#বাড়ির_নাম_বৃষ্টিলেখা
#পর্ব-১৫
বৃষ্টি বাড়ি ফেরার সময় অঘটন ঘটালো। রিকশা থেকে পড়ে পা মচকে গেল। ওদিকে আবিরেরও বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এলো। দুজনেই বিছানায় শুয়ে দুটো দিন কাটালো। দুদিন পর আবিরের জ্বর একটু কমলে বৃষ্টির খোঁজ নিলো। দুলুকে জিজ্ঞেস করলো,
“ওই বাড়ির কী খবর রে আপা?”
দুলু মুখ টিপে বলল,
“বিশেষ একজনের খবর জানতে চাচ্ছিস নাকি ওই বাড়ির সবার?”
“বুঝতে যখন পারছো তখন ঢং করছো কেন?”
“তুই হেয়ালি করে জানতে চাইলি তাই।”
“এখন খবর জানলে বলো।”
“তুই খোঁজ নিয়ে আয়। দেখ ওই বাড়ি ঢুকতে পারিস কি না!”
“ঢুকতে না পারার কী আছে। ওদের বাড়ির লোকজন দলবল নিয়ে আমাদের বাড়ি আসছে আর আমি গেলে ঢুকতে পারব না!”
দুলু হাসলো। টুকুর মা আবিরদের বাড়িতে একদিনের বেশী থাকে নি। দ্বিতীয় বেলায় খেতে বসেই বলল,
“আবিরের মা তোমরা খাবারে অনেক বেশী ঝাল খাও। আমার কষ্ট হয়।”
আবিরের মা বুঝতে পারলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। তারপর চা খেতে গিয়ে বলল,
“আমাদের বাড়ি চায়ে লেবু পাতা দেয়া হয়। তাই তোমার চায়ে মজা পাই না।”
দুলু বলল, ফুপু তুমি বাড়ি চলে যাও। আমাদের কোনো কিছুই তোমাদের পছন্দ হবে না। টুকুর মা মুখ ভার করে রইলো। ভেবেছিল তাকে সাধতে কেউ আসবে। কেউ আসে নি। পলিন এসেছিল একবার। সেও সাধেনি বাড়ি যাবার জন্য। পরে নিজেই লাজ লজ্জা, রাগ ভুলে বাড়ি গেল। বাড়িতে ঢুকে গম্ভীর গলায় বলল,
“ওই মেয়েরে বলবা আমার সামনে যেন না পড়ে। এইটা আমার বাপ, ভাইয়ের বাড়ি। আমি এই বাড়িই থাকব। সে যেন আমার সামনে না পড়ে।”
***
টুকু বউ রেখে চলে গেল। প্রতি সপ্তাহে আসবে বলে গেছে। বৃষ্টি আর পলিন কে বলে গেল দেখে রাখতে। পলিন বলল,
“ভয় নাই টুকু ভাই৷ তোমার বউ কেউ নিয়ে যাবে না।”
টুকু লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল। পলিন সেটা দেখে হেসে ফেলল। বলল,
“বিয়েশাদি করেছো এখন একটু লজ্জা কম পাও। তুমি তো তোমার বউয়ের চেয়েও বেশী লাজুক।”
পলিনের কথা সত্যি। নিলুফার চটপটে মেয়ে। ক’দিনেই সবার সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলেছে। পলিনের সঙ্গে ভাব জমেছে বেশী। এছাড়া দাদী, রেনু, বৃষ্টির মা এদের সঙ্গেও খাতির জমাতে ব্যস্ত। রান্নাঘরের টুকটাক কাজেও সাহায্য করে। সবার জন্য সকালের চা’ও নিজে বানায়। শুধু শাশুড়ীর থেকে দূরে থাকে। তার সামনে খুব একটা পড়ে না।
****
আতিফ পলিন কে নিয়ে একটু চিন্তায় আছে। মেয়েটার পরীক্ষার আর ক’টা দিন বাকী। এবার যদি ফেল করে তাহলে লজ্জায় ওর মাথা কাটা যাবে। নিজের ভর্তি পরীক্ষার পড়ার টেনশন বাদ দিয়ে ও পলিন কে নিয়ে টেনশন করছে। আর পলিনের কোনো হেলদোল নেই। সে তার মতো বিন্দাস ঘুরেফিরে কাটাচ্ছে। পড়ার সময় রাজ্যের অজুহাত নিয়ে বসে।
আতিফের নতুন চিন্তার কারণ অবশ্য অন্যকিছু। আজ ও পলিন কে সিনেমা হল থেকে বেরোতে দেখেছে। সঙ্গে আরও দুটো মেয়ে আর ছেলে ছিলো। একটা ছেলের সঙ্গে পলিনের হেসে কথা বলাও ওর চোখ এড়ায় নি। তারপর থেকে টেনশন বেড়ে গেছে। এই মেয়ে আবার প্রেম করছে না তো! সরল সোজা টাইপ মেয়ে কোনো কিছু না ভেবে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েও যেতে পারে। তাতে ওর কিছু যায় আসে না যদিও। তবুও মাথা থেকে ব্যাপার টা ঝেড়ে ফেলতে পারছে না।
আতিফ সন্ধ্যেবেলা পড়াতে এসে পলিন কে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি আজ ক্লাস না করে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলে?”
পলিন সঙ্গে সঙ্গে অস্বীকার করলো। বলল,
“না।”
“তোমার কাকা স্কুলে থাকা অবস্থায়ও পালিয়ে সিনেমা দেখতে যাও! তোমার তো ভারী সাহস দেখছি।”
পলিন তোতলাতে তোতলাতে বলল, কই না তো। আমি স্কুলে ছিলাম।
“আমি দেখেছি।”
“অন্যকাউকে দেখেছেন।”
“তোমাকে চিনতে আমার ভুল হবে!”
পলিন চুপ করে রইলো। আতিফ জিজ্ঞেস করবে না ঠিক করেও, জিজ্ঞেস করলো,
“যে ছেলেটার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছিলে ও তোমার বন্ধু?”
“কোন ছেলেটা?”
“যাদের নিয়ে সিনেমায় গিয়েছিলে তাদের মধ্যে যার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছিলে। ”
“না বন্ধু না। আমার সঙ্গে একসাথে পড়ে। ওই তো সিনেমা দেখালো।”
“আচ্ছা। বন্ধু না তবুও সিনেমা দেখতে গেলে!’
“কেন তাতে কী!’
“কিছু না। বই বের করো।”
পড়ানোর পুরো সময় টা আতিফ চুপ করে রইলো। পড়ার বাইরে পলিনও কোনো কথা বলল না।
যাবার আগে বলল,
“বাড়ির কেউ জানে যে তুমি এভাবে সিনেমা দেখতে যাও?”
পলিন মাথা নেড়ে না বলল।
“বুবুও জানে না?”
পলিন আবারও না সূচক মাথা নাড়লো।
আতিফ আর কিছু বলল না। চলে গেল। আতিফ যেতেই পলিনের ভয় লাগতে শুরু করলো। এই ছেলে আবার বাড়ির লোক কে বলে দিবে না তো! বললে তো পলিনের আষাঢ় মাসেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। পৌষ মাস অবধি অপেক্ষা করতে হবে না।
***
আবির সাহস করে বৃষ্টিদের বাড়ি এলো। বৃষ্টির মা বলল,
“বৃষ্টি, পলু ওরা ঘরে আছে। দেখে আয়। ”
ব্যস! আবির কে আর কে পায়! এই বাড়ির সব ঘরে আসা হলেও এই ঘরে আসা হয় নি। পলিন পড়ছিলো। আবির কে দেখে বলল,
“একি তুমি রাতের বেলা?”
আবির বিরসমুখে বলল,
“রোগী দেখতে চলে এলাম। ”
বৃষ্টি বিছানায় বসা ছিলো। হাতে একটা গল্পের বই। আবির কে দেখে নড়েচড়ে বসলো। পলিন বলল,
“তা রোগী দেখতে এসেছো খালি হাতে? কিছু নিয়ে আসো নি?”
আবির লজ্জায় পড়ে গেল। এই পলিন টা সবসময় ও’কে অপ্রস্তুত করে।
বৃষ্টি এতক্ষনে মুখ খুলল। বলল,
“পলু তুই কী থামবি।”
পলিন চুপ করতেই আবির বলল,
“তোর কী অবস্থা? রিকশা থেকে ঝাপ দিয়ে মরতে গেছিলি শুনলাম?”
বৃষ্টি উত্তর দেবার আগেই পলিন বলল,
“বুবু মরতে যাবে কিসের দুঃখে। ওর বিরহ কিসের!”
আবির বলল, এই যা৷ কিছু খাবার, দাবার নিয়ে আয়। অতিথি আপ্যায়ন শিখিস নি! তোর শ্বশুর বাড়ি গেলেও তো এমন না খাইয়ে রাখবি!
পলিন মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“বললেই হয় যে বুবুর সঙ্গে তোমার ব্যক্তিগত কথা আছে।”
আবির মারমুখী হয়ে উঠে বলল, ওরে ফাজিল দাঁড়া। এই বয়সে ব্যক্তিগত কথা শিখে গেছিস!
পলিন চলে গেল।
পলিন যেতেই বৃষ্টি বলল,
“কেন এসেছো?”
“তোকে দেখতে।”
“আচ্ছা। দেখা হয়ে গেলে বিদায় হও।”
আবির হেসে ফেলল। বলল,
“রাগলে তোকে এক রকম লাগে। আর অভিমান করলে আরেক রকম।”
“ফালতু কথা শেষ হলে বিদায় হও। আর শোনো, তুমি হয়তো ভেবে বসে আছো যে কথা দিয়ে আমাকে দূর্বল করবে। সেটা ভেবে থাকলে ভুল করছো। ”
আবির আবারও হাসলো। বলল,
“তুই যে দূর্বল হবার মেয়ে না সেটা আমি আগেই জানি। দূর্বল হলে আমার চোখের পানি দেখেই দূর্বল হতি।”
বৃষ্টি অন্যদিকে তাকানো ছিলো। আবিরের কথায় ওর দিকে তাকালো। আবির ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যথার জায়গা টা এখনো ফুলে আছে। আবির আলতো করে ছুঁতে গেলে বৃষ্টি পা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো।
বৃষ্টি গলার স্বর খানিকটা রুক্ষ করে বলল,
“আবির ভাই বাড়ি যাও।”
“তোদের বাড়ি থাকতে আসি নি। এতো যাও যাও করিস না।”
বৃষ্টি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। আবির বলল,
“তুই ওদিকে তাকিয়ে আছিস কেন! নিচে কী তোর শ্বশুরের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে?”
“তুমি আমার দিকে তাকিয়ে আছো তাই। ”
আবির আবারও হেসে ফেলল। বলল,
“বৃষ্টি শোন, ইগোর দেয়াল ভেঙে ফেলার সময় এখন এসেছে। অনেক তো হলো! আর কতো! ”
বৃষ্টি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো। আবির বলল,
“বুঝতে পারছিস না?”
বৃষ্টি জবাব দিলো না। আবির বলল,
“এই দুদিন তোর খোঁজ নিতে একবারও আসিনি বলে তুই তোর ভাইবোন কে দিয়ে আমার খোঁজ নিয়েছিস তারপরও বলবি আমার কোনো গুরুত্ব নেই তোর জীবনে!
বৃষ্টি চোখের দৃষ্টি আড়াল করলো। আবির নিঃশব্দে হাসলো।
চলবে…..