। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো ছেলেটার মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। গায়ের সাদা শার্ট টা রক্তে লাল হয়ে গেছে। বৃষ্টি পড়ছে বিধায় পুরো শার্ট ভিজে গেছে। বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে রক্ত ফলে সাদা শার্ট টা লাল বর্ণ ধারণ করছে। ছেলেটাকে এই অবস্থায় দেখে ভড়কে যায় সায়েন। সায়েন ওর ফ্রেন্ড দিশার বাড়ি থেকে নোটস কালেক্ট করে ফিরছিলো। বিকেল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নামছিল তাই সে রেইনকোট নিয়ে এসেছিল। এখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে চারিদিকে। বৃষ্টির প্রকোপ বাড়ায় গায়ে রেইনকোট জড়িয়ে বাড়ি ফিরছিল সায়েন। হঠাৎ করেই ছেলেটা কোথা থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়লো ওর স্কুটির সামনে। সায়েন স্কুটিতে বসা অবস্থায় তাকালো ছেলেটার দিকে। ইশশ কি বেহাল অবস্থা ছেলেটার। সায়েন কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,’কে আপনি?? আর আপনার এরকম দশা হলো কিভাবে??’

ছেলেটার মুখ দিয়ে অস্পষ্ট কথা বেরোচ্ছে যা সায়েন শুনতেই পারছিল না। তবে মানতে হবে যে ছেলেটা স্ট্রং নাহলে এতো জখম হওয়া সত্ত্বেও পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিভাবে??সায়েন ছেলেটার জায়গায় হলে তো জ্ঞান হারিয়ে পগারপার হয়ে যেতো। কিন্তু ছেলেটাকে তো সাহায্য করতে হবে। এই অবস্থায় থাকলে মরেও যেতে পারে। আশেপাশে কেউ নেই। সায়েন বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,’এখন কি করি?? আশেপাশে তো কাউকে দেখতেও পাচ্ছি না। এই বৃষ্টির মধ্যে ডক্টরের দোকান আদৌ খোলা থাকবে??কি করি??কি করি??একে বরং আমার বাড়িতে নিয়ে যাই। প্রাথমিক চিকিৎসা করি। তারপর দেখা যাবে। কিন্তু মা তো আমাকে আস্ত রাখবে না। মা বকলে বকুক। তাছাড়া সাহায্য করছি বললে কিছু বলবে না।’

যেই ভাবা সেই কাজ। সায়েন ছেলেটাকে ধরে বলল,’আপনি আমার স্কুটিতে বসতে পারবেন তো?? তাহলে নিয়ে যেতে পারবো।’

ছেলেটা নিভু নিভু চোখে সায়েনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো। কিন্তু সে স্বাভাবিক ভাবে স্কুটিতে বসতে পারলো না। সায়েন পড়লো আরো বিপদে। হঠাৎ করেই মাথায় এলো ওর ব্যাগে তো ওড়না আছে। রেইনকোট পড়ার জন্য ওড়না খুলে রেখেছিল সে। সায়েন দ্রুত ওড়না বের করে নিজের কোমড়ের সাথে ছেলেটার কোমড়সহ বেঁধে ফেলল। যাক এখন পরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ছেলেটা দুহাতে সায়েনের গলা জড়িয়ে ধরেছে। অস্বস্তি হওয়া সত্ত্বেও সায়েন স্কুটি স্টার্ট দিলো। ছেলেটাকে নিয়ে সায়েন সোজা বাড়িতে এলো। কোনরকমে ছেলেটাকে ধরে নিয়ে বাড়ির দরজায় পর্যন্ত আসলো। সায়েন কলিং বেল বাজালো। কিন্তু কেউ দরজা খুলল না। কয়েকবার বাজানোর পর ও কেউ দরজা খুলল না দেখে সে এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। ছেলেটাকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে খাটের উপর শুইয়ে দিলো। বাড়িতে কেউ নেই দেখে সায়েন অবাক হলো।

সায়েন দৌড়ে বাবার রুমে গেল। বাবার ডাক্তারি ব্যাগটা বের করে নিয়ে ছুটলো নিজের রুমে। ব্যাগ থেকে ঔষধ পত্র বের করলো। মাথা ড্রেসিং করে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো সে। হাতও কাটা ছেঁড়া। সব জায়গায় ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে হাফ ছাড়লো সায়েন। কিন্তু ছেলেটার গায়ের জামাকাপড় যে এখনও ভেজা। সায়েন একটু ভেবে ছুটলো শাফিনের রুমে। একটা টাউজার আর গেঞ্জি নিয়ে আসলো সে। তারপর অচেনা আগুন্তক কে উদ্দেশ্য করে বলল,’তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নিন। এমনিতেই আপনি আঘাত পেয়েছেন। যেকোন সময় জ্বর আসতে পারে। ভেজা শরীরে থাকলে জ্বর তাড়াতাড়ি চলে আসবে।’
অচেনা লোকটা শুধু মাথা নাড়লো। সায়েন দ্রুত রুম ত্যাগ করলো। বাবার রুমে তার ব্যাগটা রেখে ফোন করলো ওর মা’কে। জয়নব বেগম ফোন রিসিভ করতেই সায়েন বলল,’মা তোমরা কোথায়??আমি একা বাড়িতে বসে আছি।’

জয়নব বেগম বললেন,’আমি আর তোর বাবা তোর লিলি খালার বাসায় এসেছি। বৃষ্টির জন্য বের হতে পারছিনা তোর খালাও আসতে দিচ্ছে না। তাই আমরা থেকে যাব। তুই চিন্তা করিস না শাফিন চলে যাবে তাড়াতাড়ি। আমি ফোন করেই দিয়েছি। আর কোন ঝামেলা করবি না। চুপচাপ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বি।’

সায়েন মুখটা গোমড়া করে বলল,’ঠিক আছে মা।’

সায়েন ফোনটা কেটে দিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে এসেছে।এখন এই অজানা ছেলেটাকে নিয়ে সে কি করবে?? এখন মনে হচ্ছে ছেলেটাকে বাড়িতে নিয়ে আসাই ভুল হয়েছে। ওর মা যদি জানতে পারে তাহলে ওর ফাসি হবে নিশ্চিত। মা কি বলবে তাই ভেবে কাঁপতে লাগল সায়েন। কি হবে??সায়েন আর শাফিন প্রচন্ড ভয় পায় ওর মা’কে। মায়ের প্রতিটা কথা দুজনে মান্য করে। সায়েন বিড়বিড় করে বলল,’কালকে মা এসে এই ছেলেটাকে দেখলে তো আমি শেষ। তার আগেই একে বিদায় করতে হবে।’

এসব বলতে বলতে সায়েন রান্নাঘরে চলে গেল। ওর মা রান্না করে রেখে গিয়েছে। গরম করে খেতে হবে শুধু। সায়েন দুধ গরম করলো ছেলেটাকে দেবে বলে। গরম দুধ গ্লাসে ঢালতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। সাথে সাথে সায়েন প্রচন্ড জোরে কেঁপে উঠলো। নিশ্চয়ই শাফিন এসে পরেছে। কয়েকবার ঢোক গিলে সায়েন নিজের রুমের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে দরজা খুলে দিলো। শাফিন কাক ভেজা হয়ে ফিরেছে। শাফিনকে দেখে সায়েন দাঁত বের করে হাসলো। শাফিন চুল ঝাড়তে ঝাড়তে ভেতরে ঢুকলো। সায়েনের দাঁত কেলানো দেখে সে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর ভেজা শরীরে ড্রয়িং রুম আর রান্নাঘর ঘুরে দেখলো। শাফিনের কান্ড দেখে সায়েন বলল,’কি হলো ভাইয়া কি দেখছিস??’

শাফিন সায়েনের দিকে তাকিয়ে বলল,’কিছু গন্ডগোল করেছিস??’
সাথে সাথে সায়েনের মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেলো। শাফিন বলল,’তোর হাসি দেখে বুঝতে পেরেছি যে কিছু গন্ডগোল করেছিস তুই। গ্লাস প্লেট ভেঙেছিস??’
সায়েন জোরে জোরে মাথা নাড়িয়ে বলল,’না না ওসব কিছু না। তুই যা তো চেঞ্জ করে নে। নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে।’

শাফিন নির্দিধায় রুমে চলে গেল। সায়েন দ্রুত দুধের গ্লাস নিয়ে রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। রুমে গিয়ে সায়েন অবাক। ওমা, ছেলেটা তো ঘুমিয়ে আছে। সায়েন বিছানার দিকে সামান্য ঝুঁকে আস্তে করে বলল,’ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি মরে গেছে??মরে গেলে তো আমি মার্ডার কেসে ফেসে যাব। হায় আল্লাহ কোন ঝামেলায় ফেললে আমাকে??রুমে বিপদ রুমের বাইরে ও বিপদ।’
সায়েন ছেলেটার নাকের সামনে হাত রেখে দেখলো নিশ্বাস নিচ্ছে তারমানে বেঁচে আছে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জোরে শ্বাস ফেলল সায়েন। তখনই দরজায় টোকা পড়লো। সায়েন চাদর দিয়ে ছেলেটাকে সম্পূর্ণ ঢেকে দিয়ে দরজা হালকা খুলে মাথা বের করলো। শাফিন চোখ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল,’আমার ব্রাউন রঙের গেঞ্জি কই??এ্যাশ রঙের টাউজারটাও খুঁজে পাচ্ছি না।’

সায়েন ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলল। শাফিনের টাউজার আর গেঞ্জি তো ওই ছেলেটাকে পরতে দিয়েছে। সায়েন তোতলাতে তোতলাতে বললো,’দ দেখ মা হয়তো কোথাও রেখেছে। আপাতত অন্য কোন জামাকাপড় পর যা।’

শাফিন যেতে নিয়ে আবার ফিরে এসে বলল,’দুধ কার জন্য??’
সায়েন হাতের গ্লাসের দিকে তাকালো। শাফিন দেখে ফেলেছে। সায়েন আমতা আমতা করে বলল,’আ আমার জন্য।’

‘কিন্তু তুই তো দুধ খাস না।’

সায়েন আরো ঘাবড়ে গেল। পদে পদে বিপদ এসে পরছে। সামাল দিতে কষ্ট হচ্ছে সায়েনের। সে বলল,’ক কে বলেছে আমি দুধ খাই না??খাই তো!!’
এই বলে সায়েন এক চুমুকে সব দুধ খেয়ে ফেললো। সায়েনের এরকম কাজে বেশ অবাক হয় শাফিন। হঠাৎ করে সায়েনের হলো কি?? অদ্ভুত বিহেভ করছে। ভেজা কাপড়ে থাকার জন্য শাফিন কথা না বলে রুমে চলে গেল। সায়েন ঠাস করে দরজা আটকিয়ে দিলো। দুধ সে খেতে পারে না। গন্ধটা অসহ্যকর। ওয়াক ওয়াক করতে করতে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে চকলেট বের করে খেতে লাগলো।

‘অসহ্যকর!!এই ছেলেটার জন্য এরকম হচ্ছে। ভাইয়া যদি জানতে পারে তাহলে এখনি মা’কে বলে দেবে। ঘরে বাইরে সবখানে বিপদ।’

সায়েন পায়চারি করছে আর চকলেট খাচ্ছে। হঠাৎ জানালা দিয়ে জোরে বাতাস আসতেই ছেলেটার মুখের উপর থেকে চাদরটা সরে গেল। সায়েনের চোখ আটকে গেল ছেলেটার ঘুমন্ত মুখের দিকে। ফর্সা মুখখানা লাল হয়ে গেছে। ঠোঁটের কোণে রক্ত জমে কালচে হয়ে গেছে। ঠোঁটজোড়া গোলাপের পাপড়ির ন্যায় কোমল। চেহারা জুড়ে মায়া ছড়ানো। সায়েন কেন যে কেউ দেখলে মুগ্ধ হয়ে দেখবে ছেলেটাকে। এমন সুন্দর ছেলেটাকে এভাবে আঘাত করলো কে??বিবেকে কি তার একটুও বাঁধলো না??এই মুহূর্তে সায়েনের সামনে সুদর্শন যুবক শুয়ে আছে। এরকম ভাবে কাউকে কখনো পর্যবেক্ষন করেনি সায়েন। কিন্তু এই ছেলেটার রূপ তাকে দেখতে বাধ্য করেছে। আঁখিযুগল অসম্ভব সুন্দর। শুধু কি ছেলেরাই মেয়েদের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়?? নাহ মেয়েরাও ছেলেদের রূপে মুগ্ধ হয়। তার প্রমাণ সায়েন নিজে। সায়েন অবাক নয়নে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। তখনই কারেন্ট চলে গেল। অন্ধকার হওয়ায় সায়েনের সম্বিৎ ফিরে এলো। এত সুন্দর একটা মুহূর্ত কারেন্টটা নষ্ট করে দিলো। এদিক ওদিক খুজে মোমবাতি জ্বালিয়ে একটা টুলের উপর বসলো। এই মোমবাতির আলোয় ছেলেটাকে মোহনীয় লাগছে। ছেলেটাকে দেখছে আর চকলেট খাচ্ছে সে। এর মধ্যে শাফিন এসে ডেকেছিল কিন্তু সায়েন বলেছে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই শাফিন চলে গেছে।

…………………

ঘুমের ঘোরে সায়েন অনুভব করছে যে কেউ একজন ওকে দেখছে। সায়েনের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে যে,সায়েন একজোড়া আঁখি গভীর দৃষ্টিতে তোকে দেখছে। তার দৃষ্টি যে শুধু তোর দিকে। চট করে সায়েন চোখ মেলে তাকায়। দেখে সত্যি সত্যি একজোড়া আঁখি ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সায়েন তড়িঘড়ি করে ঠিক হয়ে বসলো। ছেলেটার পায়ের কাছে বসে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা টের পায়নি সে। অচেনা ছেলেটা খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে সায়েনের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এতে সায়েন অস্বস্তি বোধ করছে। মোমবাতি এখনও জ্বলছে কারেন্ট আসেনি এখনও। ইতস্তত করতে করতে শেষে সায়েন বলল,’আ আপনি এখন ঠিক আছেন??’

ছেলেটা আস্তে করে বলল,’পুরোপুরি ঠিক না।’
ছেলেটার মধুর কন্ঠ শুনে শিহরণ বয়ে গেল সায়েনের শরীর জুড়ে। এতো সুন্দর কন্ঠ কারো হয়?? আচ্ছা ছেলেটা মানুষ তো??নাকি অন্যজগতের কেউ??সায়েন কোথায় যেন শুনেছে যে, সবচেয়ে সুন্দর হয় তারাই যারা অন্যজগতের মানুষ। মানে জ্বিন অথবা পরী। এই ছেলেটাও কি সেইরকম কিছু??সায়েন অপলক চোখে তাকিয়ে ভাবছে। ছেলেটা বলে উঠলো,’এক্সকিউজ মি কি হলো??’
ছেলেটার কথায় কেঁপে উঠলো সায়েন। সে বলল,’আপনার নাম কি??বাসা কোথায়??’

ছেলেটা ঠোঁট উল্টে বলল,’জানি না মনে পড়ছে না।’
সায়েন অবাক হয়ে গেল বলল,’কি??মনে পড়ছে না মানে কি??’

ছেলেটা সহজ ভাবে বলল,’মনে পড়ছে না মানে মনে পড়ছে না। আমার কিছু মনে পড়ছে না।’
সায়েন চট করে দাঁড়িয়ে পড়লো বলল, ‘ইয়ারকি পেয়েছেন নাকি??রাত দুপুরে মজা করছেন আমার সাথে??’

‘বিশ্বাস করুন আমার সত্যি কিছু মনে পরছে না। বোধহয় আমার মেমোরি লস হয়েছে!!’

ছেলেটার এরকম কথায় সায়েন চোখ বড়বড় করে তাকালো। রোগী নিজেই বলছে তার মেমোরি লস হয়েছে। এই প্রথম শুনলো সে।অবাক হয়ে বলল,’অদ্ভুত তো?? আপনার মেমোরি লস হয়েছে আপনি কিভাবে জানলেন??এটা কি বাংলা সিনেমা পেয়েছেন নাকি??যে গাছের সাথে ধাক্কা লেগে স্মৃতি হারিয়ে গেছে।’

ছেলেটা ইনোসেন্ট ফেসে বলল,’আমার তো গাছের সাথে ধাক্কা লাগেনি। আমার মাথায় কেউ জোরে আঘাত করেছে যার ফলে আমার মেমোরি লস হয়েছে। আমি এখন কিছু মনে করতে পারছি না।’

সায়েন কটমট করে তাকিয়ে বলল,’আপনার মেমোরি লস হোক বা না হোক তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার বাড়ি থেকে বের হন এখুনি।’

ছেলেটা মুখটা কাঁদো কাঁদো করে বলল, ‘এরকম করছেন কেন??এই বৃষ্টির মধ্যে আমি কোথায় যাব?? আমাকে এখানে কয়েকদিন থাকতে দিন। আমি তো অসুস্থ। একটু সুস্থ হই তারপর না হয় চলে যাব। আমার মতো অবলা পুরুষ কে তাড়িয়ে দিতে আপনার বিবেকে বাঁধছে না??’

সায়েন অবাকের চরম সীমান্তে পৌঁছে গেছে। অবলা নারী হয় কিন্তু অবলা পুরুষ ও যে হয় তা সে আজ শুনলো। কিন্তু ছেলেটার অসহায় মুখ দেখে মায়াও হচ্ছে। সে বলল,’কিন্তু আপনাকে তো এখানে রাখা অসম্ভব। মা বাবা খালামনির বাসায় গেছে। তাই আপনি এখন ও এখানে আছেন। ওরা এসে পড়লে আপনাকে তো বের করবেই সাথে আমাকেও বাড়ি ছাড়া হতে হবে। আপনি আমার মা’কে চেনেন না।’

ছেলেটা অনুরোধ করে বলল,’প্লিজ। আমাকে কোথাও লুকিয়ে রাখেন তবুও আমাকে তাড়িয়ে দিয়েন না।’

‘উফফ কি করি এখন?? আপনার সত্যি নিজের নাম ঠিকানা বাবা মা কারো কথা মনে নেই???’

ছেলেটা ঘাড় নেড়ে বলল,’নাহ মনে নেই।’

সায়েন ফোনটা হাতে নিয়ে বলল,’ওকে আমি আপনার ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে দিচ্ছি। দেখবেন কালকের মধ্যে আপনার পরিবারের সবাইকে খুঁজে পাবেন।’

ছেলেটা মৃদু চিৎকার করে বলল, ‘নাআআআ’

সায়েন মুখে আঙ্গুল দিয়ে বলল,’হুসসস চিৎকার করবেন না। পাশের রুমে ভাইয়া আছে। সে যদি জানতে পারে যে একটা অচেনা ছেলে তার বোনের রুমে আছে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

ছেলেটা মুখে আঙ্গুল দিয়ে মাথা নেড়ে চুপ হয়ে গেল। সায়েন বলল,’আপনার ছবি ফেসবুকে দিবো না কেন??’ বলেই সায়েন ভ্রুকুটি করে ছেলেটার দিকে তাকালো। ছেলেটা অসহায় হয়ে বলল,’দেখুন সত্যি আমার কিছু মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে যে কতগুলো গুন্ডা আমাকে এটাক করেছিল। তাদের সাথে আমি পেরে উঠিনি। তাই ওরা আমার এই অবস্থা করেছে। আর কিছু মনে নেই আমার। আপনি যদি আমার ছবি ফেসবুকে দেন তো গুন্ডাগুলো আমার খোঁজ তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবে তার সাথে আপনার উপর ও এটাক করবে। এই বাড়িতে ও চলে আসতে পারে। আমি চাই না আমার জন্য আপনার ক্ষতি হোক!!তাই বলছি আমাকে কয়েকদিন থাকতে দিন।একটু সুস্থ হলেই আমার সব মনে পড়ে যাবে। তারপর না হয় চলে যাবো!!!’

ছেলেটা ধীরে ধীরে কথাগুলো বলল। সায়েন মাথা চুলকে ভাবতে লাগলো যে কথাগুলো তো সত্যি। ওই গুন্ডাগুলো যদি ওর উপর এটাক করে!!! ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসে সায়েনের। পুলিশ গুন্ডা সে খুব ভয় পায়। আর তাছাড়া ওর বাবা মা ভাইয়ের যদি কোন ক্ষতি হয় তখন কি হবে??কিন্তু এই ছেলেটাকে এই বাড়িতে রাখাটা রিক্সের ব্যাপার। মা তো কিছুতেই এখানে রাখবে না ছেলেটাকে। আর বাবা তো মায়ের কথায় ওঠে বসে। শাফিন তো শাফিনই। সায়েন ঠোঁট কামড়ে ভাবতে লাগলো কি করা যায়??সায়েনকে এভাবে চিন্তিত হতে দেখে ঠোঁট চেপে হাসলো ছেলেটা। সায়েন বলল, ‘ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আপনাকে আমার বাড়িতে কিভাবে রাখব?? আমার মা থাকতেই দেবে না। আমি মা’কে খুব ভয় পাই। শুধু আমি না ভাইয়া আর বাবাও। আমার মা আপনাকে এখানে থাকতে দেবে না।’

ছেলেটা কিছু একটা ভেবে বলল,’আমি বরং আপনার খাটের তলায় লুকিয়ে থাকব।’

সায়েন মাথা নাড়িয়ে বলল,’সেটা অসম্ভব। কারণ মা প্রতিদিন আমার খাটের তলা ঝাড়ু দেয়। আর আমার রুমটা তত বড় নয় যে আপনাকে কোথাও লুকিয়ে রাখব।’

‘আপনাদের এত বড় বাড়িতে কি এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আমাকে লুকিয়ে রাখা যায়??’

সায়েন কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর হঠাৎ করেই ওর কিছু একটা মনে পড়লো। সে বলল,’আছে। একটা জায়গা আছে যেখানে আপনি থাকলে কেউ বুঝতে পারবে না।’

ছেলেটার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বলল,’কোথায়??’

‘আমাদের ছাদে একটা চিলেকোঠার ঘর আছে। সেখানে আপনি থাকলে কেউ সন্দেহ করবে না।’

‘কেন??ছাদে কি কেউ যায় না??’

‘নাহ। আসলে ছোটবেলায় আমার ভাইয়া ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিল। ভাগ্য ভাল যে আমাদের বাড়ি ঘেঁষে একটা পেয়ারা গাছ ছিল সেটার সাথেই আটকে ছিল ভাইয়া। তাই হাত পা ভাঙা থেকে বেঁচে গেছে। তারপর থেকে বছরের পর বছর ধরে ছাদ সহ চিলেকোঠার ঘরও বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। কেউ ছাদে জামাকাপড় ও মেলতে যায় না। আমাদের বাড়ির সামনে যে উঠোন আছে সেখানে জামাকাপড় মেলে।’

ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে বলে,’বুঝলাম। তাহলে আমি ওখানেই থাকব।’

সায়েন মুখটা কাচুমাচু করে বলল,’তাহলে আপনি এখানে থাকুন আমি চিলেকোঠার ঘরটাকে মানুষ করে রেখে আসি।’

ছেলেটা টেবিলে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,’এখন রাত দুটো বাজে। এতো রাতে যাবেন??’

সায়েন মুখ বাঁকিয়ে বললো,’তাছাড়া কোন উপায় নেই। সকালের আলো ফোটার আগেই আপনাকে চিলেকোঠার ঘরে যেতে হবে। আপনি থাকুন আমি যাই।’
সায়েন বেরিয়ে যেতেই ছেলেটা হাসলো। তারপর পকেট থেকে ফোনটা বের করলো। ফোনটা এখনও ঠিক আছে। শুধু ফোনের গ্লাস ফেটে গেছে। সে তাড়াতাড়ি করে কাউকে ফোন করলো। ফোন রিসিভ হতেই বলল, ‘কিছু লোক আমার উপর এটাক করেছিল। তাড়াতাড়ি খবর নে কে বা কারা এসব করেছে।’

অপর পাশ থেকে কেউ কিছু বলল। ছেলেটা চটপট কিছু কথা বলে ফোনটা পকেটে পুরে রাখলো। সায়েনকে তার বোকা বোকা লাগছে। নাহলে এত তাড়াতাড়ি ছেলেটার কথাগুলো বিশ্বাস করে নিলো??এই ভেবে সে হাসলো। তবে সায়েনের চান্ঞ্চল্যতা ছেলেটাকে মুগ্ধ করেছে। সে ঠিক করেছে এখানেই সে থাকবে কিছুদিন। তার কাজ না হওয়া পর্যন্ত এখানে থাকতে হবে। সায়েনকে বোকা পেয়ে সে মানিয়ে নিয়েছে।

ঘড়ির কাঁটা সাড়ে তিনটার দিকে। সায়েন ফিরছে না দেখে ছেলেটা উঁকি দিচ্ছে দরজার দিকে। কিন্তু দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। কারেন্ট আসার নাম গন্ধ নেই এখনও। কিছুক্ষণ পরে সায়েন ফিরলো। সায়েনকে দেখে সে বলে উঠলো,’কি করলেন??’

সায়েন হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,’অনেক কিছু। আপনার জন্য এই রাত বিরতে ধুলো ময়লা মাখতে হয়েছে আমাকে।’ কথাগুলো বলতে বলতে জামাকাপড় ঝাড়লো সায়েন। তারপর ছেলেটার দিকে এগিয়ে এসে বলল,’চলুন চিলেকোঠার ঘরে। হাঁটতে পারবেন তো!!’

ছেলেটা খাটের উপর থেকে পা নামিয়ে দিলো মেঝেতে তারপর বলল,’আমাকে একটু সাহায্য করুন তাহলে পারব।’

সায়েন ছেলেটার হাত ধরে আস্তে আস্তে ছাদে নিয়ে গেলো। চিলেকোঠার ঘর দেখে ছেলেটা অবাক। এরকম ঘরে মানুষ কেন কোন জংলি পশুও থাকবে না। কিন্তু আফসোস এখন তাকে এখানে থাকতেই হবে। সায়েন পুরো ঘরটা পরিস্কার করতে পারেনি। এতো সময় তার নেই। শুধু মেঝে পরিষ্কার করে সেখানে তোশক বিছিয়েছে। ছেলেটাকে তোশকের উপর বসিয়ে দিয়ে বলল,’এখন থেকে এখানেই থাকবেন। ভুলেও বের হবেন না। অবশ্য আমি বাইরে থেকে দরজা আটকে দিয়ে যাব। ছাদের দরজায় তালা দেওয়া থাকবে।’
ছেলেটা শুধু সায়েনের কথা শুনলো কিন্তু কিছু বলল না। সায়েন ফিরে যেতে নিয়ে আবার ঘুরে তাকিয়ে বলে,’এই যে শুনুন। ধ্যাত এসব কি বলছি!! আপনার নামটা মনে করার চেষ্টা করুন না??’

ছেলেটা আবার ঠোঁট উল্টে জবাব দেয়,’সত্যি আমার নামটাও মনে পড়ছে না। আপনি একটা নাম ঠিক করে দিন। তাহলেই হবে।’

‘বয়েই গেছে আপনার নাম ঠিক করতে। আপনার চক্করে পড়ে আমি নিজের নাম ভুলতে বসেছি। নিজের নাম নিজে ঠিক করে নিন। আর হ্যা কিছুর দরকার হলে আমাকে ডাকবেন।’

‘কিন্তু কিভাবে ডাকব?? আপনার মা বাবা ভাই তো বাসায় থাকবে সবসময়।’

সায়েন মাথা চুলকে বলল,’তাই তো!!এক কাজ করুন। যখন আপনার কিছু প্রয়োজন হবে তখন কোকিলের কন্ঠে ডাকবেন। তাহলেই আমি যেকোন উপায়ে চলে আসব। কেমন??’
ছেলেটা মাথা দোলাতেই সায়েন বের হয়ে যায়। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যায়। আর ছাদের দরজায় তালা মেরে চাবি কঙ্খিত স্থানে রেখে জামাকাপড় পাল্টে ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু একটা ভয় মনে গেথেই রয়েছে সায়েনের। একে তো মায়ের ভয় দ্বিতীয়ত ছেলেটার প্রতি মায়া। এসব ভাবতে ভাবতে সায়েন ঘুমিয়ে পড়ে।

সকালে দেরিতে ঘুম ভাঙে সায়েনের। শাফিন এসে টেনে না তুললে সায়েনের ঘুম ভাঙত না। দেরি করে ঘুমানোর জন্য এসব হয়েছে। ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসতেই দেখলো বাবা টেবিলে বসে খাচ্ছে। সায়েন চোখ বড়বড় করে তাকালো। তারমানে ওর বাবা মা এসে গেছে!! এবার তো কিচ্ছা খতম। ধরা পড়লেই শেষ। ওদিকে ছেলেটা চিলেকোঠার ঘরে কি করছে কে জানে??মা রান্না ঘর থেকে পরোটা নিয়ে এসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সায়েনের দিকে। সায়েন কয়েকটা ঢোক গিলে মেকি হাসি দিলো। জয়নব বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,’এতো দেরি হলো কেন ঘুম থেকে উঠতে??’

‘আসলে বৃষ্টি পড়েছিল তো তাই ঘুমটা একটু বেশি হয়ে গেছে। এরপর থেকে আর হবে না প্রমিস।’

বলতে বলতে সায়েন পরোটা ছিঁড়ে মুখে দিলো। কিন্তু চিবুতে পারলো না। কারণ কোকিলের কন্ঠে কুহু কুহু করে কেউ ডাকছে। সায়েন তব্দা মেরে বসে রইল।

#চলবে,,,,,,,,,,,,,