#বিকেলের_শেষ_আলো
#লেখনীতে_নূরকথা
#পর্ব_১
বাসর ঘরে নয় মনে হচ্ছে যেন জেলখানায় বসে আছি। শ্বশুর নেই‚ তিনি নাকি অনেক আগেই গত হয়েছেন। তাই নির্লজ্জের মতো জামাইয়ের বাড়িই বলতে হবে। নির্লজ্জ বলছি কারণ আমি কখনো আমার আম্মু‚ দাদী‚ নানীকে জামাইয়ের বাড়ি বলতে শুনিনি। আসলে ছোটোবেলা থেকেই একটা কথা শুনে বড়ো হয়েছি‚ স্বামীর নাম মুখে আনতে নেই। কী জানি এমন অদ্ভুত কথা কে বের করলো! তবে আমি তাদের মতো এমন আজব কথাটথা মানতে বড্ড নারাজ।
অন্য সব মেয়েদের গা ভর্তি গহনা থাকে আর আমার গা জড়িয়ে আছে কালো বোরকা‚ নিকাব আর মোজা। আমি ধার্মিক পরিবারের মেয়ে। পর্দার আড়ালেই জীবন কেটেছে। তবে পুরোপুরি পর্দা করা শুরু হয়েছিল অনার্স পড়াকালীন। ইচ্ছে ছিল ধার্মিক কোনো পরিবারেই বউ হয়ে আসবো। হলোও তাই। কিন্তু শুনেছি আমার জামাই এবং তার পরিবার আমাদের চেয়েও অনেক বেশি ধার্মিক। তাই পর্দা নিয়ে কড়াকড়ি অনেক বেশিই। কিন্তু তা বলে বাসর ঘরেও বোরকা পরে থাকবো! এখানে তো নন মারহাম কেউ নেই। তাহলে কেন একজনও এলো না আমাকে পোশাক বদলে সহযোগিতা করতে? এমন প্রশ্ন করতে মনে পড়লো আমার জামাই নাকি একমাত্র ছেলে। তার কোনো ভাইবোন নেই।
দরজায় শব্দ হলো। নিশ্চয়ই কেউ ঘরে ঢুকছে। আমি একটু নড়েচড়ে বসে ধীরে ধীরে চোখ তুলে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার আগেই শুনতে পেলাম‚ “যতক্ষণ না অনুমতি দিবো‚ ততক্ষণ আমার দিকে তাকাবেন না।”
মানে কী! এটা আবার কেমন কথা? বোঝা যাচ্ছে ইনি আমার সদ্য বিয়ে করা স্বামী যেহেতু বাসর ঘরে প্রবেশ করেছেন। আমি তার পেট অবধি দেখতে পেয়েছিলাম; শেরওয়ানি পরা। তাই আন্দাজ করতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু এমন শর্ত দেওয়ার মানে ঠাওর করতে পারলাম না।
বিছানার ওপর এক সেট কাপড়চোপড় রেখে বললেন‚ “পোশাক বদলে ওযু করে আসুন।”
“কিন্তু আমি তাকাবো না কেন?” প্রশ্নটা না করে পারছিলাম না। আর আমি একটু বাচাল টাইপের মেয়ে; ঠোঁট কা*টা স্বভাবের— এ নিয়ে এতগুলো বছর সবার যে কত অভিযোগ শুনেছি!
আমার বান্ধবী সুবর্ণা তো একবার সবার সামনেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল‚ “তোর মুখে কি জীবনেও মধু পড়েনি?” সত্যি বলতে মধু তেমন পড়েনি কারণ মিষ্টি জাতীয় খাবার আমার দুই চোখে বিষের মতো লাগে অথচ হাস্যকর ব্যাপার হলো আমার নাম মিষ্টি।
“বিয়ের আগে ছবি পাঠানোর পর যখন দেখেননি। তাহলে এখন আমি অনুমতি না দিলে দেখা নিষেধ।” বিয়ের আগে সত্যিই আমাকে পাত্রের ছবি দেখানোর চেষ্টা চলেছিল। আম্মু নিজে পাত্রের ছবি নিয়ে বলেছিলেন‚ “আমাদের সবার তো মাশাআল্লাহ পছন্দ হয়েছে। তুমিও একবার দেখে নাও। শরিয়ত মতে পাত্র পাত্রী বিয়ে আগে নিজেদের দেখেশুনে নেওয়ার বিধান আছে। সমস্যা হবে না।” কিন্তু না। আমি তো মহা পন্ডিত। তাই মহান হতে আর বিজ্ঞের পরিচয় দিতে বলেছিলাম‚ “না আম্মু। তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ। আমার কোনো আপত্তি নেই।” এখন এসব মনে পড়তেই ইচ্ছে করছে নিজে গালে ঠাস করে দুটো চ*ড় দিতে।
কথা বাড়ালাম না। ভেতরে ভেতরে আমার যৎসামান্য রাগ হচ্ছে। নিঃশব্দে কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লাম।
ফুল হাতার কালো রঙের সালোয়ার কামিজ। চুমকি বসানো খুব সুন্দর একটা ওড়না। কিছুক্ষণ এগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে রাগটা কেমন মিইয়ে গেল কারণ কালো রঙ আমার ভীষণ পছন্দের।
ওযু করে বের হতেই শুনতে পেলাম‚ “এবার বিছানায় বসুন। আপনার সাথে কিছু কথা আছে। কিন্তু আমার দিকে তাকাবেন না আর আমি কথা শেষ না করা পর্যন্ত আমাকে কোনো প্রশ্ন করবেন না।”
“ঠিক আছে। কিন্তু কথা শেষ হলে কি প্রশ্ন করতে পারি?” ওয়াশরুমের বাইরে দাঁড়িয়েই প্রশ্নটা করলাম। আসলে তাকে দেখার জন্য বড্ড ছটফট লাগছে। আবার আমি বেশিক্ষণ চুপ করেও থাকতে পারি না। কথা বলতে আমার অনেক ভালো লাগে অথচ আমাদের ধর্ম বলে‚ নীরবতাও পুণ্যের কাজ। কিন্তু আমি যে হাজার চেষ্টায়ও চুপ থাকতে পারি না।
“আগে বিছানায় এসে বসুন।” গলার স্বরে একটু যেন গম্ভীরতা ভেসে উঠলো। কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ বিছানায় গিয়ে বসে পড়লাম।
একটু দূরত্ব রেখে তিনিও বিছানায় বসলেন। এরপর বলতে শুরু করলেন‚ “আমি জানি আপনি ধার্মিক মেয়ে‚ পর্দা করেন। তবে চাইবো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলার প্রতি আপনার আনুগত্য আরও বাড়ুক। একটু বেশি কথা বলেন যদিও তবে সমস্যা নেই। মধুর কণ্ঠের অযথা বকবক শুনতে আমার ভালো লাগে।” এটা প্রশংসা ছিল নাকি অপমান? যাই হোক‚ আমি চুপচাপ শুনে যাচ্ছি‚ “শুধু ইহকালে স্ত্রী হিসাবে পেতে আমি আপনাকে বিয়ে করিনি। পরকালেও আপনাকেই চাই। কারণ গত চার বছর ধরে আমি আপনাকে বউ হিসাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলার কাছে চেয়ে এসেছি।”
“চার বছর! মানে? চার বছর ধরে কীভাবে?” আমি প্রশ্ন না করে পারলাম না। তিনি নিষেধ করা সত্ত্বেও আমি প্রশ্ন করলাম। তবে রাগ না হয়ে তিনি বললেন‚ “কথার মাঝে বাঁধা দিলে কীভাবে বলবো যে চার বছর না আট বছর? আপনাকে তো বলেছি‚ আমার কথার মাঝে কথা বলবেন না।”
“কিন্তু এত ভণিতা আমার ভালো লাগছে না।” একটুখানি বিরক্ত প্রকাশ করলাম।
“বাসর ঘরে কি আপনার সাথে ঝগড়া করবো? এখানে ঝগড়া করতে বসেছি?” কাঠ কাঠ গলায় প্রশ্ন করলেন। আমি কি দমে যাওয়ার মতো মেয়ে নাকি? বাসর ঘর বলে মিনি বেড়াল হয়ে থাকতে হবে? অসম্ভব!
“ঝগড়া করার কথা আসবে কেন? আপনি সোজাসাপ্টা কথা না বলে আমার কৌতূহল বাড়াচ্ছেন। এরপর চেহারা দেখতেও মানা করেছেন। আমার ধৈর্যশক্তি ভীষণ কম। আর ঘুমও পাচ্ছে।” বেশ দায়সারা ভাব নিয়ে আমি কথাগুলো বললাম।
“আপনার মাথায় কি আগেই সমস্যা ছিল নাকি আমার সাথে বিয়ে হওয়ার জন্য সমস্যা শুরু হলো? চুপচাপ আমার কথা কি শুনবেন? নাকি আপনার হাত পা আর মুখ বেঁধে এরপর কথা শোনাবো? ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি কী করলেন! না‚ ইকোনমিকস নিয়ে অনার্স করবেন।” পরিহাসের সুর পেলাম তার কথায়।
“আমার ইকোনমিকসে অর্নাস করা নিয়ে আপনার সমস্যা কোথায়? আর আমি তো আপনাকে ম্যানেজমেন্ট নিয়ে অর্নাস করতে মানা করিনি। মানা করবো কীভাবে? বিয়ে হওয়ার পরও যার চেহারা দেখিনি তাকে চার বছর আগে কীভাবে ম্যানেজমেন্টে অনার্স করতে মানা করবো?” আমি তার কোনো কথাই বুঝতে পারছি না। কীসব বলছে আল্লাহ তাআলা ভালো জানেন। এদিকে আমার সত্যি খুব ঘুম পেয়েছে।
“বিয়ের আগে আপনি আমাকে দেখেননি?”
“না। আম্মু ছবি নিয়ে গিয়েছিল। আমি মানা করে দিয়েছিলাম। আপনি তো জানেন যে আমি আপনাকে না দেখেই বিয়ে করেছি।”
“জি না। আপনি আমাকে গত বছর ধরে চোখ দিয়ে গিলে খেয়েছেন। এত পরিমাণ দেখেছেন যে বাকি জীবন না দেখলেও চলবে।”
“নাউজুবিল্লাহ! এ কেমন ব্যবহার আপনার? সদ্য বিয়ে করা বউয়ের সাথে মুমিন বান্দা এমন করে কথা বলে!”
“জ্ঞান দিবেন না। বুঝেছি‚ আপনার সাথে মিষ্টি মিষ্টি সংসার করা আমার দ্বারা হবে না। একে তো বাচাল তারপর তেঁতো ছেয়ে আছে কথাবার্তায়। অ্যাই আপনার নাম মিষ্টি কে রাখলো বলুন তো। আমার এত সুন্দর একটা মুড আলহামদুলিল্লাহ ছিল। কত কিছু সাজিয়ে রেখেছিলাম আজকের রাতের জন্য। কিন্তু আপনি?”
“আমি কী? সেই কখন থেকে চোখ আর মাথা নামিয়ে রেখে ঘাড় ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। আর আপনি আমার সাথে এমন ব্যবহার করছেন! কী করেছি আমি? একটু প্রশ্ন করেছি বলে এত কথা শোনাচ্ছেন? মিষ্টি মিষ্টি সংসার করা হবে না মানে কী?”
আচমকা তিনি আমার চিবুক আলতো করে উপরে তুলে বললেন‚ “মিষ্টির সাথে মিষ্টি সংসার করলে ডায়াবেটিস হয়ে যাবে। ঝাল ঝাল সংসার করতে হবে; ২৪ ঘন্টার মধ্যে সাড়ে ২৩ ঘন্টা কথা কা*টাকা*টি আর আধঘন্টা ‘বউ তোমাকে ভালোবাসি’।”
“একি! আপনি এখানে?”
……….চলবে কি?